পাতা বাহার পর্ব ২৪

পাতা বাহার পর্ব ২৪
বেলা শেখ 

আর বলতে পারে না পাতা। ভোর পাতার গালে হাত বুলিয়ে কপালে চুমু খেয়ে উজ্জ্বল নেত্রদ্বয় স্থির রেখে এক বুক ভালোবাসা নিয়ে ডাকে,
-” আম্মু!”

ডাকটা পাতার কলিজায় লাগে। সে তো কখনো মা হয় নি! মা হওয়ার অনুভূতির সাথে বড্ড অপরিচিত! মা কেমন হয়? লাবনী আম্মুর মতো? যে কিনা বাচ্চা জন্মের আগেই অন্য কাউকে দেয়ার প্রতিশ্রুতি দেয়?একমাসের দুধের বাচ্চাকে অন্যের হাতে তুলে দেয়। নাকি পারুল মায়ের মতো? প্রথমে সন্তানের মতো ভালোবাসে! তারপর নিজের সন্তান এলেই ভালোবাসা ফুরিয়ে যেতে শুরু করে তার মাতৃ হৃদয় থেকে।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

তার মন কুঠুরিতে মা সুন্দর একটি শব্দ উৎকণ্ঠিত হলেই সে ভাবনায় পড়ে মা আসলে কেমন হয়? মায়েদের নিয়ে তার অভিজ্ঞতা খুবই নড়বড়ে। সে কি ভোরের মা, না আম্মু হতে পারবে? বাচ্চাটা কতটা আবেগ ঢেলে তো ডেকে দিল! সে কি তার মর্যাদা রাখতে পারবে? পারুল মায়ের মতো নিজ সন্তান এলে ভালোবাসা কি ফুরিয়ে যাবে না? পাতার মেরুদন্ড বেয়ে এক শীতল স্রোত বইয়ে গেল। নিজের শৈশবের বাজে স্মৃতি স্মরণে আসে। তবে সে নিজের কাছেই প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয় আজকের এই আম্মু ডাকের মর্যাদা সে রাখবে। সাথে সাথে উপর ওয়ালার কাছে আর্জি খারিজ করে, এই ‘আম্মু’ ডাকের মর্যাদা ক্ষুন্ন হয় এমন কাজ যেন তার দ্বারা না হয়।

সে ভাবনা থেকে বেরিয়ে অরুণে দিকে চায়। লোকটা এতো জলদি বলে দিল বাচ্চাটাকে? সে তো ভয়ে ছিল! ভোর বাচ্চা ছেলে। মায়ের কথা মনে আছে, এমনকি দেখাও করে, ভালোবাসে! নিজ চোখে দেখা তার। সেখানে তাকে মায়ের দরজা দিতে পারবে? তাকে এজ আ টিচার পছন্দ করলেও মা হিসেবে নিশ্চয়ই পছন্দ করবে না। রেগে যাবে নিশ্চয়ই? তাকে ছেলেটার মন জয় করতে হবে মা হিসেবে। কিন্তু এখানে সবকিছু অন্যরকম হলো!

অরুণ ভ্রুযুগল কুঁচকে যায়। ভোর পাতার দিকে মুচকি হেসে তাকিয়ে প্রতিক্রিয়ার আসায়! আর এই মেয়ে তার দিকে তাকিয়ে আছে হা করে! আবার পলক ফেলছে না। আম্মু ডাক শুনে ফিট খেয়ে যায় নি তো আবার! সে পাতার দিকে চেপে এসে বসে। নাহ তাও এই মেয়ের হেলদোল নেই। ড্রাইভার মঞ্জু আড়চোখে কয়েকবার তাকিয়েওছে। অরুণ এবার বিরক্ত হয়। আঙ্গুল দিয়ে পাতার নাক চেপে ধরে। সেকেন্ড পঁচিশ বাদে পাতা ঝাঁকুনি দিয়ে উঠে। চোখ পিটপিট করে। অরুণের দিকে চোখ বড় বড় করে চায়। অরুণ ভোরের দিকে ইশারা করে। পাতা ভোরের দিকে চায়। তার কোলে বসে গলা জড়িয়ে তার দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসছে। পাতার অধরকোণে হাসি ফুটে ওঠে। ভোরের ছোট্ট আদুরে মুখ খানা আঁজলায় ভরে। ভোরের চোখ উজ্জ্বল হয় সাথে অধরকোণের হাসি ছড়িয়ে পড়ে। পাতা লক্ষ্য করে। ভোরের কপালে অধর ছুঁয়ে চুমু দেয় সময় নিয়ে। ভোর হাসি মুখে পুনরায় ডাকে,

