পাতা বাহার পর্ব ৪১

পাতা বাহার পর্ব ৪১
বেলা শেখ 

ঝমঝম বৃষ্টি বর্ষণে ভিজতে থাকে মেদিনী! বৃষ্টির ফোঁটার ছন্দপতনের শ্রুতিমধুর আওয়াজ যেন বর্ষপ্রেমীদের তনুমন জুড়িয়ে দেয়। বৃষ্টির সাথে সাথে হালকা ঝড়ো হাওয়া বইছে এলোমেলো। দীগন্তের বুক চিড়ে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। মাঝে মাঝে মৃদু গর্জনের আওয়াজ শোনা যায়। অরুণ পাতা জলদি পা চালায়। কলিং বেলের বেজে ওঠার সাথে সাথেই দরজা খুলে দিল আভারি। অরুণ ভিতরে প্রবেশ করে বলে,
-” আভারি ভাই ভোর কোথায়?”
কন্ঠে উদ্বিগ্নতা। আভারি মুচকি হেসে বলে,
-” ঘুমুচ্ছে আপনাদের ঘরে!”
-” খেয়েছে কিছু?”
-” শুধু নুডুলস খেয়েছে। এতো ডাকলাম। সে আব্বু আম্মু এলেই খাবে!”

অরুণ রুমের উদ্দেশ্যে পা চালায়। পাতা তার পিছনে গুটি গুটি পায়ে হেঁটে যায়। ঘরে প্রবেশ করেই অরুণ জুতো খুলে বিছানায় বসে। উপুর হয়ে শুয়ে থাকা ছেলের গা থেকে কম্ফোর্ট সরিয়ে দেয়। ঘুমন্ত ছেলেকেই টেনে বুকের উপর তুলে চুমুতে চুমুতে ভরিয়ে দিল। ইশ বুকটার জ্বলুনিতে যেন ঠান্ডা মলমের প্রলেপ পড়লো। কলিজাটাকে রেখে যাওয়ায় তার বুকের ভিতর কেমন আনচান করছিল। এখন একটু ভালো লাগছে। চুমুর বর্ষন থামিয়ে অরুণ ছেলের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে। কপালে ভাঁজ পড়ে মৃদু। ছেলের চোখের কিনারায় পানি। চোখের পাতাও ভেজা! তাদের প্রতিক্ষায় কেঁদেছিলো কি? অরুণ ডাকে ছেলেকে,

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

-” আব্বু? এই কলিজা? আমার মানিক সোনা? ”
ভোর হালকা নড়াচড়া করে বাবার বুকের মধ্যে সেঁটে যায়। ছোট্ট বাচ্চাদের মতো বাবার মুখ হাতরিয়ে নিশ্চিন্তে ঘুমে তলে যায়!
পাতা হামি তুলে অরুণের ব্লেজার ও তার স্কার্ফ সোফায় রেখে বিছানায় ধপাস করে শুয়ে পড়ল।
-” ঘুমুচ্ছে ঘুমোক!
অরুণ পাতার দিকে তাকিয়ে বলে,
-” খায়নি ছেলেটা! রাতে না খেয়ে ঘুমোতে নেই!
পাতা কম্ফোর্টের ভিতরে ঢুকে বলে,

-” নুডুলস খেয়েছে তো। আর এভাবে কাঁচা ঘুম ভাঙলে খুব খারাপ লাগে! থাক না?”
বলে আবার হামি তোলে। অরুণের কপালে আবার ভাঁজ পড়ে। গম্ভীর গলায় বলে,
-” সে থাক। তুমি বিড়াল ছানার মতো কম্ফোর্টের ভিতর ঢুকছো কেন?”
পাতা আপাদমস্তক ঢেকে হেসে বলে,
-” ঘুমাবো তাই!”
অরুণ ছেলেকে শুইয়ে দিয়ে বলে,
-” হোয়াট? পাগল তুমি? ওঠো! পাতাবাহার? যাও কাপড় চেঞ্জ করে ফ্রেশ হয়ে এসো? এককাজ করো গোসল করে নাও। ফ্রেশ লাগবে!”
-” পাতাবাহার ঘুম!”
ভোরের মতো করে বলে পাতা। অরুণ মুচকি হাসলো। কম্ফোর্ট সরিয়ে টেনে আনে পাতাকে। পাজা কোলে নিয়ে ওয়াশ রুমের দিকে পা বাড়ায়,
-” ফ্রেশ হয়ে ঘুমিও!”

