তোমাতেই আসক্ত পর্ব ২
তানিশা সুলতানা
“আমার শরীর ভালো নেই ভাবি। রান্না করতে পারবো না।
ক্লান্ত ভঙ্গিমায় সোফায় গা এলিয়ে দিয়ে বলেন আতিয়া বেগম৷ বেশ কয়েকদিন যাবত গা গুলচ্ছে তার। মাছ মাংস খেতে পারছে না৷ মাথা ঘুরিয়ে বারংবার বমি আসছে। বয়স তার পঁয়তাল্লিশ ছুঁয়েছে। চেয়ারার জৌলুশ কমে এসেছে। চোখের নিচে কালি, দুই একটা চুলও সাদা হয়েছে।
শশুরের মৃত্যুর পরে তিনি স্বেচ্ছায় ভাসুরদের সাথে এক বাড়িতে থাকেন। দুটো ভাসুর খুবই স্নেহ করলেও তাদের বউ খুব একটা ভালো চোখে দেখেন না আতিয়া বেগমকে। সুযোগ পেলেই কটাক্ষ করতে ভুলে না৷
রাজিয়া বেগম লক্ষ করে আতিয়া বেগমকে। বলবে বলবে করেও বলা হয় নি। আজকে কপাল কুঁচকে বলেই ফেলে
” কাল দেখলাম বমি করলে। মাছ খেতে পারলে না। ঘটনা কি? স্বামী ম রে ছে এতো বছর হয়ে গেলো। সন্তানরা ফেলে রেখে গেছে। এই সুযোগে কার সাথে শু ****য়ে ছিলে?
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
বড় ভাবির কথায় কোনো প্রতিক্রিয়া করেন না আতিয়া বেগম। যৌবন কালে যখন স্বামী পরলোক গমন করেছিলেন। তখন বাবা ভাই বহুবার বলেছিলো “আতিয়া নতুন করে জীবন কর। এভাবে দিন যাবে না”
আতিয়ার মন গলাতে পারে নি। সম্পর্ক ছিন্ন করেছিলেন বাবা ভাইয়ের সাথে।
তাচ্ছিল্য হাসি ফুটে ওঠে আতিয়ার ঠোঁটের কোণে। রাজিয়ার বিরক্তি আকাশ ছুঁই ছুঁই। বারংবার এগিয়ে আসেন ঝগড়া বাঁধাতে কথা কাটাকাটি করতে। কিন্তু পারে না। মাঝেমধ্যে তিনি হতাশ হয়। মনে মনে ভাবে “আতিয়া বেগম মানুষ না কি অন্য কিছু”
তবে আজকে তিনি ছাড়বেন না যেনো পণ করেছে। এগিয়ে এসে বসে আতিয়ার পাশে এবং বলেন
“তুমি কি ব্যাপারখানা ভেবে দেখছো না? দুটো সন্তানের মা হয়েছো। এই লক্ষণ গুলোর সাথে পরিচিত তুমি। কোনো অঘটন ঘটিয়ে ফেললে আগেই বলো। আমরা ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাবো। এবোর্সন করিয়ে আনবো। ঝামেলা মিটিয়ে ফেলবো।
চোখ খুলে আতিয়া। শান্ত দৃষ্টিতে পর্যবেক্ষণ করেন রাজিয়া বেগমকে৷ কি অবলীলায় বলে ফেললো কথা গুলো। তার সন্তানরা কাছে থাকলে নিশ্চয় তাকে এভাবে অপমান করতে পারতো না কেউ।
আদ্রিতা এ্যানিকে কোলে নিয়ে এগিয়ে আসে। বড় মায়ের বলা কথা গুলো সে শুনেছে। অপেক্ষায় ছিলো মা কখন প্রতিবাদ করবে? কখন বলবে ” ভাবি এসব কিছু না। তুমি চিন্তা করিও না”
কিন্তু আদ্রিকে হতাশ করে দিয়ে চুপ থাকে আতিয়া। চোখ দুটো টলমল করে ওঠে। রাজিয়ার মুখোমুখি দাঁড়ায় এবং কাঠ কাঠ গলায় বলে
“বড় মা।
আমার মাকে এমন কথা বলবেন না। তিনি ফুলের মতো পবিত্র। আপনার মন মানসিকতা পরিবর্তন করা দরকার
