পাতা বাহার পর্ব ৩৬

পাতা বাহার পর্ব ৩৬
বেলা শেখ 

পুরো সরকারি জুয়েলারি ফ্যাশন হাউস বন্ধ। মানে ছুটিতে আছে বসের অর্ডারে। সকালেই নোটিশ দেয়া হয়েছে।‌সাথে শনিবার তরি পূর্বের মাফিক পুরো দমে অফিসে আসার আহ্বান। ধরনী সন্ধ্যার কবলে। মাগরিবের আজান হয়েছে একটু আগেই। অরুণসহ সুজন, আরিয়ান, রাসেল ও জীবন অফিসের ছোট মসজিদে নামাজ পড়ে নেয়। নামাজ শেষ হলেই গ্রাউন্ড ফ্লোরে গেস্টদের জন্য বরাদ্দকৃত ওয়েটিং রুমে বসে।

জীবন বাদে সবাই উপস্থিত। অরুণ সোফায় গা এলিয়ে টি টেবিলে পা রেখে হামি তুলে। আরিয়ান সামনে দাঁড়িয়ে বকর বকর করে কানের পোকা বের করে দিলো বলে। আরিয়ানের সাথে রাসেলও কম যায় না। রাসেলের হাতে সুজনের ফোন। আলমের ভিডিও দেখছে আর তাকে বকছে।অরুণের সেসবে ভাবান্তর নেই। সে বকাগুলো এক কান দিয়ে শুনছে অপরকান দিয়ে বের করে দিচ্ছে। সুজন চুপচাপ দাঁড়িয়ে তাদের কর্মকাণ্ড দেখছে। এক পর্যায়ে জীবন চলে আসে। হাত তার ভর্তি। একটা ব্যাগ অরুণের কাছে দিলো। অরুণ সেগুলো সরিয়ে রাখে। আরিয়ানের ঘোর সন্দেহ হয়। ব্যাগে কি আছে? সে গিয়ে ব্যাগটা একপ্রকার ছিনিয়েই নেয়! খুলে দেখে বেশ কয়েকটা লেইস চিপসের ফ্যামিলি প্যাক, আরো বিভিন্ন চিপস, চকলেটস, ক্যাডবেরি, সুইটস, কুকিজ, আর ড্রিম কেকের বক্স! অরুণ গম্ভীর চোখে আরিয়ানের দিকে তাকিয়ে বলল,

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

-” পেলি কিছু?”
আরিয়ান সব গুছিয়ে ব্যাগে ভরে। সে ভেবেছিল বিয়ার টিয়ার আনিয়েছে হয়তো! মাতালদের ভরসা নেই কি না! সে আমতা আমতা করে বলল,
-” না! মানে এগুলো দিয়ে কি করবি?”
-” শশুর বাড়ী যাবো একটু পর! তাই!”
শান্ত গলা অরুণের। সুজন চিন্তিত গলায় বলল,
-” বস শশুর বাড়ি এগুলো নিয়ে যাবেন? শশুর বাড়ি যেতে পান সুপারি, নানা রকম মিষ্টি, দই, বড় বড় তিন চারটা মাছ, ফল ফলাদি….”

জীবন তাকে থামিয়ে বললো,
-” খুব এক্সপেরিয়েন্স দেখছি! বিয়ে করেছো?”
সুজন খানিকটা লাজুক হেসে মাথা দোলায়।
-” বাহ্ বাহ্। খুব ভালো কাজ করেছো! ফরজ কাজ করেছো! কয়টা বিয়ে করলে?”
কথার ছলে ফেলে অন্য হাতের ব্যাগটা কৌশলে আরিয়ানের চোখ ফাঁকি দিয়ে টি টেবিলের নিচে লুকিয়ে নিলো। সুজন হেসে বলল,
-” কি যে বলেন না ভাই! একটাই সামলাতে পারি না! কয়টা!!!”
জীবন হো হো করে হেসে উঠলো। অরুণ মুচকি হাসে। তার হাসি দেখে রাসেল কটমট করে তাকালো।
-” শালা খুব হাসি বেরোচ্ছে? কি একটা কান্ড করে এলি দুজন যদি ধরা পরতি? আর এই সব.. কি সব !! এতো শয়তানি বুদ্ধি আসে কোথা থেকে?”
মোবাইল অরুণের দিকে তাক করে বলে। অরুণ ফোনে প্লে লিস্টে আলমের ভিডিও দেখে ফোনটা কেড়ে নেয়। অফ করে সুজনের দিকে বাড়িয়ে বলে,

-” এটা তোমার হেফাজতে রাখলাম!”
সুজন ফোনটা নিয়ে পকেটে পুরে। আরিয়ান অরুণের পাশে বসে বললো,
-” ভাই এসব কি? এখন যদি ওরা আবার কেস করে? কি হাল করে ছেড়েছিস শয়তানটার! একটা জখমও মানুষকে দেখানোর জো রাখিস নি!”
-” ওতটাও সাহস নেই! আর করলেও অরুণ সরকার দেখে নেবো! সেফটি গার্ড হিসেবে ভিডিও আছে তো!তোরা এখন যা তো! তোর বউ অপেক্ষা করছে!”
জীবনের কথায় অরুণ তার দিকে চায়। জীবন দাঁত কেলায়। রাসেল দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে,
-” আমি তো সারাটা দিন বুকে হাত দিয়ে বসেছিলাম কখন না শালা কেস খাওয়ায়! পিস্তলটা যে আমারি!”
-” ওটা তো শো অফ করার জন্য নিয়ে গিয়েছিলাম আর তাছাড়াও খানিকটা সেফটি গার্ড হিসেবে। ওর কাছে যদি অস্ত্র থাকতো? তাই! আর তোরা এখন এসব বাদ দে তো! ভালো লাগছে না এসব কথা কখন থেকে ঘ্যান ঘ্যান করছিস মাছির মতো!”

