তোমাতেই আসক্ত পর্ব ৬
তানিশা সুলতানা
ছোট্ট একখানা কক্ষ দেওয়া হয়েছে আদ্রিতাকে। এখানে আসবাবপত্র বলতে ওই একটা ড্রেসিং টেবিল খাট এবং কাবাড। আর কক্ষের সাথে ছোট্ট বারান্দা রয়েছে। সেই বারান্দা হতে বিশাল পাহাড় এর দেখা মেলে৷ গাড়ো সবুজ রংয়ের উঁচু উঁচু পাহাড় দেখতে মন্দ লাগে না। এদেশে বোধহয় পাখির সংখ্যা কম। তাই তো এই সোনালী সন্ধ্যায় কিচিরমিচির আওয়াজ ভেসে আসছে না। ঝাঁক বেঁধে আপন নিড়ে ফিরে যাওয়ার দৃশ্য চোখে পড়ছে না। কেমন জানি ফাঁকা ফাঁকা লাগছে শহরটা। এই শহরের বাতাসে প্রশান্তি খুঁজে পাচ্ছে না আদ্রিতা। বাংলাদেশে থাকলে এতোক্ষণ তিথি আপুর সাথে ঝগড়া করতে পারতো, তুহিন ভাই আইসক্রিম এনে দিতো। বড় মা বকা দিতে দিতে অস্থির হয়ে উঠতো।
রাগ করে আদ্রিতা মায়ের ফোন খানা নিয়ে ছাঁদে চলে যেতো। বাবা নামক লোকটিকে কল করতো। দীর্ঘক্ষণ কথা বলে মন ভালো করতে পারতো। আদ্রিতার মনে পড়ে গত কয়েকদিন হলো বাবার সাথে কথা বলা হয় না।
শীতের আমেজ পড়েছে। রাত বাড়ার সাথে সাথে বাড়ছে শীতের প্রতাপ। আদ্রিতা মনে করার চেষ্টা করে বাংলাদেশে শীতের শ ও ছিলো কি না? মনে পড়ে মগজ গলে যাওয়ার মতো উত্তাপ বাংলাদেশে। আর এখনে শীত? মানা যায়?
বারান্দায় যেনো শীতটা একটু বেশিই। সেই শীতকে উপেক্ষা করে বসে আছে আদ্রিতা। কিছুতেই সরবে না এখান থেকে৷ গায়ে গরম কাপড় নেই। ওই তো সাদা রংয়ের লেডিস শার্ট এবং রেইব্রো এর মতো বিভিন্ন রংয়ের স্কার্ট। চুল গুলো এলোমেলো হয়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে ফ্লোরে। সেদিকে একটুও মনোযোগ নেই তার। মা খানিকক্ষণ আগেই এসেছে বোধহয়। আদ্রিতাকে ইতোমধ্যেই দুবার ডাকেছে। সাড়া দেয় নি সে। আর প্রতিজ্ঞা করেছে সাড়া দিবেও না। একটু বেশিই কষ্ট পেয়েছে কি না। এমনটা কেনো করবে?
