পাতা বাহার পর্ব ২১
বেলা শেখ
বৃষ্টির দিন মানে ভরপুর খাওয়া দাওয়া, শান্তির ঘুম। খাওয়া দাওয়া বলতে ভাজিপুড়ি, খিচুড়ি, ছোলা বাদাম,মুড়িমাখা ইত্যাদি। আর ঘুম! ফুল স্পীডে বৈদ্যুতিক পাখা চালু করে কাঁথা মুড়ি। আহ পুরাই শান্তিময় জীবন। আর এই শান্তিময় জীবনে বিঘ্নিত ঘটায় প্রাকৃতিক কার্যক্রম। এই বৃষ্টির পানি দেখলেই যেন শরীর থেকে পানি বের হওয়ার জন্য ছটফট করে খানিক সময় পর পর। তখন ছুটতে হয় ওয়াশরুম। আজকের দিনটাও বৃষ্টিমুখর। এখনো বারিধারা বহমান ধরনীতে।
অরুণ ড্রেসিন টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে টাই বাঁধছে। চুলগুলো স্পাইক করে পরিপাটি হয়ে আছে। পরনে ফরমাল ড্রেস আপ। সাদা শার্টের উপর কালো কটি। তার উপর ভায়োলেট ব্লেজার। অরুণ টাই লাগিয়ে পরিপাটি চুল গুলোয় হাত চালিয়ে নিজেকে আয়নায় দেখে নেয়। কালো চুল গুলো উঁকি দিচ্ছে। তাকে কি বেশিই বয়স্ক লাগে? চুলে কালার করলে পাকা চুল গুলো দেখা যাবে না। কিন্তু সে কালার করবে কেন? এগুলো কি লুকোনোর জিনিস নাকি। বয়স হচ্ছে চুল পাকবে না। আয়নার থেকে নজর সরিয়ে হেঁটে বিছানায় শুকনো মুখে বসা ছেলের কাছে যায়। কপালে হাত দিয়ে তাপমাত্রা পরখ করে চুমু খায়। জ্বর কমতে শুরু করেছে। ভোর বাবার গলা জড়িয়ে ধরলো। কাঁধে মুখ গুঁজে বলে,
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
-” আব্বু তুমি রাতে কোথায় গিয়েছিলে? আমি তোমার জন্য ওয়েট করছিলাম।”
অরুণ ছেলেকে কোলে তুলে অফিস ব্যাগটা হাতে নিয়ে বের হয়। চিরচেনা গম্ভীর মুখে বলে,
-” একটু কাজ ছিল বাবা। এসে দেখি তুমি ঘুমিয়ে!”
ভোর মাথা তুলে বাবার মুখোমুখি হয়ে গালে হাত রেখে বলে,
-” আব্বু কাল কি হয়েছিল? ওই পচা লোকগুলোকে মারছিলে কেন?”
অরুণ গাম্ভীর্যতা যেন একটু বেড়ে গেল।
-” ওসব তোমার জানতে হবে না। লোকগুলো ভিলেন ছিলো। তাই পানিশ্ড করেছি।”
ভোর মুখ খুলে আরো কিছু বলবে। অরুণ ছেলের ঠোঁটে চুমু খেয়ে বলে,
-” আর প্রশ্ন না বাবা।”
ভোর চুপ করে যায়। তার ফোলা ফোলা মুখশ্রী রক্তিম হয়ে আছে কান্না ও জ্বরের ফলে। নাকটা যেন রক্তিম কৃষ্ণচূড়ার ন্যায়। চোখ মৃদু লাল ও টলমলে। অরুণ ড্রয়িংরুম কাটিয়ে ডাইনিং প্লেসে যায়। ছেলেকে কোলে নিয়েই একটা চেয়ারে ব্যাগ রেখে অন্য চেয়ার টেনে বসে । সামনে আসমা বেগম আরিয়ান ব্রেকফাস্ট করছে। মিনু পরিবেশন করছে।আদুরি, রুবি, আনিকা এখনো উঠে নি হয়তোবা। বৃষ্টির দিনে তারা ঘুমবিলাসী বনে যায়। সে আসমা বেগম ও আরিয়ানের মুখশ্রী দেখে।কেমন যেন থমথমে। তার কপার কুঞ্চিত হয়। গতরাতের ব্যাপারে কিছু জেনে গেছে কি! সে কিছু বলবে এর আগে আরিয়ান মুখ খোলে,
-” ভাই ঘটনা কি সত্যি?”
