রাজনীতির রংমহল সিজন ২ পর্ব ৬৬(৩)

রাজনীতির রংমহল সিজন ২ পর্ব ৬৬(৩)
সিমরান মিমি

সরদার মঞ্জিল,স্থান টা বর্তমানে গেট।সেখানেই রয়েছে পাঁচ থেকে ছয়জন ডেকোরেশনের কর্মচারী।যারা বেশ বিশাল আকারে রাজকীয় গেট সাজাতে ব্যস্ত।এখনো ঝাঁড়বাতি টাঙানো হয়নি।মাত্রই রঙ বেরঙে পর্দাগুলো বাশের উপর পেঁচানো হচ্ছে।বাড়িতে ঢোকার প্রথম পর্বেই বিয়ের গেট থেকে থমকে গেল স্পর্শী।ক্লান্ত চোখদুটো বিষন্নতায় বুঝে এলো।গাড়ি গেট পেরিয়ে ভেতরে ঢুকলো।স্পর্শী আবারো চমকালো।বিশালাকার চত্তর পুরোটাতে বাঁশ পোতা হচ্ছে।শামসুল সরদারের ইচ্ছা তার মেয়ের বিয়ে কোনো কমিউনিটি সেন্টারে নয়।বরং তার নিজ বাড়িতেই দিবেন।বাবার কথা মনে আসতেই কলিজা টা মোঁচড় দিয়ে উঠলো স্পর্শীর।এইতো গতরাতেই বাবার মুখে শুনেছে বরযাত্রীকে এখানেই খাওয়ানো হবে।অনায়াসে হাজার লোক বসতে পারবে এই চত্তরে।বোনের বিষন্ন মুখের দিকে তাকিয়ে ভ্রুঁ কুঁচকালো সোভাম।কন্ঠে নমনীয়তা এনে বললো,

_”সাজানো কি পছন্দ হয়নি তোমার?”
স্পর্শী চমকালো।নোয়ানো লোঁচন খানি অল্পবিস্তর প্রসারিত করে ভাইয়ের মুখের দিকে লক্ষ্য করলো।মুখে আওড়ালো,
_”আমি রুমে যাব।”
সোভাম তাই করলো।বোনকে ধরে সদর দরজা দিয়ে ভেতরে প্রবেশ করতেই দৃষ্টি পড়লো বাবার দিকে।তিনি স্পর্শীকে দেখামাত্রই দ্রুতপায়ে এগিয়ে এলেন।তড়িঘড়ি করে মেয়েকে ধরে বললেন,
_”একি!কি হয়েছে তোমার?সোভাম কেন ধরে রেখেছে তোমাকে?”
_”আব্বু,ওর শরীর খারাপ লাগছে।সারাদিনে না খাওয়া।”
ক্ষুদ্ধ হলেন শামসুল।ধমকের সুরে বললো,

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

_”সারাদিন খাওয়া-দাওয়া বাদ দিয়ে এভাবে অসুস্থ হওয়ার মানে কি?আগামীকাল বিয়ের অনুষ্ঠান সেটা কি ও ভুলে গেছে?_এরপর মেয়ের দিকে তাকিয়ে বললেন,”কোথায় গেছিলে?”
স্পর্শী উত্তর দিলো না।আলগোছে ভাইয়ের হাত ছাড়িয়ে ক্লান্ত পায়ে উঠে গেল দোতলায়।শামসুল সরদার হতাশ হলেন।মেয়ের চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে বললেন,_”মেয়েটা কারো কথা শোনে না।এতটা একরোখা কিভাবে যে হলো।”

সোভাম বাবার দিকে তাকিয়ে হাসলো।বললো,_”ঠিক হয়ে যাবে।এতো চিন্তার কিচ্ছু নেই।পরিবারের মধ্যে এমন একজন জেদি,একরোখা মনোভাবের কাউকে দরকার।নাহলে সবাইকে সোজা রাখবে কে?”শামসুল সরদার নিজেও হাসলেন।এরপর ছেলের কাঁধে হাত রেখে রুমের দিকে যেতে যেতে বললেন,_”সেটা ঠিক।কিন্তু এভাবে না খেয়েদেয়ে রোগ বাঁধাবে,কাল যে বিয়ে।সেটা তো মাথায় রাখা উচিত।ওর যে আরো একটা পরিবার হচ্ছে সেটার কথাও মাথায় রাখা উচিত।”
থেমে ছেলের দিকে তাকিয়ে ভাবলেন।এরপর কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয় মনে পড়ে যেতেই বললেন,_”তোমার সাথে কিছু কথা ছিলো আমার।”

