এক মায়াবতীর প্রেমে পর্ব ৪৭
তানিশা সুলতানা
এই মুহুর্তে তামিমকে একদমই আশা করে নি কেউ। বাইরে এখনো ঝিরিঝিরি বৃষ্টি পড়ছে। এই সময় কার সাথে আসলো?
তন্নি যখন আসলো তখন হাজারবার বলেছে “যাবি আমার সাথে ” বিচ্ছুটা তখন আসতে চাইলো না। আর এখন নাচতে নাচতে চলে আসলো?
অথৈ ইতোমধ্যেই খাবার ছেড়ে উঠে পড়েছে। এঁটো হাতেই এগিয়ে আসে তামিমের পানে। দরজায় উঁকি ঝুঁকি মেরে দেখে সাথে কেউ এসেছে কি না। কিন্তু নাহহ সাথে কেউ নেই।
অথৈ তামিমের মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়। আদূরে স্বরে প্রশ্ন করে
“একা একা কিভাবে আসলি?
তামিমের পরনে হাফ প্যান্ট আর হাতা কাটা নীল রংয়ের গেঞ্জি। পায়ে বাড়িতে পড়ার স্লিপার স্যান্ডেল।
” লাবিবাকে ফলো করতে করতে চলে এসেছি।
স্পষ্ট জবাব তামিমের। যেনো সদা সত্য বাদী।
ভ্রু কুচকে সকলেই তাকায় তামিমের পানে। লজ্জা শরম ভুলে তন্নিও তাকায়। এবং চোখ রাঙায়। এই ছেলেটা কবে মানুষ হবে? এই তো কয়েকদিন আগেই বেদম পিটুনি খেলো। এখন আবার লাবিবা লাবিবা শুরু করে দিয়েছে?
তন্নির দৃষ্টি দেখে তামিম ভেংচি কেটে বলে
“আপি তুমি একদম তোমার উঁচু নাক গলাতে আসবে না। বলে দিলাম।
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
অথৈ আপু দুই একটা দিন তোমাদের বাড়িতে থাকবো আমি। কোনো প্রবলেম তোমার?
অথৈ অনবরত মাথা নেরে বোঝায় তার কোনো সমস্যা হবে না। তামিম থাকতে পারে তার সাথে। তখন আশা বেগম আঁচলে ঘাম মুছতে মুছতে বের হয়। তামিমকে দেখে মনে করে তন্নির সাথেই এসেছে। তাই এসে কাছে ডাকে। আদর করে কপালে চুমু খায়। কিছু চকলেট ছিলো তার কাছে সব গুলো দিয়ে দেয়। ডেইরি মিল্ক চকলেট খেতে বড্ড ভালোবাসে কি না৷
পুরো সময়টা অর্ণব নিশ্চুপ। জীবনের বারোটা বেজে গেলো। এবার রোমাঞ্চের র ও করতে পারবে না। এই বিচ্ছু যখন তখন যেভাবে সেখানে চলে আসবে। আর অর্ণব ধরা পড়ে যাবে। শেষমেশ দুই চার দশ গ্রামের মানুষ জেনে যাবে “অর্ণব চৌধুরী তার বউকে চুমু খেয়েছে”
আসলেই কি ব্যাপারটা লজ্জা জনক? একদমই না। নিজেরই তো বউ। তাও আবার একমাত্র। চুমু খেতে ইচ্ছে করবে না? নেহাত অর্ণব ভালো মানুষ তাই একটু আতটু চুমু খায়৷ খারাপ হলে তো পনেরো দিনের মধ্যে দরজা খুলতো না। বউ নিয়ে বেড বিলাস করতো।
নিজের দিকে একখানা নোবেল ছুঁড়ে মারে অর্ণব। গর্বে বুক ফুলিয়ে এক লোকমা খাবার মুখে পুরতে যায়। তখনই ভেসে আসা জ্বালাময়ী কন্ঠস্বর
“এই যে চুমু খাওয়া ভাইয়া। তুমি কি আমাকে দেখে খুশি হও নি?
সকলের দৃষ্টি পড়ে অর্ণবের পানে। হাতের খাবার হাতেই রয়ে যায়। মুখে পুরা হয় না। একটু হাসার চেষ্টা করে বলে
” ভীষণ খুশি হয়েছি। এতোই খুশি হয়েছি যে মুখ থেকে কথা বের হচ্ছে না। ভাষা হারিয়ে ফেলেছি।
তামিম গভীর ভাবে কিছু ভাবে এবং বলে ওঠে
“আমারই মতো। লাবিবাকে দেখলে আমারও মুখ থেকে কথা বের হয় না খুশিতে। ভাষা হারিয়ে ফেলি।
বুজেছি তুমি আমাকে লাবিবার মতোই ভালোবাসো।
হাসি চেপে রাখতে পারে না আর্থি। তামিমের গাল টেনে দিয়ে বলে
” পুরাই কিউটের ডিব্বা।
হতাশার নিঃশ্বাস ফেলে তামিম।
“কিউট না গো আপু
কিউট হলে কি আর লাবিবা পালাই পালাই করতো?
