মেহেরজান পর্ব ১৮

মেহেরজান পর্ব ১৮
লেখনীতে- সোহা

সকাল থেকেই ঝিরিঝিরি বৃষ্টি পড়ছে আজ। তবে এখন আবার মেঘে গর্জন হচ্ছে।বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে।শুক্রবার দিন হওয়ায় বাড়িতে আজ সবাই আছে।বৃষ্টির দিনে খিচুড়ি খাওয়ার মজায় আলাদা। আর সেটা যদি হয় উর্মিলা বেগমের হাতের তৈরি তাহলে তো কোনো কথায় নেই।বাড়ির ছেলেমেয়েদের জন্য আজ নিজ হাতে ভুনা খিচুড়ি রান্নার পরিকল্পনা করেছেন উর্মিলা।বাইরে মেঘ ডাকছে আর বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে এদিকে দোতলায় বসার ঘরে বাড়ির ছেলেমেয়েরা সবাই মিলে লুডু খেলায় মেতে রয়েছে। রাউশি সোফায় গুটিশুটি মেরে শুয়ে আছে আর বাকিরা খেলায় মত্ত।তখনই রাউশির চোখ যায় মেহরানের রুমের দিকে।মেহরান দরজায় হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে দৃষ্টি তার দিকেই।রাউশি তড়িৎ বেগে উঠে বসলো। ভালোভাবে বসে খেয়াল করলো মেহরান তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তারই দিকে তাকিয়ে।রাউশি বিড়বিড় করে বলল,

“কি তীক্ষ্ণ চাহনী।”
“একদম শকুনের মতো।” পাশ থেকে উজান কথাটা বললো।খেলায় হেরে যাওয়াতে রাউশির পাশে এসে বসেছে ছেলেটা।উজানের কথা শুনে তার দিকে ফিরে তাকালো রাউশি।উজান দাত কেলিয়ে হাসলো।রাউশি উজানকে পেয়ে জিজ্ঞাসা করলো,
“আচ্ছা উজান ভাই,এই মেহরান সবসময় গোমরামুখো হয়ে কেন থাকে?আর রাগ রাগ ভাব তো আছেই।মেহরান মানুষ নাকি ভিনগ্রহ থেকে পৃথিবীতে আছড়ে পড়া কোনো প্রাণী?”
“কি বললি?ভাইকে নাম ভিনগ্রহের প্রাণী বললি আর নাম ধরে ডাকলি?”
“হ্যা ডেকেছি, তো কি হয়েছে?”

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

“দাড়া ভাইকে বলে দিচ্ছি তুই ভাইকে ভিনগ্রহের প্রাণী বলেছিস।”
“বলো মেহরান আমায় কিছুই বলবে না।”
উজান কি যেনো ভাবলো।তারপর বাঁকা হেসে বলল,
“এটা বললে নিশ্চিত সিরিয়াস হবে, যে তুই ভাইকে নাম ধরে ডাকছিস যাতে অভ্যাস হয়ে যায়।অর্থাৎ তুই ভাইকে বিয়ে করতে চাইছিস।”
রাউশি চোখ বড় বড় করে তাকালো।এ বলে কি?এমন মনোভাব আপাতত মাথায় আনে নি রাউশি।আর উজান কিনা বিয়ে পর্যন্ত গেলো।রাউশি মেহরানকে ভাই বলে ডাকতে সাচ্ছন্দ্যবোধ করে না।নাম ধরে ডাকতেই যেন তার ভালো লাগে।উজান দাত কেলিয়ে হেসে বলল,

“দাড়া ভাইকে বলি।”
উজান উঠতেই যাবে এর আগেই রাউশি উজানকে থামিয়ে দিয়ে বলে,
“এই না না ভাইয়া এটা বলো না।”
“না আমি তো বলেই ছাড়বো।”
“উজান ভাই প্লিজ এমনটা করো না।”
“ঠিক আছে বলবো না তবে একটা শর্ত আছে।”
রাউশি ভ্রু কুঁচকে তাকাতেই উজান রাউশির পাশে বসে বলল,
“সিলেট তো আজ বিকেলেই যাচ্ছি।আসলে সিলেটে আমার খুব পছন্দের কিছু একটা আছে।যা সম্পর্কে ভাই জেনে গেছে।এখন আমি চাইছি ভাইকে তুই বোঝা।”
“কিইই আমি?”