_হ্যাঁ বলো।”
_”রুমে আসো।গুরুত্বপূর্ণ কথা।এভাবে বলা যায় না।আমি তোমার সাথে আমার ভাবনার বিষয়ে আলোচনা করতে চাইছি।”
সোভাম চমকালো।সন্দেহী দৃষ্টিতে বাবার দিকে তাকিয়ে কপাল কুঁচকে রইলো।এরপর ধীরপায়ে এগিয়ে গেল তার পিছু পিছু।কক্ষে প্রবেশ করতেই দুয়ার বন্ধ করে দিলেন শামসুল।ছেলেকে বিছানায় বসতে বলে নিজেও বসলেন।মুহুর্ত খানিক গভীর ভাবে ভাবলেন।পরক্ষণে নিজেকে সাজিয়ে ছেলের উদ্দেশ্যে বললেন,

_”দেখো বাবা।আমি জানি তুমি রাজনীতি পছন্দ করো না।শুধুমাত্র এটা আমার শখের জায়গা বলে আমাকেও বাঁধা দিতে পারছো না।এই ঝামেলা,মারামারি, মিছিল-মিটিং সমস্তটা তোমার অপছন্দের সেটাও আমি জানি।গত কয়েকদিন ধরে অনেক ভেবেছি।আমি তোমায় এবার স্বস্তি দিতে চাই।এমনিতেও বয়স হয়েছে অনেক।তাছাড়া সবচেয়ে যেটা গুরুত্বপূর্ণ সেটা হলো আমার মেয়েরা।রাজনীতিতে শিকদার -সরদার ছাড়া সেরকম ভাবে বিরোধী কেউ নেই।থাকলেও তারা মাথা উঁচিয়ে দাঁড়াতে পারছে না।বিভিন্ন সময় কারনে-অকারণে ঝামেলা বাঁধছেই।আর সেটা আমাদের মধ্যে একটা ক্ষোভের সৃষ্টি করছে।

তুমিই ভাবো,শিকদার দের সাথে কিন্তু আমার তেমন কোনো ব্যক্তিগত শত্রুতা নেই;শুধুমাত্র রাজনৈতিক বিরোধিতা ছাড়া।সেক্ষেত্রে সম্পর্ক টা কতটা টক্সিক হয়েছিলো সেটাও তো অজানা নয়।আমার মেয়ে দুটো ওদের বাড়িতে।এখন যদি আবারো সেই রাজনীতি নিয়ে নিজেদের মধ্যে বিরোধীতা হয় তাহলে তার প্রভাব টা ওদের উপর পড়বে,আমাদের সম্পর্কের উপর পড়বে।কিন্তু আমি এটা আর চাই না।আমার মেয়েরা শান্তিতে থাকুক।তাছাড়া তুমি যদি এসবে জড়াতে তাও একটা কথা ছিলো যে আমার পরে তুমি দাঁড়াবে।কিন্তু সেটাও আর হচ্ছে না।তাই ভাবছি এ বছরই রাজনীতি থেকে বেরিয়ে আসবো।এদিকে আমার দল যদি আমার মেয়েজামাই এর পক্ষ নেয় তাহলে পরশের দল আরো ভারী হবে।ওকে টলানোর সূযোগ সহজে কেউ করতে পারবে না।যে ছেলে কিনা প্রথম বার ভোটে দাঁড়িয়েই আমাকে হারিয়েছে;যে আমি কিনা গত পনেরো বছর ক্ষমতায় ছিলাম।সে অযোগ্য হবে না।তুমি এ ব্যাপারে কি বলো?”

