পাতা বাহার পর্ব ৪২

পাতা বাহার পর্ব ৪২
বেলা শেখ 

নিস্তব্দ রজনী। ঘড়িতে এগারোটা বেজে পঁয়ত্রিশ মিনিট। অরুণ সরকার সোফায় বসে আছে গালে হাত দিয়ে। উত্তেজনায় চোখে ঘুম এখনো ধরা দেয় নি। দিবে কিভাবে? তার কলিজার বার্থডে! ছেলেটা পাঁচ পেড়িয়ে ছয়ে পা দিবে। ভাবতেই অবাক লাগে তার ছেলেটা দেখতে দেখতে ছয় বছরের হয়ে গেল! কদিন আগে না নার্স সাদা তোয়ালে মোড়ানো এক পিচ্চি বাচ্চা তার হাতে দিলো! সে কি কান্না জুড়ে দিয়েছিল তার কাছে এসে। থামার নামই নেই। সে তো ঘাবড়ে গিয়েছিলো। বুকটা ধ্বক ধ্বক করছিল! বাচ্চাটার কিছু না হয়ে যায়। অনেক বছর পর অরুণ সেদিন ছেলের কান্নায় কেঁদেছিল! তারপর থেকে ছেলে কাঁদলে তার চোখটাও জ্বলে ওঠে। ঠিকরে বেড়িয়ে আসতে চায় নোনাজল। বুক ভারি হয়ে ওঠে নিমিষেই।

ধীরে ধীরে ছেলে বড় হলো। অ আ বুলি শিখলো! অরুণের তখন মনে হতো সারাক্ষণ ছেলেটার সামনে বসে তার বুলি শুনতে। তখন সে প্রায়ই অফিস ম্যানেজারের কাছে সপে বাড়িতে আস্তানা গড়ে নিতো। কখনো ল্যাপটপ নিয়ে ছেলের সামনে বসেই সব কাজ সেরে ফেলতো। চাঁপা স্বভাবের গম্ভীর অরুণ ছেলের সাথে আধো আধো বুলি আওড়িয়ে হাসাতো, খেলতো।ছেলেটা বাবা অন্ত প্রাণ হলেও প্রথমবার কিন্তু মা’ কেই ডাকতে শিখেছে। এ নিয়ে অরুণ পুরো দুদিন ছেলেকে কোলে নেয় নি আর না কথা বলেছে। পরে নিজের বোকামিতে নিজেকে শাসিয়ে তার কলিজাকে কোলে তুলে নিয়ে আদরে আদরে ভরিয়ে দেয় তখনই ভোর ছোট্ট হাতে অরুণের নাকে একটা থাপ্পড় লাগিয়ে বা বা বলে। অরুণ প্রথমে ফ্যালফ্যাল করে চেয়েছিল। ভোর শরীর দুলিয়ে হেসে আবার বা বা বলতেই অরুণের শরীর জুড়ে আলাদা শিহরণ বইয়ে বেড়ায়। প্রথম প্রথম ভোর যতবারই বা বা বলেছে অরুণ মনে হয় নতুন করে নিজেকে চিনেছে। সে এখন কারো বাবা! ভোর হাঁটতে শিখে খুবই ধীর গতিতে। দেড় বছরে হাঁটতে শিখেছে। প্রথম একটু হেঁটেই বসে পড়ে কাঁদো কাঁদো গলায় বলতো,

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

-” বা বা পা তায়াড! কুলে?”
হাত বাড়িয়ে দিতো কোলে নেয়ার জন্য। তখন ছেলেকে কোলে তুলে ঘারে বসিয়ে নিয়ে নিজে ঘুরে বেড়াতো এদিকে ওদিকে। ছোট ভোর লাল টকটকে অধর নাড়িয়ে ভাঙ্গা ভাঙ্গা শব্দে অনেক কথাই বলতো। একদন্ড সে চুপ থাকতো না। ছটফটে চঞ্চলতায় ভরপুর ছিলো। সবসময় হাসবে খেলবে। ছোট্ট আনিকাকে দেখে বলতো,
-” চোত বুন? আনি!

যার মুখে যেটা শুনবে সেটাই তার বুলি! একটা হাসিখুশি বাচ্চা। এই হাসিখুশি বাচ্চাটা হাসির প্রদীপ নিস্প্রভ হয়ে যায় যখন তার মা চলে যায়। কেউ সামলাতে পারতো না তাকে। শুধু এক নাগাড়ে হাঁউমাঁউ করে কেঁদেই যেতো! মা মা বলে গলা ফেটে কাঁদতো। তখন সে বাবা কেও তোয়াক্কা করতো না‌। তার মা চাই! মা আনো! মা আনো! বলে কাঁদতো। ছেলেটার তখনও দু বছর পড়ে নি। মায়ের বুকের দুধ ছাড়ে নি। মা যাওয়ার পর জোর করেও তাকে খাওয়ানো যেতো না। কাঁদতে কাঁদতেই ঘুমিয়ে পড়তো‌। ঘুমের ঘোরে মুখে ফিটার দিলে চুক চুক করে খেতো! ঘুম ভাঙলে আবার কান্না!

ধীরে ধীরে তার কান্না থেমে যায়। সাথে ছটফটে চঞ্চলে স্বভাবের ভোর একদম শান্ত ছেলে। কারো সাথেই কথা বলবে না। চুপটি করে যে কোলে নেবে তার গলা জড়িয়ে নিস্প্রভ চোখে চেয়ে থাকবে। যেন সে প্রাণহীন এক জড় পদার্থ। অরুণ ভোরকে অফিসে নিয়ে যাওয়া শুরু করলে ছেলেটা ধীরে ধীরে স্বাভাবিক হয়। অপর্না, লাবিব, মিসেস রুনা সহ আরো কয়েকজন স্টাফদের সাথে তার বেশ ভাব হয় ধীরে ধীরে। হয়ে ওঠে সেই আগের ছটফটে ভোর। তবে খুবই সেনসিটিভ। কখনো সে বুঝদার ছেলে;তো কিছু কিছু বিষয়ে সে বড্ডো অবুঝ ও নাছোড়বান্দা! সবার সাথেই মিশে যাবে নিমিষেই। ছোট ,বড়, বুড়ো আর জোয়ান সবার সাথেই অল্প সময়েই মিশে যাবে। যাকে ভালো লাগবে তাঁর কাছে ঘুরে ফিরে যাবে। যে আদর করবে তার কোলে উঠে বসে থাকবে। তার আদুরে চঞ্চল ছেলেটা তাঁর প্রাণভোমরা। ছেলেটা হাসলে তার মনটা হাসে। কাঁদলে তাঁর বুকটা কাঁদে। মলিন মুখ দেখলে তার হৃদয়টা পুড়ে যায়।অরুণের ভাবনার সমাপ্তি ঘটে কোলে কারো জায়গা দখল নেয়ায়। পাতাবাহার মিও মিও করে ডেকে অরুণের কোলে শুয়ে পড়ে। অরুণ ছোট ছোট করে তাকিয়ে তার গায়ে হাত বুলিয়ে বলে,

-” সবসময় আমার পিছনে পড়ে থাকো কেন পাতাবাহার? তোমার ভাবসাব তো সুবিধের না! আমার কিন্তু তোমার চেয়েও কিউট আদুরে একটা বউ আছে!”
বিড়াল শাবকটি মিও মিও করে। অরুণ গম্ভীর ভঙ্গিতে তার কান টেনে দেয়। এই বিড়ালটা একদম গা ঘেঁষে থাকে তার। সে বাড়িতে থাকলে আর কারো কাছেই যাবে না। তার পিছু পিছু আঠার মতো লেগে থাকবে।প্রথম প্রথম একটু বিরক্ত হলেও এখন ভালোই লাগে। অরুণ ভেবে পায় না সে বিড়ালছানাকে সেভাবে কখনো কাছে টানে নি তবুও কেন তার সঙ্গ এর পছন্দ। মাঝে মাঝে দু একটা কথা বলতো, কান টেনে দিয়ে গা বুলিয়ে দিতো এই যা!
অরুণ উঠে বিছানায় ছেলের শিয়রে বসে মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়। আদর করে। তাঁর বুকটা কেমন চিন চিন করছে। কেমন একটা অদ্ভুত অনুভুতি হচ্ছে। বুকটা কাঁপছে অনবরত। ভয় ভয় লাগছে। মনে হচ্ছে কিছু একটা হবে। কিছুদিন হলোই তার এমন মনে হচ্ছে। চিন্তায় মাথা ঘুরপাক খায়। অরুণ আবার ঝুঁকে ছেলের গালে মুখে চুমু দেয়। ভোর নড়াচড়া করে পাশ ফিরে শোয়। অরুণ সরে আসে। পাতাকে ওঠায় ঘুম থেকে। পাতা ঘুম ঘুম চোখে অরুণের দিকে তাকিয়ে।

-” আমার ঘুমের সাথে আপনার কিসের শত্রুতা ভোরের বাবা?”
অরুণ ছোট ছোট করে চেয়ে পাতার এলোমেলো চুল হাত বাড়িয়ে গুছিয়ে দেয়। পরনের লং শার্টটার উপরের বোতাম আটকে দিয়ে শান্ত গলায় বলে,
-” উঠো! বারোটা বাজতে চলল! ভোরকে উইশ করবে না?”
পাতার ঘুম ছুটে যায় নিমিষেই। ঘুমন্ত ভোরের দিকে একপলক তাকিয়ে বলে,
-” হুম! তাই বলে এভাবে ওঠাবেন?”
-” কিভাবে উঠিয়েছি?”
অরুণের গম্ভীর গলা শুনে পাতা কটমট করে চায়‌। মনে মনে ভেঙায় ‘কিভাবে উঠিয়েছি?’ এ মুখে বলা যায়! অসভ্য লোক! পাতা রিমোট হাতরে লাইট অন করে। এতক্ষণ ড্রিম লাইট জ্বলছিল! সাদা ঝলমলে আলোয় পুরো রুমের ডেকরেশন দেখে সে অবাক!লাল গোলাপ আর বেলুনে সজ্জিত ঘর। এসব কখন করলো?