রাজিয়া দাঁড়িয়ে পড়ে। তেড়ে আসে আদ্রির দিকে। উচ্চস্বরে বলে
” কে কেমন আমি জানি না? দুটো চোখে সব তো দেখি। পাশের বাড়ির আফজালের ঘন ঘন বাড়িতে আসার কারণ বুঝি না আমি? নেহাৎ আমরা ভালো মানুষ তাই চুপ করে থাকি।
এ্যানি মিউ মিউ আওয়াজ তুলে। যেনে সে বুঝতে পেরেছে মহিলাটি আদ্রিকে বকা দিচ্ছে।
রাজিয়া বিড়ালের পানে তাকায়৷ পরপরই বলে
“তোর পবিত্র মাকে বলিস বাচ্চা নষ্ট করতে। বিধবা মানুষ। চাহিদা থাকতেই পারে। তাই বলে আমাদের মানসম্মান ডুবাতে দিবো না।
আর তুই ই বা কি বোঝাবি তুই ও তে বিধবা
আতিয়া বেগমও দাঁড়িয়ে পড়ে। চোখ দুটো ছলছল করছে তার। এতোক্ষণের এতো কথা তার গায়ে না লাগলেও এবারে কলিজায় লেগেছে। ধরে আসা গলায় মিনতি করে বলে
“এমন কথা বলবেন না ভাবি৷ আদ্রিতা বিধবা নয়৷ ও কখনোই বিধবা হবে না।
আদ্রি মুখ বাঁকিয়ে বলে
“আপনার বোধহয় স্মৃতি শক্তি হারিয়ে গিয়েছে। আপনি ভুলে গিয়েছেন৷ আমার বিয়ে হয় নি। মা তুমিও না। এর কথা শুনো না তো।
রাজিয়া আরও কিছু বলতে যাবে আতিয়া তার হাতটা মুঠো করে ধরে। ইশারায় মিনতি করে কিছু না বলতে। মুখ বাঁকায় রাজিয়া৷ আতিয়া বেগম এর থেকে হাত খানা ছাড়িয়ে নেয় ঝাড়া দিয়ে৷ রাগ তার আকাশ ছুঁই ছুঁই। আদ্রির গালে কষে একটা থা প্প ড় দিতে পারলে শান্তি লাগতো। সাহস কতো তাকে বলে তার না কি স্মৃতি শক্তি হারিয়েছে।
” তুই তোর মাকে নিয়ে বেরিয়ে যেতে পারিস না এই বাড়ি থেকে? আমাদের একটু শান্তি দিতে পারিস না?
আদ্রিও সমান তালে বলে
“এই বাড়িটা বড় মায়ের ছেলের৷ তাহলে এখান থেকে তোমরা বের
বাকিটা শেষ করার আগেই রাজিয়া বেগম এর হাত উঠে যায় আদ্রির গালে। খুবই শক্ত একটা থা প্প ড়ে চুপ করিয়ে দেয়। মাথা ভনভন করছে আদ্রির। কিছু মুহুর্ত চোখ বন্ধ করে দাঁড়িয়ে থাকে। কানে আসে আতিয়া বেগম এর আর্তনাদ। অনুভব করে নরম তুলতুলের এক খানা হাত জড়িয়ে ধরেছে আদ্রিকে।
থেমে নেয় রাজিয়া। উচ্চস্বরে বলেই চলেছে
” বাইরের মেয়ে হয়ে আমাকে এসব বলার সাহস কোথায় পায়? মুখ বেড়ে গিয়েছে? একদম ভে ঙে গু ড়ি য়ে দিবো। আবরার একটা চোর। সে চুরি করে আমার শশুরের থেকে বাড়ি লিখে নিয়ে নিখোঁজ হয়েছে। আমাদের ঘাড়ে রেখে গিয়েছে উটকো ঝামেলা। তার মা একটা বেহায়া মহিলা। বুড়ো বয়সে পে ট বাঁধিয়েছে।
এমন আর অনেক কিছু। আদ্রি চোখ খুলে। তার কোলে থাকা এ্যানি মিউ মিউ আওয়াজ তুলে বকা দিচ্ছে রাজিয়া বেগমকে। কতো বড় সাহস তারই মনিবের গায়ে হাত তুলেছে। আদ্রি কোল থেকে নামালে এতোক্ষণে খামচে দিতো রাজিয়াকে৷ আতিয়া বেগম স্নেহ মাখা হাত বুলিয়ে দেয় আদ্রির গালে। কপাট রাগ দেখিয়ে বলে
“বেশি কথা কেনো বলিস তুই? চুপ থাকা যায় না?
