পাতা বাহার পর্ব ৩৫

পাতা বাহার পর্ব ৩৫
বেলা শেখ 

বৃষ্টি ভেজা সকাল।গত ভোর রাতের মতো আজ ভোর রাতেও বৃষ্টি হয়েছে ঝমঝমিয়ে। গত ভোর রাতের চেয়েও বেশি হারে বৃষ্টি হয়েছে।গতদিন অরুণ হাঁটতে বের হতে না পারলেও আজকে বৃষ্টি থামার সাথে সাথেই বেরিয়েছে ছাতা সমেত। যানজট বিহীন বৃষ্টি ভেজা পিচঢালা রাস্তায় হাঁটার মজাই অন্যরকম । তবে আজ অরুণ একা না। সাথে ভোর;! আজ ডাকতে হয় নি ছেলে, ছেলের আম্মুকে। পাতাবাহারকে ফজরের ওয়াক্তে দুই বার ডেকেই তোলা গেছে। তবে নামাজ শেষ করেই বিছানায় চিৎপটাং!

অরুণ ছেলের হাত ধরে হাঁটছে ধীরে ধীরে। সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠেই ভোরের বুলি ফুটেছে বেশ। দু’দিন বাবার সাথে ভালো করে কথাই হয়নি তা বোধহয় এই অল্প সময়েই উসুল করে নিচ্ছে। একটার পর একটা কাহিনী বলে যাচ্ছে। কাল কি করেছে, গতদিন কি করেছে! পাতাবাহার নামক বিড়াল শাবকটির সাথে আম্মুর কতবার ঝগড়া বেঁধেছে! কি নিয়ে বেঁধেছে! আনিকার সাথে তার ঝগড়া লাগে নি গত দু’দিন! আভারি কাক্কু পুকুরে থেকে ছোট ছোট অনেক গুলো মাছ ধরেছে! মিনু খালা সেগুলো ভেজে দিয়েছে।খেতে অনেক মজা! আব্বু যেন তাকেও মাছ ধরা শেখায়! সাথে সাইকেল চালানোও! আরো অনেক অনেক কথা! অরুণ শুনছে কি না বোঝা যাচ্ছে না। হা হু কিছু বলছে না। এতে ভোর থেমে নেই। সে তার মতো বলে যাচ্ছে। আরেকটু পথ হেঁটে যাওয়ার পর দেখা হয় সেই বৃদ্ধা লোকটির সাথে যার নাম কাবেল! অরুণকে দেখেই হ্যান্ডশেক করে হালকা জড়িয়ে ধরে পিঠ চাপড়ে দিলো। ভোরকে দেখে বলল,

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

-” আব্বাজান নাকি?”
ভোর বাবার হাত শক্ত করে ধরে পিটপিট করে চায়। অরুণ ছেলের মাথায় হাত বুলিয়ে ‘হুম’ বলে। বৃদ্ধা ভোরের গাল হালকা চেপে ধরে মুখ উঁচু করে। ভোরের লাল ঠোঁটজোড়া,গাল ফুলে ওঠে। ভোর আড়চোখে বাবার দিকে তাকিয়ে রইল। বৃদ্ধা হেসে তাকে ছেড়ে দিয়ে বলল,
-” এতো তোর কার্বন কপি রে অরুণ! অনিকের মতো হয় নি একটুও! তুইও ছোট বেলায় এমনি ছিলি! কুটুর মুটুর করে চেয়ে থাকতি!”
ভোর ছাড়া পেয়ে গালে হাত বুলায়; বাবার সাথে সেঁটে গিয়ে মুখ লুকায়। পঁচা বুড়ো! তার সুন্দর কিউট গালটাকে কিভাবে ধরলো! অরুণ ছেলের মাথায় হাত বুলিয়ে বৃদ্ধার উদ্দেশ্যে বলল,
-” দোয়া করবেন আমার ছেলেটার জন্য!”

বৃদ্ধা হেসে ভোরকে টেনে অরুণের থেকে ছাড়িয়ে নেয়। ভোর খানিকটা ভয় পেয়ে অরুণের দিকে কাঁদো কাঁদো হয়ে তাকিয়ে রইল। অরুণ মুচকি হেসে চোখের ইশারায় আশ্বস্ত করে। বৃদ্ধা লোকটি ভোরের মাথায় সময় নিয়ে হাত বুলিয়ে দিয়ে গালে হাত রেখে দোয়া করে। তারপর হেসে বলল,
-” অনেক বড় হন আব্বাজান! দীর্ঘজীবী হন! আর বড় হয়ে আপনার বুড়ো আব্বুরে ভুলে যাইয়েন না!”
ভোরের মুখে হাসি ফুটে ওঠে। বুড়ো দাদুটা পঁচা না; ভালোই। আদর করলো তাকে।
-” নতুন মা আদর করে? ভালোবাসে?”
ভোর মিষ্টি হেসে হাত প্রসারিত করে জবাব দিল,

-” অনেক ভালোবাসে আদর করে আম্মু!”
বৃদ্ধা ভোরের গাল টিপে দিয়ে বলল,
-” তাহলে তো অনেক ভালো!”
-” তাহলে আম্মুকেও দোয়া করে দাও দাদু?আর আব্বুকেও”
ভোরের কথায় হাসে বৃদ্ধা!
-” যাহ দিলাম! শিঘ্রই তোদের বাড়ি নতুন সদস্যের আগমন হবে! কিরে অরুণ হবে না?”
অরুণ খুক খুক করে কেশে ওঠে। গাছ রোপনই করলো না বুড়ো ফলের দোয়া করছে! তবুও সে হেসে মাথা দোলায়। ভোর কিছু বুঝতে পারলো না। নতুন সদস্য কোথা থেকে আসবে? এটা কেমন দোয়া করলো! অরুণ বৃদ্ধা কাবেলের থেকে বিদায় নিয়ে হাঁটা শুরু করে। ভোর চিন্তিত মুখে বাবাকে প্রশ্ন করে,

-” আব্বু নতুন সদস্য কে? কোথা থেকে আসবে? কখন আসবে?”
অরুণ ছেলেকে কোলে তুলে নিয়ে হাঁটতে হাঁটতে বলল,
-” কি জানি কলিজা! যখন আসবে জিজ্ঞেস করে নিও!”

