পাতা বাহার পর্ব ৩৪(২)

পাতা বাহার পর্ব ৩৪(২)
বেলা শেখ 

মেঘলা আকাশ মেঘলা দিন! পরিবেশ কেমন যেন থমথমে! ঝড়ো এলোমেলো বাতাসে গাছপালা মড়মড় করে দুলছে।পাখির দল ঝাঁকে ঝাঁকে উড়ে বেড়াচ্ছে। এই কারেন্টের পোল, তারে একে একে বসছে মিনিটের জন্য আবার ডানা ঝাপটে দৌড়ে কোনো দোকানে বসছে।‌ আবার এলোমেলো উড়ে স্কুলের কৃষ্ণচূড়ার ডালে ডালে বসে কিচিরমিচির শব্দে হৈচৈ মাতিয়ে রেখেছে। স্কুলের পরিবেশটাও আজকে হইহুল্লোড়ে ভরপুর। স্কুলে স্টুডেন্টের উপস্থিতি ঢের সাথে গার্ডিয়ান! হবে না কেন আজ ফাস্ট টার্মিনালের রেজাল্ট দিবে! অডিটরিয়াম পুরো হাউসফুল! বাচ্চাসহ গার্ডিয়ানে ভরপুর! ইয়াং ক্লাস টিচার্সরা সবাই স্টেজে দাঁড়িয়ে!

প্রিন্সিপাল ম্যাম সহ আরো সিনিয়ার টিচাররা অডিটরিয়ামের সামনের সারিতে ভি আই পি সিটে বসে আছে। মাত্রই শুরু হবে ফলাফল ঘোষণার কার্যক্রম! আজকের অনুষ্ঠান পরিচালনার দায়িত্বে আছে সৈয়দ! মিষ্টি ভাষী মজার স্যার মজার মজার কথা বলে পুরো অডিটোরিয়াম মেতে রেখেছে! সকলেই হাসিমুখে, কেউ বোর ফিল করছে না বোধহয়! প্রতিটি সেকশনের জন্য সিট মার্ক করে রাখা হয়েছে। প্লে ও নার্সারির বাচ্চারা সামনের সারিতে! তারপর ওয়ান, ট্যু! এরপর ক্রমান্বয়ে থ্রি, ফোর, ফাইভ, সিক্স, সেভেন, এইটের ছেলে মেয়ে! প্লে, নার্সারি, ওয়ানের সকল বাচ্চার সাথেই গার্ডিয়ান উপস্থিত! ট্যু থেকে এইটের ছেলে মেয়েদের সাথে হাতেগোনা কয়েকজন গার্ডিয়ান এসেছে। বিশাল বড় অডিটোরিয়ামে ছাত্র-ছাত্রী ও গার্ডিয়ানের সমাগমে গমগম শব্দ হচ্ছে।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

ভোর সামনে সারিতে বসে আছে গালে হাত দিয়ে। মুখশ্রী মোটেও স্বাভাবিক নয়! গম্ভীর ও ছলছলে! তার যথা উপযুক্ত কারণ আছে বটে। তার ক্লাসের সকলের বাবা অথবা মা এসেছে। অনেকের বাবা মা দুজনেই এসেছে। তার পাশে রোহানের আম্মু, রোহান। ভোরের সাথে কেউ আসে নি! গতরাতে সে ঘুমানোর পর আব্বু এসেছিল বোধহয়! সকালে উঠে সে অনেকবার বলেছিল আব্বু যেন আজ তার সাথে স্কুলে থাকে! আব্বু রাজি হয় না। তার নাকি গুরুত্বপূর্ণ কাজ আছে আসতে পারবে না। আর আম্মু তো যাচ্ছেই। ভোর মেনে নিয়েছিল! আম্মু তো আছেই! কিন্তু এখানে তো আম্মু নেই। আম্মু সব টিচার্সদের সাথে টিচার হিসেবে আছে।

ভোরের আম্মু হয়ে না। তার সব সহপাঠীরা বাবা মায়ের সাথে কতো মজা করছে! আর সে একা একা বসে আছে। কেউ তার সাথে কথা বলছে না। এমনকি রোহানও না! সে তো তার মা’কে পেয়ে বন্ধুকে ভুলেই গেছে! আইসক্রিমটাও একা একা খেলো! তাকে সাধলোও না। সাধলে সে কি খেতো নাকি!! ভোর গম্ভীর মুখে সামনে পাতার দিকে অভিমানী চোখে চেয়ে থাকে! কিছুক্ষণের মধ্যেই ফলাফল ঘোষণা শুরু হয় পর্যায়ক্রমে। প্রথমে নার্সারির বাচ্চাদের ক্লাসটিচার তাদের রেজাল্ট দিলো! মেধাতালিকার দশজনের নাম ডেকে এরপর শুধু পরীক্ষায় উত্তীর্ণ দের নাম ঘোষণা করলো! নার্সারির পর প্লের বাচ্চাদের!

রোহানের আম্মু উৎসুক হয়ে তাকিয়ে। তার বিশ্বাস রোহান ফার্স্ট হবে। কিন্তু তার আশায় পানি ঢেলে রোহান সেকেন্ড আসে।ফাস্ট গার্লের সাথে তার দুই মার্কের তফাৎ! রোহান ভয় ভয় চোখে মায়ের দিকে চায়। রোহানের আম্মু চোখ রাঙায় ছেলেকে। চাপা স্বরে গোটাকয়েক ধমক লাগায়! বকতে শুরু করে নিচু স্বরে। রোহান ধমক শুনে কাঁচুমাচু মুখে ভোরের দিকে চায়। ভোরও অসহায় মুখে তার দিকেই চেয়ে। বেচারা সেকেন্ড হয়েছে তাই বকা শুনছে সে তো মনে হয় পাশটাও করতে পারবে না। আব্বু বলেছে পাশ না করলে বিয়ে করিয়ে দিবে!! আর সে বিয়ে করতে চায় না। সে বাবার মতো বড় হতে চায়!
রোহানের আম্মু রোহানকে ধমকের সুরে ধীরে বলল,

-” মানুষের দিনে দিনে উন্নতি হয়। অথচ তোমার অবনতি হচ্ছে! আর হবে নাই বা কেন? সঙ্গ দোষে লোহা ভাসে! মানুষ সবসময় নিজের চেয়ে ভালো গুড স্টুডেন্টদের সাথে বন্ধুত্ব করে আর তুমি? তোমার বন্ধু? সেতো দশের ভিতরেও নেই! আদৌ পাশ করবে কি না! ওর না পড়লেও চলবে ওর বাবা ব্যবসায়ী! বড় হয়ে বাবার ব্যবসা সামলাবে কিন্তু তুই কি করবি? এরপর থেকে ওর সাথে মেশা তো দূরে থাক কথা বললেও তোর খবর আছে! তাহসান, মোহন ওদের সাথে থাকবি!”

