পাতা বাহার পর্ব ৭ (২)

পাতা বাহার পর্ব ৭ (২)
বেলা শেখ

স্নিগ্ধ সকাল! সারাদিন তীব্র গরম থাকলেও সকালটা যেন স্বস্তিদায়ক! আতিকুর ইসলাম রোজ সুবাহে সাদিকেই বিছানা ত্যাগ করে! মসজিদে নামাজ কায়েম করে হাঁটতে বের হয়! বেশ সময় নিয়েই রাস্তার ধারে হাঁটেন তিনি! আজও তার ব্যতিক্রম হয়নি। নামাজ শেষেই হাঁটতে বের হয়েছেন। রাস্তার দু ধারে ফসলি জমি! সাথেই কিছু দূরত্ব পর পর এক তলা দুই তলা বাস ভবন, মুদি দোকান, হোটেল, চা স্টল! রাস্তার কিনারায় সারি সারি বেঁধে কড়ি গাছ লাগানো! মাঝে মাঝে দু একটা কৃষ্ণচূড়া শিমুল গাছও আছে! শহর থেকে খানিকটা দূরে হওয়ায় যানবাহনের ভিড় ততটা নেই! তবে গাড়ি চলাচল স্বাভাবিক। আতিকুর ইসলাম আশেপাশে নজর দিয়ে হাঁটতে থাকে। গরম লাগছে তবে হালকা বাতাসে সেটা সহ্যনিয়। তাদের বাড়ি থেকে খানিকটা দূরত্বেই চা স্টল আছে সাথেই হোটেল যেখানে খিচুড়ি, ভাত, রুটি পরোটা পুরি সিঙাড়া ইত্যাদি পাওয়া যায়। সেখান দিয়ে যাওয়ার সময় আতিকুর ইসলাম হোটেলের সামনে দাঁড়ায়! গরম তেলে সিঙাড়া ভাজছে হোটেলের এক কর্মচারি! অল্প বয়সী ছেলে।আরেক মধ্যবয়সী লোক পরোটা বেলছে আর ভাজছে । তিনি ভাবলেন গরম গরম সিঙ্গাড়া নেয়া যাক বাচ্চাদের জন্য। হোটেল মালিক ভিতরে বসে খোদ্দেরকে আপ্যায়ন করছে। আতিকুর ইসলামকে দেখে অল্প বয়সী ছেলেটাকে ধমকে বলে,

-” এই পল্টুর বাচ্চা? কাস্টমার আইছে চোক্ষে পড়ে না? কি লাইবো জিগাইতে দুঃখু পাও? আতিক ভাই ভিতরে আসেন! বসেন? কি নিবেন?”
আতিকুর ইসলাম পকেটে হাত ঢুকিয়ে বললেন,
-” দশটা সিঙাড়া দাও গরম গরম!প্যাকেট করে দিও!”
হোটেল মালিক হেসে মাথা নাড়িয়ে বলে,
-” এইতো দিতাছি! গরম গরম ভালো লাইগবো খাইতে! তা বাড়ির সবাই কেমন সব ভালো চলতেছে?”
আতিকুর রহমান গম্ভীর মুখে জবাব দেন,
-” হুম ভালো!”

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

-” আপনার ছোট মাইয়ার বিয়া ঠিক হইছে কি? মেয়েটা বড়ই ভালো! নম্র ভদ্র কথাবার্তা। কখনো খারাপ কিছু চোক্ষে পড়ে নাই! এই তো সামনে বাড়ির এক মাইয়া প্রতিদিনই দেহি এক পোলার লগে হাসতে হাসতে যায়! তোমার মাইয়াটা সেই দিক দিয়ে ভালোই! প্রায় প্রত্যেকদিনই আমাগোরে হোটেল থাইকা রুটি পরোটা নেয়! রুটি টিফিন বাক্সে ভইরা লইয়া যায় তো তাই দেহি!”

