পাতা বাহার পর্ব ২৩

পাতা বাহার পর্ব ২৩
বেলা শেখ 

চারদিক ঝলমল করছে কৃত্রিম আলোর প্রভাবে। রাত হলেও এমন ভাবে আলো ছড়াচ্ছে মনে হচ্ছে দিনের বেলা। সুন্দর ডেকোরেশন করেছে গার্ডেন এরিয়ায়। কৃত্রিম ফুলে সজ্জিত বিভিন্ন পিলার , গাছ! হরেক রঙের বেলুন ঝুলছে। অনেক দুষ্টু বাচ্চারা সেগুলো ফাটিয়ে শব্দ সৃষ্টি করছে। গার্ডেনের লাস্ট মাথায় বিভিন্ন কার্টুন যেমন: মটু-পাতলু, ডরিমন, ওগি, শিভা ইত্যাদির পাপেট দাঁড়িয়ে হাসিমুখে। বাচ্চাদের দল তাদের সাথে সেলফি তুলছে। মটুর পেটে গুঁতো মারছে তো ওগির লেজ ধরে টানছে। সেখানে পার্টি লাইট জ্বলছে সাথে মিউজিক।

অনেক বাচ্চা গানের তালে নাচছে। পাতা তাদের নাচ দেখে মুখে হাত দিয়ে হাসে। সেখান থেকে নজর ঘুরাতেই অরুণ সরকারকে দেখতে পায়। তার নেত্রযুগল আপনা আপনি বড় হয়ে যায়। এই লোক এখানে? কিভাবে সম্ভব! আবার তার দিকেই তাকিয়ে আছে যেন চোখ পাকিয়ে শাসাচ্ছে! আচ্ছা তাকে দেখছে নাকি আশেপাশের কেউ? নাহ তার দিকেই তো তাকিয়ে। পাতা হাত নাড়িয়ে হায় জানায়। অরুণ নজর ফিরায়। পাতার ভ্রু যুগল কুঁচকে যায়। সত্যিই লোকটা অরুণ সরকার ওরফে নাক উঁচু ম্যানারলেস লোক তো?

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

নাকি তার মতোই দেখতে অন্যকেউ? ভাই টাই ও হতে পারে! নাক উঁচু লোক হলে তো তাকে দেখে কোনো প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করতো! আর আশেপাশে ভোরকেও দেখছে না‌। নিজের ভাবনায় নিজেই অবাক হয় পাতা! সে পাগল হয়ে যায় নিতো! কি সব ভাবছে। ওটা নাক উঁচু লোকই। তার ষাঁড়ের মতো মুখশ্রী দেখেই চেনা যায়। পাতা হালকা ইতস্তত বোধ করে এগিয়ে যায়। লোকটা কিছু লোকদের সাথে দাঁড়িয়ে কথা বলছে হয়তো! সবাই সুট বুট পরা ধনীর দুলাল কি না! পাতা অস্বস্তি নিয়ে এগিয়ে যায় ধীর পায়ে। হাতের পার্সটা ওড়নার আড়ালে নেয় কৌশলে। পার্সটা একটু পুরনো। পাতা অরুণের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। গলা কাঁপছে কেমন যেন! কথার খেই হারিয়ে ফেলেছে।এসেছে তো কিন্তু কি বলবে ভেবে পাচ্ছেনা। আবার লোকটাও তার দিকে তাকাচ্ছে না। অথচ উপস্থিত সকলে তার দিকে চেয়ে আছে, একজন মহিলাও আছে। সে ভাবে চলে যাবে। কিন্তু যায় না। ঠোঁটে হালকা হাসি ঝুলিয়ে অরুণকে উদ্দেশ্য করে বলে,

-” আপনি এখানে? ভোর এসেছে?”
বলেই ঢোক গিলে পাতা। অরুণ একপল তার দিকে তাকিয়ে আসলাম কে বলে,
-” আসলাম মেহমান আসা শেষ? কেক কখন কাটবে ?”
স্পষ্টতই ইগনোর। পাতা সেদিনের স্টেশনারির কথা মনে পড়ে। এভাবেই ইগনোর করে চলে গিয়েছিল লোকটা। সে আর কিছু বলে না। পা ফিরিয়ে চলে আসে হনহন করে। লজ্জা অপমানে কপোলদ্বয় রক্তিম।
পাতা যাওয়ার দিকে সকলে চেয়ে। অরুণ নির্বিকার। আসলাম বলে,
-” অরুণ ভাই চেনেন নাকি?”
অরুণ তার দিকে তাকিয়ে গম্ভীর গলায় বলে,
-” হুম!”

উপস্থিত লোকের মধ্যে একজন বলে,
-” তাহলে কথা বললেন না কেন? মেয়েটা কিভাবে চলে গেল?”
অরুণ জবাব দেয় না। আসলাম হেসে বলে,
-” ভাইয়ের এক্স নাকি? হুম?”
-” ওয়াইফ!”
সবাই অবাক হয়। আসলাম অবাক সুরে বলে,
-” এটা তো বর্ষা ভাবি নয়! আমি চিনি তাকে!”
অরুণ পকেটে হাত ঢুকিয়ে বলে,
-” ইটস কমপ্লিকেটেড! সময় হোক জানতে পারবে! বাট সি ইজ মায় ওয়াইফ! আসছি!”
বলে চলে যায়! সবাই অবাক হয়! আরে বেটা বউ হয় তো কথা‌ বললি না কেন?