-” আম্মু?”
পাতার চোখ ভরে ওঠে। কেন? জানা নেই। সে ভোরের কপাল হতে অধর সরিয়ে গালে চুমু খেয়ে ভোরকে বুকে জড়িয়ে ধরে। চোখে পানি অন্যপাশে ফিরে মুছে নেয়।
অরুণের বুকটা যেন ভরে উঠলো। তনুমন জুড়ে ভালোলাগার রেশ ছড়িয়ে পড়লো কি?পাতার লুকিয়ে চোখ মোছা দেখে অধরকোণে ফুটে ওঠা হাসি লুকিয়ে গমগমে গলায় বলে,
-” ছিঁচকাদুনে!”
পাতার রাগ হওয়ার বদলে হাসি পায়।
-” মোটেও না!”
-” হ্যা দেখতেই পাচ্ছি!”
পাতা বিরক্ত হয়ে অরুণের দিকে তাকায়।
-” আপনি আমার সাথে ঝগড়া করতে চাচ্ছেন?”
অরুণ পাতার দিকে দৃষ্টি স্থির রেখে জবাব দেয়,
-” না!”

পাতা অরুণের চোখে চোখ রাখে শান্ত ভঙ্গিতে। তাকিয়েই থাকে সরায় না নজর। না পলক ফেলে। অরুণ মৃদু হেসে চোখ সরিয়ে বাইরে তাকায়। পাতা পলক ঝাপটায়।
-” ভোরকে কখন জানিয়েছেন?”
ভোর মাথা তুলে পাতার দিকে হাসিমুখে বলে,
-” কাল রাতে বলেছে আম্মু! আমি প্রথমে একটুও বিশ্বাস করিনি! আব্বু বলে অনেক বড় সারপ্রাইজ দিবে ওষুধ খাওয়ার পর। তাই আমি ওই পচা তেতো ওষুধ খেয়ে ছিলাম। তারপর যখন বলল এখন থেকে তুমি আমার আম্মু! আমি একটুও বিশ্বাস করি নি! আব্বু আই লাভ ইওর সারপ্রাইজ! থ্যাংক ইয়ু!”
পাতা তার খুশি দেখে হতভম্ব। এতোটা খুশি? সে ভোরের গালে ঠোঁট ডাবিয়ে চুমু খায়।

-“তাই?”
ভোর মাথা নাড়ে কিউট ভঙ্গিতে। অরুণ তার গাল টিপে বলে,
-” শুধু পাকা পাকা কথা!”
ভোর জিভ বের করে ভেটকায় । পাতা হেসে ওঠে। ভোর পাতার গলা জড়িয়ে বলে,
-” আম্মু এখন তুমি আমাদের সাথে থাকবে! তাই না? আমরা অনেক মজা করবো? তুমি কিন্তু আমার সাথে খেলবে? আম্মু তুমি সাইকেল চালাতে পারো?”

-” হুম । পারি তো!”
-” তাহলে আমাকেও শিখিয়ে দিবে! ঠিকাছে?”
পাতা তার চুল গুলো এলোমেলো করে বলে,
-” তোমার সাইকেল আছে?”
-” নেই! তবে চাচ্চু বলেছে এবার ঈদে আমায় ও আনিকে সাইকেল কিনে দেবে! তুমি বলো শিখিয়ে দিবে?”
-” আচ্ছা বাবা দেব!”
বলে আড়চোখে অরুণের দিকে চায়। নাক উঁচু লোকটা তাদের দিকেই চেয়ে। পাতা চোখ সরিয়ে নিয়ে ভোরকে বলে,

-” তোমার চাচ্চুর নাম কি ভোর?”
ভোর পাতার কোল থেকে নেমে অরুণের কোলে পা তুলে দিয়ে পাতার কোলে মাথা রেখে শুয়ে পাতার দিকে তাকিয়ে বলে,
-” আরিয়ান সরকার। চাচিমনির নাম রুবি! দাদির নাম আসমা বেগম। দাদার নাম অনিক সরকার!”
ভোরের মুখে আরিয়ান নাম শুনে পাতার মুখটা চুপসে যায়। এই আরিয়ান সরকারের সাথে তো সে কোমড় বেঁধে ঝগড়া করে এলো।
অরুণ ছেলের পায়ের শু ,মুজো জোড়া খুলে দিয়ে ছেলের পায়ে চুমু খায়। ভোর পা সরিয়ে নিয়ে হাসতে হাসতে বলে,

-” আব্বু সুরসুরি লাগে তো!”
অরুণ তার পা জোড়া পুনরায় কোলে নিয়ে পায়ের আঙ্গুল টেনে দেয়। পাতা ভোরের চুলের মাঝে হাত গলিয়ে দেখতে থাকে এক যত্নশীল বাবাকে। কতটা ভালোবাসা ও যত্নে মুড়িয়ে রাখে ছেলেকে। সে গোপনে দীর্ঘশ্বাস ফেলে অরুণকে বলে,

