শুভ্ররাঙা ভালোবাসা পর্ব ২৯

শুভ্ররাঙা ভালোবাসা পর্ব ২৯
সুমাইয়া সুলতানা

সোনারগাঁও, যা বাংলাদেশের নারায়ণগঞ্জ জেলায় অবস্থিত, মূলত একটি ঐতিহাসিক স্থান এবং নগরী। এখানে কোনো বড় পাহাড়ি এলাকা নেই, কিন্তু আশেপাশের কিছু অঞ্চলে ছোট-বড় কিছু গ্রামীণ জনপদ এবং প্রাকৃতিক সৌন্দর্য রয়েছে।সোনারগাঁওয়ের কাছে পদ্মা নদী অবস্থিত, যা এখানে অসাধারণ দৃশ্য তৈরি করে। নদীর পাড়ে বসে প্রকৃতির শান্তি উপভোগ করা যায়। এখানে অনেক প্রাচীন স্থাপনাও রয়েছে, যেমন সোনারগাঁও জাদুঘর, শাহী মসজিদ যা প্রাচীন বাংলার সংস্কৃতি এবং ঐতিহ্য প্রদর্শন করে। সোনারগাঁওয়ের আশেপাশে কিছু গ্রামে ছোট ছোট বাগান এবং পিকনিক স্পট রয়েছে, যেখানে গাছপালার ছায়ায় বসে সময় কাটানো যায়। সোনারগাঁও শিক্ষকদের গেট-টুগেদারের জন্য একটি অসাধারণ স্থান। এটি সুন্দর পরিবেশ, আরামদায়ক থাকার ব্যবস্থা এবং বিভিন্ন বিনোদনের সুযোগে ভরপুর।

দীর্ঘসময় পর গতিময় বাস গাড়িটি এসে থামল তার নির্দিষ্ট গন্তব্যে। এই গরমে লং জার্নি করে সকলেই ভীষণ ক্লান্ত। মোমের বাসে চড়ার অভ্যাস নেই। ভাগ্য ভালো আজকে বমি-টমি করেনি। আগুনের কাঁধে মাথা রেখে কিছুক্ষণ ঘুমিয়ে ছিল। আস্তে আস্তে সকলে গাড়ি থেকে নেমে পড়ল। আগুন এক হাতে ব্যাগ নিয়ে অন্য হাতে মোম’কে আগলে সাবধানে বাস থেকে নামল। মোমের আবার ঘুম পাচ্ছে। জবরদস্তি নয়ন জোড়া খুলে রাখার আপ্রাণ চেষ্টা করছে। ঢুলুঢুলু চোখে চেয়ে আগুনের সাথে পা চালাচ্ছে।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

সোনারগাঁও চার-স্টার মানের হোটেল রয়েছে। যেখানে আধুনিক সুবিধা যেমন: সুইমিং পুল, জিম, কনফারেন্স রুম রয়েছে। এছাড়া, শাহাজালাল নামে হোটেল আছে। এটি আরও একটি মানসম্মত হোটেল, যেখানে আরামদায়ক কক্ষ এবং ভালো সেবা পাওয়া যায়। সবাই মিলে শাহাজালাল হোটেলে উঠেছে। সোনারগাঁওয়ে স্থানীয় ট্যুর কোম্পানির মাধ্যমে প্যাকেজ ট্যুরের ব্যবস্থা করা হয়েছে। যেখানে থাকার, খাওয়ার এবং ভ্রমণের সবকিছু একসাথে করা যাবে। স্থানীয় রেস্টুরেন্ট গুলোতে স্ন্যাকস এবং অন্যান্য মজাদার খাবারও পাওয়া যায়।
হোটেলে এসে সকলে নিজেদের জন্য বরাদ্দকৃত রুমে চলে গেল। দম্পতি যারা রয়েছে তাদের জন্য একটা করে রুম পারমানেন্ট, আর যারা সিঙ্গেল আছে তারা তিনজন করে একটা রুমে থাকবে। সেই অনুযায়ী রুম বুকিং করা হয়েছে। জার্নি করে সকলেই ক্লান্ত ছিল, সেজন্য ফ্রেশ হয়ে খাওয়া-দাওয়া করে সবাই রেস্ট নিচ্ছে। ঠিক করেছে সন্ধ্যার পর সকলে মিলে আড্ডা দিবে।