পাতা সকাল সকাল ব্যস্ত সময় পার করছে। কিচেনে কাজ করতে সে মহাব্যস্ত!ভাবসাব এমন যে কারো দিকে তাকানোর সময় নেই। আজ সে কাজের গুষ্টির তুষ্টি করে দেবে। আর তার কাজের নমুনা যেমন: চা বানিয়েছে; মিনুকে পেঁয়াজ ছিলে দিয়েছে;ডিম সিদ্ধ করছে; ভাজির লবণ ঝাল পরখ করিয়েছে মিনু; সবশেষে এখন তা’য়ে রুটি সেকছে! যদিও রুটি মোটেও ফুলছে না; পুরে যাচ্ছে খানিকটা। মিনু হতাশ হয়। এই মেয়ে তো কিছুই পারে না। এ ঘরে না পড়ে অন্য কোনো দজ্জাল শাশুড়ির তালে পড়লে উঠতে বসতে ঝাড়ি খেতো! কিছুই পারে না এমন না!! মিষ্টি করে অল্প সল্প কথা বলে। আর সবার কথা মনোযোগ দিয়ে শোনে, বিরক্ত হয় না‌! এই যে সে রান্নাঘরে পুরোটা সময় এটা ওটা বলছে মেয়েটা চুপচাপ শুনছে আবার ছোটখাটো প্রশ্নও করছে।

-” ম্যাডাম হইছে আপনি যান! আমি কইরে দিতেছি! আপনের কষ্ট হইতেছে! যান!”
বলতে পারে না যে আপনার এ রুটি বাড়ির লোকজনের সামনে দিলে ফিক্কে ফাইলে দিবে!
পাতা হেসে বলল,
-” না! আমার কষ্ট হচ্ছে না। বরং ভালো লাগছে!”
মিনু মুখ গোমড়া করে। কতগুলো আটা রুটি নষ্ট সাথে সময়ও; খাটুনির তো কথাই নেই। পাছে আবার তাকে নতুন করে রুটি করতে হবে। তাই সে আমতা আমতা করে বলল,
-” রুটি তো ফুলতেছে না। এই রুটি কেউ খাইতো না!”
পাতা রুটির দিকে চায় অসহায় চোখে। মুখ খানি তার দেখার মতো। শেষ রুটি টা নামিয়ে পাতা চুপটি করে দাঁড়িয়ে থাকে। মিনু পাতার অমন মুখ দেখে বলল,

-” ম্যাডাম রাগ করছেন আমার কথায়? কিছু মনে করবেন না!”
-” আরে না রাগ করবো কেন? আমি সত্যিই পারি না! তুমি শিখিয়ে দিও মিনু আপা! দিবে না?”
হেসে বলল পাতা। মিনু তার কথায় আশ্বস্ত হয়। সায় জানিয়ে ‘আইচ্ছা’ বলে। তখনই দৌড়ে কিচেনে আসে ভোর। মিনুর দিকে তাকিয়ে বলল,
-” ও মিনু খালা আজ আমার জন্য সেমাই রান্না করবে। মিষ্টি করে! তারপর ফ্রিজে রেখে দিবে। ঠান্ডা হলে খাবো!”
মিনু তার দিকে তাকিয়ে হেসে বলল,
-” আচ্ছা ভোর বাবা! কই গেছিলা তুমি? পায়ে ময়লা লেগে আছে!”

ভোর নিজের পায়ের দিকে চায়। কাঁদা রাস্তায় হাঁটতে গিয়ে লেগেছে। এরইমধ্যে অরুণ সরকারের আগমন ঘটে রান্নাঘরের দরজায়। পাতা তাকে দেখে খানিক আড়ষ্ট ভঙ্গিতে পুরে যাওয়া রুটি আড়াল করে দাঁড়ায়। অরুণের অবশ্য সেদিকে ধ্যান নেই! সে ভোরকে কোলে নিয়ে বলল,
-” চলো ময়লা পরিষ্কার করে দিই! স্কুলে যেতে হবে তো!”
বলেই পা বাড়ায়। পাতা তাদের যেতে দেখে নিজেও গুটিগুটি পায়ে অরুণের পিছু পিছু হাঁটে। মিনু‌ সেটা দেখে মুচকি হাসলো।

পাতা অরুনের পরে রুমে ঢুকে। অরুণ ভোরকে নিয়ে ওয়াশ রুমে চলে যায়। পাতা বসে থাকে। একটু পরে অরুণ তোয়ালে পেঁচিয়ে ছেলেকে নিয়ে আসে। ভোর পাতাকে দেখে লজ্জা পায়। পাতা তার লজ্জা দেখে হাসে। ভোর তোয়ালে ধরে বাবার পিছনে লুকায়। অরুণ আলমারি থেকে প্যান্ট এনে পরিয়ে দেয়।
-” স্কুলে যাওয়ার কোনো তাড়া দেখছি না!”
-” আমি আজ স্কুলে যাব না আব্বু!”
ভোরের কথায় অরুণের কপালে ভাঁজ পড়ে।
-” কেন?”
-” যেতে ইচ্ছে করছে না!”
-” তবুও যেতে হবে! আমি রেডি করিয়ে দিচ্ছি!”

বলে পাতার দিকে আড়চোখে চেয়ে আলমারির কাছে যায়। পাতা মিনমিনে গলায় বলে,
-” আজ থাক! আমিও যাবো না। প্রিন্সিপাল ম্যামের থেকে ছুটি নিয়েছি!”
-” কে যাবে, না যাবে তার ব্যাপার! ভোর তুমি যাচ্ছো!”
গম্ভীর মুখে বলে অরুণ! পাতার মুখটা চুপসে যায়। ভোর কাঁদো কাঁদো জেদি গলায় বলে,
-” আমিও যাবো না! আম্মু যাবে না ভোরও যাবে না।”
অরুণ চোখ রাঙায়। ভোর গাল ফুলিয়ে নেয়। আব্বু আজকে যতই চোখ রাঙাক না কেন সে যাবে না মানে যাবে না। অরুণ শান্ত গলায় বলে,

-” বলেছিলে না নেক্সট এক্সামে ভালো করবে? তারজন্য ভালোভাবে পড়তে হবে না? স্কুলে যেতে হবে না?”
-” আমার না পড়লেও চলবে!”
-” কিভাবে চলবে?”
ভোর গাল ফুলিয়ে বলে,
-” ওভাবেই!”
-” ভোর!”
ধমকে বলে অরুণ! ভোর ভয় পায় না। জেদ ধরে বলে,
-” আব্বু!”
পরিস্থিতি বেগতিক দেখে পাতা নরম গলায় অনুরোধের সুরে বলে,

-” আজ থাক না? এমনিতেই আজ খুব একটা ক্লাস হবে না। বৃহস্পতিবার তার উপর কাল রেজাল্ট হলো! সেগুলো নিয়েই আলাপ সালাপ হবে!”
অরুণ কিছু বলে না। চুপচাপ প্রয়োজনীয় কাপড়চোপড় নিয়ে ওয়াশ রুমে চলে যায়‌। পাতা বিষন্ন মনে তাকিয়ে দেখে। রেগে তার থাকার কথা ছিল না? অথচ লোকটা তার সাথে কথা বলছে না। অরুণ মিনিট কয়েক পরেই বেরিয়ে আসে। চুপচাপ ড্রেসিন টেবিলের সামনে গিয়ে শার্ট ইন করে বেল্ট পড়ে! চুল পরিপাটি করে পারফিউম স্প্রে করে। জেন্টস পারফিউমে পুরো রুম জুড়ে সুগন্ধ ছড়িয়ে পড়ে। হাত ঘড়ি বেঁধে বিছানায় বসে মুজো পড়ে, শু পড়ে নেয়‌। পাতা পলকহীন তার দিকেই চেয়ে! আজ ব্লু শার্ট! কালো প্যান্ট। নিত্যদিনের মতো আজও মারাত্মক লাগছে তার জামাইটাকে। শুধু মুখটা নিরস! একটু হাসিমুখে থাকলে লোকটার থেকে চোখ ফেরানো দায় হয়ে যেতো! অরুণ শু পড়ে বিছানায় চুপচাপ বসে থাকা ছেলের কপালে চুমু দেয়। মোবাইল ও ল্যাপটপের ব্যাগটা হাতে তুলে কিছু না বলেই হনহন করে চলে যায়! পাতার চোখ জোড়ায় বিষন্নতার মেঘ নামে। ভোরের মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়। হঠাৎ খেয়াল হয়, লোকটা না খেয়ে চলে যাবে নাকি?

