যাতনা আমার পর্ব ৩৬(২)
সানজিদা ইসলাম সূচনা
পুরো চেরি ব্লসমের সাম্রাজ্য যেন এই বিয়ের ভেন্যু। সাদা, হালকা কৃত্রিম ফুল গুলো নিজেদের সৌন্দর্য ফুটিয়ে তুলেছে। আমেজ পূর্ণ পরিবেশ চারদিকে। শহরের নাম করা ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট এটা। মেহমানদের বসার আসন থেকে বিয়ের পুরো স্টেজ চেরি ব্লসমের পরিপূর্ণ। সকাল থেকেই ফাহাদ আর জায়ানের উপর প্রচুর চাপ যাচ্ছে। মিজানুল করিম এযাত্রা নিজের মনের মতো মেহমান আপ্যায়নে ব্যস্ত রইলেন। ফাহাদ আজ ভোরে বাড়িতে ফিরেছে। তিথির রাগ ভাঙতে সঙ্গে নিয়ে এসেছিল অনেক রকম গিফট। বোনের রাগ ভাঙিয়ে উঠতেই আবার ধমকে উঠেছিলো ফাহাদ। কারণ সমূহ নিধিকে কেন মির্জা বাড়ি যেতে দিয়েছে তিথি? সেদিন অনুষ্ঠান শেষে ইশান এসে নিধিকে নিয়ে গেছিলো।
যা, ফাহাদ কে জানায় নি কেউই। এই নিয়ে কিছুক্ষণ রাগারাগি করে শান্ত হয়েছিলো ফাহাদ। এরমধ্যেই অনেক বার ফাহাদ নিধিকে কল করলেও ফোন রিসিভ করে না নিধি। রাগের মাত্রা ছাড়িয়ে তার। তবু্ও চুপচাপ করে আছে ফাহাদ। জায়ান আজকেও কালো শেরওয়ানি কোট পরে দিব্যি কাজকর্ম করে বেড়াচ্ছে। ইনায়ার কথার দ্বারপ্রান্তে নেই সে। খাবারের মেন্যু গুলো আরো একবার পরোক্ষ করে জায়ান ছুটলো তিথিদের মেকআপ রুমে। বরযাত্রা এলো বলে, কিন্তু এদের আসার কোনো নাম গন্ধ নেই। জায়ান তাড়াহুড়ো করে দুতালার কর্নার রুমে নক করে। কিছুক্ষণ পরে দরজা খুলে বেরিয়ে আসে ইনায়া। জায়ানের চোখ যেন স্নিগ্ধ হলো। হিমালয়ের শীতল ধমকা হাওয়া বয়ে গেলো তার শরীর জুড়ে। জায়ান কাপছে কি? হয়তো। অত্যাধিক গরমে এ শীতল হাওয়া জরুরি ছিলো তার। স্নিগ্ধ, ততোটাই প্রশান্তিময় বর্তমান সময় টা ঠেকলো তার কাছে। অযাচিত ভাবে ঠোঁট নাড়িয়ে বলে উঠলো,
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
-” আমার স্নিগ্ধ হরিণী। ”
থমকে গেলো হৃদয় যেন। চারপাশ পরিনত হয়ে গেছে অবাধ্য মিউটে। মনে বেজে যায় অবাক করা মুগ্ধতায়। তার পাগল দৃষ্টি, হৃদয় এফোঁড়ওফোঁড় করার ক্ষমতা রাখে নিমিষেই।
-” আর আপনারা একটা পাগল। ”
জায়ানের হৃদয় নিংড়ানো মুগ্ধতা কাটে, ইনায়ার রুক্ষ মরুভূমি ন্যায় তপ্ত মুখ আর কন্ঠ শুনে। ল্যাভেন্ডার কালারের সুন্দর লেহেঙ্গা পরনে ইনায়ার। যতোটা স্নিগ্ধ ততোটাই মায়াবী লাগছে তাকে। এইরূপে যেকোনো পুরুষ কপোকাত হবে নিশ্চিত। কিন্তু এযাবৎ জায়ান আর দমলো না। কন্ঠে যথাযথ গম্ভীরতা টেনে জিজ্ঞেস করে,
-” কি বললে? ”
-” পাগল বলেছি। আপনি, আপনার বোন সব পাগল। বুঝলেন? ”