ধীরে আওয়াজে বলেছে। তবে ভোরের কানেও যেন যায় সেভাবেই বলেছে। ভোরও ভালোভাবেই শুনতে পেয়েছে। তার গম্ভীর মুখশ্রী যেন আরো গম্ভীর হয়ে গেলো। যেন এ অরুণ সরকারের অবিকল কার্বন কপি! ভোর আস্তে করে সিট থেকে উঠে অডিটোরিয়ামের কোনায় বুকে হাত গুঁজে দাঁড়িয়ে থাকে চুপচাপ। তার জন্য রোহান যেন আর বকা না শোনে। সে মিশবে না আর রোহানের সাথে কথাও বলবে না।

পাতা স্টেজে চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে। সে একা না তার সব কলিগরাই উপস্থিত আছে। পাতা ক্লাস থ্রির স্টুডেন্টসদের ফলাফল ঘোষণা করবে। তার জন্যই এখানে দাঁড়িয়ে থাকা। নইলে সে ভোরের কাছে থাকতো! ছেলেটা গোমড়া মুখে বসে আছে। পাতা ভোরের রেজাল্ট আগেই দেখেছে। র ্যাংকিয়ে বাইশ! পাতা ভেবেছিলো দশের মধ্যে থাকবে। এখন নেই এতে তো আর কিছু করার নেই! সৈয়দ তার নাম ডাকলে পাতা রেজাল্ট শীট নিয়ে সামনে গেলো। সালাম জানিয়ে ধীরে ধীরে রেজাল্ট বলতে শুরু করলো!

ভোর গাল ফুলিয়ে পাতার দিকে তাকিয়ে। এখনো দাঁড়িয়ে। প্রিন্সিপাল সাবরিনা সাবিনা লক্ষ্য করছিল বেশ কিছু সময় ধরে। ওখানে ওভাবে গাল ফুলিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ডাকে ওকে। ভোর প্রথমে বুঝতে না পারলেও পড়ে বুঝতে পারে তাকেই ডাকছে। গুটি গুটি পায়ে এগিয়ে যায়। সাবরিনা ভোরকে পাশে বসিয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে বলল,
-” ওখানে ওভাবে দাঁড়িয়ে ছিলিস কেন? একদম বাপের মতো মুখ বানিয়ে!”
-” এমনি ম্যাম!”
-” রেজাল্ট ভালো হয় নি বলে মন খারাপ? অরুণ বকবে?”
-” না ম্যাম!”
সাবরিনা চৌধুরী ভ্যানিটি ব্যাগ থেকে একটা চকলেট বক্স বের করে ভোরের হাতে দিলো। ভোর লজ্জা পেল খানিক; না করবে তখন সাবরিনা বলল,

-” না করলে বকে দেবো! আর নানু হই তোর! নানু ডাকতে পারিস না?”
ভোর কাঁচুমাচু করে। সাবরিনা হেসে বলল,
-” অরুণ মানা করেছে?”
ভোর মানা করে, বলে নি। সাবরিনা চৌধুরী ভোরের কপালে চুমু খায়! এবার ভোর লজ্জায় শেষ! মিনমিন গলায় বলল,
-” আসি ম্যাম!”

বলেই আর অপেক্ষা করে না। একপ্রকার ছুটেই চলে যায়। অডিটরিয়াম থেকে বেরিয়ে বাইরে চলে যায়। কলেজের একপাশে বটগাছের নিচে শান বাঁধানো জায়গায় বসলো। নিত্যদিনের মতো আজ স্কুল ড্রেসে নেই। হাফ প্যান্টের সাথে হাফ হাতার ব্লু কালারের শার্ট মাথায় ক্যাপ পরা। একাই বসে থাকে। স্কুলের আঙিনায় এখন খুব একটা মানুষ জন নেই। কিছু ঝালমুড়ি ওয়ালা, হাওয়াই মিঠাই, কুলফি আইসক্রিম ওয়ালা আরো কিছু লোকজন। কুলফি আইসক্রিম দেখে ভোরের লোভ হয়। পকেট ফাঁকা থাকায় খাওয়া হয় না। চকলেট বক্স খুলে একটা ক্যাডবেরি ছিঁড়ে মুখে নেয়। চিবোতে চিবোতে সামনে দেখে একটা পাগল দাঁড়িয়ে, ছেঁড়া ময়লা কাপড় গায়ে। ভোর চেনে, তাদের স্কুলেই থাকে। একটু ভয় পেলো সে! উঠে দৌড় লাগাবে। তখনি লক্ষ্য করে পাগলটা তার চকলেটের দিকে চেয়ে! ভোর আর দৌড়ায় না। পাগলটিকে জিজ্ঞেস করলো,

