পাতা বাহার পর্ব ২২

পাতা বাহার পর্ব ২২
বেলা শেখ 

অরুণ ছেলের গায়ের কম্ফোর্ট ঠিক করে দেয়। বিড়াল শাবকটি বারবার টেনে সরিয়ে দিচ্ছে।
-” ঘুমুচ্ছে!”
-” ওহ্। আচ্ছা রাখছি! ছেলের খেয়াল রাখবেন।”
বলেই কেটে দেয়। অরুণ ফোনের দিকে তাকিয়ে থাকে। কেটে দিল? এর প্রশ্নের উত্তর অরুনের মন থেকে আসে, তো কি তোর সাথে প্রেমালাপ করবে? অরুণ জলপট্টি দেয়া বন্ধ করে দেয়। আর দেবে না। পাছে না ঠান্ডা লেগে যায়। এমনিতেই ঠান্ডা লেগেই আছে। সর্দিতে নাক বন্ধ থাকায় হা করে ঘুমুচ্ছেন মহারাজ! অরুণ সব সরিয়ে রেখে ছেলের কম্ফোর্টের ভিতরে ঢুকে জড়িয়ে নেয় ছেলেকে। কপালে চুমু খেয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে থাকে। বিড়াল শাবক অরুণের পিঠ ঘেঁষে শুয়ে এক পা দিয়ে অরুণকে খোঁচায়। অরুণ বিরক্ত হয় ঘার ঘুরিয়ে পিছনে তাকায়। পাতাবাহার পিটপিট করে চেয়ে মিও মিও ডাকে। যার অর্থ আমাকেও একটু আদর করো!! অরুণ তার পা সরিয়ে দিয়ে বলে,

-” দেখ পাতাবাহার খোঁচা দিবে না। আচর লাগবে। তখন তোমার না দেখা সখি সন্দেহ করবে আমায়!”
পাতা ফোন কেটে পরনের লং টি শার্টের পকেটে রাখে। গলায় ছোট ওড়না ঝুলছে।পাতা চুলের ঝুটি খুলে দেয়। কাঁধ থেকে সামান্য নিচে ঝরঝরে সিল্কি কালো চুল ছড়িয়ে পড়ে। কপালে কাটা ছোট ছোট চুল বড় হয়েছে কিছুটা কানের পাশে গুজে সম্মুখ পানে চায় সে। ঠোঁটে মুচকি হাসি রেখে উঠোনে বর্ষণের পতন দেখে। অন্ধকার হলেও আবছা আবছা দেখা যাচ্ছে। কি অপরূপ দৃশ্য। ঝমঝমিয়ে বৃষ্টির ফোঁটা পড়ছে উঠোনে জমায়িত পানির উপর। টিনের চালের উপর পড়ে সেটা গড়িয়ে উঠোনে পড়ছে কলাম হয়ে। পাতা শ্বাস টানে। ঠোঁট যুগল কম্পমান, উল্টে ওঠে।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

নাকের পাটা ফুলে উঠছে মৃদু। নেত্রযুগল রঞ্জিত! সেথায় মেঘ জমেছে। যেকোনো মুহূর্তে বর্ষণে ঝড়ে পড়বে। পাতা ঢোক গিলে! সাথে সাথে একফোঁটা বৃষ্টি সেই মেঘ হতে কপোল বেয়ে গড়িয়ে পড়ে।তারপর এক ফোঁটা দু ফোঁটা থামার নাম নেই। পাতা পা ভাঁজ করে বারান্দার সিমেন্টের খুঁটি ঘেঁষে বসে । বৃষ্টির পানি চাল বেয়ে গড়িয়ে মাটিতে পড়ছে সেখান থেকে ছিটকে তার গায়ে লাগছে। কখনো হালকা বাতাসের সাথে বৃষ্টির পানি ছিটেফোঁটা এসে ভিজিয়ে দিচ্ছে। পাতা স্থির নয়নে শুন্যে চেয়ে। চোখ যুগল থেমে নেই, বর্ষিত হচ্ছে। তার কেন কান্না পাচ্ছে সে জানে না। শুধু কান্না পাচ্ছে ব্যস! কান্নার সাথে অতিতের স্মৃতি ভেসে আসে। এমনই বৃষ্টিমুখর পরিবেশে পাবেলের জন্ম হয়।ওর জন্মের দিন অনেক বৃষ্টি ছিল। সেই বৃষ্টির স্থায়িত্ব কাল ছিল পরবর্তী তিন দিন। তারপর পাভেল দেড় বছরের হলো। সেদিন এমন সন্ধ্যা ছিল বোধহয় এমনকি সেদিনও বৃষ্টি ছিল। তার খুব একটা মনে নেই‌ ।সে পাঁচ বছরের ছিল বোধহয়। পারুল, ফাতেমা ও আকলিমা খাতুন বসে ছিল কুপির আলোয় পাভেলকে কোলে নিয়ে! পাতা কাপড়ে বানানো পুতুল হাতে সেই ঘরে যাচ্ছিল ভাইয়ের সাথে খেলতে। দরজার কাছে যেতেই মা দাদি চাচির কণ্ঠস্বর ভেসে আসে। দাদির মুখে নিজের নাম শুনায় থেমে যায় কি মনে করে।

