মেহেরজান পর্ব ২৭
লেখনীতে- সোহা
ভোর সাড়ে চারটার দিকে বৃষ্টির ঘুম ভাঙলো বৃষ্টির। ঘুমুঘুমু চোখে দরজার দিকে তাকালো তার মা জেগেছে কিনা দেখতে।তবে অন্ধকার দেখতে পেয়ে আবারও ঘুমানোর চেষ্টা করলেও ঘুমাতে পারলো না।কিয়ৎক্ষণ এপাশ ওপাশ করলো।পাশে থাকা ছোট বোনটার দিকে একবার তাকিয়ে উঠে দাঁড়ালো। ভাবলো শীতের সকালে একবার ক্ষেতের আইল বেয়ে একবার হেঁটে আসবে এই এতো ভোরে।যেই ভাবা সেই কাজ। বেরিয়ে আসলো ঘর থেকে।ভোরের আলো ফুঁটতে শুরু করেনি।
এখনও অন্ধকার বললে খুব একটা ভুল হবে না।উঠোনের বাম পাশে বাশের সাথে থাকা লাইটটা এখনও জ্বলে আছে।দূর আকাশে হালকা আলকা ভোরের আলো দেখা যাচ্ছে সবে।হাত উপরে তুলে আড়মোড়া ভেঙ্গে হাই তুললো বৃষ্টি। টিউবওয়েলের সামনে গিয়ে হাতলে চাপ দিয়ে বালতিটা ধুয়ে নিয়ে সেখানে এক বালতি পানি জমা করলো।এরপর সেই বালতি থেকে পানি নিয়ে মুখটা ধুয়ে নিলো। ওড়না দিয়ে মুখটা ভালোভাবে মুছে নিতেই চোখ গেলো সামনের গোয়ালঘরে। কিছু একটা নড়াচড়া করছে। ভয় পেলো বৃষ্টি।
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
ভয়কে জয় করার জন্য ঘরের ভেতর থেকে বাবার টর্চটা নিয়ে এলো।হাঁটা ধরলো গোয়ালঘরের দিকে।টর্চটা দিয়ে এদিক ওদিক ঘোরাতে ঘোরাতে চোখ গেলো গরুর জন্য রাখা ঘাসের ওপাশে।ঘাসের স্তুপের ওপরপাশে এক জোড়া চোখ দেখে ভয়ে চেঁচাতে চাইলেই চেঁচালোনা বৃষ্টি।আরেকটু এগিয়ে গিয়ে দেখলো একটি মেয়ে কেমন ভয়ে জড়োসড়ো হয়ে কিছু ঘাস হাতে ধরে তারই দিকে তাকিয়ে আছে।মেয়েটার হালকা কাদামাখা চেহারা দেখতেই মুখ থেকে আপনা-আপনিই ‘মাশাআল্লাহ’ শব্দটা বেরিয়ে আসলো। এমন অবস্থাতেও যে কাউকে সুন্দর লাগে ধারণা নেই বৃষ্টির।কিছুক্ষণ একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকার পর হঠাৎ ভয় পেয়ে গেলো।ভাবলো কোনো জ্বিন বা পরী নাকি।আবার চেঁচাতে চাইলেই মেয়েটিই থামিয়ে দিয়ে অনুনয় করে বললো,
“আমায় নিয়ে যাবেন না প্লিজ।আমি বাঁচতে চাই।আমি আমার বাবা মায়ের কাছে, মেহরান ভাইয়ের কাছে আমার পরিবারের কাছে ফিরতে চাই।ওরা ওরা আমায় মেরে ফেলবে।”
শেষের কথাটা বলে আঙুল দিয়ে বাইরে দেখিয়ে দিলো মেয়েটি। বৃষ্টি মেয়েটির আঙুল অনুসরণ করে বাইরে তাকালে কিছু দেখতে পেলো না।তবে মেয়েটির এমন ভয়াবহ অবস্থা আর এমন কাতর গলা শুনে নিজেও কিছুটা বিচলিত হলো।আরেকটু কাছে এগিয়ে গিয়ে জিজ্ঞাসা করলো,
“কে আপনি? আর এসব কি বলছেন?”