কাছাকাছি আসতো। বউ বউ খেলতো।
অথৈ আর্থি উচ্চস্বরে হেসে ওঠে।
তন্নি ধমকের সুরে বলে
” বাবা কি তোকে এমনি এমনি পিটানি দেয়? আস্ত বদমাইশ তুই একটা।
তামিম ঘোর প্রতিবাদের সুরে বলে
“বাবা এমনি এমনিই পিটানি দেয়। কেনো বাবা কি মাকে ভালোবাসে না?
বাবা মাকে ভালোবাসে। আমি লাবিবাকে। আমরা দুজনই তো প্রেমিক পুরুষ।
তাহলে বাবা কেনো মারবে আমায়?
নেহাৎ বাবার সামনে কথা বলতে হাঁটু কাঁপে নাহলে ফটাফট বলে দিতাম আমি। হুহহ
অর্ণব তামিমের পিঠ চাপকে বাহবা দিয়ে বলে
” শালাবাবু আমি আছি তোমার সাথে। তোমার লাবিবাকে ধরে বেঁধে এনে দিবো।
“তোমার ভরসায়ই তো বেঁচে আছি। নাহলে কবেই গলায় দঁড়ি দিতাম।
তামিম মূলত সিএনজি ওয়ালাকে দশ টাকা দিয়ে একা একাই এসেছে অর্ণবদের বাড়িতে। প্রথমে তো আসতে ইচ্ছে করে নি। পরে উঁকি ঝুঁকি মেরে জানতে পারলো লাবিবা নানী বাড়ি গিয়েছে। এতিম তামিম একা একা কি করবে বাড়িতে? তারেক তো ধমকে ধমকেই আধমরা করে দিবে। তাই বাবার পকেট থেকে টাকা চুরি করে চলে এসেছে।
আছরের আজান পড়েছে কিছু মুহুর্ত আগেই। সারাদিন মুসলধারায় বৃষ্টির পরে প্রকৃতি এখন স্বভাবিক। পশ্চিম দিগন্তে সূর্যের দেখা মিলেছে। রোদের তাপ এসে পড়ছে অথৈয়ের চোখে মুখে। দিনের শেষ সময়ের রোদ কখনো এতোটাও প্রখর হয়? হুমম হয়। এই যে অথৈ টের পাচ্ছে। ইতোমধ্যেই রাস্তা ঘাটে জমে থাকা পানি শুকিয়ে গিয়েছে। কাঁদাও শুকতে শুরু করেছে। অথৈ ভেবে পায় না এতো এতো পানি মুহুর্তেই কোথায় চলে যায়? সেখানে অথৈকেও নিয়ে যাক। দেখে আসুক অথৈ পানিদের বাড়িঘর। এতোসব উল্টাপাল্টা ভাবনার মাঝেই গাড়ি এসে থামে কলেজের গেইটের সামনে। বিশ টাকা ভাড়া। অথৈ পঞ্চাশ টাকা দেয় রিকশা মামাকে।
কিন্তু রিকশা মামা পঞ্চাশ টাকা নিবে না।
সে মাথা নিচু করে বলে
” আপা আমি বিশ টাকার পরিশ্রম করেছি। পঞ্চাশ টাকা নিতে পারমু না। আপনি আমারে বিশ টাকাই দেন।
হাসে অথৈ। এমনিতে অন্য রিকশায় ভাড়া মিটিয়ে না আসলে চল্লিশ টাকা পর্যন্ত দাবি করে। এক প্রকার ঝগড়া বেঁধে যায় রিকশা মামাদের সাথে। আর উনি পরিশ্রমের বেশি টাকা নিবে না। এই রিকশা মামাকে এলাকায় নতুন দেখা যাচ্ছে। হয়ত আগে অন্য পেশায় নিয়োজিত ছিলো। এখন অভাবের তাড়নায় রিকশা চালাচ্ছে।
অথৈ পার্স থেকে বিশ টাকা বের করে রিকশা মামাকে দেয়। এবং একটু দাঁড়াতে বলে। দৌড়ে চলে যায় দোকানে। সেখান থেকে একটা ঠান্ডা কিনে আবারও দৌড়ে আসে।
রিকশা এবং সে ইতোমধ্যেই ঘেমে নেয়ে একাকার। প্রচন্ড গরমে জান যায় যায় অবস্থা।
অথৈ হাঁপাতে হাঁপাতে বলে
“মামা এটা রাখুন প্লিজ।
রিকশা মামা ফের আপত্তি করে বলে
” না না লাগবো না আমার।
অথৈ জোর দিয়ে বলে
