মন রাঙানোর পালা সিজন ২ পর্ব ২৪

মন রাঙানোর পালা সিজন ২ পর্ব ২৪
ইয়াসমিন খন্দকার

সকাল বেলায়, সুন্দর সাদা গাড়িতে উঠে বসল সারজিস। সারজিস গাড়ি চালানো শুরু করল। তার চোখে চাপা উদ্বেগ। সারাটা সময় তার মায়ের বলা কথাগুলো ভাবতে ভাবতে তার মনে শান্তি আসেনি। অভীক্ষার সাথে তার সম্পর্কের ওপর আঘাত হানতে পারে এমন কিছু যদি সে দেখে—এমন ভাবনায় তার মন স্ফীত হয়ে উঠেছিল। আজ সে বুঝতে পারছে, সম্পর্কের মাঝে বিশ্বাসের পুঁজির মূল্য কতটা।
গাড়ির স্টিয়ারিং ধরার আগে সারজিস নিজেকে বলেছিল,”অভীক্ষা, আমি তোমাকে বিশ্বাস করতে চাই। আমাদের ভবিষ্যৎ যেন মাটিতে মিশে না যায়।”

সে কিছুক্ষণ গাড়ির দিকে তাকিয়ে ছিল, যেন শেষবারের মতো তার ভালবাসার প্রতি আস্থা রাখতে চাইছে। গাড়ি চালাতে শুরু করে সে মনে মনে আবারও আশ্বাস দেয়—”আমি বিশ্বাস করব, আমি বিশ্বাস করব…”
এদিকে, অভীক্ষা হোটেলের পাশের একটি ক্যাফেতে বসে ছিল। তার মুখে হাসি ছিল, কারণ আজ তার বিদেশী ক্লায়েন্টদের সাথে মিটিং একদম সফল হয়েছে। তারা তার ডিজাইন সম্পর্কে প্রশংসা করেছে। এতোদিনের কঠোর পরিশ্রমের ফলাফল হাতে পাওয়ার মুহূর্ত তার জন্য বিশেষ। সে স্মৃতিতে ফিরে গেল—কীভাবে সে এই স্বপ্নের পথে পা রেখেছিল।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

মিটিং শেষে, ফোন বের করে সে সারজিসকে কল দিতে চায়। কিন্তু ফোনে চার্জ নেই দেখে তার মন ভেঙে যায়,”আচ্ছা, এখন কি করব?”
সে নিজের কাছে প্রশ্ন করল। অভীক্ষার দৃষ্টিতে হতাশা স্পষ্ট—বাড়ির চার দেয়ালে এই যান্ত্রিক জীবনের মধ্যে সে একটু উন্মুক্ত হতে চাইছিল। “একটু বিশ্রাম তো প্রয়োজন,” বলে সে মনে মনে সিদ্ধান্ত নিল।
হোটেলে ফিরে সে নিজের রুমে বিশ্রাম নিতে গিয়ে আবারও ভাবতে লাগল সারজিসের কথা, “আমাদের মাঝে কি কিছু বদলাতে যাচ্ছে?” নিজেকে প্রশ্ন করল সে।
অল্প কিছুক্ষণ পর, মুন্নি, অভীক্ষার সেক্রেটারি, তার রুমে এসে বলল, “ম্যাম, কিছু জরুরি কাজ আছে। আমি বাসায় যেতে হবে।”

অভীক্ষা একটু চিন্তিত হয়ে বলল, “ঠিক আছে, তোমার কাজ থাকলে চলে যাও।”
মুন্নি প্রসন্ন হয়ে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে বিদায় নেয়।
মুন্নি চলে যাবার কিছু সময় পরেই মুকিত হাফাতে হাফাতে গ্রান্ড হোটেলে চলে আসে। এসেই হোটেলের রিশেপসনিস্টের কাছে এসে জিজ্ঞেস করে,”আচ্ছা, বিখ্যাত ফ্যাশন ডিজাইনার অভীক্ষা কি এই হোটেলেই উঠেছেন?”
রিশেপসনিস্ট উত্তর দেন,”জ্বি, কিন্তু কেন বলুন তো?”
“উনি আমার ফ্রেন্ড হন। উনি কত নম্বর রুমে আছে একটু বলুন তো।”
“কাইন্ডলি একটু ওয়েট করুন, আমি চেক করে বলছি।”
“আচ্ছা।”
“৪২৭ নাম্বার রুম।”
‘ধন্যবাদ আপনাকে।’