বৃষ্টি গ্রামের মেয়ে হলেও শুদ্ধ বাংলা বলা তার বাবা তাকে শিখিয়েছে।এছাড়া বৃষ্টি কলেজের ইন্টার পাস করেছে কয়েক বছর আগে।বিয়েও হয়েছে তবে স্বামী অত্যাচার করায় তালাক দিয়ে বাপের বাড়ি চকে এসেছে।এতে তার বাবা মা তাকে কোনোদিন কোনো কথা বলেনি।উলটো শ্বশুরবাড়ির লোকদের বিরুদ্ধে কেইস করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলো বৃষ্টিই আটকেছে তাদের। বাবা একজন কৃষক। অর্থ ধন সম্পদের কমতি থাকলেও বাড়িতে শান্তির কমতি নেই।
বৃষ্টি খেয়াল করলো মেয়েটির শরীর পুরো কাদায় মাখা।কাদাগুলো শুকনো নয়।বৃষ্টি বুঝতে পারলো মেয়েটা হয়তো সবেই এখানে এসেছে।চোরও তো মনে হচ্ছে।পোশাক আশাক কাদায় মাখামাখি হলেও ধরণ আর কারুকাজ দেখে বোঝা যাচ্ছে আভিজাত্যের ছোয়া।বৃষ্টি বিপাকে পড়লো।কে এই মেয়ে। আর এসব কি আবোল তাবোল বলছে? পরক্ষণেই মাথায় আসলো মেয়েটি হারিয়ে যায় নি তো? তাদের এই বাড়িটা বসতি জায়গা থেকে কিছুটা দূরে।ক্ষেতের মাঝখানে কয়েক একর জায়গা কিনে মতিন মোড়ল এই বাড়িটা করেছেন।পরিসরে ছোট্ট একটি বাড়ি তাদের।কিন্তু মেয়েটা ঠিক কোথা থেকে এসেছে এখানে?
এটা তাৎক্ষণিক বুঝলো না বৃষ্টি।আরেকটু কাছে এগিয়ে গিয়ে দেখলো মেয়েটার মুখে বিভিন্ন জায়গায় রক্তের ছোপ ছোপ দাগ।গায়ে ওড়না নেই।নিষিদ্ধ জায়গাগুলো বোঝা যাচ্ছে কাদায় মাখোমাখো হওয়ায়। বুকের বিভাজনও বোঝা যাচ্ছে দেখে চোখ সড়িয়ে নিলো বৃষ্টি।দৌঁড়ে নিজের ঘরে গিয়ে একটা ওড়না নিয়ে আসলো মেয়েটির জন্য।তবে মেয়েটির এখন পরিষ্কার হওয়া জরুরি এভাবে শুধু ওড়না দিয়ে কি করবে?
মেয়েটার মুখ দেখে মায়া লাগছে বৃষ্টির৷ কাছে এগিয়ে গিয়ে মেয়েটাকে জিজ্ঞাসা করলো,
“আপনার নাম কি? আপনি কোথা থেকে এসেছেন? আর আপনার অবস্থা এমন কেনো? কি হয়েছে?”
মেয়েটা তৎক্ষনাৎ উত্তর দিতে পারলো না। হেঁচকি তুলছে।ভীষণ মায়া লাগছে বৃষ্টির। কাছে গিয়ে হাটু গেড়ে বসে কাঁধে হাত রাখলো,
“ভয় পাবেন না আমায়।আপনার কি হয়েছে বলুন আমি সাহায্য করার চেষ্টা করবো।আপনার নাম কি বলুন?”