আদ্রি মৃদু হেসে মাথা ঠেকায় আতিয়া বেগম এর বুকে এবং ধরে আসা স্বরে বলে
“চলো না মা আমরা দূরে কোথাও চলে যাই। যেখানে তুমি আমি ছাড়া কেউ থাকবে না৷ আমাদের শান্তির একটা সংসার হবে।
জবাব দেয় না আতিয়া বেগম। মনে মনে বলে
“আমাদের কপালে শান্তি লেখা নেই রে মা। আমরা যে পোরা কপাল নিয়ে দুনিয়ায় এসেছি। আমার আবরার আমাদের দুখের সাগরে ভাসিয়ে দিয়েছে।
সুইজারল্যান্ড এর জুরিখ শহর নির্জন এবং নিস্তব্ধ। বাংলাদেশের মতো যানজট, শব্দ দূষণ, কোলাহল এসবের অস্তিত্ব নেই। ভোরের আলো ফুটেছে বেশ কয়েক ঘন্টা আগেই৷ কর্মজীবী মানুষ জন ছুটে চলেছে নিজ নিজ কর্মস্থলে। রোডের সাথে অবস্থিত ছোট বাড়িটিতে এখনো আলো জ্বলে নি। বাড়ির ভেতরটা অন্ধকারে ছেয়ে আছে। যেনো সূর্য মামা এখনো ওঠে নি৷
বাড়ির মেইন ফটক পেরুলেই নজরে পড়ে বিশাল ড্রয়িং রুম৷ বড় বড় চার খানা সোফা চারিপাশে বসানো। মাঝখানে টি-টেবিল। সেই টেবিলের ওপরে আর্কিট ফুলের একখানা টব রাখা।
বাম পাশে কিচেন৷
এবং সোজাসুজি সিঁড়ি। সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠলেই নজরে পড়বে দুটো রুম। একটা রুমের সামনে বড়বড় অক্ষরে লেখা “Abrar Tasnin” অপর রুম খানা হতে হাই তুলতে তুলতে বেশ হয় সিয়াম। ঘুম তার এখনো পুরোপুরি কাটে নি৷ চোখ দুটো যেনো লেগে আসছে৷ হাতে বড় এক খানা ফোন। দৃষ্টি তার এখনো ফোনের স্কিনে। ললাটে তিনটে ভাজ পড়েছে। মূলত ঘুম ছোটানোর উদ্দেশ্যে ফেন খানা হাতে তুলে ছিলো। ফেসবুকের নিউজফিড ঘাটতে ঘাটতে হঠাৎ নজর আটকেছিলো এড ফ্রেন্ডে আসা একটা আইডির পানে। তখুনি তরিঘরি করে বিছানা ছেড়েছে সে।
সিয়াম আবরারের কক্ষের দরজায় টোকা দেয়। দৃষ্টি পড়ে নেইম-প্লেটের ওপর। বিরবির করে একবার নাম খানা পড়ে নেয়। পরপরই মুখ বাঁকায়৷
“শালা তোর নাম আবরার সেটা আমরা জানি৷ আমাদের জানাতে হবে না।
পরপরই আবারও টোকা দেয়। ভেতর হতে কোন সাড়াশব্দ পাওয়া যায় না৷
বিরক্ত হয়ে সিয়াম দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকে পড়ে। ডান পাশে থাকা সুইচবোর্ডের বাটন টিপে রুমটা আলোকিত করে।
কোমর ওবদি কম্বল জড়িয়ে ঘুমিয়ে আছে আবরার। বড় বড় চুল গুলো এলোমেলো। দুই হাত ওপর দিকে দিয়েছে। ফর্সা বুকের কালো কয়লার ঠিক ওপরে সাদা রংয়ের ব্যান্ডেজ জড়ানো৷ নাভির বাম পাশেও ওয়ান টাইম ব্যান্ডেজ। কপালে র ক্ত শুকিয়ে টানটান হয়ে আছে।
সিয়াম এগিয়ে যায়৷ আবরারের শরীর হতে কম্বল টান মেরে নিয়ে নেয়৷ হাত বাড়িয়ে কাটা জায়গা গুলো ছুঁয়ে দেয় আলতো করে। পরপরই বলে
” আবরার ব্রো অহনা ছাড়াও তোর আরও একটা বোন আছে?
