তোমাতেই আসক্ত পর্ব ১০
তানিশা সুলতানা
অহনা আদ্রিতার কোলে তুলে দেয় বাচ্চাকে। এবং একটু আরাম করে বসে। সদ্য সিজার করা হয়েছে। দীর্ঘক্ষণ বাচ্চা কোলে রাখলে পেরেশান হয়ে ওঠে।
আদ্রিতা বাচ্চাকে কোলে নিলো ঠিকই তবে মনে মনে বিরবির করে বলে
“কয় বছরের জন্য যে আমার কোলে তুলে দিলো আল্লাহ জানে”
ইদানীং এ্যানি ভীষণ জেলাস ফিল করে। এই যে আদ্রিতার কোলে ছোট্ট বাচ্চা যাকে এই মুহুর্তে টপাটপ চুমু খাচ্ছে এটা দেখে তার হিংসা হচ্ছে। মনে হচ্ছে তাকে গুরুত্ব কম দিচ্ছে।
অসহায় এ্যানি বসে পড়ে আদ্রিতার পায়ের কাছে। কুটুর কুটুর নয়নে তাকিয়ে থাকে। অপেক্ষা করে কখন এই বাচ্চাটা নামবে তার মালিকের কোল থেকে।
আতিয়া বেগম একটার পর একটা বাটি এনে রাখছে টেবিলে। একটু আগে যে আদ্রিতা মস্ত বড় এক খানা কথা বলেছে বেমালুম ভুলেই গিয়েছে বোধহয় তিনি।
কোনো জবাব দিলো না। প্রতিক্রিয়া করলো না?
কেনো?
কেনো?
কেনো?
আবরার শান্ত নয়নে তাকিয়ে আছে আদ্রিতার পানে। সিয়াম একবার আদ্রিতাকে দেখছে তো আবার আবরারকে।
অতঃপর কিছু একটা চিন্তা করে এক গাল হাসে। বা হাতে চুল গুলো পেছনে ঠেলে টিশার্ট খানা টেনেটুনে ঠিক করে নেয়। পকেট থেকে ফোন বের করে তার স্কিনে নিজের চেহারা খানা একবার দেখে নেয়।
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
“আদ্রিতা তোমার জন্য একটা ছেলে দেখেছি।
বলতে বলতে এগিয়ে যায়। একদম আদ্রিতার পাশে গিয়ে বসে পড়ে। অহনা ছোট ছোট নয়নে সিয়ামের পানে তাকিয়ে বলে
” তোকে কে দায়িত্ব দিছে আদ্রিতার জন্য ছেলে খোঁজার?
“আহহহহ অহনা। তুই সারাজীবন বলদই থেকে যাবি।
আমিও বাংলাদেশি আদ্রিতাও বাংলাদেশি। তো আমার একটা দায়িত্ব রয়েছে না?
আদ্রিতা বলো দায়িত্ব আছে না?
আদ্রিতা খুশি হয়ে কিছু বলতে যাবে তার আগেই আতিয়া বেগম বলে ওঠে
” আমি কখনো আদ্রিতার বিয়ে দিবো না৷
সিয়ামের হাসি মুখটা চুপসে যায়। সেই সাথে আদ্রিতারও। তাকে বিয়ে দেওয়া হবে না? মানে সারাজীবন সিঙ্গেলই কাটাতে হবে৷ গভীর রাতে বরের সাথে রোমাঞ্চ করা হবে না। চুমু খাওয়া হবে না। বাচ্চার মা হওয়া হবে না। বরের কোলে ওঠা হবে না।
এটা মানা যায়?