ইনায়ার বিরক্ত কন্ঠস্বরে তেজ নিয়ে বলে উঠলো কথাখানি। জায়ান তার যথাযথ কারণ খুঁজে পেলো না। আবারো গম্ভীর মুখে জিজ্ঞেসা দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো ইনায়ার তপ্ত মুখের দিকে। ইনায়া গলা নামিয়ে বলে ওঠে,
-” ভাই বিয়ের সব ফাংশনে কালো পড়ে ঘুরেছে। আর বোন? নিজের বিয়ের দিন কালো ভূতনী সেজে বসে আছে। এটা নাকি তার স্বপ্ন ছিলো। সে আর তার স্বামী বিয়ের দিন ভূত আর ভূতনী সাজবে। আশ্চর্য,। ”
জায়ান এবার বুঝলো ইনায়ার রাগের কারণ। কিছুটা স্মিথ হেসে তাকালো তার হরিণীর দিকে। মৃদু স্বরে জিজ্ঞেস করে উঠলো,
-” তোমার কালো এতোটা অপছন্দ কেনো হরিণী? আমি তো কালোতেই তৈরি। ”
ইনায়া বিদ্রুপ করে হেঁসে উঠলো। কাজল কালো জোড়া চোখ দুটিও হাসলো কষ্ট নিয়ে। তারপর বিড়বিড়িয়ে বলে ওঠে,
-” যার জীবনের আস্তরণ দুঃখের কালো রঙে রাঙানো, তার কালো রঙ কি করে সহ্য হবে বলুন? ”
-” হবে, সে সময় অতি সন্নিকটে। তুমি দেখে নিও। আমার নিঃশ্বাস যতোদিন থাকবে। ততোদিন তোমার, সব অশুভ কালোকে শুভ ভালো মনে হবে। ”
ইনায়া আর প্রতিত্তোর করলোনা। টলমলে চোখ জোড়া অশান্তের ন্যায় দিকবিদিকশুন্য হয়ে যেন ঘুরলো। যার স্থান সে নিজেই খুজতে অক্ষম। অনেকক্ষণ পরে জায়ান সেই অশান্ত চোখের মালিক কে এড়িয়ে যেতে-যেতে বলে উঠলো,
-” শীগ্রই চলে এসো। সময় খুব সন্নিকট। ”
– ” যদি এসময় আর না আসে? ”
-” তবে ভেবো আমি আর নেই। ”
ইনায়া চমকালো। সমুদ্রে উত্তাল জলোচ্ছ্বাসের ন্যায় তার ভেতর টা হুংকার দিয়ে উঠলো। কিন্তু, মুখের অভিব্যক্তি নরমাল। ভেতরের উচ্ছ্বসিত দহন টা বুঝতে দিলো না সামনের নেতা কে। নিজেকে দমিয়ে শুনলো আবারো তার কিছু কথা।
-” আমি বেঁচে থাকতে তোমার আমার ভিতরে দুঃখের ‘ দ ‘ ঢুকতে দেবো না। কারণ আমি তোমাতে পাগল হরিণী, ভিষণ ভাবে পাগল। ”
একভাবে ফুলে সজ্জিত, সারিবদ্ধভাবে এগিয়ে চলছে বরযাত্রীর গাড়ি গুলো। যেন পিপীলিকার দল সারিবদ্ধভাবে যাচ্ছে। আর মাত্র কয়েক মিনিট বিয়ের ভেন্যুতে পৌঁছাতে। প্রথম গাড়িতে বর বেশে ইশান। তার স্বপ্ন পুরোনে আর মাত্র কিছুক্ষণ। খুব হাসি মুখে বা পাশে দাদির দিকে তাকাতেই মুখ ভোঁতা হয়ে গেলো ইশানের। আয়েশা মির্জা চোখ পাকিয়ে তাকিয়ে রয়েছেন তার দিকে। ইশান দীর্ঘশ্বাস ফেলে। তিথির পাগলামি মানতে গিয়ে আরো কতো সমস্যা যে হবে তার গিন্নীর সাথে, তার কোনো হদিস নেই। সবেতো মাত্র শুরু। কালো পাঞ্জাবি পরায় বাধ সেধেছিলেন আয়েশা মির্জা। এমন শুভদিনে নাকি কালো?