বিরক্ত হয়ে বলে অরুণ। আরিয়ান হাত ঘড়িতে সময় দেখে। সাতটা বেজে দশ! বাড়ি ফিরতে হবে জলদি!
-” ভাই আমি কি চলে যাবো? তুই তো শশুর বাড়ি যাবি!”
অরুণ কিছু বলবে এর আগে জীবন চটজলদি বলে,
-” হ্যাঁ হ্যাঁ তুই যা জলদি যা ভাই!”
তার তাড়া দেখে আরিয়ানের সন্দেহ হয়। কিছু তো গন্ডগোল আছে। তাকে তাড়ানোর এতো জলদি কিসের? তার তীক্ষ্ণ দৃষ্টি দেখে জীবন খানিকটা এলেবেলে হয়ে যায়‌। মনটা দুরু দুরু করে ব্যাগটা না দেখে নেয়! পা বাড়িয়ে টি টেবিলের নিচে ব্যাগটা আরেকটু ভিতরে রাখে। চতুর এডভোকেট আরিয়ান সরকারের চোখে ধরা পড়ে ব্যাপারটা। ঝুঁকে ব্যাগটা নিজের কাছে নেয়। ব্যাগ খুলেই সে হতাশ! না এদের কিচ্ছুটি হবে না। আরিয়ান বিয়ারের চারটা বোতল ও চিপস, চানাচুরের প্যাকেট গুলো টি টেবিলে রেখে বল,

-” তোমরা সুধরাবে না, না? কুকুরের লেজ সোজা হবে তবুও তোমাদের মতো মাতালদের মত খাওয়া শেষ হবে না!”
জীবন তড়িৎ বেগে এসে বিয়ারের বোতল গুলো নিজের কাছে টেনে নিয়ে বলল,
-” মাতাল কাদের বলছিস? আমরা মত খাই না! শুধু মাঝেমধ্যে হ্যাংআউটের জন্যা দু এক সিপ এই এনার্জির ওষুধ খাই!”
অরুণ চুপচাপ গম্ভীর। শালা আবার এসব কেন নিয়ে এসেছে? সে তো এসবের থেকে দূরেই ভাগতে চায়। প্রতিবার ভাবে আর খাবে না। কিন্তু কোনো না কোনো উছিলায় সামনে আসে আর লোভী মনটা আঁকুপাঁকু করে একটু চেখে দেখতে। অরুণ নিজের মনকে কষিয়ে ধমক লাগিয়ে জীবনকে ধমকে বলে,

-” এই শালা চুপ! নামাজ শেষ ওমনি শয়তান হাজির! নামাজে দাঁড়িয়ে এটাই ভাবছিলি? শালা তোদের দেখে তো শয়তানও ভয় পাবো! যখনই ভাবি আর জীবনেও ওসবে হাত লাগাবো না তখনই হাজির হোস এসব নিয়ে!”
অরুণের ধমকে জীবনের কপালে ভাঁজ পড়ে। বাহ্। ভূত পড়ছে ভূত তাড়ানোর মন্ত্র!! আরিয়ান ভাইয়ের দিকে ত্যাছড়া নজরে তাকিয়ে বলল,

-” বাহ্ ভাই! সূর্য আজ কোন দিকে ডুবলো? চোর চোরকে চুরির জন্য ধমকাচ্ছে! সে যাই হোক জীবন ভাই? দাও তোমার এনার্জেটিক ওষুধ গুলো! সব কমোডে ঢালবো। তার নাকি পেট খারাপ! এই ওষুধে ঠিক হবে না?”
জীবন গম্ভীর মুখে কাটকাট গলায় বলল,
-” এই জীবন জীবন থাকতে জীবনেও এগুলো তোর হাতে দিবে না। আমার কতগুলো টাকা! তুই সুদ্ধ পুরুষ যা ফুট!”
-” গিলো! বেশি করে গিলো! আমি তৃপ্তি ভাবিকে ফোন করে সব বলবো!”
-” যা যা! তোর তৃপ্তি ভাবিকে আমি ভয় পাই নাকি!”
-” সে দেখা যাবে! আর ভাই তুই যদি এসব গিলেছিস তোর আম পাতা জোড়া জোড়ার কানে সব খবর যাবে!”
বলেই চলে যায়! জীবন পুনরায় বিয়ারের বোতল সব টি টেবিলে রেখে বলে,
-” দেখেছিস অরুণ? বড় ভাবিকে সম্মান দিতে যানে না।আর তুইও বলি হারি এই চুনোপুঁটির ঝাড়ি খাস!! আগে না খুব খিল্লি উড়াতি! এখন এতো ভালোবাসা?”

রাসেল খপ করে একটা বিয়ারের বোতল তুলে নিয়ে বলে,
-” কথা ঠিক! দুশমন কি করে বন্ধু হলো?”
অরুণ টি টেবিল থেকে পা নামিয়ে সোজা হয়ে বসে। শান্ত গলাতেই বললো,
-” আগে ওকে দেখলেই গা জ্বলে উঠতে রাগের মাত্রা তরতর করে বেড়ে যেতো! সহ্যই করতে পারতাম না। ওর ক্ষেত্রেও একি ঘটনা ছিলো। এখন বুঝতে পারি আরিয়ান ওতটাও বিরক্তিকর নয়। ভালো ছেলে। আর শাসন ঝাড়ির কথা বলছিস? ও যখন বকে বা শাসন করে!ঝাড়ি দেয় মনে হয় আব্বু বকছে আমাকে। আব্বুও এভাবেই বকতো! ভালো লাগে খানিকটা!”

কথা শেষ করে মুচকি হাসলো। জীবন ও রাসেল খানিকটা ইমোশনাল হয়ে যায়। আর সুজন তো পুরোই ইমোশনাল বনে গেলো। তবে জীবন ইমোশনকে বাদ দিয়ে অরুণের দিকে বিয়ারের বোতল বাড়িয়ে বলল,
-” হয়েছে ইমোশনাল কথাবার্তা! ওসব শুনলে হাসি পায়! ধর ওষুধ খেয়ে নি?”
অরুণ বিয়ারের বোতলের দিকে পিট পিট করে চায়। খাবে কি? বেশি না এক সিপ খাবে! আবার ভাবে এক সিপ বললেও এক সিপে কিছু হবে না তার। বেহায়া মন আরো লোভী হবে।
-” খাবো না আমি! তোরা এনজয় কর! আর সুজন অফিসে নজর বুলিয়ে লক করে বের হবে! বেশি গিলবে না। আসছি!
অরুণ ঝটপট উঠে দাঁড়ালো। শু পড়ে ব্যাগটা নিয়ে একপ্রকার ছুটে চলে গেল দোয়া দরুদ পাঠ পাঠ করতে করতে!