আকলিমা খাতুন নাতিনকে পায়ের উপর বসিয়ে সরিষার তেল মেখে বলছিল,
-” শোন পারুল তোমায় বলছিলাম আর কয়েকবছর অপেক্ষা করো! বাচ্চা হইবো। তোমাগোরে তো কোনো সমেস্যা ছিল না। কিন্তু তোমরা শুনলে না। বোনের কাছ থেকে চেয়ে আনলে ওই পাতাকে। এখন হলো তো নিজের পেট থেকে!!”
ছোট্ট পাতার মন ভিত হয় কি বলছে দাদি? এমনিতেই জুবাইদা ও কাওসার ভাই সবসময় বলে পাতাকে কুড়িয়ে এনেছে! ছোট্ট পাতা সেসব শুনে কষ্ট পেলেও হেসে উড়িয়ে দিত। ভাবতো মজা করে বলছে। কিন্তু দাদি কি বললো এখন?
পারুল হেসে বলে,

-” তখন কি জানতাম নাকি আল্লাহর রহমত আমাদের উপরও বর্তাবে।”
আকলিমা খাতুন নাতির মালিশ শেষ করে কোলে নিয়ে বলে,
-” এখন কি করবা? দেখ পাতা এখন ছোডই আছে। তোমার বোনরে ফিরাইয়া দিয়া আসো! তোমার একটা আছে আবার হইবো! তয় ক্যান অন্যেরটা পাইলবা? ছেলে হইলে তাও কথা ছিল। মাইয়া ! পড়াইয়া খিলাইয়া এতটাকা খরচ কইরা আমাগোরেই বিয়া দিতে হইবো। শোন পারুল আমার পোলার ওত ত্যাল হয় নাই! লাবনীরে দিয়া দেওগা তার মাইয়া পাতারে!”

পাতা আর ঘরে ঢোকে না। কাঁদতে কাঁদতে নিজের ঘরে যায়। ছোট্ট পাতার পাবেল হওয়ার পর আলাদা ঘর হয়! মাঝে মাঝে জুবাইদাও সঙ্গি হয়। পাতা চৌকির তলায় লুকিয়ে সেদিন অনেক কেঁদেছিল। তার ছোট মন মানতে নারাজ ছিল দাদির কথা। কারণ দাদি তাকে ভালোবাসে না। কখনো কোলে নেয় না, আদর করে না। কিছু হলেই খ্যাক করে ওঠে। থাপ্পড় লাগাতে ভুলে না। বাবা তার জন্য সদাই আনলে কেড়ে নিয়ে জুবাইদাকে দিত। এভাবে চলতে থাকে। পাতা ধীরে ধীরে বড় হয়। আরো বুঝতে শেখে। বাবার ভালোবাসা কমে যাওয়া দেখে। প্রিয় সংসারে আসলে মায়ের তার জন্য আর সময় হয় না।