সোভাম এক দৃষ্টিতে বাবার দিকে তাকিয়ে রইলো।যেন বিশ্বাস করতেই তার কষ্ট হচ্ছে।এটাই কি সেই শামসুল সরদার যিনি গত সপ্তাহেও মেয়ের বিবাহ দেবেন না বলে অগ্নিশিখার মতো জ্বলে উঠেছিলেন।সেই তিনি কি-না আজ মেয়ে জামাইয়ের সাথে সম্পর্ক খারাপ হবে বলে রাজনীতি ছেড়ে দেবে।
_”কি হলো?তুমি কি রাজি না আমার প্রস্তাবে?”
টনক নড়লো সোভামের।মলিন হেসে বাবার দিকে তাকিয়ে বললো,

_”আমার রাজি হওয়ায় বা না হওয়ায় কি আদৌ কিছু এসে যায় আব্বু?আর রাজনীতির ব্যাপারে যদি বলো সেক্ষেত্রে আরো অনেক আগেই তোমাকে এই অসুস্থ ঝামেলা থেকে বের হতে বলেছি।সেখানে তুমি আজ এতো বছর পর বের হচ্ছো সেটাতে আমার কোনো আপত্তি নেই।বরং আমি খুশি।তোমার বয়স যথেষ্ট হয়েছে।এখনো এসব ঝামেলার মধ্যে না জড়িয়ে শান্তিতে থাকাই শ্রেয়।তবে তুমি যাচ্ছো বলে যে একদম দল নষ্ট করে সেটা পরশ শিকদারের দলকে ভারী করার কাজে লাগাবে এ বিষয়ে আমি একমত হতে পারলাম না।আবার আমি যে এটা চাই না সেটাও নয়।আমি চাই তুমি সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে আরো সজাগ হও,সময় নেও,সচেতন হও।হুট করে দল নষ্ট করবে,সবাই তোমার মেয়েজামাই হিসেবে পরশ শিকদারের দলে নাম লেখাবে।এরপর তোমার যেকোনো বিপদে বা ঝামেলায় যে তারা আবারো তোমার জন্য পরশ শিকদারের সাথে লড়বে এমনটা ভাবা কিন্তু বোকামি।যাই হোক,ভেবে-চিন্তে সিদ্ধান্ত নাও।আমি গোসলে যাচ্ছি।”
শামসুল সরদার আবারো ভাবনার সাগরে ডুবে গেলেন।ছেলে যে তার খুব বেশি অযৌক্তিক কথা বলেছে সেটাও নয়।তার সত্যিই হয়তো সময় নেওয়া উচিত।

চোখ দুটো বুঁজে লাইট অফ করে শুয়ে আছে স্পর্শী।অক্ষিকোটরের দুপাশ থেকে অশ্রুকণা গুলো ঝরছে অবিরত। পুরো মস্তিষ্ক জুড়ো অসম্ভব যন্ত্রণা।কর্ণকুহরে প্রতিক্ষণে বাজছে শুধু একটা লাইন।_”তোকে খুন করতে আমার হাত একবার ও কাঁপবে না।”
আচ্ছা,সত্যিই কি তাই?স্পর্শীয়া কি এতোটাই ঠুনকো পরশ শিকদারের কাছে?তার প্রতি কি কোনোরকম মায়া-মমতা,ভালোবাসা নেই?কোনো টান ই কি কাজ করে না?কিভাবে তাকে মারার কথা বলতে পারলো?বুক টা কি একটুও কেঁপে উঠলো না?কই সেতো কখনো পরশ শিকদারের মৃত্যু কামনা করতে পারে না।ভয় হয়,কান্না পায়,বুকে অসহ্য বেদনা হয়।তাহলে পরশের কেন হয় না?সে এতটা নিষ্ঠুর হয় কি করে তার প্রতি।নিজের রাজনীতি, ক্যারিয়ার,দলের লোক কি স্পর্শীর থেকেও বেশি প্রিয়?”

একের পর এক প্রশ্ন খুঁজছে স্পর্শীয়া।কিন্তু কে দেবে এই প্রশ্নের উত্তর?কাকেই বা জিজ্ঞেস করবে?সবাই-ই তো বলবে, _”তুই জেদ করে বিয়ে করতে চেয়েছিস।আমরা কেউ রাজি ছিলাম না।”
ভাবনার মধ্যেই দরজায় খুট করে আওয়াজ হলো।তড়িৎ গতিতে সেদিকে তাকালো স্পর্শী।সন্ধ্যার আবছা অন্ধকারে বাবার অবয়ব দেখেই সে চিনে নিলো।দ্রুত হাতে চোখ মুছে উঠে বসলো।গায়ে ওড়না দিয়ে লাইট জ্বালালো।শামসুল সরদার এগিয়ে এলেন।মেয়ের পাশে বসতেই চমকালেন।সন্দেহী দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললেন,