-” আমি নিচে যাই তোমার আব্বু না খেয়ে চলে গেল নাকি? তুমিও এসো আস্তে ধীরে।”
বলেই শাড়ির কুঁচি ধরে একপ্রকার দৌড় লাগায়। সিঁড়ির কাছে গিয়ে দেখে লোকটা ড্রয়িং রুমে দাঁড়িয়ে আরিয়ান ভাইয়ের সাথে কথা বলছে। পাতা স্বস্তির নিঃশ্বাস ছেঁড়ে চটজলদি নেমে কিচেনে যায়। মিনু রান্না করা শেষ হয় নি। রুটি সেকছে। পাতা মিনুকে বলে একটা প্লেট নিয়ে তিনটে গরম রুটি ও ভাজি নেয়। মিনু ততক্ষণে ডিম ভেজে দিয়েছে। পাতা প্লেটে ভাজা ডিম নিয়ে ড্রয়িং রুমে যায়। দেখে লোকটা ভাইয়ের থেকে বিদায় নিচ্ছে যাওয়ার জন্য। সে গিয়ে মিনমিনে গলায় বলে,

-” খাবারটা খেয়ে যান!”
অরুণ ভ্রু উঁচিয়ে পাতার দিকে ও একবার প্লেটের দিকে তাকিয়ে পা বাড়ায়। আরিয়ানেরও কপালে ভাঁজ পড়ে। তবে পাতার দিকে তাকিয়ে ব্যঙ্গ করে হাসে। পাতার নাকের পাটা ফুলে ওঠে।
-” প্লিজ খেয়ে যান? আমি খাবার এনেছি!”
অরুণ ঘুরে ডায়নিং এ বসে। পাতার মুখশ্রী উজ্জ্বল হয়। আরিয়ানকে ভেংচি কেটে প্লেট নিয়ে অরুণের সামনে রাখে। গ্লাসে পানি ঢেলে দেয়। অরুণ হাত ধুয়ে নেয়। রুটি ছিঁড়ে মুখে পুরে। এরইমধ্যে ভোর চলে আসে। ড্রয়িং রুমে চাচ্চুর পাশে বসে গল্প জুড়ে দিলো। অরুণ যত দ্রুত সম্ভব রুটি তিনটে সাবার করে পানি খেয়ে হাত ধোয়ার জন্য উদ্যত হলে পাতা বলল,

-” আর দুটো আনি?”
অরুণ গম্ভীর মুখে পাতার দিকে চায়। একটা গ্লাস ভাঙ্গার পর মেয়েটা এতটা যত্নশীল হয়ে উঠলো? গ্লাস ভাঙ্গার এতো পাওয়ার!
-” নো নীড!”
অরুণ হাত ধুয়ে মুখ পুছে। অরুণ পকেট থেকে রুমাল বের করবে পাতা আশেপাশে নজর বুলিয়ে নেয়। হাত বাড়িয়ে আঁচল দিয়ে যত্ন সহকারে মুখ মুছে দিয়ে বলে,
-” অফিসে ঝামেলা হচ্ছে সেটা আমায় বললে আমি কি ঝামেলা বাড়িয়ে দিবো? নাকি আমাকে বলা যায় না?”
অভিমানের গলা! অরুণ প্রতিত্তরে কিছু বলে না। ঠোঁটের কোনায় হাসি ছড়িয়ে পড়তে চাইলেও বাঁধা দেয়। গম্ভীর মুখে উঠে দাঁড়ালো। চেয়ারে রাখা ব্যাগটা ফেলেই হাঁটা দেয়। আরিয়ানের কোলে বসা ছেলেটার গালে পুনরায় চুমু দিয়ে বেরিয়ে যায়। পাতা কি বুঝলো?

পাতা তার যাওয়া দেখে। তারপর চেয়ারে রাখা ব্যাগটা নিয়ে নিজেও পা বাড়ায়। মেইন ফটক পেরিয়ে বাইরে আসতেই দেখে লোকটা দাঁড়িয়ে আছে গম্ভীর মুখে। তাহলে পাতার ধারনাই ঠিক। লোকটা ইচ্ছে করেই ব্যাগ ফেলে গেছে। পাতা মুচকি হেসে অরুণ পাশে দাঁড়ায়! অরুণ খপ করে ব্যাগটা কাঁধ গলিয়ে নেয়। দু গালে হাত রেখে পরপর ঝুঁকে বধুয়ার ললাটে চুম্বন করে সময় নিয়ে। আজকের ওইটুকু যত্ন অরুণের জন্য আকাশ সমান। অরুণের আবছা আবছা স্মৃতিতে ভাসে; আদর করে খাইয়ে দেয়ার পর আঁচল দিয়ে মা’য়ের মুখ মুছিয়ে দিয়ে কপালে চুমু খাওয়ার দৃশ্য খানি। মা যাওয়ার পর প্রথমবার কেউ খাওয়ার পর মুখটা যত্ন সহকারে আঁচল দিয়ে মুছে দিলো!
অরুণ ললাট থেকে অধর সরিয়ে গালে ছোট ছোট দুটো চুমু দিয়ে আলতো কামড় বসিয়ে ছেঁড়ে চলে যায় বিনা বাক্যব্যয়ে! স্বর্গে ভাসতে থাকা পাতার হুঁশ ফিরে। খানিকটা গলা উঁচিয়ে অরুণের উদ্দেশ্যে বলে,

-” সাবধানে যাবেন! নিজের খেয়াল রাখবেন!”
অরুণ শুনতে পেলেও পিছনে ফেরে না। অধর বাঁকিয়ে হনহন করে চলে যায় গেটের ভিতরে অবস্থানরত গাড়ির দিকে।
পাতা যায় না। সেখানেই দাঁড়িয়ে থাকে যতক্ষণ পর্যন্ত গাড়িটা গেইট পেরিয়ে বেড়িয়ে না যায়। তার জীবনের কঠিনতম গোলক ধাঁধা থেকে নিরবচ্ছিন্ন হয়ে কেমন রামধনুর সাত রঙের মতো রঙিন হচ্ছে। স্বামী সংসার নিয়ে তার দেখা স্বপ্ন বাস্তবিক রূপ নিয়ে রঙিন ছবির ন্যায় পর্দায় ভাসছে কি!!