দাদি মারলে আগের মতো কোলে নিয়ে আদর করে না কেউ। ছোট প্রিয় সহ সকল বাচ্চার জন্য সদাই, কাপড় চোপড়, খেলনা এলেও তার জন্য আসে না। তাকে তার চেয়ে ছোট্ট জুবাইদার পুরনো জামা কাপড়, খেলনা নিয়ে খুশি থাকতে হতো। আর পাতা ছোট মোট হওয়ায় লেগেও যেত! তবে কাওসার ভাই তাকে লুকিয়ে চুরিয়ে অনেক কিছু দিত।ফলে কাওসার ভাইয়ের সাথে তার বেশ ভাব।দুই ঈদ ও হালখাতার সময় নতুন জামা আসত তারজন্য। আর মামার বাড়ি ও খালার বাড়ি গেলে পেত দুই এক সেট। বাবা কাজে যাওয়ার সময় পাভেল , প্রিয়কে আদর করে চুমু দিত। সে সামনে দাঁড়িয়ে সব দেখতো!

তার মাথায় শুধু হাত রাখতো। পাতা এতেই খুশি। সে যতো বড় হয় বুঝতে পারে দাদির সেদিনের সন্ধ্যার কথা ঠিক ছিল। তবে সে চাইতো না তাকে রেখে আসুক ও বাড়ি। সে এখানেই থাকতে চায়। ও বাড়িতে আতিকুর ইসলামকে সে অনেক ভয় পায়। লুব ভাইকে কিভাবে সবার সামনে চর মেরেছিল সেবার! তাকে সেখানে রেখে আসলে তো অনেক মারবে! পাতাকে দিয়ে সংসারের কাজ করাতো না কেউ। তার দায়িত্ব ছিল প্রিয়, ফরহাদের দেখাশোনা! বলা চলে পাতার কোলে পিঠেই বড় হয়েছে দুজন। তাই তো তার নেওটা। তাকে ভালোবাসে। সে যেদিন বাড়ি ছেড়ে আসে সেদিন অনেক কেঁদেছিল দুজন। পাতা কান্নার মাঝেও হাসি পায়। হেসেও দেয়। ও বাড়িতে গিয়ে প্রথম প্রথম কষ্ট লাগলেও ধীরে ধীরে ভালো লাগতে শুরু করে। লতা আপু, লুব ভাই তাকে অনেক ভালোবাসে।

লাবনী আক্তারের টা বোঝা মুশকিল। বকবে শাসন করবে! হুট করে কেয়ার করবে। আতিকুর ইসলাম নীরব থাকতো। ও বাড়িতে খাওয়া দাওয়া, পোষাক-আষাকে কমতি ছিল না। উপরন্তু হাত খরচও পেত অনেক । সব মিলিয়ে ভালোই কেটেছে। মাঝে মাঝে পাতা ভাবে ভালোই হয়েছে ও বাড়িতে পাঠিয়ে দিয়েছে। পাতা মানিয়ে নিয়েছিল দুই বাড়িতেই। কিন্তু খুব করে চাইতো! রুপকথার মতো তার জন্যও কোনো রাজপুত্র আসুক। তাকে নিয়ে যাক দায়িত্ব নামক বেড়াজাল থেকে এক ভালোবাসার রাজপ্রাসাদে। তার নিজস্ব ব্যাক্তি। যার সবটা জুড়ে শুধুই পাতার অস্তিত্ব থাকবে। তাকে খুব ভালোবাসবে। কিন্তু সেসব হবার ছিল না। তাকে আবার মানিয়ে নিতে হবে। সে মানিয়েও নিবে কিন্তু মানুষটা যেন তার হয়। তাকে বুঝতে চেষ্টা করে।
হঠাৎ কারো পায়ের আওয়াজে সয়ংবৎ ফিরে। ঝটপট বৃষ্টির পানি আঁজলায় ভরে মুখে ঝাপটা দেয়। একাকার হয় দুই বর্ষণের জল।

কাওসার লুঙ্গি হাতে এগিয়ে আসে। পাতার ছোট চুল গুলো টেনে বলে,
-” কি রে এই রোমান্টিক মৌসুমে জামাইকে নিয়ে স্বপ্ন বুনছিস?”
পাতা হেসে বলে,
-” কি যে বল না তুমি!!”
বলে উঠে দাঁড়ায়। কাওছার তাকে ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করে। চোখ লাল হয়ে আছে। কাঁদছিল কি? তবে সেটা জিজ্ঞেস করে না।
-” পাতু তুই কিন্তু এটা মোটেও ঠিক করিস নি। জামাই জামাই বলে ঘুরতি আমার পিছনে অথচ আরেক বুড়ো বেডার গলায় ঝুলে পড়লি? ধরনী সইবে না রে!”
পাতা হেসে তার বাহুতে কয়েকটা আলতো চর মেরে বলে,