মোমের এতক্ষণ ঘুম পেলেও এখন আর ঘুম আসছে না। তখন ক্লান্ত ছিল বলে হয়তো ঘুম পাচ্ছিল। গাড়িতে বেশ ভালোই ঘুমিয়ে ছিল। মোম বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে। এখান থেকে বাইরের কোলাহল পূর্ণ পরিবেশ সুন্দর করে দেখা যাচ্ছে। বারান্দায় বসার ব্যবস্থা আছে। মোম চেয়ার টেনে বসে পড়ল। গালে এক হাত ঠেকিয়ে তাকিয়ে থাকল অনিমেষ। আগুনের চোখে ঘুম ধরা দিয়েছে। আনমনে পাশে হাত রাখতেই চমকে উঠল। একি! মোম কোথায়? এখানেই তো শুয়ে ছিল। আগুন দরজার দিকে তাকায়। দরজা তো বন্ধ, তাহলে মোম কোথায় গেল? আগুন উঠে বসলো। ঘাড় ঘুরিয়ে এদিক ওদিক নজর বোলালো।

বারান্দায় কারো জর্জেট ওড়না হাওয়ার প্রকোপে উড়ছে। চিন্তে অসুবিধা হলো না। এটা মোমের ওড়না। আগুন চোয়াল শক্ত করে এগিয়ে যায়। ছোট্ট লোহার টেবিলে ধারাম করে হাত দিয়ে শব্দ তুলল। আকষ্মিক শব্দের তোপে মোম কেঁপে ওঠে। তড়িৎ বেগে নজর ফেরাল সেথায়। আগুন রাগান্বিত চোখে চেয়ে আছে। রাগের আভাস কতটা তীব্র সেটা আগুনের ঘনঘন নিঃশ্বাস আর বক্ষস্থল ওঠানামার দরুন বুঝতে পারলো। মোম শুষ্ক ঢোক গিলে উঠে দাঁড়ায়। হা করে কিছু বলতে চাইল, কিন্তু আগুন তার আগেই মোমের বাহু ধরে টেনে রুমে নিয়ে আসলো। এক প্রকার ঝারা দিয়ে মোমের হাত ছেড়ে দিল। সজোরে ধাক্কা দিয়ে বিছানায় ফেলে মোমের উপর ওঠে গেল। মোম হকচকিয়ে যায়। অবাক হয়ে চোখ দুটো বড়ো বড়ো করে চেয়ে রইল। মোমের হাত দু’টি বিছানায় চেপে ধরে ক্রোধান্বিত ভঙ্গিতে দাঁতে দাঁত চেপে আগুন বলল,

” আমাকে টেনশন দিতে খুব মজা পাও, তাই না? ঘুমে আচ্ছন্ন হয়ে হেঁটে হোটেল পর্যন্ত আসতে পারছিলে না, আর এখন যখন ঘুমানোর জন্য বলেছি তখন তুমি চুপিচুপি উঠে বারান্দায় চলে গেলে? আমাকে একবারও বলার প্রয়োজন মনে করলে না? ”
মোম ভীতু নয়নে চেয়ে আতঙ্কিত গলায় বলল,
” ঘুম আসছিল না, সেজন্য উঠে পড়েছিলাম। তাছাড়া, রুমেই তো ছিলাম। বাইরে তো যায়নি। ”
আগুন চিৎকার করে উঠে ধমকে বলে,
” আবার মুখে মুখে তর্ক করছো? সাহস বেড়ে গিয়েছে? দিনদিন অবাধ্য হয়ে যাচ্ছো! কথা বললে গায়ে মাখো না! ডানা বেশি বড়ো হলে, সেটা কাটতে আমার বেশি সময় লাগবে না! ”