পাতা থমথমে মুখে হাঁটতে থাকে। কোথায় যাচ্ছে ধ্যান নেই। শুধু হাঁটতেই থাকে। লোকটা এভাবে ইগনোর করে সবার সামনে অপমান করতে পারলো! এর আগেও করেছে। তখন তো তাদের মধ্যে সম্পর্ক ছিল না তাই মানা যায়।কিন্তু এখন আছে! ধর্মীয় মোতাবেক তার স্ত্রী সে। হ্যা লোকে জানে না। তাই বলে সৌজন্যের খাতিরেও কথা বলা যাবে না? পাতা তুই এই লোকের সাথে সারাজীবন কাটাবি কি করে! আচ্ছা এমন করার কারণ কি! পাতার মাথা ঝুঁকিয়ে নিজের দিকে চায়। হাতের পার্স , পরণের জামা, জুতা সব দেখে। এসবের জন্য কি?

কমদামি সাজসজ্জার জন্য!! পাতা পাশে দাঁড়িয়ে থাকা দুজন মহিলার দিকে তাকায়। দামি পাতলা সিল্কের শাড়ি গায়ে জড়িয়ে অপরজন ওয়েস্টার্ণ পড়ে। হাতে দামি পার্স, ঘড়ি! মুখে ভারি মেকাপ! বেশ ভালো লাগছে দেখতে। পাতা মলিন হাসে! ওদের সামনে সে কেউ না। তাই হয়তো লোকটা সবার সামনে ইগনোর করলো। পাতা সবসময় কোনো অনুষ্ঠানে গেলে অন্যের সাজসজ্জা ও পোষাক দেখে হিনমন্যতায় ভোগে।এটা তার একটা সমস্যা বলা যায়। পাতা নিজেও জানে এটা ঠিক না। মানুষের পোষাক কখনো তার যোগ্যতার পরিচয় দেয় না।

মানুষের আচরণ কথাবার্তায় ফুটে ওঠে তার ব্যক্তিত্ব। পাতা অন্যমনষ্ক হয়ে হাঁটতে হাঁটতে একজনের সাথে ধাক্কা লাগে। পাতা সরি বলবে কিন্তু তার মুখশ্রী দেখে খানিকটা ভাবনায় পড়ে। মুখের আদলটা চেনা চেনা! হ্যা অরুণ সরকারের মতোই।
আরিয়ান আইসক্রিম লেগে যাওয়া শার্টের দিকে তাকিয়ে রাগি মুখে সামনের রমনীর দিকে চায়। সে ভোরের জন্য আইসক্রিম নিয়ে যাচ্ছিল। একটু মেল্ট হয়ে গেছে। এটা ওতটাও ঠান্ডা হয় না। কিন্তু এই মেয়েটা! সে কড়া সুরে বলে,
-” এই মেয়ে দেখে চলতে পারো না। চোখ আসমানে রেখে হাঁটো? স্টুপিড কোথাকার!”
পাতা শান্ত চোখে চায়। মানছে তার দোষ আছে তাই বলে এভাবে বলবে।

-” দেখুন আমার দোষ আছে মানছি। তার জন্য দুঃখিত।তাই বলে এভাবে বলতে পারেন না। দোষ আপনারও আছে।”
আরিয়ান ফুঁসে ওঠে।একে তো তার পার্টির ড্রেস নষ্ট করে দিল তার উপর এটিটিউড দেখাচ্ছে।
-” আমি চোখ কান খোলা রেখেই হাঁটছিলাম। তুমি হুট করে সামনে এসে ধাক্কা দিলে।আবার সাফাই গাইছো যে আমার দোষ আছে!”
পাতা বিরক্ত হয়ে বলে,
-” হয়েছে সব দোষ আমার খুশি? ছেলেমানুষ এতো ঝগরুটে হয় জানতাম না!”

আরিয়ান তেড়ে আসে।রুবি তার বাহু ধরে থামায়। আরিয়ান পাতার দিকে আঙুল তুলে শাষানো ভঙ্গিতে বলে,
-” তোমার সাহস কি করে হয় আরিয়ান সরকারকে ঝগরুটে বলার। এইটুকু মেয়ে আবার বড় বড় কথা! ভারি বেয়াদব তো তুমি। তোমার গার্ডিয়ান ডাকো ?”
পাতা চোখ বড়বড় হয়ে যায়। কি নাম বললো? আরিয়ান সরকার! ওই নাক উঁচু লোকটার আত্মীয় হবে! স্বভাব চেহারা দুটোতেই মিল আছে। পাতা ক্লোজ আপ হাসি দেয়।