-” ওসব বলবে না। আমি তখন ছোট ছিলাম! ওয়ানে পড়তাম।‌ বুঝতাম নাকি। বর বউ খেলায় তুমি আমার বর হয়েছিলে তাই বলতাম এমনি এমনি!”
কাওসার দুঃখি মুখ বানিয়ে বলে,
-” কিন্তু আমি তো সত্যি ধরে নিয়ে সপনে স্মরনে শুধু তোমাই বুনেছি বনপাতা!”
পাতা খিলখিলিয়ে হেসে ওঠে।
-” হ্যা তোমার গার্লফ্রেন্ড ঝুমুরের কানে যাক! তোমার মাথায় আর চুল থাকবে না।”
-” হয়েছে এমন ভালো ওয়েদারে ওই পেত্নির কথা মনে করিয়ে দিস না।”
বলার সাথে সাথে কাওসারের ফোন বেজে ওঠে। কাওসার ফোন বের করলেই ঝুমু নাম স্ক্রিনে ভেসে ওঠে। কাওসার বড় বড় করে চায়।

-” এই পেত্নির নাম নিলি না? তার কল হাজির! আমি যাই হ্যা! এই রোমান্টিক মৌসুমে একটু প্রেমালাপ করি। তুই ও জামাইকে নিয়ে স্বপ্ন বুনতে থাক”
পাতা হেসে ওঠে। কাওছার কল রিসিভ করে হ্যালো বলতে বলতে চালে যায়। পাতার মুখটা পুনরায় মলিন হয়ে যায়। স্মৃতির পাতায় ভেসে ওঠে পুরনো স্মৃতি। কাওসার ভাইকে জামাই ডাকার জন্য ফাতেমা চাচির কথার বাণ! দাদির হাতে কাঁচা কুঞ্চির আদর। নাহ আর মনে করতে চায় না সে। ওড়না দিয়ে ভেজা মুখ মুছে নেয়। পা বাড়াবে তখনই গেট খুলে কেউ ভিতরে ঢুকে ছাতা হাতে। পাতা দেখে তিনজন লোক। রহিম মিয়া ও করিম মিয়া। অপর জনকে চেনে না। তারা বারান্দায় আসে চটজলদি। ছাতা পাশে রাখে। করিম আগে পাতাকে দেখে বলে,

-” আরে পাতা যে! কখন এসেছিস? ভালো আছিস?”
পাতা হেসে বলে,
-” এই তো দুপুরের দিকে এসেছি। ভালো আছি। তুমি ভালো আছো ছোট আব্বা?”
করিমা মাথা নাড়ে। ভালো আছে সে। পাতা রহিমের দিকে তাকিয়ে বলে,
-” বাবা তুমি কেমন আছো?”
রহিম মিয়া মাথা নাড়িয়ে বলে,
-” ভালোই। তুই?”
-” ভালো!”

পাশের লোকটি পাতাকে ভালো করে দেখে রহিম মিয়াকে উদ্দেশ্য করে বলে,
-” এটা তোমার মাইয়া? তোমার মাইয়া তো প্রিয়! এইডা কিভাবে?”
রহিম মিয়া ইতস্তত বোধ করে। মাথা চুলকিয়ে বলে,
-” মনসুর ভাই আমার না। আমার ভাইরার মাইয়া। পাতা নাম। প্রিয়োর মতো বাবা বলে ডাকে মাঝে মধ্যে।”
পাতা মুচকি হেসে বাবার দিকে তাকিয়ে মাথা নাড়ে। তার হাসির মাঝে লুকায়িত বেদনা নজরে আসে না রহিম মিয়ার। মনসুর লোকটি পাতাকে আরেকবার দেখে নেয়। বেশ দেখতে মেয়েটি। সে পাতাকে জিজ্ঞেস করে,

