পাতা বাহার পর্ব ৩৮
বেলা শেখ
জুম্মার দিন মুসলমানদের জন্য সাপ্তাহিক ঈদের দিন। এই দিন আমাদের দেশে ছুটির দিন! যোহর ওয়াক্তে অন্যান্য দিনের তুলনায় জুম্মার দিনে সকল মসজিদে জলদি অর্থাৎ সারে বারোটার তরি আজান হয়ে থাকে। সবাই আজানের আহ্বান শুনে গোসল সেরে পাক পবিত্র হয়ে, মাথায় টুপি পড়ে আতর মেখে দল বেঁধে মসজিদে যায় যতো দ্রুত সম্ভব! ওইদিন ইমাম সাহেব খুতবা পাঠ করে শোনান। বিভিন্ন হাদিস পাঠ করে শোনান। তারপর নির্দিষ্ট সময়ে জুম্মার নামাজ শুরু হয়! জুম্মা অর্থ জমায়েত হওয়া।
সকল শ্রেণীর মুসলিম উম্মাহ একসাথে এক সারিতে সমবেত হয়ে এক আল্লাহ তায়ালার নিকট সিজদাহ করে। যেখানে জাত, বংশ, ধনী গরীব কোনো ভেদাভেদ নেই। সবাই সমান; এক আল্লাহ পাকের গোলাম! মাথা নিচু করে নিজেদের বশ্যতা স্বীকার করে। দু হাত তুলে দীর্ঘ মোনাজাতে কেঁদে বুক ভাসিয়ে ক্ষমা প্রার্থনা করে! আল্লাহ তায়ালার নিকট আর্জি পেশ করে! শোকর আদায় করে। জুম্মার নামাজ শেষে সবাই নিজ সামর্থ্য অনুযায়ী দান সদকা করে! অনেকে মানত স্বরূপ মসজিদে জিলিপি, মিষ্টি, তবারক বিলি করে! সেই জিলিপি, মিষ্টি, তবারক সবাই গ্রহণ করে। কেউ নিক সিঁটকায় না বরং খুশি মনে সেটা গ্রহণ করে দোয়া করে।
আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন
আতিকুর ইসলাম, অরুণ, রাতুল, কাওছার,লুবমান লাবিব ,ভোর সবাই মসজিদ থেকে ফিরছে একসাথে। ভোর,লাবিবের হাতে আইসক্রিম! ভোর নামাজ শেষে যখন জিলিপি দিলো গোমড়া মুখে সেটা নিয়েছিল। সে তো মোনাজাতে আল্লাহর কাছে আইসক্রিম চেয়েছিল আল্লাহ দিল না কেন? আতিকুর ইসলাম হেসে তাকে ও লাবিবকে মসজিদ সংলগ্ন দোকানে নিয়ে গিয়ে আইসক্রিম কিনে দেয়। এবং বুঝিয়ে বলে যে জিলিপি কে দেয়, কেন দেয়! শুধু তাকে না লাবিবকেও কিনে দেয়। ভোর আইসক্রিম পেয়ে খুব খুশি।
গপাগপ মুখে পুরে খেতে থাকে। অরুণ ভ্রু উঁচিয়ে তাকালে ভোর বাবার কাছে না গিয়ে আতিকুর ইসলামের হাত ধরে হাঁটতে থাকে। হাঁটতে হাঁটতে তাঁরা বাড়ির কাছে আসে। দেখতে পায় পাতা, প্রিয় ও লতা দাঁড়িয়ে আছে রাস্তার ধারে। লতার কোলে ছোট রুম্পা। তিনবোন হাসি ঠাট্টায় মেতে আছে। অরুণ আশেপাশে তাকায়। রাস্তায় অনেকেই আছে; মসজিদ থেকে বাড়ির উদ্দেশ্যে যাচ্ছে তাঁরা। অথচ এরা রাস্তায় দাঁড়িয়ে হি হি করছে। লতা, প্রিয় সালোয়ার কামিজের সাথে ওড়না দিয়ে ঘোমটা টানা থাকলেও পাতার পড়নে শাড়ি। যদিও মাথায় আঁচল দিয়ে ঘোমটা টেনেছে তবুও ব্যাপারটা মোটেও ভালো দেখাচ্ছে না। অনেক মুরুব্বি জোয়ান গোছের লোকজন যাচ্ছে। যাদের নজর ওদিকেই! অরুণের শান্ত মেজাজ বিগড়ে গেলো। তাদেরকে দেখে লতা, পাতা, প্রিয় হাত নাড়ে। ভোর লাবিব দৌড়ে যায়। কে আগে তার আম্মুকে ধরতে পারে। দুজন তীব্র গতিতে ছুটছে। লাবিব এগিয়ে আছে ভোরের থেকে। ভোর আরো জোরে দৌড়াতে থাকে কিন্তু লাবিবের আগে পৌঁছাতে পারে না। লাবিব লতাকে ধরে আনন্দে আত্মহারা হয়ে বলে,
-” ইয়ে আমি জিতে গেছি! ভোর তোমার আগে ধরেছি আম্মুকে!”
ভোর দৌড়ে এসে হাঁটুতে ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে হাঁপাতে হাঁপাতে বললো,
-” আমি ইচ্ছে করেই হেরে গেছি লাব্বু ভাইয়া!”
লাবিব হেসে ব্যাঙ্গ করে বলে,
-” তাই না!”
ভোর ক্লোজ আপ হাসি দিয়ে সায় জানালো। পাতার কোমড় জড়িয়ে ধরে। পাতা সহ সবাই হেসে উঠলো। এরইমধ্যে বাকি সবাই এসে উপস্থিত হয়। আতিকুর ইসলাম গম্ভীর গলায় ধমকের সুরে বলল,
-” বাড়িতে জায়গার অভাব পড়েছিল? রাস্তায় দাঁড়িয়ে কিসের হাসাহাসি?”