-” খাবে?”
পাগলটি ময়লা দাঁতে হি হি করে হেসে মাথা নাড়ল খাবে! ভোর তার হাসিতে ভয় পায় খানিক। কিছু ক্যাডবেরি পকেটে রেখে পাগলটির দিকে বাড়িয়ে দিলে পাগলটি খপ করে ধরে নেয়। ভোর ভয় পেয়ে দৌড় লাগায় মাঠ বরাবর! দৌড়ে অডিটরিয়ামের সামনে গিয়ে হাঁপাতে থাকে। কিছুসময় দাঁড়িয়ে থাকলে দেখতে পায় পাতা বেড়িয়ে আসছে। ভোর পিটপিট করে তার দিকে চায়!
পাতা এগিয়ে আসে ভোরকে দেখে। পুরো অডিটরিয়াম খুঁজে সে হয়রান! ভয় পেয়ে গিয়েছিল ছেলেটা কোথায় চলে গেলো! রোহানও বলতে পারে নি! এক স্টুডেন্ট বলল বাইরে যেতে দেখেছে তাই তড়িঘড়ি করে বেরিয়ে আসে। ভয় পেয়ে গিয়েছিল! পাতা এগিয়ে আসতেই ভোর ছোট বাচ্চার মতো দুই হাত বাড়িয়ে দেয় কোলে নেয়ার জন্য! পাতা কোলে তুলে নিলে ভোর তার গালে চুমু দিয়ে বলল,

-” আম্মু বাড়ি যাবো! আব্বুর সাথে কথা বলবো! আব্বুকে ফোন করো না!”
পাতা উদ্বিগ্ন স্বরে জিজ্ঞেস করল,
-” কি হয়েছে ভোর? যাবো তো বাড়ি! তোমার আব্বুর সাথেও কথা বলিয়ে দিবো! আগে বলো কোথায় ছিলে তুমি? কত খুঁজছিলাম আমি তোমায়! ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম!”
ভোরের মুখে হাসি ফুটে উঠলো।
-” ওখানে বসে বোর হচ্ছিলাম তাই ওই গাছতলায় বসেছিলাম! ওখানে পাগল দেখে দৌড়ে এসেছি!”
পাতা ভোরকে নিয়ে অডিটরিয়ামের ভিতরে যায়!
-” তোমার কি রেজাল্ট দেখে মন খারাপ?”
ভোর জানেই না তার কি রেজাল্ট! শোনেই নি!

-” আমি জানিই না!”
-” পাশ করেছেন আব্বাজান! বিয়ে করতে হবে না।”
ভোর খুশি হয় খানিকটা।
-” আব্বুর সাথে কথা বলবো! ফোন দাও না আম্মু?”
-” হ্যাঁ দেব সোনা। তুমি না বাড়ি যেতে চাইলে? প্রিন্সিপাল ম্যামের থেকে পারমিশন নিয়ে চলে যাবো!”
পাতা ভোরকে কোলে নিয়ে প্রিন্সিপাল ম্যামের কাছে যায়। বাড়ি যাওয়ার পারমিশন চাইলে বিনা বাক্যব্যয়ে পারমিশন দেয়। দিবে না কেন ভাগিনা বধু বলে কথা! তবে পাতাকে বলল,
-” বাচ্চাটার খেয়াল রেখো! পড়াশোনার দিকে ভালোভাবে নজর দিবে নেক্সট এক্সামে যেন ফাস্ট হয়! কিরে ফাস্ট হবি না?”

ভোর আগেই মুখ লুকিয়ে রেখেছে পাতার ওড়নায়। ওনার কথায় আরেকটু লুকিয়ে যায়। কথা বলে না। পাতা হেসে প্রিন্সিপাল ম্যামের থেকে বিদায় নিয়ে বেরিয়ে যায়! টিচার্স রুম থেকে নিজের ব্যাগটা নিয়ে ক্যাম্পাসে হাঁটতে থাকে। রঞ্জু ড্রাইভারের নাম্বারে কল করে গাড়ি আনতে বলে। ভোর কুলফি খাওয়ার বায়না করলো। পাতা দুটো কুলফি কেনে। একটা ভোরকে দিয়ে অপরটা নিজের কাছেই রাখে। তবে খায় না। তার খাওয়ার মুড নেই! গত দিনের মতো আজকেও সবার হাসি তামাশার খোরাক হয়েছে! তাই তো বাড়ি যাওয়ার তাড়া। ভোর অল্প সময়ে কুলফি শেষ করে আবদার জুড়ে, আরেকটা খাবে! পাতা নিজের হাতেরটা বাড়িয়ে বলল,

-” এটা খাও! আমি খাই নি! তবে এটাই লাস্ট! দুটো খেয়েছো জানলে তোমার নাক উঁচু আব্বু আমার নাকটাই কেটে দিবে!”
ভোর হাতে নিয়ে পাতার মুখের সামনে ধরে। পাতা মুচকি হেসে একটু মুখে নিল। ভোর পরপর কুলফি মুখে নিয়ে বলল,
-” আব্বুর নাক মোটেও উঁচু না! তুমি সবসময় বলো! আমার আব্বুর নাক সব থেকে পার্ফেক্ট! হুম!”
-” আচ্ছা? উঁচু না! তোমার আব্বুর নাক বোচা!”
পাতা হেসে ভোরের চুল এলোমেলো করে দিয়ে বলল! ভোর বলল,
-” বোচা আবার কি?”
-” তোমার আব্বুর নাক!”

ভোর গাল ফুলিয়ে হাঁটতে থাকে। পাতা ফোন বের করে অরুণের নাম্বারে কল দিলো! রিং বাজলো তবে রিসিভ হলো না। কেটে দিলো। একটু পরে আবার কল এলো। পাতা রিসিভ করে বলল,
-” সবসময় কল কেটে দিয়ে ব্যাক করে কি প্রমাণ করতে চান যে আমার ফোনে ব্যালেন্স থাকে না? রিসিভ করলে কি হয়?”
ওপাশে অরুণ থমথমে মুখে। মেজাজটা তার বেশ গরম! ঝগড়ার মুড না ফাইটিং মুডে সে। মি. আলম কেস করেছেন। তামিম আপাদত পুলিশের হেফাজতে। আরিয়ান অবশ্য তার জামিনের ব্যবস্থা করেছে। কিন্তু আসল কথা হলো জলটা ঘোলা হয়েছে বলে কি সে শিং ধরতে পারবে না? ওরা অরুণ সরকারকে জানে না! অরুণ নিজেকে শান্ত করে পাতার কথার জবাবে বলে,