_”তুমি কাঁদছিলে কেন?”
স্পর্শী দ্রুতহাতে চোখের কিনারায় হাত দিলেন।কই পানি নেই তো?তাহলে বাবা কিভাবে বুঝলেন।ভাবতেই হেসে দিলো।মেয়ের হাসি দেখে শামসুল নিজেও অবাক হলেন।পরক্ষণেই স্পর্শী বাবা কোল শুয়ে পড়লো।এরপর আহ্লাদী কন্ঠে বললো,
_”কই কাঁদছিলাম না তো?তোমাকে কে বললো আমি কাঁদছি?”
মেয়ের মাথায় হাত বোলাতে লাগলেন শামসুল।গম্ভীর কন্ঠে বললেন,
_”তোমার চোখ লাল।আমি বুঝতে পারি।”

_”বেশি বুঝো তুমি।বলেছিলাম না শরীর খারাপ।জ্বর উঠবে মনে হয়।মাথাও যন্ত্রণা করছে খুব।শুয়েছিলাম, দেখি চোখের কোনায় পানি গড়িয়ে পড়ছে।হয়তো জ্বর আর মাথা ব্যাথার কারনে।বাদ দাও,কিছু বলবে?”
শামসুল চুপ করে মেয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে রইলেন।এরপর শান্ত গলায় বললেন,
_”কাল বিয়ে।দু-বাড়িতেই অনুষ্ঠানের আয়োজন প্রায় শেষ। ভীর রাতের দিকে গরু-ছাগল জবাই দেবো।আর তুমি এখন এতোটা অসুস্থ।আমার মাথা কোনো কাজ করছে না মামুনি।”
চুপ হয়ে গেল স্পর্শী।কিছুক্ষণ পর কাতর কন্ঠে বললো,

_”আব্বু বিয়েটা কি দু/তিন দিন পেছানো যায় না?আমার শরীর টা ভীষণ খারাপ।ওদের বলে দাও না আমি অসুস্থ।আর গরু-ছাগল থেকে যাবতীয় বাজার ঘাট আপাতত বন্ধ করো।ওদের বলে দেও বিয়ে পেছানো হয়েছে।দু-চারদিন পর নিবে।আর বাকি রইলো ডেকোরেশন! সেটা এই পর্যন্তই থাক।বাদ বাকিটা দু-চার দিন পর করতে বলো।আমি জানি হয়তো এতে দু -বাডিতেই কিছু লোকসান হবে।কিন্তু আমি তো অসুস্থ।আর বিয়ে তো একবার’ই হয়।হুট করে দেখা গেল বিয়ের আসরে বসে আমি অজ্ঞান হয়ে গেলাম।না হয় মারা গেলাম।তখন কি করবে?”
সহস্তে মেয়ের মাথা কোল থেকে সরিয়ে দিলেন শামসুল।বিছানা থেকে উঠে কঠোর কন্ঠে বললেন,

_”মরার আগে এই যে যাবতীয় খরচ হয়েছে আমার এগুলো দিয়ে তারপর যাবে।”
বলে গটগট পায়ে বেরিয়ে গেল রুমের বাইরে।স্পর্শী হাসলো।হাসতেই হাসতেই মুখ চেপে ধরলো।চোখ দুটো আবারো বাঁধ ভেঙেছে।কান্নাগুলো দলা পাকিয়ে চিৎকারের সহিত বের হতে চাইছে।মনে মনে ভাবলো,সত্যিই কি সে অসুস্থ?মন উত্তর দিলো হ্যাঁ। সে মানসিক ভাবে অসুস্থ।কোনো একজনের কথা বেশ গভীর ভাবে দাগ কেটেছে তার মনে।

