শুভ্ররাঙা ভালোবাসা পর্ব ২০

শুভ্ররাঙা ভালোবাসা পর্ব ২০
সুমাইয়া সুলতানা

” একা একা দিন যে কাটে, মনের মানুষ নাই
বলো কোথায় গেলে তারে আমি পাই?
এতো স্বাদের জীবন আমার, যাবে কি বৃথাই?
বলো কোথায় গেলে তারে আমি পাই?
আরে মনের মানুষ নাই, এই অন্তর পুড়ে ছাই
ভালোবেসে এই আমারে আদর দিবে কে?
বড়ো ভাই পায়ে পড়ি রেএএ
মেলা থেকে বউ এনে দে।
ও বড়ো ভাই পায়ে পড়ি রেএএ
মেলা থেকে বউ এনে দে। ”

ইংরেজি ক্লাস না করে ভরদুপুরে ভার্সিটির ক্যানটিনে বসে বসে আড্ডা দিচ্ছে আয়মান সহ তার ক্লাসের কয়েকজন বন্ধুরা মিলে। এই ইংরেজি ক্লাস না করার মূল কারণ, ইংরেজি স্যার। এই স্যারের ক্লাস কখনোই ভালো লাগে না আয়মানের। ব্যাটা ক্লাসের পড়া রেখে আউট জ্ঞান বেশি দেয়। আয়মান ক্যানটিনের বেঞ্চিতে বসে বন্ধুদের কাছে সিঙ্গেল জীবনের দুঃখ প্রকাশ করছে। যা তার গুনগুন করে গাওয়া গানের মধ্যেই প্রকাশিত হচ্ছে। আয়মানের এক বন্ধু জিজ্ঞেস করলো,

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

” তুই একা কিভাবে? তোর তো গার্লফ্রেন্ড এর অভাব নেই। মেয়েরা তোর বাহ্যিক সৌন্দর্য দেখে হুমড়ি খেয়ে পড়ে। আর আমি নিজে থেকে কোনো মেয়েকে প্রপোজ করলেও পাত্তা দেয় না। শালা ফাটা কপাল আমার! সেখানে তুই তে অনেক লাকী। তাহলে ঢং করে স্যাড সঙ গাইছিস কেন? ”
আয়মান বসা হতে উঠে দাঁড়ায়। ব্যাগটা বাম কাঁধে চাপিয়ে তাচ্ছিল্য হেসে জবাব দিল,

” ওই গুলো সব থার্ডক্লাশ মার্কা মেয়ে। আমার সৌন্দর্য দেখে না, আমার বাবার টাকা আছে বলে আমার পিছু পিছু ঘোরে। যদি কখনো শুনতে পারে আমার কিছুই নেই। আমার বাবার কোনো সম্পত্তি আমি পাবো না। তখন আমার দিকে আর ফিরেও তাকাবে না। আমি যে এতো গুলো মেয়েদের সাথে টাইম পাস করি সেইসব জানা সত্বেও ওই মেয়ে গুলো আমাকে ইমপ্রেস করার চেষ্টা করে। ভালো মেয়ে হলে, এসব শোনার পরও কখনোই আমার সাথে রিলেশনে জড়াত না। তোর কি মনে হয়, ওই মেয়ে গুলো শুধু আমার সাথেই কথা বলে? না রে পাগলা! তারা আমার মতো আরও অনেক ছেলের সাথেও রিলেশনশিপ এ জড়িয়ে আছে। যদিও অনেক মেয়েদের সাথে আমি টাইম পাস করেছি। তবে এই পর্যন্ত কোনো মেয়ের হাতটাও স্পর্শ করে দেখিনি। জাস্ট সাময়িক আনন্দের জন্য ওদের সাথে কথা বলি। এর বেশি কিছু না। ”

একটু থেমে লম্বা শ্বাস টেনে পুনরায় বলল,
” আমার হবু বউয়ের দেখা পাবো কবে? জানি না। কবে সে আমার জীবনে আসবে? সেটাও জানি না। তবে যেই মেয়ে আয়মান শিকদারের বউ হবে, তার মধ্যে অবশ্যই স্পেশাল কিছু থাকতে হবে। এমন কিছু যেটা বাকি মেয়েদের মধ্যে নেই। শুধু তার মধ্যে থাকবে। এমন কিছু, যার জন্য আমি তার প্রতি আসক্ত হয়ে পড়বো। সেই আসক্ততা এতোটাই প্রবল যে, এরপর আর অন্য কোনো মেয়ের প্রতি আকৃষ্ট হবো না। মেয়ে সুন্দরী না হলেও চলবে। শ্যামবর্ণের হলে আমার কোনো সমস্যা নেই। বরং শ্যামবর্ণের মেয়ে গুলো দেখতে ভীষণ মায়াবী হয়। ”

