প্রেমসুধা পর্ব ৪৮

প্রেমসুধা পর্ব ৪৮
সাইয়্যারা খান

তৌসিফ থম ধরে রইলো। ঘন্টা খানিক হলো ওর বুকের ভেতর ছোট্ট পাখিটা ঘুমাচ্ছে। তৌসিফে’র বুকটা এখনও শান্ত হয় নি। সমানতালে এটা শব্দ করেই যাচ্ছে। তৌসিফে’র দম আটকে আসতে চায়। যতক্ষণ চিৎকার করে পৌষ কেঁদেছে ঠিক ততক্ষণ ও এক প্রকার দম আটকে ছিলো। কণ্ঠনালী রোধ হয়ে ছিলো। ভেতরে ছাইচাপা আগুন যেন এখনই বেরিয়ে আসতে চায়। ছারখার করে দিতে চায় চারপাশ। নিজের কাছেই নিজেকে অপরাধী মনে হয়। জঘন্য এক অপরাধী যে কি না তার অসুস্থ বউ’কে রেখে গিয়েছে। তৌসিফ যদি একটা বার টের পেতো একটা সপ্তাহ ধরে ওর আদরের মানুষটা এভাবে তড়পাচ্ছে তাহলে বুঝি তৌসিফ যোগাযোগ না করে?

টেনে পৌষ’কে নিজের আরো কাছে নেয় তৌসিফ। কপালে আস্তে করে একটা চুমু খায়। রুগ্ন দেহের মেয়েটাকে এই মুহুর্তে বাজে দেখাচ্ছে। ভীষণ বাজে। ঠিক ততটা বাজে যতটা বাজে হলে তৌসিফ মিলাতে পারে না পূর্বের পৌষ’র সাথে। ঠিক ততটাই বাজে যতটা বাজে দেখায় একজন হেরে যাওয়া প্রেমিকাকে।
তৌসিফ আস্তে করে চোখ বুজলো। ওর ঘুম প্রয়োজন। ঠান্ডা মাথায় কিছু কাজ তার এখনও করতে হবে। যার জন্য তৌসিফে’র এই দিন দেখতে হলো তার ব্যবস্থা করতে হবে। তৌসিফ উশুল করা জানে। সে সমতায় বিশ্বাসী। তাকে কেউ ইট ছুঁড়লে তৌসিফ যে পাটকেলের বর্ষণ ঘটাবে এটাও সকলের বুঝা উচিত ছিলো।
মিথ্যা এই মামলার সঠিক তথ্য আজই সব খোলাসা হয়েছে। এতক্ষণে হয়তো শিরোনাম দেখাচ্ছে। রাজনীতি তৌসিফ করতো বহু আগে। বাবা-চাচার জের ধরেই করা হয়েছিলো। উচ্চপদস্থ হয়ে যথেষ্ট সম্মান কামিয়েছিলো তৌসিফ। সকল দলবল, পদবি তৌসিফ ছুঁড়ে ফেলেছিলো বাবার এক বাক্যে। নিজের ব্যবসায় মনোযোগী হয়েছিলো। আজকের এই ঠাট বাট তো এত বছরের ছোট্ট একটা পুরষ্কার মাত্র।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