রাত তখন আটটা।সোভাম সব শুনলো।এরপর বাবার চিন্তিত মুখশ্রীর দিকে তাকিয়ে ব্যথিত হলো।তাকে বোঝানোর স্বরে বললো,_”বিষয়টা খুব বেশি সিরিয়াস ও না আব্বু।বিয়েটা স্পর্শীয়ার।সে এখন অসুস্থ।যতোই আমরা এদিকে গোছগাছ করি না কেন তাই বলে একটা অসুস্থ মানুষকে বিয়ের পিঁড়িতে বসানো যায় না।সেটাও তার অমতে।ও নিজেই এই বিয়ের ব্যপারে সম্মতি দিয়েছে।সেখানে খুব বেশি অসুস্থ না হলে কখনোই বিয়ে পেছানোর কথা বলতো না।আমার মনে হয় বিয়েটা ওর সুস্থ হওয়ার পর দেওয়া উচিত।আর এমন তো নয় যে আমরা গরু ছাগল জবাই দিয়ে দিয়েছে।হ্যাঁ বাজার করা হয়েছে অনেক।তো কি?এগুলো কি দু-তিন দিনের মধ্যে পঁচে যাবে?গরু গোয়ালে থাকবে।বাহাদুর কাকা দেখভাল করবে।আর সমস্যা কোথায়?”

ছেলেকে নিজের চিন্তার কারন বোঝাতে না পেরে হতাশ হলেন শামসুল।আহত কন্ঠে বললেন,
_”এটা আমিও বুঝি।কিন্তু সমস্যা টা হলো ওদের বোঝাবে কে?রাত গেলে দিনে বিয়ে আর এখন যদি ফোন করে বলি বিয়ে পেছানোর কথা,তাহলে ওরা কি মানবে?”
_”তোমার কথা বলতে অসুবিধা হলে আমি বলছি।”
এরপর ফোন হাতে নাম্বার খুঁজতেই শামসুল সরদার বললেন,
_”পরশ কে দিচ্ছিস?
_”আমি তার সাথে কথা বলতে মোটেও ইচ্ছুক না।আংকেল কে দিচ্ছি।”
মুখখানা থমথমে হয়ে গেল শামসুলের।কিন্তু টু শব্দটিও করলেন না।ছেলে তার পরশের নাম ও শুনতে পারেন না।হয়তো রাজনীতির জন্যই।

_”আব্বু,কল আসছে তোমার ফোনে।”
সোফায় বসে মনযোগ দিয়ে খবর দেখছেন আমজাদ।রুমের ভেতর থেকে মেয়ের কন্ঠস্বর পেতেই ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালেন।এরপর বিরক্ত কন্ঠে খবরের দিকে তাকিয়ে বললেন,
_”নিয়ে আসো।”
প্রেমা পুণরায় কন্ঠস্বরকে উঁচুতে তুলে বললো,_”আরে কেটে যাবে তো।আননৌন নাম্বার।”
_”রিসিভড করো।”
বাবার আদেশ শুনতেই কল রিসিভড করলো প্রেমা।কন্ঠে নমনীয়তা এনে বললো,
_”আসসালামু আলাইকুম! “থমকে গেল সোভাম।ফোনের ও-প্রান্ত থেকে এই মেয়েলি কন্ঠস্বর সে মোটেও আশা করেনি। কান থেকে ফোন টা নামিয়ে নাম্বার টা আরেকবার চেক করে নিলো।এরপর জিভের ঢগা দিয়ে ঠোঁট ভিঁজিয়ে বললো,_” কে?”

ধীর পায়ে নিচের দিকে নামছে প্রেমা।ওপাশ থেকে প্রশ্ন শুনে নাক-চোখ কুঁচকে বললো,_”বারে!না চিনলে ফোন কেন দিয়েছেন?রঙ নম্বরে কল দিয়ে কি মেয়েদের সাথে কথা বলতে ইচ্ছে করে?”
থতমত খেয়ে গেল সোভাম।প্রেমা চোখ বড়সড় করে নিলো।ফোন টা যে বাবার সেটা একপ্রকার ভুলেই গেছিলো। ইশশ!কে না কে ফোন দিয়েছে।কি যে ভাববে ভাবতেই লজ্জা লাগছে।নিজেকে শোধরাতে নমনীয় কন্ঠে বললো,_”শুনুন,আমি প্রেমা শিকদার।আব্বুর মেয়ে।”
এতোক্ষণে চিনতে পারলো সোভাম।প্রেমা নামটা শুনতেই চোখের সামনে ভেসে আসলো ছোট্ট-খাট্টো একটা শরীর।যে অবয়ব টা তাকে জনসম্মুখে প্রেম পত্র দিয়েছিলো।চোয়াল শক্ত করে বললো,_”তোমার আব্বুকে দাও।”
ইতোমধ্যে বাবার হাতে ফোন দিয়ে দিয়েছে প্রেমা।আমজাদ কানে নিয়ে সালাম দিলো।অপর পাশ থেকে বিনয়ের সাথে সোভাম উত্তর দিলো।বললো,_”ওয়ালাইকুম আসসালাম!আংকেল আমি সোভাম সরদার বলছি।”