বলেই পেছন ফিরে হাঁটা ধরল। উদ্দেশ্য আগুনের ফ্ল্যাটে যাওয়া। ভার্সিটির গেইট পেরিয়ে গাড়ির জন্য অপেক্ষা করছে সে। পরমুহূর্তেই মনে পড়লো, আজকে তো গাড়ি আসবে না। যদিও আয়মান বেশির ভাগ সময়ই রিকশা করে বাড়ি ফিরে। তবে মাঝে মাঝে বাড়ির গাড়ি করেও ভার্সিটি যাওয়া-আসা করে। দুপুরের সময় বলে হয়তো গাড়ি চালানো পরিশ্রমী মানুষ গুলো খাবার খেতে গিয়েছে। রাস্তায় অনেক গাড়ি দাঁড়িয়ে। সেগুলোর মধ্যে কিছু সংখ্যক গাড়ির মালিক গাড়িতে নেই। আবার কিছু সংখ্যক গাড়ির মালিক গাড়িতে চোখ বন্ধ করে চুপ করে বসে আছে।

বিশেষ করে রিকশা গাড়ি গুলো সারিবদ্ধ ভাবে স্থির হয়ে এভাবেই দাঁড়িয়ে আছে। আয়মান ফোঁস করে নিঃশ্বাস ছেড়ে হাঁটতে শুরু করল। বাসে চড়া আয়মান একদম পছন্দ করে না। এভাবে ধাক্কাধাক্কি করে বাসে চড়তে বিরক্ত লাগে তার। তাছাড়া, বাসে অনেক মানুষের ভীড় থাকে যা আয়মানের অসহ্য লাগে। নয়তো, এত কষ্ট করে এই রৌদ্রজ্বল পিচ-ঢালা রাস্তায় হাঁটতে হতো না। বাসে করেই চলে যেতো। আয়মান হাঁটছে আর চারপাশে নজর বুলচ্ছে। পাশ কাটিয়ে অনেক রিকশাওয়ালা’ই চলে গিয়েছেন। তবে সেই রিকশা খালি ছিল না। যাত্রী ছিল রিকশার মধ্যে। আয়মান হতাশ হয়ে হাঁটতে থাকলো। একটা না একটা খালি রিকশা তো পাবেই।

বেশ কিছুক্ষণ হাঁটার পর হঠাৎ আয়মান থেমে গেল। ভ্রু কুঁচকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকাল রাস্তার ওপর প্রান্তে। লাঠিতে ভর দিয়ে একজন বৃদ্ধ লোক দাঁড়িয়ে আছে। রোদে দাঁড়িয়ে থাকতে লোকটির কষ্ট হচ্ছে নিশ্চয়ই? হয়তো রাস্তা পার হওয়ার চেষ্টা করছে কিন্তু পারছে না। ভরদুপুর হলেও রাস্তার মধ্যে গাড়ির আনাগোনা বেশ ভালোই দেখা যাচ্ছে। আয়মানের মায়া হলো। বড়ো ভাইয়ের মতো সেও পরোপকারী মানুষ। আয়মান চটজলদি রাস্তা পার হয়ে ওপারে গেল। বৃদ্ধর কাছে এসে হাসি মুখে দাঁড়িয়ে বেশ উচ্ছ্বসিত কন্ঠে বলল,
” দাদু, আপনি নিশ্চয়ই রাস্তা পার হতে চাচ্ছেন? কিন্তু পারছেন না। চিন্তা করবেন না। আমি আপনাকে রাস্তা পার করে দিচ্ছি। ”