আজও হয়তো ফিরা হতো না যদিও না তিন দিন আগে পৌষ ওমন পা’গল হয়ে ছুটলো। শুধু মাত্র ওর জন্য কাজ দ্রুততার সাথে সেরেছে তৌসিফ। কঠোর ভাবে বিধিনিষেধ জারি করতেই এত দ্রুত ফলাফল এলো।
বুকের মাঝে আরেকটু গুটিয়ে গেলো পৌষ। তৌফিক ওকে সহ নিজেকে ঢেকে নিলো। ঠান্ডা পরছে। নভেম্বর মাসে রাত নামলেই ঠান্ডা নামে কিন্তু আজ এখনই ভালো ঠান্ডা। চোখ বুজে কল্পনা করে তৌসিফ।
বিস্তর এক বেলাভূমির মাঝে সে পৌষ’র পিছনে ছুটছে। খিলখিল করা হাসির শব্দে তৌসিফে’র ধ্যান ভটকায়। সে দেখে ছোট্ট একটা পরী তার কাছে আসছে। তৌসিফের কাছে আসার পূর্বেই সে ধপ করে পরে যায়। কেঁদে উঠে উচ্চস্বরে। তৌসিফে’র হৃদকম্পন থামে। বৃষ্টি নামে প্রচুর বেগে। তৌসিফ দৌড়ে যায়৷ বাচ্চাটাকে বুকে তুলে আদর করে। ছোট্ট পরীটা তখন আদো বুলিতে ডাকে, “বাব্বাহ”।
তৌসিফ হাসে। ঝলমলে এক হাসি। বাচ্চাটাকে চুমুতে সিক্ত করতেই সে হাসে। তৌসিফ দেখলো পৌষ সমুদ্রের মাঝে যাচ্ছে। তার চোখ মুখ ভেজা। কেঁদে নাক লাল করেছে। হলুদ শাড়ীতে লাল রঙের পার। তৌসিফ ডেকে উঠলো,

— পৌষরাত, হানি যেয়ো না।
পৌষ পিছন ঘুরে। অভিমানী কণ্ঠে বলে,
— আমাকে আপনি ভালোবাসেন না।
— এই যেয়ো না। কথা শুনো…ডুবে যাবে।
রুগ্ন দেহের পৌষ তখন হাসে। আচমকা এক জোয়ার আসে। ভেসে যায় পৌষ। হলুদ শারীর আঁচল ভাসে পানিতে। তৌসিফ থম ধরে দাঁড়িয়ে থাকে। কোলের বাচ্চাটা তখন ডাকে,
— মাম্মাহ।
তৌসিফ চমকায়৷ ফলস্বরূপ বাচ্চাটা মাটিতে পরে কাঁদায় মাখামাখি হয়ে গেলো। তৌসিফ ওকে তুলতে নিলেই পৌষ’র কান্না…….

দরদর করে ঘামতে ঘামতে মুচড়ে উঠে তৌসিফ। হা করে শ্বাস টানে। গলা শুকিয়ে গেছে তার। বহু কষ্ট এক ঢোক গিলে ওর বুকের ভেতর পৌষ’কে দেখে ও। হ্যাঁ, এই তো। তার ঐ রুগ্ন দেহের মাঝে ভঙ্গুর চেহারা। তৌসিফ মানতে পারে না। একদমই না।
আস্তে করে হাত বাড়িয়ে পানির গ্লাস নিলো। এক পলকে সবটা গলায় ঢেলে আস্তে ধীরে উঠে গেলো। প্রায় তিনঘণ্টা যাবৎ ঘুমাচ্ছে সে। পৌষ হয়তো আরো ঘুমাবে।
তৌসিফ উঠে বাইরে গেলো। বুয়ারা তখন কেউ নেই সেখানে। তৌসিফ গলা ছেড়ে ডাকতেই লাইন ধরে তিনজন বুয়া দৌড়ে এলো। মিনুও বাদ গেলো না। নার্সটা দাঁড়িয়ে আছে এক কোণায়। তৌসিফ ধমকে জিজ্ঞেস করলো,
— ওর এই অবস্থা কেন?
কেউ উত্তর দিলো না৷ তৌসিফ চোয়াল শক্ত করে বললো,

— আজ এই মুহুর্তে আমার বাড়ী ছাড়বি সবকটা। জানে মা’রব তোদের আমি। কু*ত্তার বাচ্চারা টাকা গিলাই নি তোদের? ওর খেয়াল রাখিস নি কেন? লাখ লাখ টাকা তোদের মুখের উপর মে’রে গেলাম ফল কই? ওর চুল আঁচড়ে দিস নি কেন? ওকে খাওয়াস নি কেন? ওর মুখের এই অবস্থা কেন? নিজেরা গিলেছিস শুধু……..
বুয়ারা ভয়ে কাঁপছে কাঁপছে অবস্থা। তৌসিফ জানে, টাকা দিয়ে সবটা হয় না৷ কিছুই হয় না৷ এত টাকা দিয়ে লোক রাখার পরও কতটা আনাদর, কতটা অবহেলা। তৌসিফে’র মন চাইলো কারো খু’ন করতে। তার মস্তিষ্ক তখন দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। এই পৌষ’কে দেখেই ওর নিজেকে খু’ন করতে মন চায়।