-” এসব আপনি করেছেন?”
-” না! আরিয়ান আর আদুরি এসে সাজিয়ে দিয়ে গেছে!”
পাতা খানিকটা আতংকে চায় অরুণের কথায়। আরিয়ান ভাই ছিল ঘরে? তার ঘুমানোর কোনো ছিড়ি নেই। অরুণ হয়তো তার মুখের আদল দেখে বুঝতে পারলো। বিছানা থেকে উঠে বলল,
-” কম্বলে আপাদমস্তক ঢেকে ছিলে দুজন!”
পাতা স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়লো। বিছানা থেকে নেমে বলে,
-” ওনারা কোথায়? আমাকে ডাকেন নি কেন?”
অরুণ ঘড়িতে সময় দেখে! পঁয়তাল্লিশ বাজে। আর মাত্র পনেরো মিনিট। সে পাতার কথার জবাবে দেয়,
-” ঘুম পাগল তুমি। তাই ডিস্টার্ব করি নি। আর ঘর ডেকোরেশনের কোনো প্ল্যান ছিল না। আরিয়ান আদুরি এসে সাজিয়ে দিয়ে গেলো। ওরা সবাই এলো বলে। ওড়না নাও?”
পাতা ওড়না পেঁচিয়ে নেয় গলায়। সোফায় অরুণের পাশে পা তুলে বসে বলে,

-” কত বাজে?
-” ফোরটি সিক্স!”
-” কেক দেখি কেমন বেক করেছেন?”
অরুণ টি টেবিলে রাখা কেকের ঢাকনা তুলে দেখায়। পাতার চোখে মুখে অবাকতার রেশ! এই কেক উনি বানিয়েছে? একদম পারফেক্ট! মনে হচ্ছে অর্ডার করে এনেছে। ছোট সাইজের চকলেট কেক! সুন্দর ডিজাইন করা! উপরে হ্যাপি বার্থডে লেখা। ভোরের নাম উল্লেখ করে নি। ছয়টা ছোট মোমবাতি দাঁড়িয়ে আছে কেকের উপর। পাতা অরুণের এক বাহু জড়িয়ে সেখানে মাথা ঠেকিয়ে বলে,

-” আপনি তো পুরোই অলরাউন্ডার! অফিস সামলান! রান্না বান্নায় এক্সপার্ট! বেকিংও করতে পারেন।”
-” হুম সাথে আরো দুটো বাচ্চা সামলাই!”
ভোর ও পাতাকে ইশারা করে গম্ভীর মুখে বলে। পাতা ছোট ছোট করে তাকিয়ে হেসে ওঠে খিলখিলিয়ে। অরুণের মুখে হাসির ছিটেফোঁটাও নেই। কেমন গম্ভীর ও থমথমে। পাতা খেয়াল করে হাসি থামায়। মাথা উঁচিয়ে জিজ্ঞেস করে,
-” কি হয়েছে আপনার? চিন্তিত লাগছে!”
-” কিছু না!”

পাতা তার বাহু ছেড়ে দিয়ে সোজা হয়ে বসে। হাঁটু ভাঁজ করে সেথায় থুতনি ঠেকিয়ে বসে থাকে। শুনেছে স্বামীরা ঘরে বাইরের টুকটাক সব কথাই বউয়ের সাথে শেয়ার করে। কিন্তু এই লোকটা সব নিজের ভিতরেই পুষিয়ে রাখবে। কখনো কিছুই বলবে না। সে জিজ্ঞেস করলে বলবে কিছুই হয় নি। এরপরও যদি জোর করা হয় ব্যস! মহারাজ বিরক্ত হয়ে মেজাজ হারিয়ে ফেলেন। তাদের মাঝে শুধু ভোরের ও তার বিষয়ে কথা হয়। পাতার ভাবনার মাঝেই নক করে প্রবেশ করে আরিয়ান, আনিকা, রুবি, রূপ, আসমা বেগম, আনিকা ও আভারি! সবার হাতেই কিছু না কিছু গিফট আছে। পাতা অস্বস্তিতে পড়ে। তাঁর কাছে তো কোনো গিফট নেই। সে কি দেবে ভোরকে? আনিকা ঘুমে ঢুলু ঢুলু পায়ে এগিয়ে এসে দাঁড়িয়ে থেকে বিছানায় মাথা রাখে। আরিয়ান হেসে বলে,

-” ভোরকে উইশ করবে বলে ঘুমাবে না। ফোন দেখতে দেখতে কখন ঘুমিয়ে পড়েছে। ডেকে তুলে এনেছি। নইলে সকালে চিল্লাচিল্লি শুরু করবে।”
বলে মেয়েকে বিছানায় বসিয়ে দেয়। আদুরি অনেকগুলো বেলুন হাতে দাঁড়িয়ে বলে,
-” আর মাত্র পাঁচ মিনিট ভাই! ওর মাথায় বেলুন ফাটিয়ে জাগাবো কিন্তু?”
পাতা সোফা থেকে উঠে আসে। আদুরির পাশে দাঁড়িয়ে বলে,
-” ভয় পাবে! নরমালি ডেকে তোলার পর ফাটিও বেলুন!”
আদুরি সায় জানালো। অরুণ কেকটা নিয়ে উঠে আসে। পাতা পিছিয়ে যায়। আসমা বেগমের কাছে গিয়ে ফিসফিস করে বলে,

-” আমাকে আগে জানাতে পারতে মা! আমি রাতে জেনেছি!”
-” ইশ্! আমি ভেবেছিলাম তুমি জানো!”
পাতা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে। রুবির কোল থেকে ছোট রূপ পাতাকে দেখে মুচকি হাসে। হাত বাড়িয়ে ‘আ মা’ ডাকে। পাতা তার নাক টেনে কোলে নেয়।
অরুণ কেকেটা রূবির কাছে দিয়ে ভোরের পাশে বসে গালে হাত রেখে মৃদু চাপড় মেরে ডাকে,
-” আব্বু? এই ভোর? কলিজা? ওঠো!”
ভোর চোখ পিটপিট করে তবে ওঠে না। অরুণ আরো কয়েকবার ডাকে কাঁধ ঝাঁকিয়ে। ভোর লাফ দিয়ে ওঠে। অরুণ ছেলেকে বুকে জড়িয়ে কপালে চুমু দিয়ে বলল,
-” হ্যাপি বার্থডে কলিজা!”
ভোর বুক থেকে মাথা তুলে ফ্যাল ফ্যাল করে চায়! তখনই আদুরি এগিয়ে এসে ভোরের মাথার উপর বেলুন ফাটায় গোটা চারেক। সকলে সমস্বরে বলে,

-” হ্যাপি বার্থডে ভোর!”
বিড়াল শাবটিও মিও মিও করে। ভোর পলক ঝাপটায় ঘন ঘন। সে কি কোনো স্বপ্ন দেখছে? ভোর বাবার গালে মুখে হাত রাখল বোঝার জন্য। হ্যাঁ সত্যিই তো বাবা! ভোরের মুখে মিষ্টি হাসি ফুটে উঠলো। আজ তার হ্যাপি বার্থডে? তাঁর তো একটুও মনে ছিল না। তার ঘুম ছুটে পালায়। বাবার কাছে থেকে সরে গিয়ে হাসিমুখে বলে,
-” আজ আমার বার্থডে! আমি তো ভুলেই গিয়েছিলাম! থ্যাংক ইয়ু সবাইকে!”
রুবি একটা ছোট টেবিল এনে বিছানায় রাখে। কেকটা সেখানে সাজিয়ে দিয়ে বলে,
-” নাও কেকটা কাটো! তোমার আব্বু নিজের হাতে বানিয়েছে! তোমার ফেবারিট চকলেট কেক!”
ভোর বাবার দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসি দিয়ে গলা জড়িয়ে ধরে।গালে টপাটপ কয়েকটা চুমু বসিয়ে বলে,

-” ভোর লাভস ইয়ু সো মাচ আব্বু কলিজা!”
অরুণ প্রতিত্তরে ছেলের গালে মুখে আদরের বন্যা বইয়ে দেয়।
-” আব্বু ওলসো লাভস ইয়ু ঠ্যু মাচ কলিজা!”
অরুণের বলা শেষ হতেই সবাই সমস্বরে চেঁচিয়ে বলে,
-” উই ওলসো লাভ ইয়ু ভোর!”
আনিকা কানে হাত দেয়। বিরক্ত হয়ে ভোরকে বলে,
-” এই কেক কাটতো? ঘুম পাচ্ছে আমার!”