বৃদ্ধ লোকটি কিঞ্চিৎ ভাঙা চশমার আড়াল থেকে হালকা ঘোলাটে চোখে আয়মানের দিকে তাকালেন। বৃদ্ধ লোকটিকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই, আয়মান তাকে ধরে সাবধানে রাস্তা পার করে দিলো। আয়মানের ঠোঁটে ফুটে ওঠে বিজয়ী হাসি। আয়মান জানে, কারো উপকার করলে সেই ব্যক্তি উপকারী মানুষটির প্রশংসা করে পাবলিকের কাছে ভাইরাল করে দেয়। বৃদ্ধ লোকটিও নিশ্চয়ই এখন তার প্রশংসা করে করে মাথায় তুলে নাচবেন। ভাবতেই কেমন খুশি খুশি লাগছে। আয়মানের ভাবনার মাঝেই বৃদ্ধ লোকটি ভাঙা গলায় চেঁচিয়ে উঠলো,

” এই হতচ্ছাড়া! তুই আমাকে রাস্তার এপারে কেন এনেছিস? কত কষ্ট করে এক ঘন্টা দাঁড়িয়ে থাকার পর একটা লক্ষী মেয়ে এসে আমাকে রাস্তা পার করে ওপারে নিয়ে গিয়েছিল। দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে হাঁটু ব্যথায় টনটন করছে। আর তুই আমাকে আবার রাস্তার এপারেই এনে দিয়েছিস? এখন আমাকে আবার রাস্তা পার হতে হবে। কিন্তু রাস্তার ওপারে এখন কে নিয়ে যাবে, শুনি? আমাকে এপারে কেন নিয়ে আসলি? আমি তোকে বলে ছিলাম? ”
আয়মান ভ্রু কুঁচকে বৃদ্ধ লোকটির দিকে তাকায়। তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে চেয়ে গমগমে গলায় জবাব দিল,
” এই জন্যই বলে লোকের ভালো করতে নেই। আপনি যখন রাস্তা পার হয়েই গিয়েছিলেন, তাহলে ওই খানে দাঁড়িয়ে ছিলেন কেন? নিজ গন্তব্যে প্রস্থান করতেন। ”
নিচের ঠোঁট কামড়ে দুষ্টু হেসে পুনরায় বলল,

” নাকি রাস্তায় সুন্দরী রমণীদের দেখার জন্য দাঁড়িয়ে ছিলেন? আরে লজ্জা পাবেন না কিন্তু! লজ্জা পাওয়ায় কিছু নেই। আমরা আমরাই তো। মানুষ বাহ্যিক ভাবে বুড়ো হলেও মন তো আর বুড়ো হয়ে যায় না, তাই না? তবে আফসোস একটাই। এখনকার মেয়েরা বয়স্ক সুগার ড্যাডি পছন্দ করে। আমার মতে নিষ্পাপ বাচ্চাদের চোখে দেখতে পায় না। সেজন্যই বলতে ইচ্ছে করে, বইন তোগো যৌবনে ঠা’ডা পড়বো। ”
বৃদ্ধ লোকটি হাতে থাকা লাঠি টা দিয়ে আয়মানের পেটে একটা গুঁতো মারল। তিরিক্ষি মেজাজ নিয়ে বলে,
” হতচ্ছাড়া! বেয়াদব! তোর জন্য আমার কতো সময় নষ্ট হলো। মেয়েটা হয়তো এখন আমাকে খুঁজছে। ”
আয়মান ব্যঙ্গ করে বলে ওঠে,

” হুহ্! জানতাম। মেয়ে ঘটিত ব্যাপার। এই আয়মান পুরোনো খেলোয়াড়, বুঝেছেন? তা মেয়েটা কে? তাকে ডাকেন। আমিও একটু দেখি। তরুণ ছেলেদের রেখে শেষে কি না এক বুড়ো লোকের প্রেমে পড়ল? ছ্যাঃ! ”
আয়মান নিজের বক্তব্য শেষ করার পরপরই কেউ একজন পেছন থেকে আমানের শার্টের কলার চেপে ধরল। মুহূর্তেই আয়মানের চোয়াল শক্ত হয়ে ওঠে। হাতের আঙুল গুটিয়ে শক্ত করে মুঠো করল। শিরায় শিরায় রক্ত টগবগিয়ে উঠছে। মুখে ফুটে উঠল তীব্র ক্ষোভ! তড়িৎ বেগে পেছন ফিরে আগুন্তকঃ কে না দেখেই বাম হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে সজোরে থাপ্পড় বসালো তার গালে।

