তোমার জন্য সব পর্ব ২৮
রেহানা পুতুল
খেয়া চমক খেলো। মুখাবয়ব বিকৃত করে বলল,
“হোয়াট?”
“চোর যখন চুরি করে, সে মনে করে কেউই দেখেনি। কেউই জানে না। কিন্তু সে নিজের অজান্তেই এমন এক প্রমাণ রেখে যায়, যা তার গোটা জীবনটা ধ্বংস করে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট। সঙ্গে তার পরিবারেরও।”
দুর্বোধ্য হেসে বলল কলি।
খেয়ার মাথায় যেন বজ্রপাত হলো। ক্ষিপ্ত চোখে চেয়ে অপ্রস্তুত গলায় কলিকে বলল,
“তোর মনে হয় পাখনা গজালো ইদানীং? নিউ বিজনেস দিলি। কাবিন হলো। মাহমুদ স্যারের নেক নজর লাভ করলি। সবমিলিয়ে ফাঁফরে আছিস। তাই না? কিন্তু তুই কি জানিস পিপীলিকার পাখা গজায় মরিবার তরে?”
কলি বাঁকা হাসলো। ধীর কন্ঠে খেয়াকে বলল,
“খেয়া এটা বাসা নয়। পাবলিক প্লেস। আমি এমন কিছু তোকে এখন বলতে চাই না,যাতে তুই বাসা পর্যন্ত না যেতে পারিস। সুতরাং ভালোর ভালো স্থান ত্যাগ কর বলছি। সিচুয়েশন অপ্রীতিকর করে তুলতে চাই না আমি। কারণ আমি তোর মতো অভদ্র নই। একজন মেয়ে হয়ে অন্য একজন মেয়ের এতটুকু গুরুত্ব আমার কাছে আছে।”
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
খেয়া নাকমুখ লাল করে চলে গেলো। তবে মনের ভিতর কঠিন শংকা কাজ করছে। কলি কি মিন করে কিসের ইঙ্গিত দিলো তাকে। কিছুই বুঝে উঠছে না সে। ভীষণ গোলমেলে লাগছে তার কাছে।
কলি বসে পড়লো চেয়ারে। ম্যানেজার কিছু একটা ডাউট করলেও কলিকে জিজ্ঞেস করার সাহস হলো না। কলির বাকিদিন কাটলো অসহিষ্ণু মেজাজে। ভাবছে,
খেয়া মেয়েটা কি মানুষ? সেই শুরু থেকেই নানাভাবে, নানা প্রকারে আমাকে হেনস্তা করায় চেষ্টায় লিপ্ত হয়ে আছে। আগের চেয়ে এখন যেন বেড়ে গিয়েছে এই খেয়া। এর অবশ্য স্পষ্টত দুটো কারণ আছে। সেদিন মাহমুদ স্যারের হয়ে তাকে চড় মারা। এবং যখন সে জানলো আমি স্যারকে পছন্দ করি। এবং স্যার আমার অনুভূতিকে প্রাধান্য দিচ্ছে। বাকি ইতিহাস শুনলে যে খেয়ার কি হাল হবে। ওহ নো! বলেই কলি ডানে বামে মাথা দুলিয়ে আলতো হেসে উঠলো।
সেদিন কলি সময়ের আগেই বাসায় চলে গেলো। তবে নিজেদের বাসায় গেলো। যদিও কলি বিয়ের পর শ্বশুরের বাসায় বেশিরভাগ সময় থাকে। সেখান থেকেই পড়াশোনা চালিয়ে নিচ্ছে। আনুশকার রুমেই সে পড়াশোনা করে। ভার্সিটি যাচ্ছে। দোকান পরিচালনা করছে। সন্ধ্যায় কলিকে দেখেই জুলি গোল গোল চোখে চাইলো বোনের দিকে।
“চাঁদ কোনদিকে উঠলো রে আজ? আপা আজকাল ত সেটাই তোর বাসা হয়ে গেলো দেখি। বাবার বাসায় আসিস পরিযায়ী পাখির মতন।”
“ধর নে।”
বলে কলি জুলির হাতে দু তিনটে প্যাকেট দিলো।
“কি আনলি দেখি? ওয়াও! আমার কফি ফ্লেভারের বক্স আইসক্রিম। আনার ফল আব্বুর জন্য বুঝলাম। আম্মুর দই। ভেরি গুড। এভাবেই পরিবারের দায়িত্ব পালন করিবে কন্যা।”
রেবেকা এসে মেয়েকে বুকে জড়িয়ে ধরলেন। জুলি খাবারগুলো রাখলো। নুরুল হকও মেয়ের গলা শুনে এগিয়ে এলেন। মেয়ের মাথায় আর্শীবাদের হাত রাখলেন। রেবেকা রান্নাঘরে ছুট দিলেন। তালের পিঠা বানাচ্ছেন তিনি। কলি মায়ের পিছন দিয়ে রান্নাঘরে বলল,
” তালের পিঠা? না এলে ত ঠকে যেতাম আম্মু। আমি যেতে কয়টা দিওতো তাদের তিনজনের জন্য।”
” অবশ্যই দিব। এটা বলতে হয় মাকে? তুই রাতে থাকবি না মা?”