বলেই হামি তুলে। সবাই হেসে ওঠে। আরিয়ান ছুরি এগিয়ে দেয়। ভোর হাতে নিলো! অরুণ দিয়াশলাই জ্বালিয়ে মোমবাতি গুলো জ্বালিয়ে দেয়। ছেলেকে কোলে বসিয়ে মোমবাতিতে ফুঁ দিতে বলে। ভোর অতি উৎসাহের সাথে এক ফুঁ দিয়েই সব নিভিয়ে দিলো। সবাই হাততালি দিয়ে উইশ করে। আদুরি পার্টি স্প্রে করে অরুণ ভোর ও আনিকার মাথায়। অরুণ ছেলের হাত ধরে কেক কেটে ছেলের মুখে পুরে দেয়। ভোরও বাবার মুখে দিলো। তারপর একে একে সবার। পাতা রূপকে কোলে নিয়ে হাসিমুখে দাঁড়িয়ে। পাশে আসমা বেগম খানিকটা গম্ভীর মুখে। কেক কাটার সময় পাতার উপস্থিতি তার পাশে নয় বরং ভোরের পাশে হওয়া উচিত ছিল! অথচ বাপ ছেলে ভুলেই গেছে বেচারিকে। ভোর দাদিকে কেক খাইয়ে আম্মুর দিকে তাকায়। রূপকে তার কোলে দেখে গালটা ফুলে যায়! কেক খাইয়ে না দিয়ে হাতে দিয়ে বাবার কাছে আসে। পাতার মুখটা মলিন হয়ে আসতে চায়; তা লুকিয়ে হাসি ফুটে তোলে। রূপকে আসমা বেগমের কোলে দিয়ে হাতের কেকটা নিয়ে ভোরের মুখের সামনে ধরে বলে,

-” জন্মদিনের অনেক শুভেচ্ছা ভোর! দোয়া করি অনেক বড় হও। এই অধর জুড়ে সর্বদা মিষ্টি হাসি বিরাজমান থাকুক!”
ভোর অল্প কেক মুখে নিয়ে পাতাকেও খাইয়ে দেয়। অরুণের টি শার্টে হাত মুছে পাতার গলা জড়িয়ে বলে,
-” আই লাভ ইয়ু আম্মু!”
-” মি ঠ্যু!”
ভোর পাতাকে আর ছাড়ে না। সে ছেড়ে দেবে আর ওই রূপ আবার তার আম্মুর কোলে উঠবে? আ মা ডাকবে? সেটা তো হবেনা। অরুণ সরে বিছানার মাঝখানে বসে পাতাকে জায়গা করে দেয়। পাতা সেখানে বসলে ভোর তার কোলে বসে। রূপ আসমা বেগমের কোল থেকে ‘আ মা, আ মা’ করে হাত বাড়িয়ে ডাকে। ভোর কপাল কুঁচকে পাতার হাত জোড়া আটকে নেয়। পাতা হাসে। অরুণ হাত বাড়িয়ে ইশারায় ডাকে। রূপ হেসে ঝুঁকে আসে। আসমা বেগম অরুণের কোলে দেয়। ভোর নাখশ চোখে চায়। আম্মুকে ছেড়ে এখন তাঁর আব্বুকে ধরেছে পঁচা রূপ! অরুণ রূপের মুখে ক্রিম দেয়। সে সেটা গলাধঃকরণ করে সামনে রাখা বাকি কেকে থাবা মেরে হাতে মাখিয়ে মুখে দেয়। গাল মুখে ক্রিম লেগে যায়। সবাই হেসে উঠল তবে ভোর গাল ফুলিয়ে কাঁদো কাঁদো হয়ে বলে,

-” আমার কেক!!”
অরুণ টিস্যু দিয়ে রূপের মুখটা মুছে বলে,
-” কলিজা আবার বানিয়ে দেবো তো!”
ভোর আর কিছু বলে না। সবাই একে একে তাকে গিফট দিয়ে দোয়া করে। সাথে আদর করতে ভোলে না। গিফটের থেকে ভোর আদর পেয়ে মনে হয় বেশি খুশি হয়েছে।হালকা আড্ডা দিয়ে সবাই বিদায় নিয়ে বেড়িয়ে যায়! বাকি কেক টুকু পাতাবাহার চেটেপুটে খেতে থাকে! অরুণ উঠে দরজা লাগিয়ে সব গুছিয়ে নেয়। বিছানায় শুয়ে লাইট অফ করে ড্রিম লাইট জ্বালিয়ে দেয়। ভোর মাঝখানে পাতা অরুণ দু পাশে। ভোরের চোখে মুখে উৎফুল্ল! ঘুমের অবকাশ নেই।

-” ও আব্বু? আমার না আইসক্রিম খেতে ইচ্ছে করছে! একটু খাই?”
ভোর বলেই আড়চোখে বাবার দিকে তাকালো। সে জানে বাবা এখন একটু মানা করবে না। অরুণ পুনরায় লাইট জ্বালিয়ে মিনি ফ্রিজটা থেকে একটা বড় ভ্যানিলা আইসক্রিমের বাটি নিয়ে আসে। সাথে একটা চামচ।ভোর আইসক্রিম দেখে উঠে বাবু হয়ে বসল।অরুণ বাটি খুলে তার হাতে দেয়। ভোর গপাগপ মুখে পুরে দুই চামচ। পরপরই আরেক চামচ তুলে পাতার মুখে ধরে বলে,

-” আম্মু খাও?”
পাতা উঠে বসে মুখে নেয়। ভোর এবার চামচে ভরে বাবার মুখে দেয়‌। অরুণ আইস্ক্রিম মুখে নিয়ে ভোরের হাত থেকে চামচ সহ আইসক্রিমের বাটি নিয়ে বলল,
-” আমি খাইয়ে দিচ্ছি!”
-” আব্বু! আমার না অনেক হ্যাপি হ্যাপি লাগছে! আজ আমার বার্থডে। আমি যা বলব তাই হবে! আব্বু তুমি কিন্তু একটুও মানা করবে না। আর বকবেও না।”
-” ওকে কলিজা!”

-” আম্মু? তুমি আমাকে অনেক অনেক আদর করবে! আমি তুমি আব্বু অনেক মজা করবো! কিন্তু রূপকে একটুও কোলে নিবে না। একটুও না। তাহলে ভোর রাগ করবে! হুম! ”
পাতা তার গাল টিপে দিয়ে চুমু দিয়ে বলে,
-” যো হুকুম মেরে আজ্ঞা!”
ভোর হেসে উঠলো।
-” আব্বু কাল কিন্তু আমি আম্মু স্কুলে যাবো না। তুমিও অফিস যাবে না।ঠিকাছে?”
-” ঠিকাছে!”
বিড়াল শাবকটি বিছানায় উঠে আসে। অরুণের কাছে গিয়ে মিও মিও করে ডেকে লেজ নাড়ে। ভোর কাছে ডাকে পাতা নাক ছিটকে বলে,
-” এটাকে এখন একদমই কোলে নেবে না। দাঁড়াও আমি খাঁচায় পুরে দিই!”
বিড়াল শাবকটি যেন এর ঘোর বিরোধীতা করে।ভলিউম বাড়িয়ে মিও মিও করে অভিযোগ করে অরুণের কাছে। অরুণের মায়া হয়। পাতার মুখে আইসক্রিম পুরে থামিয়ে দিল।
-” খাঁচায় ভরতে হবে না। সি ইজ আ গুড গার্ল! তাই না পাতাবাহার?”

বিড়াল শাবকটি মিও মিও করে সায় জানালো। পাতা ভেংচি কাটলো মনে মনে। আহা! কি দরদ! অরুণ উঠে বিড়ালের দুধের বাটি আনে। সেখানে আইসক্রিম দেয় দুই চামচ! বিড়াল শাবক লেজ নাড়িয়ে খুশি প্রকাশ করে। অরুণের পায়ে গা ঘেঁষে আইসক্রিম চাটতে শুরু করে। অরুণ পুনরায় বিছানায় বসে। পাতা হামি তুলে ভোরকে বলে,
-” তো বার্থডে বয়? কি গিফট চাই তোমার বলো? যা চাইবে তাই পাবে?”
ভোর গোল গোল করে তাকালো আম্মুর দিকে।

-“যা চাই তাই দিবে আম্মু?”
পাতা তার গালে চুমু দিয়ে বলে,
-” হ্যাঁ! বলো! সবাই গিফট দিলো! তোমার আব্বু, চাচ্চু, চাচি, ফুপ্পি, দাদি, আভারি কাক্কু! শুধু আমিই বাকি আছি, তাই না? এখন বলো?”
ভোর ভাবে সময় নিয়ে। তারপর পাতাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বলে,
-” আম্মু তুমি কখনো আমাকে ছেড়ে যেও না। আমাকে সবসময় ভালোবেসো! সবসময়!”
কেঁপে কেঁপে ওঠে ভোরের ছোট শরীর। পাতা ঠাহর করতে পারে। বুকে জড়িয়ে নিয়ে আদুরে গলায় বলে,
-” আমি সবসময় তোমার পাশে থাকবো ভোর! সবসময়! ভোরের আম্মু হয়ে। আর ভালো কিভাবে বাসে? সেটা তুমিই শিখিয়ে দিও! আর ছেড়ে যাওয়ার প্রশ্নই আসেনা।”
ভোর অধর কোনে হাসি ফুটে উঠলো। আম্মুকে ছেড়ে দিয়ে দাঁড়ায়। পাতার মুখটা ছোট দু হাতের আঁজলায় ভরে কপালে, গালে, নাকে চুমু দিয়ে বলে,

-” আম্মু তুমি অনেক ভালো!”
পাতার চোখ ভরে গেল নিমিষেই। এতোটা ভালোবাসা! এতোটা বিশ্বাস! এতোটা যত্ন! সে এসবের মূল্য দিতে পারবে আদৌও? এক নিষ্পাপ শিশু কে অজান্তেই না দুঃখ দেয়। যেমনটা আজ দিয়েছিল! ভোর পাতার চোখের পানি মুছে দিয়ে কাঁদো কাঁদো গলায় বলে,
-” আম্মু তুমি কাঁদছো? আমিও কিন্তু কেঁদে দেবো?”
পাতা ভোরকে বুকে জড়িয়ে চুমুতে ভরিয়ে দেয়। এই ছেলেটা এতো ভালো? এতো মিষ্টি? অরুণ চুপচাপ গম্ভীর মুখে আইসক্রিম খাচ্ছে। আইসক্রিম তারও খুব ফেভারিট। সে একের পর এক চামচ ভরে আইসক্রিম মুখে পুরছে আর পাতা ভোরকে দেখছে।