-” এখন বলুনতো কাওছার ভাই কোথায়? অনুষ্ঠানে খুঁজছে নিশ্চয়ই আমাকে! ইয়া আল্লাহ!”
অরুণের আচ্ছাখাচ্ছা মেজাজটা বিগড়ে যায়। পাতার দিকে তাকিয়ে বলে,
-” বললাম না মেরে দিয়েছি!”
-” দেখুন ফাজলামি বাদ দিন! ভালোয় ভ..! এক মিনিট কল করলেই তো ল্যাটা চুকে যায়!”
বলেই উইন্ডোজের পাশে পার্স থেকে ফোন বের করে। ভোর দ্বিধা যুক্ত গলায় বলে,
– “আম্মু ল্যাটা চুকে যাওয়া কি?”
-” ও ওহ্। দ্যাট মিনস প্রবলেম সলভড!”

বলেই ফোন অন করে। কিন্তু কল করতে পারে না। অরুণ হাত বাড়িয়ে ফোনটা কেড়ে নেয়। ফোন এপিঠ ওপিঠ করে দেখে! কমদামি একটা ফোন! উর্ধ্বে দশহাজার হবে! পাতা অরুণের হাত থেকে ফোন নেওয়ার চেষ্টায়।
-‘ আশ্চর্য ফোন নিলেন কেন? দিন বলছি! ভালো হবে না কিন্তু?”
ভোর উঠে এসে পাতাকে সাহায্য করার উদ্দেশ্যে বাবার হাত থেকে ফোন কেড়ে নিতে চায়। পাতা আবার বলে,
-” দিন বলছি? আমি কিন্তু রেগে যাবো?”
-” আমি তো ভয় পেয়ে গেলাম! কলিজা আমার ভয় করছে!”

ভোর খিলখিলিয়ে হেসে দেয়। পাতা অরুণের দিকে এগিয়ে আসে। তার উঁচিয়ে রাখা হাত থেকে ফোন নেওয়ার জন্য বাহু ধরে টান দেয়। ভোর সিটের উপর দাঁড়িয়ে বাবার হাত থেকে ফোন ছিনিয়ে নিয়ে আম্মুকে দিবে, তার আগে অরুণ কৌশলে ভোরের হাত থেকে ফোন নিয়ে পকেটে পুরে। পাতা কটমট করে চায়।
-” শালার জামাই!”
বলেই জিভে কামড় লাগায়। শালার মুখ! এখনি ফসকে যেতে হলো? অরুণ চোখ রাঙ্গায়। পাতা বোকা হেসে বলে,
-” স্লিফ ওফ টাং! ভোর কিছু শুনো নি তাই না?”
ভোর বাধ্য ছেলের মতো মাথা নাড়ায় শোনে নি। অরুণ ভোরকে সিটে বসিয়ে দিল। ভোর তার ছোট্ট হাত বাড়িয়ে পাতাকে জড়িয়ে ধরে। পাতা তার পিঠে হাত বুলিয়ে দেয়। আড়চোখে অরুণের দিকে তাকিয়ে বাইরে নজর দেয়। অরুণ কিছু বলে না।

পিনপিন নিরবতা বিরাজ করছে গাড়িতে। ভোর ঘুমিয়ে পড়েছে পাতার কোলে মাথা রেখে। পাতা তার চুলের ভিতরে হাত গলিয়ে আদুরে ভঙ্গিতে বুলিয়ে দিচ্ছে। অরুণ পাতার দিকে তাকিয়ে বলে,
-” ওবাড়ি কবে ফিরবেন?”
পাতা অরুনের দিকে চায়।
-” কাল ভোরেই রওনা দেব! কেন?”
অরুণ সিটে গা এলিয়ে বলে,
-” আমার ফ্যামিলি যাবে আপনাদের বাড়ি! ডেইট ঠিক করতে! ঈদের দু দিন পরে! আপনার কোন সমস্যা ?”
পাতা মলিন হাসে। তার কি সমস্যা? সে তো চায় দ্রুত ওবাড়ির দায়িত্বের বেড়াজাল থেকে বেরিয়ে আসতে। সে তো সেদিন রাতেই নাক উঁচু লোকটার সাথে চলে যাবে ভেবেছিল। কিন্তু লোকটা সরাসরি বলে ‘ সে ধুমধামের সাথে নিয়ে যাবে।’ পাতা অরুনের কথার জবাব দেয়,