উজান মাথা উপর নিচ তুলে বোঝালো হ্যা। রাউশি মেহরানের দিকে একবার তাকালো। মানুষটা এখন ফোনে কথা বলছে।মুখে গম্ভীর ভাবটা এখনও রয়েছে।নিশ্চয় উজানের বিষয়টা জানতে পেরে নাকোচ করে দিয়েছে।এখন এই বিষয়েই যদি আবার রাউশি কিছু বলে তো কাঁচা চিবিয়ে খাবে। মাথা নাড়িয়ে না বোঝাতেই উজান মেহরানকে বলে দেবে বলে উঠে দাড়াতেই রাউশি সম্মতি জানালো।উজান তো মহাখুশি।মেহরান দূর থেকে রাউশি আর উজানকে কথা বলতে দেখে কাছে এগোয়। উজানের পাশে গিয়ে বসতেই উজান উঠে দাঁড়ায়।কারণ সে রাউশি আর মেহরানের ঠিক মাঝখানেই বসে ছিলো।মেহরান ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞাসা করলো,

“সমস্যা কি?”
উজান উত্তরে বলল,
“আমি তোমাদের কপোত-কপোতীর মাঝে বসে থাকতে পারবো না।”
বাকিরা একটু দূরে ছিলো আর খেলাতে এতটাই মত্ত ছিলো শুনলো না এদের কথাবার্তা।উজানের কথাটা শুনে রাউশি কেঁশে উঠলো।চোখ রাঙিয়ে উজানের দিকে তাকাতেই পাশে তাকিয়ে দেখে মেহরানের ঠোঁটের কোণে ক্ষীণ হাসি।রাউশি ভালোভাবে তাকাতেই মেহরান একদম স্বাভাবিক হয়ে যায়।উজান সেখান থেকে চলে যেতেই মেহরান আয়েশী ভঙ্গিতে বসে। রাউশি উশখুশ করছে।উঠে যেতেও পারছে না আবার বসে থাকতেও পারছে না।কি একটা বিপদ।তানিয়া আর মাইশাকে ইশারায় ডাকতে চাইলো।হিশ হিশ শব্দ করলো।রাউশির এমন কাজে মেহরান গম্ভীরভাবে প্রশ্ন করলো,

“টয়লেটে পেয়েছে তো চুপচাপ যা।এভাবে বসে বসে হিশ হিশ করছিস কেন?”
এমন কথায় রাউশি লজ্জা পেলো খানিক। এদিকে সামনে খেলায় মত্ত সবাই তাকালো পেছনে।তাজবির এগিয়ে এলো রাউশির দিকে।মেহরানের দিকে তাকিয়ে রাউশির দিকে তাকিয়ে বলল,
“এই রাউশিপু মেহরান ভাইয়া কি তোমায় বকছে?”

রাউশি তাজবিরের দিকে তাকালো।মেহরান এক ভ্রু উঁচিয়ে তাকিয়ে আছে দুজনের দিকে।রাউশি আড়চোখে মেহরানের দিকে তাকিয়ে এখান থেকে কেটে পড়তে সুযোগ পেয়ে কথা ঘুরিয়ে বলল,
“চল তাজবির আমার রুমে যাই।তোকে আমার ফোনে গেম খেলতে দেব।”
তাজবির খুশিতে মাথা নাড়ালো অনেকবার। ছেলেটা ফোনে এতো গেইম খেলতে পারে। তবে তখনই রূপা বেগম উপরে উঠে এসে বলল,
“এই তোরা এখনও এখানে বসে খেলছিস? খাবি কখন?তাড়াতাড়ি আয়।বেলা গড়াচ্ছে। আরেকটু পর তো রওনা দিতে হবে।”

মায়ের কথাটা শেষ হতে না হতে রাউশি তাজবিরের হাত ধরে মা’কে পাশ কাটিয়ে নিচে নেমে গেলো।মেয়ের এমন কাজে কপাল কুঁচকালো রূপা বেগম।বাকিরাও ধীরে ধীরে নামতে লাগলো।মেহরান সোফা থেকে উঠে নিজের রুমে হাটা ধরতেই রূপা বেগম জিজ্ঞাসা করলেন,
“মেহরান বাবা, তুমিও এসো।”
মেহরান থামলো। রূপা বেগমকে বলল,