কঠিন দৃষ্টি নিক্ষেপ করল সম্মুখের মানুষটির দিকে। একটা মেয়ে গালে হাত দিয়ে ওদিকে ফিরে আছে। মেয়েটির খোলা চুল অর্ধেক মুখের সামনে এসে পড়েছে। যার জন্য মেয়েটির মুখ দেখা যাচ্ছে না। তার মানে ও কোনো মেয়েকে থাপ্পড় মেরেছে? অমনি আয়মানের ললাটে প্রগাঢ় ভাঁজ পড়ল। কে এই মেয়ে? চেনা নেই? জানা নেই? আয়মানের কলার চেপে ধরার সাহস কোথা থেকে পেলো? বেশ হয়েছে, থাপ্পড় মেরেছে। মেয়েটা থাপ্পড় খাওয়ারই যোগ্য। কত বড়ো স্পর্ধা! আয়মানের কলার চেপে ধরে? মেয়েটি গাল থেকে হাত নামিয়ে এদিক ওদিক নজর বুলিয়ে কিছু খুঁজছে।

ওই তো, একটু দূরেই আধ ভাঙা একটি ইটের টুকরো দেখা যাচ্ছে। মেয়েটি চঞ্চল পায়ে হেঁটে গিয়ে ইটের টুকরো টা হাতে তুলে নিয়ে, দ্রুত আগের জায়গায় ফিরে আসে। আয়মান ভ্রু কুঁচকে শ্যামবর্ণের মেয়েটির দিকে তাকিয়ে আছে। মেয়েটির কাজল কালো চোখে ফুটে উঠেছে রাগের আভাস। ঠোঁটে ফুটে উঠেছে প্রতিবাদ করা কঠিন বাক্য বলার রেশ! মেয়েটি আয়মান’কে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই হাতে থাকা ইটের ভাঙা অংশটি দিয়ে সজোরে মাথায় আঘাত করল। আয়মান উচ্চতায় মেয়েটার থেকে বেশ ভালোই লম্বা। যার ফল স্বরূপ, আঘাত’টা গিয়ে লাগলো আয়মানের কপালে। ইটের আঘাতে কপালের বাম দিকে কিছুটা থ্যাঁতলে গিয়েছে। ইটের ক্ষুূদ্র কণা কপালের চামড়া ভেদ করে ঢুকে গিয়েছে। মুহূর্তেই ফিনকি দিয়ে গলগল করে রক্ত বের হতে শুরু করল। আয়মান মৃদু আর্তনাদ করে এক হাতে কপাল চেপে ধরল। চেপে ধরা হাতটা তাজা রক্তে লাল হয়ে উঠল। রক্তের ধারা আয়মানের হাত বেয়ে কনুই তে এসে জমা হচ্ছে। আর সেখান থেকে ফোঁটায় ফোঁটায় পিচ ঢালা উত্তপ্ত রাস্তার উপর পড়ছে।

মেয়েটি সাইড ব্যাগ থেকে পানির বোতল বের করে বৃদ্ধ লোকটি দিয়ে, একটা রিকশা গাড়ি ডেকে এনে বৃদ্ধ’কে রিকশায় উঠিয়ে ভাড়া মিটিয়ে বৃদ্ধ’কে তার ঠিকানায় পাঠিয়ে দিলো। আয়মানের কাছে এসে তার গলায় প্যাঁচানো ওড়না থেকে কিছু অংশ ছিঁড়ে আয়মানের কপাল প্যাঁচিয়ে, বার্তি অংশ টুকু মাথার পেছনে নিয়ে শক্ত করে বেঁধে দিলো। আরেকটা রিকশা গাড়ি ডেকে এনে আয়মান’কে নিয়ে দ্রুত ছুটলো কাছাকাছি কোনো এক হসপিটালে।