-” কি হয়েছে টাকি তোর পাতা? ভালোভাবে কথা বলছিস না কেন আমার সাথে?
-” আপু কই কথা বলছি না! ভালোভাবেই তো বলছি!”
পাতা শান্ত ভাবে উত্তর দিলো। কিন্তু লতা জ্বলে উঠলো যেন। রিসেপশনের পর থেকে প্রতিদিন পাঁচ ছয় বার কল করেছে। পাতা একবারও রিসিভ করে নি। এখন ঢং চলছে? সে রাগে গজগজ করতে বলে,
-” দেখ পাতা একদম ফুটেজ খাবিনা। কি হয়েছে? তোর বুইড়া জামাই কি বলেছে আমার নামে? বল?”
পাতা খানিকটা বিরক্ত হয়। কথায় কথায় বুইড়া জামাই বলে আপু কি বুঝাতে চায়! মজা করে বলে? কিন্তু এই মজাটা ভালো লাগে না তার। আর সে সাবধানও করেছে। পাতা বিরক্তিকর সুরেই বললো,
-” কি বলবে উনি আমায়? কিছু বলে নি।”
-” তাহলে ফোন ধরিস নি কেন আমার?”
-” খেয়াল করি নি!”
লতা হাসে।

-” বাহ্ খেয়াল করিস নি! বুইড়া জামাইয়ের খেয়ালে এতো ডুবে ছিলি যে প্রত্যেক দিনই আমি তিন চারবার করে কল করেছি আর তুই খেয়ালই করিস নি!
পাতা বোনের দিকে চায় শান্ত দৃষ্টিতে।
-” মানছি সে তোমার ছোট বোনের জামাই বাট উনি তোমার সিনিয়র!! বুইড়া কেমন ভাষা আপু?”
রাতুল, লুবমান, কাওছার, পাবেল, প্রিয় হেসে উঠলো উচ্চস্বরে। কাওছার, প্রিয়, পাবেল সকালে এসেছে। তাদের প্রিয় পাতা আপু আসবে শশুর বাড়ি থেকে আর তারা আসবে না? লতা থমথমে মুখে তাদের দিকে তাকায়। তাকিয়েই হেসে ফেললো। সবার হাসিতে একতলা বাড়ির পুরো ছাঁদ কেঁপে উঠলো যেন। একটু দূরে খেলতে থাকা লাবিব ভোর ঘার মুড়িয়ে একপল তাকিয়ে পুনরায় খেলায় গভীর মনোযোগ দিল।

পাতার মুখে হাসির লেশটুকুও নেই। ওদের নিকট ব্যাপারটা মজার হলেও পাতার ক্ষেত্রে না। জানে সবাই মজা করছে! লেগপুল করছে! তবুও প্রতিবার বুইড়া বলে কি বোঝায় যে, পাতা তোর বুড়োর সাথে বিয়ে হয়েছে! লোকটাকে কেমন অবজ্ঞার সুরে অপমান করছে মজার সুরে। আর সবচেয়ে বড় কথা লোকটার সম্মুখে এসব বললে কেমন দেখাবে ব্যাপারটা! উনি কিভাবে নেবে? পাতা কিছু বলে না। চুপচাপ চলে আসতে চাইলে কাওছার হাত ধরে আটকালো। রাতুল হাসি থামিয়ে বলল,

-” আরে পাতা রেগে যাচ্ছো কেন? আমরা সবাই মজা করছি! আর দেখছি জামাইয়ের প্রতি তোমার কত টান!”
লুবমান পাতার মাথায় টোকা দিয়ে বলল,
-” এভাবে জামাই পাগল হলে হবে? লতা আপুর মতো জামাইকে পাগল বানাতে হবে! তবেই না জমবে সংসার!”
রাতুল লুবমানের পিঠ চাপড়ে বলল,
-” শালাবাবু এভাবে বলতে পারলে দোয়া করে দিলাম এর থেকেও দজ্জাল বউ জুটবে তোমার কপালে! তোমাকে পুতুল নাচ নাচাবে!”
-” শকুনের দোয়ায় গরু মরে না দুলাভাই!”
প্রিয় হেসে বলল,
-” তোমরা ইন ডিরেক্টলি লতা আপুকে দজ্জাল বললে!”
রাতুল প্রিয়র দিকে তাকিয়ে বলল,

-” কোনো সন্দেহ আছে তোমার! আমি ডিরেক্টলি বলছি তোমাদের বোন দজ্জাল বউ! উঠতে বসতে ঝাড়ি! কথা বলাই যায় না। আগে জানলে লতা ছেড়ে পাতার জন্য প্রস্তাব পাঠাতাম। এরকম জামাই পাগল বউই তো সব ছেলে চায়! বুড়ো বলেছে বলে কেমন ক্ষেপে গেল! আর আমারটা কি না কি বলে গালি দেয় অনবরত!”
বাকি সবাই হাসে। লতা চোখ রাঙানি দেয় রাতুলকে। রাতুল তোয়াক্কা করলো না এবার। সবাই হাসলেও পাতার মুখশ্রী হাসি বিহীন।
পাবেল এগিয়ে এসে পাতার কাঁধ জড়িয়ে বলল,

-” আপু! রাগ করছিস কেন? আচ্ছা বলবো না। এখন বল কেমন চলছে তোর সংসার জীবন? ”
-” ভালো!”
পাতার ছোট্ট জবাব। কাওছার ভ্রু নাচিয়ে বলল,
-” তোর জামাই কেমন? মানে ভালো টালো বাসে? আদর যত্ন করে?”
-” করে!”
রাতুল ঠোঁট চেপে হেসে বলল,
-” করবে না বুড়ো বয়সে ছোট সুন্দরী বউ! মাথায় তুলে রাখার কথা!”
পাতা কিছু বলে না। গম্ভীর মুখে দাঁড়িয়ে থাকে। লতা রাতুলকে ধমকে বলে,
-” তোমার সাহস তো কম না পাতার জামাইকে বুড়ো বলছো! দেখো কেমন সাপের মতো ফোঁস ফোঁস করছে!”
বলেই হেসে উঠলো। প্রিয় এসে পাতাকে জড়িয়ে বলল,