-” ছিচকাদুনের দল! তোমাদের কান্না জলদি শেষ করো! নইলে এদিকে আইসক্রিম শেষ হয়ে যাবে!”
ভোর আম্মুকে ছেড়ে বাবার হাত থেকে বাটি কেড়ে নিয়ে বলে,
-” আব্বু? তুমি তো শেষ করে দিচ্ছো! বাকিটুকু আমার আর আম্মুর!”
-” তাই?”
-” হুম! দাও চামচ?”
অরুণ দেয়। তিনজনের হাসি খুনসুটিতে সময় পেরিয়ে যায়। পাতার চোখ ঘুমে ঢুলুঢুলু। বারংবার হামি তোলে। তবে ভোরের চোখে ঘুম নেই। সে বাবার সাথে কথা বলছে। এটা ওটা টুকটাক সব বিষয়েই।
‘রূপ কেন তার আম্মুকে মা বলবে? আব্বু যেন রূপকে বকে বারণ করে দেয়।’

আনিকা কেন সবসময় ব্যাট করবে? আউট হলেও ব্যাটই করবে নইলে খেলবে না। কেন? এটাতো রুলস নয়!
মিনু খালার পেটের বাবু কবে হবে? আচ্ছা পেটের ভিতর থেকে বাবু কিভাবে শ্বাস নেয়? কি খায়? এরকম হাবিজাবি অনেক কথা! তার কথা, প্রশ্ন ও অভিযোগের ঝুড়ি ফুরায় না। অরুণ অতি ধৈর্য্যের সাথে ছেলের সব কথা শুনছে; মাঝে মাঝে ব্যাখাও দিচ্ছে। পাতার পক্ষে আর চোখ খুলে রাখা সম্ভবপর হয় না তাই সে ঘুমে কাত! এদিকে বাবা ছেলের আলাপচারিতা ফুরোয় না। ভোর এটা ওটা বলে লাল টুকটুকে অধর নাড়িয়ে। অধরকোনে মিষ্টি হাসি। অরুণ পলকহীন তাকিয়ে থাকে ছেলের মুখের দিকে। ভোর কথা বলতে বলতে খেয়াল করে বাবাকে। সে বাবার গালে হাত রেখে বলে,

-” ও আব্বু ঘুম পাচ্ছে তোমার?”
অরুণ ছেলেকে টেনে বুকের উপর তুলে চিৎ হয়ে শোয়। কম্বলে ঢেকে নিয়ে পিঠে, চুলের ভাঁজে ভাঁজে হাত বুলিয়ে বলে,
-” কলিজা? অনেক রাত হয়েছে ঘুমাও মানিক!”
ভোর মাথা তুলে বাবার বুকে কুনুই ঠেকিয়ে গালে হাত রেখে ঠোঁট উল্টিয়ে বলে,
-” কিন্তু আমার তো একটুও ঘুম পাচ্ছে না!”
অরুণ শান্ত চোখে ছেলের দিকে চায়,
-” আব্বুর বুকে মাথা রাখো! ঘুম পাড়িয়ে দিচ্ছি!”
ভোর রাখে না। এগিয়ে এসে বাবার কপালে চুমু দেয়। নাকে কামড় দিয়ে খিলখিলিয়ে হেসে উঠলো। অরুণ নাক কুঁচকে বলে,

-” আমার দুষ্টু আব্বু!”
-” আমার নাক উঁচু আব্বু!”
বলেই ভোর হাসিতে ফেটে পড়ে। অরুণের কপালে ভাঁজ পড়ে। ওহ্ আম্মুর ছেলে আম্মুকে কপি করছে!
-” ভোর এভাবে বলতে পারলে?”
শান্ত গলায় বলে অরুণ। ভোরের হাঁসি থেমে যায়। ভাবে আব্বু হয়তো কষ্ট পেয়েছে তাঁর কথায়। সে পিটপিট করে তাকিয়ে বাবার নাকে পরপর তিনটে চুমু দিয়ে বলে,
-” আমার আব্বুর নাক একটুও উঁচু না। সবথেকে পার্ফেক্ট। আমি তো মজা করে বলছিলাম!”
অরুণ হেসে ছেলের গালে মুখে চুমু দেয়। পরপর ঠোঁটে চুমু খেয়ে বলে,

-” আব্বু আমার মানিক! অনেক হয়েছে। এখন ঘুমাও! রাত দুটো বাজতে চললো!”
ভোর পিটপিট করে বাবার দিকে তাকিয়ে বলল,
-” আব্বু তুমি তো আমাকে গিফট দিলে না?”
-” কাল দেব!”
ভোর খুশি হয়ে বাবার বুকের উপর উঠে বসে। কৌতূহল মনে জিজ্ঞেস করে,
-” কি গিফট দেবে?”
-” একটা লাল টুকটুকে বউ এনে দেবো তোমায়। খুব মিষ্টি দেখতে হবে।”

ভোরের মুখমানি চুপসে যায়। সে বউ দিয়ে কি করবে? সে আর একটা কথাও বলে না। গাল ফুলিয়ে বাবার গলায় মুখ গুঁজে চোখ বন্ধ করে। অরুণ হাসে এই টুকু ছেলের এতো লজ্জা! সে ছেলের মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে থাকে। ভোরের চোখে সহজে ঘুম নামে না। বাবার কাঁধ থেকে মুখ সরিয়ে নিয়ে বুকে মাথা রাখে। উশখুশ করে বাবার বুক থেকে নেমে বাহুতে মাথা ঠেকিয়ে শোয়। কখনো পেটের উপর মাথা রাখে। আবার ওদিকে ঘুরে বালিশে মাথা রাখে। অরুণ কাত হয়ে ছেলেকে টেনে পিঠটা বুকের সাথে লেপ্টে নেয়। গলায় বুকে হাত বুলিয়ে দোয়া পড়ে চোখের পাতায় ফুঁ দেয়। ভোর কিছু সময় পর ঘুমিয়ে পড়ে।

সরকার বাড়ির পরিবেশ রমরমা! অতিথিদের আগমন চোখে পরার মতো। মেয়র স্বাধীন চৌধুরী, সাবিনা চৌধুরী, অরুণের সব বন্ধুরা তার পরিবার সহ‌। রুবির বাবার বাড়ির আত্নীয় স্বজন। আসমা বেগমের বোন আসমানী বেগমও এসেছে দুই নাতি নাতনি সমেত। বাড়িতে এখন সকলের হৈ হুল্লোড়ে মুখরিত পরিবেশ। ডেকোরেটরের জন্য কিছু লোক এসেছে। তারা ড্রয়িং রুমের একপাশ ডেকোরেট করছে। আরিয়ান তাদের ইন্সট্রাকশন দিচ্ছে। অরুণ বন্ধুদের সাথে বসেছে পুকুর ঘাটের শান বাঁধানো জায়গায়। অরুণ বন্ধু কিশোর বনে যায়। বন্ধুদের সাথে মেতে থাকে আড্ডায়। পাতাও অতিথি আপ্যায়নে ব্যস্ত সময় পার করছে। সকলের সব সুবিধা অসুবিধা নিজেই দেখছে। লোক সমাগম ভালো না লাগায় মিনু ঘরে শুয়ে আছে। আভারি বাজার করতে বেরিয়েছে। ভোর তার সমবয়সী খেলার সাথী পেয়ে যেন সব ভুলে গেছে। এদিকে ওদিকে ছুটে খেলতে ব্যস্ত। সারে এগারোটা বাজতে চলল এখনো সকালের নাস্তা পেটে নেয় নি। শুধু মিনি সাইজের বার্গার খেয়েছে একটা। পাতা গরম ভাত ও মাছ ভাজা নেয় একটা বাটিতে। ভোরের কাছে গিয়ে বলে,

-” ভোর সোনা? অনেক খেলেছো! খেয়ে নাও। দুপুর হতে চলল এখনো সকালের নাস্তাই করো নি!”
ভোর কালো শার্ট ও ফুল প্যান্ট পড়েছে। কোমড়ে বেল্ট; শার্ট ইন করা! চোখে কালো সানগ্লাস! পুরোই ড্যাসিং লুক! এ ছেলে বড় হলে মেয়েদের লাইন লাগবে পিছনে। পাতার ইচ্ছে করে বাচ্চাদের মতো করে ভোরের কপালের একপাশে কালো টিকা দিয়ে দিতে।ভোর বড় খেলনা বন্দুকটা আনিকার দিকে তাক করে; এক আঙুলে চশমা খানিক নিচে নামিয়ে চশমার উপর দিয়ে তাকিয়ে বলে,

-” ইয়ু আর আন্ডার অ্যারেস্ট আনি! ভোরের খপ্পর থেকে বাঁচা একেবারে ইয়ামপচিবল! বোলে তো?”
সব বাচ্চারাই সমস্বরে চিৎকার করে ‘ইয়ামপুচিবল’ বলে! ভোর হু হা হেসে উঠলো। আনিকার হাতে খেলনা হ্যান্ডকাফ পড়িয়ে দিলো। তারপর পাতার দিকে বন্দুক তাক করে বলে,
-” আম্মু আমি এখন খাবো না। আমার একটুও ক্ষিধে নেই। যখন লাগবে আমি খেয়ে নেবো। আমি এখন খেলছি!”
পাতা ছোট ছোট তাকিয়ে ডোন্ট কেয়ার ভাব নিয়ে বলে,
-” এজ ইয়ুর উইশ! আমি রূপকে কোলে নিয়ে খাইয়ে দিই যাই! রূপতো কখন থেকে আমা আমা করছে!”
বলে পা বাড়ায় দুই কদম। ভোর নাকের পাটা ফুলিয়ে হনহন করে পাতার সামনে দাঁড়িয়ে বন্দুক পেটে তাক করে বলে,