-” কোন কেলাসে পড় তুমি?”
পাতা চোখ উল্টিয়ে বিরক্ত প্রকাশ করে।
-” আমি একজন শিক্ষক। স্নাতক শেষ করেছি প্রায় দুই বছর হবে!”
লোকটি চোখ যেন উজ্জীবিত হয়। রহিমের দিকে তাকিয়ে বলে,
-” বিয়ে টিয়ে হইছে নি? আমার হাতে ভালো প্রস্তাব আছে!”
রহিম তার কাঁধে হাত রেখে বলে,
-” বিয়ে হইছে।”

লোকটির উজ্জীবিত চোখ মুখ চুপসে যায়। পাতা হন হন করে চলে যায় তাদের তোয়াক্কা না করেই। ঘরে গিয়ে দেখে পাভেল এখনো অরুণ সরকারের গল্প শোনাচ্ছে ফরহাদকে। সব আজগুবি গল্প যার কোনো অস্তিত্বই নেই।অথচ ফরহাদ হা করে গিলছে। প্রিয় তার ব্যাগ থেকে জামাকাপড় বের করে ওয়্যাড্রবে রাখছে। পাতা তার কাছে এগিয়ে গিয়ে বলে,
-” কাপড়চোপড় রাখছিস কেন ভিতরে?”
প্রিয় কপালে ভাঁজ ফেলে বলে,
-” বাহ রে! থাকবে না এখানে কয় দিন! শোন পাতুপু এবারের ঈদ এখানেই কাটিয়ে যাবে বলেদিলাম। তোমার কোনো ভংচং শুনবো না।”
পাতা শান্ত চোখ চায়। সে কিছুদিন থাকার ভাগ করেই এসেছিল। কিন্তু থাকবে না আর। কেন থাকবে? বাবা এতবার কল করে ডেকে আনলো এখন লোকের সামনে বলে কিনা ভাইরার মেয়ে!! দাদির কথা তো বাদই দিল!

-” শুনতে হবে! আমি কালই চলে যাবো!”
প্রিয়ো বড়বড় করে চায়।
-” একদম না। আমি জানি তুমি কিছুদিন থাকবে বলেই এসেছো! জামাকাপড়ও এনেছো। আর কাল গেলে লুব ভাই আজ যেত না! এই সত্যি করে বলো দাদি কিছু বলেছে? বুড়িটার চুল টেনে ছিড়বো!”
পাতা অস্থির প্রিয়কে থামায়। মেয়েটা এতো চঞ্চল। ফরহাদ, পাভেল এদিকে চেয়ে আছে। কিছু বলবে তার আগেই পাতা বলে,
-” এই চুপ! কেউ কিছু বলে নি। দাদিও না। উনি কল করেছিল। জলদি যেতে বলেছে। কালই যত শিঘ্র সম্ভব। তাই থাকা সম্ভব না!”
পাভেল রসিকতার সুরে ভ্রু নাচিয়ে বলে,

-” উনি টা কে পাতা আপু?”
পাতা কাপড় গুলো পুনরায় ব্যাগে ভরে বলে,
-” তোদের দুলাভাই বুঝলি!”
ফরহাদ,পাবেল ‘ওহ হো’ বলে চিল্লিয়ে ওঠে।
প্রিয়র রাগ উঠে লোকটার উপর। লোকটা পাতা আপুকে তাদের সাথে থাকতে দিবে না! সে হন হন করে বেড়িয়ে যায় ঘর থেকে। পাতা ডাকে শোনে না।

পেরিয়ে গেছে দুদিকে। এই দুদিন টানা বর্ষণের পর স্বস্তি মিলেছে। বৃষ্টি ভালো লাগলেও টানা‌ দু একদিনের বর্ষণ অনেকের পছন্দ নয়। অনেকের জীবিকা নির্বাহের পথ বন্ধ হয়ে যায় বিশেষ করে যারা দিন আনে দিন খায় তাদের। কেননা কাজে না গেলে তাদের পেটেও কিছু পড়ে না। তাদের জন্য এমন সময় খুবই কষ্টকর। আজ আর বৃষ্টির দেখা মিলে নি। আকাশও পরিষ্কার,মেঘের ছিটেফোঁটাও নেই। সূর্য মামার উপস্থিতিতে রৌদ্রোজ্জ্বল দিন কেটে এখন সাঁঝ বেলা। আবছা আবছা অন্ধকার বিরাজমান ধরনীতে। অরুণ ছেলের হাত ধরে দাঁড়িয়ে আছে আইসক্রিম স্টলের সামনে একটু দূরে। দুজনেই একই ড্রেসআপে।