-” লতাপু হয়েছে আপুকে আর লেগপুল করো না তো! বেচারি গাল ফুলিয়ে আছে!”
পাতা প্রিয়র থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে চলে যাবে। তবে এবার লুবমান আটকালো।
-” আরে পাতু! তুই রেগে যাচ্ছিস কেন? আগে তো রাগ করতিস না কোনো কথায়! বিয়ের পর চেঞ্জ হয়ে গেলি? সাথে আমাদেরও ভুলে গেলি!”
-” রাগ করি নি। আর না ভুলেছি তোমাদের! রাত অনেক হয়েছে নিচে যাই!তোমরাও চলো?”
সবাই সায় জানালো। সত্যি রাত হয়েছে বেশ। নটা দশ বাজে। প্রিয় বলল,
-” নিচে গিয়ে সবাই কার্ড খেলবো! আইডিয়া কেমন?”
রাতুল হাই তুলে বলে,

-” মন্দ না। ঠিকঠাক! চলো পিচ্চি শালিকা!”
সবাই নেমে গেল। লাবিব জেদ করে যাবে না! সে খেলবে ভোরের সাথে। লতা লাবিবকে টেনে নিয়ে সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামলো; লাবিব চেঁচাচ্ছে। ছাদে পাতা ও ভোর! ভোর ছাদে বিছানো পাটিতে বসে লাবিবের চিৎকারে হাসছে মিটমিট করে। পাতা গিয়ে ভোরের সামনে দাঁড়ায়।
-” চলো ভোর নিচে যাই!”
ভোর উঠে দাঁড়ালো। হাফপ্যান্ট ঝেড়ে বলল,
-” আম্মু আব্বু কখন আসবে? ফোন করেছিলে?”
পাতা ভোরের দিকে তাকায়। লোকটা কি আসবে আদৌ? সে কল করে নি! করলে যদি মানা করে দেয়; বলে যে আসবে না। তাহলে? আর লোকটাও তো ফোন করে বলে নি যে আসবে না। তার মানে আসার চান্স আছে। সে ভোরের হাত ধরে হাঁটা দেয়।

-” আসবে তো! এই এলো বলে! ”
ড্রয়িং রুমে আড্ডা জমে ক্ষীর। কার্ড খেলার সিদ্ধান্ত বদলে গেছে। ডায়নিং টেবিলের ওপাশে রান্নাঘরের পাশে অল্প ফাঁকা জায়গায় চেয়ার পেতে সকলে মিলে গানের কলি খেলছে। দুই দলে বিভক্ত হয়েছে সবাই। পাতা, কাওছার, পাবেল, রাতুল অন্য দলে লতা, লুবমান, প্রিয়! দু দলের হাড্ডাহাড্ডি লড়াই। কেউ কারো থেকে কম না। লতার দলে সদস্য কম হলেও পয়েন্টে শীর্ষে। কিশোরী প্রিয়র গানের সাথে বেশ সম্পর্ক। গানের গলাও ঠিকঠাক। পাতাদের দলও কম যায় না। রাতুল ভুঁইয়া গান সম্পর্কে এক্সপার্ট। গানের গলাও প্রশংসাযোগ্য। সব মিলিয়ে সবাই বেশ এনজয় করছে। এমনকি পাতাও। তার মনটাও ফুরফুরে। একটু আগের সকলের কথা ভুলে আড্ডায় মেতে উঠেছে।এরইমধ্যে লাবনী আক্তার এসে জিজ্ঞেস করে অরুণ কতদূর? পাতা আমতা আমতা করে! কি‌ জবাব দেবে। তার তো কথাই হয় নি। তবুও বলে আসছে।

ভোর লাবিবের সাথে সোফায় বসে ফোনে গেম খেলছে। ভোর লাবিবের মধ্যে বন্ধুত্ব গড়ে উঠেছে অল্প সময়ে। হবে না? ভোর লাব্বু ভাইয়া, লাব্বু ভাইয়া বলে এমন মিষ্টি করে ডাকে লাবিব যেন গলে আইসক্রিম বনে যায়। আতিকুর ইসলাম ঘর থেকে বেরিয়ে আসে নাতনি রুম্পাকে কোলে নিয়ে। ভোরের পাশে বসে রুম্পাকে ফ্লোরে নামিয়ে দিলো! রুম্পা ভোরের পা ধরে উঠে দাঁড়ালো। ভোরের হাতে ফোনটা টেনে ‘দা দা’ বুলি আওড়ায়। মানে ফোন দাও! ভোর ভ্রু কুটিতে ভাঁজ ফেলে বলল,

-” দেব না! আমি খেলছি দেখতে পাচ্ছো না? যাও?”
রুম্পা কেঁদে উঠলো শব্দ করে। আতিকুর ইসলাম কোলে তুলে নেয়। রুম্পা শান্ত হয় না। ভোরের চুলের মুঠি ধরে টেনে ধরে। লাবিব উঠে দাঁড়িয়ে বলে,
-‘ বুনু ছেড়ে দাও! ভাইকে ছেড়ে দাও?”
রুম্পা ছাড়ে না বরং আরো শক্ত করে ধরে। আতিকুর ইসলাম হাত ছাড়িয়ে নিতে নেয় রুম্পা ছাড়ে না। ভোর চুপ করে বসে তবে আঁখি জোড়া এই ভরে উঠলো বলে! ফোনটা সোফায় পড়ে গেছে। পাতা ওপাশ থেকে লক্ষ্য করে দৌড়ে উঠে আসে। রুম্পার হাত থেকে ভোরের চুল গুলো ছাড়িয়ে দিয়ে কোলে তুলে নেয়। আতিকুর ইসলাম ভোরকে জিজ্ঞেস করে,