মোম হতভম্ব হয়ে গেল। কি থেকে কি বলছে এই লোক? না ঘুমিয়ে ওঠে পড়ায়, এই সামান্য ব্যাপারে এতটা রেগে গিয়েছে? এভাবে ধমকাচ্ছে? চেপে ধরা হাতে বেশ ব্যথা পাচ্ছে মোম। আগুন বেশ শক্ত করেই মোমের হাত ধরে রেখেছে। মোম হাত ছাড়ানোর চেষ্টা করল না, এতে কুমড়োটা আরো রেগে যেতে পারে। ভীষণ কান্না পাচ্ছে ওর। ঘন পাপড়ি যুক্ত আঁখি জোড়া ছলছল করে উঠল। ঠোঁট কামড়ে কান্না আটকানোর চেষ্টা করছে, কিন্তু সফল হলো না। বেহায়া চোখ দুটো থেকে নোনাজল গড়িয়ে পড়ল। এক সময় না পেরে, মোম ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল। মোমের কান্নায় আগুনের হুঁশ ফিরল। তুরন্ত হাত ছেড়ে দিল। ঝট করে মিশিয়ে নিলো প্রসস্থ বুকে। লম্বা শ্বাস টানল। মাথায় আদুরে হাত বোলালো। ভারিক্কি নিঃশ্বাস ছেড়ে শান্ত কন্ঠে বলল,

” অচেনা অজানা জায়গায় এসেছ। আমার জন্য না হলেও তোমার জন্য এই শহর নতুন। তোমাকে দেখতে না পেয়ে টেনশনে পড়ে গিয়েছিলাম। এমনিতেই একটা ব্যাপারে তোমাকে নিয়ে ভয়ে তটস্থ থাকি। তাই রাগ হয়েছিল। ”
মোম কিছু বলল না। আগুনের বুকে থেকে ক্রমশ ফুঁপিয়ে যাচ্ছে। আগুন পুনরায় অতন্ত্য মোলায়েম গলায় বলল,
” জায়গাটা অপরিচিত, আমাকে না বলে কোথাও যাবে না। যেখানেই যাবে, আমাকে বলে যাবে। মনে থাকবে তো? ”
মোম ঠোঁট উল্টে বলে,
” থাকবে, তবে ওয়াশরুমে গেলেও বলে যেতে হবে? ”
আগুন এক পেশে হাসল। আরেকটু নিজের সাথে জড়িয়ে নিয়ে বলল,
” দরকার হলে তাই। এবার বলো, না বলে আর কোথাও যাবে? ”
মোম ছোট করে উত্তর দিল,
” যাবো না। ”

আগুন তপ্ত শ্বাস ছাড়ল। অঞ্জলিপুটে মোমের কোমল মুখশ্রী তুলে নিলো। এইটুকুতেই কেঁদেকেটে চোখমুখ ফুলিয়ে ফেলেছে মেয়েটা। স্বাদে কি আর আগুন তার পিচ্চি বউকে কোমলমতি বলে? আগুন গরম ওষ্ঠপুট এগিয়ে মোমের চোখে চুমু দিল। পরপর চুমু পড়ল মোমের পাতলা পীবর ঠোঁটে। আগুন যত্ন নিয়ে চুমু খেল বউয়ের কোমল রক্তাভা গালে। মোম চোখ তুলে চায়। আগুন তার ভেজা গাল মুছে দিল। মোম ভোঁতা মুখে বলল,
” ঘুম আসছে না। ”
মোম’কে বুকে নিয়ে শুয়ে পড়ল আগুন। রাশভারী গলায় বলে,
” কোনো কথা না। চুপ করে চোখ বন্ধ করো, ঘুম চলে আসবে। ”

হোটেল থেকে মাগরিবের আযানের পর সকলে বের হলো। সকলের মুড এখন ফুরফুরে। অল্প অল্প বাতাস বইছে, গায়ে লাগায় বেশ আরাম অনুভব করছে সকলে। গরমের সময় প্রকৃতি হাওয়া মন্দ না! হোটেল থেকে কিছুদূর সকলে গোল হয়ে আসন পেতে বসেছে। বসার জন্য চেয়ারের ব্যবস্থা নেই। স্থানীয় লোকেরা পাটি বিছিয়ে দিয়েছে। এতগুলো মানুষ, সবাইকে চেয়ার যোগাড় করে দেওয়া সম্ভব নয়, সেজন্য পাটির ব্যবস্থা করা হয়েছে। স্থানীয় লোকেরা ভীষণ আন্তরিকতার সঙ্গে তাদের বরণ করেছে। সকলে মিলে টুকটাক গল্পের আসড় জমিয়ে দিয়েছে। এই গরমের মধ্যে আনন্দটাকে দ্বিগুণ বাড়ানোর জন্য উঠোনের মাঝখানে শুকনো কাঠ জ্বালিয়ে দিয়েছে। মোম খুশিতে হাততালি দিতে চেয়েও পারেনি, কারণ সবাই আছে এখানে। সকল দম্পতিদের মধ্যে আগুন, মোমের জুটি বেশি আকর্ষণ করছে। দুজনের গায়ে একই রঙের পোশাক। সকলের মধ্য থেকে রাফি দাঁড়িয়ে উচ্চস্বরে বলে উঠলো,