সাদা শার্টের উপর কালো কোট! টাই বেঁধে একই সুট বুটে বাপ ছেলে! ভোরের জ্বর সেদিন রাতেই ছেড়েছে আর আসেনি। এখন পুরোপুরি সুস্থ, তবে ঠান্ডা আছে। সেটা ওর পুরনো বন্ধু। তারা এখন উপস্থিত আছে এক আত্মীয় বাড়িতে। রুবির দাদুর বাড়ি। রুবির একমাত্র ভাইয়ের দুইমাত্র জমজ মেয়ে আছে। তাদের জন্মদিন উপলক্ষে। সে মোটেও আসতে চায় নি। কিন্তু রুবি এখানে একটু চালাকি করেছে! ভোরকে ফুঁসলিয়ে ফাসলিয়ে রাজি করিয়েছে। এখন জেদি ভোরের আবদারে সে রাজি হতে বাধ্য! ফলাফল সরূপ বাপ বেটা এখানে। রুবি , আরিয়ান, আনিকা ও রুপক এসেছে।

আসমা বেগম ও আদুরি আসতে পারে নি দরকারি কাজে। অরুণ ছেলেকে নিয়ে এদিক সেদিক হাঁটছে। অনুষ্ঠান এখনো পুরোপুরি শুরু হয় নি। এখনো অনেক গেস্ট আসা বাকি! ভোর অরুণের সাথে পা মিলিয়ে চলছে আর এটা ওটা জিজ্ঞেস করছে! আব্বু ওটা কি? আব্বু ওটা এমন কেন? আব্বু ওনার পেট ওতো মোটা কেন? পেটে কি বাবু আছে? ছেলেদের পেটেও বাবু হয়? আব্বু ওই আন্টিটাকে ভুত ভুত লাগছে, মুখে কি দিয়েছে? আরো কতশত। অরুণ কখনো জবাব দেয় কখনো না।

ভোরের এতে হেলদোল নেই সে প্রশ্ন করতে আগ্রহী। হাঁটার মধ্যে হঠাৎ ভোরের নজর যায় আইস্ক্রিম স্টলের দিকে। যেহেতু এটা‌ বাচ্চাদের পার্টি তাই আইসক্রিম স্টল থাকবে না এটা মেনে নেওয়া যায়? ভোর দেখে স্টলের সামনে আনিকা , বার্থডে গার্লস প্রীতি প্রেমা সহ আরো অনেক বাচ্চা আইসক্রিম খাওয়ার প্রতিযোগিতায়। ভোর বাবার হাত ঝাঁকিয়ে আবদার করে,

-” আব্বু ওই দেখ সবাই আইসক্রিম খাচ্ছে। আমিও খেতে চাই! ওখানে চলো না আব্বু?”
অরুণ আইস্ক্রিম স্টলের দিকে একনজর চেয়ে ভোরকে নিয়ে অন্যদিকে হাটা দেয়। ভোর চিল্লাচিল্লি করতে শুরু করে আইসক্রিম খাবে বলে। অরুণ গম্ভীর মুখে শান্ত কণ্ঠে ধমক দেয়,
-” এই চুপ!কাল জ্বর সারলো, সর্দি নাকের ভিতর নিয়ে ঘুরছে আর উনি আইসক্রিম খাবে! সব সময় জেদ করবে না। আমি কিন্তু বকবো?”
ভোরের মুখ কাঁদো কাঁদো হয়ে যায়।
-” আব্বু একটা খাবো বেশি না। প্লিজ? ও আব্বু?”