-“ওকে বকে দেবো! ব্যাথা পেয়েছো ভোর?”
ভোর না বোধক মাথা নাড়ে। তবে সে ব্যাথা পেয়েছে।এমন শক্ত করে চুল টেনে ধরেছে! ব্যাথা পাবে না? পঁচা বাঁদর মেয়ে। নাকের পাটা ফুলিয়ে ভোর পাতার দিকে চায়। ব্যাথা সে পেয়েছে অথচ আম্মু ওই বাঁদর মেয়েকে কোলে নিয়ে আদর করছে!
পাতা রূম্পাকে আদর দিয়ে এটা ওটা বলে শান্ত করে! কোলে নিয়ে রান্নাঘরে যায়। একটা আইসক্রিম বাচ্চাটার হাতে দিয়ে তার মায়ের কোলে দেয়। ভোরের কাছে এসে দেখে ছেলে গাল ফুলিয়ে ঢোল বানিয়ে রেখেছে। সে ভোরের মাথায় হাত বুলিয়ে কোলে তুলে নেয়।
-” ব্যাথা পেয়েছো?”
ভোর নাক টেনে জবাব দেয়,
-” অল্প অল্প!”
পাতা দু গালে চুমু দিয়ে বলল,

-” ছোট বাবু বোঝে না তাই ওমন করেছে! তবুও রুম্পাকে বকে দেবো! চলো ওখানে বসে গানের কলি খেলি?”
ভোর মাথা নাড়ল। পাতা তাকে নিয়ে কাওছারের পাশের চেয়ারে বসে পড়লো। ভোর পাতার গলা জড়িয়ে রাখলো।
-” আম্মু? আব্বু কখন আসবে?”
পাতা কিছু বলবে কাওছার ভোরকে টেনে নিয়ে নিজের কোলে বসিয়ে বলে,
-” আসবে না তোর বাবা! এসেছে থেকে শুরু করে দিয়েছিস আব্বু কখন আসবে!”
ভোরের চোখ টলমল করছে। সে পাতার দিকে তাকিয়ে ঠোঁট উল্টায়। এখুনি কেঁদে দিবে। লুবমান কাওছারের কোল থেকে ভোরকে টেনে নিজের কোলে বসিয়ে গাল টিপে বলল,
-” তোর বাপকে তো ডাকাতরা ধরে নিয়ে চ্যাংদোলা করে পেটাচ্ছে! আর তোর বাপ ‘উরি মা’ বলে চিৎকার করে কাঁদছে!”
রাতুল পাশ থেকে বলল,

-” শুধু কি তাই? দড়ি দিয়ে বেঁধে ইয়া বড় বড় লাঠি দিয়ে ঠাস ঠাস করে মারছে…’
এ পর্যায়ে আর থামানো গেলো না ভোরকে। ঠোঁট উল্টিয়ে আব্বু বলে কেঁদে উঠলো। চোখ দিয়ে বড় বড় ফোঁটায় বর্ষণ হচ্ছে। পাতা এগিয়ে এসে কোলে নেয় ভোরকে।
-” দিলে তো ছেলেটাকে কাঁদিয়ে!! আর ভোর! বাবা কাঁদে না ! মামারা মজা করছে তোমার সাথে। তোমার আব্বু ঠিক আছে। এই তো আসলো বলে! কথা‌ বলবে? ফোন দিই?”
ভোর পাতাকে জড়িয়ে ধরে ফোপাতে থাকে। আব্বুর জন্য তার বুকটা কেমন করছে! তার আব্বুকে চাই! এখনি চাই? পাতা ভোরের মাথায় হাত বুলিয়ে এটা ওটা বলে শান্ত করানোর চেষ্টা করে। আতিকুর ইসলাম এসে গম্ভীর মুখে সবাইকে ধমকায় বাচ্চাটাকে কাদানোর জন্য। লতা বলে,

-” আমরা তো এমনি মজা করছিলাম! কে জানে ভোর সোনা কেঁদে বুক ভাসাবে! ভোর আমরা সবাই স্যরি হ্যাঁ? মজা করছিলাম তো! তোমার আব্বু ঠিক আছে। এক্ষুনি আসবে! কেঁদো না!”
পাতা ভোরের মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল,
-” ছেলেটা বাবা ছাড়া কিচ্ছু বোঝে না। বাবার পাগল! ওসব শুনে!”
লুবমান ফ্রিজ থেকে আইসক্রিমের বাটিটা বের করে ভোরের কাছে দাঁড়িয়ে বলল,
-” ছেলে মানুষ এভাবে কাঁদে নাকি! হয়েছে কান্না বান্না। এখন নে আইসক্রিম খা? চকলেট ফ্লেভার!”
অন্যসময় হলে ভোর অফার লুফে নিতো। এবার কিছু বলে না। কাওছার পাতার কাছ থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে ভোরের ফুলো গালে, মুখে চুমু দিলো।

-” ইয়া আল্লাহ কি কিউটের ডিব্বা! পাতা তোর এই ছেলেকে আমি আমার মেয়ের জামাই বানাবো! তার জন্য জলদি বিয়ে করতে হবে আমাকে। এই তোমরা কেউ নজর দিবা না আমার মেয়ের জামাইয়ের উপর!”
ভোর এবার লজ্জা পায়। হেসে ফেললো শব্দ করে। তার হাসি দেখে সবাই স্বস্তির শ্বাস নেয়। টুকটাক হাসির কথা বলে ভোরকে হাসায়। এরমধ্যে কলিং বেল বেজে উঠলো। লাবিব দৌড়ে গিয়ে দরজা খুলে দিল। সামনে দন্ডায়মান মানবটিকে দেখে হেসে গলা উঁচিয়ে বলল,
-” ভোর দেখ কে এসেছে? তোমার আব্বু এসেছে!”

অরুণ তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে ভেতরে প্রবেশ করে। আতিকুর ইসলাম সহ সবাই এগিয়ে আসে। অরুণ সালাম দিল। আতিকুর ইসলাম জবাব দিয়ে জিজ্ঞেস করে,
-” কেমন আছো? বাড়ির সবাই কেমন আছে?”
-” ভালো!”
প্রতিত্তরে আর কিছুই বলে না। পাতা কটমট করে চায়। এ লোক আসলেই ম্যানারলেস! ভোর কাওছারের কোল থেকে নেমে দৌড়ে গিয়ে বাবার কোলে ওঠে। বাবার গালে কপালে বেশকিছু চুমু দিয়ে গলা জড়িয়ে বলল,
-” আব্বু এতো দেড়ি করলে কেন? আই মিসড ইয়ু!”