আদ্রিতা মানতে পারবে? কখনোই না।
রোমাঞ্চ করার জন্য হলেও বিয়ে করতেই হবে।
আচমকা আদ্রিতা চিৎকার করে দাঁড়িয়ে পড়ে। চিল্লিয়ে বলে
“মা আমার বিয়ে করতেই হবে। একটা জীবন জামাইয়ের আদর ছাড়া কাটাতে পারবো না আমি।
চারজন সদস্য বড় বড় নয়নে তাকায় আদ্রিতার পানে। আবরার চোয়াল শক্ত করে ফেলে। ইচ্ছে করছে ঠাটিয়ে একটা থা প্প ড় বসিয়ে দিতে৷ বেয়াদব একটা।
আতিয়া আর অহনা হেসে ফেলে।
সিয়াম আফসোসের সুরে বলে
” তোমার মতো করে বলতে পারি না বলে আজও আমি সিঙ্গেল।
লজ্জা পায় আদ্রিতা। এতো জোরে বলা উচিত হয় নি। এতোগুলো বড় বড় মানুষ। ছিহহ আদ্রিতা ছিহহহ। তুই তো দেখছি সত্যি সত্যিই চরিত্রহীন হয়ে যাচ্ছিস। চরিত্রের চ ও নেই তোর।
কাচুমাচু হয়ে বসে পড়ে।
আতিয়া প্লেটে খাবার পরিবেশন করতে করতে বলে
“আমার দুটো সন্তান। তাদের কাছে আমার কোনো মূল্য নেই৷ বছরের পর বছর চলে গিয়েছে তারা কখনোই আমার খোঁজ নেয় নি৷ হ্যাঁ প্রতিমাসে মোটা অঙ্কের কিছু টাকা পাঠিয়েছে। দীর্ঘ দিন জন্ডিসে ভুগেছি৷ বাড়ির প্রতিটা সদস্য বদনাম দিয়েছিলো আমি বুড়ো বয়সে প্রেগন্যান্ট হয়েছি।
আমার ছেলেমেয়ে পাশে থাকলে এমন বদনাম দেওয়ার সাহস কারোর হতো না।
আমার বেঁচে থাকার অবলম্বন আদ্রিতা। এই মেয়েটিকে বুকে জড়িয়েই বেঁচে আছি আমি। আমার সুখ দুঃখে এই একটা মানুষকেই পাশে পাই।
তাকে বিয়ে দিয়ে পরের ঘরে পাঠালে যে আমি একদম নিঃশ্ব হয়ে যাবো৷ একাকিত্বে ম রে যাবো।
বলতে বলতে আঁখিতে অশ্রু জমে আতিয়া বেগমের। আবেগে ভেসে যায় আদ্রিতাও। তারও কান্না পায়। উহু আতিয়া বেগমের দুঃখের কথা শুনে নয়। নিজের দুঃখের কথা মনে করে।
চিরন্তন সত্য কথা হচ্ছে আদ্রিতারও আতিয়া বেগম ছাড়া আর কেউ নেই। এই মানুষটি না থাকলে আদ্রিতাও একাকিত্বে ম রে যেতো।
অহনা হাতের উল্টো পিঠে চোখের পানি মুছে নেয়। সবাইকে সেন্টি খেতে দেখে আদ্রিতা বলে ওঠে
“ইহহহ মা তোমার যদি আরও একটা ছেলে থাকতো তাহলে তাকে আমি বিয়ে করতে পারতাম। তারপর সারাজীবন একসাথেই থাকতাম। দারুণ হতো না?
আবরার বড় বড় পা ফেলে নিজ কক্ষের পানে অগ্রসর হয়। এতোক্ষণে কেউ তাকে খেয়াল করে নি। আতিয়া বেগম পায়েসের বাটি হাতে নিয়ে এক দৌড়ে এসে দাঁড়ায় আবরারের সামনে এবং বলে
” শুভ জন্মদিন বাবা৷ তোর জ
বাকিটুকু শেষ করতে পারে না আতিয়া বেগম আবরার তাকে পাশ কাটিয়ে চলে যায়।
আতিয়া বেগম ধপ করে বসে পড়ে ফ্লোরে। আজ তার ছেলের জন্মদিন। তাই তো সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠে ছেলের পছন্দের সকল কিছু একা হাতে রান্না করেছে।
ভেবেছিলো আজকের দিনটাতে আবরার তার সাথে ভালো করে কথা বলবে। পায়েস খাবে।
কিন্তু তার কিছুই হলো না।
খুব বেশি ভুল করেছিলো কি সে? মস্ত বড় অপরাধী?
