দোলনচাঁপার সুবাস পর্ব ৬৬

দোলনচাঁপার সুবাস পর্ব ৬৬
তাসফিয়া হাসান তুরফা

নিশীথের বুকে দোলা আরামে ঘুমোলেও ওর চোখে ঘুম নেই। এতমাস পর নিজের চিরচেনা রুমে, নিজের গন্ডিতে ফিরে আসার মুহুর্তটা কেমন হতে পারে নিশীথ কল্পনা করেনি! ও ভেবেছিলো যেদিন বাবা মন থেকে দোলাকে মেনে নিয়ে নিজ হতে ওদের ডাকবে সেদিন ও ফিরে আসবে নিজের ঘরে। কিন্তু জীবন বড়ই বিচিত্র, কখন কার সাথে কি ঘটে যায় মানুষ বুঝতেও পারেনা! যতই আগে থেকে পরিকল্পনা করে রাখুক না কেন, হবে তো সেটাই যেটা স্রষ্টা ঠিক করে রেখেছেন।

—আপনার বুক এত জোরে ধুকপুক করছে কেন? শরীর খারাপ লাগছে?
আচমকা দোলার গলায় নিশীথের ধ্যান ভাঙে। নিজ হতেই চোখ চলে যায় ওর বুকে শায়িত দোলার উপর, যে আপাতত চিন্তিত মুখে নিশীথের পানে চেয়ে আছে। নিশীথ অবাক হয়ে বলে,
—তুমি ঘুমাওনি? আমি তো ভেবেছিলাম তুমি ঘুমিয়ে গেছো।
—আপনি টেনশন করলে আমি কিভাবে ঘুমাতে পারবো?
দোলা এরই মাঝে উঠে বসে। ওর দেখাদেখি নিশীথও উঠে বসলো। একটা শ্বাস ছেড়ে বললো,
—তেমন কোনো টেনশন করছিলাম না, দোলনচাঁপা। তুমি অযথাই ভাবছো!
—টেনশন না করলে আপনার হার্টবিট বাড়বে কেন? আপনি নিশ্চয়ই কিছু একটা নিয়ে চিন্তা করছিলেন আমি জানি। আমায় সব বলুন! এক্ষুনি!

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

দোলার জোরাজোরিতে নিশীথ শেষমেশ মুখ খুলে। ওকে বুঝায়, এতমাস পর নিজের বাসায় নিজের চিরচেনা গন্ডিতে ফিরে এসে ওর ঠিক কিরকম অনুভূতি হচ্ছে! যে জীবন ছাড়া নিশীথ অন্য কোনো জীবন কল্পনাও করতে পারতোনা, সেই জীবন ছাড়ার আগে কম চিন্তাভাবনা করেনি ও। নিজেকে চ্যালেঞ্জ করে এতবড় স্টেপ নিয়েছে। নিশীথ নিজের কাছে প্রতিজ্ঞা করেছিলো সবকিছু স্বাভাবিক না হওয়া অব্দি সে এখানে থাকতে আসবেনা কিন্তু আজ ওর সেই প্রতিজ্ঞা ভেঙে যাওয়ায় মনে মনে সে নিজের প্রতি ভীষণ ক্ষিপ্ত!

দোলা এতক্ষণ বেশ মনোযোগ দিয়ে নিশীথ সব কথা শুনছিলো। একদিন বিপদে পড়ে বাসায় থাকতে হচ্ছে, এটাতেও এতকিছু ভেবে মনে মনে কতই না ধারণা পুষছে নিশীথ। ভীষণ জেদি মানুষদের এই একটা সমস্যা। একবার একটা কিছুর জেদ ধরলে সেটা পূরণ না হওয়া পর্যন্ত ওদের এই খুতখুত স্বভাব যাবেনা! দোলা বাস্তবিক দিক থেকে বিষয়টা বুঝলেও নিশীথ ওর মতো তৎক্ষণাত বুঝবেনা। তাই ওর মন বদলাতে দোলা বলে,

—আপনি কার জন্য বাড়ি ছেড়েছিলেন?
—মানে?
—জিজ্ঞেস করলাম আপনি কার জন্য এ বাড়ি ছেড়ে চলে গিয়েছিলেন?
দোলার প্রশ্নে নিশীথ ভ্রু কুচকায়। বলে,
—তোমার জন্য, দোলনচাঁপা। এ আবার কেমন প্রশ্ন?
—জরুরি প্রশ্ন। এবার আরেকটি প্রশ্নের উত্তর দিন
দোলা গম্ভীর মুখে বলে। নিশীথ আর মাথা না ঘামিয়ে জবাব দেয়,
—বলো
—আপনি আজ রাতে কার জন্য এ বাসায় থাকছেন?
—তোমার জন্য!