-” আম্মু? ইন্সপেক্টর ভোর কিন্তু রেগে যাচ্ছে!”
পাতা বন্দুকটা সরিয়ে দিয়ে বলে,
-” আমার তাতে কি?”
ভোর গাল ফুলিয়ে চায় পাতার দিকে। বন্দুকটা ছুঁড়ে ফেলে বলে,
-” ঠিকাছে! খাবো আমি! তবে অল্প কিন্তু? আর তোমাকে খাইয়ে দিতে হবে!”
পাতা বিজয়ী হাসে। ভোরের ফুলো গাল টিপে মুখে খাবার তুলে বলে,
-” তুমি সবার সাথে খেলো! আমি খাইয়ে দিচ্ছি! ”

ভোর খুশি হয়ে মাথা নাড়িয়ে খাবার চিবোতে চিবোতে বন্দুকটা আবার হাতে তুলে নেয়। আর সব বাচ্চাদের সাথে খেলতে থাকে। পাতা একটু পর পর তার মুখে খাবার দেয়। পানি খাওয়ায়। হঠাৎ নজরে পড়ল সোফার দিকে। রূবি তার মা ও ভাবির সাথে কথা বলছে। পাতার মনটা খারাপ হয়। পুরো বাড়ি মেহমানে ভরপুর। সকাল থেকেই তাদের আগমন ঘটে। প্রায় অনেকেই এসেছে। শুধু তার সম্পর্কীয় কোনো আত্মীয় আসেনি। লোকটা কি কাউকে বলে নি? আবার ভাবে এখানে সব উচ্চ বিত্তশালীদের ভিড়ে তার মধ্যবিত্ত ঘরের লোকজন হয়তো বেমানান লাগবে তাই বলে নি। পাতা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ভোরকে খাইয়ে মুখ মুছে দিয়ে বাটি গ্লাস রেখে বেসিনে হাত ধুয়ে নেয়। ড্রয়িং রুমে আসতেই রুবির মা পাতাকে বলে,

-” বউমা তোমার বাড়ি থেকে কেও আসে নি?”
পাতা কি জবাব দিবে? বুকটা ভারী হয়ে আসে। হাসিমুখে মাথা নাড়িয়ে উপরে চলে যায়। চোখের পানি বাঁধ ভেঙে পড়ে। পাতা মুছে নেয়। হা করে শ্বাস নিয়ে কান্না গিলে নিল। রুমে গিয়ে দেখল আদুরি আর শুভ স্যারের মেয়ে শুহানি বসে আছে সোফায়।পাতাকে দেখে আদুরি বলে,
-” বড় ভাবী? এখানে বসো!”
পাতা শুহানির পাশে বসে। শুহানি মেয়েটা ভোরের চেয়ে বছর তিনেকের বড় হবে। বেশ মিষ্টি দেখতে। একদম স্যারের মতোই ভদ্র, শান্ত শিষ্ঠ মিষ্টভাষী মেয়ে। সবসময় ঠোঁটের আগায় মিষ্টি হাসি লেপ্টে থাকে। আদুরি শুনানির গাল টিপে দিয়ে পাতার উদ্দেশ্যে বলল,
-” মেয়েটা কতো আদুরে আর মিষ্টি তাই না বড় ভাবী? একদম বাপের মতো!”
-” হুম!”
ছোট জবাব পাতার। আদুরি আরো বলে,

-” শুভ ভাইয়াও কিন্তু বেশ হ্যান্ডসাম! বড় ভাইয়ার বন্ধুদের মধ্যে শুভ ভাইয়া সবচেয়ে নজরকাড়া। সব দিক দিয়েই পারফেক্ট! আর আমার চাইল্ডহুড ক্রাশ!”
বলেই পাতাকে চোখ টিপে হাসে। পাতাও হাসে তার কথায়। আদুরি আবার বলে,
-” বড় ভাইয়াও কিন্তু কম হ্যান্ডসাম নয়! আসলে সে গোমড়া মুখে থাকে। কালে ভাদ্রে একটু আকটু হাসে। আর মেজাজের কোনো ঠিকঠিকানা নেই। কোনো মেয়ে লাভ লেটার বা প্রপোজ করলে কি করে জানো ভাবী?”
পাতার আগ্রহ প্রকাশ করে আকাশ সমান। মেয়ে! লাভ লেটার! প্রপোজ! আদুরি হেসে বলে,
-” কিছু বলবে না। মেয়েটার বাবার নম্বরটা নিয়ে সরাসরি কল করে বলবে আপনার মেয়ে দিন দিন উচ্ছন্নে যাচ্ছে। জলদি ভালো একটা ছেলে দেখে বিয়ে দিয়ে দিন! ব্যস মেয়েরা আর এ মুখো হয় না।”
বলে খিলখিলিয়ে হেসে উঠলো। সাথে শুহানি ও পাতাও যোগ দেয়। হঠাৎ আদুরি হাসি থামিয়ে কাঁদো কাঁদো গলায় শুনানিকে বলে,

-” তোমার আব্বু একটা মিথ্যুক শুহানি! ছোট বেলায় বলেছিল আমাকে বউ বানাবে। অথচ হঠাৎ একদিন শুনি সে বিয়ে করে নিয়েছে। সেদিন আমি অনেক কেঁদেছিলাম। এই শুভ ভাইয়ার প্রমিজ! শুভ ভাইয়া তার কথা রাখলে আজ তুমি আমার বাচ্চা হতে!”
পাতা খিলখিলিয়ে হেসে ওঠে তার কথা শুনে। শুহানিও তার সাথে যোগ দিল। পাতা হাসি থামিয়ে বলে,
-” খুব মানাতো কিন্তু আদু! শুভ স্যারের অনেক ডিমান্ড দেখছি! ভার্সিটিতেও সব মেয়েরা তার উপর ফিদা ছিল! একেবারে ডাই হার্ট ফ্যান যাকে বলে!”
আদুরি সন্দেহ চোখে পাতার দিকে তাকিয়ে বলে,

-” তুমিও খেয়েছিলে নাকি ক্রাশ নামক বাঁশ?”
পাতা আমতা আমতা করে। খেয়েছিলো তো। আদুরি তার আমতা আমতা দেখে বলে,
-” তার মানে খেয়েছিলে! আরে চিল ভাবী! হ্যান্ডসাম ড্যাসিং টিচার্সদের উপর ক্রাশ খাওয়া ছাত্রীদের শিক্ষাগত অধিকার!”
পাতা লজ্জা পেয়ে বলে,

-” বেশি না। ওই একটু আকটু! আর তখন তো ছোট ছিলাম। সবে ভার্সিটিতে ভর্তি হয়েছিলাম! কিন্তু যখন জানতে পারলাম স্যার ম্যারিড আর সাথে বাচ্চাও আছে ছ‌্যাকা খেয়েছিলাম!”
আদুরি শুহানি উচ্চস্বরে হেসে উঠলো।
-” ভাই শুনলি? তোর ছোট কিউট আদুরে বউয়ের কথা!”
ফিসফিস করে বলে ফয়সাল। অরুণ তার পাশে দাঁড়িয়ে। বর্তমানে তাঁরা অরুণের রুমের দরজার কাছে দাঁড়িয়ে। দরজাটা বন্ধ না, আধ খোলা। তাঁরা নক করে ভিতরে ঢুকবে কিন্তু ভিতরের আলোচনার কিছু উচ্ছিষ্ট কানে ঠেকায় দাঁড়িয়ে থাকতে বাধ্য হয়। ফয়সাল অরুণের দিকে তাকায়। শালা সবসময়ের মতো ষাঁড়ের মতো মুখ বানিয়ে রেখেছে। ঠাহর করা মুশকিল রেগে আছে নাকি স্বাভাবিক। সে অরুণের পেটে গুঁতো দিয়ে বলে,
-” দেখলি বলেছিলাম না ঘাপলা আছে? এই আমাদের শুভর ভিতর কি এমন আছে বলতো? মোমাছিরা শুধু তার দিকেই ঝুঁকে আসে। আমাদের কি চোখে পড়ে না? আসলে বন্ধু হয়েছে কি! মেয়েদের চোখে সমস্যা, ছানি পড়েছে!”
অরুণ চোখে শাসিয়ে নক করে রুমে প্রবেশ করে। সাথে ফয়সাল হাসিমুখে। পাতা খানিক ঘাবড়ে যায় অরুণকে দেখে; লোকটা শোনে নি তো আবার? পাতার ঘাবড়ানোকে দ্বিগুণ বাড়িয়ে দিতে ফয়সাল হাসিমুখে বলে,

-” পিচ্চি ভাবী? এতো সুদর্শন হাট্টাকাট্টা জামাই থাকতে জামাইয়ের বন্ধুর উপর ক্রাশ খান? দ্যাটস ভেরি ব্যাড! বেচারা অরুণ শুনে ফিট খাওয়ার মতো অবস্থায়!”
পাতার চোখের আকার বড় হয়। আদুরি পাতার পক্ষ নিয়ে কথা বলে,
-” ভাইয়া খায় নি, খেয়েছিল! সেই বাচ্চা কালে! আর খেতেই পারে। ক্রাশ একটা জাতীয় ফল বুঝলে? ছোট বড় সবাই খায়। এতে কোনো দোষ নেই। আমিও খেয়েছিলাম শুভ ভাইয়ার উপর ক্রাশ!”
-” শুহানি? তোমার মা তোমাকে ডাকছে! আদু ওকে নিয়ে যা?”