হালকা হালকা শব্দ পেয়ে চোখ মেলে পৌষ। নিজেকে বিছানায় একা আবিষ্কার করেই ওর হৃদপিন্ড চিলিক দিয়ে উঠে। হুর মুড়িয়ে উঠে বসে বিছানায়। তৌসিফ নেই তাহলে কি স্বপ্ন দেখলো ও? ঐ লোক কোথায়? পৌষ’র মাথা এলোমেলো হলো৷ চিৎকার করে ডাকতে লাগলো,
— এই আপনি কোথায়? কোথায় আপনি? এখানে আসুন…….! কোথায় গেলেন?
পৌষ’র কান্নায় ভেজা চিৎকারে দৌড়ে রুমে ঢুকে তৌসিফ। পৌষ ওকে দেখেই বিছানা থেকে নামতে নেয় হুরমুর করে। হাত-পা এলোমেলো হয়ে পরতে নিলেই আগলে ধরলো তৌসিফ। পৌষ ওর কোমড় জড়িয়ে ধরে শক্ত হাতে। নাক টানে। গুঙিয়ে উঠে অদ্ভুত স্বরে। তৌসিফ ওর মাথা চেপে ধরে। খুবই হালকা স্বরে আদর মেখে শুধু বলে,

— আ….আমি আছি।
— কই… কই ছিলেন আপনি? আমি খুঁজেছি।
— একটু বাইরে….
— কেন কেন? বিছানায় কেন ছিলেন না? আপনি কেন চলে যান?
— হানি, প্লিজ….
— কোন প্লিজ না৷ তুই আমাকে ছেড়ে দে। আমি থাকব না এখানে। ছাড়াছাড়ি হবে। আজকেই হবে। আমাকে মে’রে ফেলতে চায়। সবাই মা’রতে চায়। আপনার ফাঁ’সি হবে আমি দেখেছি…..জেলে নিবে আপনাকে…..
বাকিটা বলার আগেই পৌষ টলে গেলো। তৌসিফ হতবাক, বিমূর্ত হয়ে রইলো। আচ্ছা, একটা মানুষ আটদিনের ব্যবধানে কতটা শোকাহত হয়? ঠিক কতটা শোকাহত হলে সে এমন পা’গলামি করে? তৌসিফ বুঝে উঠতে পারে না৷ তার ভাষা ফুরিয়ে আসে। সে কথা বলার খেই হারায়।
পৌষ’কে নিজের সাথে জড়িয়ে ধরে এই প্রথম তৌসিফ কাঁদলো। কাঁদলো ভালোবাসার শোকে। প্রেমের দুরস্ত অবস্থা দেখে। তার দুই চোখ দিয়ে গুনে গুনে চার পাঁচ ফোঁটা পানি পরলো যা ছিলো রাগের বশে আসা। তৌসিফ ধ্বংস করতে চাইলো। ওর ভালোবাসার মানুষটাকে কষ্ট দেয়া প্রতিটা মানুষকে।

ভাই এসেছে শুনা মাত্র তায়েফা ছুটে এসেছে। সে দেশে ছিলো না। ল্যান্ড করেই এখানে ছুটে এসেছে। তৌসিফ তখন পৌষ’র মাথায় পানি দিচ্ছে। হঠাৎ ই জ্বর উঠেছে। পৌষ চোখ মেলে বললো,
— কটা বাজে?
— বারোটা?
— দুপুর?
— না রাত।
— আমি উঠব৷
— কেন? শুয়ে থাকো পৌষরাত।
— উহু।
তোয়ালে দিয়ে ওর চুল পেঁচিয়ে দিলো তৌসিফ। উঠে বসতেই তৌসিফ কপালে হাত দিয়ে দেখলো। হালকা উষ্ণ এখনও। তৌসিফ ওকে ধরে বললো,