“মেজো মা আমার এখন একটু কাজ আছে।তুমি বরং কাউকে দিয়ে আমার খাবারটা পাঠিয়ে দাও।”
রূপা বেগমও মাথা নাড়িয়ে চলে গেলেন। মেহরান নিজের রুমে ঢুকে গেলো।নিচে হৈ-হুল্লোড় পড়ে গেছে ছেলেমেয়েগুলোর। বাড়ির কর্তারা নেই তাই এতো চিল্লাফাল্লা করছে আজ।মাইশা চেয়ার টেনে ধরতেই তানজিম সেই চেয়ারে বসে পড়ে।মাইশা রেগে যায়।তানজিমের মাথার চুল টেনে দিয়ে রাউশির পাশে গিয়ে বসে পড়ে। নাহিন প্লেটে গরম গরম খিচুড়ি আর ইলিশ মাছ ভাজা নিয়ে গপাগপ খাওয়া শুরু করে দিয়েছে অলরেডি।এটা দেখে তানজিম বলল,

“শালা আস্তে আস্তে খা।রাক্ষসের মতো এভাবে খাচ্ছিস কেন?যেন কত বছরের অভুক্ত তুই।”
নাহিন খেতে খেতেই রোকসানা বেগমকে বলল,
“ছোট চাচী দেখো তোমার ছেলে আমায় কিসব বলছে।আমি বছরে একবার এসে এমন চান্স পেয়ে থাকি আর তোমার ছেলে আমার সাথে দূর্ব্যবহার করে।”
রোকসানা বেগম তানজিমকে ধমকে বললেন,
“এই তানজিম ছেলেটা একদিন মাত্র আসে। এভাবে এসব কি বলিস?চুপচাপ খা নয়তো চলে যা।”
তারপর নাহিনের দিকে তাকিয়ে বলল,
“বাবা তুই তোর ইচ্ছেমতো খা।”

নাহিন বিজয়ের হাসি হাসলো।উজান নাহিনের কাঁধে চাপড় মেরে বলল,
“তোর মতো এতো গাধা আমি আমার জীবনে আরেকটা দেখিনি।”
খাবার মুখে নিয়েই উজানের দিকে তাকালো নাহিন।চোখ দিয়ে প্রশ্ন করলো কি গাধামি করেছে সে।উজান নিজের প্লেটে খিচুড়ি নিয়ে বলল,
“কিছুদিন পর বুঝতে পারবি।”
নাহিন পাত্তা না দিয়ে খাওয়া শুরু করলো আবারও।রূপা বেগম অন্য একটি প্লেটে খাবার সাজিয়ে গুছিয়ে দিচ্ছিলো উর্মিলা বেগম এসে জিজ্ঞাসা করেন,
“এটা কার জন্য?”
“মেহরানের জন্য আপা।”
“এই ছেলেটা না কি যে করে?”

রূপা বেগম প্লেট হাতে নিয়ে যেতে নিলে উর্মিলা বেগম কিছু একটা মনে করে বলেন,
“খাবার বেশি করে দে রূপা।আর রাউশিকে দিয়ে পাঠিয়ে দিস।”
রূপা বেগম বিষয়টা স্বাভাবিকভাবে নিলেও উর্মিলা বেগম চক্ষু হাসলেন।রাউশি নিজের প্লেটে খাবার নিয়ে সবে এক লোকমা মুখে তোলার জন্য রেডি হচ্ছিলো সে সময় রূপা বেগম এসে বললেন,
“যা তো রাউ মা এটা মেহরানকে দিয়ে আয়।”
রাউশি ঠোঁটে ঠোঁট চেপে দাতে দাত পিষে মায়ের দিকে তাকালো।রূপা বেগম চোখ দিয়ে ইশারা করলেন যেতে।রাগে হাতের লোকমাটা প্লেটে জোর দিয়ে ফেলে দিলো। যার দরুণ সেখান থেকে কিছু ভাত নাহিনের মুখে গিয়ে লাগলো।নাহিন ওর পাশেই বসে ছিলো।নাহিন এটা দেখে ক্ষেপে গেলো।বলল,