-” না সমস্যা নেই। তবে একটা অনুরোধ! আমরা মধ্যবিত্ত আপনাদের মতো লাক্সারিয়াস আয়োজ..’
পাতাকে থামিয়ে অরুণ গম্ভীর গলায় বলে,
-” সে বিষয়ে আপনাকে ভাবতে হবে না। আমি আছি তো!”
‘আমি আছি তো’ কথাটা পাতার কানে বাজে। লোকটা আছে তো। নাক উঁচু ম্যানারলেস লোকটাকে সে চেনেই না ভালোভাবে অথচ লোকটার সাথে তার ভবিষ্যৎ আস্টেপিষ্টে জড়িয়ে। তার সাথে থাকতে হবে বাকিটা জীবন! কেমন হবে তাদের সংসার? আদৌ হবে তো!
পাতাকে চুপ থাকতে দেখে অরুণ বলে,
-” মিস পাতাবাহার?”
পাতা চমকে পাশে চায়। অরুণ তার মাথায় হাত রেখে বলে,

-” আপনি আমার থেকে বয়সে অনেকটা ছোট! পুরো এক যুগেরও বেশি গ্যাপ আছে। আমরা একে অপরকে ভালোকরে জানিও না। আমাদের পথচলা খুব একটা সহজ হবে না বোধকরি! আপনি খুবই ভালো একটা মেয়ে। কিন্তু আমি লোকটা ওতটা ভালো নই। আপনার ধারনায় অহংকারী! হয়তো তাই।কিন্তু আমার ছেলেটা খুবই নরম মনের। ভালোবাসা, আদরের কাঙাল। ওকে কেউ আদর করলেই ,একটু ভালোবাসা জাহির করলেই তার আগেপিছে ঘুরঘুর করবে আরো আদরের আশায়। আমার কলিজা ও। একদন্ড না দেখলেই দমবন্ধ বন্ধ লাগে। আপনার কাছে একটাই চাওয়া আমার ছেলেটাকে একটু ভালোবাসবেন। কখনো অবহেলা করবেন না প্লিজ।

আমি আমার ছেলের দায়িত্ব কাউকেই দিইনি। নিজেই সব পালন করার চেষ্টা করেছি! বর্ষার সাথে ডিভোর্স হওয়ার পর নিজের হাতে বড় করেছি। ছোট্ট ছেলেকে বগলদাবা করেই অফিস সামলিয়েছি! বাড়ির কারো কাছে একদিনের জন্যও রেখে যায় নি। এমন না যে ওরা অযত্ন করবে! তবে আমি চাইনি আমার ছেলেকে সবাই মা নেই বলে এক ফোঁটাও করুণা করে দায়িত্ব নিক! সেই আমি আমার কলিজাটাকে দিচ্ছি আপনাকে। অনুরোধ কখনো অবহেলা করবেন না। একটু আদর, যত্ন, ভালোবাসা দিয়ে বুকে আগলে নিবেন। তবে করুণা করে নয়‌।”
বলে থামে। পাতার চোখ বেয়ে জল গড়িয়ে পড়ে। তড়িৎ বেগে মুছে নেয়। ড্রাইভার রঞ্জুর চোখেও অশ্রুর আভাস‌। অরুণ পাতার ক্রন্দনরত মুখশ্রী দেখে বলে,

-” আরে কাঁদবেন না! আপনি দেখছি ভোরের চেয়েও বেশি ছিঁচকাদুনে!”
পাতা হেসে বলে,
-” আমি ছিঁচকাদুনে নই!”
-” হ্যা তাই তো!”
-” আপনি মজা নিচ্ছেন?”
অরুণ মাথা নাড়ায়, নাতো! পাতা তার দিকে তাকিয়ে হেসে ফেলে। অরুণ তার হাসি দেখে। পাতা হাসি থামিয়ে বলে,
-” আমারো কিছু বলার আছে আপনাকে?”
অরুণের কপালে ভাঁজ পড়ে।
-” এটা বলবেন না যে আপনার বয়ফ্রেন্ড আছে। তাকে ছাড়া বাঁচবেন না ব্লা ব্লা! একবার যখন অরুণ সরকারের সাথে জুড়ে গেছেন আর নিস্তার নেই।”
পাতার অধরকোনের হাসি বিস্তার লাভ করে!
নজর ফিরিয়ে জানালার বাইরে দৃষ্টি ফেলে বলে,

-” আমার কিছু বলার আছে। আমি আগেই জানিয়ে রাখতে চাই!”
-“বলুন?”
পাতা সামনে ড্রাইভারের দিকে চায়। অরুণ পাতার মনোভাব বুঝতে পেরে রঞ্জুকে বলে,
-” রঞ্জু ভাই? সামনে কোনো সেফ জায়গায় গাড়ি দাঁড় করাও!”
রঞ্জু সায় জানায়। একটু এগিয়ে গিয়ে গাড়িটা থামায়। অরুণ নেমে জায়গাটা পর্যবেক্ষণ করে রঞ্জুকে বলে ,
-” তুমি আশপাশ দিয়ে ঘুরে এসো। লোকালয়ের ভিতরে যেও না। চোর ভেবে গনধোলাই খাবে। কাছাকাছিই থেকো!”