অরুণ ছেলের কপালে চুমু দিয়ে বুকে জড়িয়ে ধরে, কিছু বলে না। লাবনী আক্তার এটা ওটা জিজ্ঞেস করলো! অরুণ হুম হা তে জবাব দিলো। অরুণ উপস্থিত সকলের দিকে নজর বুলিয়ে নেয়। রাতুল, কাওছার, পাবেলের সাথে টুকটাক কথা বলে পাতার দিকে তাকিয়ে ইশারায় ডাকে। পাতা এগিয়ে আসলে তার হাতে ব্যাগটা ধরিয়ে দেয়।
-” সবার জন্য!”

পাতা অরুণের চোখে চোখ রাখে। সবার জন্য এনেছে! ভালো কথা, তার হাতে দিচ্ছে কেন লোকটা! সুন্দর করে ডেকে আম্মুর হাতে দিতি ! লাবনী আক্তার অরুণকে উদ্দেশ্য করে বলে,
-” ঘরে যাও বাবা! ফ্রেশ হয়ে নাও! পাতা নিয়ে যাহ?”
পাতা মাথা দোলায়। ব্যাগটা মায়ের হাতে ধরিয়ে দিয়ে অরুণের উদ্দেশ্যে ‘আসুন’ বলে নিজের ঘরে চলে যায়। অরুণ ছেলেকে কোলে নিয়ে তার পিছু পিছু যায়। অরুণ প্রবেশ করা মাত্রই পাতা ধরাম করে দরজা বন্ধ করে দেয়। অরুণ তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে থাকে। পাতা অরুণের সামনে দাঁড়িয়ে ভদ্রভাবে সুবোধ মহিলার মতো সুধায়,
-” আত্নীয় স্বজনের সাথে ভালোভাবে কুশল বিনিময় করতে ট্যাক্স লাগে?”
অরুণ পাতার সামনে থেকে সরে ভোরকে বিছানায় বসিয়ে দিয়ে নিজেও বসে। বেশ গরম লাগছে তার। শার্টটা টেনে খুলে ফেলতে ইচ্ছে করছে।

-” সালাম দিয়েছিলাম তো!”
পাতা ফ্যান চালায়, রেগুলেটর ঘুড়িয়ে ফুল পাওয়ারে ছাড়ে। অরুণ যেন কিছুটা স্বস্তি পায়। ঘেমে নেয় একাকার সে। পাতা এগিয়ে অরুণের সামনে দাঁড়িয়ে বলল,
-” সালাম দেওয়ার পর ভালোমন্দ জিজ্ঞেস করতে হয়! কেউ ভালো আছো বললে প্রতিত্তরে তার ভালোমন্দের খোঁজ নিতে হয়! জানেন না?”
অরুণ পাতার শাড়ির আঁচল টেনে মুখশ্রীর নোনাজল মুছে জবাব দিল,
-” জানি না!”
অরুণের কান্ডে পাতার মন পায়রা বাক বাকুম ডেকে উঠলো। মুচকি হেসে অরুণের হাত থেকে আঁচল ছিনিয়ে নিয়ে নিজেই গলায় গড়িয়ে পড়া বিন্দু বিন্দু ঘাম মুছে দিলো! শার্টের বোতামে হাত গলিয়ে একটা একটা করে যত্ন সহকারে খুলতে শুরু করলো।

-” তা জানবেন কেন! নাক উঁচু ম্যানারলেস লোক কি না!! সবাই কি ভাববে? যে অহংকারী! বড়লোক তাই ভাব নেয়। অথচ তারা তো জানে না যে আপনার মুখে রসকস নেই! ছেলের থেকেও তো কিছু শিখতে পারেন!”
ব্যাক্তিগত নারীর যত্ন ও শাসনে ঘেরা বাক্যে অরুণের অধর জুড়ে খেলা করে ক্ষীণ হাসির রেশ। ভোর পিছন থেকে অরুণের গলা জড়িয়ে পিঠে ঝুলে পড়ে। কাঁধ গলিয়ে উঁকি দিয়ে পাতাকে বলে,
-” আমার আব্বুকে বকছো কেন?”
পাতা তার গাল টিপে দিয়ে বলল,
-” তোমার আব্বু কার্টেসি জানে না! বকবো না তো কি করবো?”
-” বেশি বেশি আদর করবে! একটুও বকবে না!”

কাঁধে মাথা গলিয়ে গালে বাবার গালে চুমু দিয়ে বলে ভোর! পাতার হাত থেমে যায়! পিটপিট করে ভোরের দিকে তাকালো ‌। আড়চোখে অরুণের দিকে তাকাতে ভুলে না। লোকটি মিটমিট করে হাসছে।
-” কলিজা একদম খাঁটি কথা বলেছে পাতাবাহার!”

পাতা লজ্জা পায় খানিকটা! সরে আসতে নিবে অরুণ বুঝতে পেরে আঁচল গলিয়ে উন্মুক্ত কোমড়ে হাত রাখে‌। পাতার চোখের আকার বড় হয়। অরুণ দু হাতে টেনে নিয়ে ঊরুর উপরে বসিয়ে দেয় পাতাকে। শক্ত করে কোমড় চেপে ধরে, যেন পালাতে না পারে ‌। পাতা পালানোর চেষ্টাও করে না। লজ্জা বরণ মুখশ্রী নিয়ে চুপটি করে বসে থাকে। অরুণ হাসে। এতে পাতার লজ্জা তরতর করে বেড়ে যায়। এবার ছাড়া পাওয়ার জন্য ছটফট শুরু করে। অরুণ মুখশ্রী এগিয়ে নিয়ে যায়। পাতার গালে ঠোঁট ডাবিয়ে শব্দ করে চুমু খায়!

লজ্জা ও ভালোলাগার সংমিশ্রিত অনুভূতিতে পাতা নুইয়ে পড়ে। কপোলজোড়া লালিমায় ছেয়ে যায়; অধরকোনে লজ্জালু হাসিমাখা। ভোর বাবার কাঁধ থেকে মাথা এগিয়ে এনে পাতার অপর গালে শব্দ করে চুমু খেয়ে বত্রিশ পাটি দাঁত বের করে হাসে। আবেগী পাতার নেত্রযুগল আবেগে টইটুম্বুর হয়ে ওঠে। কোমড়ের কাছটার শার্টের কোনা মুঠোয় পুরে অরুণের ঘারে মুখ লুকায়। এরা‌ বাবা ছেলে এতো মিষ্টি কেন? পুরো রসমালাই! অরুণ পিঠে হাত বুলিয়ে জড়িয়ে নেয়। বেশ সময় পেরিয়ে যায়। পাতা ওভাবেই থাকে; ছাড়ার নাম নেই। ভোর গলা ছেড়ে পিছনে দাঁড়িয়ে অরুণের চুল টেনে দিচ্ছে। অরুণ শান্তির শ্বাস ছাড়ে। জীবনটা যেন এমনি স্বস্তির হয় আজীবনভর!