_”আরে হ্যাঁ হ্যাঁ! বলো।কেমন আছো তোমরা?
_”জ্বী আংকেল।আছি।আপনারা ভালো আছেন?”
আমজাদ কিছুটা থমকালেন।সোভামের এই ছেড়ে ছেড়ে কথা বলাটা মোটেও স্বাভাবিক লাগছে না তার কাছে।সন্দেহী কন্ঠে বললেন,_”সব ঠিক আছে?তোমার বাবা কোথায়?”
সোভাম এ পর্যায়ে বাবার দিকে তাকালেন।এতোক্ষণ ব্যাপার টা ইজি মনে হলেও এই মুহুর্তে খুবই অসস্তি লাগছে।একপ্রকার জড়তা চেপে ধরেছে তাকে।নিজেকে স্বাভাবিক করে বিনয়ের সহিত বললো,

_”আংকেল আসলে কথাগুলো যদিও ফোনে বলা উচিত নয়।কিন্তু আমার মনে হচ্ছে আপনাদের বাড়ি গিয়ে বলতে বলতে আরো দেরী হয়ে যাবে।আসলে স্পর্শীয়া হুট করেই ভীষণ অসুস্থ হয়ে পড়েছে।আমরা বিয়েটা দু/তিন দিন পেছাতে চাইছি।ক্ষমা করবেন।ও নিজেই বলেছে এই মুহুর্তে বিয়ে করা সম্ভব নয়।ডাক্তার কে কল করেছি।উনি এসে যাবেন।বুঝেন’ই তো, বিয়ে তো আর বার বার হয় না।ওর বিয়ে,ও-ই যদি অসুস্থ থাকে,এনজয় না করতে পারে সেক্ষেত্রে আমাদের খারাপ লাগবে।আর বিয়ে বিষয় টাতে তো আর তাড়াহুড়োর কিছু নেই বলুন।”

আমজাদ সব টা শুনলেন।বিয়ে মেয়ের বাড়িতে হওয়ার তাগিদে আপাতত যাবতীয় আয়োজন সেখানেই করা হয়েছে।শিকদার বাড়ি টা শুধুমাত্র সাঁজানো ব্যতীত তেমন কোনো খাওয়া-দাওয়ার রাজকীয় আয়োজন করা হয়নি।তাদের পরিকল্পনা ছিলো সরদার বাড়িতে বিয়ে হবে। এরপর বউ নিয়ে সে রাতেই শিকদার বাড়িতে আসবে।রাত শেষে পরদিন যাবতীয় অনুষ্ঠান আবার শিকদার বাড়িতে হবে।আমজাদ চিন্তিত কন্ঠে বললেন,
_”সমস্যা নেই।অসুস্থতা তো আর বলে কয়ে আসে না।কিন্তু তোমাদের ওদিকে খবর কি?ক্ষতি হবে তো অনেক।”
_”কিছু করার নেই আংকেল।

আমজাদ কি বলবেন সেটা ভেবে পেলেন না।এমনিতেই ঝামেলার উপর ঝামেলা।এখন পরশ কে কিভাবে এই খবর জানাবে সে।সোভাম কে বললো,_”ঠিক আছে,ডাক্তার কি বলে জানিয়ো।”
এরপর কেটে দিলেন ফোন।প্রেমা কৌতূহল নিয়ে বাবার দিকে তাকালো।বললো,
_”কে ছিলো আব্বু?আর কি হয়েছে?”
চমকে মেয়ের দিকে তাকালেন।এরপর স্বাভাবিক কন্ঠে বললেন,_”তোমার ভাবীর বড় ভাই।তোমার ভাবী অসুস্থ।বিয়েটা পেছাবে।পরশ আসলে বলো বাবা ডেকেছে।”
এরপর ধীর পায়ে রুমের দিকে এগিয়ে গেলেন।স্ত্রীকে জানানো উচিত।তার থেকে অন্ততপক্ষে সুন্দর কোনো পরামর্শ তিনি পেতে পারেন।