করুণের কুঞ্চিত কপাল শিথিল হয়। টেবিলে থাকা অরেঞ্জ জুস গ্লাসে ঢেলে ছেলের মুখে দেয়। ভোর একটু খানি খেয়ে মাথা নাড়ে আর খাবে না। অরুণ জোর করে না। বাকিটুকু নিজে শেষ করে। আরিয়ানের দিকে তাকিয়ে বলে,
-” এখন প্রশ্ন হলো তোরা ঘটনা টুকুর কতটুকু শুনেছিস?”
আরিয়ান ভাইয়ের হেঁয়ালিপূর্ণ কথায় বিরক্ত হয়।
-” ভাই বিয়ের ব্যাপারটা কি সত্যি?”
-” হুম।”
আসমা বেগম ও আরিয়ান অবাক হয় না। তারা সিওর ছিল। শুধু একটু বাজিয়ে নিল যে অরুণ স্বীকার করে কি না তাদের কাছে। ভোর কিছু বোঝে না। দূর্বল গলায় মিনমিন করে নাক টেনে বলে,
-” আব্বু কার বিয়ে?”
মিনু ততক্ষণে অরুণের প্লেটে খাবার দিয়েছে। ভুনা খিচুড়ি সাথে কষা মাংস ও চাটনি। অরুণ খিচুড়ি হাতে নিয়ে ফু দিয়ে ছেলের মুখের সামনে ধরে ভোর মুখ কুঁচকে মাথা নাড়ে খাবে না। অরুণ নিজের মুখে নিয়ে বলে,
-” আব্বু বড়দের আলোচনায় কান দিতে নেই।”
ভোর এবার গাল ফুলিয়ে ঘুরে বাবার বুকে মুখ লুকিয়ে চোখ বুজে নেয়। অরুণ বা হাতে মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে থাকে।
আসমা বেগম সেদিকে চেয়ে বলে,
-” ভোরের জ্বর এখন কেমন?”
-” ছেড়েছে। ওষুধ খাইয়ে দিয়েছিলাম।”
আসমা বেগম অরুণের গাম্ভীর্য ঘেরা চেহারার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে বলে,
-” কাল এতো কিছু ঘটে গেলো অথচ আমাদের জানানোর প্রয়োজন বোধ করলে না!”
আরিয়ান মায়ের কথা কেড়ে নিয়ে তাচ্ছিল্য ভরা কণ্ঠে বলে,
-” মা তুমিও না! আমাদের কেন বলবে? আমরা কি ভাইয়ের আপন কেউ নাকি! সৎ সম্পর্ক আমাদের। আপন সম্পর্কের লোক তো সাথেই ছিলো!”
অরুণ প্লেটে হাত থেমে যায়। ঢোক গিলে মুখের খাবার গলাধঃকরণ করে। আরিয়ানের দিকে তাকিয়ে বলে,
-” তোর সবসময় ছেলেমানুষী কথা বার্তা। এখানে সৎ আপনের কথা উঠছে কেন? পরিস্থিতি তেমন ছিল না। আর আমি নিজেও জানতাম না এমন কিছু করবো। যখন ভেবে সিদ্ধান্ত নিই তখন বলার মতো পরিস্থিতি ছিল না। আর রাতে এসেও দেখি সকলে ঘুমিয়ে। সকালে বলতে চেয়েছিলাম ছেলের জ্বরে ঘেটে ঘ হয়ে গেছে।”
আসমা বেগম আরিয়ানকে চোখ রাঙায়। ব্রেকফাস্টে মনোযোগ দিয়ে বলে,
-” আমাদের জানানোর পরিস্থিতি ছিলো না অথচ মেয়র সাহেব সেথায় পৌঁছে যায়।”
অরুণ দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে,
-” ছোট মা? ব্যাপারটা তেমন না। মামাকে নিয়ে গিয়েছিলাম দরবার সামলাতে। না সে জানতো এমন কিছু হবে আর নাই বা আমি।”
আসমা বেগম আর তর্কে গেলেন না।
-” হুম বুঝলাম। তা তাকে আনো নি কেন? বাচ্চাটাকে জানাবে না?”