-” পাতাবাহার ফাও কথার মুড সময় একটাও নেই! দরকারি কথা থাকলে বলো নইলে রাখছি! আই এম বিজি নাও!”
পাতা ভেংচি কাটলো। আসছে ব্যস্ত মানব!
-” ভোরের রেজাল্ট বেরিয়েছে! র ্যাংকিংয়ে বাইশ! দেখুন বকবেন না আমার ছেলেকে! ওতটাও খারাপ করে নি।”
অরুণ খানিকক্ষণ চুপ থেকে বলল,
-” ওর কাছে দাও?”
-” দিচ্ছি। আপনার সাথেই কথা বলার জন্য উতলা হয়ে আছে!”
বলে ভোরের কাছে দিলো! ভোর ফোন কানে ঠেকিয়ে ডাকলো,

-” আব্বু!”
অরুণ ক্ষিপ্ত মেজাজ ঠান্ডা হলো কি!!
-” কনগ্রেটস কলিজা!”
ভোরের মুখে হাসি ফুটে উঠলো।
-” থ্যাংক ইয়ু আব্বু! আমি নেক্সট এক্সামে অনেক ভালো করবো দেখে নিও?”
-” ইনশাল্লাহ আব্বু! মন খারাপ করবে না। কেমন? আমার কলিজাকে হাসিখুশিই ভালো লাগে!”
-” আব্বু তুমি জলদি আসো! আই মিস ইয়ু!”
-” একটু কাজ আছে মানিক সোনা! কাজ শেষ করে জলদি চলে আসবো! তুমি সাবধানে থেকো! আর তোমার আম্মুর খেয়াল রেখো! রাখছি আচ্ছা?”
-” হুম!”

বলেই কেটে দিল ভোর। অরুণ চেয়ারে গা এলিয়ে দিলো! মেজাজটা একটু কন্ট্রোলে এসেছে। এখন মি. আলমের হচ্ছে! অরুণ সরকারের সাথে লাগতে আসার ফল তো ভোগ করতেই হবে। এমন হাল করে ছাড়বে যে আয়নায় নিজের চেহারাটি দেখতে লজ্জায় পড়ে যাবে!!
ভোর ফোনটা পাতার কাছে দেয় না। নিজের পকেটে পুরে হাঁটতে শুরু করল। পাতা তার পিছু পিছু। বাপকে বোচা বলেছে বলে ছেলে গাল ফুলিয়ে আছে। এতো বাপ পাগল ছেলে হয়? গেইট পেরিয়ে রাস্তার ফুটপাতে দাঁড়ালো দুজন। পাতা ভোরের হাত ধরে আছে শক্ত করে। ভোর চুপচাপ দাঁড়িয়ে। পাতা আড়চোখে ছেলের গম্ভীর মুখশ্রী দেখে নিলো। সামনে ঝালমুড়ি ওয়ালাকে দেখে বলল,

-” ঝাড়মুড়ি খাবে ভোর?”
ভোর পাতার দিকে চায়। ঝালমুড়ি অনেক ঝাল হয়। একবার সে বাবার কাছে জেদ ধরে ঝালমুড়ি খেয়েছিলো! ঝালে তার মুখ মনে হয় জ্বলে যাচ্ছিলো!
পাতা ভোরের উত্তরের আশা করে না। বিশ টাকার ঝালমুড়ি নিলো তবে ঝাল দিতে মানা করলো! তবুও যদি ঝাল লাগে তাই দুটো হাওয়াই মিঠাই কিনলো! রঞ্জু গাড়ি নিয়ে এলে দু জন গাড়িতে উঠে বসলো! রঞ্জু বলল,
-” দেড়ির জন্য স্যরি ম্যাডাম! আপনি বলেছিলেন দেড়ি হবে দেড়টার মতো লাগবে তাই..”
-” আরে না স্যরি বলতে হবে না। দেড়ি হতো ভোর বাড়ি যাবে বলল তাই জলদি চলে এলাম!”
হাসিমুখে বলে পাতা! রঞ্জু প্রতিত্তেরে মুচকি হেসে গাড়ি স্টার্ট করে। ভোর বলে উঠলো,
-” আঙ্কেল? আব্বুর অফিসে চলো! আব্বুর কাছে যাবো!”
রঞ্জু মিররে ভোরের দিকে আড়চোখে তাকিয়ে বলল,

-” ভোর বাবা! আজ অফিসে যাওয়া যাবে না। স্যার অনেক ব্যস্ত আছে। আজ বাড়ি যাবো!”
-” প্লিজ?”
অনুরোধ করে ভোর। পাতা তার গাল টিপে বলল,
-” বিকেলে তোমার হুজুর আসবে! আরবি পড়তে হবে না? আর তোমার ওই টুম্পা মিস আসে না কেন?”
-” আব্বু বলল মিস আর আসবে না!”
মন খারাপ করে বলল ভোর! পাতার কপালে ভাঁজ পড়ে। আসবে না কেন? আর লোকটা তাকে বলল না কেন?
-” কেন আসবে না?”
-” মিসের নাকি স্টাডি আছে অনেক! তাই!”

পাতার অধর যুগলে কিশোরীদের মতো হাসি ফুটে উঠলো। কেন আসবে না এটা বিষয় না! আসবে না এটাই মুখ্য বিষয়। অমন সুন্দরী মেয়ের আসারও দরকার নেই।‌ তার জামাইয়ের সামনে অমন হুর পরী ঘুর ঘুর করবে আর সে জ্বলবে? কদাপি নেহি! তার মনটা কেন জানি ফুরফুরে হয়ে উঠলো! এ কেমন ছেলেমানুষী মন!!
পাতা ঝালমুড়ির ঠোঙা খুলে ভোরকে দিলো!
ভোর ঝালমুড়ির দিকে চেয়ে বলল,

-” যদি ঝাল লাগে?”
-” আরে ঝালই দেয় নি! খাও অনেক মজা! আমি কত খেয়েছি!”
বলেই অল্প ঝালমুড়ি ভোরের মুখে দিলো। ভোর মজা পেলো। এটা তো বেশি ঝাল না। একটু একটু ঝাল; আর ভালো লাগছে খেতে। সে আবার হা করে; পাতা তার মুখে দিলো! নিজেও খেলো! একটু পর পাতা খেয়াল করলো ভোরের ঠোঁট গালজোড়া লাল টকটকে হয়ে গেছে। ঝাল লাগছে কি?
সে পানি দিলো। ভোর ঢকঢক করে খেলো।

-” ঝাল লাগছিলো বলবে না?”
-” বেশি না আম্মু একটু একটু!”
পাতা হাওয়াই মিঠাইয়ের ঠোঙা ছিঁড়ে দিলে ভোর খেলো।
-” ঝাল কমেছে?”
ভোর পাতার গলা জড়িয়ে কোলে বসে গালে চুমু দিয়ে মিষ্টি হেসে বলল,
-” না! একটা কোন আইসক্রিম খেলেই কমে যাবে!”