বলেই মুকিত ৪২৭ নাম্বার রুমের দিকে রওনা দেয়। অভীক্ষা তখন সেখানেই শুয়ে ছিল। এমন সময় মুকিত এসে তার দরজায় নক করে। অভীক্ষা উঠে গিয়ে দরজা খুলে মুকিতকে দেখতে পেয়ে অবাক স্বরে বলে,”তুমি?!”
মুকিত দ্রুত অভীক্ষার রুমে ঢুকে পড়ে বলে,”এত অবাক হচ্ছ কেন? তুমিই তো আমায় এখানে ডেকে পাঠিয়েছ!”
“এসব কি বলছ তুমি মুকিত? আমি তোমায় ডেকে পাঠিয়েছি মানে?”

“এটা মজার সময় নয় অভীক্ষা। আমি জানি তুমি এখনো আমাকেই ভালোবাসো। আমি আমার মায়ের থেকে সবটা শুনেছি কেন তুমি আমাকে ২ বছর আগে ছেড়ে দিয়েছিলে৷ সবটা তুমি আমার ভালোর কথা ভেবেই করেছিলে অথচ আমি তোমায় কতই না ভুল ভেবেছিলাম। আমার তো সেসব ভেবে নিজের উপরই রাগ ও ঘৃণা হচ্ছে। কতই না খারাপ ব্যবহার করেছি তোমার সাথে। এখন হয়তো সেসব কিছুর জন্যই শাস্তি পাচ্ছি।”
“এসব কথা এখন বলার মানে কি? আর তুমিই বা এখানে কি করে এলে?”
“তুমিই তো কারো মাধ্যমে আমাকে এখানে আসতে বললে।”
“তোমার মাথা কি খারাপ হলো নাকি?! আমি এমন কিছুই বলিনি।”

হঠাৎ করেই মুকিত আবেগপ্রবণ হয়ে অভীক্ষাকে জড়িয়ে ধরে। অতঃপর বলে,”আমি জানি, তুমি আমার উপর অভিমান করেই এসব বলছ। তুমি তো ঐ সারজিসকে স্বেচ্ছায় বিয়ে করোনি, করেছ বাধ্য হয়ে। তুমি তো এখনো আমাকেই ভালোবাসো। তোমাকে আর এই মিথ্যা সম্পর্কটা বয়ে নিয়ে বেরাতে হবে না অভীক্ষা। তুমি ঐ সারজিসকে ডিভোর্স দিয়ে দাও। তারপর আমরা আবার বিয়ে করে নেব। আমাদের একটা ছোট্ট, সুখের সংসার হবে যার স্বপ্ন আমরা সবসময় দেখেছি। প্রয়োজনে আমি নিজের বাবার বিজনেসও ছেড়ে দেব। আমার শুধু তোমাকেই চাই।এসব বিত্ত, প্রতিপত্তি কিছুই চাই না।”

এমন সময় সারজিস সেখানে চলে আসে এবং অভীক্ষা ও মুকিতকে এভাবে দেখে সে ভীষণ রেগে যায়। তার কপালের শিরা ফুলে যায়, হাত মুষ্টিবদ্ধ হয়। বিশ্বাসঘাতকতা বোধ হয়। সারজিস হুংকার দিয়ে বলে ওঠে,”অভীক্ষা!”
অভীক্ষা সাথে সাথেই মুকিতকে ধাক্কা দিয়ে দূরে সরিয়ে দেয়৷ সারজিসকে দেখতে পেয়েই তার দিকে ছুটে গিয়ে বলে,”আপনি এসেছেন সারজিস? আপনি আমায় ভুল বুঝবেন না প্লিজ। আমি কিছুই করি নি৷ মিস্টার মুকিত চৌধুরীই..”

মুকিত বলে ওঠে,”আর তোমায় এই সারজিসকে ভয় পেয়ে চলতে হবে না অভীক্ষা। আমি সব জানি এই লোকটা কিভাবে এই ক’দিন তোমায় নজরে রেখেছে। তোমার আর আমার কোন এক শুভাকাঙ্ক্ষী আমাকে সব বলেছে। কিন্তু এখন তো আমি আছি। এই লোকটা তোমার আর কোন ক্ষতি করতে পারবে না।”
অভীক্ষা মুকিতের সামনে হাতজোড় করে বলে,”এসব আজেবাজে কথা বলা বন্ধ করো প্লিজ।”
অতঃপর সে সারজিসের দিকে তাকায় অনেক আশা নিয়ে। সারজিসকে বলে,”বিশ্বাস করুন, আমায়। এসব কিছু..”
সারজিস আচমকা পাগলের মতো হেসে ওঠে। হাসতে হাসতে বলে,”বিশ্বাস আর তোমার মতো দুশ্চরিত্রা মেয়েকে! কখনোই না।”