ড্রাইভার সায় জানিয়ে চলে যায়। অরুণ পাতাকে বেরিয়ে আসতে বলে ভোরকে সিটে শুইয়ে দিয়ে। পাতা বেরিয়ে আশে। আশপাশ দেখে গা ছমছম করে ওঠে। এটা তো তেঁতুল তলা। ছোটবেলায় কতো তেঁতুল পেরে নিয়ে গেছে এখান থেকে। শুনেছে ভুত আছে এখানে। সে মিনমিন করে অরুণকে বলে,
-” গাড়িতে বসেই কথা বলি! বাইরে কেমন গা ছমছমে পরিবেশ!”
অরুণ আবছা আলোয় পাতার দিকে চায়। মেয়েটাকি ভয় পাচ্ছে। কিন্তু কিসে? তাকে নাকি অন্ধকার ছমেছমে পরিবেশ কে?

-” তুমি কি.. স্যরি আপনি কি ভয় পাচ্ছেন?”
পাতা দরজা লাগিয়ে অরুণের কাছে যায়। ভয় তো তার করছেই। তবে বললে এ লোক মজা উড়াবে!
-” তুমি বলতে পারেন! আর ভয় করছে না আমার। এমনি বললাম অন্ধকার তো!”
-” অন্ধকার ওতটাও খারাপ নয়! অন্ধকার আছে বলেই আলোর এত কদর। আপনি অন্ধকারে ভয় পান অনেকে অন্ধকারকেই জীবন বানিয়ে বেঁচে থাকার স্বপ্ন বুনে!”
পাতা কিছু বলে না। অন্ধকারে তার ফোবিয়া আছে বলা যায়! অরুণ খেয়াল করে পাতা কেমন গুটিয়ে আছে। ভয় কি বেশি পাচ্ছে? ভয় কিসের সে আছে তো!
-” কি যেন বলতে চেয়েছিলেন?”
পাতা মাথা নাড়ায়। দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলতে শুরু করে,

-” মধ্যবিত্ত ফ্যামিলি আমাদের। আগে অবস্থাটা আরো নিচু ছিল। নিম্ন মধ্যবিত্ত যাকে বলে। আব্বুর অল্প বেতনের সরকারি চাকরি। একটা মেয়ে ও একটা ছেলে ভালোই চলছিল। কিন্তু তাদের সুখের সংসারে আগাছার সরূপ আমার আগমনের বার্তা আসে যেটা অনাকাঙ্ক্ষিত। আব্বু আম্মু রাখবে না। অভাবের সংসারে দুজন বাচ্চার খাওয়া পড়ালেখার খরচ চালাতেই হিমশিম। সেখানে আরেকজন! তো কথাটা কোনো ভাবে সম্পর্কে আমার খালার মা বলে ডাকি তার কানে যায়। সে নিসন্তান ছিল তখন! শতচেষ্টা করেও বাচ্চা হচ্ছিল না। সে খালুকে বাবা বলে ডাকি নিয়ে চলে আসে আমাদের বাড়ি‌। আব্বু আম্মুকে অনুরোধ করে বাচ্চাটা যেন তাকে দিয়ে দেয়। অনেক অনুরোধ অনুনয় করার পর সিদ্ধান্ত হয় বাচ্চা জন্মের একমাস পর বাচ্চার সকল দায়িত্ব তারা কাঁধে তুলে নিবে।

তো একমাসের বাচ্চা মেয়েটা জন্মদাত্রী ছেড়ে অন্য নিসন্তান মায়ের কোলে যায়। আদর যত্নে বড় হয়। তার তিন চার বছর পর নিসন্তান দম্পতির কোল আলো করে পুত্র সন্তান হয় নাম পাবেল। সবাই খুশি। ছোট্ট মেয়েটাও খুশি ভাই হয়েছে। দিন যায় বছর পেরিয়ে ‌। এক বৃষ্টি মুখর সন্ধ্যায় সে জানতে পারে সে যাকে মা বাবা বলে ডাকে তারা আসল বাবা মা নয়। তাকে পালক এনেছে বোনের কাছ থেকে। তবে সে জানতে পারে এটা কেউ জানে না‌। বছর যায় দম্পতির কোলে আরেকটা মেয়েকে হয় নাম প্রিয়। তো সব মিলিয়ে চলতে থাকে জীবনের নৌকা। সেই মেয়েটা বড় হয় তেরো চৌদ্দ পেরিয়ে পনেরো। বাবার ব্যবসায় ব্যাপক লস হয়।