” শুধু গল্পগুজব করে সময় পাড় করলে চলবে? যারা পার্টনার সহ এসেছেন, তাদের তো রাজ কপাল। আর আমরা যারা সিঙ্গেল তাদের তো ফাটা কপাল! যাইহোক, কোনো গেম খেলার আয়োজন করলে কেমন হয়? ”
প্রিন্সিপাল স্যার ভাবুক চিত্তে উৎফুল্ল সমেত বললেন,
” ভালো হবে। কি গেম খেলা যায়, বলো তো? ”
রাফি, আগুনের দিকে চেয়ে হাস্যোজ্বল মুখে বলল,
” প্রফেসর আগুন, আপনি কিছু বলুন? ”
আগুন নড়েচড়ে উঠল। ঠোঁটে ঠোঁট চেপে কিছুক্ষণ চুপ থেকে নরম কন্ঠে জানাল,
” খেলুন, আপনাদের যেটা ভালো লাগে। আমি এসবের মধ্যে নেই। ”
রাফি ভ্রু কুঁচকে জানতে চাইল,
” নেই মানে? তা বললে তো শুনবো না। আপনাকেও খেলায় অংশগ্রহণ করতে হবে। এখানে উপস্থিত প্রত্যেক সদস্যদের খেলতে হবে। এটা একধরনের মজা, কেউ হেয়ালি করবেন না। ”
আগুন ঠোঁট দুটি গোল করে ভারিক্কি নিঃশ্বাস ছাড়ল। কোনো প্রতিক্রিয়া দেখাল না। রাফি পুনরায় ভাষণ দেওয়ার ভঙ্গিতে বলল,

” এখানকার স্থানীয় সঙ্গীত বা নৃত্য অনুষ্ঠান আয়োজন করলে কেমন হয়? চিন্তা নেই, আপনারা যারা যেই গান, নাচ পারেন সেভাবেই সকলের সামনে প্রেজেন্ট করবেন। তাছাড়া, স্থানীয় লোকেরা আমাদের সাথে খেলায় অংশ নিবে, এতে তাদের গান, নৃত্য উপভোগ করতে পারবো। সবার মধ্যে আনন্দদায়ক পরিবেশ তৈরি হবে। ”
প্রিন্সিপাল মুচকি হেসে সায় জানালেন। রাফি গলা পরিষ্কার করে খেলার নিয়ম বলতে লাগল,
” কাগজের মধ্যে কিছু লিখে তা ভাঁজ করে অনেক গুলো চিরকুট একত্রে রাখা হবে। সবাইকে তার পছন্দ মতো একটা করে চিরকুট নিতে হবে। সেটাতে যা লেখা থাকবে তাকে সেটা করতে হবে। এক্ষেত্রে দম্পতিদের জন্য একটা লাভ আছে। সেটা হলো, একজন চিরকুট নিলে সে যদি সেটা করতে না পারে, তাহলে তার পার্টনার তার হয়ে ওই কাজটা করে দিতে পারবে। সো এভরি-ওয়ান, আপনারা সবাই বুঝতে পেরেছেন খেলার নিয়ম? ”
সকলে এক সঙ্গে উচ্চ আওয়াজে বলে উঠলো,

” ইয়েস! ”
রাফি একেকটা চিরকুটে কিছু লিখে, ভাঁজ করে সবগুলো চিরকুট একত্রিত করল। স্থানীয় লোকেদের থেকে ছোট্ট একটা ঝুলি নিয়ে সেটাতে চিরকুট গুলো রাখল। প্রথমেই প্রিন্সিপাল স্যারকে একটা চিরকুট উঠাতে বলল। প্রিন্সিপাল মুচকি হেসে একটা চিরকুট তুললেন। সেটাতে লেখা নাচতে হবে। প্রিন্সিপাল হো হো করে হেসে উঠলেন। হাসতে হাসতে বললেন,
” এই বয়সে আমি নাচবো? ”
রাফি উৎফুল্ল চিত্তে ভারিক্কি গলায় বলল,
” অবশ্যই স্যার। আনন্দের কোনো বয়স হয় নাকি? ”
” চেষ্টা করছি। ”