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
তখন আবরার বাইরে থেকে দরজা বন্ধ করে রেখে গেলেও পরে আদ্রিতা ভেতর থেকে বন্ধ করে রেখেছে। সে আর এই কক্ষ হতে বের হবে না। হবে না ওই পাষাণ পুরুষের মুখোমুখি। দেখাবে না এই মুখ খানা তাকে। যতদিন থাকবে সুইজারল্যান্ড নামক দেশে ততদিন এই বারান্দায় কাটিয়ে দিবে। ব্যাসস ভাবনা চিন্তা করে সিদ্ধান্ত নেওয়া শেষ।
দক্ষ হাতে গরুর মাংস এবং ভুনা খিচুড়ি রান্না করে ফেলে আবরার। সিয়ামও টুকটাক বেশ সাহায্য করেছে। বহু বছর বিদেশের মাটিতে পড়ে থাকলেও বাঙালি খাবার বেশ পছন্দ আবরারের৷ সেই জোর ধরেই টুকটাক রান্না শিখেছে। মাঝেমধ্যেই বন্ধুরা মিলে হরেক রকমের রান্নার আয়োজন করে।
সিয়াম টমেটো শশা এবং কাঁচা পেঁয়াজ কাটছে সালাদ বানানোর জন্য। সেই তখন থেকে গাল ফুলিয়ে রেখেছে। সর্বক্ষণ বক বক করা সিয়াম আজকে চুপচাপ কাজ করে যাচ্ছে। আবরার অবশ্যই সেদিকে খেয়াল দিচ্ছে না।
ধীর গতিতে এ্যানি কিচেনে ঢোকে। চোখ মুখ তার বড়ই ক্লান্ত। হবে না? ইতোমধ্যে গোটা বাড়ি দুইবার চক্কর দিয়ে ফেলেছে। তারপরও আর্দিতাকে না পেয়ে হতাশ সে। কোথায় গেলো তার মাম্মাম?
এ্যানির পানে নজর পড়তেই সিয়াম এর ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটে ওঠে। ছু ড়ি খানা নামিয়ে টিশার্টেই হাত মুছে নেয়। অতঃপর হাঁটু মুরে বসে কোলে তুলে এ্যানিকে। নরম তুলতুলে শরীরে ঠোঁট দাবিয়ে চুমু খায় শব্দ করে। এবং শুধায়
“কোথায় গিয়েছিলে তুমি? তোমার বিরহে আমি আধমরা হয়ে যাচ্ছিলাম।
বিড়াল ছানাটি বেশ বিরক্ত। সে অপরিচিত মানুষের কোলে উঠতে চায় না। তারওপর আবার চুমু। সিয়াম এর থেকে ছাড়া পাওয়ার জন্য ছোটাছুটি করে ওঠে। মিউ মিউ আওয়াজ তুলে ছেড়ে দিতে বলে। তবে সিয়াম ছাড়ে না। বরং আরও এক খানা চুমু খেয়ে বলে
“ওরেহহহহ শা লা কোলে থাক। তোর মায়ের কাছে নিয়ে যাবো।
বলেই দাঁড়িয়ে পড়ে। আবরারকে উদ্দেশ্য করে বলে
” ব্রো টমেটো এক পিছ কেটেছি। বাকি গুলো তুই কেটে নিস। আমি আদ্রিকে ডেকে আনি। ঠিক আছে?
বড় বড় পা ফেলে কিচেন ত্যাগ করে সিয়াম। আবরারের কোনো ভাবান্তর হয় না। সে নিজ গতিতে কাজ করে যাচ্ছে। যেনো সিয়াম এর কথা শুনতেই পায় নি৷
অহনা এবং তার বাচ্চাকে সাথে করে এনেছে আতিয়া বেগম। এই মুহুর্তে কিছুতেই মেয়েকে শশুর বাড়ি যেতে দেবেন না৷ মা আর শাশুড়ী কি এক হলো? মায়ের মতো আদর যত্ন কখনোই শাশুড়ী করতে পারবে না। আবরার ছোট ছোট নয়নে বোন এবং বাচ্চাটিকে দেখছে। পাঁচ দিন হলো বাচ্চাটি দুনিয়াতে এসেছে। অথচ একবারও আবরার হাসপাতালে যায় নি দেখতে। ওর সব বন্ধুই গিয়েছিলো। সিয়ার তিন রাত্রি হাসপাতালে কাটিয়েছে। এমনকি অহনাকে হাসপাতালে সিয়ামই নিয়ে গিয়েছিলো। ড্রয়িং রুমের সোফায় বসে আছে অহনা। তার কোলে ছোট্ট ছানাটি। যে হাত পা নেরে খেলছে। আতিয়া বেগম ব্যস্ত ভঙ্গিমায় কিচেনে খাবার বানাচ্ছে অহনার জন্য। আবরারের রান্না করা গরুর মাংস ভুনা খিচুড়ি খাওয়া বারণ অহনার৷
সিয়াম আদ্রিতার কক্ষের সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। দুবার টোকা দেয়। কোনো রেসপন্স না পেয়ে শুকনো কাশি দিয়ে গলা পরিষ্কার করে নেয়। তারপর নরম স্বরে বলে
“আদ্রি অহনা এসেছে তার ছানা নিয়ে। কি যে কিউট। তুমি কোলে নিবে?