সংসারে অভাব অনটন আসে। যৌথ সংসার কতগুলো পেট! বাচ্চাদের পড়াশোনা! সবাই ঠিক করে পালিত মেয়েটিকে রেখে আসবে। এখানে অভাবের সংসারে কষ্ট করে থাকার চেয়ে ওখানে ভালো ভাবে থাকতে পারবে। তো একদিন মেয়েটি স্কুল থেকে ফিরে দেখে তার জামাকাপড় নেই। সব ব্যাগে ভরে রেখেছে।‌ সে কারণ জিজ্ঞাসা করলে তাকে আদর করে খাইয়ে নাইয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে সত্যিটা জানায়। মেয়েটা খুব ভয় পায় যেতে চায় না। কান্না জুড়ে দেয় মায়ের পা জড়িয়ে।

তার কান্নায় কেউ গলে না। ব্যাগপত্র নিয়ে পাঠিয়ে দেয়। তারপর তার নতুন জীবন শুরু হয়।‌ নিজের আসল বাবা মায়ের ঘরে বড় হয়। তারা খুব দায়িত্বের সাথে তাকে লালণ পালন করে। ভাগ্যিস সেদিন রেখে গিয়েছিল। নইলে জীবনে অনেক আফসোস থেকে যেত। সে যাইহোক! আমি আপনাকে সব জানিয়ে রাখলাম! পরে কারো থেকে শুনে বলতে পারবেন না।”
একনাগাড়ে কথা গুলো বলে পাতা খানিকটা হাঁপিয়ে যায়। অরুণ গম্ভীর মুখে বুকে হাত সবটা শোনে।‌ পাতার কথা শেষ হলেই বলে,

-” হয়েছে বলা? এসব জানি! নতুন কিছু বলার থাকলে বলুন!”
পাতার কপালে ভাঁজ পড়ে।
-” জানেন মানে? কিভাবে জানেন? কে বলেছে?”
-” বলেছে কেউ।”
-” কে বলেছে?”
-” আপনাকে জানতে হবে না!”
পাতা সন্দেহ নজরে চায়। লোকটা তার ব্যাপারে খোঁজ খবর নিয়েছে কি? অরুণ পাতার সামনে দাঁড়ায়। খানিকটা ঝুকে বলে,
-” মিস পাতাবাহার! আপনি ভুতে বিশ্বাস করেন?”

পাতার চোক্ষুযুগল বড় বড় হয়ে যায়। সে ভুতে দিনের বেলায় বিশ্বাস না করলেও রাতে ষোলো আনা বিশ্বাস করে! সে ঢোক গিলে। এখানকার পরিবেশ গা ছমছম ভুতুড়ে! তেঁতুল তলা! শুনেছে তেঁতুল গাছ ভুতের বাসস্থান! চারদিকে অন্ধকার। আশেপাশে কোনো বসতি নেই! কিছু বাঁশঝাড় আছে। সেখানে জোনাকির দল উড়ে বেড়াতে দেখা যাচ্ছে।দাদির মুখে শুনেছে জোনাকি পোকার সাথেও ভুত প্রেত থাকে। কিছু বাদুড় তেতুল গাছের ডালে ঝুলছে সাথে অদ্ভুত শব্দ তৈরি করছে। চাঁদের ম্লান আলোয় সব স্পষ্ট! পাতার ভয়টা দ্বিগুণ হারে বেড়ে যায়। তবে অরুণকে বুঝতে না দিয়ে বলে,

-” নাহ্ ভুত বলতে কিছু হয় নাকি! সব ভুয়া! জলদি চলুন! রাত অনেক হয়েছে!”
বলে গাড়ির দিকে পা বাড়ালে অরুণ তার হাত টেনে ধরে। পাতা ঘার ঘুরিয়ে অরুণের দিকে চায়। তার দিকে তাকিয়ে কেমন করে যেন হাসছে! কি হয়েছে এর? ভুতে টুতে ধরে নি তো! ওহ্ আল্লাহ! সে অরুণের হাত ছাড়ানোর চেষ্টা করে বলে,

-” এই এই ছাড়ুন! দেখুন ভোরের বাবা ভালো হচ্ছে না কিন্তু?”
অরুণ পাতাকে টেনে কাছে আনে।‌ কাঁধ জড়িয়ে তার বুকের নিচে পড়ে থাকা পাতাকে শক্ত করে ধরে।
-” আরে পালাচ্ছেন কেন? আপনি বললেন না ভুত প্রেত কিছু হয় না? শুনুন হয়! আজ আপনাকে প্রমাণ দেখাবো! সরাসরি ভুতের সাথে সাক্ষাৎ করাবো মিস পাতাবাহার?”