পাতা ছোট ছোট করে চায়। ভোর মিষ্টি হেসে পাতাকে আম্মু বলেই যেন বশ‌ করে নিলো! এরকম মিষ্টি করে আবদার করলে মানা করা যায়? পাতা তো করতে পারে না। ভোর পাতার মিষ্টি মেলাবন্ধনে পরিবেশ মুখরিত। দুজনেই ভুলে যায় তাদের মন খারাপী! একে অপরের মন খারাপ হাওয়ায় মিলিয়ে দুজনে মেতে ওঠে।ভোর মিষ্টি মিষ্টি হেসে হাত নাড়িয়ে নানা গল্প বলে! তার গল্প শেষ হয় না। আর পাতা তাকে উৎসাহ জানিয়ে মনোযোগ সহকারে প্রত্যেকটা কথা গুরুত্ব সহকারে শোনে। বরবরই পাতা একজন ভালো ধৈর্যশীল শ্রোতা! আর এরকম মিষ্টি মুখ করে মিষ্টি মিষ্টি কথা বললে সে সর্বক্ষণ শুনতে রাজি! দুটো পরিবারের মাঝে থেকেও তার এত বছরের একাকিত্ব অনুভব ঘুচিয়ে দিতে সক্ষম এই মিষ্টি মিষ্টি গল্প। এক দুটো কথার ফুলঝুরি শুরু হয়ে বিশাল উপন্যাস হয়েও তাদের মিষ্টি গল্প ফুরোয় না। অসমাপ্তই রয়ে যায়!

রাতের বেলা! গোধূলির লগ্ন শেষ হয়ে ধরনী জুড়ে তিমিরের খেলা। মেঘলা আকাশ জুড়ে ঝিরিঝিরি বর্ষণ হচ্ছে। ঠান্ডা আবহাওয়ায়! মাঝে মাঝে ক্ষীণ সুরে মেঘের গর্জন শোনা যায়। আনিকা ও ভোর সোফায় বসে ফোনে ‘বাবল স্যুটার’ গেম খেলছে আলাদা আলাদা ফোনে। দুজনে নিজেদের মধ্যকার হৈ হুল্লোড়ে ব্যস্ত।‌আর বড়রা ব্যস্ত চিন্তায়! অরুণ আরিয়ান এখনো বাড়ি ফিরেনি। এদিকে অফিসে ঝামেলা! কি যে হলো? আর পাতার চিন্তার কারণ ভিন্ন। সে এখনো অফিসের ঝামেলার কথা জানেই না। সে তো অরুণের চিন্তায়। লোকটা এখনো আসছে না কেন? বৃষ্টি হচ্ছে বাইরে। রাতও কম হলো না। দশটা বাজতে চললো। এদিকে ভোর একটু পর পর আব্বু আব্বু করছে। খাচ্ছেও না। বলছে আব্বু আসলে খাবো! পাতা প্লেটে গরম ভাত ও বড় রুই মাছের চাকা ভাজা নিয়ে ভোরের পাশে বসলো। মাছের কাঁটা বেছে ভাতসহ ভোরের মুখের সামনে ধরলো। ভোর মুখ ফিরিয়ে বলল,

-” আব্বু আসলে খাবো!”
-” এখন অল্প খেয়ে নাও! তোমার আব্বু আসলে আবার খেও!”
-” না আব্বু আসলেই খাবো!”
ভোরের জেদি কন্ঠস্বর। পাতা হতাশ হয়। এতো জেদ ছেলের। যা বলবে তাই! আসমা বেগম সোফায় সামনের সোফায় বসে ধমক দিয়ে বললেন,
-” এখনি খাবে! খাও? দশটা বাজতে চললো! সেই দুপুরে একটু দুধভাত খেয়েছে। তারপর সব হাবিজাবি চকলেট,চিপস! ভাত খেতে হবে না? আরিয়ানও তো আসে নি! আনিকা খেলো না? তুমি খাবে না কেন?”
ধমকে কাজ হলো বোধহয়। ভোর নাকের পাটা ফুলিয়ে হা করে। পাতা হেসে তার মুখে খাবার তুলে দেয়। সবটুকু খাবার খাইয়ে দিলো। পানি খাইয়ে দিয়ে আঁচলে মুখ মুছে চুমু খেলো। ভোর হাসলো! ফোন পাতার কাছে দিয়ে বলল,

-” ঘুমাবো আমি! ঘুম পাচ্ছে!”
বলেই হাই তোলে। পাতা এঁটো প্লেট রেখে আসে। মিনুকে বলে দুই গ্লাস গরম দুধ নিয়ে আসে। ভোর দুধ দেখেই পেটে হাত দিয়ে বলল,
-” আম্মু আমার টাম্মিতে একদম জায়গা নেই! সত্যিই বলছি!”
-” আইসক্রিমের জন্য জায়গা হবে?”
পাতার কথায় ভোর দাঁত বের করে হেসে দিলো। আইসক্রিমের জন্য তার পেট সবসময় খালি! পাতা আনিকাকে এক গ্লাস দিয়ে ভোরকে বলে,
-” চুপচাপ শেষ করবে! কোন বাহানা না!”