-” দেখুন মি. আমি স্কুল পড়ুয়া বাচ্চা নই যে গার্ডিয়ান নিয়ে ঘুরব। আমি এক স্বনামধন্য স্কুলের শিক্ষিকা! আর হ্যা কখন থেকে তুমি তুমি করছেন? অপরিচিত কাউকে প্রথম দেখায় তুমি বলা কেমন ভদ্রতা?”
বলে আর দাঁড়িয়ে থাকে না। হালকা এটিটিউডের সাথে মাথা উঁচু করে চলে যায়। আরিয়ানের চোয়াল ঝুলে যায়। সে রাগে কটমট করে রুবির দিকে চায়।

-” এইটুকুনই মেয়ে! কলেজই পার করে নি বোধহয় বলে কি না স্কুলের শিক্ষিকা! এই আজকালকার মেয়েরা এতো বেয়াদব যা বলার বাহিরে। এই তুমি হাসছো কেন?”
রুবির হাসি দীর্ঘ হয়। হাসতে হাসতে আরিয়ানের বাহু জড়িয়ে বলে,
-” তুমি আসলেই একটু ঝগরুটে বুঝলে সরকার!মেয়েটা ঠিক বলেছে”
আরিয়ান ঝটকা মেরে তার হাত সরিয়ে হনহনিয়ে চলে যায়। রুবির হাসি কমে না।
পাতা রাগে গজগজ করতে করতে আইসক্রিম স্টলের দিকে আসে। শালার সরকার গুষ্টি সুদ্ধই অহংকারী। অহংকারে পা যেন মাটিতে পড়ে না। অরুণ সরকার গোমড়া মুখো ক্ষ্যাপা ষাঁড়। আর এটা ঝগরুটে বলদ! লাফায় বেশি শালা! বাকি নমুনা গুলো না জানি কোন গোয়ালের! হাঁটতে হাঁটতে সে আবার ধাক্কা খায়। দাঁতে দাঁত চেপে কিছু বলবে কিন্তু তার আগে ঝাড়ি পড়ে।

-” এই তোকে না বললাম ওখানেই দাঁড়িয়ে থাকবি এক পাও নড়বি না। অথচ তুই ড্যাং ড্যাং করে ঘুরে বেড়াচ্ছিস! এক চটকানা লাগাবো!”
পাতার গাল ফুলায়। সামনে একটা বাচ্চাকে দেখতে পায়। ফরমাল পোষাকে ভোর সরকার! কালো প্যান্ট,ব্লেজার, টাই ও ভিতরে সাদা শার্ট। পকেটে হাত ঢুকিয়ে গম্ভীর মুখে হাঁটছে। একদম বাবার মতো, পুরাই জেরক্স কপি। যেন ছোট্ট অরুণ সরকার। পাতা ডাকে না শুধু তাকিয়ে দেখে তার গতিবিধি। এদিকে ওদিকে ঘুর ঘুর করছে। বারবার আইসক্রিম স্টলের সামনে বাচ্চাদের দিকে তাকাচ্ছে।
কাওছার পাতার বাহু ধরে ঝাকুনি দেয়।

-” কি রে কোথায় হারিয়ে গেলি। আমি বকছি কানে ঢুকছে না?
পাতা নজর হাটায় না। ভোরের দিকে ইশারা করে। কাওসার সেদিকে চায়। পাতা মুচকি হেসে বলে,
-“কাওসার ভাই ওই বাচ্চাটা কালো সুট বুট পরে পকেটে হাত গুজে আছে। দেখেছো?”
কাওসার দেখে বলে,
-” হুম! চিনিস?নাকি পছন্দ হলো?”
পাতা তার বাহু জড়িয়ে বলে,
-” আমার ছেলে বুঝলে!”
কাওছার তাকে ছাড়িয়ে মাথায় গাট্টা মেরে বলে,
-” হ্যা। তোর ছেলে ! আল্লাহ পাক মাত্রই আকাশ থেকে ঢিল দি..”

বলতে বলতে থেমে যায়। পাতার দিকে তাকায় প্রশ্নাত্মক চাহনিতে। সে যা ভাবছে তাই কি? পাতা মুচকি মাথা নাড়ে। যার অর্থ তাই! কাওছার বাচ্চাটার দিকে চায়। বেশ দেখতে! কিউট বিড়াল ছানার মত! দেখলেই আদর করতে মন চাইবে। পাতা হেসে বুকে হাত গুটিয়ে ভোরের দিকে চায়।

ভোর পকেট থেকে হাত বের করে ব্লেজার খোলার চেষ্টা করে। গরম লাগছে তার। কিন্তু খুলতে পারছে না। তার রাগ লাগছে সাথে কান্নাও পাচ্ছে। চাচ্চু বলেছিল আইসক্রিম আনবে। কিন্তু কই আইসক্রিম!! সে মুখ ফুলিয়ে আইসক্রিম স্টলের দিক এগোতে থাকে। সেই চেয়ে নেবে ওই আঙ্কেলের থেকে। বাবা দেখবে দেখুক! সে টুপ করে মুখে পুরে নিবে, ব্যস হয়ে গেল। সে হনহন করে হাঁটতে গিয়ে থেমে যায়। সামনে মিস পাতা দাঁড়িয়ে! সে চোখ ডলে সত্যি দেখছে নাকি স্বপ্ন! না স্বপ্ন না। ওটা পাতা মিসই। মুচকি হাসছে তার দিকে তাকিয়ে। পাশে কেউ আছে কিন্তু সেটা দেখার সময় নেই তার সে দৌড়ে যায়। পাতা হেসে দু হাত বাড়িয়ে দেয়। ভোর দৌড়ে তার কোলে ওঠে।
-” আসসালামুয়ালাইকুম মিস!কেমন আছো? তুমি এখানে? আমার জন্য এসেছো? আব্বু ডেকে এনেছে তোমায়? কথা বলছো না কেন?”