পাতা ভয় পেয়ে যায় খুব। একে অন্ধকার তার উপর তেঁতুল গাছ। সেখানে আবার বাদুড় ঝুলছে! তার উপর নাক উঁচু ম্যানারলেস লোকের বিহেভিয়ার চেঞ্জ! ভুত ধরেছি কিনা আল্লাহ জানে! নাকি তার সাথে মজা করছে! সে মজা হোক বা সত্যি সে ঘাবড়ে গেছে পুরো! শরীর ও কপাল বেয়ে শ্বেদ জল গড়িয়ে পড়ছে। পাতা ভয়ে মুখ উঁচিয়ে অরুণের বুকে লুকাল। অরুণ ঢোক গিলে! এই মেয়ে তো দেখি সাংঘাতিক! সে সরানোর চেষ্টা করে পারে না। পাতা যেন আরো চিপকে যায় ভয়ে। খামচে ধরে পেটের কাছের শার্ট! অরুণের হৃদযন্ত্রটা ধুকপুক করে। নিজেকে সামলে পাতাকে নিয়ে এগিয়ে যায়। তেঁতুল গাছের গোড়ায় গিয়ে বলে,

-” মিস পাতাবাহার! সামনে তাকান?”
পাতা তাকায় না। অরুণের বুকে মুখ লুকিয়ে বিড়বিড় করে বলে,
-” প্লিজ প্লিজ চলুন এখান থেকে আমার ভয় করছে! অন্ধকার ভয় পাই আমি! প্লিজ?”
অরুণ আশ্বাসের সুরে বলে,
-” আরে চোখ খুলুন তো ভুত বাবাজিও অপেক্ষায় আছে আপনার সাথে সাক্ষাৎকার করার জন্য! আরে?”
পুরনো বাজে স্মৃতি মাথার ভিতর কিলবিল করে। অন্ধকার! ভয়ানক আওয়াজ! ঠক ঠক আওয়াজ! কান্নার সুর!পাতা রেগে মেগে কেঁদেই দেয়,

-” রাখ বেটা তোর সাক্ষাৎকার! বা*লের ভুত টুতরে যেতে বল এখান থেকে! আমি ভয় পাই! আম্মুওও”
অরুণ চোখ বুজে! এই সুন্দর শান্ত শিষ্ট আদুরে মেয়ের মুখের ভাষা এতো জঘন্য! সে পাতাকে ধমক দিয়ে বলে,
-” এক থাপ্পড় লাগাবো! মুখের কি ভাষা! কোথা থেকে শিখেছেন এসব? আমার কানে আরেকবার গেলে আমার হাত আপনার গাল!”

পাতা রাগে দুঃখে ভয়ে বাকহারা। একবার নিস্তার পাক এই লোকের গুষ্টি তুষ্টি করে দেবে। অরুণ হতাশ হয় এই মেয়ে এখনো মুখ লুকিয়ে। সে নিজেকে শান্ত করে। সামনের বাঁশঝাড়ের দিকে তাকায়। বেশকিছু জোনাক পোকার দল আলো জ্বালিয়ে উড়ে বেড়াচ্ছে। অন্ধকারে বেশ লাগছে দেখতে।সেটাই দেখাতে এনেছিল। কিন্তু এই ভিতু মেয়ে!!
-” মিস পাতাবাহার ভুত নেই কোনো! মজা করেছি! চোখ খুলে দেখুন?”

পাতা মাথা ঝাঁকিয়ে না করে। অরুণের এবার রাগ হয়। পাতাকে ছাড়িয়ে হনহন করে হাঁটা দেয়। পাতা চোখ খুলে আম্মু বলে গাড়ির দিকে ছুটে যায়। অরুণ দরজা খুললে সে তড়িৎ বেগে ভিতরে ঢুকে আয়াতুল কুরসি পাঠ করে। তখন মনে না পড়লেও এখন পড়ছে। ভোরের মাথা পুনরায় কোলে তুলে নেয়। অরুণ চুপচাপ বাইরে দাঁড়িয়ে ড্রাইভারকে কল করে। ড্রাইভার সাথে সাথেই আসে। অরুণ ভিতরে ঢুকে। পাতা জানালার দিকে সেটে যায়। অরুণ বিরক্ত হয়ে বলে,

-” ভুত ভর করেছে আমার উপর! আপনার ঘার মটকাতে মন চাইছে! ইডিয়েট কোথাকার!!”
পাতার চেহারা কাঁদো কাঁদো হয়ে যায়। আবারো পুরনো বাজে স্মৃতি মাথার ভিতর কিলবিল করে। অন্ধকার! ভয়ানক আওয়াজ! ঠক ঠক আওয়াজ! কান্নার সুর! পাতা জোরে জোরে শ্বাস টানে। ড্রাইভার গাড়ি স্টার্ট দেয়। অরুণ বিরক্ত ভঙ্গিতে পাতাকে বলে,
-” আপনার বাড়ি কোন দিকে? ইন্স্ট্রাকশন দিন ওনাকে!”
পাতা নিজেকে শান্ত করে কিছু সময় নিয়ে তারপর বলে,