চিন্তিত মুখে সোফায় বসে আছে রাসেল। সামনে স্ত্রী সুফিয়া ছেলে মেয়ে সুজির হালুয়া খাওয়াচ্ছে। ছেলে মেয়ে দুটো জমজ! ছেলেটার নাম সাহির মেয়েটার নাম সামান্থা। ছয় বছর পেরিয়ে সাতে পা দিয়েছে সবে। এতো দুষ্টু দুটো! হাড় মাংস জ্বালিয়ে খায়। এই যেমন সকালে রুটি খাবে না! পরোটা বানিয়ে দিলো সেটাও না! অমলেট দিলো সেটাও খাবে না। ওর মা ব্রেড ভেজে দিলো সেটাও খাবে না। তাহলে কি খাবে জিজ্ঞেস করলেও বলতে পারে না। নুডুলস, পাস্তাও বানিয়ে দিলো তারা খাবে না। তখন ছেলেটা বলল সে হালুয়া খাবে। তাও সুজির হালুয়া!

এদিকে বাড়িতে সুজি নেই! সুফিয়া ভালোভাবে বুঝিয়ে বলল দুপুরে বানিয়ে দিবে সেটাও চলবে না। অগত্যা তাকে বাজারে দৌড়াতে হয়‌। এখন সে সিভিল পোষাকে বসে আছে অরুণ সরকারের অপেক্ষায়। দশটায় ক্যান্টনমেন্ট পৌঁছাতে হবে। তার বাড়ি থেকে প্রায় ঘন্টা খানেকের রাস্তা। এখন নয়টা বিশ বাজে এখনও শালার আশার নাম নেই! সে চলে যেতো ; কিন্তু শালা অস্ত্র চেয়েছে! সে জানে অরুণ এটা নিয়ে উল্টাপাল্টা কিছু করবে না। পূর্ণ বিশ্বাস আছে তার। তবে দেয়ার ইচ্ছে এইটুকুও নেই!

এটা কোন খেলনা জিনিস মোটেই না। আর সরকার এটা তাকে দিয়েছে দায়িত্ব পালনের জন্য! সাধারণ মানুষকে হেফাজতে রাখার জন্য। সেখানে সে সাধারণ মানুষের হাতে কিভাবে এই অস্ত্র তুলে দিবে? এটাতো অন্যায়। তবে না দিয়েও নিস্তার নেই। অন্য কোন বন্ধু হলে মুখের উপর কড়া কথা বলে মানা করে দিতো। কিন্তু অরুণ? ওই শালারে না করলে কিছু বলবে না। কিন্তু গাল ফুলিয়ে নেবে। কথাই বলবে না যোগাযোগ তো দূরের কথা। তার ভাবনার মাঝেই কলিংবেল বাজলো। রাসেল গিয়ে দরজা খুলে গোমড়া মুখে। সামনে অরুণ দাঁড়িয়ে! অন্যসময় হলে গলা জড়িয়ে কুশল বিনিময় করতো। এখন সেই পরিস্থিতি নেই। অরুণ বন্ধুকে দেখে হেসে পেটে পাঞ্চ করে বলে,

-” ঝটপট দে! সময় নেই আমার!”
রাসেল মুখ কুঁচকে বলে,
-” শালা তোর জন্য আমি কেস খেয়ে যাবো!’
-” বন্ধুর জন্য বন্ধু জান দেয় তুই না হয় কেস খাবি । এটা কোন বড় ব্যাপার না!”
রাসেল পিস্তল টা বের করে অরুণের দিকে বাড়িয়ে দিল। অরুণ রুমালে মুড়ে হাতেই রাখলো! অপর হাতে থাকা চিপস ও আইসক্রিমের পলিটা রাসেলের দিকে বাড়িয়ে বলল,
-” বাচ্চাদের জন্য! শালা ভিতরেও যেতে বললি না। কতটা ম্যানারলেস তুই রাসু!”
রাসেল পলিটা নিয়ে কটমট করে বলল,
-” হ্যা আমি বললে তুই ভেতরে এসে ব্রেকফাস্ট করতি। আমার একবেলার রেসন ফুরিয়ে যেতো! যা চেয়েছিলি পেয়েছিস! এখন যা ফুট! তবে মনে রাখিস সন্ধার আগে যেন এটা আমার হাতে থাকে!”
অরুণ রাসের গালে আলতো থাপ্পড় মেরে বললো,

-” ওকে রাসু ডার্লিং!”
-” অরু সত্যি করে বল কি করবি এটা দিয়ে?”
উদ্বিগ্ন স্বরে জিজ্ঞাসা করে রাসেল। অরুণ হাঁটা দেয়,
-” একটা গন্ডারকে খুলি বরাবর গুলি করবো!”
বলে থামে না। রাসেল তার যাওয়ার পথে চেয়ে থাকে কিছু পল!
অরুণ পার্কিং এ দাঁড়িয়ে থাকা গাড়ির ভিতরে বসে। ড্রাইভার বিনা বাক্যব্যয়ে গাড়ি স্টার্ট করে। অরুণ রুমালে মুড়ানো পিস্তলটা বের করে। ফ্রন্টসিটে বসা ম্যানেজার সুজনের চোখ চড়কগাছ। সে ভিতু স্বরে বলে,
-” বস! এটা দিয়ে কি করবেন?”

অরুণ পাশ থেকে স্যুটকেস টেনে কোলের উপর নেয়। স্যুটকেস খুলে ভিতরে পিস্তলটা রেখে বলল,
-” মি. আলমকে টপকে দিবো!”
সুজনের চোখের আকার বড় হয়। সাথে মুখশ্রীর ভয়ের রেশ বেড়ে যায়। আমতা আমতা করে বলল,
-‘ স্যার মজা করছেন?’
অরুণ প্রতিত্তর করে না। ড্রাইভারকে উদ্দেশ্য করে বলে,
-” গাড়ি মি. আলমের ফ্ল্যাটে গিয়ে থামবে!”

ড্রাইভার ঘার কাত করে দুরু দুরু মনে গাড়ি চালায়। স্যার কি সত্যিই খুন করবে? প্রায় মিনিট বিশেক পরে একটা ফ্ল্যাটের সামনে দাঁড় করায় গাড়িটি। স্যুটকেস হাতে অরুণ ও সুজন নেমে আসে। দারোয়ান কে পরিচয় জানালে সালাম জানিয়ে ফ্ল্যাট নাম্বার বলে ভিতরে যাওয়ার তাগিদ দেয়। অরুণ সানগ্লাস চোখে স্যুটকেস হাতে লিফটে প্রবেশ করে। কাঙ্ক্ষিত ফ্লোরে লিফটের দরজা খুলে যায়। অরুণ, সুজন মি. আলমের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে। সুজন ক্রলিং বেল বাজায়। মিনিটের মাঝেই মধ্যবয়সী মহিলা দরজা খুলে দেয়। সুজন মেয়েটির আপাদমস্তক দেখে। দেখে কাজের মেয়েই মনে হচ্ছে তবে কাপড় পড়ার ভঙ্গিমা জঘন্য! অশ্লীলতায় ভরপুর। এরকম কাজের মেয়ে বাড়িতে ঘুরঘুর করে মি. আলমের স্ত্রী কিছু বলে না? মেয়েটি তাদের উদ্দেশ্যে হেসে বলল,