বাসায় আসার পর থেকে মোমের মন’টা ভীষণ খারাপ হয়ে আছে। তখন রাস্তার মধ্যে ঘটা ঘটনার জন্য না। এখন মন খারাপ এর কারণ, মাস্টার মশাই। বাসায় ফেরার পর থেকে আগুন মোম’কে ইগনোর করছে। এই যেমন, ফ্রেশ হয়ে দুপুরের খাবার খেয়ে মোম’কে বলেছে এখন আগুনের রুমে না থাকতে। আয়মানের রুমে চলে যেতে। সেখানে মিনা, ময়ূরীর সাথে সময় কাটাতে বলেছে। রেস্ট নিলে ওই রুমে থেকেই নিতে বলেছে। মিনা, ময়ূরীর কোনো অসুবিধা হচ্ছে না বরং তারা খুব খুশি। ময়ূরী তো বেশি খুশি। মোমের সাথে গল্প করতে পারবে। কতদিন এক সাথে বসে আড্ড দেওয়া হয় না। ময়ূরী, মোম’কে ভাবি’র থেকে বেশি নিজের ছোট বোন মনে করে। আয়মানের রুমের বিছানা’টা বেশ ভালোই বড়ো। আরামসে তাদের তিনজন এর জন্য জায়গা হয়ে যাবে। যেহেতু, তিনজনই মেয়ে। তাই চাপাচাপি করে শুয়ে পড়লেও কোনো সমস্যা নেই। মোম যেতে চায় নি। বলেছে, সে আগুন’কে কোনো ডিস্টার্ব করবে না। চুপটি করে বিছানায় শুয়ে থাকবে। কিন্তু আগুন, মোমের কথা শোনেনি। ধমকে রুম থেকে বের করে দিয়েছে। আর তারপর থেকেই মোমের মন খারাপ।

বাসায় ফিরে আগুন ব্যস্ত হয়ে পড়ল। কত কাজ বাকি। ডাক্তারের কাছে গিয়ে কতো সময় নষ্ট হয়ে গিয়েছে। ফ্রেশ হয়ে এসে রুমে বসে একটা ছোট্ট কাগজের মধ্যে কিছু লিখছে। লেখা হতেই সেটা ভাঁজ করে সাইডে রাখলো। ফোন’টা হাতে নিয়ে আয়মানের নাম্বারে কল করল। রিং হচ্ছে কিন্তু রিসিভ হচ্ছে না। পরপর কয়েকবার দিলো, তবুও ফোন ধরছে না। আগুন সচারাচর কাউ’কে এতবার ফোন করে না। শুধু একটা কাজের জন্য আয়মান’কে বারবার ফোন করছে। আগুনের মেজাজ খারাপ হচ্ছে। রাগে চোয়াল শক্ত হয়ে উঠেছে। আয়মান’কে একটা কাজ দিয়ে ছিল। আয়মান যদি কাজটা করতে না পারে আগুন’কে বলে দিতো। আগুন সামলে নিতো। একে দিয়ে একটা কাজ যদি ঠিকঠাক মতো হতো? সারাক্ষণ দুষ্টমি আর অন্যের পেছনে লাগা ছাড়া ওর যেন, আর কোনো কাজই নেই। আগুন ওঠে ড্রেসিং টেবিলে থাকা জগ থেকে গ্লাসে পানি ঢেলে ঢকঢক করে খেয়ে নিলো। দরজায় ঠকঠক শব্দ হতেই আগুন গিয়ে দরজা খুলে দিলো। মোম দাঁড়িয়ে আছে। মোমের চোখ দুটো ফোলা ফোলা। আগুন ভ্রু কুঁচকে মোম’কে আপাদমস্তক পর্যবেক্ষণ করল। হাত ধরে রুমে নিয়ে এসে দরজা বন্ধ করে দিলো। বিছানায় বসে নিজে পাশে বসলো। বুকের মধ্যে হাত গুঁজে গম্ভীর কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলো,

” রুমে আসতে নিষেধ করে ছিলাম না? তবুও কেন এসেছ?
মোম গাল ফুলিয়ে চুপ করে বসে আছে। কিছু বলছে না। আগুন আলতো করে মোমের চোয়াল চেপে ধরল। ভ্রু উঁচিয়ে গমগমে গলায় জানতে চাইল,
” কিছু বলার না থাকলে শুধু শুধু এসেছ কেন? যাও চলে যাও। ”