ভোরের আলো ফুঁটতে শুরু করেছে।মেয়েটা কাঁপাকাঁপা গলায় ছোট্ট করে থেমে থেমে উত্তর দিলো,
“আ_আ_মার না_ম রা_উশি।”
বৃষ্টি নামটা একবার আওড়ালো ‘রাউশি’। তারপর আস্তে ধীরে টেনে তুললো রাউশিকে। রাউশি ভরসা করতে না পারলেও ভরসা করতে ইচ্ছে করছে।মেয়েটার সাহায্যে নিজেও উঠে দাঁড়ালো।সেই জঙ্গল থেকে ক্ষেতের আইল বেয়ে এতদূর পর্যন্ত হেঁটে এসেছে।জুতোজোড়াও তো সেই জঙ্গলেই হারিয়ে গেছে।পায়ের অবস্থা শরীরের অবস্থা একেবারেই নাজেহাল।মুখের অবস্থাও বিধ্বংসী লাগছে।আইলগুলো অনেক বেশি পিচ্ছিল থাকায় হাঁটতে প্রচুর অসুবিধা হয়েছে। তারওপর জীবনে প্রথমবার।
রাউশিকে বৃষ্টি টেনে বাইরে নিয়ে আসতেই মুখোমুখি হলো মায়ের সাথে।হাসনা বেগম মেয়ের সাথে এমন বিধ্বংসী অবস্থায় আরেক মেয়েকে দেখে চিন্তায় চেঁচিয়ে উঠলেন,
“ও মা রে!”
বৃষ্টি বিরক্ত হলো,
“আহ মা।কি হয়েছে টা কি? এভাবে চেঁচাচ্ছো কেন?”
মুখে শাড়ির আচল দিয়ে ঢেকে ভয়ে ভয়ে মেয়েকে জিজ্ঞাসা করলেন,
“এইদা কেডারে বৃষ্টি।এরে তুই কোত্থেইকা পাইছস হ্যা?এইডা কি জ্বিন নাকি?”
বৃষ্টি কন্ঠে বিরক্তি ঢেলে বলে,
“বাজে বকা বাদ দিয়ে আমায় সাহায্য করো রাউশিকে ঘরে ঢোকাতে।ওকে গোসল করাতে হবে।”
রাউশি ঢিমে চোখে চারপাশ খেয়াল করছে শুধু।চোখের জল শুকিয়ে গেছে।কান্নাও আসছে না।এদিকে এদের ভরসা করলে কি ঠিক হবে? তাও ভেবে পাচ্ছে না।কোথায় এসেছে সে? আদও কি বাড়ি ফিরতে পারবে কিনা তা মাথায় বিড়বিড় করছে শুধু।তবে মস্তিষ্ক জানান দিলো যেন তাকে ধরে রাখা মেয়েটাকে ভরসা করলে খুব একটা ভুল হবে না।অনেকখানি পথ অতিক্রম করে এখানে পৌঁছেছে রাউশি।শরীরটাও কেমন অবশ হয়ে আসছে।মাথাটা ঝিম মেরে আছে।হাতে পায়ে নিম্নটুকুও শক্তি নেই। ভয় আশঙ্কা সংকোচ নিয়ে সেখানেই জ্ঞান হারালো রাউশি।
আবিরদের খুঁজে পাওয়া গেলেও রাউশিকে খুঁজে পাওয়া যায় নি।আবিরকে তার বাবা ইচ্ছামতো মেরে পুলিশের হাতে তুলে দিয়েছেন।এমন ছেলে যে তার ঘরে এসেছে এই ভেবেই যেন অরুণ হাওলাদারের যতসব আহাজারি।নাজিয়া বেগমও ছেলের থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন।আবিরকে খাদেজা বেগম ভীষণ ভালোবাসতেন।নাতিদের মাঝে আবিরই সবচেয়ে প্রিয় ছিলো উনার।তবে নাতির এমন জঘণ্য কাজে নিজেও একটা চড় মেরেছেন আবিরকে।আবির মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে ছিলো শুধু।চোখেমুখে ছিলো না অনুশোচনার ছাপ।তবে সব সত্যি স্বীকার করেছে।যে রাউশিকে সে রাইশার মতো দেখতো।আর রাউশিকে রেপড করার জন্য প্ল্যান করেছিলো রাউশিরা এখানে আসার পর।তবে প্ল্যানটা যেন সফল হতে হতেও বিফলে গেলো।এ নিয়ে আফসোস করছিলো আবির।ওকে অরুণ হাওলাদার এলোপাতাড়ি মারা শুরু করলে পুলিশ আবিরকে নিয়ে চলে যায়।