অরুণ ওয়াশরুমে পাতাকে রেখে আসে। আলমারি খুলে পাতা ও তার প্রয়োজনীয় কাপড় নিয়ে রেখে আসে ওয়াশরুমে। পুনরায় রুমে এসে পরনের শার্ট মুজো খুলে এসির পাওয়ার কমিয়ে দেয়।বিড়ালশাবটাকে খাঁচা থেকে বের করে। মহারানী বের হয়েই মিয়াও মিয়াও বলে শ খানিক অভিযোগ দায়ের করে। অরুণ তার কান টেনে মাথায় হাত বুলিয়ে দিল। ব্যস পাতাবাহার নামক বিড়াল শাবকের অভিমান শেষ। অরুণ ক্যাট ফুড দেয় বাটিতে। বিড়াল মিও মিও করে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে ক্যাটফুড গলাধঃকরণ করে। অরুণ বেলকনিতে যায়। নিমিষেই ঝড়ো বাতাসে ভেসে আসা বৃষ্টির ফোঁটা ভিজিয়ে দেয়।

অরুণ চোখ বুজে নেয়! কিছু সময় সেখানে দাঁড়িয়ে থেকে ভিতরে আসে সাথে বেলকনির দরজা লাগিয়ে দেয়। রুমে এসেই তার হৃদস্পন্দন বেড়ে যায় দ্বিগুণ। অশান্ত হৃদযন্ত্রের অস্বাভাবিক ক্রিয়ার দরুণ অরুণ এই ঠান্ডা শীতল তম পরিবেশেও ঘামতে থাকে। কিছু সময় স্ট্যাচুর মতো দাঁড়িয়ে থেকে ওয়াশ রুমে চলে যায় হন হন করে। পাতা লজ্জায় মরি মরি! পড়নে তাঁর প্লাজো ও অরুণের স্কাই ব্লু রঙের টিশার্ট! সে টিশার্টের কলার মুঠোয় নিয়ে তড়িঘড়ি কম্ফোর্টের ভিতরে অবস্থান নেয়। আক্কেল গুড়ুম হয়ে কেন যে সে লোকটার টি শার্ট পড়তে গেল। ধ্যাত লোকটা কি ভাবলো? এখন তোর কি হবে পাতু?

অরুণ অল্প সময়েই বেড়িয়ে আসে। পরনে শুধু ট্রাওজার। টি শার্ট তো মালকিনের দখলে। মাথায় তোয়ালে চালিয়ে ভেজা চুল মুছতে থাকে সে। পাতাবাহার খেয়ে দেয়ে পেট ফুলিয়ে অরুণ পা ঘেঁষে ঘুরঘুর করে। অরুণ সরিয়ে দিল। তোয়ালে সোফায় ঢিল ছুঁড়ে বিছানায় ছেলের পাশে শুয়ে পড়লো। লাইট অফ করে না। সময় পেরিয়ে যায়। ভোরের দু পাশে শুয়ে থাকা মানব মানবীর চোখে ঘুম ধরা দেয় না। পাতা মটকা মেরে শুয়ে থাকে। এরমধ্যে বিড়াল শাবকটি কম্ফোর্টের ভিতরে ঢুকে পাতার পেটের উপর উঠে। পাতা মৃদু স্বরে চেঁচিয়ে লাফ দিয়ে উঠলো। পেটে ওর হারালো নখের আঁচড় লেগেছে। অপরদিকে অরুণের অধরকোনে বাঁকা হাসির রেখা। পাতাবাহারকে তুলে নিয়ে খাঁচায় পুরে দেয়। পাতার সম্মুখে বসে মাথায় হাত রাখল। শান্ত গলায় বলে,

-” রিল্যাক্স পাতাবাহার! তোমার সখি ছিল!”
-” রাখুন আপনার সখি!”
বলে আবার শুয়ে পড়ল। অরুণ সেখানেই বসে থাকে। পাতা তার দিকে ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করে,
-” ঘুমোবেন না?”
অরুণ তার দিকে তাকিয়ে শান্ত দৃষ্টিতে।
-” বাহ্ ভালো তো! ঘুম হারাম করে ঘুমানোর আহ্বান? হুম?”
পাতার কান গরম হয়ে আসে। ঠান্ডা পরিবেশও গরম লাগতে শুরু করে কেমন যেন! পাতা ভেবে পায় না কি বলবে! সব লাজ এসে ভিড় করে তার চোখে মুখে। পাতা মুখ লুকায়।
-” ভোরকে ওই ঘরে রেখে আসি?”
অরুণের কথায় পাতার কপালে ভাঁজ পড়ে। অরুণের চোখে চোখ রেখে বলে,
-” কেন?”