অরুণ চোখ রাঙায়। ভোর চুপ করে। ঘার ঘুরিয়ে আনিকাদের দিকে চায়। কি মজা করে আইসক্রিম খাচ্ছে ওরা। সে মুখ ফুলিয়ে বাবার হাত ছেড়ে হাঁটতে থাকে। অরুণ হাত পকেটে পুরে বলে,
-” গাল ফুলিয়ে লাভ নেই। আমি এলাও করবো না!”
ভোর কিছু বলে না। অরুণ ভোরের পিছু পিছু হাঁটতে থাকে। ভোর সামনে একটা চেয়ারে উঠে গালে হাত দিয়ে ছলছল চোখে বসে থাকে। অরুণ কিছু বলে না। তার পাশে দাঁড়িয়ে থাকে। ভোর ঘার ফিরিয়ে বার বার আনিকাদের দিকে তাকায়। অরুণ দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে। এই ছেলেটাও না!
-” ওদিকে বার বার তাকাচ্ছো কেন?
ভোর আবার সেদিকে তাকিয়ে বলে,

-” আমার চোখ আমি তাকাবো!”
-” আবার তাকাচ্ছে! লোকে কি বলবে? ছোঁচা ছেলে!”
-” তুমি ছোঁচার আব্বু!”
বলে ভেংচি কাটে। অরুণ শান্ত দৃষ্টিতে চায় অভিমানী ছেলের দিকে। যতই অভিমান করুক এই আবদার মানবে না। হেলথের সাথে কোনো আপস নয়।
-” কাল রাতে তোমাকে কত বড় সারপ্রাইজ দিলাম! তারপরও কিভাবে আবদার করো?”
ভোর বাবার দিকে চায় ঘার উঁচিয়ে। তারপর চেয়ারে পা তুলে দাঁড়ায়। তবুও নাগাল পায়না অরুণের। ইশ আব্বুটা এতো লম্বা! সে কবে এতো বড়‌ হবে! সে অরুণের দিকে আঙ্গুল তুলে বড়দের মতো করে বলে,
-” আমি তোমার সারপ্রাইজের কথা বিশ্বাস করি না আব্বু! তুমি আমায় বাচ্চা ছেলে পেয়ে বোকা বানিয়েছো! তেতো ওষুধ খাইয়েছো! এখন আমার আইসক্রিম চাই! চাই চাই চাই!”

শেষে এক প্রকার চিল্লিয়ে বলে। আশেপাশের লোক এদিকেই তাকিয়ে অদ্ভুত চাইনিতে। অরুণ তাদের চাহনি লক্ষ্য করে ভোরকে চোখ রাঙানি দেয়। আঙুল নামিয়ে দিয়ে কড়া সুরে বলে,
-” এই চুপ! বেয়াদবি করবে না। না বলেছি না! আর কথা নয়। আরেকবার আইস্ক্রিমের কথা বললে ঘার ধরে বাড়ি নিয়ে যাবো!”

ভোরের গোল গোল আঁখি যুগল ভরে ওঠে। নাকের পাটা ফুলে ওঠে।চেয়ার থেকে নেমে দৌড়ে চলে যায়। অরুণ তার যাওয়ার দিকে তাকিয়ে রয়। এই ছেলে এতো ছিঁচকাদুনে!! কিচ্ছু বলাও যাবে না। সে পিছন পিছন যায়। কিন্তু ভোরের নাগাল পায় না। গম্ভীর মুখে আশেপাশে খুঁজতে থাকে। ফুলের বাগানের ওদিকে যেতেই হাসির শব্দ শুনতে পায়। তার পদযুগল থেমে যায়। একটু বেঁকে পাশে তাকাতেই কারো ব্যাক সাইড দেখতে পায়। কোনো মেয়েলি কায়া। অরুণ নজর সরায়। সামনে হাঁটতে শুরু করলেই কিছু স্মরণে আসায় থেমে যায়। পিছু এসে আবার সেখানে দাঁড়ায়। মেয়েলি কায়ার দিকে আবার চায়। চেনা চেনা লাগছে। তার কপাল কুঞ্চিত হয়।

অরুণ খানিকটা এগিয়ে যায়। মেয়েটির এক সাইড দৃশ্যমান হয়। অরুণের কুঞ্চিত কপাল শিথিল হয়। এ যে মিস পাতাবাহার! কিন্তু এখানে? সে পাতার দিকে খেয়াল করে। লং গাউন পড়ে ওড়না একপাশ দিয়ে নিয়েছে। মাথায় হিজাব। মুখশ্রী পুরো দেখা যাচ্ছে না। কিন্তু একটু লম্বা লাগছে। সে পায়ের দিকে চায়। ওহ্ ! উঁচু জুতোর কামাল! সে এগিয়ে যেতে নেয় কিন্তু সামনের দৃশ্য দেখে পা থেমে যায়। চোয়াল শক্ত হয়। পকেটে হাত পুরে সেখানেই দাড়ায়। মিস পাতাবাহার একা নয়। সাথে আরেকজন আছে। সাতাশ আটাশ বছরের যুবক। যার বাহু ধরে পাতা দাঁড়িয়ে। ঠোঁটে মুচকি হাসি। অরুণ হনহন করে চলে আসে সেখান থেকে। মেজাজটা বিগড়ে আছে তার। সে ভোরকে দেখতে পায়। ওইতো ওখানে। পকেটে হাত দিয়ে হাঁটছে গম্ভীর মুখে। সে এগিয়ে যাবে তখন রুবির ভাই আসলাম ডাক দেয়,