পাতা হেসে ওঠে।এতো চঞ্চল এই বাচ্চাটা! তার তো সন্দেহ হয় এতো মিষ্টি বাচ্চা কিনা ওই গম্ভীর মুখো নাক উঁচু ম্যানারলেস লোকটার। নিশ্চয়ই কোনো ভদ্রলোকের থেকে বাচ্চা চুরি করে এনেছে। চেহারায় মিল না থাকলে সে বাচ্চা চুরির কেস ঠুকে দিত কনফার্ম।
-” আরে বাবা আস্তে! কোনটা রেখে কোনটার উত্তর দেব! আচ্ছা তুমি বলো আগে? এখানে কেন তুমি?”
ভোর হেসে বলে,
-” আনিকার কাজিনদের হ্যাপি বার্থডে! তাই এসেছি! আব্বু,চাচ্চু, চাচিমনি, আনিবুড়ি, রুপও এসেছ!”
-” তাই?”
-” হুম। তুমি চলো ওদের সাথে দেখা করিয়ে দেই?”
-” নাহ! অন্যসময়। এখানে একা একা ঘুর ঘুর করছিলে কেন?”
ভোর এবার গাল ফুলায়। আনিকাদের দেখিয়ে অভিযোগের সুরে বলে,

-” মিস দেখ? সবাই আইসক্রিম খাচ্ছে! আব্বুকে বলেছিলাম আব্বু ধমক দিয়ে বলে ঘার ধরে বাড়ি নিয়ে যাবে। তাই রাগ করে চলে এসেছি! আড়ি তার সাথে!”
পাতা হেসে তার গালে চুমু খায়। ভোর অপর গাল এগিয়ে দেয়। পাতা সেখানেও দেয়। ভোর কপাল থুতনিতেও আদর আদায় করে নেয়। পাতা তাকে কোল থেকে নামিয়ে দিল। চুলের মাঝে হাত বুলিয়ে বলে,
-” জ্বর থেকে মাত্রই সেরে উঠলে।এখন আইসক্রিম খেলে জ্বর বাবাজি আবার হাজির হবে। তাই আইসক্রিম খাওয়া তো ঠিক হবে না ভোর!”
ভোর দু আঙ্গুল দেখিয়ে কাঁদো কাঁদো গলায় বলল,

-” এইটুকুনই খেলেও কি জ্বর আসবে?”
পাতা মুচকি হাসে। আরে এতো সুইট করে বললে তো খুবই মুশকিল! ওর বাবা ধমক দেয় কিভাবে? সে কিছু বলবে তার আগে কাওছার ভোরের গাল টিপে বলে,
-” নাতো কিচ্ছু হবে না। তবে এইটুকুই কিন্তু হ্যা?”
ভোর চেনে না তাকে। সে প্রশ্নাত্নক চাহনিতে পাতার দিকে চায়। পাতা তার চাহনি বুঝতে পেরে বলে,
-” আমার ভাই! তোমার মামা হয়!”
-” তোমার কতগুলো ভাই মিস?”
কাওছার ভোরকে কোলে নিয়ে স্টলের দিকে যেতে যেতে বলে,
-” অনেক গুলো!”

পার্টিতে মানুষের ঢল। বিশেষ করে বাচ্চাদের। তারা এদিকে ওদিকে দৌড়াদৌড়ি করছে। বেলুন ফাটাচ্ছে। অরুণ তাদের মাঝে ছেলেকে খুঁজে। সেই যে পালালো আর দেখা নেই। আরিয়ান রুবির কাছেও নেই। আইসক্রিম স্টলের আশেপাশেও খুঁজে পায় নি। অরুণ গার্ডেনের শেষ মাথায় যায়। সেখানে আনিকা, প্রীতি প্রেমাসহ তাদের বন্ধুরা নাচছে। সবার মাঝে আনিকাই ছোট্ট। প্রীতি প্রেমা ক্লাস ফাইভে। তাই তাদের বাচ্চাও বলা যায়। অরুণ তাদের ডেকে হাত নাড়িয়ে জিজ্ঞেস করে,

-” বাচ্চারা? আনিবুড়ি ভোরকে কোথাও দেখেছো?”
লাউড মিউজিকের আওয়াজে কেউ শুনতে পায় না। অরুণ ভিতরে যায়। বাচ্চাদের হইহুল্লোড়ে একেবারে যাচ্ছেতাই অবস্থা। অরুণ গলা উঁচিয়ে জিজ্ঞেস করে কিন্তু কেউ শুনতে পায় না। পাবে কি তাদের নজরেই আসে নি বিশাল দেহি অরুণ সরকার। অরুণ গিয়ে মিউজিক ওফ করে দেয়। এবার বাচ্চারা চিল্লিয়ে ওঠে। অরুণ কানে হাত দেয়। প্রীতি এগিয়ে আসে। অরুণকে দেখে বলে,

-” কি হয়েছে আঙ্কেল?”
অরুণ প্রীতিকে জিজ্ঞেস করে,
-” ভোরকে দেখেছো তোমরা?”
প্রীতি খানিক ভেবে বলে,
-” ওকে তো আইস্ক্রিম স্টলের পিছনে দেখেছিলাম! ওখানেই আছে হয়তো!”
-” থ্যাংক ইয়ু প্রীতি!”