লতা, পাতা, প্রিয়র মুখ খানি চুপসে যায়। তড়িঘড়ি পা চালায় বাড়ির উদ্দেশ্যে। বাকি সবাই তাদের পিছনে। পাতা হাঁটার গতি মন্থর করে অরুণের পাশাপাশি হাঁটে। অরুণ আড়চোখে পাশে তাকিয়ে দেখলো পাতাকে। তার মেজাজটা খানিক শীতল হবে হবে ভাব। সে গলা খাঁকারি দিয়ে প্রস্তুতি নেয় পাতাকে কিছু বলার জন্য কিন্তু তার আগেই পাতা গায়েব! পাতাকে আসতে দেখে কাওছার জিলিপির প্যাকেট লুকিয়ে ফেলল। পাতা হেসে বলল,
-” লুকিয়ে লাভ নেই! দাও বলছি কাওছার ভাই?”
কাওছার হার মানে। জিলিপির প্যাকেট দিয়ে দেয়! ছোট থেকেই প্রতি জুম্মার দিনে জিলিপি দিলে কাওছার আনবে। আর তার আনা জিলিপির একমাত্র ভাগিদার পাতা। কাওছারের বোন জুবাইদাকেও দিতনা একটা! পাতা জিলিপির প্যাকেট ছিঁড়ে একটা মুখে পুড়ে। প্রিয় এগিয়ে এসে বলল,
-” পাতুপু একা খাবে নাকি! আমাদেরও হক আছে!”
-” একদম নেই! কাওছার ভাইয়ের বিয়ের আগ পর্যন্ত এটাতে শুধু আমার অধিকার! তাই না কাওছার ভাই?”
পাতার কথায় কাওছার মুচকি হেসে মাথা নাড়ে। পাতাও মুচকি হেসে জিলিপি খাওয়ায় মনোনিবেশ করে। তিরিক্ষি মেজাজের অরুণের চোয়াল শক্ত হয়ে গেল নিমিষেই। কথাগুলো খুবই কটু শোনালো তার কর্ণগহ্বরে। প্রিয়কে ডেকে জিলিপির দুটো প্যাকেট তার হাতে দিলো। প্রিয় খুশি হয়ে পাতাকে প্যাকেট জোড়া দেখিয়ে ভেংচি কাটলো। পাতার কপালে ভাঁজ পড়ে। লতা পিছনে তাকিয়ে অরুণের উদ্দেশ্যে হেসে বলল,
-” এটা কিন্তু না ইনসাফি ভাইয়া! আমারও হক আছে!”
প্রিয় একটা প্যাকেট তার দিকে বাড়িয়ে বলল,
-” ধরো নাও তোমার হক!”
লতা হাতে নেয়। মেয়েকে কার কাছে দেবে ভাবলো! ছোট্ট রুম্পা অরুণের দিকে হাত বাড়িয়ে আ আ বুলি আওড়ায়! অরুণ হাত বাড়িয়ে কোলে নেয় রুম্পাকে। ঠোঁট ডাবিয়ে গালে চুমু খায়। অপরদিকে ভোর আতিকুর ইসলামের পাশ থেকে গাল ফুলিয়ে আড় চোখে তাকায় বারংবার। অরুণও তাকায় ছেলের গোমড়া মুখের দিকে। ভোর ঘার ফেরায়; তাকায় না আর। ওই পঁচা মেয়ে বাবু কাল তার চুল টেনে ছিঁড়ে দিয়েছিল। আর আব্বু ওই পঁচা মেয়েকে আদর করছে। সে পাতার কাছ ঘেঁষে হাঁটতে লাগলো। তারা বাড়িতে প্রবেশ করবে তখনি বাড়ি সংলগ্ন সামনের রাস্তায় একটা গাড়ি এসে থামে। অরুণ রুম্পাকে কোলে নিয়েই গাড়ির পাশে দাঁড়ালো। গাড়ি থেকে একে একে নেমে আসে সবাই। আসমা বেগম,আদুরি, রুবি, আরিয়ান! আরিয়ানের কোলে আনিকা। আর আদুরির কোলে রূপ! পাতা এগিয়ে এসে সালাম জানায়। আদুরির কাছ থেকে রূপকে কোলে নেয়। আনিকার গাল টিপে দিল সাথে আরিয়ানকে ভেংচি কাটতে ভুলে না। আতিকুর ইসলাম সহ বাকি সবাই এগিয়ে আসে। আগত মেহমানদের সাথে হাসিমুখে কুশল বিনিময় করে সানন্দের সাথে স্বাগত জানিয়ে ভিতরে নিয়ে যায়।
সরকার বাড়ির সোফায় বসে কাঁদছে মিনু। এ কান্নার শেষ নেই। ঘন্টা দেড়েক হবে মিনু কান্না শুরু করেছে এখনো থামার নাম নেই। মাঝে মাঝে কান্নার গতি কমে আসে, আবার কখনো বেড়ে যায় হুট করে। আভারি দূর্বল কাঁপা কাঁপা গলায় কান্না করতে বারণ করে। মিনুর কান্না তখন থামার বদৌলতে বেড়ে যায় চক্রবৃদ্ধিহারে। আভারি হতাশ হয়। এই মেয়ে মানুষ এতো এতোটা আবেগী হয়? পাগলীর দল সব! আভারি আর কান্না থামানোর কথা বলে না। কিচেনে গিয়ে ফ্রিজ খুলে কয়েকটি কমলা বের করে ছিলে কোয়া ছাড়িয়ে জুস মেকারে দেয়। জুস বানিয়ে গ্লাসে ঢালে। কিচেনের কেবিনেটে থাকা কেকের স্লাইড, পাউরুটি, ক্যাচাপের বৈয়াম ও একটা চামচ একটা ট্রেতে করে নিয়ে সামনে টি টেবিলে রেখে মিনুর পাশে বসলো! টি টেবিলে থাকা সেন্ট্রাল হসপিটালের দেয়া মিনুর রিপোর্ট নাড়াচাড়া করে পাশে রাখে। মিনুর মাথায় হাত বুলিয়ে আদুরে গলায় বলল,
-” কাইন্দো না! আর কত কাইন্দবে? বাদ দেও তো! জলদি কইরে এসব খাইয়ে নেও! সকাল থেকে কিচ্ছুটি খাও নাই!”