আগে তো বলিস নি। কি কিউট রে তোর বোন৷ আন্টির সাথে পিকচার আপলোড করেছে ফেসবুকে।
আবরার চোখ খুলে। তাকায় সিয়ামের পানে। বা ভ্রুটা উঁচু করে। ব্যাসস সিয়াম বুঝতে পারে।
“কথা বলতে কি প্রবলেম তোর। সব সময় এমন ইশারা কেন করিস? মাঝেমধ্যে মনে হয় আমি তোর বউ বাচ্চাদের নিয়ে সময় কাটাচ্ছি। তোর জোর রোমাঞ্চ পেয়েছে তাই ইশারায় ডাকছিস কাছে যেতে৷
সিঙ্গেল লাইফে এমন ইশারা কতোটা যন্ত্রণাদায়ক বুঝিস তুই?
আবরার ধীরে সুস্থ উঠে বসে। বা হাতে চুল গুলো পেছনে ঠেলে হামি তুলে। দেয়ালে টাঙানো ঘড়ির পানে নজর বুলিয়ে সময় দেখে নেয়। পরপর গম্ভীর স্বরে বলে
” স্টপ দ্যা ড্রামা এন্ড টেল মি হোয়াট হ্যাপেন্ড?
সিয়াম ধপ করে বসে পড়ে আবরারের পাশে৷ ফোন খানা এগিয়ে দেয়। সেখানে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে আতিয়া বেগম এর কাঁধে মাথা রেখে দূরে অবস্থিত সাগর দেখাচ্ছে একটা মেয়ে। নীল রংয়ের টপস এবং কালো জিন্স পরনে তার। গলায় ঝুলছে নীল রংয়ের ওড়না। লম্বা চুল গুলো হাঁটু ছাড়িয়ে গিয়েছে। আবরারের চোখ আটকায় ক্যাপশনে। সেখানে লেখা রয়েছে
“আই উইশ আমার জীবনে একজন সুপারহিরো আসতো। আমাকে আর আমার মাকে নিয়ে চলে যেতো অনেক দূরে। যেখানে সবাই আমাদের ভালোবাসতো এবং সম্মান করতো।
সিয়ামের ফোন খানা শূন্যে ছুঁড়ে মারে আবরার। রুম ছাড়িয়ে বেলকনি পেরিয়ে তার স্থান হয় বাগানে। ইতোমধ্যেই চোয়াল শক্ত করে ফেলেছে। লাল লাল আঁখি দুটোয় যেনে আগুন ঝড়ছে স্তব্ধ সিয়াম খানিকক্ষণ তাকিয়ে থাকে আবরারের মুখ পানে। পরপরই কাঁদো কাঁদো স্বরে বলে
“আমার ফোন তোর কি ক্ষতি করেছিলো ভাই? পাঁচ দিন হলো ফোন টা কিনেছিলাম।
ফোঁস করে শ্বাস টানে আবরার। চোখ বন্ধ করে কিছু একটা চিন্তা করে। তারপট খাটের পাশে থাকা টি-টেবিলের ওপরে থাকা চার্জার হতে ফোন তুলে ব্যস্ত ভঙ্গিমায় কিছু করতে করতে সিয়ামকে আদেশের স্বরে বলে
” দুটো টিকেট এর ব্যবস্থা কর ইমিডিয়েটলি।
ফেনের শোক ভুলে চিন্তিত হয়ে পড়ে সিয়াম। পরপরই ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটে ওঠে। বাই এনি চান্স আবরার কি তার জন্যই মেয়েটিকে এখানে আনার ব্যবস্থা করছে?
” তোর বোনকে এখানে আনবি? আগেই বলে রাখছি তাকে কিন্তু আমি বিয়ে করবো। প্রেম ট্রেম করবো না।
আবরার তাকায় সিয়ামের পানে। মুহুর্তেই সিয়াম এক দৌড়ে বেরিয়ে পড়ে রুম হতে। প্রথমে বাগানে যেতে হবে। ফোন খানা আস্ত থাকলেই হলো।
তোমাতেই আসক্ত পর্ব ১
আবরার বিরবির করে আওড়ায়
“আই উইল কিলল হার
তার সাহস হলো কি করল আমার আম্মুর পিকচার ফেসবুকে আপলোড দেওয়ার?