আগুনের কথায় মোমের চোখে পানি চলে এসেছে। এভাবে বলার কি আছে? মোম তো ইচ্ছে করে আসেনি। আসতে বাধ্য হয়েছে। আয়মানের রুমের বিছানায় এক সাইডে হাত লেগে জগ থেকে পানি পড়ে ভিজে গিয়েছে। মিনা, ময়ূরী কোনো রকম ম্যানেজ করে শুয়ে আছে। ভেজা জায়গাটা খালি। সেখানে তো আর মোম’কে শুতে দিতে পারে না। তাই মিনা বলেছেন মোম’কে আগুনের রুমে চলে যেতে। আগুন নিষেধ করায় মোম আসতে চায়নি। মিনা জোর করে পাঠিয়ে দিয়েছেন। মোম মুখ কালো করে বিছানা থেকে নেমে চলে যাওয়ার জন্য সামনের দিকে অগ্রসর হলো। দরজা খোলার আগেই আগুন এসে হাত টেনে পুনরায় বিছানায় এনে বসিয়ে দিলো। মোম হাত ছাড়ানোর জন্য ছটফট করছে কিন্তু আগুনের বলিষ্ঠ হাত মোমের কোমল হাতটা শক্ত করে ধরে আছে। হাত ছাড়াতে না পেরে মোম ডুকরে কেঁদে উঠল। আগুন হতভম্ব হয়ে গেল। মোমের কান্নার কারণ, আগুনের বোধগম্য হলো না। তৎক্ষনাৎ মোম’কে বুকে জড়িয়ে নিলো। মোম, আগুনের বুক থেকে সরে আসতে চাইল কিন্তু পারলো না। আগুনের বলিষ্ঠ হাত দু’টি মোম’কে মুক্তি দিলো না। মোম, আগুনের বুকের সঙ্গে মিশে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে। আগুন, মোমের মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়। মোমের কান্না কমে আসতেই আগুন শান্ত কন্ঠে শুধাল,

” এখন কান্না করার কোনো কারণ দেখছি না? কান্না করার মতো কিছু হয়েছে কি? তাহলে, শুধু শুধু কাঁদছ কেন? কান্না করার কারণ টা কি জানতে পারি? ”
ফুঁপিয়ে কান্না করার ফলে মোমের শরীর মৃদু কেঁপে কেঁপে উঠছে। আগুন আরও শক্ত করে মোমের ক্ষুদ্র শরীর’টা নিজের সাথে জড়িয়ে রাখলো। কপাল কুঁচকে কিছু একটা ভেবে চওড়া গলায় বলে উঠলো,
” তখন রুম থেকে চলে যেতে বলেছি বলে কাঁদছ? এতে কান্না করার কি আছে, মোম? আমার একটা ইমপোর্টেন্ট কাজ ছিল বলে তোমাকে রুমে আসতে নিষেধ করে ছিলাম। ”
মোম নিজেকে সামলে কাঁদো কাঁদো মুখ করে অভিমানী কন্ঠে বলে উঠলো,

” দুপুরে খাওয়ার পর রুমে আসতে নিষেধ করায় কাঁদছি না বরং কিছুক্ষণ আগে এভাবে রুম থেকে চলে যেতে বলেছেন বলে, কষ্ট পেয়েছি। এমন ভাবে রুম থেকে বেরিয়ে যেতে বললেন, মনে হলো আমি এ বাসার আশ্রিতা। মানুষ’টা ছোট হতে পারি। হয়তো অনেক কিছু সঠিক ভাবে বুঝতে পারি না। তাই বলে ভাববেন না, আমার আত্মসম্মান নেই। আয়মান ভাইয়ার রুমে বিছানায় একাংশ পানি পড়ে ভিজে গিয়েছিল বলে মা আমাকে আপনার রুমে চলে আসতে বলেছেন। আমি আসতে চাইনি। আমি তো জানতাম, আপনি কাজ করছিলেন। সেজন্যই তো আসতে চাইনি। মা এতবার বলায় ওনার কথা ফেলতে পারিনি। ভেবেছিলাম ড্রয়িংরুমে থেকে যাবো তবুও আপনার রুমে এসে, আপনাকে বিরক্ত করবো না। কিন্তু মা আমাকে ড্রয়িংরুমে দেখলে খারাপ ভাবতেন। তাই আপনার রুমে চলে আসতে হলো। আমি আন্তরিক ভাবে দুঃখিত। এরপর থেকে বিষয়টা খেয়াল রাখবো। তবে আপনার কথায় মোম কষ্ট পেয়েছে মাস্টার মশাই। মোমের বুকে ব্যথা করছে। ”