অরুণ গম্ভীর গলায় আদেশ করে! আদুরি ভাবীর দিকে অসহায় চোখে চেয়ে শুহানিকে নিয়ে বেড়িয়ে যায়। ফয়সাল মিটমিট হেসে গুনগুনিয়ে গান গায়। অরুণ তাকে চোখ রাঙিয়ে রুমের মিনি ফ্রিজ থেকে কোকের ক্যান বের করে দেয় গোটা দশেক! সে সেগুলো নিয়ে বেড়িয়ে যায় হাসতে হাসতে। অরুণ গিয়ে ধরাম করে দরজা লাগায়। পাতা অসহায় প্রানীর মতো দাঁড়িয়ে থাকে। লোকটার মুখের দিকে তাকানো যাচ্ছে না। রাগ চোখে মুখে স্পষ্ট। এখানে পাতার কি দোষ? ক্রাশ খাওয়া একটা মনস্তাত্ত্বিক ব্যাপার স্যাপার। যে কেউ যাকে দেখে খেতেই পারে। এখন মনকে তো আর ধরে বেঁধে রাখা যায় না। আর তখন সে অষ্টাদশী ছিল; মনটা এমনিতেই আবেগে বাকবাকুম ছিল। সুদর্শন হ্যান্ডসাম ব্যাক্তিত্বে ভরপুর লোক দেখে একটু আকটু ক্রাশ খেয়েছিলে । তখন তো সে জানতো না যে যার উপর ক্রাশ খেয়েছে তারই বন্ধুর সাথে তার নিকাহ্ হবে!

অরুণ এগিয়ে এসে বেলকনির দরজা বন্ধ করে। পাতার ভ্রু যুগলে ভাঁজ পড়ে। অরুণ পাতার বাহু ধরে একপ্রকার ছুঁড়ে ফেলে বিছানায়। পাতা অবাকের চূড়ান্ত সীমায়। পাতা রুক্ষ স্বরে বলে,
-” এটা কেমন আচরণ?”
অরুণ স্যান্ডেল জোড়া খুলে পাতার উপর চড়াও হয়। গলা থেকে ওড়না সরিয়ে নিতেই পাতা একপ্রকার চিল্লিয়ে বলে,
-” হয়েছে টা কি বলবেন? এরকম অভদ্রের মতো আচরণের মানে কি?”
অরুণ তার দুহাতের আঙ্গুলের ভাঁজে আঙ্গুল দিয়ে আটকে নেয়। গালে দাঁত বসিয়ে বলে,
-” ক্রাশ কিভাবে খায়? এভাবে?”
পাতা বিরক্তিকর শ্বাস ছাড়ে। অসভ্য অভদ্র লোক!
-” এ কেমন ছেলেমানুষী?”
অরুণ অপর গালে দাঁত বসিয়ে বলে,
-” না একটু শিখে নিতে চাই কিভাবে খায় ক্রাশ!”

পাতা কিছু বলে না। না ছড়ানোর চেষ্টা করে, না ছটফট করে। চুপচাপ সেভাবেই পড়ে থাকে। অরুণ থুতনি মুখে পুরে কামড় বসিয়ে অধরে অধর ছোঁয়ায় আলতোভাবে পরপর কামড়ে ধরে অধর জোড়া। পাতার বাধা না পেয়ে যেন সুযোগ পায়! হিংস্রতা ভুলে নিবিড়ভাবে হারিয়ে যায়। মধ্যাহ্নের এই অবেলায় খেই হারিয়ে বসে।
যোহরের আযানের সুমধুর ডাক ভেসে আসতেই হুঁশ ফিরে কপোতির।বড় শ্বাস ফেলে সরে আসে অরুণ সরকার। ফ্লোর থেকে শার্ট তুলে পুনরায় গায়ে জড়িয়ে বোতাম লাগাতে লাগাতে বলে,
-” ক্রাশ নামক আবর্জনার উচ্ছিষ্টও যদি অবশিষ্ট থাকে উগড়ে নাও পাতাবাহার! মনে রাখবে তোমার সাথে তোমার মনটাও আমার নামে লিখিত সংবিধান!”

পাতা রেগে বালিশ ছুঁড়ে মারে তার মুখে। অরুণ হেসে সেটা ধরে। মুচকি হেসে বলে,
-” আরে রেগে যাচ্ছো কেন? এতো আদর করলাম একটু হাসো? তোমার বাবার বাড়ির লোকজন এসেছে তোমার গোমড়া মুখ দেখলে কি ভাববে?
পাতা অরুণের চোখে চোখ রাখে। সত্যিই? পাতা বিছানা থেকে উঠে ওড়না গলায় পেঁচিয়ে দৌড় লাগায়। কতদিন হলো বাড়ির সবাইকে দেখে না! আব্বু, আম্মু, লুব ভাই, লতাপু! অরুণের কপালে ভাঁজ পড়ে। একদম ছেলেমানুষী কান্ড। এভাবে দৌড়ে যেতে হবে? সে পিছন থেকে গলা উঁচিয়ে গম্ভীর গলায় হুকুম ছাড়ে,
-” এই বেয়াদব? আস্তে যাও? পড়ে যাবে তো!”
পাতার কানে পৌঁছালেও তোয়াক্কা করে না।

বাড়ির ও আগত সকল পুরুষ মসজিদে গিয়েছে নামাজের উদ্দেশ্যে। শুধু বাচ্চারা ও মেয়েরা বাড়িতে অবস্থান করছে। বাচ্চারা সব ড্রয়িংরুমে বসে ওয়ার্ড পাজল দিয়ে খেলছে। লতা পাতা তাদের সঙ্গী‌। পাতার মা লাবনী আক্তার রুবির মা, আসমা বেগম, আসমানী বেগম সবাই আড্ডা দিচ্ছে ছাদে বসে। আদুরি আর সাবরিনা সাবিনা মার্কেটে গেছে ভোরের জন্য গিফট কিনতে। পাতা চুপচাপ বসে মনোযোগ সহকারে বোনের কথা শুনছে। কিন্তু তার নজর ভোরের দিকে। বাচ্চাটা মসজিদে যায় নি সাথীদের পেয়ে। সবার সাথে খেলায় সে এতো মশগুল যে মসজিদে যাবে না। অরুণ বুঝালেও কাজ হয় না। নামাজ শেষে অরুণ কিছু দান সদকা করবে। গরীব দুঃস্থ মানুষের হাতে কিছু খাবার তুলে দিবে। ভেবেছে ভোরের হাতে দিয়ে দেবে কিন্তু ছেলে যাবে না।

জোর করলেও কাজ না হওয়ায় অরুণ তাকে রেখে যায়। তবে পাতাকে সাবধান করে ছেলের সর্বোচ্চ খেয়াল রাখতে। একনজরও যেন চোখের দূর না রাখে। তার মনটা কু ডাকছে। পাতা আশ্বস্ত করেছে খেয়াল রাখবে তারপরও অরুণ বারবার বলেছে ছেলেটাকে চোখে চোখে রাখতে। ভোর আর সব বাচ্চাদের সাথে খেলার মাঝেই আবদার করে আইসক্রিম খাবে। পাতা তাদের একটু অপেক্ষা করতে বলে রুমে যায় আইসক্রিম আনতে। পাতা লতাকে তাদের খেয়াল রাখতে বলে উঠে যায়। একটু পর রুম্পা কেঁদে উঠলে লতা তাকে নিয়ে একটু দূরে যায়। এই সুযোগে বাচ্চারা সব বেড়িয়ে যায় মেইন ফটক পেরিয়ে। পাতাবাহার নামক বিড়াল ছানা তাদের পিছু পিছু। গেইট থেকে একটু ভিতরে একটা কামরাঙা গাছের নিচে দাঁড়িয়ে কামরাঙা পাড়ার উদ্দেশ্য ঢিল ছুড়ে। কিন্তু পড়ে না। লাবিব বড় একটা মাটির দলা এনে ঢিল ছুড়লে দুটো পড়ে ।

সরকার বাড়ির সামনের রাস্তায় বেশ কিছুদিন হলো তিন চারজন লোকের বেশ আনাগোনা শুরু হয়। তিনজনেরই ক্যাপ, মাস্ক পড়ে ঘুর ঘুর করে আশেপাশে। কখনো বাড়ির দাড়োয়ানের সাথে সুখ দুঃখের আলাপ জুড়িয়ে চায়ের অফার করে; তো কখনো দুপুরে এসে ভরপেট কাচ্চি খাওয়ায় পাশের রেস্তোরাঁ থেকে। কখনো পান বিড়ি সিগারেটের ধোঁয়ায় তাদের আড্ডা চলে। দাড়োয়ান বাঁচাল গোছের হওয়ায় সঙ্গী পেয়ে দিনকাল ভুলে যায়। আর তাদের সাথে এক জোড়া চতুষ্পদ জন্তু কুকুর থাকে। গলায় ডগ লেস লাগিয়ে হাতে দড়ি নিয়ে সাথে সাথেই নিয়ে ঘুরে ফিরে। আজকেও তাঁদের দেখা যাচ্ছে। রাস্তার ধারে একটা কালো রঙের গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে। গাড়িতে বসে এক লোক ল্যাপটপে সব পর্যবেক্ষণ করছে।