-” স্যারের সাথে দেখা করতে এসেছেন বুঝি?”
অরুণ গম্ভীর মুখে দাঁড়িয়ে। কাজের মেয়েটির নজর অরুণের দিকে স্থির। ঠোঁট কামড়ে অরুণের আপাদমস্তক দেখে মুচকি মুচকি হাসে। অরুণের চোয়াল শক্ত হয়। হাত মুঠোয় ভরে। সুজন স্যারের শক্ত চোয়াল দেখে ঢোক গিলে।
-” মি. আলমের সাথে দেখা করতে এসেছি আমরা। ওনাকে ডেকে দিবেন প্লিজ!”
-” ওহ্। তা বাইরে বসে আছেন কেন? ভেতরে আসুন বসুন? আমি অতিথি আপ্যায়নে একটুও কনজুসি করি না! ভালোভাবে তৃপ্তি সহকারে আপ্যায়ন করি! আমার নাম তানিয়া! তানি বলে ডাকতে পারেন”

হেসে দরজা ছেড়ে দাঁড়িয়ে বলল। সুজন প্রবেশ করে ভিতরে, তার পিছনে অরুণ। মহিলাটি এখনো অরুণের দিকে তাকিয়ে। সাথে বিশ্রী নজর ও হাসি তো আছেই। অরুণ পারে না ফ্লাওয়ার ভাসটা মহিলার মাথায় ফাটিয়ে গায়ে কেরোসিন ঢেলে আগুন ধরিয়ে দিতে! ড্রয়িং রুমের সোফায় বসে সুজন মহিলাটির উদ্দেশ্যে বলে,
-” মি. আলমকে ডেকে দিবেন প্লিজ! আর ওনার স্ত্রী বাচ্চাদের দেখছি না?”
-” ওনারা তো কক্সবাজার বেড়াতে গেছে দুদিন হলো! বাড়িতে শুধু উনিই আছে। আর আমি তার সেবায় মানে রান্না বান্না ঘরদোর পরিষ্কার হাবিজাবি!”

বলে ভিতরে চলে যায়। অরুণ টি টেবিলের সামনে থাকা খালি জগটা লাত্থি দিয়ে ফেলে দেয়। সুজন চোখ বড় বড় করে চায়। এই রে ক্ষ্যাপা ষাঁড় ক্ষেপেছেন। সে ঢোক গিলে বলে,
-” কুল বস কুল!”
অরুণ তার দিকে চায়। সুজনের মুখ খানি চুপসে যায়। বস এখন তাকে না আছাড় মেরে ফেলে দেয়। এরইমধ্যে মি. আলম আসে হন্তদন্ত পায়ে।
-” অরুণ সরকার যে? এতো সকালে!!”
অরুণ নিজেকে শান্ত করে জবাব দিল,
-” দেখা সাক্ষাৎ করতে এলাম। কাল ফোনে ভালোভাবে কথাই হলো না।”
মি. আলম দাঁত বের করে হাসে। ফ্লোরে ভাঙ্গা জগের টুকরোগুলো দেখে বলে,

-” কিভাবে ভাঙলো?”
অরুণ সোফায় গা এলিয়ে জবাব দেয়,
-” পা ফসকে ভেঙ্গে গেল!”
মি. আলম চিন্তায় পড়ে পা ফসকে কিভাবে ভাঙ্গে! তবে মাথা ঘামায় না। তানিয়াকে ডেকে কাঁচের টুকরো পরিষ্কার করে চা দিতে বলে। এরপর অরুণের বিপরীতে সিঙ্গেল সোফায় বসে বলল,
-” তা কি সিদ্ধান্ত নিলে অরুণ?”
-” কি সিদ্ধান্ত নিবো! আপনি কি আর পথ বাকি রেখেছেন! আপনার কথাই সই! তাই তো জলদি এলাম আপনার ফরমাইশ নিয়ে!”

বলেই স্যুটকেস টি টেবিলের উপর রাখে। মি. আলমের চোখ চক চক করে ওঠে লোভে। হাত বাড়িয়ে স্যুটকেস নেবে, অরুণ স্যুটকেসের উপর পা তুলে দিয়ে আয়েশ করে বসে।
-” এতো জলদি কিসের? সবুর করুণ সবুরে মেওয়া ফলে! বাকি কথা ফাইনাল করে নিই?”
অরুণের আচরণ ভালো না লাগলেও মি. আলম মাথা নাড়ল। মালকড়ি পাচ্ছে এটাই অনেক, সম্মান ধুয়ে পানি খাবে নাকি সে!
অরুণ সানগ্লাসটা খুলে হাসিমুখে বলে,
-” আপনার পঞ্চাশ আপনি পাবেন। তবে কেস তুলে নিবেন! একটা ভালো স্টেটমেন্ট দিবেন! তার পরেই!”
-” গ্যারান্টি?”
অরুণ হাসে।

-” এডভান্স!”
মি. আলমের চিন্তিত মুখশ্রীতে হাসি ফুটে উঠলো। এরমধ্যে তানিয়া এসে ফ্লোরে বসে ঝুঁকে কাঁচের টুকরো তুলছে ধীরে ধীরে। আড়চোখে অরুণের দিকে লাজহীন অশ্লীল নজরে তাকিয়ে থাকে। অরুণ সেদিকে তাকানো তো দূর তোয়াক্কাই করে না। সুজন একবার চেয়েছিল আড়চোখে। বড় গলায় ব্লাউজ। বুকে আঁচল আছে তবে সেটা না থাকার মতোই! ঝুঁকে থাকার দরুণ বুকের বেশিরভাগই দৃশ্যমান। সে তৎক্ষণাৎ নজর ফিরিয়ে তওবা কাটে। ছিঃ ছিঃ কি বেহায়া নির্লজ্জ মহিলা! মি. আলম ধীমে সুরে অরুণের দিকে তাকিয়ে বলে,
-” আর ওই ব্যাপারটা! তোমার কচি বউ..”

অরুণ উঠে দাঁড়ালো। মি. আলমের সামনে গিয়ে সর্বশক্তি দিয়ে ঠাস ঠাস করে গালে দুটো থাপ্পর লাগায়। বুকের উপর এক পা তুলে চুলের গোড়া টেনে ধরে শক্ত করে। মি. আলম যেন ঘোরের মাঝে চলে যায়। কানটা এখনো ঝিঁ ঝিঁ করছে। গালটা জ্বলছে তীব্র ব্যাথায়। এরকম থাপ্পড় মায়ের জনমে খায়নি সে।
-” জা*নোয়ারের বাচ্চা! তোর *** সহ পুরো তোকে পিস পিস করে কেটে শকুনকে খাওয়াবো! তোর কলিজায় কত সাহস আজ দেখবো! শালা *****! *****”