বলতে বলতে মোমের চোখ দুটো আবারও জলে টইটম্বুর হয়ে গেল। আগুনের খারাপ লাগলো। এভাবে বলা উচিত হয় না। মেয়েটার ক্ষুদ্র মস্তিষ্কে আগুনের কথার বাজে ইফেক্ট পড়েছে। এতটাই বাজে ইফেক্ট পড়েছে যে, মেয়েটা নিজেকে আশ্রিতা ভেবে বসেছে! আগুন তো চাইলে কাজ করার জন্য নিজে ড্রয়িংরুমে বা বারান্দায় চলে যেতে পারতো। কি দরকার ছিল মোম’কে রুম থেকে বেরিয়ে যেতে বলার? তবে মোমের সরল স্বীকারোক্তি আগুন’কে মুগ্ধ করেছে। অনেক বউরা তো ভেতরে ভেতরে অভিমান পুষে রেখে কতো টালবাহানা করে। সেই হিসেবে আগুনের বউ’টা তো চমৎকার। আগুন দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। মোম’কে বুক থেকে সরিয়ে খসখসে দু’হাতের অঞ্জলিপুটে মোমের মুখশ্রী তুলে নিলো। বউয়ের কপালে দৃঢ় ভাবে নিজের ওষ্ঠ ছুঁয়ে দিলো। মোম চোখ বন্ধ করে নিলো। মুহূর্তেই অক্ষিকোটরে জমানো নোনাপানি গড়িয়ে পড়ল গালে। আগুন সেই পানি মুছে দিয়ে শীতল গলায় বলল,

” সরি, মোম। মোম’কে কষ্ট দেওয়ার জন্য মোমের মাস্টার মশাই, এতো গুলো সরি। আর কক্ষনো এভাবে বলবো না। আমি তোমাকে কষ্ট দেওয়া তো দূরে থাক, কষ্ট দেওয়ার কথা চিন্তাও করতে পারি না। ”
মোম মায়া ভরা নয়নে তাকায় স্বামীর আদলে। লম্বা শ্বাস টানলো আগুন। মোমের চোখের দিকে চেয়ে পুনরায় কন্ঠ খাদে এনে রাশভারী গলায় বলল,
” আর বারবার আপনার রুম আপনার রুম বলছো কেন? বলবে আমাদের রুম। আমার যা কিছু আছে, সবকিছুতে তোমার সমান অধিকার আছে। নিজেকে কখনো ছোট ভাববে না। মনে রেখে, তোমার মাস্টার মশাই সর্বদা তোমার সাথে আছে। আর মন খারাপ করো না। ঠিক আছে? ”
মোম মাথা নিচু করে ব্যগ্র কন্ঠে জবাব দিল,

” আচ্ছা। ”
আগুন ভ্রু কুঁচকে চওড়া গলায় জানতে চাইল,
” সত্যি, আর মন খারাপ করবে না তো? ”
মোম দু দিকে মাথা নেড়ে বুঝালো, সে মন খারাপ করবে না। আগুন নিরেট স্বরে বলল,
” তাহলে একটু হাসো। ”
মোম মুখ গোমড়া করে রাখলো। আগুন, মোমের ঠোঁটে আঙুল ছুঁয়ে শীতল কণ্ঠে বলল,
” না হাসলে মনে করবো, এখনো রাগ করে আছো। একটু হাসোনা ছকিনার মা! ”

লাস্টের কথাটা আগুন সুর টেনে বলল। মোম ফিক করে হেসো ফেলল। মোমের হাসি দেখে আগুনেরও অধর কোণে হাসি ফুটে উঠল। আগুন প্রশান্তির নিঃশ্বাস ত্যাগ করল। বউয়ের যে এতো জ্বালা সেটা আগুন হারে হারে টের পাচ্ছে। বিয়ে না করলে তো কখনো জানতেই পারতো না বউরা এতো ছিঁচ কাঁদুনে হয়! আশানুর প্রায়ই ফোন করে আফিফা তাকে কিভাবে জ্বালিয়ে মারে সেসব আগুন’কে বলতো।