আতিকুর ইসলাম অবাক হয় বেশ খানিকটা! সে জানে পাতা মেয়েটা ভালো। এভাবে তার প্রশংসা করায় খানিকটা ভালোই লাগলো! সাথে খানিকটা চিন্তিতও হয়! এখান থেকে রুটি নিয়ে যায় মানে!! তখন খেয়াল আসে লাবনী রান্না করে দেড়িতে!! মেয়েটা কেক বিস্কুট হাবিজাবি বাসি খাবার খেয়েই বেরোয়।কখনো না খেয়েও যায়! দুপুরে কি খায় খেয়ালই আসে নি! আজ জানতে পারলো হোটেল থেকে নিয়ে যায়! মনটা কেমন যেন করলো!মেয়ের মতো ভালো না বাসুক! আদর না করুক খানিকটা মায়া তো কাজ করে! সে জন্যই হয়তো রহিমকে জোর গলায় বলতে পারে না ‘ নিঃসন্তান ছিলে বলে মেয়েকে সারাজীবনের জন্য নিয়েছিলে! বলেছিলে মেয়ের মতোই আদর যত্নে ভালোবেসে বড় করবে!এখন পিছু হটলে তো হবে না! দায়িত্ব নিয়েছো তো পালন করবে আমি রাখতে পারবো না!’ বলতে পারেনি সে! তারই যে অংশ! ওইবাড়িতে অযত্নে লাথি, গুঁতা, কটু কথার বান খেয়ে থাকার চেয়ে তার বাড়িতেই থাকুক। লতা, লুবমানের মত ভালোবাসা না দিক! কখনো কটু কথা বা ধমকে কথা বলে নি!

ভালো না বাসুক ঘৃণাও করে নি! যত্ন না করুক অযত্নেও রাখেনি! চাইলে বুকে টেনে নিয়ে ভালোবাসতে পারতো! কেন যেন পারে নি! আর না পারবে!! এখন শুধু একটা ভালো ছেলে দেখে বিয়ে দিয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে মন থেকে দোয়া করে সাথে ক্ষমাও চাইবে!!

আতিকুর রহমান কিছু বললেন না। হোটেল মালিক কথার জবাব না পেয়ে চুপ করেই রইলেন। আতিকুর ইসলামকে চেনেন, স্বল্পভাষী সাথে কঠোর। তবে কোনো খারাপ রেকর্ড পান নি এপর্যন্ত! আতিকুর সিঙাড়ার প্যাকেট নিয়ে পাঁচটা ডাল পরোটাও নিলেন টাকা পরিশোধ করে বাড়ির উদ্দেশ্যে রওয়ানা হন।
পাতা স্কুলের জন্য রেডি হয়ে বেরিয়েছিল সবে‌ ব্যাগ কাঁধে ড্রয়িংরুমে যেতেই আতিকুর সামনে পড়ে। পাতা কিছু না বলে পাশ কাটিয়ে চলে যেতে নিলে আতিকুর ইসলাম ডাক দেয়,
-” পাতা? না খেয়ে যাচ্ছো কেন? খেয়ে যাও!”

পাতার পা আপনা আপনি থেকে যায়। এ বাড়িতে থাকার সময় গড়িয়ে তার নয় দশ বছর হবে হয়তো! আতিকুর ইসলাম তাকে সম্মোহন হীন ডেকেছে। পাতা বলে ডাকে নি! তবে আজ ডেকেছে!সে প্রায়ই না খেয়ে স্কুলে , কলেজে ভার্সিটি যেত না ! কখনো বলে নি এ কথা! হাতে বিশ পঞ্চাশ টাকা দিয়ে এও বলে নি কিছু কিনে খেও!! তবে মাস শেষে লতা লুবমানের মতো হাত খরচ দিতো। ওদের তুলনায় তাকে কম দিতো না! বরং একশ দেড়শ বেশিই দিতো! পাতা মনটা কেঁদে ওঠে।
খুশি হয় খানিকটা! সে ঘার ফিরিয়ে বলে,