“নাহ আম্মু। কাল ক্লাস আছে। বইখাতা সবই ত সেই বাসায়। আব্বুকে দোকানের বিক্রির আপডেট জানাতে আসছি। ও হ্যাঁ আম্মু, তোমার দুধ চিতইয়ের কাটতি ভালো। নারকেল ব্লেন্ড করাটাও পারফেক্ট হয়েছে। মিহি হয়েছে বেশ। কাল আগের পরিমাণে বানিয়ে আব্বুকে দিয়ে পাঠিয়ে দিও।”
“আচ্ছা দিবো। হ্যাঁরে, মাহমুদ, আপা,ভাই কিছু বলে আমাদের দোকান নিয়ে? তোর সময় দিতে হয় যে,আবার সেই বাসা থেকে ডিমের পুডিং, ভেজিটেবল রোল বানাই নেস বলে?”
“ধুর! কি যে বল না। আমি আমাদের বাসার মতই সেখানে ফুল ফিড্রম নিয়া চলতে পারি। তারা কিছুই মনে করে না। বরং আমাকে মেন্টালি সাপোর্ট দিতে পারছে। এই ভেবেও তারা আনন্দ পায়। এডুকেটেড ফ্যামিলির পারসনগুলো খুবই ব্রড মাইন্ডের হয় আম্মু!”
” সহনশীলতা,পরোপকারী, মহৎ মনের মানুষগুলোই এমনিই।”
বলল কলির বাবা। কলির বাবার দিকে চেয়ে বলল,
“আর আব্বু, উনারা যে যা আমার কাছে এক্সপেক্ট করে,তার তো কমতি হচ্ছে না। আমি আমার দায়িত্বগুলো সবই পালন করছি।”
“আলহামদুলিল্লাহ মা। ঠিকভাবে চলিস তাদের মন যুগিয়ে।”
কলি দোকানের ভালোমন্দ বিষয়গুলো বাবার সঙ্গে শেয়ার করলো। নুরুল হকও বুঝে নিলেন। কলি বাবা মায়ের সঙ্গে একত্রে ডিনার সেরে নিলো। রাতে একাই রিকশা নিয়ে বাসায় চলে গেলো। তালের পিঠাগুলো বের করে নিজ হাতে একটি প্লেটে নিয়ে নিলো। স্বশুরের রুমে গিয়ে তাদের দুজনের সামনে রাখলো।
“কি এটা বৌমা?”
“বাবা এটা তালের পিঠা। মা আপনাদের জন্য দিলো কিছু।”
“বাহবা। আঞ্চলিক পিঠার স্বাদতো ভুলতেই বসেছি আমরা শহুরে বাস করা মানুষেরা। তাল কি গ্রাম থেকে আসা?”
“নাহ বাবা। আব্বু শখ করে একটা কিনে নিয়েছে।”
মাহফুজা পটাপট তিন চারটে পিঠা খেয়ে নিলো। আবদুর রহমান মুখে দিতে গেলে কলি বলে উঠলো,
“বাবা খাওয়ার আগের মেডিসিন খেয়েছেন?”
“খেলাম মা।”
“তাহলে খেতে পারেন পিঠা।”
“ওহ! দারুন স্বাদ লাগলো। আরো খেতে হবে বেয়াইনের নরম হাতের নরম পিঠা।”
কলি হেসে উঠলো।
মাহফুজা, বাতাসীকেও দিলো দুটো পিঠা। মাহমুদকে ডাক দিয়ে আনলো। মাহমুদ বাবা মায়ের রুমে এলো। দেখলো কলিও চেয়ারে বসে আছে। মাহমুদ ভারকন্ঠে কলিকে বলল,
“আপনি যে গিয়েছেন বাবার বাসায়? কার অনুমতি নিয়েছেন?”
কলি ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেলো। মুখের উৎফুল্লভাব মুহূর্তেই মিলিয়ে গেলো। সে জবাব দেওয়ার আগেই মাহফুজা বলে উঠলো ছেলের উদ্দেশ্যে,
“মাহমুদ কি হলো আজ তোর হঠাৎ? কলি আমাকে ফোনে বলেছে তাদের বাসায় যাচ্ছে। আসবে রাতে। আমি তোর মা। তোর ও আর কলির অভিভাবক। আমার কাছে বললে তোর কাছে আলাদা করে এত বলতে হবে কেন?”
মাহমুদ পিঠা খেল না। চলে গেলো।
“বাপের মতো একটা গোঁয়ার হয়েছে। কলি পিঠা রুমে নিয়ে যাও। এত মজার পিঠা পাবে কই?”