মিনু আঁচলে চোখের জল মোছার বৃথা চেষ্টা করে ক্রন্দনরত সুরেই বলে,
-” আমার গলা দিয়ে এখন কিছু নাইমবে না! খাইবো না আমি! আপনি খান!”
আভারি শক্ত করে বলল,
-” যা বইলতেছি করো! খাও? ডাক্তার আপা কি বললো মনে নাই? বেশি বেশি খাইতে বলছে!”
বলেই মিনুর কপালে হাত রেখে জ্বর পরখ করে। না! জ্বর নেই বললেই চলে। আশ্চর্য এতো জলদি জ্বর নেমে গেল!! দুপুরের দিকে তো গায়ে হাত রাখাই যাচ্ছিল না তাপে। ওষুধ বিনা একটা রিপোর্টেই জ্বর গায়েব? আভারি জুসের গ্লাসটা মিনুর মুখে দেয়! মিনু পুনরায় আঁচলে চোখ মুছে এক চুমুক দিলো। এখন সন্ধ্যা বেলা! আজান দিবে। মিনু কোনো প্রকার ছুট বাহানা না দিয়ে সব খেয়ে নিলো!
-” আপনে একটু অরুণ স্যাররে কল করেন? জলদি আসতে বলেন না? ভোর বাবার জন্য পরানটা পুইড়তেছে!”
উদ্বিগ্ন স্বরে বলে মিনু। আভারি খানিক হেসে বলল ,
-” কাল রাইতে গেল শশুর বাড়ি আইজই আইসবে? কটা দিন থাইকবে না?”
মিনু মন খারাপ করে উঠে ঘরে গেল। আজান দিচ্ছে। আভারিকে মসজিদে যেতে বলে; সাথে ওযু করে নিজেও নামাজে দাঁড়ায়! উপর ওয়ালার কাছে দু হাত তুলেই ঝরঝর করে কেঁদে ওঠে মিনু। আল্লাহ তায়ালার লাখ কোটি শুকর আদায় করে বুক ভাসিয়ে দেয়।
নামাজ শেষ করে বাড়িতে এসে আভারি অরুণের কাছে কল লাগায়! টুকটাক কথা বলে কল কেটে মিনুকে ডেকে বলে সবাই আসছে। মিনু খুশি হয়! রান্না চড়াতে যায় । আভারি গিয়ে লাগায় ধমক অসুস্থ শরীর নিয়ে মহারানি রান্না করতে এসেছে। মিনু ধমক শুনে গাল ফুলিয়ে রাখে। তার গাল ফুলানো দেখে আভারি হাসে। এতো সেই কিশোরী মিনু। সদ্য বিয়ে করা নতুন লাজুক বউ। যাকে ধমক তো দূর একটু উঁচু শব্দে কথা বললে গাল ফুলিয়ে বসে থাকতো। কথা বলতো না, কাছেও ঘেঁষতে দিতো না। রাতে শাশুড়ির কাছে গিয়ে ঘাপটি মেরে শুয়ে থাকতো!
-” রান্না কইরতে হইবে না। সবাই রাইতের খাবার খাইয়ে আসবে!”
আভারির কথায় মিনু আশ্বস্ত হয় না। মিনমিনে সুরে বলে,
-” এতো দূরের রাস্তা! আসতে আসতে তো আবার খিদে লাইগে যাইবে! আমি বরং হালকা পাতলা কিছু রাঁনধি?”
আভারি শান্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে মিনুর দিকে।
-” আচ্ছা বানাও!”
মিনু খুশি হয় তার কথায়! খুশি মনে রান্না করে। ডাল, ভর্তা ভাত ও ডিম ভেজে নেয়। রান্না বান্না শেষ করে মিনু আভারি সকলের প্রতিক্ষার প্রহর গোনে। কিন্তু কারোর আসার নামধাম নেই। রাত দশ বাজতে চলল। বাড়িতে মানুষ বলতে তাঁরা দুজনই আর এক জন বোবা প্রাণী!সেও বসে আছে ব্যাথিত নয়নে মেইন ফটকের পানে তাকিয়ে। মাঝে মাঝে মৃদু স্বরে ‘মিও মিও’ ডাকছে। তাকে রেখেই সবাই বেড়াতে গেল!
ঘড়ির কাঁটা ঘুরতে ঘুরতে যখন বারোটার অতি নিকটে পৌঁছে যায় আভারি মিনু খেয়ে নেয় রাতের খাবার। বিড়াল শাবকটিকে ও ক্যাট ফুট দেয়। সে ফটাফট খাবার সাবার করে আভারির পা ঘেঁষে বসে থাকে। ঘড়ির কাঁটা সারে বারোটার ঘরে পৌছানো মাত্রই কলিং বেল বাজার শব্দ হয়। আভারি ধরফরিয়ে ওঠে। একটু চোখ লেগে গিয়েছিল তার! কলিং বেলের আওয়াজ শুনে ঘোর কেটে যায়। তড়িঘড়ি করে দরজার কাছে যায়। পিছু পিছু পাতাবাহার লেজ দোলাতে দোলাতে আঁকা বাঁকা পায়ে হেঁটে যায় ধীরে ধীরে। দরজা খুললে ভিতরে প্রবেশ করে সবাই! পাতাবাহার দৌড়ে গিয়ে তার মালিকের পা ঘেঁষে মিও মিও করে। আরিয়ান ঘুমন্ত মেয়েকে কোলে নিয়ে সোফায় বসে মিনুর পাশে! মিনু উঠে দাঁড়ালো।
-” আরে মিনু আপা উঠছো কেন? বসো বসো! এখন কেমন আছো? জ্বর কমেছে?”
আরিয়ানের কথায় মিনু মাথা নাড়িয়ে জবাব দিল জ্বর কমেছে। তবে বসে না, উঁকি ঝুঁকি দিয়ে ভোরকে খোঁজে। দেখতে পায় ভোর ঘুমুঘুমু চোখে ঢুলুঢুলু পায়ে পাতার হাত ধরে আসছে। পিছনে অরুণ সরকার ও বিড়ালছানা। মিনু এগিয়ে এসে ভোরকে কোলে তুলে নিয়ে মুখশ্রী জুড়ে আদরের বন্যায় ভাসিয়ে দিল। ভোর মিষ্টি হেসে মিনুর গলা জড়িয়ে ঘুম জড়ানো গলায় বলল,
-” মিনু খালা ভোর ঘুম!”