সিয়াম হতাশ হয়। অহনাও কেঁদে ফেলে।
আদ্রিতা চোয়াল শক্ত করে ফেলে। এক রাশ রাগ জন্মায় আবরারের ওপর। ইচ্ছে করছে বড় বড় চুল গুলো টেনে ছিঁড়ে দিতে।
সেই সকালে কারোরই আর খাওয়া হয় না। আতিয়া বেগম নিজ কক্ষে দরজা আটকে কাঁদছে। অহনা তৈরি হতে গিয়েছে। আজকে তাকে হাসপাতালে যেতে হবে চেকাপ করাতে। অহনার স্বামী হিমেল এবং শাশুড়ী এসে বসে আছে। তারাই নিয়ে যাবে ডাক্তারের কাছে। বাবু এখন হিমেলের কোলে।
আদ্রিতা এ্যানিকে কোলে নিয়ে একটু বাইরে বের হয়। আজকেই প্রথমবার বাইরে বের হলো আদ্রিতা। কাউকে বলে আসে নি৷ সাথে এনেছে আতিয়া বেগম এর ফোন খানা। আসিফ আদনান রিপ্লাই করেছিলো মেসেজের। এবং বলেছে আজকে কল দিবে।
এখানকার মেয়ে গুলো বেশ সুন্দর। জিন্স টপস,শর্টস যে ড্রেসই পড়ুক তাদের বেশ সুন্দর লাগে। আদ্রিতা রাস্তার এক কোণা দিয়ে হাঁটছে এবং রাস্তা দিয়ে যত মানুষ যাচ্ছে সবাইকে পর্যবেক্ষণ করছে। সরু রাস্তার দুই পাশেই রয়েছে ছোট ছোট বাড়ি। বাংলাদেশের ঢাকার শহরের মতো উঁচু উঁচু বিল্ডিং দেখা যাচ্ছে। অতিরিক্ত যানবাহনও নেই। রিকশা, অটো, টোটো, টেম্পু, ঠেলা গাড়ি কিছুই নেই। শুধু একটু পরপরই লাল, কালো, সাদা রংয়ের চার চাকার গাড়ি দেখা যাচ্ছে। খুব বেশি জোরে ড্রাইভ করছে না বরং রয়েসয়ে ধীরে সুস্থে।
হাঁটতে হাঁটতে কতো দূর চলে এসেছে জানা নেই আদ্রিতার। তবে পা ব্যাথা করছে। কোল থেকে এ্যানিকে নামিয়ে রাস্তার পাশে বসে পড়ে। তখনই ফোন বেজে ওঠে। স্কিনে আসিফ আদনান নামটা ভেসে উঠেছে।
আদ্রিতার ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটে ওঠে। তারাহুরো করে রিসিভ করে
“হ্যাঁ আমি আদ্রিতা।
ওপাশ থেকে হাসির শব্দ ভেসে আসে।
” হ্যাঁ চিনতে পেরেই কল করেছি। কেমন আছো?
“ভালো আছি। আপনি?
” আমিও ভালো আছি। সুইজারল্যান্ড এর কোথায় আছো?
“জুরিখ শহর মেবি।
“সেখানে আমার নানুবাড়ি। বছরে একবার যাওয়া হয় আমার। কতোদিন থাকবে তুমি?
“দুই তিন মাস মনে হয়। সঠিক জানি না তো।
” ঠিক আছে আমি আসছি এই মাসের মধ্যেই।
জরিখ নদী দেখেছো?
“আমাকে এখানে ঘুরতে নিয়ে যাওয়ার মতো কেউ নেই। কিছুই দেখতে পারি নি।
” আচ্ছা আমি এসে ঘুরতে নিয়ে যাবো।
আদ্রিতার খুশি আর দেখে কে। মনটা নেচে ওঠে পেকুম তুলে। কিছু বলার জন্য হা করে তখনই ভেসে আসে এক গম্ভীর কন্ঠস্বর। এই নিয়ে তিনবার এই কন্ঠ শুনলো আদ্রিতা।
“এখানে কি করছো?