“নিন না।
আমি ভালোবেসে দিচ্ছি আপনাকে। না নিলে কষ্ট পাবো। প্লিজজ নিন
আমতাআমতা করতে করতে নেয় উনি৷ অথৈ মুচকি হেসে চলে যায়। সাগর দূর থেকে লক্ষ করছিলো পুরো ব্যাপারটা। প্রথমে রাগ হয় বেশি টাকা দেওয়ার জন্য পরে মুগ্ধ হয়।
অথৈ এদিক ওদিক তাকিয়ে খোঁজে সাগরকে। তার ধারণা সাগর আসবে না। তবুও মন বলছে আসবে আসবে।
অথৈ মনের ওপর ভরসা করেই এসেছে। কলেজের বা পাশে বিশাল বটগাছটার নিচে সাগরকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটে ওঠে অথৈ। বরাবরই সাগর এখানেই দাঁড়ায়। প্রিয় জায়গা কি না। বড়বড় পা ফেলে সেদিকে এগোয় অথৈ।
কাছাকাছি গিয়ে সাগরকে কিছু বলতে না দিয়ে নিজেই বলে ওঠে
“ফুল কই?
সাগরের কপালে ভাজ পড়ে। হাতে ধরে রাখা হেলমেট বাইকের ওপর রাখে৷ ঠিক বুঝতে পারছে না ” কিসের ফুল?” মনের মধ্যে প্রশ্ন খানা চাপা না দিয়ে মুহুর্তেই বলে ওঠে
” কিসের ফুল?
ওড়নার আঁচল দিয়ে ঘাম মুছতে মুছতে অথৈ বলে
“আমার সাথে মিট করতে এসেছেন৷ ফুল আনবেন না? টাকা নেই কি?
থতমত খেয়ে যায় সাগর। মিট করতে তো সেই ডাকলো? আবার ফুলও আনা উচিত ছিলো? জীবনেও ফুল টুল কিনে নি। ধারণা নেই। তাছাড়া অথৈ তো তার প্রমিকা নয়। তাহলে ফুল কেনো আনবে? মনে মনে এসব কথাই ভাবছিলো সাগর। সাগরের নিশ্চুপতা দেখে অথৈ বলে ওঠে
” নো প্রবলেম
চলুন ফুলের দোকানে। বাকিতে একটা ফুল কিনে দিবেন আমায়। পরে হাতে টাকা হলে দিয়ে দিবেন দোকানদারকে। ফুলের সাথে নো কম্পোমাইজ।
কাছে টাকা আছে প্রমাণ করতে সাগর সাথে সাথেই জবাব দেয়
“টাকা আছে আমার কাছে।
” বাহহ তাহলে তো ভালোই হলো। একটা গোলাপ আর একটা বেলি ফুলের মালা কিনে দিবেন৷ তারপর কফি খাওয়াবেন। এতেই হবে আমার। কোল্ড কফি খাবে কিন্তু।
চলুন চলুন
তাড়া দিয়ে বাইকের ওপরে থাকা হেলমেট তুলে সাগরের মাথায় পড়িয়ে দেয় যত্ন সহকারে। তারপর সাগরের শার্টের বোতামের ভাজে থাকা চশমা নিয়ে নিজের চোখে পড়ে নেয়। পার্স হতে ক্লিপ বের করে চুল গুলো আটকে নেয়। সাগরের বুঝি আজকে অবাক হওয়ারই দিন। সে অবাক নয়নে তাকিয়ে আছে অথৈয়ের পানে। মেয়েটির এই রূপ আচরণ আজকেই প্রথমবার দেখলো। সাগরকে স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে অথৈ তাড়া দিয়ে বলে
“কি হলো চলুন
দেরি হচ্ছে তো। আবার সন্ধ্যার আগে বাড়ি ফিরতে হবে।
অগত্য সাগর বাইকে বসে। সাগরের কাঁধে হাত চেপে অথৈও বসে পড়ে। দুই হাতে জাপ্টে জড়িয়ে ধরে সাগরের পেট। পিঠে মাথা রাখে।
সাগরের হার্টবিট বোধহয় দুবার মিস হলো। বুকটা অস্বাভাবিক ভাবে কাঁপতে থাকে। মেয়ে মানুষের এই রূপ ছোঁয়া আজকেই প্রথমবার পেলো।
” এই যে সাগর ভাইয়া
যাচ্ছেন না কেনো?