বলেই চোখ বুজে। মিনু তার চোখের পাতায় চুমু খেয়ে ঝরঝর করে কেঁদে ফেললো! ভোরের ঘুম ছুটে গেল নিমিষেই! মিনু খালাকে কাঁদতে দেখে তারও কান্না পাচ্ছে! মিনু খালা কাঁদছে কেন? সবার নজর মিনুর দিকে! হঠাৎ এভাবে কাঁদছে কেন? রুবি ঘুমন্ত ছেলেকে নিয়ে আরিয়ানের পাশে বসে। আদুরিও ভাইয়ের পাশে বসে উৎসুক মুখে মিনুর দিকে তাকিয়ে। আসমা বেগম বসেন না। মিনুর কাছে গিয়ে নরম গলায় সুধায়,
-” কি হয়েছে মিনু?”
মিনু বলতে পারে না কান্নার চোটে। ভোরের আঁখি যুগলও ভরে ওঠে। আরিয়ান মেয়েকে সোফায় শুইয়ে দিয়ে উঠে এসে আভারির কাঁধে হাত রেখে জিজ্ঞেস করে ‘কি হয়েছে’। আভারি টি টেবিলের উপরে থাকা রিপোর্ট তুলে এনে পাতার কাছে দেয়। পাতা কপালে ভাঁজ ফেলে রিপোর্ট খুলে। মিনু আপার মেডিক্যাল রিপোর্ট! কি হয়েছে মিনু আপার? সে পেজ উল্টিয়ে দেখে। কিন্তু কিছুই বুঝতে পারে না। কিসের রিপোর্ট এটা? পাতা রিপোর্ট থেকে নজর উঠিয়ে সবার দিকে তাকায়। সবার উৎসুক প্রশ্নাত্নক দৃষ্টিতে তার দিকেই তাকিয়ে। পাতা আমতা আমতা করে। সে তো কিছুই বুঝতে পারছে না। আশ্চর্য আভারি ভাই তার হাতে দিলো কেন? সে কাঁচুমাচু করে রিপোর্টটা পাশে দণ্ডায়মান অরুণের দিকে বাড়িয়ে দেয়। অরুণের ভ্রু কুটিতে ভাঁজ পড়ে। হাত বাড়িয়ে নেবে তার আগে আরিয়ান খপ করে নিয়ে রিপোর্ট পড়তে শুরু করে।
-” ভাই তোর আম পাতা জোড়া জোড়া সামান্য মেডিকেলের রিপোর্টই পড়তে পারে না! এ নাকি স্কুল টিচার! আমার তো ঘোর সন্দেহ হচ্ছে! সার্টিফিকেট, এন আই ডি কার্ড একটু পরখ করে নিস!”
পাতা কটমট করে চায়। দাঁতে দাঁত চেপে হিসহিসিয়ে বলে,
-” আমি কোনো ডাক্তার নই যে রিপোর্ট দেখবো আর গলগল করে বলে দেব!”
আরিয়ান বত্রিশ পাটি বের করে হেসে বলল,
-” অ আ, ক খ,এ বি সি ডি, রিডিং পড়তে পারো? রিপোর্ট পড়তে ডাক্তারি পড়তে হয় না!”
পাতা কিছু বলবে অরুণ চোখ রাঙায় তাকে। আরিয়ানকে ধমকের সুরে বলে,
-” ফালতু কথা বাদ দিয়ে বল রিপোর্টে কি লেখা আছে?”
আরিয়ান রিপোর্ট বন্ধ করে অরুণের দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসলো।
-” বউয়ের প্রতি খুব দরদ দেখছি!”
অরুণ কিছু বলবে এর আগেই আসমা বেগমের ধমকে আরিয়ান চুপ করে যায়। রিপোর্ট হাতে নিয়ে আভারির সামনে দাঁড়িয়ে গম্ভীর সুরে বলল,
-” আমার দেয়া আয়ুর্বেদিক হারবাল ঔষধ পত্র কাজে লেগেছে আভারি ভাই! বলেছিলাম না? এখন আমার কমিশন কই?”
আভারি লজ্জা পায় সাথে মিনুও! ভোরকে নামিয়ে দেয় মিনু। অরুণ কোলে তুলে নেয় ছেলেকে। আদুরি ঘুম জড়ানো গলায় বলে,
-” এতো সাসপেন্স রাখছো কেন জলদি বল না ?”
পাতার মুখশ্রীতে চিন্তার আভাস! আয়ুর্বেদিক হারবাল? সে তো কিছুই বুঝতে পারে নি!
-” আয়ুর্বেদিক হারবাল কিসের জন্য? কি হয়েছে ক্লিয়ার করে বলছেন না কেন?”
আরিয়ান পাতার দিকে আড়চোখে চেয়ে হেসে আভারিকে বলল,
-” সেটা আমাদের পার্সোনাল ব্যাপার। মিষ্টির হাঁড়ি আনো আম পাতা জোড়া জোড়া! আভারি ভাই বাবা হচ্ছে! মিনু আপা প্রেগন্যান্ট! থ্রি মান্থ রানিং!”
সবাই অবাক চোখে মিনুর দিকে তাকায়! মিনুর ক্রন্দনরত মুখের দিকে তাকিয়েই সব পরিষ্কার হয়ে যায়। অবশেষে এক অভাগীর শূন্য কোল পূর্ণ হতে চলেছে। পাতা, আদুরি, রুবি মিনুকে জড়িয়ে ধরে অভিনন্দন জানায়। আসমা বেগম তার মাথায় হাত বুলিয়ে দোয়া করে। অরুণ এগিয়ে আসে ছেলেকে নিয়ে। মিনুর মাথায় হাত রেখে বলল,
-” অনেক সুখি হও মিনু আপা! তোমার কোল জুড়ে খুশির চেরাগ আসুক! আল্লাহ তায়ালা তাকে সুস্থ সমেত পৃথিবীতে আসার তৌফিক দান করুক! সাবধানে থাকবে! আভারি ভাই দায়িত্ব বেড়ে গেল কিন্তু!”