-” গতরাতের ঘটনা ভুলে যাও। সব পারিবারিক ও আনুষ্ঠানিকভাবে হবে। তোমরা গিয়ে বালা রিং পড়িয়ে একটা ডেট দিয়ে এসো। আর কি কি করবে তোমরা জানো! আমি ওসবে নেই!”
আরিয়ান চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে বলে,
-” মেয়েটা কেমন? শুনলাম কমবয়সী! ভোরকে..”
অরুণ তার দিকে চায় শান্ত চোখে।
-” ভালো। ওকে খুব আদরে রাখবে ইনশাআল্লাহ। ওকে জানাস না। পরে সারপ্রাইজ দেব!”
আরিয়ান তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে ভাইয়ের দিকে বলে,
-” এই সত্যি করে বলতো ভাই আগে থেকে কোনো চক্কর টক্কর ছিলো নাকি? হঠাৎ করেই.”
অরুণ তাকে থামিয়ে দিয়ে বলে,
-” আমি অফিসে যাচ্ছি। আর যেমনটা ভাবছিস তেমন নয়। সবটা অনাকাঙ্ক্ষিত।”
অরুণ ছেলেকে চেয়ারে দাঁড় করিয়ে বেসিনে যায়।ভোর টেবিলে মাথা ঠেকিয়ে আরিয়ানের দিকে তাকিয়ে বলে,
-” তোমার পেটের হাতি এখনো নাচছে চাচ্চু?”
আরিয়ান হেসে মাথা নাড়ে। নাচছে না। উঠে এসে ভোরের কপালে হাত রেখে তাপমাত্রা পরখ করে।
-” তোমার জন্য ইয়া বড় সারপ্রাইজ আছে। জলদি সুস্থ হও তারপর দিবো!”
অন্যসময় হলে ভোর খুশিতে নেচে কুদে আরিয়ানের কোলে উঠে সারপ্রাইজ চাই চাই বলে কানের পোকা বের করে দিতো। জ্বরের শরীরে ভোর হেসে বলে,
-” সত্যি!”
আরিয়ান তাকে কোলে তুলে আদর করে।
-” হ্যা সোনা।”
ততক্ষণে অরুণ এসে ব্যাগ কাঁধে নিয়ে ছেলেকে আরিয়ানের কাছ থেকে বুকে জড়িয়ে নিল। আরিয়ান ভোরের মাথায় হাত বুলিয়ে বলে,
-” রেখে গেলেই পারিস। সবাই বাড়িতেই। অসুস্থ ছেলেটাকে নিয়ে অফিসে গিয়ে আরো অসুস্থ বানানোর পাঁয়তারা!”