রাফি ছোট্ট একটা মিউজিক বক্সে পুরোনো দিনের গান ছেড়ে দিল। প্রিন্সিপাল গানের তালে যেমন পেরেছেন, নেচে দেখালেন। মোম হাসি মুখে পুরোটা মুহূর্তটা উপভোগ করল। আগুন খেলায় মনোযোগ কম দিয়েছে, সে তো হাসিমাখা বউয়ের মুখশ্রী দেখতে ব্যস্ত। যে ছেলে বউ ছোট বলে বিয়ে করবে না, করবে না বলে চিৎকার করে বাবার সাথে মনোমালিন্য পর্যন্ত করেছে, সে ছেলে এখন পিচ্চি বউয়ের প্রতি তীব্র ভাবে আসক্ত হয়ে পড়েছে। মোম থেকে বেশিক্ষণ দূরে থাকতে পারে না, দূরে গেলেই বুকটা কেমন শূন্য শূন্য লাগে।

একে একে সবাইকে চিরকুট দেওয়া হলো। যার চিরকুটে যেটা লেখা ছিল সবাই সেটা আনন্দ সরূপ করে দেখিয়েছে। স্থানীয় লোকেরা তারাও খেলায় অংশগ্রহণ করে নাচ, গান করে সবাইকে আনন্দ দিয়েছে। কিন্তু যখন আগুনের পালা আসলো, তখন সে বেঁকে বসলো। কারণ, তার চিরকুটে নাচতে বলা হয়েছে। আগুন তো নাচতে পারে না, আর আগুনের পার্টনার মোম। মোম’কে তো আগুন নাচতে কিছুতেই দিবে না। রাফি বিরক্তিকর মুখভঙ্গিতে বলে ওঠে,
” আগুন স্যার, আপনি কিন্তু খেলার নিয়ম ভঙ্গ করছেন। প্রিন্সিপাল স্যারও তো নাচতে পারছিলেন না, তবুও তিনি যেমন পেরেছেন নেচে দেখিয়েছেন। আপনি একটু নেচে দেখালে কি হবে? ”

আগুন মুখ কুঁচকায়। রাগ হচ্ছে ভীষণ। বেশিরভাগ সিনিয়র, তাই চেঁচিয়ে কিছু বলতেও পারছে না। কিছুটা ঝাঁঝ সমেত তিরিক্ষি মেজাজ নিয়ে বলল,
” দেখুন, আমি নাচতে পারি না। শুধুশুধু জোর করে তো লাভ নেই। ”
রাফি বাঁকা হাসল। উচ্ছ্বসিত কন্ঠে শুধাল,
” আচ্ছা নাচতে না পারলে আপনাকে এখন যেটা করতে বলবো, সেটা করে দেখান। ”
আগুন ভ্রু কুঁচকে ফেলল। চওড়া গলায় জানতে চাইল,
” সেটা কি? ”
রাফি গলা খাঁকারি দিয়ে জানায়,

” আমাদের সকলের সামনে রোমান্টিক একটা গান গেয়ে ভাবি’কে প্রপোজ করতে হবে। ”
আগুন অকপটে জবাব দিল,
” এটাও পারবো না। ”
ক্ষেপে গেল রাফি। নাকের পাটাতন ফুলিয়ে খোঁচা মেরে বলল,
” জনতাম পারবেন না। স্টুডেন্টদের টিচিং দেওয়া ছাড়া আর কিছুই পারেন না। জানা আছে আমার। আহা রে! পিচ্চি ভাবিটা কত আশা করে ছিল বরের থেকে ঘুরতে এসে রোমান্টিক কিছু মুহূর্ত উপহার পাবে। সেটা আর হলো না। তার বর তো আনরোমান্টিক! ”