শুকনো ঢোক গিলে সাগর। জিভ দ্বারা ঠোঁট ভিজিয়ে বাইক স্ট্রাট করে।
ফুলের দোকানের সামনে বাইক থামায়। অথৈ নেমে যায়। সাগরের অপেক্ষা না করেই দোকানে ঢুকে পড়ে। দেখতে থাকে ফুল। বেছে বেছে তিনটে গোলাপ এবং তিনটে সূর্যমুখী ফুল নিয়ে নেয়। একটা বেলি ফুলের মালাও হাতে তুলে নেয়। এবং দোকানদারের নিকট গিয়ে বলে
“কতো হলো ভাইয়া?
” ৩৫০ টাকা।
অথৈ সাগরের পানে তাকায়।
“৩৫০ টাকা দিয়ে দিন।
পকেট থেকে ওয়ালেট বের করে পাঁচশো টাকার নোট দেয় দোকানদারকে। পাওনা টাক ফেরত নিয়ে ফের তাকায় অথৈয়ের পানে। অথৈ ফুল নিয়ে ব্যস্ত। কখনো ফুলের ঘ্রাণ নিচ্ছে তো কখনো হাতে পড়ার চেষ্টা করছে।
সাগর সেটা দেখে বলে
” আমি পড়িয়ে দিবো?
অথৈ এক গাল হেসে বেলি ফুলের মালা খানা সাগরের হাতে দেয়। এবং নিজের বা হাত খানা বাড়িয়ে দেয়। সাগর যত্ন সহকারে মালা পড়িয়ে দেয় হাতে।
আর্থিকে সাফিন শাড়ি পড়ে পিকচার তুলে দিতে বলেছে। তাই শাড়ি পড়েছে। এবং তন্নিকেও জোর জবরদস্তি করে শাড়ি পড়িয়ে দিয়েছে। তামিম আর অর্ণব গিয়েছে মার্কেটে। তামিমের জন্য জামাকাপড় কিনতে।
আর্থি এবং তন্নি সুন্দর করে সাজুগুজু করে আশা বেগমকে দেখাতে তার রুমে যায়। তিনি প্রশংসা পঞ্চমুখ। বেশ কয়েকবার মাশাআল্লাহ আওড়ায়। তারপর দুজন চলে যায় ছাঁদে। আর্থি কিছু ফটো তুলবে আর ফটো তুলে দিবে তন্নি।
ফটো তুলতে তুলতে মাগরিবের আজান দিয়ে ফেলে। আর্থিকে সাফিন কল করেছে বলে সে ছাঁদের অপর প্রান্তে চলে যায়। তন্নি ঘুরে ঘুরে ছাঁদের ফুল গাছ গুলো ছুঁয়ে ছুঁয়ে দেখছে। ইতোমধ্যেই চারিপাশে অন্ধকার নেমে গিয়েছে। পাখি গুলো কিচিরমিচির শব্দ করে নিজ আস্তানায় চলে যাচ্ছে। ঝিরিঝিরি বাতাস বইছে। তন্নির লম্বা চুল গুলো বাতাসের তালে দুলছে। মুহুর্তটা দারুণ লাগছে তন্নির কাছে। ইচ্ছে করছে সমটাকে এখানেই থামিয়ে দিতে।
অর্ণব গোটা বাড়ি তন্নিকে খুঁজে পায় না। শেষে ছাঁদে আসে। দরজা ওবদি আসতেই পা থেমে যায় অর্ণবের।
কালো শাড়িতে আবৃত তন্নিকে দেখে রীতিমতো শক খায়। হাতে ফোন ছিলো সেটা হাত ফঁসকে মুহুর্তেই জমিনে পড়ে যায়। বিকট শব্দ তোলে। চোখের পাতা নড়ছে না।
গলা শুকিয়ে আসছে। তন্নি ঘাড় বাঁকিয়ে তাকায়। অর্ণবকে দেখে খুশি হয়ে এগিয়ে আসে।
অর্ণব তন্নিকে হুশিয়ার করে বলে
এক মায়াবতীর প্রেমে পর্ব ৪৬
“আজকে তুমি শেষ তন্নি। তোমার ম র ণ আমার হাতেই লেখা রয়েছে৷ বাঁচতে চাইলে পালাও। আমি তোমায় খুঁজে বের করে মা রি। আর না পালালে এখুনি চলো আমার সাথে। আমার কন্ট্রোললেস ব্লাস্ট করেছে।