প্রেমসুধা পর্ব ৫০

প্রেমসুধা পর্ব ৫০
সাইয়্যারা খান

বহু যুদ্ধের পর শেষ ক্ষণে জয়ী হলো পৌষ। তৌসিফ বলেছে ওরা যাবে হেমন্ত’র বাবু দেখতে। পৌষ খুশি হলেও ততটা হতে পারলো না কারণ মন থেকে বলে নি তৌসিফ। তার চোখ মুখে স্পষ্ট বুঝা যাচ্ছিলো সে না পারতিতে রাজি হয়েছে। পৌষ যে বুঝে না তা কিন্তু না। পৌষ বুঝে কিন্তু প্রকাশ করতে চায় না। তৌসিফে’র অনুপস্থিতে চাচারা ততটা এগিয়ে আসে নি যদিও তাদের এগিয়ে আসায় কোন ফল হতো না। বড় চাচা ফোন দিয়েছিলেন৷ পৌষ’কে সেখানে যেতেও বলেছিলেন। ছোট চাচা দুই বার ফোন করেছিলো।

ভাই-বোন গুলো ছোট ছোট। তারা আদৌ কতটা জানে পৌষ জানে না। ওদিকে শ্রেয়ার অবস্থা ছিলো ভয়ংকর খারাপ। হেমু ভাই যে এসেছিলো তাই তো বেশি। এই তো একটু আগেও ফোন দিলো হেমু ভাই। কিছুটা রাগ তারা। ইনি, মিনি আর পিহা জানে না। তারা বায়না ধরে এখানে আসার কিন্তু বড়রা আসতে দেয় না। এটার কারণ আছে। এ বাড়ীর মানুষ জনের মুখ ছুটা। কখন, কে, কে বলে ফেলে বলা মুশকিল। তৌসিফ’কে তারা ভয় পেলেও একা পেলে তাদের কথার ঝুলি খুলে বসে যেন।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

জৈষ্ঠ্য আর চৈত্র প্রায়ই ফোন করে। যেতে বলে কিন্তু পৌষ তো পারে না।
পৌষ ছোট থেকে চাচা,চাচিদের এই রুপ ব্যবহারই দেখে আসছে। এখানে কাউকে সে দোষ দেয় না। তার কপালে নেই সেই আদর। মা নেই, বাবা নেই তাকে এতটা বছর পেলেছে এটাই বা কম কিসের?
পৌষ’র অবশ্য এখন আর আফসোস নেই। তৌসিফ তাকে সবটা দিয়েছে। এত আদর পৌষ ইহকালে পাবে তা কোনদিনই ভাবে নি।
তৌসিফ চাচাদের গা ছাড়া ভাব দেখেই ও বাড়ী মুখী হতে চায় না কিন্তু পৌষ তো মনকে মানাতে পারে না। তার মন কিছুতেই মানে না। বেহায়া মনটা শুধু ছুটতে চায় ঐ বাড়ী। তার আপন নীড়ে।
দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে তায়েফা। হাতে গরম গরম কিছু তৈরী করে এনেছে। পৌষ হাসিমুখে বললো,

— আপা ভেতরে আসুন না।
— বারান্দায় কি তোর? ঠান্ডা কত? তুসু দেখলে ধমক খাবি।
পৌষ চাপা হাসলো। “তুসু” নামটা তার দারুণ লেগেছে। ভেবেছে মাঝেমধ্যে “তুসু ভাই” বলে ডাকবে।
মামাতো ভাই ডাকলে তার সে কি রাগ! “তুসুভাই” ডাক শুনলে এবার পৌষ’কে কাঁচা না চিবুলেই হলো।
তায়েফা এগিয়ে এলো। পৌষ তায়েফা’কে বসার জায়গা দিয়ে বললো,

— কি এনেছেন আপা?
— তোর জামাই ফোন দিলো। কঠিন ভাবে বললো তার বউকে গরম কিছু খাওয়াতে।
পৌষ’র চোখ দুটো আকারে বড় হলো। লোকটা এত কেন পা’গল? তার পা’গলামির শেষটা কোথায়? মিনু হাতে করে কাপড় এনে পৌষ’র বিছানায় রেখে জিজ্ঞেস করলো,
— ছোট ভাবী, এগুলো কি আলমারিতে রাখব?