পেছনে বালিশ দিয়ে আধশোয়া হয়ে চোখ বন্ধ করে বসে আছে স্পর্শী।গায়ে পাতলা একটা কাঁথা।পাশেই আর্শি বসে আছে পা গুছিয়ে।সামনে অজস্র মানুষ।স্পর্শীর বিরক্ত লাগছে।এই মাঝরাতে এতোগুলো মানুষ কিভাবে একটা অসুস্থ মানুষের রুমে এসে এভাবে বসে থাকে?একটু আক্কেল-জ্ঞান তো থাকা উচিত যে মেয়েটা ঘুমাবে, সে অসুস্থ।নিচ থেকে অনেক গুলো চেয়ার আনা হয়েছে।আমজাদ শিকদার,আলতাফ শিকদার,পাভেল,প্রেমা,পিয়াশা থেকে শুরু করে সরদার বাড়ির প্রত্যেকটা মানুষ উপস্থিত এই মুহুর্তে। শুধুমাত্র সোভাম মিসিং।পরশ শিকদারকে আসতে দেখেই সে দরজা আটকেছে।কাউকে ডিস্টার্ব করতে বারন করেছে কঠোরভাবে।সবাই টুকটাক আলাপে ব্যস্ত।দূর থেকে একজোড়া হিংস্র চোখের নজর পড়ছে স্পর্শীর উপরে।সে দৃষ্টি অপলক,স্থির। চাহনি তে যেন ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ
পাচ্ছে।স্পর্শী এক ঝলক তাকালো।পরশ দরজার কাছেই চেয়ারে বসে আছে।মুখে কোনো কথা নেই।নানা রকমের ভাবনা-চিন্তা মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে।

সবার আলোচনা শেষে সিদ্ধান্ত হলো আগামী সোমবার বিয়ে। পুরো তিনদিন পর।এরমধ্যে নিশ্চয়ই সুস্থ হয়ে যাবে।আমজাদ স্পর্শীর দিকে তাকিয়ে বললো,
_”বেশ।তুমি বিশ্রাম নাও।যদিও ডাক্তার বলেছে তেমন কোনো সমস্যা না।তারপরেও ঠিকমতো খাওয়া-দাওয়া করো। সুস্থ হয়ে যাবে ইনশাআল্লাহ। ”
স্পর্শী আলতো হেসে মাথা নাড়ালো।পরশ সেই হাস্যোজ্জ্বল মুখের দিকে তাকালো।এরপর শান্ত কন্ঠে সবার উদ্দেশ্যে বললো,_”ও এতো কম সময়ে সুস্থ হবে না।আমার মনে হয় ওকে আরো বেশি সময় দেওয়া উচিত।”
সবাই চমকে তাকালো।পরশ পুণরায় স্পর্শীর দিকে তাকিয়ে বললো,_”তুমি বিশ্রাম নাও।যত খুশি ততো।কিন্তু বিয়ে কালকেই হবে।কোনো অনুষ্ঠানের প্রয়োজন নেই।শুধুমাত্র কাবিন হবে।এরপর তিন দিন কেন;পরবর্তী তিনমাস বিশ্রাম নিও।আমার কোনো সমস্যা নেই।কিন্তু,বিয়ে কালকেই হবে।বুঝেছো?”