নিশীথ জবাব দেওয়ার সাথে সাথেই থেমে যায়। ও থামতেই দোলা মুখ ঘুরিয়ে ওর দিকে চায়। নিশীথ বিস্মিত দৃষ্টিতে তাকাতেই দোলা বলে,
—এবার পেয়ে গেছেন আপনার দ্বিধার জবাব?
নিশীথ চুপ করে থাকে। দোলা ওর বুক থেকে উঠে নিশীথের ঠিক সোজাসুজি বসে! নিশীথ একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকায় ওর গালে হাত রেখে বলে,
—যার জন্য আপনি বাড়ি ছেড়েছিলেন তার জন্যই আজ বাড়িতে এসেছেন। যে বাবার কথায় আপনি চলে গিয়েছিলেন আজ সেই বাবাই আপনার দোলনচাঁপাকে নিজ থেকে এখানে থাকতে অনুরোধ করেছেন, এটাই কি আপনার মনকে শান্ত করার যথেষ্ট নয়?

এবার নিশীথের কুঞ্চিত ভ্রুযুগল শিথিল হয়। দোলার কথাগুলো যেন কোনো এক আশ্চর্য জাদুবলে ওর মনের মাঝে চলমান দ্বিধার গতিকে মন্থর করতে সক্ষম হয়! নিশীথের ঠোঁটের কোণে সূক্ষ্ম হাসির রেখা দেখা যায়। তা দেখে দোলা ভ্রু নাচায়। নিশীথ মুহুর্তে ওকে বুকে জড়িয়ে ধরে। দুহাতে দোলার নরম দেহখানা বদ্ধ করে বলে,
—তুমি এত সহজে কিভাবে আমাকে বুঝতে পারো বলো তো? কত ইজিলি আমার মন ঠান্ডা করে দিলে। কি জাদু জানো, দোলনচাঁপা?
দোলা হাসলো নিশীথের কথায়। ওকে আরেকটু নিবিড়ভাবে জড়িয়ে ধরে বললো,
—এটা তো ভালোবাসার জাদু, তালুকদার সাহেব। এটা শিখেছি আপনার থেকেই!
অতঃপর দুজনেই হাসলো কিছুক্ষণ। একে-অপরের সান্নিধ্যে প্রশান্তি খুজে পেলো।

পরদিন ভোর পৌনে ছয়টা বাজে। ইউনুস তালুকদার বরাবরের ন্যায় ফজরের নামাজ পড়ে কুরআন শরীফ পড়ছিলেন রুমে বসে। হঠাৎ দরজা খোলার শব্দ হওয়ায় সেদিকে তাকিয়ে দেখলেন নিশান এসেছে তার রুমে। এত ভোরে নাতিকে উঠতে দেখে স্বভাবতই তিনি অবাক হলেন। পবিত্র গ্রন্থ পড়ায় ইতি টেনে চশমা খুলে রেখে উঠে দাড়ালেন। নিশান এগিয়ে এসে দাদুর সাথে বিছানায় বসলো। ইউনুস সাহেব বললেন,
—কি ব্যাপার, ভাইজান? এত্ত সকাল সকাল দাদুকে মনে পড়লো যে?
বুড়োর কথায় নিশান হেসে বললো,

—জেটল্যাগ হচ্ছে রে, দাদু। কয়েকদিন হলো এসেছি তবুও হঠাৎ হঠাৎ ভোর করে ঘুম ভেঙে যায়। আরও সময় লাগবে মেইবি এডজাস্ট হতে!
দাদু মাথা নেড়ে বললেন,
—তা ঠিক বলেছিস। তবে ভালো হয়েছে এখানে এলি। একা একাই তো জেগে থাকি সকালে। বউমা কাজে ব্যস্ত থাকে। আজ নাতির সঙ্গ পেয়ে ভাল্লাগছে!
—হুম এজন্যই তো এলাম। ভাবলাম তোমার সাথে গল্প করি।
কিছুক্ষণ দাদু-নাতি মিলে বেশ গল্প করলো। এত বছর নিশানের অনুপস্থিতিতে বাসায় কি কি হয়েছে, না হয়েছে সবকিছু শুনলো ও দাদুর থেকে। এভাবেই কথার মাঝে প্রসঙ্গ যখন নিশীথের বিয়ে নিয়ে এলো, তখন নিশান হঠাৎ বললো,