বলে তার মাথায় হাত বুলিয়ে চলে যায় অরুণ। সাথে সাথে মিউজিক অন হয়, বাচ্চারা পুনরায় ‘ইয়ে’ বলে চিল্লিয়ে ওঠে। অরুণ বেরিয়ে এসে সোজা আইসক্রিম স্টলে যায়। একবার খুঁজে পাক কলিজাকে! একদম হাতছাড়া করবে না। সে এগিয়ে যায়। সেখানে গিয়ে দেখতে পায় মহারাজ কোন আইসক্রিম খাচ্ছে মজা করে। সে একা নয় পাশে আরো দুজন হাসি ঠাট্টায় আইসক্রিমে মজে আছে।
অরুণ সেখানে গিয়ে বুকে হাত গুজে দাঁড়ায়। তিনজনেরই নজর আকর্ষণ করতে সফল হয়। পাতা তাকে দেখেও চুপচাপ আইসক্রিম মুখে পুরে। ফ্রি আইসক্রিম কার না ভালো লাগে! আহা! কাওছার প্রথমে চিনতে না পারলেও ভোরের ড্রেসাপের সাথে মিল দেখে বুঝতে পারে ইনি কে! সে পাতার দিকে চায়। ভোরের চোখ জোড়া রসগোল্লার ন্যায়। সে একবার আইসক্রিম তো আরেকবার বাবার দিকে চায়। তারপর বাকি থাকা অল্প আইসক্রিম গপ করে মুখে পুরে নেয়। গালদ্বয় ফুলে ঢোল!
অরুণ ভোরকে ডাকে,

-” কাম টু মি ভোর!”
শক্ত কঠিন গলা শুনে দ্বিরুক্ত না করে ভোর পাতার দিকে একবার তাকিয়ে অরুণের কাছে যায়। অরুণ কিছু বলে না। রুমাল বের করে ছেলের মুখ মুছে দিয়ে কোলে তুলে নেয়। ভোরের মুখে হাসি ফুটে ওঠে। বাবা বকে নি! সে বাবার গালে চুমু দিয়ে কানে কানে ফিসফিস করে বলে,
-” আব্বু তুমি যে কাল রাতে বড় সারপ্রাইজের কথা বললে সেটা কি সত্যিই? দেখ মজা করবে না!”
অরুণ পাতার দিকে তাকিয়ে জবাব দেয়,
-” হুম!”

ভোর খুশি হয়ে আরেকটা চুমু দেয়। মিটমিট হেসে পাতার দিকে চায়।পাতার ভ্রু দ্বয় কুঁচকে যায় বাপ ছেলে কি গুসুর ফুসুর করছে। এই না বলছিল আড়ি তার সাথে!!
কাওছার এগিয়ে এসে হাত বাড়িয়ে বলে,
-” আপনিই অরুণ সরকার! পাতা বলেছিল! আমি ওর কাজিন কাওছার হাবিব!”
অরুণ গম্ভীর মুখে বাড়ানো হাতের দিকে চেয়ে। পাতা ভিত হয় খানিক। লোকটা কি হাত মেলাবে না? না মেলালে কাওছার ভাইয়ের অপমান হবে। সে নাক উঁচু লোকটাকে ছাড়বে না। অরুণ হাত বাড়িয়ে হ্যান্ডশেক করে। কাওছার হেসে বলে,

-” প্রীতি প্রেমার কি হন আপনি? না মানে..”
-” আমার ভাই জামাই এ বাড়ির! তার শ্যালকের মেয়ে হয় দুজন!”
-” ওহ্!”
অরুণ পাতার দিকে চায় পুনরায়। সেদিকে দৃষ্টি স্থির রেখে কাওছারকে বলে,
-” আপনারা?”
কাওছার হেসে বলে,

-” স্টুডেন্টস ছিল আমার! আর তাছাড়া রমজান দাদু আমার দাদুর খালাতো ভাই ছিল। অনেক দূরের সম্পর্ক!”
-” ওহ আর উনি কি বিনা দাওয়াতে এসেছে নাকি?”
পাতাকে ইশারা করে বলে অরুণ। পাতার চোখ মুখ শক্ত হয়। কাওছার হেসে বলে,
-” কিছুটা তেমনই!”
পাতা কটমট করে বলে,
-” কাওছার ভাই!!”
কাওছার পাতার গাল টিপে বলে,
-” আরে রাগিস ক্যান! জামাইয়ের সামনে হাসি মুখে থাকবি, বুঝলি?”
পাতা চোখ রাঙায়। অরুণের চোয়াল শক্ত হয়। ভোরকে পাতার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলে,
-” ওকে নিন!”
পাতা কাওছারের সামনে কিছু বলে না। কোলে নেয়। পাঁচ বছরের ছেলে ওতটাও ছোট নয়। কোলে নিয়ে থাকা অনেকটা কষ্টকর! আর পাতার মতো চেঙ্গিস খানের পক্ষে আরো কষ্টকর। কাওছার বুঝতে পেরে কোলে নিতে চাইলে অরুণ বলে,