মিনু মুচকি হেসে মাথা নাড়ল। অথচ আঁখি যুগল দিয়ে নোনাজল ভেসে আসে। ভোর কিছু বোঝে না।
-” আব্বু কি হয়েছে?”
অরুণ মুচকি হেসে বলল,
-” তোমার মিনু খালার আদরের ভাগ বসাতে আরেকজন আসছে!”
ভোর পিটপিট করে মিনুর দিকে চায়। তার আদরের ভাগ? এরমধ্যে পাতা মিষ্টির প্যাকেট নিয়ে আসে ফ্রিজ থেকে। তার পিছনে পাতাবাহার। পাতা একটা মিষ্টি থেকে অল্প মিষ্টির টুকরো ভেঙ্গে নিয়ে ভোরের মুখে দিয়ে বলে,
-” তোমার মিনু খালা মা হতে চলেছেন! ছোট বাবু হবে তার! রুপ আনির মতো আরেকটা ভাই অথবা বোন আসবে তোমার!”
মিষ্টির দরুণ ভোরের গাল ফুলে যায়। ফুলো গালে মিষ্টি হেসে মিনুকে বলে,
-” মিনু খালা আমার কিন্তু বোন চাই! মিষ্টি বোন!”
মিনু হেসে উঠলো। সাথে বাকি সবাই! পাতা মিনু আভারি সহ সবাইকে মিষ্টি খাওয়ায়। এরপর অরুণের সামনে এসে একটা মিষ্টি বাড়িয়ে দেয়। অরুণ নেয় না। পাতা কপালে ভাঁজ ফেলে মিষ্টি মুখের সামনে ধরলো। অরুণ ঝুঁকে একটু মিষ্টি মুখে নিয়ে সরে যায়। বাকি অংশ পাতা মুখে পুরে নেয়। ঘুরে দাঁড়াতেই আরিয়ানের সম্মুখ হয়। ত্যাছড়া দৃষ্টিতে তার দিকেই তাকিয়ে। পাতা মিষ্টি গলাধঃকরণ করে প্যাকেট থেকে আরেকটা মিষ্টি নিয়ে আরিয়ানের মুখে পুরে দেয় সব টুকুই! জয়ী হেসে কিচেনের দিকে অগ্রসর হয়। বিড়াল শাবকটি তার পায়ে পায়ে হাঁটছে শুরু থেকেই। পাতা একটা মিষ্টি তার সামনে দিয়ে বলে,
-” সবটুকু খাবি? তোকেও দিলাম! আর আমার পিছু আসবি না! খবরদার”
বিড়াল শাবকটি মিও মিও করে মিষ্টি শুঁকে চাটতে থাকলো!
আঁধার রজনী তে আঁধার ঘরে বসে আছে দুজন মানব মানবী। দুজনেই সদ্য নতুন অনুভূতির সাথে পরিচিত হয়েছে আজ! অচেনা উত্তেজনা, শিহরণে চোখে ঘুম ধরা দিচ্ছে না। মেলে রাখা চোখের তারায় আকাশসম স্বপ্ন ভেসে বেড়াচ্ছে! ছোট ছোট শখ, আশা মিলে বুনতে থাকে স্বপ্নের আর্শিমেলা! তাদেরই অস্তিত্ব জুড়ে আস্তে ধীরে বেড়ে উঠছে এক ছোট্ট প্রাণের অংশ! দীর্ঘ বছরের পর শূণ্য কোল পূর্ণ হয়ে একটা ছোট্ট প্রাণের কেঁদে ওঠার সুর ভেসে আসে সেই স্বপ্নের আর্শিতে! শিহরণ বয়ে বেড়ায় শিরায় উপশিরায়। কেঁপে ওঠে তনুমন! হাত পা শীতল হয়ে আসে। ছোট ছোট হাত পা নাড়িয়ে তাদের কোল আলো করবে। হেসে খেলে বেড়াবে। তাদের আঙ্গুল ধরে হাঁটতে শিখবে। অ আ বুলি আওড়াবে! মা বাবা বলে ডাকবে। শতশত আবদার করবে। এতো বছরের স্বপ্ন, আশা, শখ সব পূরণ হবে ইনশাআল্লাহ। মিনু আভারির কাঁধে মাথা রাখলো। আভারি পিঠ গলিয়ে হাত রেখে জড়িয়ে ধরে। মিনু তার অপর হাত নিয়ে পেটের উপর রাখে।
-” অবশেষে খোদা আমাদের ঘরেও সুখপাখি পাঠিয়ে দিলো! আপনার আমার আমরা ব্যাতিত আপনজন আসছে!”
আভারি মিনুর ললাটে চুমু খায়। মিনু অনুভব করে লোকটা কাঁদছে। মিনু কিছু বলে না। কাঁদুক একটু। এ কান্নার মাঝেও যে এক সমুদ্র পানির পরিমাণ আনন্দানুভূতি লুকিয়ে আছে।
গালে হাত দিয়ে বিছানায় বাবু হয়ে বসে আছে ভোর সরকার। গভীর চিন্তায় মগ্ন সে। একটু আগে ঘুমুঘুমু চোখে চিন্তার আবির্ভাব ঘটে ঘুম গায়েব হয়ে গেছে। পাতা ওয়াশরুম থেকে ড্রেস চেঞ্জ করে শর্ট কামিজ ও ঢোলা সালোয়ার পরে বেড়িয়ে আসে। বিছানা থেকে ওড়না নিয়ে গায়ে জড়ায়। বিছানায় চিন্তায় মগ্ন ভোরকে দেখে কপালে গাঢ় ভাঁজ পড়ে। তার পাশে বাবু হয়ে বসে নরম গলায় জিজ্ঞেস করে,
-” কি হয়েছে আমার বাবাটার? কি নিয়ে চিন্তা করছো?”