অরুণ মুচকি হাসে। সাথে যেন তার মায়াময় ছোট চোখ দুটো হেসে উঠলো। পাতার গা শিরশিরিয়ে ওঠে তার হাসি আর ওই হাস্যোজ্জ্বল চোখের গভীরতা দেখে। অবুঝ পাতা কি বুঝলো কেন যানে! ধ্বক করে ওঠলো বক্ষস্থল। ঢোক গিলে নিজেকে স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করে। অরুণ চোখ সরায় না। না পাতা! নয়নে নয়ন মিলে কথোপকথন হয়। পাতা যেন বশীভূত হয়ে যায় নিমিষেই। অরুণ ভোরকে কোলে তুলে নিয়ে যায়। পাতা কেমন নিস্তেজ হয়ে পড়ে। সর্বাঙ্গ কেমন কেঁপে কেঁপে উঠছে। ভয়ে, লজ্জা, অস্বস্তিতে পাতা ঘামতে শুরু করে। এরমধ্যে অরুণ প্রবেশ করে রুমে। পাতা সবটা দেখে। লোকটা আলমারি থেকে কম্ফোর্ট নিয়ে বের হয়। একটু পর আবার ফিরে আসে। বিছানায় এসে তাঁর পাশে শুয়ে পড়লো। সাথে সাথেই লাইট নিভে যায়। পাতা ঢোক গিলে চোখ মুখ খিঁচে নেয়।

ঘরময় শুনশান নিরবতা। বাইরের বৃষ্টির বেগের সাথে ঝড়ো হাওয়া বয়ে যাচ্ছে অবিরাম। বৃষ্টির ফোঁটার ছিটা ভিজিয়ে দিচ্ছে বেলকনির পুরোটা জুড়ে। ভেজা পর্দা বাতাসে উড়ে এসে বারংবার আঘাত‌ হানছে রেলিংয়ের গায়ে। বেলকনির দরজা বন্ধ থাকায় বৃষ্টির ফোঁটা ভিতরে প্রবেশ করতে পারছে না। ঘরের দেয়ালে অবিরাম ঘূর্ণায়মান ঘড়ির সেকেন্ডের কাটার খট খট শব্দ শোনা যায়। দোদুল্যমান ঘড়ির কাঁটা দুলছে অবিরাম।ঘরময় ঘন চাপা নিঃশ্বাসের আনাগোনা। মাঝে মাঝে চাঁপা স্বরে ক্ষীণ ক্রন্দনরত সুর ভেসে আসে। তীব্র প্রণয়ের জোয়ারে ভাসমান যুগ্ম কপোতি। হঠাৎ নিঃশ্বাসের শব্দের বেগ কমে এলো। ক্রন্দনরত সুর ভেসে আসে না; শুধু নাক টানার শব্দ আসে। এসি সংযুক্ত শীতল রুমে ফুল স্পীডে ঘূর্ণায়মান ফ্যানের দিকে আবছায়া আলোয় স্থির দৃষ্টিতে চেয়ে কপোতি। একপল, দুই পল, বেশ সময় নিয়ে তাকিয়ে থাকে। দুজনের মধ্যকার দীর্ঘ নীরবতার সমাপ্তি ঘটিয়ে অবশেষে অরুণ সরকার নরম গলায় সুধায়,

-” আর ইউ ওকে?”
পাতার চোখের কার্ণিশ বেয়ে নোনাজল গড়িয়ে পড়ে। দুজনের গায়ে জড়িয়ে থাকা কম্ফোর্ট নিজের দিকে টেনে নেয় পাতা। গলা অবধি ঢেকে ছোট করে জবাব দেয়,
-” হুম!”
অরুণ বালিশ থেকে মাথা তোলে। পাতার দিকে ঝুঁকে কম্ফোর্ট গলা থেকে খানিকটা সরিয়ে সেথায় নাক ঠেকিয়ে লম্বা শ্বাস টেনে নেয়। গম্ভীর মোহনীয় গলায় ধীমে সুরে সুধায়,
-” দ্যাটস ভেরি গুড! আই এম নট ডান ইয়েট!”
বলেই মাথা উঁচিয়ে পাতার চোখে চোখ রাখে। পাতা অবুঝ চোখে চায়। নাক টেনে বলে,
-” মানে?”
-” আ’ম নট ডান!”
ঘুমে বুজে আসা পাতার চোক্ষুযুগলের আকাল বড় হয়। কিছু বলার জন্য মুখ খুলবে সেটাও সম্ভবপর হয় না। অরুণ সরকার নিজ কাজে অগ্রসর হয় পূর্বের চেয়েও বেশ অশান্ত, বেপরোয়া গতিতে। আস্তেধীরে কম্ফোর্টের অবস্থানের পরিবর্তন হয়। উন্মুক্ত বলিষ্ঠ পৃষ্ঠদেশ পাতা সর্বশক্তি দিয়ে আকরে ধরে। দেয়ালে ঝোলানো ঘড়ির সময় টিক টিক টিক চলে নিজ গতিতে। বাইরের বৃষ্টিও নিজ ছন্দপতনে ঝড়ে পড়ে ভিজিয়ে দেয় মেদিনীপুরের সর্বাঞ্চল। শান্ত ঝড়ো পবন অশান্ত হয়। মেঘের গর্জনে পরিবেশ থমথমে।