তাঁর ল্যাপটপ স্ক্রিনে ভেসে চলছে ছোট ছোট বাচ্চাদের কামরাঙা গাছে ঢিল ছোড়ার দৃশ্য। তার পাশে আরেকজন বসে যার হাতে রিমোট। যার দরূণ সে সরকার বাড়ির আঙিনায় ড্রোন ক্যামেরা কন্ট্রোল করছে। তাঁরা প্রায়ই এসে সব পর্যবেক্ষণ করে। তবে সুযোগ পায় না কোনো কিছু করার। তবে আজ ভাগ্য বোধহয় তাদের ফেবারে। আজ শুধু বাচ্চাদের দেখা যাচ্ছে। গাড়িতে বসা দুই লোক কুটিল হেসে কানে রাখা ব্লু টুথ ডিভাইসের সাহায্যে কাউকে কিছু বলে। অপর পাশের লোকটা তার ইন্সট্রাকশন মোতাবেক কুকুর জোড়া নিয়ে একটু স্পেসে দাঁড়ায়। আরেক লোক দাড়োয়ানের কাছে গিয়ে তার সাথে আলাপ চারিতায় মেতে থাকে। বাঁচাল টাইপের দাড়োয়ান কথা বলার সঙ্গী পেয়ে দিন কাল ভুলে যায়! বাচাল লোক কথা বলতে খুব পরিমাণে সাচ্ছন্দ্য করে তবে তাদের কথা শোনার মতো ধৈর্যশীল ব্যক্তির বড়ই অভাব।

এখন বাঁচাল লোক তার বাঁচাল আলাপচারিতার জন্য ভালো শ্রোতা পেলে আর কি চাই। দাড়োয়ানকে কথার জালে ভুলিয়ে রেখে অপর লোক খোলা ছোট গেইট দিয়ে কুকুর দুটোকে ভিতরে ঢুকিয়ে দেয়। ঢুকানোর আগে ফোনে একটা বাচ্চা ছেলের হাস্যোজ্জ্বল মুখটা ভালোভাবে দেখিয়ে বিড়বিড় করে কিছু বলে। কুকুর গুলো জিভ দিয়ে লালা ফেলে হু হু শব্দ সৃষ্টি করে ভিতরে প্রবেশ করে ধীরে ধীরে হেঁটে যায়। শুঁকে শুঁকে এগিয়ে যায়। এতদিন ছবিতে দেখা বাচ্চাকে সম্মুখে দেখে কুকুর জোড়া ঘেউ ঘেউ করে দৌড় লাগায় ঝড়ের বেগে।

হঠাৎ কুকুরের ডাক শুনে সব বাচ্চারা ঘাবড়ে যায়। সামনে তাকাতেই দুটো কুকুরকে ছুটে তাদের দিকে আসতে দেখে সবাই দৌড় দেয় বাড়ির উদ্দেশ্যে। পাতাবাহার গাছের ডালে উঠে পরে ঝটপট। লাবিব সবার মধ্যে বড় হওয়ায় আগেই পৌঁছে যায়। ভোরও কুকুরের ডাকে ভয় পেয়ে দৌড় লাগালো কিন্তু আনিকার সাথে ধাক্কা লাগার দরূণ দু’জনেই ছিটকে পড়ে যায় মাটিতে। আনিকা ভয়ে কেঁদে ফেলে। কুকুর দুটো তাদের খুব কাছে এসেছে। আনিকা অনেক কষ্টে উঠে আবার দৌড় লাগালো। কিন্তু ভোর উঠতে পারে না। হয়তো আজ ভাগ্যও তার সহায় নেই। ইটের সাথে বেজে তার হাঁটু ছিলে গেছে। অনেক ব্যথা পেয়েছে; পা সোজাই করতে পারছে না উঠবে কি করে? সে জোড়ে গলা ফাটিয়ে আম্মুকে ডাকে।

একবার ডেকেই ঠোঁট ভেঙে কেঁদে দেয় ব্যাথায় । অন্যদিকে কুকুর দুটো তার কাছে পৌঁছে যায়। ভোর অনেক কষ্টে উঠে দাঁড়াতেই কুকুরের আকস্মিক আক্রমণ ভয় পায়! কুকুর গুলো খুবই হিংস্র। জিভ দিয়ে টপাটপ লালা পড়ছে। ভয়ংকর শব্দে ঘেউ ঘেউ করে। কুকুর দুটো ভোরের উপর চড়াও হয়। নখ দিয়ে আঁচড় কেটে প্যান্টের উপর দিয়েই কামড় বসায়। ভোর চিল্লিয়ে কেঁদে কেটে আম্মু বলে ডাকে আর কুকুর গুলোকে হাত দিয়ে সরিয়ে দিতে চেষ্টা করে। কুকুর তার হাতেও কামড় বসায়। ভোর হাঁউমাঁউ করে ব্যাথা ও ভয়ে কাঁদতে থাকে।

-” আম্মু?ও আব্বু? বাঁচাও! যা! ও আম্মু?”
পাতাবাহার গাছে বসে সব দেখে ব্যাথিত নয়নে। অলস অবুঝ বিড়ালটি কি বুঝলো কে জানে। গাছ থেকে নেমে দৌড়ে যায় মালিকের কাছে। কিসের টানে? এতোদিনের আশ্রয় ও ভালোবাসার টানে? অবুঝ বোবা প্রানী! সে জানে ওখানে গেলে হয়তোবা আর রক্ষে নেই তার! তবুও যায়। তার ছোট পায়ের নখ দিয়ে আঁচড় কেটে মিও মিও করে। হয়তোবা ছাড়তে বলে তার মালিককে। হিংস্র কুকুর
ছোট বিড়ালটিকে মুখে তুলে নেয় ঘার কামড়ে। ছিটকে ঠাস করে ফেলে দেয় মাটিতে। বিড়ালটি মিও মিও করে তবে ওঠে না। একটু পরে চোখ বুজে নেয়।

লাবিব ফিরে আসে পুনরায়। বাগান থেকে সে বড় লাঠি এনেছে। সেটা দিয়ে কুকুর দুটোকে আঘাত করে। একটা কুকুর ভোরকে ছেড়ে লাবিবের দিকে তেড়ে আসে। লাবিব একটু সরে এসে জোড়ে বারি দেয় কুকুর টিকে। ভোর কুকুরকে ছাড়িয়ে দৌড় লাগায়। কুকুরটি ভোরের কোমড়ে খামচি কাটে। ভোর চিল্লিয়ে ওঠে সর্ব শক্তি দিয়ে। এরমধ্যে লতা ও পাতা দৌড়ে এগিয়ে আসে। ছাদে থেকে আসমা বেগম সহ সবাই দেখে; তারাও এগিয়ে আসে। দাড়োয়ান আলাপ বাদ দিয়ে লাঠি নিয়ে দৌড়ে আসে‌। আর মাস্ক পড়া লোকটি বাঁকা হেসে কেটে পড়ে।
পাতা ঝড়ের বেগে দৌড়ে এসে কুকুরটিকে লাত্থি দিয়ে সরিয়ে ভোরকে কোলে তুলে নেয়।
ভোর আম্মুর কোলে উঠে শক্ত করে গলা জড়িয়ে হাঁউমাঁউ করে কাঁদতে কাঁদতে বলে,

-” ও আম্মু পঁচা কুকুর! আমি অনেক ব্যাথা পেয়েছি!”
-” আম্মু এসে গেছে কিছু হবে না কলিজা!”
ভোর মোটেও শান্ত হয় না। হাঁউমাঁউ করে কাঁদতে থাকে পাতার গলা জড়িয়ে ধরে। শরীর তার ভয়ংকর ভাবে কেঁপে উঠছে ক্ষণে ক্ষণে। শরীরে আঘাতের চিহ্ন। ছেঁড়া কালো শার্টের ভিতর দিয়েই উকি দিচ্ছে আঁচড়। ছোপ ছোপ লাল রক্ত । হাতে পায়ে কামড় ও আঁচড়ের বেশ কয়েকটি দাগ। মাংস তুলে নিয়েছে মনে হয়। গলগলিয়ে তাজা রক্ত বের হচ্ছে। বাচ্চাটা চিল্লিয়ে কাঁদছে বসে যাওয়া ফ্যাসফ্যাসে গলায়। মুখ দিয়ে লালা গড়িয়ে পড়ছে।

কুকুর গুলো যেন আরো আক্রমণাত্মক হয়ে ওঠে। পাতার উপর ঘেউ ঘেউ করে করে এসে হামলে পড়ে। ওড়না টেনে ধরে। পাতা আবার লাথি লাগালে পায়ে আঁচড় কেটে কামড় বসায়। সম্মুখ দুই পা তুলে কাপড় টেনে ছিঁড়ে ফেলে। পাতা বাঁধা যতো দেয় ওরা ততই হিংস্র হয়। লতা লাবিবের হাত থেকে বাঁশের ফালিটা নিয়ে কুকুরের পিঠে এলোপাথাড়ি শক্ত করে মারতে থাকে। কুকুর দুটো পাতাকে ছেড়ে লতার দিকে তেড়ে আসে। লতা তাদের মুখে ও মাথায় আঘাত করে। এরমধ্যে দাড়োয়ান এসে তার হাতের মোটা বাঁশ দিয়ে বারি লাগায় কুকুর টিকে। আসমা বেগম সহ অনেকেই বাগান থেকে বাঁশের ফালি এনে কুকুর গুলোকে পিটাতে থাকে। কুকুর দুটো যেন ভয় পেল এবার। ঘেউ ঘেউ করে লেজ গুটিয়ে পালিয়ে গেলো!

কুকুর পালিয়ে গেলেও কেউ স্বস্তির শ্বাস নিতে পারে না। ভোরের অবস্থা খুবই নাজুক। সাথে পাতাও জখম হয়েছে। পাতা ভোরের মাথায় হাত বুলিয়ে বলে,
-” কলিজা আমি আছি তো! ভয় পায় না। কুকুর চলে গেছে। দেখি দেখি?”
ভোর ছাড়ে না শক্ত করে হাত পা দিয়ে পেঁচিয়ে পাতাকে জাপটে ধরে কাঁদতে থাকে। আসমা বেগম এগিয়ে এসে বলে,
-” আমি অরুণকে ফোন করছি! ডাক্তারের কাছে যেতে হবে ইমার্জেন্সি!”
পাতা কেঁদে দিল শব্দ করে। ইশ্ ছেলেটার কি হাল হয়েছে। লোকটা চোখে চোখে রাখতে বলেছিল। একটু খেয়াল রাখতে বলেছিল! সে পারলো না খেয়াল রাখতে। ছেলেটা তাকে আম্মু বলে। সে পারলো না তার মর্যাদা দিতে। পাতাকে কাঁদতে দেখে লতা ধমক দেয়,
-” চুপ! কাঁদছিস কেন? ভয় পাচ্ছে ছেলেটা!”
পাতার কান্না থামার বদলে বেড়ে যায়।
-” আপু আমার ছেলেটা..”