সুজন মনে মনে কান বন্ধ করে। তার বস এতো সুন্দর করে গালি দিতে পারে সে জানতোই না! কাজের মহিলাটি ভয়ে দৌড় লাগায়! অরুণ মি. আলমের বুকে লাথি মেরে সিঙ্গেল সোফা সহ ফেলে দেয়। সুজনকে ইশারা করে মহিলাটির ব্যবস্থা করতে। সুজন নাক সিঁটকায়! ওই খারাপ মহিলাকে সে ধরতে পারবে না। তবে বসের আদেশ অমান্য করার সুযোগ নেই। অগত্যা মহিলাটির পিছনে যায়। দেয়াল ঘেঁষে পড়ে থাকা ব্যাটটা তুলে নেয় হাতে।
মি. আলম পড়ে গিয়ে ব্যাথা পায় বেশ! মোটাসোটা স্বাস্থ্য তার। উল্টে পড়ায় নাক ফেটে রক্ত বেরোচ্ছে। তবুও উঠে দাঁড়ালো।

-” ভূল করলি অরুণ সরকার! এই আশরাফুল আলমকে চিনিস না। তোর থেকে আমার হাত অনেক বড়!”
অরুণ এগিয়ে আসে, বাড়ন্ত ভুরিতে লাথি মেরে ফেলে দেয়। গলায় পারা দিয়ে বলে,
-” তোর মতো **** দের কে না চেনে। বরং তুই চিনিস না এই অরুণ সরকারকে! চিনলে বোন জামাই শুকলা শু*য়োরের কথায় এই অরুণ সরকারের সঙ্গে লাগতে আসতি না! এই তুই নিজে একটা জা*নোয়ার ***! আরেকটা জানোয়ারের সাথে বোন বিয়ে দিয়েছিস! ভালো সম্পর্ক গড়ে তুলেছিস! **** দল!!”
মি. আলম কাঁশতে থাকে। অরুণ পা সরায় না। আরেকটু শক্তি খাটিয়ে পিষ্ট করে রাগে ক্ষোভে বলে,

-” তোর মতো চুনোপুঁটির সাহস দেখে আমি হতবাক! শালা আমার সাথে বাটপারি করে ব্লাকমেইল করিস! টাকা চাস! আবার হুমকি দিস! তাও আবার এরকম লেইম ঘটনাকে কেন্দ্র করে! মাথা ঘিলু টিলু নেই? আমার অর্ধাঙ্গীর নামে বাজে কথা বলিস! এই সবাইকে নিজের মতো ভাবিস যে বউকে অন্যের ঘরে পাঠাবে! শালা তোকে তো আজ…”
আজ বলে পেটে আরেকটা লাথি লাগায়। মি. আলম ছাড়া পেয়ে লম্বা শ্বাস টানলেও পেটে লাথি পড়ায় গুঙ্গিয়ে চিৎকার করে উঠল।এরমধ্যে সুজন চলে আসে। অরুণ কে উদ্দেশ্য করে মিনমিনে গলায় বলে,

-” বস কেউ জানতে পারলে কেস খেয়ে যাবো! জলদি একটা ব্যবস্থা করতে হবে!”
-” ওই স্ল্যা*টের কি করলে?”
সুজন দাঁত বের করে হাসে।
-” মাথায় একটা বারি দিয়ে পা’য়ে মেরেছি! এতেই বেহুঁশ! তবে চিন্তা করবেন না। মরবে না!”
অরুণ আলমের দিকে চায়। আলমের চিৎকার থেমে গেছে। ভয়ার্ত চোখে অরুণের দিকে চায়। অনেক কষ্টে উঠে অরুণের পা ধরে বসে পড়ে,
-” আমি কেস তুলে নেব! আর কখনো তোর ধারের কাছেও ঘেঁষবো না। মারিস না আমায়! আমায় মারলে কিন্তু তুই ও কেস খেয়ে যাবি!”

অরুণ লাথি মেরে সরিয়ে দিলো আলমকে! সোফায় বসে স্যুটকেস খুললো! স্যুটকেসের ভিতরের অস্ত্রপাতি দেখে সুজনের চোখ চড়কগাছ! গোটা তিনেক ছুড়ি, হেক্সা ব্লেড, এন্টি কাটার, স্ক্রু গজ, হ্যামার, কাঁচি, প্লাস, রেঞ্জ সহ আরো কিছু দেশি সরঞ্জাম পিস্তল তো আছেই। ওদিকে আলমের জান যায় যায় অবস্থা। সে দৌড়ে যায় দরজার দিকে। সুজনও দৌড় লাগালো। আলমের পায়ে লাথি মেরে ফেলে দেয়। আলম সিটকে পড়ে ফ্লোরে। মুখ নাক মনে হয় শেষ! চিৎকার দেয় গলা ফাটিয়ে। সাউন্ড প্রুফ রুম হওয়ার দরুণ অসুবিধা হবে না। সুজন তাকে উঠিয়ে টেনে আনে! অরুণ কিছু রশি ও কাপড় দেয়, বাঁধতে বলে জানোয়ারকে! সুজন কাঁপা কাঁপা হাতে হাত, পা বাঁধে! মুখে কাপড় গুজে বেঁধে দেয়। অরুণ ছুড়ি সমেত উঠে যায় কিচেনে। চুলা জ্বালিয়ে তা’য়ে ছুড়ি ঠেকায়। ছুড়ির প্লাসিটের অংশে কাপড় পেঁচিয়ে ধরে। বেশ সময় নিয়ে ধরে রাখে।

সুজন দু বার এসে উঁকি ঝুঁকি দেয়। বস কিচেনে কি করছে? তার উত্তর সে পেয়ে যায়।
অরুণ আগুনের তায়ে লাল আভার রূপ পরিণত হওয়া ছুরি দুইটা নিয়ে আলমের সামনে বসে।‌ আলম মুখে কাপড় বাঁধা অবস্থায় ছটফট করতে থাকে। চোখের ইশারায় কতশত অনুরোধ অনুনয় বিনয় করে! অরুণ অগ্রাহ্য করে। সুজনকে আদেশ করলে সুজন আলমকে উল্টে শুইয়ে দেয়। ট্রাওজার ও আন্ডারওয়্যার নিচে নামিয়ে নিলে অরুণ আলমের নিতম্বের উপর গরম ছুরিদ্বয় চেপে ধরে। আলম ছটফট করে গলা কাটা মুরগীর মতো! মুখে কাপড় গুঁজে বেঁধে দেওয়ার দরূণ চিল্লাতে পারে না তবে উ উ শব্দে কাঁদতে থাকে। বাঁধা হাত দিয়েই অরুণের পা চেপে ধরে অনুনয় চোখে ক্ষমা চায়! প্রাণের ভিক্ষা চায়! অরুণ নির্বিকার! অসহ্য রকম যন্ত্রণা, ব্যাথায় আলম জ্ঞান হারায়!
অরুণ ছেড়ে দেয়। খানিক সময় পর কারেন্টের শখ দেয় অল্প ভোল্টেজের ।আলম ধরফরিয়ে ওঠে! কাঁদতে কাঁদতে ফ্লোর ঘেঁষে এসে দন্ডায়মান অরুণের পা ধরে উ উ করে। অরুণ ঝটকা মেরে সরিয়ে দেয়। সুজনকে উদ্দেশ্য করে বলে,