বৃষ্টিতে ভেজা ঘোর তমসার সমাপ্ত পাঠ করে ধরনী জুড়ে স্নিগ্ধ ভোরের আগমন। পূর্ব দীগন্তে অরুণ দেখা যায় তার চিরচেনা তেজি রূপে। ঝলমলিয়ে আলো ছড়িয়ে দিচ্ছে বসুন্ধরায়। ভেজা গাছ পালা রাস্তা ঘাট শুকোতে শুরু করেছে। গাছের ডাল পালা হালকা বাতাসে নড়ছে। সাথে গাছের পাতার উপর জমায়িত বৃষ্টির কনা পড়ছে বৃষ্টির ফোঁটার মতো। সরকার বাড়ির পুকুরে ব্যাঙের দল ডেকে চলেছে ঘ্যাঙর ঘ্যাঙ। আনিকা ড্রয়িং রুমের সোফায় বসে আইসক্রিম খাচ্ছে। রুপ তার পাশে বসে ‘দা দা’ বুলি আওড়াতে থাকে। আনিকা চামুচে অল্প করে আইসক্রিম নিয়ে তার মুখে দেয়। ছোট্ট রূপ হেসে সেটা চেটেপুটে খেয়ে নেয়। তার গাল নাক মুখ দিয়ে আইসক্রিম লেগে আছে। সে হাত নাড়িয়ে আরো চায়। আনিকা অল্প করে দিয়ে নিজে খায়। আসমা‌ বেগম চা হাতে নাতনির পাশে বসে। রূপ এবার দাদিকে দেখে বু বু বলে হাত বাড়ায়! আসমা বেগম একহাতে কোলে টেনে নেয়। রূপ অপর হাতে থাকা চায়ের কাপ টেনে নিতে চায়। ‘দা দা’ বলে চিল্লাতে থাকে। আনিকা তার পিঠে একটা কিল বসিয়ে বলে,

-” পঁচা ভাই! যা দেখবে তাই দা দা!”
রূপ ঠোঁট উল্টিয়ে কেঁদে ওঠে। এরমধ্যে অরুণ আসে মেইন দরজা দিয়ে। পরনে স্কাই ব্লু টি শার্ট সাথে ট্রাওজার। মাথায় স্পোর্টস ক্যাপ আছে। সে এসে রূপকে কোলে তুলে নেয়‌। এটা ওটা আধো আধো বুলিতে তার কান্না থামায়! রূপ হাসতে হাসতে গড়াগড়ি খাওয়ার অবস্থা। অরুণ তার গালে মুখে আদর করে আনিকার সম্মুখের সোফায় বসে বলে,
-” আনিবুড়ি সকাল সকাল আইসক্রিম খাচ্ছে? ঠান্ডা লাগবে না?”
আনিকা কিছু বলে না। বরং মুখ পুরো করে আইসক্রিম নেয়। অরুণ হেসে বলে,
-” আম্মু আস্তে খাও! গলায় আটকে যাবে তো!’
আনিকা আস্তে খায়! অরুণ ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে বলে

-” কথা বলছো না কেন আমার সাথে? চাচ্চুর সাথে রেগে আছো?”
তাও কিছু বলে না। আইসক্রিম বক্স হাত নিয়ে উঠে চলে যায় সেখান থেকে অরুণ গলা উঁচিয়ে ডাকে,
-” আনিবুড়ি? কি হয়েছে সোনা? ভোর দুষ্টমি করেছে তোমার সাথে? বলো?”
আনিকা দাঁড়ায় না চলে যায়। অরুণ আসমা বেগমকে বলে,
-” কি হয়েছে ছোট মা? আনি গাল ফুলিয়ে রেখেছে কেন?”
আসমা বেগম চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে বললেন,
-” ছাড়ো তো! বাচ্চামো সব! একটু পরেই ঠিক হয়ে যাবে! রাতে কখন ফিরলে?”
অরুণ স্বাভাবিক নেয় ব্যাপারটা!
-” এই তো! দশটার দিকে!”
-” ওহ্! বড় বউ উঠেছে?”
অরুণ রূপকে কোলে নিয়ে উঠে দাঁড়ালো।
-” ওঠে নি বোধহয়!”
আসমা বেগমের কপালে ভাঁজ পড়ে।