অরুণ ছেলের কপালে চুমু দিয়ে বলল,
-” অফিসে যাওয়া জরুরী। কিছু ক্লায়েন্টের সাথে মিটিং আছে। আর ফটোশুটের জন্য নিউ লুক লাগবে তার ইন্টারভিউ। নইলে যেতাম না। আর অসুস্থ ছেলেকে দূরে রেখে একটা কাজেও মন দিতে পারবো না। আসছি। আসছি ছোটমা ।”
বলেই ছেলেকে বুকে জড়িয়ে বেরিয়ে যায়। আরিয়ান, আসমা বেগম তার প্রস্থান দেখে।
পাতা প্রিয়দের বাড়িতে এসেছে। এখানেই যে তার শৈশব কৈশোর কেটেছে। এই বাড়ির আঙিনায় হেসে খেলে বড় হয়েছে।এ বাড়ির প্রতিটা আনাচ কানাচ যে তার শৈশব কৈশোরের স্মৃতি বহন করে। এই বাড়িতেই জড়িয়ে আছে কিছু মিষ্টি মূহূর্ত আবার কিছু তিক্ত অভিজ্ঞতা। এ বাড়ি থেকে ভালোবাসা, অবহেলা, কথার বাণ অনেক কিছুই পেয়েছে। ছোট বেলায় হাসিমুখে যারা আপন মনে করে বুকে টেনে নিয়েছিল। তারাই যৌবনের পদার্পণের মুহূর্তে ব্যাগ প্যাক করে নির্বাসিত করেছিল। পাতা বাড়ির সম্মুখ দুয়ারে দাঁড়িয়ে। সাথে লুবমান। পাতা দুয়ারে দাঁড়িয়ে টলমলে চোখে। কেন জানিনা তার চোখ ভরে উঠছে।
রহিম মিয়া রা দুই ভাই তিন বোন। বাবা বেঁচে নেই তাদের তবে বৃদ্ধা মা আকলিমা খাতুন বেঁচে আছেন। রহিম মিয়ার ছোট ভাই করিম মিয়া একসাথেই মাকে নিয়ে থাকেন। যৌথ পরিবার যাকে বলে। করিম মিয়াও ভাইয়ের সাথে ধানের ব্যবসা সামলায়। সাথে বাজারের চালের বড় আড়তদার তারা দুই ভাই। করিম মিয়ার স্ত্রী ফাতেমা জোহরা। তাদের ঘরে দুই ছেলে এক মেয়ে। বড় ছেলে কাওসার পড়াশোনা শেষ করে ওষুধ কোম্পানিতে কাজ করে তিন বছর হলো। আর মেয়ে জুবাইদার বিয়ে হয়েছে।সে পাতার থেকে এক বছরের ছোট। আর সবার ছোট ফরহাদ ক্লাস সিক্সে পড়ে প্রিয়োর সাথে। তারা পিঠাপিঠি।
প্রিয়দের বাড়ি গ্রামে। রঙিন টিনের আধা পাকা বাড়ি। ওরা চাইলে দোতলা তিন চলা বিল্ডিং ও দিতে পারে। বর্তমানে তাদের আর্থিক অবস্থা বেশ সচ্ছল। চালের আরৎ ও ধানের ব্যবসা থেকে প্রচুর আয় করে। তাদের বাড়ি পাকা না করার কারণ কিপ্টেমি নয়। বরং আকলিমা খাতুনের ইচ্ছা। সে বিল্ডিং বা ছাদ ওয়ালা বাড়ি পছন্দ করে না। তার কাছে দম বন্ধ হয়ে আসে। এ কারণে তিনি মেয়েদের বাড়ি গিয়ে এক রাতও কাটায় না। তবে টিনসেটের এই আধা পাকা বাড়িটাও দেখতে বেশ। সৌখিনতায় ভরপুর। পাতা পা বাড়ায়। বাগানবিলাসে আচ্ছাদিত গেট খানি খুলে ভিতরে প্রবেশ করে। কোথা থেকে দুটো হাত তাকে জাপটে ধরে টাইট করে। চিল্লিয়ে বলতে থাকে,
-” পাতুপু পাতুপ!! তোমাকে আমি এতো এতো মিস করি। আই লাভ ইউ পাতুপু। তুমি আসবে আমায় বলবে না!”
পাতা হেসে বোনের মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়। প্রিয় পাতা বলতে অজ্ঞান। তাকে পাতার সঙ্গ দাও আর কিছুই চাই না। লুবমান এসে প্রিয়োর পিঠে টোকা মারে। প্রিয় পাতাকে ছেড়ে পিঠ ডলতে থাকে। লুবমান তার কাঁধে পাতার ব্যাগ দিয়ে হাত ঝাড়তে ঝাড়তে বলে,
পাতা বাহার পর্ব ১৯
-” শুধু পাতাকেই দেখতে পাস তোরা! আমাকে নজরে আসে না? বড় ভাই এসেছে পায়ে পড়ে সালাম করবি তা না! পাতুপু পাতুপু!! এই পাতুপু আবার কেমন ডাক শুনি? পাতু আপু বললেও ভালো শোনা যায় কিছুটা।”