অভিমানী আদ্রিতার অভিমান গলে জল হয়ে যায়। ছোট্ট বাচ্চা তার বড়ই ভালো লাগে। বাংলাদেশে তাদের পাশের ফ্ল্যাটে একটা বাচ্চা ছিলো। আদ্রি সদা গিয়ে সেই বাড়িতে বসে থাকতো, বাবুকে কোলে নিতো। এর জন্যও কম বকা খেতে হয় নি তাকে। আর আজকে নিজ বাড়িতেই এক খানা ছানার আবির্ভাব হয়েছে। আর আদ্রিতা কি না তাকে কোলে নিবে না? এটা হতে পারে?
বারান্দা হতে উঠে এক দৌড়ে দরজার পাশে এসে দাঁড়ায়। শিওর হওয়ার জন্য বলে
” মিথ্যে বলছেন না তো?
“একদম না৷ সিয়াম কখনো মিথ্যে বলে না। সদা সর্বদাই সত্য বলে। তাই তো আমাকে সবাই ভালোবেসে সত্যেন্দ্রনাথ ভালু বলে ডাকে।
আদ্রিতা দরজা খোলে। সিয়ামের পানে তাকিয়ে মুচকি হাসে। এ্যানি আদ্রিতাকে দেখতে পেয়েই মিউ মিউ আওয়াজ তুলে হাত এগিয়ে দেয়। যেনো শত শত বছর পরে দেখা মিলেছে মায়ের।
আদ্রিতা তাকে কোলে নেয়। মাথায় পরপর কয়েকটা চুমু খেয়ে এগিয়ে যায় ড্রয়িং রুমের পানে। সিয়াম মাথা চুলকে বিরবির করে বলে
” প্রেমে পড়েছে মন প্রেমে পড়েছে
অচেনস এক মানুষ আমায় পাগল করেছে
অহনা এক পলক তাকায় আবরারের পানে। বড়ই আশা ছিলো তার আবরার এগিয়ে আসবে বাবুকে কোলে নিবে, অহনাকে জিজ্ঞেস করবে “কেমন আছিস”
কিন্তু সেসব কিছুই হয় না। পাষাণ আবরার বোন ভাগিনীকে এড়িয়ে নিজ কক্ষের পানে অগ্রসর হয়।
আঁখি পল্লব ভিজে ওঠে অহনার। কি করেছে সে? কেনো এতো দুরুত্ব তাদের দুই ভাই বোনের মধ্যে?
অনেক ভেবেও বুঝতে পারে না তার দোষটা কোথায়। আবরার তো ছোট থেকেই এমন। বাবা মা বোন কারোর প্রতিই তার তেমন টান ছিলো না। আল্লাহ তাকে হার্টলেস বানিয়েছে হয়ত।
আদ্রিতা ঝড়ের গতিতে এগিয়ে এসে অহনার পাশে বসে৷ বাবুর পানে তাকিয়ে এক গাল হেসে বলে
“আসসালামু আলাইকুম আপু। ভালো আছেন? আমি আদ্রিতা। চিনেছেন আমায়?