-” শালার কাপড় খোল! ছোটটা বাদে সব! দেখি শালার কত তেজ!
বলে স্মরণ করে গতকালের ফোন আলাপকালে আলমের বলা লাস্ট কথা ‘অরুণ বুড়ো হয়ে গেছো! কচি বউ হ্যান্ডেল করতে পারবে না আমার কাছে পাঠিয়ে দিও!’
শালা ওয়েট কর হ্যান্ডেল করাচ্ছি তোকে!
সুজন চোখ বড় বড় করে অরুণের দিকে চায়। যার অর্থ এখন কি করবেন বস? অরুণ চোখ রাঙায়! সুজন ঢোক গিলে কাপড় খোলার চেষ্টা করে। হাত পা বাঁধা থাকায় বিরক্ত হয়ে বলে,
-” বস হাত পা বাঁধা খুলবো কি করে?”
অরুণ একটা কাঁচি দেয়! সুজন হেসে কাঁচি দিয়ে কাপড়চোপড় কেটে ফেলে খুলে নেয়। লোকটার পরণে শুধু ছোট আন্ডারওয়্যার! অরুণ বাঁকা হেসে সুজনকে বলে,

-” তোমার ফোনের ক্যামেরা ভালো না? ভিডিও অন করো! ফাস্ট!”
সুজনের চোখ রসগোল্লা হয়ে যায়। ভিডিও করবে মানে? বস কি করবে এই পেটমোটা আলমের সাথে? তবে সে ফোন বের করে ভিডিও অন করে ক্যামেরা তাক করে আলমের দিকে।
অরুণ শার্টের হাত ফোল্ড করে স্যুটকেস থেকে হ্যামার ও প্লাসটা তুলে নেয় হাতে‌। আলমের দিকে এগোতে এগোতে বলে,
-” আগে তোর সার্জারি করে নিই তারপর তোর বোন জামাই শুকলাকে করবো! ডার্লিং নড়াচড়া বা ছটফট করলে কেল্লাফতে পাঠিয়ে দিবো! তাই সাবধান!”
আলমের চোখ বড় বড় হয়ে যায়। মাথা নেড়ে না না ইশারা করে! ছটফট করতে থাকে।

তপ্ত বিকেল বেলা। সূর্যিমামার দেখা নেই। মেঘের আড়ালে লুকোচুরি খেলছে। আবছা কালো মেঘমল্লারের দল ঘুরে বেড়াচ্ছে দীগন্তের বুক জুড়ে। পাখির দল উড়ে বেড়াচ্ছে। শুনশান পরিবেশে ঝগড়া করছে দুই সখি! পাতাবাহার ও পাতাবাহার! আনিকা ও ভোর নীরব দর্শক। পাতা ঝুঁকে বিড়ালটার কান মলে দিলো। বিড়ালটি মিও মিও‌ বলে তেড়ে আসে। পাতা হাতে স্কেল তুলে নিয়ে বলল,
-” আর এক পা এগো তোকে সহ তোর মালিকের ঠ্যাং ভেঙে বসিয়ে রাখবো!”
বিড়ালটি কি বুঝলো কে জানে। তবে আগালো না‌। ভোরের পায়ের কাছে গিয়ে মিও মিও করে ডেকে অভিযোগ শোনালো যেন! ভোর তাকে কোলে নিয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দিলে। বিড়ালটি চুপটি মেরে যায়।
-” আম্মু হয়েছে ওকে আর বকো না! ও আর খামচি দেবে না!”

-” আবার দিলে ওর সবকটি নখ আমি কেটে দিবো। হতচ্ছাড়া বিড়াল!সবসময় আমার পিছনে লাগা!”
পাতার কথায় বিড়ালটি ভোরের পেটে মুখ লুকায়। পাতা গাল ফুলিয়ে বসে পড়লো সোফায়। একটু আগে সে অরুণ সরকারের আলমারিতে তাক ঝাঁক করছিলো। এটা ওটা বুলিয়ে দেখছিলো! তারপর গ্রিন কালারের একটা টি শার্ট নিয়ে শাড়ির উপড়েই পড়ে আয়নার সামনে দাঁড়ায়! দেখছিলো লোকটার টি শার্টে তাকে কেমন লাগে। হঠাৎ কোত্থেকে বিড়ালটি এসে হামলা করে। পায়ে নখ বসিয়ে দেয় পাতার। পাতা ঘাবড়ে যায় সাথে আচর লেগে কেটেও যায়। রক্ত পড়ছিলো! পাতা চটজলদি স্যাভলন ভিজিয়ে তুলো দেয়। রক্ত পড়া বন্ধ হলে টি শার্ট খুলে রেখে বিড়ালটিকে খুঁজে বের করে। শালার বিড়াল! তার জামাইয়ের টি শার্ট সে পড়েছে তাতে ওই বদ বিড়ালের এতো জ্বলেছিল কেন?

ভোর বিড়ালটিকে খাঁচায় পুরে বন্দী করে রাখে। আনিকা পাতার পাশে বসে দুঃখি গলায় বলল,
-” চাচিমনি বেশি লেগেছে? ব্যাথা করছে?”
পাতা মুচকি হেসে আনিকাকে কোলে বসিয়ে গালে চুমু খায়।
-” না কিউটি! একটুও লেগেছে ব্যথা করছে না!”
ভোর এসে পাতার পায়ের কাছে বসে। আঁচড় লাগা জায়গা লাল হয়ে ফুলে আছে। একটু একটু রক্ত লেগে আছে সেখানে। ভোর সেথায় হাত বুলিয়ে বলে,
-” আব্বু আসলে বলবো ওই পঁচা পাতাবাহারকে রেখে আসতে।”
পাতা আনিকাকে পাশে বসিয়ে পা তুলে বসে সোফায়। ভোরকেও টেনে পাশে বসায়। ভোরের মলিন গাল টিপে বলে,
-” থাক রেখে আসতে হবে না! ওতটাও লাগে নি!”
ভোর পাতার কোলে মাথা রেখে শুয়ে পড়ে। এরইমধ্যে আদুরি আসে। পাতাকে দেখে মুচকি হেসে বলে,
-” বড় ভাবী তোমার আব্বু এসেছে। সাথে তোমার দুলাভাই !”
পাতা অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে,
-” সত্যিই?”
-” হুম! বিশ্বাস হচ্ছে না?”

ভোর পাতার কোল থেকে মাথা তোলে। পাতা খুশি হয়ে উঠে দাঁড়ালো।তারপর ব্যস্ত পায়ে বেরিয়ে গেল ঘর থেকে! ড্রয়িং রুমে গিয়ে দেখলো সত্যিই এসেছে। আব্বু, দুলাভাই ও লাবিব! সে গিয়ে হাসিমুখে বলল,
-” আব্বু ভালো আছো? দুলাভাই, বোনের ছেলে তোমরা ভালো আছো? এতদিন পর আমাকে মনে পড়লো?”
হাসিমুখে বললেও চোখ জোড়া চিক চিক করছে আনন্দে। কতদিন পড়ে সকলের সাথে দেখা! রিসেপশনের পর দুই তিনবার ফোনে কথা হয়েছে শুধু! তাও শুধু আম্মু ও লুব ভাইয়ের সাথে।
লাবিব দৌড়ে গিয়ে পাতাকে জড়িয়ে ধরে। রাতুল ভুঁইয়া মুচকি হেসে বলল,
-” আলহামদুলিল্লাহ! তুমি কেমন আছো পাতা?