-” ওনার কাছেই থাক! তুমি আসো আমার সাথে? আর মিস পাতাবাহার নামিয়ে দিন। তবে হাত ছাড়বেন না মোটেও!আর এখান থেকে কোথাও যাবেন না”
বলেই পা বাড়ায় অরুণ।‌ কাওছার পাতার দিকে তাকিয়ে ঠোঁট উল্টিয়ে অরুণের পিছু পিছু চলে যায়। পাতা ভোরকে নামিয়ে দিল। হাতটা শক্ত করে ধরে বলে,
-” তোমার আব্বু কোথায় গেল?”
-” কি জানি!”

পাতা ভোরের হাত ধরে অপেক্ষা করতে থাকে। ভোর আইসক্রিম এর দিকে তাকিয়ে বলে,
-” দেখ আইসক্রিম গুলো ডাকছে আমায়। বলছে ভোর এসো আমাদের খাও!”
পাতা ভোরের বলার ভঙ্গি দেখে হেসে দেয় খিলখিলিয়ে। সাথে যোগ দেয় ভোরও। দুজনের হাসিতে মুখরিত পরিবেশ। আশেপাশের অনেকে তাদের দিকে তাকিয়ে । কেউ বাঁকা নজরে তো কেউ বিরক্ত হয়ে। পাতা ভোরের সেদিকে খেয়াল নেই তারা হাসি বিলাস করতে ব্যস্ত।
বেশ সময় নিয়ে অরুণ আসে। ভোরকে কোলে নিয়ে পাতার উদ্দেশ্যে বলে ,
-” ফলো মি!”

বলেই হাঁটা দেয়। পাতার কপাল কুঞ্চিত হয়। কাওছার ভাই কোথায়?ভেবেছিল এই নাক উঁচু লোকটার সাথে কথা বলবে না। কিন্তু কথা না বলার স্কোপ রাখে নি! সে অরুণের সাথে পা মিলিয়ে হাঁটতে হাঁটতে বলে,
-” ফলো মি মানে? কাওছার ভাই কোথায়?”
অরুণ হাঁটতে হাঁটতে ছোট্ট করে জবাব দেয়,
-” মেরে দিয়েছি!”
পাতার পদযুগল থেমে যায়। চোখ বড় বড় করে জিজ্ঞেস করে,
-” মেরে দিয়েছি মানে? দেখুন একদম ফাজলামি করবেন না। কাওছার ভাইকে ডাকুন?”

অরুণ পিছিয়ে এসে পাতার হাত ধরে একপ্রকার টেনে নিয়ে যায়। পাতা আশ্চর্য হয়ে তার হাতের দিকে তাকিয়ে। যা অরুণ সরকারের শক্ত খসখসে উষ্ণ হাতের মুঠোয় বন্দি! ভাবতেই গা শিরশির করে উঠে। কিন্তু মস্তিষ্কে ভেসে ওঠে কিছুক্ষণ আগের দৃশ্য। সে হাত ছুটাতে চায়। মোচরাতে শুরু করে। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হয় না বরং। আরেকটু শক্ত করে চেপে ধরেছে। পাতা দাঁতে দাঁত চেপে বলে,
-” কি হচ্ছে টা কি ছাড়ুন! একটু আগে তো আমায় চিনতেই পারছিলেন না! সকলের সামনে ইগনোর করলেন! আমার মধ্যবিত্ত বেশভূষা দেখে সবার সাথে পরিচয় করিয়ে দিতে কুণ্ঠাবোধ হচ্ছিল?”
অরুণ হাঁটা থামায় না। পাতাকে টেনে নিয়ে যেতে যেতে জবাব দেয়,
-” বেশি বোঝেন আপনি!”
পাতা আরো রেগে যায়।

-” হ্যা বেশি বুঝি! কাওছার ভাই কোথায় সেটা বলুন? আশ্চর্য টানাটানি করছেন কেন? লোকে দেখছে!! কি ভাববে?”
-” ওহ্ এখন লোকে দেখছে। তখন বাহু জড়িয়ে হি হি করে হাসছিলেন তখন লোকে দেখছিলো না?”
শক্ত গমগমে আওয়াজ। পাতার ছোটাছুটির প্রচেষ্টা থেমে যায়। লোকটা তাকে দেখেছিল! অরুণের কথাগুলো পুনরায় আওড়িয়ে ভাবে। লোকটা কি কাওছার ভাই ও তাকে দেখে সামহাও জেলাস? কথার টোনে তো সেটাই বোঝা যাচ্ছে, কেমন রাগি রাগি আভাস! তখনও কিভাবে তাকিয়ে ছিল! পাতা অরুণের গম্ভীর মুখশ্রীর দিকে চায়। গোফ দাড়িতে ঢাকা চোয়ালদ্বয় শক্ত। তার গলা জড়িয়ে ভোর তার দিকেই তাকিয়ে মিটিমিটি হাসছে। পাতা তার দিকে ছোট ছোট করে চায়। ভোরের প্রতিক্রিয়া সেম। পাতা অরুণকে বাজিয়ে দেখতে বলে,