ভোর গটগট করে সবটুকু সাবার করে। ঠোঁটের উপর সর লেগে গোঁফের মতো হয়। আনিকা হেসে বলল ‘ভোরের গোঁফ’! তারপর নিজের গ্লাস খালি করে বলল ‘আনিবুড়ির গোঁফ’ বলেই হেসে উঠলো। ভোরপাতার আঁচলে মুখ মুছে নিলো! আনিকা সেটা দেখে পাতার আঁচলে মুখ মুছতে নিবে ভোর আঁচলটুকু মুঠোয় পুরে বলল,
-” একদম না!”
আনিকা মুখ ভেংচি দিয়ে আসমা বেগমের কোলে বসে। আসমা বেগম যত্ন সহকারে নাতনির মুখ মুছে বলল,
-” ভোর তুমি দিন দিন হিংসুটে হয়ে যাচ্ছো!”
ভোর কিছু বলে না। পাতার হাত ধরে নিজের রুমের দিকে রওনা হয়। পাতা তার সাথে পা মেলায়! এইটুকু ছেলের এতো জেলাসি!

অরুণ,আরিয়ান বাড়ি ফেরে রাত বারোটার দিকে। রুবি জেগেই ছিলো। দরজা সেই খুলে দেয়। দুজনকে ফ্রেশ হয়ে আসতে বলে খাবার গরম করতে শুরু করে। অরুণ নিজের ঘরে যায়। ভেজানো দরজা খুলে ভিতরে প্রবেশ করে। লাইট জ্বলছে! বিছানায় পাতা ও ভোর ঘুমিয়ে আছে। অরুণ ঘড়ি খুলে সোফায়,শার্ট খুলে উদ্দেশ্যহীন ছুঁড়ে ফেলে। শু খুলেই বিছানায় উঠলো। কম্ফোর্ট সরিয়ে দেয়। ভোরের কপালে গালে মুখে আদর করে পাতার দিকে চায়। মেয়েটা আজকেও শাড়ি পড়েই শুয়ে আছে তবে আজকে শাড়ি এলোমেলো নেই, পরিপাটি।

অরুণ তার দিকে ঝুঁকে আসে! ললাটে অধর বসিয়ে সরে আসবে কিন্তু বেহায়া চোখ জোড়া অধরযুগলে পড়ে; সেখানেই নিবদ্ধ হয়। হালকা গোলাপি মোটা হৃষ্টপুষ্ট শুষ্ক ওষ্ঠাধর! মৃদু কাঁপছে। অরুণের গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে যায়! পুরুষালী মন টগবগিয়ে জেগে ওঠে। ইচ্ছে হয় শুষ্ক ওষ্ঠাধর ভিজিয়ে দিতে! হৃষ্টপুষ্ট আইসক্রিমের মতো লোভনীয় ওষ্ঠাধরের ভাঁজে ভাঁজে হারিয়ে পিপাসায় কাতর মনটাকে ভিজিয়ে নিতে। ভাবনার মাঝে অরুণ ঝুঁকে যায় বেশ খানিকটা। নাকে নাকে সংঘর্ষ হয়! সংঘর্ষে পাতা আঁখি মেলে চায় বড় বড় করে।অরুণ সরে যায়! পাতা ধরফর করে উঠে পড়ে। অবাক সুরে প্রশ্ন করে,

-” কি করছিলেন?”
-” মরে টরে যাও নি তো? শ্বাস-প্রশ্বাস চলছে নাকি তাই চেক করছিলাম!”
স্বাভাবিক সুরে নিজেকে স্বাভাবিক রেখেই জবাব দিলো অরুণ! অথচ স্বাভাবিক মুখশ্রীর আড়ালের রূপটা দেখতে পেলে পাতা হয়তো লজ্জায় নুয়ে যেতো!

পাতা পিট পিট করে তাকিয়ে থাকে অরুণের দিকে। কি সুন্দর সাজিয়ে গুছিয়ে বাহানা পরিবেশন করলো! পাতা মোটেও ঘুমিয়ে ছিল না। সে তো মোবাইল দেখছিলো! কারো আসার শব্দে খানিকটা ভয়ে ফোন অফ করে চোখ বুজে ছিলো। পরে বুঝতে পারে লোকটা এসেছে তবে চোখ খুলে নি! ভাগ্যিস খোলে নি নইলে এই ভদ্রলোকের এই রূপটা আন্দাজ করতে পারতো না! লোকটা তার ঘুমানোর সুযোগ নিয়ে কি করতে যাচ্ছিল?! ইয়া আল্লাহ পাতু তোর যা মরার লাহান ঘুম! এতো দিনে লোকটা লুকিয়ে চুরিয়ে অর্ধেক বাসর সেরে ফেলেছে হয়তোবা! লোকটা তো আচ্ছা ধরিবাজ! দেখে মনে হয় ভাজা মাছটি উল্টে খেতে জানে না অথচ কাঁটা সমেত ভাজা মাছ গিলে নেয় ঢেকুর অবধি তোলে না।

পাতার ভাবনার মাঝেই অরুণ ওয়াশ রুমে চলে গেল। পাতা পা ভাঁজ করে বসে হাঁটুতে থুতনি রেখে চিন্তা ভাবনায় মশগুল হয়। এখন থেকে ঘুমের ঘোরেও সজাগ থাকতে হবে তবেই না চোর মহারাজকে ধরতে পারবে। এই চোর তো যে সে চোর না! অরুণ সরকার নামক নাক উঁচু ম্যানারলেস অসভ্য ধরিবাজ চোর! শালার জামাই! লুকিয়ে চুরিয়ে আদর কেন করবি? সামনাসামনি করলে কি সে খেয়ে ফেলবে নাকি! বরং খুশি হয়ে আদরে আদরে ভরিয়ে দিবে, মাথায় তুলে রাখবে।
অল্প সময় নিয়ে গোসল করে অরুণ বেড়িয়ে আসে। পাতাকে ওভাবে বসে থাকতে দেখে বলল,

-” ওভাবে বসে আছো কেন? খেয়েছো?”
পাতা অরুণের দিকে চায় বিমুগ্ধ লেচনে; চোখ মুখ উজ্জ্বলতম হয়ে ওঠে; যাতে ফুটে ওঠে এক রাশ ভালোলাগা। সদ্য গোসল সেরে আধ ভেজা উন্মুক্ত শরীরে দাঁড়িয়ে থাকা লোকটি তার। ওই ভেজা লোমশ বুকটার মালকিন সে!ভেজা চুলে তোয়ালে ঘষছে! লোকটাকি ওই আধ কাঁচাপাকা চুল মোছার দায়িত্ব তাকে দিতে পারতো না? বোকা পাতা জানেই না ওই নাক উঁচু ম্যানারলেস লোকটাও চায় তার ব্যাক্তিগত নারী একটু যত্ন করুক!
অরুণ পাতাকে ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে থাকতে দেখে তোয়ালে মুখের দিকে ছুঁড়ে মারে। পাতা হচকচিয়ে উঠে। নাকে মুখে ভেজা তোয়ালে পড়ায় সে মোটেও বিরক্ত হয় না। নাক টেনে শ্বাস নেয়! যেন কোনো নেশালো বস্তু!