-” এভাবেই থাকবে পাতাবাহার?”
পাতার হুঁশ ফিরে। চটজলদি উঠে অরুণের থেকে দূরত্ব বজায় রেখে দাঁড়াল। আশ্চর্য! সে ইচ্ছে করে বসেছিলো নাকি! নিজেই টেনে বসালো, আদর করলো! যাইহোক এরকম আরামদায়ক স্থান থেকে কারই বা উঠতে মন চাইবে!
অরুণও উঠে দাঁড়িয়ে বলল,
-” জামাকাপড় কিছু এনেছো! বেশ গরম লাগছে! আই নিড টু শাওয়ার!”
পাতা টেবিলের উপর রাখা লাগেজ খুলে অরুণের টি শার্টসহ প্রয়োজনীয় কাপড় বের করে বিছানায় রাখে। অরুণ ভাঁজ কৃত কাপড় খুলে দেখে বলল,

-” পাতাবাহার তোমাকে ভদ্র মেয়ে ভেবেছিলাম তুমি দেখছি খুব ডেঞ্জারাস! আমার গোপন জিনিসপত্রের উপরও হামলা চালিয়েছো! হায় আল্লাহ!”
পাতা চোখ গোল গোল করে চায়।অরুণ আন্ডারওয়্যার ইশারায় দেখায়।পাতার কান গরম হয়ে ওঠে।বিছানার সব কাপড়গুলো তুলে নিয়ে বাইরে যেতে যেতে বলে,
-” অসভ্য নির্লজ্জ লোক!মুখে কিছুই আটকায় না।ওটা না আনলেই ভালো হতো! উপকারীর উপকার স্বীকার না করে লজ্জায় ফেলছেন!”

-” কোথায় নিয়ে যাচ্ছো ওগুলো?”
-” আমার রুমে এটাচ বাথরুম, ওয়াশ রুম নেই! আমি লুব ভাইয়ের ঘরে রেখে আসছি আপনিও আসুন জলদি করে!”
অরুণ মুখশ্রীর আদল পরিবর্তন হয়। অন্যের বাথরুম!!! অফিস থেকে গোসল সেরে আসলেই ভালো হতো! এখন কি আর করার! আধখোলা শার্টের বোতাম আটকে নিলো।ভোরকে কোলে নিয়ে ঘর থেকে বের হয়।

পাতা লুবের ঘর থেকে বের হয় ভোরের হাত ধরে। লোকটা গোসলে! অফিস থেকে সোজা এসেছে বোধহয়! অফিসের ঝামেলা কি মিটেছে? দুপুরে কিছু খেয়েছেন কি? মুখশ্রীতে অবশ্য ক্লান্তির রেশটুকু নেই। ভাবনার মাঝেই সামনে চিপসের প্যাকেট হাতে দন্ডায়মান রাতুলকে দেখে পাতা ভদ্রতাসুলভ হাসে। রাতুল চিপসের প্যাকেট ভোরের দিকে বাড়িয়ে দিয়ে পাতার উদ্দেশ্যে বলে,
-” পাতা তুমি কিন্তু বেশ ফাস্ট! জামাই পাওয়া মাত্রই ঘরে নিয়ে খিল দিলে। খোলার নাম নেই! কি কি হলো? হুম”
লজ্জায় পাতার কেঁদে দিবে ভাব!

-” আস্তাগফিরুল্লাহ্ দুলাভাই! কি সব বলেন বাচ্চার সামনে!”
রাতুল হেসে ভোরের মুখে চিপস দিয়ে ফিসফিসিয়ে বলল,
-” আরে আস্তাগফিল্লাহ্ কেন হবে! তোমারই জামাই যখন খুশী..”
পাতা আর দাঁড়ালো না। ভোরকে নিয়ে কেটে পড়ে। কি সব ছিঃ মার্কা কথাবার্তা! লজ্জায় তার মুখশ্রী লাল হয়ে এসেছে। পাতা ভোরকে নিয়ে ডায়নিং টেবিলে বসায়। লাবনী আক্তার টেবিলে খাবার সাজিয়ে রাখছে। রান্না সব কমপ্লিট করে রেখেছে শুধু অরুণের আসার অপেক্ষায় ছিলো! পাতা তাকে সাহায্য করে। পাবেল ও লাবিব এসে ভোরের পাশে বসে। লতা,পাতা ও লাবনী আক্তার মিলে সব খাবার ডায়নিং টেবিলে সাজিয়ে রাখে। পাতা লুবমানের ঘরে যায়। গিয়ে দেখে অরুণ মাত্রই গোসল সেরে বেরিয়েছে। গলায় তোয়ালে ঝুলিয়ে মাথা মুছছে।

পাতা ওয়াশ রুমে ঢুকে অরুণের ভেজা কাপড় ধুয়ে নিয়ে বেরিয়ে আসে। নিজের ঘরে নিয়ে দেয়ালে টানানো রশিতে মেলে দিলো।
খাবার টেবিলে বসে অরুণ। কোলে ভোর আর পাশের চেয়ারে রাতুল বসে। টেবিলে হরেক রকমের পদের সমাহার। অরুণ মোটেও অবাক হয় নি। বাঙালী বাড়িতে জামাই আদর সম্পর্কে অভিজ্ঞ সে। লাবনী আক্তার একের পর এক পদ অরুণের বড় প্লেটে সাজিয়ে দিচ্ছে। ভোর উৎসাহের সাথে জিজ্ঞেস করছে ওটা কি এটা কি! লাবনী আক্তার হাসিমুখে উত্তর দিচ্ছেন। পাবেল, লুবমান, রাতুল, কাওছার অরুণের সাথে রসিকতা করছে এটা ওটা বলে। মাঝেমধ্যে লতাও দু একটা কথা বলছে। অরুণ প্রতিত্তরে একবারে চুপ বসে নেই। শান্ত স্বাভাবিক গলায় তাদের জবাব দিতে ভুলছে না। তাদের গোটাদশেক রসিকতার জবাব একটাতে দিয়ে মুখ বন্ধ করে দিচ্ছে। ওরাও চুপ করে নেই এটা ওটা বলে ক্ষেপাচ্ছে; অরুণের সাথে না পেরে পাতাকেও রেহাই দিচ্ছে না। পাতার হয়ে অরুণ তাদের ক্ষেপিয়ে দিচ্ছে। শেষে হার মেনে খাওয়ায় মনোযোগী হয় সব! অরুণ নিজে খাচ্ছে সাথে ভোরকেও খাইয়ে দিচ্ছে আস্তে ধীরে। এরমধ্যে ভোর বলে,