-” আমার ভাই হয় সে! লোকে দেখলে কি?”
-” কেমন ভাই? আপন তো নয়! ওভাবে ঘোরাঘুরি করলে যে কেউ যা কিছু ভাবতে পারে!”
ফটাফট জবাব অরুণের। পাতা সন্তুষ্ট হয় না।
-” লোকের ভাবাভাবিতে আমার যায় আসে না! আমি ঘুরবো তাতে কার কি হুঁ?”
অরুণ থেমে যায়। পাতার হাত ছেড়ে দিয়ে পাতার কাঁধ জড়িয়ে নেয় নিজের সাথে।
-” অনেকের অনেক কিছু! যা আমার তা পুরোপুরিই আমার! সেখানে অন্যকারো হস্তক্ষেপ সহ্য করবো না! ”
পাতা অবাকের চুড়ান্ত পর্যায়ে। তার ছোট্ট শরীর কেঁপে উঠলো যেন। সবকিছু এতো জলদি ঘটলো যে তার মস্তিষ্ক কাজ করা বন্ধ করে দিয়েছে। তার কথা কিছুই মাথায় ঢোকে নি। শুধু এটুকু বুঝতে পারছে সে লোকটার বাহুতে বন্দি!
অরুণ ছেলেকে একহাতে বুকে জড়িয়ে অপরহাতে পাতাকে বন্দি করেছে। পা চালিয়ে চলতে থাকে গন্তব্যের উদ্দেশ্যে। পাতা চুপটি মেরে অরুণের বাহুতে আবদ্ধ হয়ে রোবটের মতো হাঁটছে। আপাদত সে মনের আঙ্গিনায় সৃষ্ট হওয়া সদ্য অনুভূতির সাথে পরিচিত হচ্ছে।

অরুণ পাতাকে নিয়ে গেটের কাছে চলে আসে। সেখানে এখন মানুষের উপস্থিতি কম। দারোয়ান সহ আরো কিছু গেস্ট দাঁড়িয়ে। বাকি সবাই অনুষ্ঠানে। একটু পরেই কেক কাটা হবে কি না! অরুণ গাড়ির সামনে আসে। তাকে দেখে ড্রাইভার রঞ্জু সালাম দিয়ে ড্রাইভিং সিটে বসে। অরুণ পাতাকে ছেড়ে ছেলেকে নামায়। পাতা যেন জানে প্রাণ ফিরে পায়। তার গলা‌ শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে।একটু পানি পেলে ভালো হতো! অরুণ গাড়ির দরজা খুলে পাতাকে উদ্দেশ্য করে বলে,
-” গাড়িতে উঠুন!”
পাতা নিজেকে স্বাভাবিক করে। কোমড়ে হাত দিয়ে অরুণের দিকে কটমট করে বলে,
-” উঠবো না! কি করবেন আপনি?”
অরুণ দরজা বন্ধ করে দেয়।
-” ভালোয় ভালোয় উঠুন! নইলে?”
-” নইলে কি?”
অরুণ গাড়িতে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে বলে,

-” ভাববেন না কোলে নিয়ে বসাব! ঘার ধরে নিয়ে বসাব! উঠুন?”
শেষে ধমকেই বলে! পাতা ভয় পায় খানিকটা। স্মরণ হয় শুকলাকে পেটানোর দৃশ্য। তার শুকনো গলা যেন মরুভূমির ন্যায় রুপ ধারণ করে। সে আমতা আমতা করে বলে,
-” দেখুন?”
-” এখন দেখবো না! জলদি উঠুন?”
পাতার চোখ কপালে।এই লোক নাক উঁচু, ম্যানার তো জানেই না। সাথে অসভ্যও! সে ভয় গিলে খায়। আঙ্গুল তুলে শাসিয়ে বলে,
-” অসভ্য বর্বর লোক! বাচ্চার সামনে বাজে কথা হচ্ছে! যাবো না আমি? কি করবেন? জোর করবেন? এমন চিল্লানি দিব পুরো পার্টির মানুষ দু মিনিটে এখানে হাজির হবে! বিশ্বাস হচ্ছে না?”
অরুণ বিরক্ত হয়। যা তার চেহারায় স্পষ্ট। পাতা ভেংচি কাটে। অরুণ চোখ রাঙায়। ভোরকে বলে,
-” উঠতে বলো ওনাকে?”