-” কি হলো?”
পাতা নিজেকে সামলে নেয়। আস্তে করে বলল,
-” আমি খেয়েছি! আপনি চলুন আমি খাবার গরম করে দিচ্ছি!”
অরুণের স্বাভাবিক মুখশ্রী গম্ভীর হয়ে ওঠে। বিছানা থেকে নামতে উদ্যত হওয়া পাতাকে বাঁধা দিয়ে বলল,
-” তার দরকার নেই! রুবি জেগে ছিলো আরিয়ানের জন্য! না খেয়েই! ওই গরম করেছে। তুমি ঘুমাও পাতাবাহার!”
বলে অপেক্ষা করে না গায়ে টি শার্ট চাপিয়ে চলে যায় হনহনিয়ে। পাতা বসে পড়লো বিছানায়। লোকটা ওভাবে বলল কেন? কেমন যেন শোনালো না? “রুবি জেগে ছিল আরিয়ানের জন্য! না খেয়েই” আচ্ছা তারও কি উচিৎ ছিল, না খেয়ে লোকটার জন্য অপেক্ষা করা? ছিল তো! হান্ড্রেন্ট পার্সেন্ট উচিত ছিলো! না খেয়ে তার স্বামীর জন্য বসে থাকা তো একজন স্ত্রীর ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ! অথচ সে কি করলো? নিজে পেট পুরে খেয়ে ঘুমে কাত! স্বামীর কথা ভুলেই বসেছে। পাতার মনটা খারাপ হয়ে গেল নিমিষেই! ইশ্ লোকটাও বুঝি তার থেকে আশা করেছিলো! লোকটা তার কত যত্ন করে আদরও করে। অথচ সে!! পাতা গাল ফুলিয়ে বসে থাকলো!
খাওয়া দাওয়া শেষ করে অরুণ রুমে প্রবেশ করে। পাতাকে গালে হাত দিয়ে বসে থাকতে দেখে সুধায়,

-” ঘুমাও নি? ঘুমিয়ে পড়ো!”
বলেই ওয়াশ রুমে চলে যায়! পাতা দু একবার চোখ পিটপিট করে। ভেবে নেয় লোকটা আসলে কি কি বলবে! একটু পর অরুণ বেরিয়ে আসলে পাতা জিজ্ঞেস করে,
-” আপনি রোজ রোজ এতো দেরি করে আসেন?”
অরুণ ব্যাগ থেকে ল্যাপটপ বের করে গ্লাসে পানি নিয়ে সোফায় বসল।
-” কখনো কখনো!”
-” এত রাতভর কিসের কাজ? শুনেছি সবার সন্ধ্যার পরপরই ছুটি হয়! আপনি এতো লেট করে আসেন কেন? ভোর আজ সারাদিন আব্বু আব্বু করেছে। অনেক রাত পর্যন্ত অপেক্ষায় ছিলো! জেদ ধরে বসে ছিল আব্বু আসলেই খাবে সে। মা বললে তবেই খেলো!”
অরুণ পানির গ্লাস পাশে রেখে ল্যাপটপে মনোযোগ দিয়ে বলল,

-” ব্যস্ত ছিলাম!”
-” এতো কিসের ব্যস্ততা?
-‘ কাজ করছি আমি! ডিস্টার্ব করো না।”
শান্ত স্বরে বলে অরুণ। পাতার ভালো লাগে না। সেই সকাল ভোরে বেরিয়েছে। সারাটা দিন ছিলো। এখন রাত বারোটার পর এসে আবার কাজ করছে! এতো কিসের কাজ? ঘড়িতে একটা বেজে গেছে। ঘুমাবে কখন? পাতা বিছানা থেকে নেমে অরুণের সামনে দাঁড়িয়ে বলল,

-” ডিস্টার্ব করছি আমি? এখন রাত একটা বাজে ঘুমোবেন কখন আপনি? সারাদিন, রাত বারোটা পর্যন্ত কাজ করেও আপনার কাজ ফুরোলো না! এতো কি কাজ?”
অরুণ প্রতিত্তর করে না। চুপচাপ কাজ করতে থাকে। পাতা আরো অনেক কিছুই বলে অরুণ কানে তুললো না। সে কাজে ব্যস্ত। পাতার দিকে তাকায়ই না! পাতা রেগে গেলো। শালার জামাই তার কথা শুনছে না! এতো দিনের আদর যত্নে পাতার বেশ সাহস সঞ্চয় হয়েছে। তাই তো অরুণের কোল থেকে ল্যাপটপ কেড়ে নিয়ে সাটার অফ করে কম্ফোর্টের ভিতর লুকিয়ে রাখে।

-” আপনি আমার কথা শুনছেন না! কখন থেকে বলে যাচ্ছি আমি! এখন কোনো কাজ না। না মানে না !”
অধিকার দেখিয়ে বলে বুকে হাত গুঁজে তীক্ষ্ম দৃষ্টিতে অরুণের দিকে চায়। গম্ভীর অরুণের চোয়ালদ্বয় শক্ত হয়! হাত নিশপিশ করে। পাশে রাখা পানির গ্লাস হাতে নিয়ে ঠাস করে ফ্লোরে ছুঁড়ে মারে। ঝনঝন শব্দে পুরো রুম ভরে ওঠে। পানি ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে ফ্লোর ভিজে গেল। ভোর এপাশ থেকে ওপাশ ফিরে শোয়। খাঁচায় বন্দী পাতাবাহার মিও মিও করে ডাকতে শুরু করে। পাতা স্তব্ধ মুক হয়ে দাঁড়িয়ে। সে বেশ ভয় পেয়েছে! সাথে এটাও বুঝে গেছে সে অনর্ধিকার চর্চা করতে গিয়েছিল! আর এর ফলাফলও‌ সুদ সমেত পেয়ে গেল। লোকটা গ্লাস ফেলেনি, পাতাকে ফেলে টুকরো টুকরো করে দিলো যেন! পাতার চোখ ভরে ওঠে। এবার আর বাঁধা দিলো না। আস্তে করে পা ফেলে কম্ফোর্টের ভিতর থেকে ল্যাপটপ বের করে অরুণের সামনে রাখে।