-” এই রাস্তাদিয়েই! আরেকটু এগিয়ে বামে মোড়! তারপর একটু সোজা গেলেই পৌঁছে যাবো!”
ড্রাইভার সেই মোতাবেক স্টিয়ারিং ঘুরিয়ে দক্ষ হাতে গাড়ি চালিয়ে অল্প সময়ের ব্যবধানে পৌঁছে যায়। পাতা দরজা খুলে দিল। অরুণ ভোরকে তার কোল থেকে নিয়ে বুকে জড়িয়ে ধরে। ঘুমে আচ্ছন্ন ভোরের ঘুম কেটে যায়। পিটপিট করে চোখ খুলে আশেপাশে চায়।অরুণ নেমে দাঁড়ায় ভোরকে কোলে নিয়ে। পাতা গাড়ি থেকে নেমে পা উঁচিয়ে ভোরের গালে হাত বুলিয়ে অরুণকে বলে,

-” ভেতরে চলুন?”
-” নো! থ্যাংকস!”
গম্ভীর গলায় বলে অরুণ। পাতা ভোরকে বলে,
-” তাহলে আসছি আমি! সাবধানে যাবে?”
বলে পা বাড়িয়ে সামনে আগায়।
ভোর ঘুম জড়ানো গলায় বলে,
-” আব্বু আম্মু চলে যাচ্ছে কেন? আমাদের সাথে থাকবে না?”
অরুণ ছেলের গালে চুমু দিয়ে বলে,
-” কিছু দিন পর থেকে থাকবে!”
-” আমি আম্মুর সাথে যাই?”
অরুণ ছেলের দিকে চায়।
-” তোমার আম্মু তো তোমায় রেখেই চলে গে..”

বলে শেষ করতে পারে না অরুণ সরকার। সম্মুখে পাতা দাঁড়িয়ে। একটু এগিয়ে গিয়েছিল। আবার এভাবে দৌড়ে এলো কেন? ভয় পাচ্ছে নাকি আবার।
পাতা লম্বা শ্বাস টেনে অরুণকে বলে,
-” ভোরকে আমার সাথে নিয়ে যাই? আজ আমার সাথে থাকুক? প্লিজ?”
ভোরের মুখে হাসি ফুটে ওঠে। হাত বাড়িয়ে দিল পাতার দিকে। পাতা কোলে তুলে নিয়ে চুমু খায়। অরুণ কিছু বলবে পাতা অরুণকে উদ্দেশ্য করে বলে,

-” আমি খেয়াল রাখবো আমার ছেলের। আপনার চিন্তা করতে হবে না।”
অরুণের গম্ভীর মুখে হাসি ফুটে ওঠে। ছেলের মাথায় হাত বুলিয়ে বলে,
-” কিছু খাইয়ে দিবেন। আসি আব্বু? দুষ্টুমি করবে না কলিজা! আর কাল ভোরে রেডি থাকবেন। আপনাকে সহ পিক‌ করে নেব!”
সম্মতি পেয়ে পাতা ও ভোর দুজনের মুখই উজ্জ্বল হয়। একসাথে মাথা নাড়ে দুজন। পাতা বলে,
-“সাবধানে যাবেন? পৌঁছে ফোন করবেন!”
কথায় স্পষ্ট অধিকারের ছাপ। অরুণ মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানায়।

-” আপনারা ভেতরে যান?”
পাতা অসম্মতি প্রকাশ করে বলে,
-” আপনি যান! আমরা এখানে দাঁড়িয়ে!”
-” ভয় পাচ্ছে না এখন?”
পাতা হেঁসে না বোঝায়। অরুণ তার নাকে টোকা দিয়ে গাড়ির দরজা খুলে ভিতরে প্রবেশ করে। ড্রাইভার গাড়ি স্টার্ট দেয়। অরুণ খোলা জানালা দিয়ে মাথা বের করে ডাকে,

পাতা বাহার পর্ব ২৩

-” পাতাবাহার?”
পাতা প্রশ্নাত্মক চাহনিতে চায়। অরুণ শান্ত দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে পুরু ঠোঁট নাড়িয়ে আওড়ায়,
-“সুখ পাখি হয়ে এসে আমাদের বিষাদে ঘেরা জীবনকে সুখের রাজ্যে প্রতিস্থাপিত করো! রাজত্ব সপে রানির হালে রাখবো!”

পাতা বাহার পর্ব ২৪ (২)