-” রান্না হয় নি এখনো! বাইরে কিছু খেয়ে নিব! আসি আব্বু?”
আতিকুর ইসলাম পাতার দিকে সিঙাড়া পরোটার প্যাকেট এগিয়ে দিয়ে বলে,
-” এখানে সিঙাড়া, পরোটা আছে গরম গরম খেয়ে যাও!সবার জন্যই এনেছি”
পাতা অবাক হয়! আতিকুর ইসলাম আগে কোনো কিছু আনলে লতার হাতে দিত। লতার বিয়ের পর লাবনী আক্তারের হাতে। তাদের হাত থেকেই পাতা পেত।এই প্রথম বার তার হাতে! পাতা ইতস্তত বোধ করে। আতিকুর ইসলাম বুঝতে পেরে পাতার হাতে ধরিয়ে দিয়ে রান্না ঘরে চলে গেল। লাবনী আক্তার রান্না করছিল। স্বামীকে আসতে দেখে জিজ্ঞেস করলেন,

-” কিছু লাগবে আপনার?”
আতিকুর ইসলাম গম্ভীর স্বরে বললেন,
-” কাল থেকে তারাতাড়ি রান্না বসাবে। কেউ যেন খালি মুখে না বেড়োয়! ভরা টিফিন বক্স নিয়ে যেন বের হয় কাল থেকে! আজ নুডুলস বানিয়ে দাও নিয়ে যাবে নি!”
লাবনী আক্তার আশ্চর্য হয়েছেন বটে তবে প্রতিত্তরের সাহস পায় না! রান্না ঘরে থেকেই একটু আগের পাতা ও আতিকুর ইসলামের সকল কথপোকথন তার কানে আসে! অবাকই হয়েছে সাথে একটু খুশিও! ড্রয়িং রুমে বসে পাতাও সব শুনতে পায়! তার চোখ ভোরে ওঠে একটুখানি যত্নে!!

পাতার সকালটা অন্যান্য দিনের তুলনায় ভিন্ন ভাবে কেটেছে। একটু ভালোবাসা একটু যত্নে তার মনটা নেচে উঠছে বারংবার! ইশ প্রত্যেকটা দিনই যদি এমন হতো! বাবার এই অল্প অল্প যত্নই যদি তার নসিবে প্রাত্যহিক জীবনে ঘটে?তাহলে কতই না ভালো হতো! সে খুশি মনে স্কুটি চালিয়ে যাচ্ছে! পাশের গাড়ি থেকে ভোরের ডাকও কানে এসেছে তার। তবে সে সারা দেবে না। ভোর ছোট কাল যেটা করেছে সেটা হয়তোবা সে জানেই না! তবে মি. ভোরের আব্বু কাজটা মোটেও ঠিক করেননি! শালা নাক উঁচু,অভদ্র,ম্যানারলেস! এরই মাঝে অরুণ সরকারের কন্ঠ কানে বাজে!

-” মিস পাতাবাহার? শুনতে পাচ্ছেন? আশ্চর্য আমি জানি শুনতে পাচ্ছেন! সামনে স্কুটি স্ট্যান্ড করুণ!”
তাকে ডাকছে! আশ্চর্যের বিষয়! অন্যসময় তো সামনে পড়লেও ভদ্রতার খাতিরে হাই হ্যালো টুকু বলে না! আজ দাড়াতে বলছে!!সে যাই হোক এই ম্যানারলেস অরুণ সরকারের থেকে তাকে শতহাত দূরে থাকতে হবে! সে অরুনের কথার তোয়াক্কা না করে স্কুটি থামানোর বদলে স্পীড বাড়িয়ে দেয়! ভোরদের গাড়ি ওভার টেক করে এগিয়ে যায় সামনে!
অরুণ সরকার গাড়িতে বসে ছেলেকে কোলে নিয়ে। পাতাকে এগিয়ে যেতে দেখে ভাবে যে সামনে স্টপেজে হয়তো থামবে। কিন্তু তাকে ভুল প্রমাণিত করে পাতা স্কুটি নিয়ে শা শা করে পথ ধরে এগোতে থাকে। অরুণ খানিকটা অসন্তুষ্ট হয়! সে তো বললো থামতে! অথচ পুঁচকে মেয়েটা তার কথা শুনেও অগ্রাহ্য করলো! বেয়াদব!