চমকে পেছনে তাকায় আদ্রিতা। কালো রংয়ের একখানা গাড়ি থেমে আছে ঠিক তার পেছনে। গাড়ির কাঁচ নামানো। সেই কাঁচের মধ্যে দেখা যাচ্ছে আবরার তাসনিন এর গম্ভীর মুখশ্রী।
হাত ফসকে ফোন খানা পড়ে যায় আদ্রিতার। এ্যানি পরিচিত মুখ দেখে এক দৌড়ে গাড়ির নিকট চলে যায়। মিউ মিউ আওয়াজ তুলে ডোর খোলার ইঙ্গিত দেয়। কিন্তু পাষাণ আবরার খোলে না ডোর।
আদ্রিতা মাথা নিচু করে ফেলে। কোলের মধ্যে পড়ে থাকা ফোন খানা তুলে কানে নেয়। ছোট স্বরে বলে
” আমার ভাই এসেছে। রাখছি। পরে কল করবো।
পরপরই কান থেকে ফোন নামিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ে। আবরারের কপালে ভাজ পড়ে। “ভাই এসেছে” ভাই?আবরার তার ভাই হয়?
আদ্রিতা দাঁড়িয়ে পড়ে। দু পা এগিয়ে এসে এ্যানিকে কোলে তুলে নেয়৷ এবং মাথা নিচু করে বলে
“ঘুরতে এসেছিলাম। যাচ্ছি বাসায়।
বলেই হাঁটতে শুরু করে। আবরার গাড়ি থেকে নামে। বড় বড় কদমে আদ্রিতার সামনে এসে দাঁড়ায়। প্রথমেই হাত থেকে ফোনটা টেনে নিয়ে ছুঁড়ে মারে দূর অজানায়। ফোন খানা কোথায় গিয়ে পড়ে তার হদিস নেই।
আদ্রিতা বড় বড় নয়নে তাকায় আবরারের পানে।
” এটা কি করলেন আপনি? মায়ের ফোন এটা। ফেললেন কেনো?
কৈফিয়ত দেওয়ার মতো মানুষ আবরার নয়। তাই কোনো কৈফিয়ত না দিয়ে আদ্রিতার বা হাত খানা মুঠোয় পুরে নেয় এবং টানতে টানতে নিয়ে আসে গাড়ির নিকটে।
আদ্রিতা সমান তালে বকবক করতে থাকে
“কি করছেন আপনি?
আমাকে জোর করতে হবে না। ভালোভাবে বললেই আমি গাড়ি বসবো। হাত ছাড়ুন। টানটানির দরকার নেই তো।
তবে সেই সব কথা শোনে না আবরার।
গাড়ির দরজার কাছে এনে আদ্রিতার হাত ছেড়ে দেয়। পরপরই নিজে বসে পড়ে ড্রাইভিং সিটে। এবং আদ্রিতাকে টেনে নিয়ে নিজের কোলে বসিয়ে দেয়।
আশ্চর্য আদ্রিতার কয়েক সেকেন্ড সময় লেগে যায় কোথায় বসে আছে বুঝতে। পরপরই অনুভব করে তার পিঠের ওপর দিয়ে একটা দড়ি চলে গেলো। মানে গাড়ির সিট বেল্ট বেঁধে নেয় আবরার আদ্রিতাসহ।
” এ…এটা কি করছেন? এভাবে কি করে যাবো? আমাকে পাশে বসিয়ে দিন
নিচু স্বরে বলে আদ্রিতা। এ্যানি পড়ে আছে পাশের ছিটে। সে গাড়িতে উঠতে পেরেই খুশি। আদ্রিতার সাথে কি হচ্ছে সেদিকে খেয়াল নেই।
আবরার যেনো শুনছেই না আদ্রিতার কথা।
তবে আদ্রিতা চুপ থাকতে পারছে না। এভাবে বসা যায়? ছিহহহ ছিহহহ। অস্বস্তিতে জেঁকে ধরেছে। লজ্জায় গাল দুটো টকটকে লাল রং ধারণ করেছে। চোখের সামনে আবরারের প্রসস্থ বুক ছাড়া আর কিছুই দেখা যাচ্ছে না। নাকে ভেসে আসছে জেন্টস পারফিউম এর কড়া ঘ্রাণ৷ গলা শুকিয়ে কাঠ কাঠ হয়ে গিয়েছে। ইতোমধ্যেই হাত পায়ে মৃদু কম্পন অনুভব করছে।
তোমাতেই আসক্ত পর্ব ৯
আদ্রিতা পূণরায় বলে
“ভাইয়া আমাকে
বাকি টুকু শেষ করার আগেই আবরার চাপা স্বরে চলে ওঠে
” আ’ম ইউওর হাজব্যান্ড