-” এটা কেমন অভ্যাস? বিয়ের পর একদিনও তাকে সকাল সকাল উঠতে দেখিনি! সে বাড়ির বড় বউ! তারও কিছু দায়িত্ব আছে সেটা মেয়েটা ভুলে যায়। রান্না বান্না পারে না। ইটস ওকে কিন্তু সকালে উঠে মিনুকে টুকিটাকি সাহায্য করতে পারে। বেচারি সন্তান সম্ভাবা! রুবি কিন্তু সকাল সকালই উঠে। রান্না না করলেও চা বানায়, মিনুকেও সাহায্য করে! তুমি একটু বড় বউকে বুঝিয়ে বলিও অরুণ!”
অরুণের মুখটা গম্ভীর হয়ে যায়।
-” ছোট মা! আমি নতুন সার্ভেন্টের ব্যবস্থা করেছি। সামনের সপ্তাহ থেকে কাজে আসবে। সেই আজ থেকে রান্না বান্নার কাজ করবে। মিনু আপা ছুটিতে থাকবেন।”
আসমা বেগম তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে অরুণের দিকে তাকিয়ে বলে,

-” তোমার বউকে কাজে বলেছি বলে..”
তাকে থামিয়ে দিয়ে অরুণ শান্ত স্বরে বলে,
-” ব্যাপারটা তেমন নয় ছোটমা!পাতা মেয়েটা সারাজীবন স্ট্রাগল করেই গেছে। তার পূর্ববর্তী জীবন মোটেই পুষ্পশয্যা ছিল না আদুরির মতো! থাক সে কথা। মেয়েটা এখন অরুণ সরকারের ওয়াইফ।সো রানির হালে থাকবে সে। আশা করি আমার কথায় কিছু মনে করবে না!”
আসমা বেগম অপমানিত বোধ করে বেশ! চোয়াল শক্ত করে বলে,
-” ভুল হয়ে গেছে আমার তোমার রানিকে কে কাজ করতে বলেছি! আইন্দা হবে না।”
-” ছোট মা..!”
-” থাক অরুণ! আর কিছু বলতে হবে না। তোমার মা হলে নিশ্চয়ই এভাবে বলতে পারতে না!”

অরুণ দীর্ঘশ্বাস ফেলল। কিছু না বলে রূপকে আসমা বেগমের কোলে দিয়ে পা বাড়ায়। হঠাৎ পিছনে ফিরে বলে,
-” আমার মা হলেও নিশ্চয়ই এভাবে রেগে যেতেন না! কান মুলে হেসে উড়িয়ে দিতেন!”
আসমা বেগম অরুণের দিকে তাকিয়ে থাকে। অরুণ চলে যায় হনহন করে। আসমা বেগমের চোখ ভরে যায় নিমিষেই। মা হওয়া কঠিন হলে সৎ মা হওয়া‌ আরো কঠিন। যতোই ভালোবাসো ভালোবাসা নজরে আসে না। একটু ধমক দিয়ে শাসন করলেই আঙ্গুল উঠে যে সৎ মা তাই এভাবে বকছে। অরুণকেও সে ছেলের মতোই ভালোবাসে। আগেও বেসেছে। মাঝে মাঝে সম্পর্কে চড়াই উৎরাই হয়েছে সে মানে। আসমা বেগম আর অরুণের সম্পর্কের অবনতি ঘটে আরিয়ান আসার পর। এর আগে অরুণ তার পিছু পিছুই থাকতো।

আরিয়ানকে অরুণ একটুও সহ্য করতে পারতো না। দেখলেই রেগে যেতো। তবুও অরুণ আসমা বেগমকে সমীহ করতো। কিন্তু সেবার অরুণ আরিয়ানকে করুণ ভাবে মেরেছিল। রক্তাক্ত অবস্থা। আসমা বেগম ছেলের এ অবস্থা দেখে পাগল প্রায়। অরুণকেও কথা শুনিয়েছে। ব্যস এরপর থেকে অরুণ তার থেকে অনেক দূরে চলে যায়। আসমা বেগম কাছে টানলেও জেদি অরুণ ফিরেও তাকাতো না। আসমা বেগমের মাঝে মাঝে রাগ হতো। অনিক সরকারের পরলোক গমনের পর অরুণ একটু একটু করে আবার তাদের সাথে জুড়ে যায়। আরিয়ানের সাথে সম্পর্কের উন্নতি হয়। তার সাথেও। তবে কোথাও কোনো খাদ ত্রুটি থেকেই যায়।
তিনি দীর্ঘশ্বাস ফেলে চায়ে চুমুক দেয়। দিয়েই মুখ কুঁচকে নেয়। ঠান্ডা শরবত বনে গেছে চা।

অরুণ রুমে প্রবেশ করে। বিছানায় দুই পাতাবাহার ও তার কলিজা ঘুমে। তার প্রবেশে এক পাতাবাহার হামি তুলে উঠে আসে। পা দুটো টান টান করে হেলতে দুলতে এগিয়েছে এসে মিও মিও করে। অরুণ ঝুঁকে তাকে কোলে তুলে নেয়। গায়ে হাত বুলিয়ে বলে,
-” সুপ্রভাত পাতাবাহার! তুমি খুবই লক্ষীটি। ডাকার আগেই উঠে পড়লে। অথচ দেখো তোমার সখি নাকে তেল দিয়ে ঘুমুচ্ছে!”