-” আব্বু মিস থামলো না কেন? উনি কি শুনতে পায় নি? আঙ্কেল গাড়ি জোরে চালাও তো? আব্বু ?মিস কি আমার সাথে রাগ করেছে? কাল ওভাবে চলে আসায়?”
অরুণের কপালে ভাঁজ পড়ে! ওহ মিস পাতাবাহার কালকের ঘটনায় গাল ফুলিয়ে আছে!! বাহ এই টুকুনি পুঁচকে মেয়ের আবার ইগোও আছে!! নট ব্যাড !
ড্রাইভার একটু আগাতেই অরুণ ও ভোর দেখে পাতার স্কুটিটা দাঁড়িয়ে আছে। অরুণ ভাবে হয়তোবা ভোরের জন্যই দাঁড়িয়েছে। ড্রাইভারকে গাড়ি থামাতে বললে গাড়ি থামিয়ে দেয়। ততক্ষণে ভোরও দেখতে পেয়েছে তার মিসকে! গাড়ি থামতেই দরজা খুলে বেরিয়ে পড়ে। অরুণ ছেলের উদ্বিগ্নতা দেখে হাসে অল্প। সেও নেমে পড়ে! ভোরের হাত ধরে সামনে এগোতে নিলেই দেখতে পায় পাতার স্কুটিতে দুটি মেয়ে উঠলো। ভোরের স্কুলেরই! ফোর ফাইভের হবে!! উঠলেই পাতা স্কুটি স্টার্ট করে চলে যায়! ভোর কাঁদো কাঁদো হয়ে বাবার দিকে চায়!

-” আব্বু মিস ওই মেয়েগুলোকে নিয়ে গেল! আমায় নিলো না!!”
অরুণ ছেলেকে কোলে তুলে গাড়িতে উঠে বসে! ড্রাইভার গাড়ি চালানো শুরু করে! আভারি ভোরের গোমড়া মুখ দেখে বলে,
-” ভোর বাবা তোমার ম্যাডাম হয়তো তোমায় দেখে নাই! মন খারাপ কইরো না!”
অরুণ ছেলেকে আদর করে বলে,
-” আব্বু? আমি বাইক কিনবো আজকেই আব্বু প্রমিজ! মন খারাপ কোরো না! মিস পাতাবাহারকে বকে দেব ঠিকাছে?”

ভোর চোখ পিটপিট করতে থাকে। অরুণ ঘুমিয়ে মুখ সামনে আনতেই কেঁদে দেয়! অরুণ বুকে জড়িয়ে নেয়! ছেলেটা তার বড্ড আবেগী! কষ্ট সহ্যই করতে পারে না। যে তাকে ভালোবাসে তাকেও ভোর মন থেকে ভালোবাসে। তার থেকে সামান্য অবহেলাও সহ্য করতে পারে না! মিস পাতাবাহারকে কড়া কয়েকটা কথা শুনাতে হবে! তার ছেলেকে কাঁদিয়েছে!

পাতা বাহার পর্ব ৭ 

-” আব্বু ? কাঁদছো কেন? কথায় কথায় কাঁদতে নেই! তোমার মিস হয়তো শুনতেই পায় নি! পেলে অবশ্যই নিয়ে যেত! আব্বুকে তো সে খুব ভালোবাসে তাই না? কাঁদে না আমার সোনাটা! আব্বু? তোমার জন্য আজ রাতে অনেক গুলো আইসক্রিম নিয়ে আসবো! সব ফ্লেভারেরই! আমরা রাতে কার্টুনও দেখবো একসাথে আচ্ছা? এই আব্বু?”
ভোর কান্না থামায়! মিস হয়তো শুনতে পায়নি!! অরুণ টিস্যু দিয়ে ছেলের নাক মুখ পরিষ্কার করে দেয়। ছেলেটার ঠান্ডার ধাত আছে! অল্পতেই ঠান্ডা লাগবে! ছেলেকে বুকে জড়িয়ে পাতার প্রস্থানের দিকে চায়!

পাতা বাহার পর্ব ৮