ভোর বুকে হাত গুজে পাতার মতো ভেংচি কেটে বড়দের মতো বলে,
-” আমি কেন বলবো? তুমিই বলো! আর একটু মিষ্টি করে অনুরোধ করে বলবে।”
অরুণ ভোরের দিকে চায় শান্ত ভাবে। পাতা গালে জিভ ঠেকিয়ে মুচকি মুচকি হাসে। আব আয়া না উঠ পাহাড় কা নিচে!! অরুণ পাতার দিকে তাকিয়ে দরজা খুলে। পাতা ঠোঁটে বিজয়ী হাসি। অরুণ ভোরকে শূন্যে তুলে গাড়িতে বসিয়ে দেয়। তারপর সময় ব্যয় না করে পাতার দিকে খানিকটা এগিয়ে আসে ! পাতার চোখের আকার বড় হয়। অরুণ হাত বাড়িয়ে তার গাল টিপে বাহু ধরে তাকেও বসিয়ে দেয়। তারপর দরজা লাগিয়ে গাড়ির অপর দরজা দিয়ে নিজে প্রবেশ করে ড্রাইভারকে হুকুম দেয়,

-” স্টার্ট দা কার!”
পাতা ভোর হা করে চেয়ে। অরুণ তাদের দিকে তাকিয়ে বাঁকা হেসে সিটে গা এলিয়ে দেয়। ভোর বাবার বাহুতে মারতে মারতে বলে,
-” আব্বু এটা চিটিং! তুমি চিটিং করেছো!”
অরুণ কিছু বলে না। ছেলের ছোট্ট দু হাত নিজের এক হাতের মুঠোয় বন্দি করে। ভোর ছাড়িয়ে গাল ফুলিয়ে বসে। পাতাও গাল ফুলিয়ে অন্যদিকে চায়।

জোৎস্না রাত। গতদিনের তুমুল বর্ষপাতের পর আজ আকাশ পরিষ্কার। তারকারাজি মিটমিটিয়ে হাসছে। শশীরাজ তার ম্লান আলোয় ধরনীকে আলোকিত করার চেষ্টায়। এমন পরিবেশে গ্রামীণ পিচঢালা রাস্তা দিয়ে একটি গাড়ি ধীর গতিতে ছুটে চলছে। গাড়িতে চারজন লোকের উপস্থিতি। ড্রাইভার মঞ্জু যে গাড়ি চালাচ্ছে। ফ্রন্ট সিট ফাঁকা। পিছনের ড্রাইভারের সাইডের জানালার পাশে বসে অরুণ সরকার। ওপাশে পাতা বসে। মাঝখানে ভোর সরকার। পিনপিন নিরবতা বিরাজমান। গাড়ির ইঞ্জিনের শব্দ ব্যাতিত আর কোনো আওয়াজ শোনা যাচ্ছে না। নাহ শোনা যাচ্ছে রাতের পোকার ঝিঁঝিঁ ডাক। অরুণ গম্ভীর মুখে বাইরের দিকে তাকিয়ে। একহাত খোলা জানার গ্লাসে। ভোর চুপচাপ বসে। ঠোঁটে হাসি নেই।

পাতা আড়চোখে বাপ বেটাকে পর্যবেক্ষণে ব্যস্ত। চুপচাপ কেন? ওই নাক উঁচু লোক ষাঁড়ের মত মুখ বানিয়ে রাখবে তার জানা!তাই তাকে নিয়ে মাথাব্যথা নেই কিন্তু এই ছোট্ট সাহেবের কি হলো? মুখে হাসি নেই কেন ? আবার দুঃখি ভাবও লাগছে না!সে ভোরের পিঠ পিছন দিয়ে হাত এগিয়ে অরুণের শক্তপোক্ত পিঠে খোঁচা মারে। অরুণ সোজা হয়ে বসে কুঞ্চিত কপালে একবার ভোরের দিকে চায়। ভোরকে চুপ দেখে পাতার দিকে চায়। পাতা ইশারায় ভোরকে দেখিয়ে বোঝায় ‘কি হয়েছে’ অরুণ বিরক্তিকর চাহনি নিক্ষেপ করে পুনরায় বাইরে মনোযোগ দেয়। পাতা কটমট করে চায়! শালা নাক উঁচু ম্যানারলেস লোক! তোর গালে ইয়া বড় পিম্পল হবে দেখেনিস! তারপর ভোরের দিকে অসহায় চোখে চেয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে থাকে। কিছু বলবে এর আগে ভোর পাতার কোলে বসে গলা জড়িয়ে ধরে। পাতা চোখ পিটপিট করে চায়। ভোর মুচকি হেসে পাতার মুখোমুখি হয়ে পলকহীন তাকিয়ে থাকে।কিছু বলে না। পাতা ভ্রু উঁচিয়ে বলে কি? ভোর কিছু বলে না, তাকিয়েই থাকে। পাতা ভোরের গালে চুমু দিয়ে বলে,

পাতা বাহার পর্ব ২২

-” কি হয়েছে..”
আর বলতে পারে না পাতা। ভোর পাতার গালে হাত বুলিয়ে কপালে চুমু খেয়ে উজ্জ্বল নেত্রদ্বয় স্থির রেখে এক বুক ভালোবাসা নিয়ে ডাকে,
-” আম্মু!”
ডাকটা পাতার কলিজায় লাগে। সে তো কখনো মা হয় নি! মা হওয়ার অনুভূতির সাথে বড্ড অপরিচিত!

পাতা বাহার পর্ব ২৪