তায়েফা হ্যাঁ বলার আগেই পৌষ না করে দিলো। তার পছন্দ না কেউ তৌসিফে’র কাপড় ধুরুক। আলমারিতে প্রয়োজনীয় কত কাপড় থাকে। পৌষ একদমই চায় না কেউ ধরুক সেগুলো।
মিনু চলে যেতেই পৌষ তায়েফা’র আনা স্যুপের বাটিটা নিজের কাছে নিলো। তায়েফা নজর দিলো পৌষ’র দিকে। অসুস্থ চেহারাটা ভাঙা ভাঙা৷ এজন্য সে কি রাগ তৌসিফে’র।
তায়েফা দোয়া করে তার ভাই ভালো থাকুক। সুখী হোক। গলা হালকা করে তায়েফা বললো,

— শরীর এখন কেমন পৌষ?
— আলহামদুলিল্লাহ আপা। ভালো তো।
— আজ বেরুচ্ছিস?
— হ্যাঁ। বাড়ী যাব।
— থাকবি?
— উনি তো যেতেই দেন না সেখানে থাকব কিভাবে?
পৌষ’র মনটা খারাপ হয়। তায়েফা ওর হাত ধরে বলে,
— তুই জানিস ও তোকে কতটা চায়?
— জানি তো আপা। আমিও তাকে চাই খুব করে।
তায়েফা’র ভালো লাগে। মেয়েটা অনুভূতি চাপিয়ে রাখে না৷ সব বলে দেয়। মনের মধ্যে কোন প্যাঁচগোচ নেই। তায়েফা বললো,

— শুরুর দিকে তোকে বলেছিলাম বাচ্চার কথা। জানি তখন তুই রেগেছিস আমার উপর। ভেবেছিস কেন এতটা পার্সোনাল কথা আমি বললাম। দেখ পৌষ, আমি তো আজ থাকব কাল চলে যাব। তুই তো আজীবন থাকবি সোনা। তৌসিফটার বয়স হয়েছে বাবা হওয়ার। তার কি সখ হয় না বল? ও তোর কাছে সরাসরি চাইছে নাকি চাইবে না তা আমি জানি না কিন্তু আমি চাই তুই ওকে বুঝার চেষ্টা কর। তোকে পা’গলের মতো ভালোবাসে। নিজেদের মধ্যে ঝামেলা থাকলে মিটিয়ে ফেল। বাচ্চাকাচ্চা নিয়ে ফেল এখনই। এখন যদি তোকে ও বুকে করে রাখে তাহলে তখন রাখবে মাথায় করে। তোর পড়াশোনায়ও ক্ষতি হতে দিবে না। তুই কি বুঝতে পারছিস? এখন কত কত সমস্যা মানুষের। এখনই উচিত সময়।

পৌষ মাথা নিচু করে সবটা শুনলো। বাচ্চা তো তৌসিফ চেয়েছে অনেক আগেই। সে জাহির করেছে সে ভালোবাসে বাচ্চাকাচ্চা কিন্তু কি করবে যদি বাবু না হয়? পৌষ কোথা থেকে আনবে বাবু? চোখ দুটো ছলছল করে উঠে ওর। বুকটা কামড়ে উঠে। তাহলে কি পৌষ’রই কোন সমস্যা আছে? কলিজাটা যেন মোচড় দিলো। মাথা তুলে তাকাতেই তায়েফা চমকালো। বলে উঠলো,
— এই কি হয়েছে? কেন কাঁদছিস? কষ্ট পেলি সোনা? আমি তো….
— আপা…..
— হ্যাঁ বল।
— আমার মনে হয় সমস্যা আছে।
— মানে? কিসের সমস্যা?
— বাবুর সমস্যা। এতদিন হয়ে গেলো এখনও কেন কিছু হলো না।

বলতে বলতে ঝরঝরে কেঁদে উঠলো পৌষ। তায়েফা মাথায় হাত দিলেন। বোঝানোর ভঙ্গিতে বললেন,
— আরে পা’গল আগে তো চেক করতে হবে।
— উনি একবার করেছিলো আপা। কিছুই হয় নি। আমার মন বলছে আমার সমস্যা আছে। উনি যদি আমাকে ছেড়ে দেন?
— থাপ্পড় খাবি৷ পা’গল কোথাকার। আচ্ছা থাম তো আগে। আমি দেখি একটা গাইনোকজিস্টের সাথে কথা বলি। তোকে নিয়ে দেখিয়ে আনব৷
— ওনাকে বলব না?
— না। দরকার নেই। আমি তো দেখি।
পৌষ’র মন অশান্ত। কি হলো এটা? তার মাথায় কেন আগে এলো না? বুকটা ভয়ে টিপটিপ করছে।