-” স্যরি!”
বলেই তন্ত পায়ে হেঁটে বিছানায় যায়। পায়ের গোড়ালিতে কাঁচ ফুটে এতেও ভাবান্তর হয় না। কম্ফোর্ট পেঁচিয়ে আপাদমস্তক ঢেকে ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠে নিঃশব্দে। লোকটা তাকে আদর যত্ন করে, খেয়াল রাখে! ঝাড়ি ধমক দেয়, তবে সেটা ভালো লাগে! ভাবে অল্প খানিক ভালোবেসেই শাসন করে যেমনটা ভোরকে করে! তাই তো পাতা সাহস পায় লোকটার উপর একটু আকটু কথা বলতে! মাঝে মাঝে বলেও! লোকটা কখনো কিছু বলে নি। অথচ আজ!! ভাবতেই পাতার ফোপানো বেড়ে যায়! বৃদ্ধাঙ্গুলির গোড়ালিতে কামড়ে কান্না, ফোঁপানো আটকানোর চেষ্টায়! ঢের শিক্ষা হয়েছে তার।

অরুণের চোয়ালদ্বয় এখনো শিথিল হয় নি। মেজাজ এখনো তিরিক্ষি! রাগে শরীরটা যেন জ্বলছে। তবুও সে নিজেকে ঠান্ডা রেখেছে। বিছানায় যে একজন অশ্রু বিসর্জন দেয়ার প্রতিযোগিতায় নেমেছে সেটাও বুঝতে বাকি নেই। অরুণ সোফায় গা এলিয়ে দেয়! মুখশ্রী কপালে হাত রাখে! যন্ত্রণায় মাথার রগ ছিঁড়ে যাবার উপক্রম! হাত পা কোমড়সহ পুরো শরীরের রগে রগে যেন সে ব্যাথা ছড়িয়ে পড়ছে! অরুণ টি টেবিল থেকে ফোনটা হাতে নেয়। রাসেলের নাম্বারে কল করে। রিসিভ হলেই অরুণ জিজ্ঞেস করে,

-” কোথায় তুই?”
রাসেল মেয়েকে ঘুম পাড়ানোর চেষ্টায় আছে। দুষ্টু মেয়েটা ঘুমুচ্ছেই না।মায়ের ফোনে কার্টুন দেখছে। ভেবেছিল মেয়েকে জলদি ঘুম পাড়িয়ে বউকে নিয়ে একটু বিছানাবিলাস করবে কিন্তু মেয়েটা ঘুমোনোর নামই নেই অথচ মেয়ের মা নাক ডেকে ঘুমাচ্ছেন। বন্ধুর ফোন পেয়ে একটু খুশিই হলো। দুঃখের কথা বলা যাবে।
-” এতো রাতে কই থাকবো! ঘরেই আছি! ভালো করেছিস ফোন দিয়েছিস! দুঃখ শেয়ার করার জন্য কাউকে পেলাম!”

-” তোর দুঃখের আলাপ শোনার টাইম আমার নেই! তোর সরকারি মালটা আমার লাগবে!”
বিরক্তিকর সুরে বলে অরুণ। রাসেলের বুঝতে বাকি নেই কিসের কথা বলছে। ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করে,
-” হোয়াট পাগল তুই? কি করবি?”
-” সেটা আমার ব্যাপার! কাল সকালে ওটা নিয়ে আসবো! বাড়িতেই থাকবি! রাখছি!”
-” আরে শোন কি করবি সেটা বল? এটা খেলনা বস্তু না যে..”
-” আমি জানি সেটা! আর আমি খেলবো না। খেলনা বস্তু আমার ছেলের ভরি ভরি আছে। আর কি করবো সেটা কালকেই বলবো!”

বলেই খপ করে কল কেটে দিলো।তারপর ফোন সোফায় ছুড়ে ল্যাপটপ ওপেন করলো। কিছু ইনফরমেশন কালেক্ট করে সেভ করে রাখলো! ল্যাপটপের সাটার অফ করে ফ্লোরের কাঁচের টুকরোগুলো তুলে বিনে রাখলো। ভেজা ফ্লোর মুছেও নিলো! টি শার্ট খুলে ফাস্ট এইড বক্স নিয়ে বিছানায় বসলো। পাতার পায়ের কাচের ছোট্ট টুকরো বের করে ড্রেসিন করে দিলো। ভোরকে সাইডে রেখে মাঝখানে শুয়ে পড়লো। ছেলের মাথায় কিছু সময় হাত বুলিয়ে লাইট অফ করে পাতার দিকে ঘেঁষে গা এলিয়ে দিলো।

পাতা বাহার পর্ব ৩৪

ঘুমিয়ে পড়েছে কি মেয়েটা! অরুণ পাতার কোমড় টেনে কাছে আনে। বুকে জড়িয়ে চুলের ভাঁজে ছোট ছোট চুমু খায়। চুলের রেবন খুলে দিয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়। পাতা চোখ খুলে অল্প। চোখের সামনে অন্ধকার দেখলেও চোখের তারায় অগনিত সুখতারা মিটমিট করে জ্বলতে থাকে। ঝাড়ি, বকা, গ্লাস ভাঙচুর যাইহোক না কেন! সবশেষে প্রতিবার এভাবে বুকে টেনে নিয়ে আদর করলে পাতা একশ দুইবার অনর্ধিকার চর্চা করবে!

পাতা বাহার পর্ব ৩৫