“সারজিস?!”
রেগে বলে অভীক্ষা।
মুকিত বলে,”একদম আমার অভীক্ষার নামে কোন খারাপ শব্দ উচ্চারণ করবেন না।”
সারজিস দ্বিগুণ রেগে বলে,”একশোবার বলব। তোমরা দুজন মিলে এত নীচ কাজ করেছ সোজা বাংলায় যাকে বলে পরকীয়া তাও কোন মুখে এত বড় কথা বলছ?”
অভীক্ষা বলে,”এবার কিন্তু আপনি সীমা ছাড়াচ্ছেন সারজিস! সবটা না জেনে, না বুঝে কেন এত বাজে কথা বলছেন?”

“নিজের চোখে এত কিছু দেখার পরেও আমার বোঝার বাকি আছে কিছু? আরে তোমাকে তো আমি নিজের মায়ের থেকেও বেশি বিশ্বাস করেছিলাম আর তার কি প্রতিদান পেলাম! তুমি একটা দুশ্চরিত্রা মেয়ে। আমাকে তো নিজের কাছে ঘেষতে দিতে না, খুব সতী সাবিত্রী দেখাতে। এইজন্যই বুঝি? কারণ তুমি ইতিমধ্যেই অন্য কারো সাথে বিছানা গরম করে ফেলেছ। আর আমার সাথে সঙ্গম করলে তো আমি বুঝে যাব তুমি পবিত্র আর ভার্জিন নও বরং..”
সারজিস নিজের কথা শেষ করতে পারে না তার আগেই অভীক্ষা ঠাস করে তার গালে থাপ্পড় বসিয়ে বলে,”তোমার চিন্তা-ভাবনা এত নীচ আমি ভাবতেও পারিনি। আমি সব সহ্য করতে পারবো কিন্তু নিজের সম্পর্কে এত বাজে কথা শোনার পর আপনার সাথে এক ছাদের তলায় থাকতে পারব না। যেই সম্পর্কে কোন বিশ্বাসই নেই তা টিকিয়ে রেখে কি লাভ? আজ এখনই, এই মুহুর্তে আমি আপনাকে ত্যাগ করলাম। আর জীবনেও আপনার মুখ দেখতে চাই না।”
বলেই অভীক্ষা ত্রস্ত পায়ে হেটে বের হয়ে যেতে নেয়। সারজিস বলে ওঠে,”তো কার মুখ দেখতে চাও এই মুকিতের? শুধু মুখই দেখবে নাকি আরো অনেক কিছু? এই মুকিত কি তোমায় এতই সুখ দিয়েছে যা আমি কখনো দিতে পারব না।”

অভীক্ষা ঘৃণাভাজন দৃষ্টিতে মুকিত ও সারজিস দুজনের দিকে তাকিয়ে বলে,”আসলে কি বলুন তো, আমি আপনাদের দুজনকেই ঘৃণা করি। কারণ আপনারা খুব সহজেই নারীর চরিত্রের দিকে আঙুল তোলেন। সবসময় তো শুনেছেন, ছেলেরা মেয়েদের থেকে মুখ ঘুরিয়ে নেয়, আজ উল্টো পূরাণ দেখে নিন, আমি আপনাদের দুজনের থেকেই মুখ ফিরিয়ে নিলাম। আমার কাছে সবার আগে নিজের আত্মসম্মান তার আগে কিছু নয়।”

মন রাঙানোর পালা সিজন ২ পর্ব ২৩

বলেই অভীক্ষা চলে আসে। নিজেকে নিরপরাধ প্রমাণ করার চেষ্টাও করে না। কেন করবে কে? সবসময় কি এই দায় মেয়েদের? মেয়েরা বারবার অপমানিত হবে আর নিজেকে প্রমাণ করবে? এই স্টেরিওটাইপ ভাঙতে চায় অভীক্ষা। সে দেখিয়ে দেবে মেয়েদের সবসময় সব দায় নয়। তারাও পারে সব অভিযোগকে পাশ কাটিয়ে বুক উঁচু করে চলতে।

মন রাঙানোর পালা সিজন ২ পর্ব ২৫