বলেই ভোরের মতো সেও হাঁউমাঁউ করে কান্না শুরু করে। দু’জনের কান্নায় পরিবেশ থমথমে। উপস্থিত সকলের চোখে মুখে বেদনার ছাপ! আনিকা দৌড়ে এসে পাতার পা জড়িয়ে হাঁউমাঁউ করে কান্না করে। আসমা বেগম অরুণের নম্বরে ডায়েল করে দাড়োয়ানের উপর গর্জে ওঠে,
-” এই কুকুর ঢুকলো কি করে? হুম? মাসে মাসে বেতন নাও ঘুমানোর জন্যে? যাও ঘুমিও সারাজীবনের জন্য!”
দাড়োয়ান মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকে। এরমধ্যে সবার নজর যায় গেটের দিকে। সবাই হন্তদন্ত হয়ে আসছে। আর অরুণ সরকার? সে দৌড়ে আসে। পাতার সামনে দাঁড়িয়ে হাপায় না। দম বন্ধ করে দাঁড়িয়ে থাকে। চোখ মুখ তার রক্ত হী;ন বিবর্ন রঙ ধারন করেছে। জখমি আহত ব্যাথায় হাঁউমাঁউ করে ক্রন্দনরত ছেলেকে দেখে যেন শ্বাস নিতেও ভুলে গেছে। বুকের ভিতর কেউ যেন ছুড়ি দিয়ে খোঁচা দিচ্ছে অনবরত। সে তড়িৎ বেগে পাতার কোল থেকে ছেলেকে নেয়। পাতার গালে সপাটে একটা চড় বসিয়ে চিল্লিয়ে বলে,

-” আমার কলিজার এই অবস্থা কি করে হলো? হুম জবাব দাও?”
এ যেন বাঘের হুঙ্কার! পাতার হাঁউমাঁউ কান্নার কথা ভুলে যায়! ভয়ে দুই পা পিছিয়ে যায়। ভোর বাবার কোলে গিয়ে কান্নার গতি কমিয়ে দিয়ে ‘আব্বু ব্যাথা’ বলে বিড়বিড় করে কাঁদে!অরুণ আবার গলা ফাটিয়ে বলে,
-” স্পিক আউট? বলেছিলাম না চোখে চোখে রাখতে? খেয়াল রাখতে? এই অবস্থা কেন? বাড়িতে এতো এতো তো মানুষ থাকতে আমার ছেলের এই হাল হবে কেন? ছোট মা? রুবি? এই কেউ কিছু বলছো না কেন?”
লতা গম্ভীর মুখে এগিয়ে আসে। বোনকে সবার সামনে চড় মারায় তাঁর মেজাজ মোটেও ঠিক নেই তবে লোকটার মনের অবস্থা বুঝতে পেরে বলল,

-” কোথা থেকে যেন কুকুর এসে হামলা করলো! সব বাচ্চারা এখানেই খেলাধুলা করছিল আর..”
আর কি বলবে লতা! অরুণ আর শোনেও না। হাঁটু গেড়ে বসে পড়লো মাটিতে। আঘাতপ্রাপ্ত ছেলের গালে মুখে আদর করে। ভোরের কান্নার গতি বাবাকে পেয়ে কমে এলেও সময়ে সময়ে তা ঠিকরে বেড়িয়ে আসতে চায়‌। ব্যাথায় কাতরাতে কাতরাতে বলে,
-” আব্বু আমার না অনেক কষ্ট হচ্ছে! অনেক ব্যাথা করছে। ওই কুকুর?”
-” এই তো বাবা এসে গেল মানিক! সব ব্যাথা গায়েব করে দেবে! কলিজা এখুনি ঠিক করে দেবো!”
জখমি হাতে গলায় পেটে হাত বুলিয়ে বলে। ভোর কাঁদতে কাঁদতে আবার বলে,
-” ও আব্বু অনেক অনেক কষ্ট হচ্ছে! ভোর মরে যাচ্ছে আব্বু!”

অরুণ অদ্ভুত শব্দ করে কেঁদে ওঠে নিমিষেই। ছেলেকে বুকে জড়িয়ে নেয় শক্ত করে। অরুণের কান্নায় পাতা এগিয়ে এসে তাদের সামনে হাঁটু গেড়ে বসে কেঁদে দেয়। জড়িয়ে ধরবে অরুণ ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিল। পাতা মাটিতে পড়ে যায়। ডুকরে কেঁদে ওঠে। লতা এসে তাকে ধরে। শুভ ফয়সাল অরুণের কাঁধে হাত রেখে বলে,
-” জলদি হসপিটালে চল! সব ঠিক হয়ে যাবে অরুণ!”
অরুণ মাথা নাড়ে বাচ্চাদের মতো। ভোরকে কোলে নিয়ে দৌড় লাগায়! রাসেল গাড়ি এনে তার সামনে দাঁড় করালে অরুণ উঠে পড়ে। ছেলেকে বুকে জড়িয়ে বিড়বিড় করে বলে,

-” কলিজা কিছু হবে না। সব ঠিক হয়ে যাবে! ইয়া আল্লাহ আমার কলিজার সব ব্যাথা আমায় দিয়ে দাও! তার ব্যাথা কমিয়ে দাও! হে রহিম রহমান তোমার এই ছোট বান্দার উপর একটু রহম করো!”
ভোর গুনগুন করে কাঁদতে থাকে। অরুণ বিড়বিড় করে দোয়া পড়ে। আল্লাহর কাছে আর্জি জানায়। ভিক্ষা চায়, আকুতি মিনতি করে বারংবার। ছেলেটার কিছু হলে সে মরে যাবে।
পাতা লতাকে জড়িয়ে হাঁউমাঁউ করে কাঁদছে। ‘আমার ছেলেটা’ বলে শিউরে উঠছে। হাত পা অবশ হয়ে আসে। লতা আসমা বেগম শান্ত করে। লাবনী আক্তার বোঝায়। পাতা অবুঝের মতো আমার ছেলেটা বলেই কান্নায় ভেঙে পড়ে। এরমধ্যে শুভ আসে দৌড়ে। পাতাকে উদ্দেশ্য করে বলে,

-” পাতা? কাম! হারি আপ? গাড়ি অপেক্ষা করছে!”
পাতা কাঁদতে কাঁদতেই মাথা নাড়িয়ে দৌড় দেয়। পড়নে ছেঁড়া জামা, ওড়না! পেছনের দরজা খুলে অরুণের পাশে বসে। অরুণ ছেলেকে আরেকটু বুকে জড়িয়ে লুকিয়ে নেয়। পাতার কান্না দেখে বিরক্ত হয়ে বলে,
-” শুভ? চুপ থাকতে বল!”
পাতা মুখে ওড়না গুঁজে নিয়ে ফোপাতে থাকে। এ কোন বিপদের সম্মুখীন করলো উপর ওয়ালা তাদের! পাতা ঢোক গিলে অনেক কষ্টে কান্না আটকে আটকে রাখে। ভোরের গুনগুন কান্নার শব্দে তার বুকটায় যেন আগুন জ্বলতে শুরু করে। শ্বাস আটকে যায়। ইয়া পরম করুণাময় রহিম রহমান একটু রহম কর এই নিষ্পাপ শিশুর উপর!
তাদের গাড়ি ছুটে চলে তীব্র গতিতে। তাদের গাড়ির পেছনে আরেকটা কালো গাড়ি যায় আপন গতিতে। গাড়িতে উপস্থিত সকলের মুখেই চাপা হাসি। শামীম হেসে ফ্রন্ট সিটে বসা আকাশকে বলে,

-” খুব হাসি পাচ্ছে! কিন্তু এই টুকুতে তো আমার মন ভরলো না আকাশ!”
আকাশ উচ্চ স্বরে হেসে বলে,
-” আমার ভরেছে। ওই অরুণ সরকারের করুণ মুখটা দেখে বুকটা যেন প্রশান্তিতে ভরে গেছে। আমার বাড়িতে ঢুকে আমার বাবার উপর হামলা চালিয়েছে। এখন ওর বাড়িতেই ওর কলিজাকে ছিন্নভিন্ন করেছে ওই কুত্তা গুলো! ব্যাথায় জর্জরিত ছটফটে ছেলেকে দেখে অরুণ সরকার তার থেকেও বেশি ছটফট করবে!”
পাশ থেকে শুকলা মন্ডল হেসে বলে,

পাতা বাহার পর্ব ৪১(২)

-” তা ঠিক বলেছিস! তবে এই টুকুই? ওর ওই টসটসে কচি বউ? হু হু ?”
আকাশ হাসে শব্দ করে।
-” একটু সবুর করো ফুপা মশাই! পিকচার আভি‌ বি বাকি হে! এই ধকলটাকে একটু সামলে উঠতে দাও! নইলে বেচারা অরুণ সরকার হার্ট অ্যাটাক করে বসবে!”
উপস্থিত সকলে হেসে ওঠে হো হো করে। তাদের বিশ্রী ভয়ানক হাসি শুনে পেছনে বসা ট্রেনিং প্রাপ্ত কুকুর দুটো ঘেউ ঘেউ করে ওঠে।

পাতা বাহার পর্ব ৪৩