এতে আগুনের কোনো ভাবান্তর হতো না। কিন্তু এখন নিজের বউ কথায় কথায় কেঁদে ফেলায় আশানুরের কষ্ট’টা কিছুটা হলেও উপলব্ধি করতে পারছে। ভাগ্যিস মোম, আফিফার মতো ত্যাড়ামি করে না। আগুনের সকল কথা মেনে চলে। মোম কতো শান্তশিষ্ট। নয়তো, বদরাগী আগুনের সাথে দুই’দিনও সংসার করতে পারতো না। মিনা ঠিকই বলেছেন, মোম ভীষণ লক্ষী একটা মেয়ে। এই প্রথম বাবা’কে মনে মনে ধন্যবাদ জানালো, আগুন। এতো মিষ্টি একটা বউ এনে দেওয়ার জন্য। রাশেদের সাথে কোনো এক অজানা কারণেই আগুনের বনিবনা হয় না। আগুন বিছানা থেকে উঠতে উঠতে মোম’কে উদ্দেশ্য করে বলল,

” শোন, এখন একটু ঘুমিয়ে নাও। বিকেলে ময়ূরীকে নিয়ে শপিংমলে চলে যেও। আয়মান থাকবে তোমাদের সাথে। সেজন্য কোনো অসুবিধা হবে না, আশা করি। ”
মোম চঞ্চল কন্ঠে শুধাল,
” কেন যাবো? ”
” শপিংমলে মানুষ কি করতে যায়? অবশ্যই শপিং করতে যায়, তাই না? ”
মোম চনমনে কন্ঠে বলল,
” কিন্তু আমার তো শপিং করার কোনো প্রয়োজন নেই। সবকিছুই আছে। ”
আগুন বিরক্ত হলো। ধমকে ওঠে বলল,
” হাজার থাক! তবুও আমি যখন বলেছি তুমি শপিং এ যাবে মানে যাবে। কথার অবাধ্যতা আমি পছন্দ করি না মোম। ”
মোমের মুখটা চুপসে গেল। গোমড়া মুখে জবাব দিল,

” ঠিক আছে। যাবো। আপনি যাবেন না? ”
” না। আমার একটা কাজ আছে। সেখানে যেতো হবে। ”
” কোথায় যাবেন? ”
” এতো কথা বলছো কেন? যেটা বললাম সেই কাজ’টা করো। ”
” আমার ঘুম আসছে না। আমি এখন ঘুমাবো না। ”
” ঘুম না আসলে চুপ করে শুয়ে থাকো। ”
মোম ব্যগ্র গলায় বলে ওঠে,

” এখন শুতে ইচ্ছে করছে না। চলুন, আমরা বসে বসে গল্প করি। ”
আগুন ফোঁস করে নিঃশ্বাস ছেড়ে কপট রাগ দেখিয়ে বলল,
” আমার গল্প করার সময় নেই। বললাম না কাজ আছে। কথা কেন শুনছো না, মোম? ”
মোম ঠোঁট উল্টে বলল,
” শুতে মন না চাইলে, সেটা আমার দোষ নাকি? ”
” আচ্ছা, তাহলে তুমি বসে থাকো। ”
আগুনের গা ছাড়া ভাব মোমের পছন্দ হলো না। কিঞ্চিৎ রাগ নিয়ে বলল,
” দূর! আমি শপিং করতে যাবো না। ”

আগুম চোয়াল শক্ত করে দাঁতে দাঁত চেপে বলল ,
” তুমি যদি এখন আমার কথা না শোন, আমি এক্ষুনি বাসা থেকে বেরিয়ে যাবো। সারা’রাতের মধ্যে একবারও বাসায় ফিরবো না। ”

শুভ্ররাঙা ভালোবাসা পর্ব ১৯

আগুনের ঝাঁঝালো কথায় মোম আঁতকে উঠল। আগুন বাসা থেকে চলে যাবে, এটা মোম কখনোই মানতে পারবে না। দ্রুত বিছানায় গিয়ে শুয়ে পড়ল। মোমের দিকে চেয়ে আগুন চক্ষু হাসলো। বউ’কে জব্দ করতে আগুন ভালোই পারে। কালকে মোম শপিং করতে না গেলে সারপ্রাইজ’টা দিবে কিভাবে? সেজন্য মোম’কে শপিংয়ে পাঠানো অত্যন্ত জরুরী।

শুভ্ররাঙা ভালোবাসা পর্ব ২১