-” আব্বু আমি আর খাবো না। পেট ভরে গেছে!”
অরুণ জোড় করে না। ছেলেকে কোলে নিয়েই খেতে থাকে। লাবনী আক্তার বাটিতে দই মিষ্টি দেয় ভোরকে। ভোর একটু মুখে পুরে রেখে দেয় আর খাবে না। তার পেট ভর্তি। পাতা খেয়াল করে অরুণ খাচ্ছে না শুধু প্লেটে নাড়াচাড়া করছে। প্লেটে অর্ধেকের বেশি খাবার এখনো বিদ্যমান। পাতা এগিয়ে এসে সুধায়,
-” খাচ্ছেন না কেন?”
অরুণ পাতার দিকে চায়। তার পেটটাও ফুল হয়ে গেছে। আর একটা খাবারও গলা দিয়ে নামবে না। অথচ প্লেট এখনো ভর্তি। এমন না সে খায় নি। যথেষ্ট খেয়েছে। তবুও প্লেট ভর্তি আর এর সব ক্রেডিট পাতার আম্মুর।
এরইমধ্যে লাবনী আক্তার পোলাও এর বোল নিয়ে এগিয়ে আসে। অরুণের পাতে পোলাও দিতে উদ্যত হয়ে বলে,

-” নাও! খাচ্ছো না কেন?”
অরুণ প্লেট সরিয়ে নিয়ে বলে,
-” আন্টি নেব না। প্লেটে যথেষ্ট আছে।আমি এটুকুই শেষ করতে পারবো না!”
লাবনী আক্তার আর দেয় না।রাতুল হেসে টিপ্পনী কেটে বলে,
-” অরুণ ভাই আপনাদের ওখানে শাশুড়িকে আন্টি বলে বুঝি? আমাদের এলাকায় কিন্তু মা , আম্মা বলে ডাকে!”
লতা সায় জানালো।
-” হ্যাঁ। আমি নিজেও শাশুড়িকে আম্মু বলে ডাকি!”
কাওছার হেসে মিনমিনে গলায় বলল,
-” আমাদের গ্রামেও সবাই আম্মা বলেই ডাকে।”
সবাই মিলে অরুণ কে জব্দ করে এবার। অরুণ পাতার দিকে তাকালো। পাতা কি করবে বুঝতে পারে না। আতিকুর ইসলাম পরিস্থিতি সামাল দিলো।

-” কি হচ্ছে টাকি! সবাই চুপচাপ খাও! আর লাবনী জামাইকে দই, মিষ্টি দাও!”
অরুণ প্লেটে নাড়াচাড়া করে এক লোকমা খাবার মুখে তোলে কিন্তু গিলতে পারে না। পেট ভর্তি পুরোপুরি। খেতে ইচ্ছে করছে না তার। আর অতিরিক্ত খাবার সে খেতে পারে না। পাতা অরুণ মুখশ্রী খেয়াল করে বলল,
-” জোড় করে খেতে হবে না। রেখে দিন! মিষ্টি মুখ করুণ! আমি দিচ্ছি!”
অরুণ যেন স্বস্তির শ্বাস ছাড়লো। ভোরের রেখে দেওয়া দই মিষ্টির বাটিটা তুলে নিল।
-” দিতে হবে না। এতেই হবে!”
বলে চামচে করে মুখে নেয়। দই শেষ করে পানি পান করে অরুণ। লাবনী আক্তার সেমাইয়ের বাটি এগিয়ে বলে,

-” একটু সেমাই নাও?”
-” যথেষ্ট খেয়েছি। আর খাব না কিছু!”
এবার আর আন্টি বলার ভুল করে না। সম্মোধন হীন কথা বলে বিদায় নেয় খাওয়ার পর্ব থেকে। পরপর সব ছেলেদের খাবার পর্ব শেষ হয়। সবাই উঠে গেলে লতা প্লেট নিয়ে ধুয়ে আনে। সবাই বসলে পাতাও এসে বসে। লতা পাতার সামনে অরুণের এঁটো প্লেটটা রেখে বলে,
-” এঁটো খেলে ভালোবাসা বাড়ে। খেয়ে নি! তোর আদরের জামাইয়ের এঁটো বলে কথা! আর এতো গুলো খাবার নষ্ট করবো নাকি!”

বলেই হাসে। পাতা প্লেটের দিকে তাকায়। একপাশ থেকে খেয়েছে লোকটা বাকি অংশে হাতই লাগায় নি মনে হচ্ছে। নীড এন্ড ক্লিয়ার খাবার দাবার লোকটার। পাতা প্লেটে হাত দিবে লতা তার মাথায় চাটি মেরে বলে,
-” এই গাধা সত্যিই খাবি নাকি! রেখে আয় কিচেনে আমি তোর প্লেট দিচ্ছি!”
পাতা মিষ্টি হেসে বলে,

পাতা বাহার পর্ব ৩৫

-” উনি একপাশ থেকে খেয়েছেন। বাকি অংশে হাতই লাগায় নি। এতো গুলো খাবার নষ্ট করার কি দরকার! আমি খাচ্ছি! তোমার মতো আমার ওত বাছ কোচ নেই!”
বলেই প্লেটে হাত দেয়। লতা হেসে পাতার চুল এলোমেলো করে দেয়। জামাই পাগল বোন তার। লাবনী আক্তার মুচকি হাসে। প্রিয় টিপ্পনী কাটে। পাতা লজ্জা পায় তবে আমলে নেয় না।

পাতা বাহার পর্ব ৩৭