ভোর পাতার কোলে মাথা রাখলো। পাতা তার চুলের ভাঁজে হাত গলিয়ে দেয়। ভোর কিছু পল চুপ থেকে শান্ত, ঘুম জড়ানো গলায় বলে,
-” আচ্ছা আম্মু? মিনু খালার বাবু আসলে মিনু খালা তাকে অনেক ভালোবাসবে তাই না?”
-” হুম! বাসবেই তো!
পাতা মুচকি হেসে জবাব দেয়! ভোর মলিন মুখে পাতার দিকে তাকিয়ে বলে,
-” আমাকে আগের মতো ভালোবাসবে না,তাই না? ওই বাবুকেই বেশি ভালোবাসবে! ভোরকে অল্প অল্প ভালোবাসবে!”
পাতা ছোট ছোট করে চায় ভোরের মলিন মুখশ্রীর দিকে। ওহ্ এই কারণে চিন্তার অন্ত নেই ভোর সরকারের! পাতা ঝুঁকে ভোরের কপালে চুমু খেয়ে বলে,
-” কে বলেছে ভালোবাসবে না? অবশ্যই ভালোবাসবে। আগের মতোই!”
-” উঁহু। আমি জানি তো! দাদি, চাচ্চু চাচিমনি আমাকে আগে অনেক বেশি ভালোবাসতো!আদর করতো! এখনো করে তবে আগের মতো না। এখন রূপকে ভালোবাসে বেশি। আমাকে কম কম এই এইটুকু। তুমি যেন আব্বুকে বলিও না এ কথা!”
পাতা ভোরের দু গালে চুমু খেলো সশব্দে। ভোর পাতার পেটে মুখ গুঁজে কোমড় জড়িয়ে ধরে। পাতা মুচকি হেসে তার মাথায় হাত বুলিয়ে বলে,
-” রূপকে অনেক বেশি ভালোবাসে এর মানে এই না যে তোমাকে কম কম ভালোবাসে। তোমাকেও অনেক ভালোবাসে। তোমার আব্বু তোমাকে অনেক অনেক ভালোবাসে! সে কি আনি, রূপকে ভালোবাসে না? বাসে তো! বেশিই বাসে। ভালোবাসা কম বেশি হয় নাকি আবার! ভালোবাসা তো ভালোবাসাই। ইকুয়াল ইকুয়াল। তবে হ্যাঁ ভালোবাসা প্রকাশ করার ব্যাপারটা আলাদা। কারো ক্ষেত্রে কম হয় তো কারো ক্ষেত্রে বেশি! ভোর শুনছো?”
না ভোর শুনছে না মোটেই। ভোর সরকার ঘুমে বিভোর হয়ে গেছে। পাতা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে। ভোরকে নিয়ে বালিশে শুইয়ে দিয়ে বুকে জড়িয়ে নিল। ছোটরা তো এমনি! ছোট ছোট বিষয় নিয়েই অভিমান করে বসে থাকে। অথচ আমরা বড়রা সেদিকে ধ্যান দেই না।
একটু পর অরুণ প্রবেশ করে রুমে। পাতা তার দিকে তাকায়। অথচ অরুণ তাকায় না মোটেও! পাতার ভ্রু যুগল কুঁচকে যায়। এই লোকের আবার কি হলো? সে লক্ষ্য করেছে জুমার নামাজ থেকে ফেরার পর লোকটা তাকে এড়িয়ে চলছে। কথাই বলছে না। এমনটা কেন করছে? তাদের মধ্যে তো কোনো তর্ক বিতর্ক হয় নি! না কোনো নোকঝোঁক। তাহলে? হ্যাঁ নামাজের আগে পাতা লোকটার উপর অনেক হেসেছিল। লোকটা রাগি রাগি মুখে চোখ পাকালেও পাতা জানে সেটা মিছিমিছি রাগ ছিলো। কিন্তু এখনকার ভাবসাব দেখে তো সেটা মনে হচ্ছে না। কিছুতো গন্ডগোল আছে। পাতা ভোরকে ছাড়িয়ে বিছানা থেকে উঠে আসে। অরুণ হাতঘড়ি খুলে ড্রেসিন টেবিলে রাখে। পড়নের টি শার্ট খুলে ছুঁড়ে ফেলে নিত্যদিনের মতো! আলমারি থেকে ট্রাওজার নিয়ে ওয়াশরুমের উদ্দেশ্যে যাবে বাঁধ সাধলো পাতা। দুই হাত মেলে বেড়িবাঁধের মতো অরুণের সামনে দাঁড়িয়ে বলল,
-” অনেকক্ষণ হলো আপনার ভাবসাব দেখে যাচ্ছি। কিছু বলছি না। এখন ঝটপট বলে ফেলুন তো কাহিনী কি? আমাকে ইগনোর কেন করছেন? কথাও বলছেন না?”
অরুণ বিরক্তের সহিত পাতার দিকে তাকিয়ে পাশ কেটে চলে যেতে নেয় পাতা আটকে নেয়,
-” আরে ভাই বলুনতো মামলাটা কি? আমি কি কোনো ভুল কিছু করেছি? যদিও আমি হান্ড্রেড পার্সেন্ট সিওর আমি একদম ইনোসেন্ট!”
অরুণ বিরক্ত হয় বেশ। কটমট করে তাকালো পাতার দিকে। পাতা আমলে নেয় না। ভ্রু উঁচিয়ে ইশারায় সুধায় কি হয়েছে? অরুণ আবারো উপেক্ষা করে পাতার কাঁধ ধরে একপাশে নিয়ে সে ওয়াশ রুমে চলে যায়। পাতা আহম্মকের মতো দাঁড়িয়ে। পরে ধীরে সুস্থে ফ্লোরে পড়ে থাকা অরুণ সরকারের টি শার্ট তুলে নেয়। ঘাম ও পারফিউম মিশ্রিত কড়া ঘ্রাণ নাকে বাজে। পাতা নাক কুঁচকে নেয়। পাতার নিকট আকর্ষণীয় পুরুষালী মিষ্টি ঘ্রাণ নাকে না আসায় রেখে দেয় টি শার্ট। বিছানায় পা ঝুলিয়ে ভাবতে থাকে কি তার অপরাধ! না তার কোনো অপরাধ খেয়ালে আসে না। আচ্ছা সে ডাকাত বলেছিল লোকটাকে এইজন্যই কি? সে তো মজা করে বলেছিল! এর জন্য রাগবে না ,তাহলে? হঠাৎ খেয়াল আসে কাওছার ভাইয়ের কথা!