এদিকে মাহমুদ খান তানজিম আর শিহাব ফিরেছেন খালি হাতে। রাউশি নেই তাদের সাথে।রূপা বেগম অজ্ঞান হয়েছেন তিন চারবার।আপাতত উনাকে বেডরেস্টে রাখা হয়েছে।মেহরান আর নুজাইশের খোঁজ নেই।এই দুজনও নিশ্চয় পাগলের মতো খুঁজছে রাউশিকে এই ধারণা পরিবারের মানুষদের।কারও চোখে সারারাত ঘুম নেই।সবাই দরজার দিকে চেয়ে আছে।শুধুমাত্র রাউশির অপেক্ষায়। উজানকে ত্যায্য পুত্র করতে চেয়েছেন মাহতাব খান তবে মাহবুব খান এমন করতে নিষেধ করেছেন।উজানও ক্ষমা চেয়েছে বাবার কাছে।এমনকি মাহমুদ খানের কাছে। কিন্তু ক্ষমা চাইলেই কি আর রাউশিকে ফিরে পাওয়া যাবে?
নুজাইশ আর মেহরান উদ্ভ্রান্তের মতো খুঁজে চলেছে রাউশিকে।পুলিশি সহায়তায় পুরো জঙ্গল খোঁজা হচ্ছে।তবে এতবড় জঙ্গল যার কিনা শেষ কোথায় জানা নেই সেখানে রাউশিকে কোথায় পাওয়া যাবে? মেহরানের শক্তপোক্ত মন নিমিষেই বিষিয়ে গেছে। কেমন পাগলের মতো এদিক ওদিক ছুটছে। এদিকে নুজাইশের অবস্থাও শোচনীয়। রাউশির কোনো ক্ষতি কখনও কামনা করে নি সে।তবে মেয়েটার সাথে কেন এমন হলো এ নিয়ে খোদার কাছে অনেক প্রশ্ন করে যাচ্ছে সে। রাউশিকে যদি পাওয়া যায় মেহরানের অগোচরেই নুজাইশ রাউশির সমস্ত সেইফটির ব্যবস্থা সে নিজেও করবে ভেবে ঠিক করে রেখেছে।
“মেহরান চল পাশের গ্রামে গিয়ে খুঁজে আসি।”
মেহরান একটা মাটির স্তুপের ওপর রাউশির ওড়নাটা নিয়ে বসে ছিলো।মুখের অবস্থা এক রাতের মাঝেই কেমন হয়ে গেছে। মেহরানের এখন ঠিক কেমন লাগছে সেটা নুজাইশ হাড়ে হাড়ে বুঝতে পারছে।
“নুজাইশ রাউশিকে আমরা পাবো তো?”
নুজাইশের বুক ধ্বক করে উঠলো।কাপা কাপা গলায় জবাব দিলো,
“কেন পাবো না? অবশ্যই পাবো।রাউশিকে আমাদের খুঁজে পেতেই হবে।রাউশি হারিয়ে যেতে পারে না।”
গলা ধরে এলো নুজাইশের।পেছনে ঘুরে মুখে হাত চেপে ধরলো।মেহরান উঠে দাঁড়ালো।নুজাইশকে পাশ কাটিয়ে কোথায় যেন রওনা দিলো।
মেহেরজান পর্ব ২৬
“মেহরান কোথায় যাস?”
মেহরান পেছনে না তাকিয়ে যেতে যেতেই কেমন রোবটের মতো উত্তর দিলো,
“আমার রাউশিকে খুঁজতে।”