কলি ছোট একটি কাঁচের বাটিতে করে তিনটে পিঠা নিয়ে রুমে ঢুকলো। মাহমুদ ল্যাপটপের টেবিলে বসে কাজ করছে। কলি একটি পিঠা নিয়ে মাহমুদের মুখের সামনে বাড়িয়ে ধরলো। মাহমুদ কলির হাত চেপে ধরলো। তিন কামড়ে পিঠা খেয়ে নিলো। উঠে দাঁড়ালো। পানি খেয়ে নিলো। বিছানার উপরে উঠে শুয়ে গেলো। কলিকে আদেশপূর্ণ কন্ঠে বলল,
“দরজা অফ করে বেডে আসুন।”
কলি অনুগত স্ত্রী হয়ে ঠিক ঠিক বিছানায় উঠে গেলো। বসে রইলো।
“শুয়ে পড়ুন বলছি।”
কলি শুয়ে পড়লো ঠোঁট উল্টিয়ে। মাহমুদ কলির পায়ের উপর এক পা তুলে দিলো। কলির রাঙা দুই ঠোঁটের মাঝে আঙুল বুলাতে বুলাতে বলল,
“বাসায় এসে আপনাকে না দেখে ভালো লাগেনি। বিয়ে হলো কয়মাস হলো। এখনো আপনার সব ধরনের জড়তা কাটেনি। কি করতে হবে আমার বলেন ত? নাকি আপনার পরিবারের প্রতি দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে আমার প্রতি মনোযোগ হারাচ্ছেন?”
“কিছুই করতে হবেনা স্যার। মনোযোগ হারানোর প্রশ্নই আসে না।”
ছোট্ট করে বলে কলি মাহমুদের বুকে মাথা রাখলো।
“আজ নাইট ড্রেস পরলেন না যে? চেঞ্জ করে আসুন। এতে সবভাবেই কম্প্রোটেবল ফিল হবে আপনার।”
“শুয়ে গেলাম। এখন উঠতে আলস্য লাগছে। সরি। আজ খেয়া দোকানে এলো। ওর বিহেভিয়ার অসন্তুষ্টজনক ছিলো।”
“কেন এলো? কি বলল?”
কলি বিস্তারিত বলল একটা বিষয় বাদ দিয়ে। মাহমুদ খেয়াকে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরলো নিজের খোলা শরীরের সঙ্গে। বলল,
“ইগনোর করেন। ”
“হুম করলাম।”
“আসুন গভীরে ডুবে যাই। মিশে যাই দুজন দুজনার মাঝে। যেমন করে মিশে যায় নদী ও মোহনা।”
মাহমুদের স্বাস প্রশ্বাস ছড়িয়ে পড়ছে কলির ঘাড়ে,মুখে,বুকে। সে কলির জোড়া তুলতুলে অধরখানা দখল করে নিলো গ্রোগাসে। এক অজানা আবেশে কলি কাবু হয়ে যাচ্ছে। বরষার ভেজা হাওয়া ভেজা পরিবেশ দুটো হৃদয়কে করে দিলো উতলা। সুখের নির্যাস আস্বাদন করলো দুজনে রাতভর। অবসাদ হয়ে আসা শরীরে তন্দ্রাঘোরে তলিয়ে গেলো দুজনে।
তার দুইদিন পর কলি ভার্সিটি গেলো বরাবরের মতই বাসে চড়ে। ক্লাস শেষে খেয়া কলিকে ডাক দিলো। কলি থামলো। বিস্ময়ভরা চোখে জিজ্ঞেস খেয়া জিজ্ঞেস করলো,
” তুই যে সেদিন বললি, সেটা বুঝিনি আমি? কিসের চোর চুরি করে প্রমাণ রেখে দেয়?”
“তুই সত্যিই বুঝতে পারিসনি?”
বলল কলি।
“একদম না।”
“ওকেহ! তোর হোয়াটসঅ্যাপ নাম্বার দে। বাসায় চলে যা। সেটা রাতে পৌঁছে যাবে তোর কাছে।”
খেয়া চলে গেলো। মনটা অশান্তিতে ছেয়ে আছে। রাতে মোবাইলের স্ক্রিনের দিকে অনবরত তাকাচ্ছে। তখন সময় দশটা। খেয়ার হোয়াটসঅ্যাপে টুং করে আওয়াজ হলো পরপর দুটো মেসেজের। একটা ভিডিও ক্লিপ। পনেরো মিনিটের। আর একটা মেসেজ। খেয়া মেসেজটা পড়লো।
তোমার জন্য সব পর্ব ২৭
“তোর ক্রাশ মাহমুদ স্যার ও ডিপার্টমেন্টে কখনো যাবে না এটা। ডোন্ট ওরি। কেবল মন চাইলে মাঝে মাঝে আমি অন করে দেখবো,কিভাবে আমার ক্লাসমেট খেয়ার থেকে একসঙ্গে দুজন যুবক মজা নিচ্ছে।”
খেয়া ভিডিও ক্লিপ অন করলো। দেখেই সে স্তম্ভিত! বাকরুদ্ধ! তার নাকমুখ দিয়ে তপ্ত ধোঁয়া নির্গত হতে লাগলো।
এই ভিডিও নেহাল রিমুভ করেনি? সে মিথ্যা বলেছে আমাকে? কিন্তু কলি কিভাবে পেলো এটা? এবার?