লোকটাটি কাওছার ভাইয়ের সাথে তার মেলামেশা নিয়ে সামহাও জেলাসিতে ভুগেছে? ব্যাপারটা ইন্টারেস্টিং হলে পাতার কাছে ভালো লাগে না! লোকটা কি তাকে সন্দেহ করছে? পাতার উরু উরু মনটা মলিনতার মেঘে ঢাকা পড়ে। ওয়াশরুমের দরজার পানে তাকিয়ে থাকে। সময় নিয়ে অরুণ সরকার বেড়িয়ে আসে। উন্মুক্ত ভেজা শরীরে পানি চুঁইয়ে চুঁইয়ে পড়ছে। পরণে শুধু ট্রাওজার। তোয়ালে দিয়ে মাথা মুছতে মুছতে পাতার সামনে দিয়ে যায়। মেল শ্যাম্পুর কড়া ঘ্রাণ পাতার নাসা গহ্বরে প্রবেশ করে; মন মস্তিষ্কের ভিতর আইলা ঝড় তুফান বয়ে তছনছ করে দেয়। পাতা দিন কাল ভুলে অরুণের দিকে তাকিয়ে থাকে; অষ্ঠাধরের মাঝে বিস্তর ফারাক। সুঠাম বলিষ্ঠ দেহের সুদর্শন পুরুষ কায়া! ভেজা লোমশ বুকে লেপ্টে। প্যান্টটা নাভিকুন্ডের নিচে অবস্থান করছে। ফর্সা উন্মুক্ত পিঠ চেয়ে আছে পাতার দিকে। মাংশল বাহু, লোমে আবৃত নজরকাড়া হাত! পাতা ঢোক গিলে। লোকটা তাকে বশ করতে নিশ্চয়ই ওয়াশরুমের ভিতর কোনো মন্ত্র টন্ত্র পড়েছে। জাদুটোনা করছে। না হলে পাতা এভাবে বশিভূত হয় ? মনে মনে আয়াতুল কুরসি পাঠ করে পাতা বুকে ফুঁ দেয়। ড্রেসিন টেবিলের সামনে দন্ডায়মান অরুণের পাশে দাঁড়িয়ে নরম গলায় বলে,
-” আপনি আমার উপর রেগে আছেন? আমি কোন ভূল করেছি? করলে স্পষ্ট বলবেন। এভাবে মুখ ফিরিয়ে নেয়া খুবই অপমানজনক!”
কথায় কাজ হলো যেন। অরুণ পাতার চোখে চোখ রাখে। তোয়ালে ছুঁড়ে ফেলে সোফার উদ্দেশ্যে। সেটা সোফায় না পড়ে ফ্লোরে গড়াগড়ি খায়। অরুণ দরজার দিকে হনহন করে যায়। পাতার কপালে ভাঁজ পড়ে। এতো রাতে কোথায় যাচ্ছে লোকটা? অরুণ যায় না। দরজা বন্ধ করে ডাক দেয়,
-” পাতাবাহার?”
-” হুম”
-‘ মিও মিও?”
দুই পাতাবাহার একসাথে জবাব দিলো। পাতা বিড়াল শাবকটির দিকে বিরক্তের নজরে চায়। এই শয়তানটা না ঘুমাচ্ছিল? কখন উঠলো? আর লোকটাইবা কাকে ডাকলো? তাকে নাকি বিড়ালটাকে! বিড়াল শাবকটি অরুণের পায়ের কাছে গিয়ে গলা উঁচিয়ে মিও মিও ডাকে। অরুণ তার দিকে তাকালো না বলে লেজ গুটিয়ে সোফায় বসে আড়চোখে তাকিয়ে থাকে। যেন সে অভিমান করেছে। কিন্তু তার অভিমানের তোয়াক্কাই করলো না কেউ। অরুণ পাতার দিকে তাকিয়ে শান্ত গলায় বলে,
-” কি যেন বলেছিলে? এক ডাকাত ডাকাতি করতে গিয়ে বিছানা থেকে পড়ে যায়। ধপাস!”
পাতা গোল গোল করে চায়। অরুণ এগিয়ে আসে। পাতার সম্মুখীন হয়ে সিনা টান টান করে দাঁড়িয়ে গম্ভীর ধীমে সুরে বলে,
-” সি পাতাবাহার ইউ আর ইন রবার’স বেডরুম! ডাকাতের ঘরে অবস্থান করছো তুমি! ভাবতে পারছো ডাকাত কি কি করতে পারে?”