বিড়াল শাবক প্রশংসায় বোধকরি খুব খুশি হলো অরুণের দিকে পিটপিট করে কিউট ভঙ্গিতে চাইলো। অরুণ তাকে নামিয়ে দিল। ওয়াশরুম হয়ে এসে বিছানায় বসে। কম্ফোর্ট সরিয়ে দেয় চড়ুই যুগলের উপর থেকে। দৃশ্যমান হয় তার হৃদয় কুঠিবাড়ির জোড়া চড়ুইয়ের মুখখানি। ভোর হা করে উবু হয়ে ঘুমুচ্ছে। পাতা ভোরের পাশ ঘেঁষে এলোমেলো হয়ে শুয়ে আছি। তার একটা পা ভোরের উপর উঠে আছে। মেয়েটার ঘুমের অভ্যাস একেবারে যাচ্ছেতাই। এই যে এখন তার কালো রঙের এক টিশার্ট পড়ে আছে সেটাও এলোমেলো! অরুণ হাত বাড়িয়ে ঠিক করে দেয়। গালে হাত রেখে ডাকে বেশকয়েকবার। পাতা মুখ কুঁচকে বিরক্তিকর ভঙ্গিতে ওপাশে ফিরে শুয়ে পড়ে। অরুণ এবার ছেলেকে ডাকে। ভোরও সেম ভঙ্গিতে গুটিসুটি মেরে মুখ লুকায়। অরুণ বিরক্ত হয়ে বলে,

-” রোজ রোজ তোমাদের এই এক কান্ড কাল থেকে সকাল বেলা আমার সাথে হাঁটতে বের হবে দুজন! এখন ওঠো? পাতাবাহার? ভোর?”
নাহ কারো কোনো রেসপন্স নেই। অরুণ পাতার দিকে এগিয়ে যায়। টি শার্ট গলিয়ে হাত গভীরে নেয়! কাজ হয়! পাতা হুড়মুড়িয়ে উঠে বসে। অরুণের হাত ঝটকা দিয়ে সরিয়ে বলে,
-” ভোরের বাবা আপনার নামে আমি কেস করবো! আমার শান্তির ঘুম আপনার সহ্য হয় না। ধ্যাত বা*ল ভাল্লাগে না। শালার জামাই!”

বলে আবার বালিশে মাথা রাখলো পাতা। চোখে তাঁর এক আকাশ সমান ঘুম! শালার জামাই সারারাত ঘুমোতে দেয় নি এখন কানের কাছে এসে প্যাক প্যাক করছে। সে কর কিন্তু এরকম অসভ্য কাজ করে তার আরামদায়ক ঘুম বাবাজির বারোটা বাজানোর কি দরকার ছিলো! লোকটা মোটেও সুবিধার না! এক নম্বরের আসভ্য লোক! অরুণ আহম্মকের মতো তাকিয়ে! এই মিষ্টি মেয়েটার মুখে এসব বস্তি মার্কা গালি! অরুণ গম্ভীর মুখে পুনরায় পাতাকে টেনে তুলে ঝাড়ি দেয়,

-” এসব বস্তি মার্কা ভাষা কোথায় শিখেছো? আর তোমার সাহস তো কম না আমাকেই বলছো এসব!”
ঝাড়িতে পাতা ভয় পায় না। চোখ বুজেই ভেংচি কেটে বলে,
-” ওসব বস্তি মার্কা ভাষা? তাহলে কাল বন্ধুদের সাথে কি আপনি চাইনিজ ভাষায় গালি দিচ্ছিলেন? আর আমার সাহস তো আপনে দেখেনই নাই! এই পাতার মতো সাহসী মেয়ে পৃথিবীতে দুটো নাই।”
অরুণের শান্ত চোখে তাকিয়ে থাকে পাতার দিকে। পাতা পিট পিট করে এক চোখ খুলে পরিস্থিতি বোঝার চেষ্টা করে। অরুণ ছেড়ে দেয় পাতাকে। পাতা ধপাস করে বালিশে শুয়ে পরলো। অরুণ ঝুঁকে আসে ! পাতার উপর সমস্ত ভার ছেড়ে দিয়ে গলার ভাঁজে মুখ গুঁজে বলে,