-” আরে ভাই। কোথায় থাকেন? এদিকে আসুন।”
অরুণ বিরক্ত হলেও এগিয়ে যায় ভদ্রতার খাতিরে। লোকটি তাকে পরিচয় করিয়ে দেয় সামনে উপস্থিত ব্যাক্তিদের সাথে। তারপর গল্প জুড়ে দেয়।
-” আরে ইয়ার! তোর এতো সুন্দর সুইট কিউট কাজিন আছে আগে বলিস নি? বললে কবে পটিয়ে নিতাম!”
পাতা অস্বস্তিতে পড়ে। কাওসার বন্ধু বাদলের পেটে আস্তে ঘুষি দেয়।
-“শালা ফ্লার্ট বন্ধ কর! ও মিঙ্গেল! জামাই আছে!”
বাদল বুকে হাত দিয়ে কাঁদো কাঁদো গলায় বলে,
-” ইশ! দিল টুট গায়া! ক্রাশ খাওয়ার সাথে সাথেই ছ্যাঁকা খেলাম!”

পাতা মুচকি হাসে। কাওসার ভাইয়ের সাথে এসেছে এখানে। কাওসার ভাইয়ের দুঃসম্পর্কের কি যেন হয় তার নাতনিদের জন্মদিনে। তার সাথে কাওসার ভাই তাদের গৃহ শিক্ষক ছিল । সেই সুবাদে জন্মদিনের দাওয়াত পায়। আত্নীয় মানুষ, হোক দুঃসম্পর্কের! দাওয়াত দিয়েছে না আসলে কেমন দেখায় তাই আসা। পাতাকেও বগলদাবা করে এনেছে।আর কাওসারের বন্ধু বাদল বার্থডে গার্লসদের মামা হয়। পাতা গতকাল বাড়ি ফিরে যেতে চেয়েছিল কিন্তু প্রিয়র জেদের কারণে যেতে পারে নি। থাকতে হয়েছে। কিন্তু কাল তার যাওয়া কনফার্ম। আর থাকবে না। সে কাওসারের বাহু টেনে একটু দূরে যায় ফাঁকা জায়গায়। মিনমিন করে বলে,

-” ভাই চলো এখান থেকে। এতো বড়লোক দের ভিড়ে অস্বস্তি হচ্ছে।”
কাওসার তার মাথায় গাট্টা মেরে বলে,
-” বড়লোকের বউ হয়েছিস। কয়েকদিন পর তাদের ভিড়েই থাকবি এখন থেকেই শিখে নে!”
পাতা কটমট করে চায়। কাওছার হেসে বলে,
-” কেক কাটলেই চলে যাবো। একটু অপেক্ষা কর মেরে বেহনা!”

পাতা বাহার পর্ব ২১(২)

পাতা হেসে দিল। কাওছার তাকে নিয়ে আবার আড্ডায় যোগ দিল।দূর থেকে যে একজোড়া চোখ তাদের দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে পর্যবেক্ষণ করছিল সেদিকে ধ্যান নেই তাদের। কিছুক্ষণ আড্ডা দিয়ে আড্ডা থেকে বেরিয়ে তারা হাঁটতে থাকে চারিপাশ। রাতের অন্ধকারেও চারপাশ ঝলমলে করছে । সব ডেকরেশনের কামাল! হঠাৎ একজন মহিলা ডাক দেয় কাওসারকে। কাওসার পাতাকে বলে,
-” আমি আসছি। দাঁড়া তুই এখানে। এক পাও নড়বি না।।”

পাতা বাহার পর্ব ২৩