পাতার চোখের আকার ক্রমান্বয়ে বড় হয়। ঢোক গিলে পরপর। এই লোক ভিলেন বনে গেল কেন? না সুবিধার ঠেকছে না। গতকালের ভয়ংকর অভিজ্ঞতা মস্তিষ্কের ভিতর কিলবিল করে। পাতা পালাতে চায়। দু এক কদম পিছিয়ে দৌড় লাগালো উদ্দেশ্য হীন! অরুণ তার গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করছিল! পাতার দৌড়ে মোটেও অবাক হয় না। বড় বড় পা ফেলে এক হাতে পাতার কোমড় জড়িয়ে শূন্যে তুলে আলমারির ঘেঁষে দাঁড় করায়। পাতা আলমারির সাথে লেগে যায়।
অরুণ বাঁকা হেসে পাতার দুই হাতের আঙ্গুলের ভাঁজে ভাঁজে আঙ্গুল দিয়ে আলমারির সাথে আটকে বন্দিনী বানিয়ে ফেলে।ভয়ে পাতার মুখের রঙ বিবর্ণ হয়ে যায়। লোকটা কি করতে চলেছে! তার হাত পা ঝিমঝিম করছে। শক্তি ফুরিয়ে আসছে। মাথা ফাঁকা ফাঁকা লাগছে। অক্সিজেনের অভাব বোধ করে। বুকটা ধ্বক ধ্বক করছে বিরামহীন! এ কেমন অসহ্যনীয় অনুভূতি। অরুণ পাতার দিকে ঝুঁকে সময় নিয়ে তাকিয়ে থাকে।একে অপরের নাক ছুঁই ছুঁই। নিঃশ্বাস আছরে পড়ছে একেঅপরের মুখশ্রীর দিকে। অরুণের বুকের ভিতরের হৃদযন্ত্রটা যেন ঢোল পিটিয়ে যাচ্ছে। সেই শব্দ পাতা নিজেও অনুভব করতে পাচ্ছে ক্ষীণ! আর ধারালো গভীর মায়াময় চোখের নিষিদ্ধ বাণ! অনভিজ্ঞ পাতাও বুঝতে পারে কিছুটা।
এতেই যেন সকল জড়তা এসে ভিড় জমায়। দুজনেই একে অপরের চোখের দিকে তাকিয়ে। চোখে চোখে যেন কথা হয় দুজনের ভিতর! অরুণ নাকে নাক ঘষে। কপালে চুমু দেয়। পাতার নিঃশ্বাস আটকে যাবার যোগাড়। মুঠোয় বন্দি অরুণের হাত চেপে ধরে শক্ত করে। অরুণ থেমে নেই মোটেও; ললাটে, দু ভ্রুয়ের মাঝে, পরপর নাকে ছোট ছোট চুমু দেয়। অধর নামিয়ে নেয়! পাতার অধরের অতি ক্ষীণ দূরত্বে অধর রেখে শ্বাস ছাড়ে। পাতা এবার ভয়ংকরভাবে কেঁপে উঠলো। প্রতিটি শিরা উপশিরায় যেন বহ্নি শিখা জ্বলে উঠলো। শান্ত পাতা ছটফটিয়ে উঠলো নিমিষেই। অথচ অরুণ শান্ত! বধুয়ার অধর জোড়ার কিনারায় সশব্দে গভীর চুমু খায়!
পাতা পুনরায় শান্ত হয়ে আসে। শরীর ছেড়ে দেয়। অরুণ আগলে নেয়। হাত ছেড়ে কোমড় জড়িয়ে বুকে তুলে নেয়। পাতা তার গলা জড়িয়ে কাঁধে মুখ লুকিয়ে নেয়। মিনিট খানেক ওভাবেই কেটে যায়। পাতার নড়চড় না দেখে অরুণ বিছানায় নিয়ে যায়। বালিশে শুইয়ে দেয় পাতাকে। পাতা অরুণের গলা ছেড়ে স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়বে কিন্তু পুনরায় অস্বস্তির সাগরে ডুবে যায়। অরুণ সরকার ওড়না সরিয়ে দেয়। গলায় মুখ গুঁজে ঠোঁট বুলায় আদুরে ভঙ্গিতে। পরপর থুতনিতে, অধরের কিনারা ঘেঁষে অধর বুলিয়ে গালে গাল ঘষে। ছোট ছোট চুমু দিয়ে হঠাৎ কামড় বসায় শক্ত করে। ব্যাথায় পাতা ছটফট করে উঠলো। হাত দিয়ে সরিয়ে দিতে চায়। অরুণ সরে না। সময় নিয়ে দাঁত বসিয়ে রাখে। ব্যাথায় পাতার চোখ ভরে ওঠে। অরুণ ছেড়ে দেয়! পাশ ফিরে পাতার দিকে পিঠ করে শুয়ে রিমোট হাতরিয়ে লাইট অফ করে বলে,
-” বেঁচে গেলে পাতাবাহার!”
পাতার নিঃশ্বাস ভারী! গালে হাত বুলায়। রাক্ষস কোথাকার! তার গালটার কি হাল করে দিয়েছে। জ্বলছে অনেক। সে কম্ফোর্টের ভিতরে ঢুকে অরুণের দিকে পিঠ করে শোয়। কথা বলবে না লোকটার সাথে। সে রাগে ফোঁস ফোঁস করে ঘুমানোর চেষ্টা করে। ঘুম বাবাজি ধরা দিতে অনিচ্ছুক। মিনিট ত্রিশ পরেও ঘুম ধরা না দিলে পাতা পাশ ফেরে। তাক ঝাঁক কর বোঝার চেষ্টা করেে লোকটা ঘুমিয়েছে কি না। তবে বুঝতে পারলো না। সে চোখ বুজে একটা হাত কম্ফোর্টের ভিতর দিয়ে অরুণের পেট জড়িয়ে ধরে একটা পা তুলে দিলো কোলবালিশের ন্যায়! কিছু সময় পেরিয়ে যায়!
পাতা বাহার পর্ব ৩৭
পাতার চোখে ঘুম নামে। অথচ ঘুমে কাতর পাতা অনুভব করতে পারল না যে, তার আঙ্গুলের ভাঁজে আঙ্গুল ঢুকিয়ে শক্ত করে ধরে। হাত টেনে নিয়ে বুকের বা পাশে চেপে ধরে শান্তির শ্বাস ছাড়ে তার নাক উঁচু ম্যানারলেস লোক। মেয়েটা এতো আদুরে কেন? মেয়েটার জন্য মন কুঠিবাড়ির কর্তৃপক্ষ ব্যাকুল হয়ে ওঠে কেন? মেয়েটার সান্নিধ্য, তর্ক, শাসন, বারণ, যত্নের জন্য বেহায়া মনটা আকুতি করে কেন? অভিজ্ঞ অরুণ বুঝতে পারে মন প্রসুণে ভালোবাসা নামক রোপণ করা অঙ্কুর ধীরে ধীরে অঙ্কুরিত হয়ে বর্ধিত হচ্ছে। তবে সে সাবধানে কদম ফেলবে। একবার বিচ্ছেদ নামক আগুনে পুড়েছে তার হৃদয়খানি! যে দুঃখ নিজেই ডেকে এনেছিল সেই দুঃখ নিয়ে সে আফসোস করতে পারে নি আর না করবে। তবে নিজ ও ছেলের ভবিষ্যত যেন একটু সুখের হাতছানি দিতে গিয়ে মুখ থুবড়ে না পড়ে সেই খেয়াল রাখবে শতভাগ।