-” খুব সাহসী তুমি তাই না? চলো একটা পরীক্ষা হয়ে যাক!”
পাতা ভয়ংকরভাবে কেঁপে উঠলো। কাল রাতের অতিশয় ভয়ংকর অভিজ্ঞতা চোখের পাতায় ভেসে ওঠে। সে ছটফট শুরু করে দেয় ছাড়া পাওয়ার জন্য। অরুণ সরকার মুচকি হেসে গলার ভাঁজে চুমুর বর্ষন শুরু করে। পাতা চমকে ওঠে। বক্ষস্থল কেঁপে ওঠে। সে চাপা স্বরে বলে,
-” কি হচ্ছে টাকি ভোরের বাবা! ছাড়ুন!”
অরুণ মাথা তুলে কপালে অধর ছোঁয়ায়।
-” হুম! ওঠো তাহলে?”
-” উঠছি আপনি সরুণ!”

অরুণ সরে আসে! পাতা নাক টেনে কম্ফোর্ট মুড়িয়ে পুনরায় ঘুমোনোর প্রস্তুতি নেয়।
-” আমি এখন ঘুমাবো ভোরের বাবা! সো ডোন্ট ডিস্টার্ব মি! প্লিজ!”
-” স্কুল..”
অরুণকে থামিয়ে পাতা কটমট করে বলে,
-” রাখুন আপনার স্কুল। ঘুমে আমি চোখে অন্ধকার দেখছি। উনি স্কুল নিয়ে পড়ে আছে। যাবো না।”
অরুণের কপালে ভাঁজ পড়ে। মেয়েটার সাহস বেড়ে যাচ্ছে? তাকে ঝাড়ি দিচ্ছে! তবে সে কিছু বলে না। ঘুমোক একটু! সে এসে ছেলেকে তুলে নিয়ে কোলে বসিয়ে ডাকে,
-” কলিজা? আব্বু? ওঠো?”
ভোর চোখ খুলে পিটপিট করে তাকিয়ে বলে,
-” ভোর ঘুম!”

বলে আবার চোখ বুজে। অরুণ ডাকে এতে ভাবান্তর হয় না। সে বাবার গলা জড়িয়ে ধরে ঘুমে কাতর! অরুণ দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে,
-” ভোর ওঠো? রাতে কিছু খাও নি। ব্রেকফাস্ট করে নাও? এই আনিকার সাথে কি হয়েছে? তুমি কোনো দুষ্টুমি করেছিলে?”
আনিকা নাম কর্ন গহ্বরে প্রবেশ করতেই ভোরের ঘুম ছুটে যায়। মস্তিষ্ক কার্যকর হয়! ভয় ভয় চোখে বাবার দিকে তাকালো। ছেলেকে অরুণ ছেলের থেকেও ভালো চিনে। সে শান্ত গলায় জিজ্ঞেস করে,
-” কি করেছো?”
ভোর ঢোক গিলে বাবার গলা ছেড়ে সরে যায়।পাতার কম্ফোর্টে ঢুকে তাকে জড়িয়ে ধরে বলে,
-” কিছু করি নি আমি কিছু করি নি।”

পাতা চোখ খুলে ভোরকে বুকে জড়িয়ে ভাঙ্গা ভাঙ্গা গলায় সুধায় ‘কি হয়েছে?’ ভোর কিছু বলে না। অরুণ গম্ভীর স্বরে ডাকল,
-” ভোর ভালোয় ভালোয় বলো?”
-” ভোরের বাবা আমি সামলে নেব! আপনি বাচ্চাটাকে বকবেন না। ভয় পাচ্ছে।”
পাতার কথায় অরুণ আশ্বস্ত হয়। বিছানা থেকে নেমে বলে,
-” দশটা বাজতে চললো! আমি রেডি হয়ে অফিসে চলে গেলাম। আপনাদের নিদ্রা বিলাস হলে লাঞ্চ করে নেবেন!”
বলে প্রয়োজনীয় কাপড় বের করে চেঞ্জ করে আসে। রেডি হয়ে ব্যাগে ল্যাপটপ ফাইল ভরে বিছানায় বসে। ঝুঁকে ঘুমন্ত ছেলে ও ছেলের আম্মুর ললাটে ভালোবাসার পরশ বসিয়ে বেড়িয়ে যায়। তার দুঃখের রাজ্যের সমাপ্তি ঘটলো তবে? সুখ পাখি সুখের সাম্রাজ্যের প্রতিস্থাপন করলো তবে? কি জানি!