— তোমার মনটা ভার দেখাচ্ছে।
— কই না তো।
বলতে বলতে কাপড়গুলো ভাজ করে আলমারিতে তুললো সোহা। মেহেদী সেদিকে তাকিয়ে বললো,
— মন খারাপ?
— না।
— মিথ্যা বলো না সোহা।
— সত্যি বলছি।
— তাহলে চোখের দিকে তাকিয়ে বলো।
— দেখুন…
— দেখাও।
— আমি বলছি রাগ করে নেই আমি।
মেহেদী ওকে টেনে কাছে নিলো। গাল দুটো হাত দিয়ে ধরে বললো,
— অনাকাঙ্ক্ষিত ছিলো ঘটনাটা৷ আম্মা কতটা ব্যথা পেলো।
সোহা চুপ রইলো৷ মেহেদী ওর হাতটা নিজের বুকে জড়িয়ে বললো,

— আমরা আরেকদিন যাব…
— তার প্রয়োজন নেই। টাকা জমানো উচিত।
— তুমি এখনও রেগে…
সোহা ঝট করে উঠে গেলো। কিছুটা তেজী গলায় বললো,
— কেন মনে হচ্ছে রেগে আছি আমি? কখন বলেছি রেগে আছি আমি? কেন বারবার একই কথা বলছেন বলুন? দোষী করছেন আমাকে?
— দোষী করছি মানে? কি বলছো?
— ঠিক বলছি, আপনার মা ভাবছে আমি ইচ্ছে করে ফেলেছি তাকে। ঐ বাথরুমে একবারও যাই নি আমি। উনি তবুও বারবার বলছেন আমিই নাকি করেছি কাজটা। বাংলা ছবির কাহিনী শুরু করেছেন সবাই।
মেহেদী চমকে তাকালো। অবক স্বরে বললো,

— মা বলেছে?
— একবার না বারবার বলছেন। যে বাড়ীতে আসছে তাকেই বলছেন। বিয়ের কয়দিন হলো আপনার মা আমাকে পছন্দই করতে পারছেন না। কি সমস্যা তার?
— সোহা! আস্তে।
সোহা রাগে ফুঁসতে লাগলো। মেহেদী উঠে দাঁড়িয়ে ওর হাত ধরতে নিলেই ঝটকা মা’রে সোহা। মেহেদী রাগী কণ্ঠে বলে,

— কথা বলছি।
— দূর থেকেই বলুন।
— আশ্চর্য!
— হ্যাঁ, আশ্চর্যই আমি। ছুঁবেন না।
— ও তাই নাকি? আমার ছোঁয়া থেকে এত তারাতাড়ি মন উঠে গেলো?
সোহা আচমকা থমকে গেলো। শুধু জিজ্ঞেস করলো,
— কি বললেন?
— কেন ভুল বললাম?
— কার সাথে খারাবি দেখেছেন আমার?
— পুরো এলাকায় গুঞ্জন হতো তোমার।
— জেনে শুনে বিয়ে করেছেন। ওওও এক মিনিট, এজন্যই আপনার মা আমাকে পছন্দ করে না৷ আগে বললেই হতো। কষ্ট করে কেন বিয়ে করলেন? দয়া কেন দেখালেন?
মেহেদী সোহার চোয়ালটা চেপে ধরে। চিবিয়ে বলে,

— মন চেয়েছে তাই।
— ছাড়ুন আমাকে।
“মেহেদী” “মেহেদী”……
মায়ের ডাক কানে আসতেই মেহেদী থমকে গেলো। কি করছিলো মাত্রই? কি ই বা বলে ফেললো? এসব তো মনের কথা না তার তাহলে মুখে কেন এলো?
ওপাশ থেকে আবারও শোনা যাচ্ছে বাবার গলা,
— চিল্লাপাল্লা কিসের মেহেদী?

প্রেমসুধা পর্ব ৪৯

মেহেদী সোহা’র চোয়াল ছেড়ে দিতেই সোহা দূরে সরলো। শ্বাস টানলো অবিরত। মেহেদী’র বুকটা জ্বলে উঠে। ও তারাতাড়ি করে চলে গেলো ওখান থেকে। সোহা ধপ করে বসে পরে। তার সুখ নেই। থাকবেও না। অন্যের খারাপ চাওয়া এবং খারাপ করা মানুষদের সাথে ভালো হয় না। পৌষ’কে নানান ভাবে জ্বালিয়েছে সোহা। তার সংসার জীবনে নানান ঝামেলা করার চেষ্টা করেছে। তার কুফল এখন সোহা’র কপালে এলো বলে। মেহেদী আজ বলেই ফেলেছে। এলাকার সবাই গুঞ্জন তুলে কিন্তু এ ঘটনার সত্যতা কারো জানা নেই। কেউ জানে না। তৌসিফ তাকে দয়া বাদে কিছুই করে নি। না কখনো করবে।

প্রেমসুধা পর্ব ৫১