অহনা মৃদু হাসে।
” ওয়ালাইকুম আসসালামু। চিনেছি তোমায়।
“বাবুকে একটু কোলে নিবেন? আমি হ্যান্ডওয়াশ দিয়ে হাত ধুয়ে এসেছি৷
অহনা আদ্রিতার কোলে দেয় বাবুকে। সে কি খুশি আদ্রিতাকে। একটু পরপরই চুমু খাচ্ছে বাবুর মাথায়, হাতে, গালে, নাকে এবং খিল খিল করে হেসে উঠছে। এ্যানি এসে আদ্রিতার পায়ের কাছে বসে পড়ে। কুটুর কুটুর নয়নে দেখতে থাকে তার মনিবকে এবং লেজ নাড়াতে থাকে।
যেহেতু অহনা অসুস্থ এবং সিঁড়ি বেয়ে যাতাযাত করতে পারবে না। তাই তার জন্য নিচের একটা কক্ষ বরাদ্দ করা হয়েছে। সেই কক্ষে চলে যায় অহনা। বড্ড ক্লান্ত লাগছে তার। একটু রেস্ট নিবে। বাচ্চার দায়িত্ব আদ্রিতাকে দিয়ে গিয়েছে।
আতিয়া বেগম এর রান্না শেষ৷ তিনি চলে যায় অহনাকে খাওয়াতে।।
দীর্ঘ ক্ষণ বাবুকে নিয়ে বসে থাকে আদ্রিতা। ভালোই লাগছিলো এতোক্ষণ। তবে এখন পিঠ চুলকাচ্ছে। বাবুকে সে দুই হাত দিয়েই ধরে রেখেছে। একদম ছোট এবং তুলতুলে। যদি পরে যায়? সাবধানের মার নেই৷ অগত্য পিঠ চুলকাতে ব্যর্থ হয়ে এদিক ওদিক দৃষ্টি ফেরায়। কেউ এদিকে আসছে না কেনো? আসলে তো একটু চুলকে দিতে বলতে পারতো। কাজের সময় কাউকে পাওয়া যায় না এরাই হচ্ছে মূখ্য বিষয়।
বিরক্ত আদ্রিতা বিরবির করে বকা দিতে থাকে সবাইকে।
তখনই দেখতে পায় আবরার নামছে সিঁড়ি বেয়ে। সুট বুট পড়ে চুল টুল খাঁড়া করে। লাট সাহেব যেভাবে একেকটা সিঁড়ি অতিক্রম করছে যেনো বলিউড হিরো আবরার তাসনিন। অবশ্যই হিরোদের মতোই দেখায় তাকে। খালি ওই একটু ঠোঁটে সমস্যা। মনে মনে ভেংচি কাটে আদ্রিতা। বিরবির করে বলে
“শা লা কোথাকার।
ভাব খানা ধরে কি? যেনো রাজপুত্রুর কোনো রাজ্যের।
ওরেহহহ গোলামের পুত ইচ্ছে করে তোর লম্বা চুল গুলো কুচি কুচি কেটে দিয়ে ভাব ছোটাতে।
আবরারকে বকতে বকতেই এক খানা মাথায় আসে। ” এই শালাকে দিয়েই কাজটা করিয়ে নেওয়া যাক”
বেমালুম ভুলেই গিয়েছে খানিকক্ষণ আগে এই পাষাণ লোকটা তাকে রুম বন্দী করে রেখেছিলো।
শুকনো কাশি দিয়ে গলা পরিষ্কার করে নেয় আদ্রিতা। তারপর বলে ওঠে
“বড় ভাই
পিঠ চুলকানিটা আমাকে একটু এনে দিন তো।
আবরারের পা থেমে যায়। ভ্রু কুচকে তাকায় আদ্রিতার পানে।
” পিঠ চুলকানি চিনেন না? ওই যে লম্বা করে দাঁত থাকে চারটা। জামার ফাঁকা দিয়ে ঢুকিয়ে অনায়াসে পিঠ চুলকানো যায়। চিনেন না?
তোমাতেই আসক্ত পর্ব ৫
আবরার দাঁতে দাঁত চেপে “ইডিয়েট” শব্দটা আওড়িয়ে বড় বড় পা ফেলে বেরিয়ে যায় সদর দরজা দিয়ে।
চিন্তিত হয় আদ্রিতা। অনেক হিসেব নিকেশ করে আবিষ্কার করে
“হয়ত সুইজারল্যান্ড এ পিঠ চুলকানির নাম ইডিয়েট”