আগুন বিড়বিড় করে বলল,
” আমি রোমান্টিক কি না, সেটা আপনার ভাবি রুমে গেলেই টের পায়। ”
” কি বিড়বিড় করছেন? আমাদের শুনিয়ে বলুন। ”
আগুন তপ্ত শ্বাস ছাড়ল। মোমের দিকে নজর রেখে ভরাট স্বরে বলে,
” দ্বিতীয় অপশন চয়েস করলাম। ”
রাফি ঠোঁট এলিয়ে হাসল। খুশিতে গদগদ হয়ে বলল,
” এই না হলে আগুন স্যার! শুরু করুন। ”

মোমের হাত ধরে আগুন উঠোনের মাঝখানে আসলো। মোম আড়চোখে আশেপাশের মানুষের দিকে তাকাচ্ছে। সকলের নজর এই দম্পতির দিকে। মোমের লজ্জা লাগছে। আগুনের গান শোনার জন্য সবাই উৎসুক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। মোম নিজেও ভীষণ এক্সাইটেড। নিস্তব্ধতা কাটিয়ে আগুন গলা ছেড়ে গেয়ে উঠলো,
❝ ভালোবাসবো, বাসবো রে
বন্ধু, তোমায় যতনে।
আমার মনের ঘরে
চান্দের আলো, চুইয়া চুইয়া পড়ে।
পুষে রাখবো, রাখবো রে
বন্ধু, তোমায় যতনে।
ভালোবাসবো, বাসবো রে,
বন্ধু, তোমায় যতনে। ❞

গান গাইতে গাইতেই মোমের কোমর প্যাঁচিয়ে দূরত্ব ঘুচিয়ে নিলো। মোম হা করে সন্তুষ্টির চোখে আগুনের দিকে চেয়ে আছে। আগুনের গানের গলা তেমন ভালো না হলেও, অতটা খারাপও না। মোমের মনে সুখপাখিরা নেচে উঠছে। কুমড়োটা গান গেয়েছে, তার জন্যে? বিশ্বাস করতে পারছে না। আগুন গোলাপি অধর জোড়া নেড়ে নেড়ে, মোমের চোখে চোখ রেখে নিরেট স্বরে বলে ওঠে,
” অ্যাই কোমলমতি, বক্ষপিঞ্জরে জায়গা তো করেই নিয়েছ। বাকিটা জীবন তোমার পাশে, তোমার সাথে থাকার অনুমতি পাবো কি? আমার রাগ, আমার শাসন, আমার জেদ সবকিছু মেনে নিয়ে থাকবে কি আমার সাথে? আমার মনের অপ্রকাশিত অনুভূতি মেশানো কথাগুলো, তুমি তোমার হৃদয়ের ব্যাকুলতা দিয়ে বুঝে নিও। আমি যেমন, তেমন ভাবেই আমি টাকে মেনে নিবে কি? বলো আমার কোমলমতি? ”

মোম একরাশ মুগ্ধতা নিয়ে আগুনের বলা সকল কথা তৃপ্তি সহ শ্রবণ করেছে। কি বলছে, এই কুমড়ো মার্কা লোকটা? মোম তাকে মেনে নিবে কি না, জানতে চাচ্ছে? মোম তো কুবল বলার পর থেকে এই মানুষটা’কে নিজের একান্ত আপন, ব্যক্তিগত মানুষ রুপে স্বীকার করে নিয়েছে। মানুষটার মোহ, বাচনভঙ্গি, যত্নে আটকেছে ক্ষণে ক্ষণে।
পাশ থেকে রাফি সহ বাকিরা চিল্লিয়ে বলছে,

শুভ্ররাঙা ভালোবাসা পর্ব ২৮

” ভাবি, উত্তরটা দিয়ে দেন। বেচারা স্যার কতটা আবেগ সমেত, উদ্বেগ নিয়ে আপনার দিকে চেয়ে আছে। ”
মোমের চোখে জলকণা উঁকি দিচ্ছে। বারকয়েক পলক ঝাপটিয়ে, ধীর গলায় বলে উঠলো,
” আমি আপনার সকল কথায় রাজি, মাস্টার মশাই। ”
আগুন চোখ বুঝে নিলো। লম্বা শ্বাস টেনে প্রশান্তির নিঃশ্বাস ত্যাগ করল। রাফি সশব্দে সিটি বাজাল। সবাই এক সাথে জোরে হাততালি দিয়ে, ওদের শুভেচ্ছা জানাল।

শুভ্ররাঙা ভালোবাসা পর্ব ৩০