—আচ্ছা দাদু, একটা কথা বলো তো
—হ্যাঁ, বল।
—নিশীথের বিয়েতে কি শুধুই বাবার অমত ছিলো? নাকি তোমাদেরও ছিলো?
ইউনুস সাহেব বিস্ময় নিয়ে বললেন,
—আমাদের কেন আপত্তি থাকবে? নিশীথকে তো তুই চিনিসই। ও যখন একবার বলেছে ও দোলনচাঁপাকে বিয়ে করবে তখনই আমি বুঝেছিলাম এ মেয়েকে ও বিয়ে করেই ছাড়বে। কারণ এর আগে ও কখনোই মেয়ে রিলেটেড বিষয়ে এ বাসায় কথা বলেনি। এবার যখন বলেছে, তাও এতটা জোর দিয়ে তখনি আমি বুঝেছিলাম দোলনচাঁপাকে নিয়ে ও কতটা সিরিয়াস!
দাদুর কথা শুনে নিশান আগ্রহভরে বলে,

—তাই? কি এমন বলেছিলো শুনি? আমি তো এতকিছু ডিটেইলস এ জানিনা। তুমিই বলো।
পুরনো কথা মনে করে ইউনুস সাহেব হেসে বললেন,
—একদিন হঠাৎ এসে নিশীথ ফোন বের করে দোলার ছবি দেখালো আমায়। আমি দেখে বললাম, মেয়েটা তো সুন্দর। এটা কে রে, দাদুভাই? ও হেসে বললো, তোমার হবু নাতবৌ। আমি অবাক হলাম। কারণ এর আগে প্রেম করলেও নিশীথ কখনোই কোনো মেয়েকে সরাসরি বিয়ে করবে এমনটা বলেনি। আমায় অবাক হতে দেখে নিশীথ আরও একধাপ এগিয়ে বললো,
“আমি দোলনচাঁপাকে বিয়ে করতে চাই, দাদু।”
নাতির মুখে এ কথা শুনে আমি চমকে গেলাম। ওকে মনে করিয়ে দিলাম, এখনো ওর আগে তোর বিয়ে বাকি। নিশীথ সব শুনে বললো,

“আমি নিজেও ভাইয়ার আগে বিয়ে করতে চাইছিলাম না, দাদু। কিন্তু আমার কাছে উপায় নেই। দোলার বাসা থেকে বিয়ে ঠিক করে ফেলেছে। ওর ফ্যামিলি থেকে অনেক জোরাজোরি করছে ওকে বিয়ে দিতে। এখন আমাকে বিয়ে করতেই হবে নয়তো ওকে হারিয়ে ফেলবো। আর আমি ওকে কিছুতেই হারাতে পারবোনা, দাদু!”
ইউনুস সাহেব কথা শেষ করে থামলেন। নিশান এতক্ষণ চোখ বড় করে দাদুর সব কথা শুনছিলো। ওর ছোটভাই, নিশীথ কবে যে এত বড় হয়ে গেলো, নিজে থেকে দায়িত্ব নিতে শিখলো তা ওরা বুঝতেই পারলোনা! নিশান মুগ্ধ গলায় বললো,

—দোলা আসার পর নিশীথ অনেকটা বদলে গেছে, তাইনা দাদু?
—তা তো বটেই। যে ছেলে আরাম-আয়েশ ছেড়ে নিজের কমফোর্ট জোনের বাইরে কখনো বের হতে পারতোনা আজ সেই ছেলে একটা মেয়েকে ভালোবেসে ওর জন্য এমন একটা জীবনে নিজেকে মানিয়ে নিয়েছে যে জীবনের কল্পনাও সে কখনো করেনি! এটা কি আমরা কোনোদিন ভেবেছিলাম?
—আসলেই ভালোবাসা মানুষকে দিয়ে সব করায়। দোলা মেয়েটাকে আমার ভালো লাগে। নিশীথ যেমন ওকে উজার করে ভালোবাসে, ও নিজেও সবকিছু ছেড়ে নিশীথের ভরসায় একা বাসায় থাকছে। একহাতে নিশীথকে ও সংসারের সবকিছু সামলাচ্ছে। এটাও বা কম কিসে!
ইউনুস সাহেব মাথা নাড়িয়ে সায় দিলেন। হঠাৎ প্রসংগ বদলে বললেন,

দোলনচাঁপার সুবাস পর্ব ৬৫

—ছোটভাই বিয়ে সেড়ে ফেলেছে, তোরটা কবে হবে? তোর কিন্তু সময় নেই হাতে।
—সেজন্যেই তো এসেছি!
নিশান বিড়বিড়িয়ে নিচু গলায় আওড়ালো। যা বৃদ্ধের কানে এলোনা। তিনি না বুঝে শুধালেন,
—কি বললি? বুঝিনাই।
নিশান ঠোঁটে রহস্যময় হাসি একে বললো,
—সময় হলেই সব বুঝবে!

দোলনচাঁপার সুবাস পর্ব ৬৬(২)