তিনি তো তিথিকে এই নিয়ে কথা শুনাবেন নিশ্চিত। নিধি ইশানের ডান পাশে বসা। সামনে নাভান। তারা আয়েশা মির্জার এমন ফেস বেশ এনজয় করছে। দুষ্টুমি হাসি ঠাট্টা সব মিলিয়ে শেষে সবাই বিয়ের ভেন্যুতে পৌছালো। ‘বর এসেছে বর এসেছে ‘ কথায় মুখরিত হলো চারপাশ। জায়ানের কাজিন মহল গেইট ধরার জন্য দাড়িয়ে আছে। নিধি আয়েশা মির্জা কে নিয়ে ভেতরে প্রবেশ করে। নাহিদ মির্জা আর নওয়াজ মির্জা মিজানুল করিমের সাথে কথায় ব্যস্ত। স্টেজে তিথি বসা পাশেই ইনায়া আর মিনারা বেগম। কালো লেহেঙ্গা আর গা ভর্তি ভারী স্বর্নের জুয়েলারি, ব্রাইডাল মেকআপে খুব সুন্দর লাগছে তিথিকে। আয়েশা মির্জা নিধির সাথে স্টেজে বসে আছে। তখন কোথা থেকে ফাহাদ আসে তাদের সামনে। আয়েশা মির্জার সাথে কুশল বিনিময় করে পাশে বসা নিধির দিকে চোখ গরম করে তাকালো। কিন্তু নিধি তাকে পাত্তা দিলো না।
-” তা নাত জামাই এমন শুকাইছো কেন? কাজের বুঝি খুব চাপ? ”
আয়েশা মির্জা পান চাবানো বাদ দিয়ে প্রশ্ন ছুড়ে ফাহাদের দিকে। ফাহাদ কিছু বলবে, তার আগেই নিধি মুখ ভেঙচিয়ে বললো,
-” তাদের আবার কি কাজ? খুনখারাবি ছাড়া। ”
আয়েশা মির্জা আর ফাহাদ দুজনেই মুখ রাঙালেন। এই মেয়ের সোজা কথা কবে আসবে জানে না ফাহাদ। তার বেলায় শুধু এমন মুখ ঝামটি। ফাহাদ ফিচেক হেঁসে নিধিকে বলে উঠলো,
-” পার্ফেক্ট, একদম ঠিক আছো। ”
-” কি ঠিক আছি? ”
ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করে নিধি। ফাহাদ দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে,
-” আমার বাবার পুত্রবধূ হিসেবে একদম ঠিক আছো তুমি। বুঁজলে? ”
নিধি মুখ ভেঙালো। ফাহাদ আয়েশা মির্জার পাশে বসে মিনমিন করে বলে,
-” তা আমি যে বউয়ের অভাবে শুকনো ডাল হচ্ছি, তা কি আপনার চোখে পরে না দিদিশাশুড়ি মা? ”
আয়েশা মির্জা একগাল হেঁসে মাথার কাপড়টা একটু টেনে নিলেন। হাতে ব্যাগ নিয়ে উঠতে উঠতে বলে উঠলেন,
-” বউ নিয়ে যাবার দায়িত্ব তোমার। আমি সাথে সঙ্গ দিবো আর কি। ”
ফাহাদও হেঁসে সম্মতি দিলো। ইশানকে এনে তিথির পাশে বসানো হয়েছে। আয়েশা মির্জা সেদিকে গেলেন। ফাহাদ বসা থেকে উঠে নিধির একহাত চেপে ধরে। নিধি আঁতকে উঠে আসে পাশে গেস্টদের দিকে তাকালো। কারো কারো নজর তাদের দুজনের দিকে। নিধি চেয়েও ফাহাদ কে কিছু বলতে পারলো না। ফাহাদ নিধির হাত টেনে নিয়ে যায় তার সাথে। নিধিও তাল মিলিয়ে গমগমে গলায় বলে ওঠে,
-” করছেন কি? লোকজন দেখছে তো না কি? ”
-” দেখবেই তো? মেয়র ফাহাদ আর আর তার বউ এখানের সবচেয়ে সুন্দর সুশীল কাপল। ”