— মেডিসিন নিতে হবে তোতাপাখি।
— আসছি একটু।
— কি কাজ?
— রাত হলো। খাবেন না আপনি। ঝটপট হাতে ডিমের কোর্মা করে দিব৷ ঝাল দিয়ে একদম আর শুধু ডাল…কোন বায়না না আর। আমার মাথা ঘুরছে।
— একদমই না পৌষরাত।
— দুইদম তাহলে৷ আমি কতদিন আপনাকে রান্না করে খাইয়াই না৷ আমার বুকটা খা খা করছিলো।
এই ধরুন তো, ছাই উঠতে পারছি না৷
তৌসিফ ধরে তুললো। বুয়াকে ডিম সিদ্ধ দিতে বলে পিয়াজ, মরিচ কাটতে বললো পৌষ। ভয়ে ভয়ে বুয়ারা তাই করলো। তৌসিফ তাদের তাড়িয়েছে। এখনও যায় নি তারা। নার্স বেচারি ভয়ংকর ফ্যাসাদে পরেছে। যাবে না থাকবে বুঝতে পারছে না সে।
পৌষ’কে রান্না করছে আর তৌসিফ দাঁড়িয়ে আছে। এই দৃশ্য বিরল। সুঠাম দেহটায় মাথা এলিয়ে হেলান দিয়ে খুন্তি নাড়াচ্ছে পৌষরাত।
তায়েফা ঢুকেই ডেকে উঠলো,

— তুসু….
তৌসিফ তাকালো। এই তো তাকে স্বার্থহীনা ভালোবাসার আরেক মানুষ।
তায়েফা ভাইকে জড়িয়ে ধরে। পৌষ’র মাথায় হাত দিয়ে রাগী কণ্ঠে বলে,
— কত কল দিলাম তোকে… এই পৌষ সোনা তোর কি হয়েছে?
পৌষ’কে দেখে চকমকানোরই কথা। তার হালতই ওমন৷ তৌসিফ চোখের ইশারায় বোনকে থামালো। খেতে বসে পৌষই জিজ্ঞেস করলো,
— আপনাকে মে’রেছে?
— না তো।
— মিথ্যা বলে আপা। ওনার শরীর ভরা দাগ।
— মিথ্যা বলব আমি? কার এত বড় হাত?
— তাহলে ওগুলো কি চুম্মাইসে আপনাকে?
— ছিঃ পৌষরাত। কেমন ভাষা এসব। গাড়ির কাঁচের সাথে আঁচড় লেগেছে।
তায়েফা অবাক হলো। বললো,
— কি বলিস?

— জেল থেকে গাড়িতে তুলা মাত্রই নীরব সড়কে এসে পুলিশ গাড়ি থামায়৷ ওখানে আমার লোক ছিলো। ওরা কাঁচ ভেঙে বের করলো আমাকে। তখনই আঁচড় লেগেছে। পায়েরটা পেয়েছি চারদিন আগে।
পৌষ অবাক হলো। তৌসিফ নিজেই বললো,
— পুলিশ তো এমনিতেই ছাড়ত না৷ তাই সাজানো নাটক তারাই করল। এখন প্রমাণিত হয়েছে তাই ঝামেলা নেই।

প্রেমসুধা পর্ব ৪৭

পৌষ’র পেট মুচড়ে উঠে৷ খেতে পারে না আর। তায়েফা এখানেই রইলো আজ। পৌষ মুখে খাবার তুলতে না পারায় স্যালাইন দেয়া হলো। তৌসিফ ওর মাথায় হাত বুলালো। কণ্ঠ খাদে নামিয়ে বললো,
— আজ আরাম করে নাও। কাল থেকে ডিউটি শুরু তোমার হানি৷ অনেক জ্বালাচ্ছো আজকাল। কোথায় আমায় আদর করবে তা না তুমি আমার সেবা খাচ্ছো।

প্রেমসুধা পর্ব ৪৯