পাতা মাথা দোলায়। আতিকুর ইসলাম পাতাকে দেখে। মেয়েটা হাসছে অথচ চোখে পানি। লাবিবকে কোলে তুলে আদর করছে। আড়চোখে তার দিকেও চাইছে। সে গলা খাঁকারি দিয়ে বলল,
-” তুমি কেমন আছো? জামাইকে দেখছি না! অফিসে? আর ওই পিচ্চি?”
পাতা লাবিবকে নামিয়ে দিয়ে আতিকুর ইসলামের পাশে দাঁড়ায়।
-” আব্বু আমি ভালো আছি! উনি অফিসে। আর ভোর ওই তো?”
আদুরি ভোরকে কোলে নিয়ে দাঁড়িয়ে। ভোর তার কোলে উঠে পিটপিট করে চেয়ে আছে সবার দিকে। ওরা কি আম্মুকে নিয়ে যাবে? আদু ফুপ্পি তো তাই বলল! না, সে তার আম্মুকে নিয়ে যেতে দেবে না।
আতিকুর ইসলাম ভোরকে ডাকে। ভোর কোল থেকে নেমে গুটি গুটি পায়ে পাতার পাশে দাঁড়িয়ে সালাম দেয়। আতিকুর ইসলাম সোফা থেকে উঠে ভোরের মাথায় হাত বুলিয়ে বলে,

-” কেমন আছো ভোর?”
-” ভালো আছি আঙ্কেল! আপনি কেমন আছেন?”
-” ভালো!”
এরমধ্যে আসমা বেগম আসেন ড্রয়িং রুমে। কোলে ছোট রূপ! আতিকুর ইসলাম সহ রাতুলের সাথে কুশল বিনিময় করেন। মিনুকে মেহমানদের আপ্যায়নের ব্যবস্থা করতে বলে মেহমানদের সাথে আলাপ চারিতায় বসে। কথার ফাঁকে রাতুল বলে পাতাকে নিতে এসেছে তারা। বিয়ের পর মেয়ে বাবার বাড়ি নাইওর যাবে না? আসমা বেগম হাসিমুখে সায় জানালো ! অস্বীকার করে না!

পাতা নিজের রুমে বসে লাগেজ গোছাচ্ছে। বিয়ের পর প্রথম বার যাবে বাবার বাড়িতে! প্রচন্ড উত্তেজনায় খুশিতে মনটা নেচে উঠছে যেন। যতই অবহেলিত হোক, তার বাপের বাড়ি ওটা! টান আছে না?
ভোর ও লাবিব বিছানায় বসে আছে। লাবিব টুকটাক কথা বলছে কিন্তু ভোর চুপচাপ গম্ভীর মুখে। আম্মু তাকে রেখে যাবে? ওই বাড়িতে গিয়ে তাকে ভুলে যাবে? ওই লাবিবকে আদর করবে? লাবিবের বোনকেও?
পাতা ব্যাগপত্র গুছিয়ে অরুণকে ফোন লাগায়। সব প্যাকিং শেষ। তার ও ভোরের জামা কাপড় সহ প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র! ভোরের বাবারও গোটাকয়েক টি শার্ট প্যান্ট নিয়েছে। এখন শুধু লোকটার থেকে পারমিশন নেওয়া বাকি! আচ্ছা লোকটাকি মানা করে দেবে! পাতা দুরু দুরু বুকে কল লাগায়। লোকটা কল কেটে কিছুক্ষণ পর কল করে। পাতা রিসিভ করে হ্যালো হ্যালো বলে। ওপাশ থেকে কিছু শোনা যাচ্ছে না।

-” হ্যাঁ বলো পাতাবাহার!”
সেকেন্ড বিশ‌ পরে অরুণের কণ্ঠস্বর শুনতে পেয়ে পাতার মুখশ্রীতে হাসি ছড়িয়ে পড়ে।
-” কোথায় আপনি?”
-” অফিসে! কেন?”
-” না! ওই আসলে আব্বু, দুলাভাই এসেছে!”
-” কখন?
-” হুম! এই ঘন্টা খানেক হবে এসেছে! আমাকে নিতে এসেছে বলল!”
-” ভালো!শুনো তাদের আপ্যায়নে যেন কোন কমতি না হয়!””
পাতা খানিক ইতস্তত ভঙ্গিতে বলল,
-” আপনি আসুন না প্লিজ? আব্বু দুলাভাই আপনার কথা জিজ্ঞেস করলো অনেকবার!”
ওপাশে নীরবতা। পাতা হ্যালো বলতেই আবার ভেসে আসে গম্ভীর কন্ঠস্বর,
-” আমি আসতে পারবো না। ব্যস্ত আছি!আশা করি বুঝতে পারবে!”
পাতা বুঝলো। লোকটা অফিসের ঝামেলা নিয়ে এখনো ব্যস্ত।

-” হুম! তাহলে আমরা কি করবো? যাবো ওখানে?”
-” পারমিশন চাইছো?”
-” আপনি বললে যাবো! নইলে যাবো না! এখন আপনি ডিসাইড করুণ!”
অরুণ হাসে। এরকম কিউট ভঙ্গিমায় বললে মানা কিভাবে করবে?
-” আচ্ছা যাও! কলিজাটার খেয়াল রেখো সাথে নিজেরও!”
পাতার খুশি ডাবল হয়।

-” হুম! আপনি কিন্তু অফিস থেকে রাতে ওখানে যাবেন! আমি অপেক্ষা করবো!”
বলেই উত্তরের অপেক্ষা না করে কল কেটে দিলো! তারপর ভোরের দিকে তাকিয়ে বলল,
-” ভোর আমরা নানু বাড়ি যাচ্ছি! অনেক মজা হবে!”
কিন্তু ভোরের মুখে হাসি নেই। সে গোমড়া মুখে গাল ফুলিয়ে বলল,
-” তো যাও! আমায় বলছো কেন? আমাকে তো আর নিবে না তোমার নানুর বাড়িতে!”
পাতা ভোরকে টেনে কোলে তুলে নেয়। গালে ঠোঁট চেপে চুমু দিয়ে বলে,
-” আমার পাগল আব্বাজান! আমরা আপনার নানুর বাড়িতে যাচ্ছি! আর আপনাকে নেবো না তাই হয় নাকি! আমি আর তুমি যাচ্ছি!”

পাতা বাহার পর্ব ৩৪(২)

ভোরের গোমড়া মুখশ্রীর আবডাল জুড়ে হাসির পুষ্প ফুটে উঠল। পাতার গলা জড়িয়ে গালে মুখে আদর করে মিষ্টি মিশিয়ে ডাকে,
-” আই‌ লাভ ইউ আম্মু!”

পাতা বাহার পর্ব ৩৬