বাবা চলে যাওয়ার বেশ সময় পর ভোর চোখ খোলে। আম্মুর বুক থেকে মাথা তুলে উঁকি দেয়। কেউ নেই। সে আম্মুর গালে চুমু দিয়ে উঠে বসে। গুটি গুটি পায়ে নিঃশব্দে হেঁটে বেড়িয়ে যায়। ঘুমে কাতর পাতা টের পায় না। সবার আগে সে স্টাডি রুমে গিয়ে বইয়ের তাকে লুকিয়ে রাখা একটা রেপিং করা বক্স বের করে টি শার্টটায় লুকিয়ে নেয়।
ভোর ড্রয়িংরুমে এসে এদিকে ওদিকে তাকিয়ে কাউকে খুঁজে বেড়ায়। কিন্তু কাঙ্ক্ষিত মানুষকে পায় না। সে গুটি গুটি পায়ে হেঁটে দাদির ঘরের সামনে যায়। দরজা দিয়ে উঁকি দিয়ে দেখে কাঙ্ক্ষিত মানুষটাকে। মুখে হাসি ফুটে ওঠে। ধরাম করে দরজা খুলে ডাকে,
-” আনিবুড়ি?”

আনিকা চমকে উঠে। ভয় ভয় চোখে ভোরের দিকে তাকিয়ে থাকে। ভোর মুচকি হেসে এগিয়ে যায়। হাতে থাকা রেপিং এ মোড়ানো বক্সটি আনির সামনে রেখে কান ধরে বলে,
-” ভোর ভেরি ভেরি স্যরি আনি! এই দেখ আমি কান ধরছি আচ্ছা উঠবসও করছি!”
বলেই উঠবস শুরু করে দেয়। আনিকা ভেংচি কেটে গাল ফুলিয়ে অন্যদিকে তাকিয়ে থাকে। রাতে সে একটু মজা করেছিল। পঁচা ভোর কিভাবে মারলো তাকে! এখন স্যরি বললে হবে? ভোর উঠবস থামায় না।
-” আনি তুই না আমার বোন! ভালো বোন! প্লিজ রাগ করিস না। ওই বক্সে তোর ফেভারিট বারবি ডল আছে। গান গায় সাথে নাচেও! ওটা তোর জন্য এনেছি। রূপের মতো আমিও তোর ভাই হই তাই না? প্লিজ স্যরি!”

আনিকা পিট পিট করে চায়। ভোর প্রথমবার এভাবে তাকে স্যরি বলছে। সে বক্সটা হাতে নিয়ে খুলে। ভোর উৎসাহ নিয়ে তাকিয়ে আছে সাথে উঠবস করে। রাতে রাগে আনিকাকে মারলেও সকালে আনিকার কথা মনে পড়ায় তার কষ্ট হচ্ছিল। আনি তো তার বোন হয়। ছোট বোন! ছোট বোনকে কেউ মারে নাকি! আম্মু এই কথা শুনলে তো ভোরকে বকবে। তাকে পঁচা ভাববে। আদর করবে না। ভালোও বাসবে না। আর আব্বু রেগে যাবে অনেক। তাই সে বারবি ডল নিয়ে স্যরি বলে আনিকাকে। বারবি ডলটা আব্বু অনেক আগে এনেছিল আনিকাকে দেয়ার জন্য ভোর লুকিয়ে রেখে দিয়েছিল। তার আব্বু কেন আনিকাকে গিফট দিবে? এখন গিফটটা কাজে লাগে।
আনিকা বারবি ডল দেখে খুশি হয় বেশ। তার ফেভারিট বারবি। ভোরের উপর সব রাগ উবে যায়।সে মুচকি হেসে সামনে দাঁড়িয়ে থাকা দাদির দিকে তাকায়। সেখানে দাদি দাঁড়িয়ে আছে ভোর খেয়ালই করে নি। আসমা বেগমের অধরকোনে হাসির ঝিলিক। সে এসে ভোরের মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়। ভোর বেশ লজ্জায় পড়ে। মিনমিনে গলায় বলে,

পাতা বাহার পর্ব ৪০(২)

-” দাদি আমি সত্যিই অনেক অনেক স‌্যরি! তোমাকেও স্যরি!”
বলে মাথা নিচু করে নেয়। আসমা বেগম ভোরকে কোলে তুলে নিয়ে আনিকার পাশে বসিয়ে দেয়। দু’জনের মাথায় হাত বুলিয়ে দোয়া করে। মুচকি হেসে বলে,
-” কখনো কারো সাথে মারামারি ঝগড়া করবে না। মিলেমিশে থাকবে। ভাই বোন তোমরা! ভোর আনি রূপ!”
ভোর মুচকি হেসে আনিকার যে গালে কাল মেরেছিল সেখানে ও মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়। আনিকা ভোরের গাল টেনে দেয় শক্ত করে। ভোর রাগে না। মুচকি হাসলো। আসমা বেগম দুজনের কান্ড দেখে হেসে ফেললো শব্দ করে।

পাতা বাহার পর্ব ৪১(২)