“পুরো প্লেটটাই মুখে ছুড়ে মার আমায়।”
রাউশি উঠে দাঁড়িয়ে নাহিনের পায়ে নিজের পা দিয়ে আঘাত করলো।নাহিন চেঁচিয়ে উঠলো।রাউশি মায়ের হাত থেকে ট্রে-টা হাতে নিয়ে ধুপধাপ পা ফেলে উপরে উঠে গেলো।উর্মিলা বেগম মনে মনে হাসলেন।রূপা বেগম নাহিনের দিকে টিস্যু এগিয়ে দিলেন আর বললেন,
“এই মেয়েকে নিয়ে আর পারি না।”
উপরে এসে মেহরানের রুমের সামনে এসে দাড়ালো।ট্রে-তে থাকা খাবারগুলোর দিকে একবার তাকালো।খিচুড়ি একপ্লেট,সাদা ভাতও একপ্লেট,একটা বাটিতে গরুর গোস্ত ভুনা, ইলিশ মাছ ভাজা আর অমলেট। মুখ ভেংচালো রাউশি।এতো খাবার খাবে কিভাবে এই লোক?রাক্ষসের বাপ নাকি? দরজায় নক করতেই ভেতর থেকে উচ্চৈস্বরে আওয়াজ এলো,

“দরজা খোলা আছে।”
রাউশি দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকতেই দেখে মেহরান বারান্দার সামনে দাঁড়িয়ে ফোনে কথা বলছে।রাউশিকে দেখেনি এখনও। রাউশি খাবারের ট্রে-টা খাটের পাশে সেন্টার টেবিলে রেখে চলে যেতে নিলে পেছন থেকে মেহরান বলল,
“দাড়া।”
রাউশি হাটা থামিয়ে দিলো।পেছনে ফিরে দেখলো মেহরান তার দিকেই তাকিয়ে আছে।মেহরান সোফায় বসে বলল,
“আমি কি যেতে বলেছি?”

রাউশি সেখানেই সং সেজে দাড়িয়ে রইলো। মেহরান কাউকে ফোন দিয়ে আবারও কথা বলতে শুরু করলো।সেসব কানে নিচ্ছে না রাউশি।পেটে যে তার খিদা জলন্ত আগুনের মতো পুড়িয়ে দিচ্ছে সব।কথা বলার সময় রাউশিকে এভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে চোখ দিয়ে ইশারা করলো বসার জন্য।রাউশি মেহরানের দিকে তাকিয়ে থাকায় ইশারাটা বুঝলো।না চাইতেও বসলো খাটের ওপর । মেহরান কল কেটে দিয়ে ফোন টেবিলের ওপর রেখে হাত উঁচিয়ে আড়মোড়া ভাঙলো।রাউশি আড়চোখে দেখলো সেসব।মেহরান উঠে এসে খাটের ওপর বসে রাউশির দিকে তাকিয়ে গম্ভীরভাবে বলল,

“আমার হাত ব্যথা খাইয়ে দে আমায়।”
রাউশি আকাশ থেকে পড়লো।এই লোক বলে কি?খাবার যে এনে দিয়েছে এটাই অনেক।আবার খাইয়ে দেবে এসব কেমন কথা?রাউশি না বলতেই যাবে তার আগেই মেহরান বলল,
“কিছুদিন পর থেকে নিত্যদিনের কাজ হবে এটা।তাই আগে থেকেই অভ্যাস থাকা অতি জরুরি।”
রাউশি রাগ করে বলল,
“আপনার হাত তো ঠিক আছে।”
“মুখের ওপর কথা বলছিস?”
“এমন কিছুই না।”
“তাহলে কি বলছিস এসব?”
“জানি না।”
“খাইয়ে দে।”
“পারবোনা।”
“তাহলে গালে একটা চুমু দে।”
“পারবোনা।”

উত্তর দেওয়ার পরই রাউশি বুঝতে পারলো মেহরানের কথাটা।বিস্মিত হয়ে তাকালো মেহরানের দিকে।মেহরান তার দিকেই একদৃষ্টে তাকিয়ে।রাউশি উঠে দাড়ালো। লজ্জা পেয়ে উঠে চলে যেতে নিলেই মেহরান হাত ধরলো রাউশির।রাউশি থমকে গেলো। অনুভুতিগুলো আবারও বেসামাল হয়ে পড়লো।এই লোকের কাছে থাকলেই তার অনুভুতিগুলো টালমাটাল হয়ে ওঠে। বাহিরে যেমন ঝড়বৃষ্টি রাউশির মনেও তেমনই ঝড় উঠে গেলো।মেহরান রাউশির কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে বলল,

মেহেরজান পর্ব ১৭

“তুই না’ই দিতে পারিস,তবে আমি তো এই ভুল করবো না।”
বলেই টুপ করে রাউশির গালে একটা চুমু খেলো।

মেহেরজান পর্ব ১৯