নিধি আর কিছু বলে না। ফাহাদ নিধিকে নিয়ে একটা রুমে ঢুকলো। বেডে বসিয়ে সে নিজে ফ্লোরে বসে নিধির কমোড় জড়িয়ে কোলে মাথা রেখে বসে রইলো। নিধি অবাক হলো ফাহাদের এহেন কর্মকান্ডে। শরীরে কাঁপন সৃষ্টি হলো প্রচুর। পা জোড়া নড়বড়ে হয়ে উঠলো কিছুটা। ফাহাদের তপ্ত নিঃশ্বাস জোড়া নিধির উন্মুক্ত উদরে গিয়ে ঠেকলো। নিধি কিছু বলতে পারেনা। কন্ঠরুদ্ধ করে দেওয়া হয়েছে যেন তাকে। নিধি কাপা হাতে ফাহাদের কাঁধ ঝাকিয়ে দিলো খানিকটা। সময় নিয়ে মাথা তুলে তাকালো নিধির পানে। নিধি থমকালো, ফাহাদের চোখ জোড়ায় তাকানোর সাহস পেলো না আর। সে যেন অতল গহ্বর। তাকালে নিজের প্রতিবিম্বিত হওয়া রুপ আর দেখা যাবেনা। নিধির মুখে তাকিয়ে নিরল গলায় জিজ্ঞেস করে,
-” কি আছে তোমার মাঝে? আমি কেন বারবার তোমার মাঝে হাড়িয়ে যাই। সেই দুবছর আগের মতোই। প্রথমবার নিজেকে বুঝিয়েছি। তুমি আমি দুই মেরুর। তোমাকে ভুলার জন্য কতো রিলেশনে গিয়েছি। কিন্তু আমার অবুঝ মন এই তোমার কাছেই থাকতো। আমার সাথে কেন এমন করো? বলতে পারবে? আমাকে কি একটুও ভালোবাসা যায় না? মেনে নেওয়া যায় না। সম্পর্কটা কে কি একটুও সুযোগ দেওয়া যায় না? আমি কি এতোটাই অযোগ্য? কি দোষ আমার? বলোনা, আমি তোমার জন্য নিজেকে বদলে দেবো কথা দিচ্ছি। সম্পর্কটা কে একটা সুযোগ দাও নিধি। ”
ফাহাদের এমন আকুতি হৃদয়ে বিধলো যেন নিধির। রাজনীতিতে জড়িত থাকায় ফাহাদকে তার পছন্দ হতোনা কোনো কালেই। তার মনে হতো, রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে কেউই সাধু নয়। সামনে ভালো দেখালেও এদের হৃদয় কলুষিত থাকে। ক’জন নিজেকে ঠিক রাখতে পারে? আসলেই কেউ পারেনা। ক্ষমতা ক্ষমতাসীন দলের নেতারা কেউই ভালো নয়। নিধি ফাহাদের দিকে তাকিয়ে হাসলো,
-” হয়তো আমি আপনাকে বোঝার চেষ্টা করিনি। আপনার এ-ই পেশার কারণে। রাজনৈতিক কলাকৌশল শেখানো ভয়ংকর নেতাদের আমি বরাবরই ঘৃণা করে এসেছি। এরা কখনোই ভালো হতে পারেনা। হয়তো সেটা আপনার মাঝেই পেয়েছি আমি। আমার সাথে যা অন্যায় হয়েছে। তাদের ছায়া দিয়ে আসছে আপনাদের মতো কিছু ক্ষমতাসীন লোকেরা। আপনাদের জন্যই এদের জন্ম। যেখানে টাকা ছুড়ে সেখানেই কুত্তার মতো ঝাপিয়ে পড়ে। যেখানে তাদের প্রতি এতো ঘৃণা। সেটাই আমার সাথে ঘটেছে। আমি সেদিকে মন কি করে দেই বলেন? ”
ফাহাদ ফিচেল হাসলো। শুভ্ররাঙা পাঞ্জাবিতে পুরো শরীর দুলে উঠল। এগিয়ে এসে নিধির চিবুকে নিজের ওষ্ঠ ছোঁয়ায় ফাহাদ। নিধি খিঁচে চোখ বন্ধ করে ফেলে। ফাহাদ সরে এসে মুখ বাকিয়ে বললো,
যাতনা আমার পর্ব ৩৬
-” ব্যাস্, এতোটুকুই? চলো বিয়ের ফাংশন কম্প্লিট করতে হবে। ”
নিধি অবাক চোখে তাকালো। এই লোকের হলো কি? ক্ষণে ক্ষণে মুড চেঞ্জ হয়ে যায়। ফাহাদ আগের মতোই তড়িঘড়ি করে নিধিকে নিয়ে বেরিয়ে যায়।