চোখজোড়া জ্বলে উঠলো স্পর্শীর।ক্লান্তি ঠেলে রুপ নিলো তেজে।কটাক্ষ করে বলে উঠলো,
_”কোনো কাবিনের দরকার নেই।যেদিন অনুষ্ঠান হবে, বিয়েও সেদিন হবে।আমি লুকিয়ে বিয়ে করছি না যে আগে রেজিস্ট্রি করে রাখতে হবে।আমার বাবা রাজকীয় আয়োজনে বিয়ে দিচ্ছে আমার।সেখানে আগেভাগে সাদামাটা ভাবে কাবিন করার প্রয়োজন কি?”
পরশ শামসুল সরদারের দিকে তাকিয়ে হাসলো।বললো,
_”আপনার মেয়ে অসুস্থ?”
হুট করেই শান্ত পরিবেশ টা কেমন বিধ্বংসী রুপ নিলো।শামসুল সরদার এতোগুলো অতিথির মধ্যে অসস্তিতে পড়লেন।পিপাসা স্পর্শীর কাছে গিয়ে ইশারায় তাকে থামতে বললেন।পরশ চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়ালো। পুণরায় তেজ নিয়ে সবার উদ্দেশ্যে বললো,_”বিয়ে কালকেই হবে।এভাবে না খেয়ে দেয়ে টই টই করে দুপুরের রোদে ঘুরলে সুস্থ মানুষ ও অসুস্থ হয়ে পড়ে।দু-বেলা খেলে আবার সুস্থ হয়ে যাবে।এজন্য বিয়ে পেছানোর কোনো প্রয়োজন পড়ে না।”

ফুঁসে উঠলো স্পর্শী।কন্ঠ উঁচিয়ে বললো,_”আমার অসুস্থতা আপনার নাটক মনে হয়?এতোটা নিচু মন-মানসিকতার আপনি। করবোনা বিয়ে,একশোবার পেছাবে।তিন দিন কেন,আরো তিন যুগ পরেও বিয়ে করবো না আমি যতক্ষণে না আমার মন চায়।”
মেয়েকে ধমকে উঠলেন শামসুল।স্পর্শী বাবার দিকে তাকিয়ে মাথা নিচু করলো।চুপ করে বসে পডলো সেখানেই।কতক্ষণ পর ছলছল চোখে তাকিয়ে বললো,
_”আমার সময় প্রয়োজন আব্বু।”

রেগে গেল পাভেল।চেয়ার ছেড়ে দাঁড়ালো।স্পর্শীর দিকে তাকিয়ে ধমক মেরে বললো,
_”এটা কি ছেলেখেলা নাকি?বিয়ের আগের রাতে বলছেন সময় প্রয়োজন।এটা কি মজা হচ্ছে?হাজার হাজার মানুষ জানে।সবাইকে দাওয়াত দেওয়া হয়েছে । এখন হুট করে এসব বললে মান-সম্মান থাকবে।”
পিয়াশা কি বলবেন কিচ্ছু ভেবে পেলেন না।দ্রুত দাঁড়িয়ে সবার উদ্দেশ্যে বললেন,
_”রাত অনেক হয়েছে।মেয়েটা এমনিতেই অসুস্থ।ওকে ঘুমাতে দেও।এভাবে রাত জাগিয়ে তোমরা সবাই নীতিকথা শোনালে বিরক্ত তো লাগবেই।ঘুমাক,মাথা ঠান্ডা হোক,সকালে উঠলে সব ঠিক হয়ে যাবে।”
বলে ঘর থেকে সবাইকে বের হতে বললেন।ধীরে ধীরে রুম খালি হয়ে গেল।কিন্তু পরশ সেভাবেই দাঁড়িয়ে রইলো।পিয়াশা কিছু বলে উঠতেই শান্ত স্বরে পরশ বললো,_”তুমি যাও।আসছি আমি।”

রাজনীতির রংমহল সিজন ২ পর্ব ৬৬(২)

পুরো রুম খালি হতেই পরশ এগিয়ে গেল বিছানার দিকে। স্বাভাবিক ভাবে বসলো স্পর্শীর পাশে।হাতের তর্জনী দিয়ে স্পর্শীর থুতনি উঁচিয়ে ধরলো।শান্ত কন্ঠে জিজ্ঞেস করলো,
_”তোমার পরিকল্পনা টা ঠিক কি?”
স্পর্শী সরাসরি দৃষ্টি ছুড়ে মারলো।বললো,
_”আপনাকে ভেঙেচুরে নতুন করে গড়া।”
পরশ হাসলো।কটাক্ষ করে বললো,_”এতো সহজ?”
_”দেখা যাবে।”
থেমে আবারো বললো,_”দু মিনিটের মধ্যে রুম থেকে বের হবেন।যাওয়ার আগে লাইট নিভিয়ে যাবেন।”

রাজনীতির রংমহল সিজন ২ পর্ব ৬৬(৪)