যাতনা আমার পর্ব ৪০
সানজিদা ইসলাম সূচনা
নিধির বারান্দার সাথে লাগোয়া শিউলি ফুলের গাছটা এখন আর সেখানে হেলে নেই। ঝড়ের কবলে পরে ভেঙে গেছিলো কয়েক মাস আগে। তারপর লোক দিয়ে গুড়ি পর্যন্ত কাটিয়ে ফেলেছিলেন সোহানা মির্জা। গুড়ি থেকে নতুন পাতা গজিয়েছে নতুন ডাল মেলেছে। সোহানা মির্জা গাছে পানি দিতে দিতে শিউলি গাছটা পরক্ষ করলেন। মেয়ের কথা হঠাৎ করেই মনে হয়ে গেলো তার। সকালের স্নিগ্ধ ঠান্ডা বাতাসের সাথে ভেতর থেকে গভীর নিঃশ্বাস বেরিয়ে আসে সোহানা মির্জার। নিধি সংসারী হয়েছে, ছেলেটাও বিদেশে, কিছু টা মন খারাপ নিয়েই কেটে যাচ্ছে নাহিদ মির্জা আর সোহানার দিন।
শরীরে চাদরটা ভালো করে জরিয়ে বিষন্ন ভগ্নহৃদয় নিয়ে সোহানা মির্জা বাড়ির দিকে গেলেন। নাহিদ মির্জা গত এক বছর যাবত অফিসের ঝামেলায় নিজেকে আর জড়ান না। আজকাল শরীর ও ভালো থাকে না। সোহানা মির্জা হন্তদন্ত পায়ে রুমে ঢুকলেন। নাহিদ মির্জার ঘুম ভেঙে গেছে। ইশানের সাথে অফিসের বিষয়ে কথা বলছেন তিনি। সোহানা মির্জা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে রান্না ঘরে ছুটলেন। নিপা আর নওয়াজ মির্জা ওমরাহ করতে গিয়েছেন আজ সাতদিন। সোহানা মির্জা নিয়ম মাফিক নিচে আয়েশা মির্জার রুমের দিকে চোখ বোলালেন। রান্না ঘরে শব্দ হতেই আবারো ছুট লাগালেন তিনি। কোমরে আচল গুজে রান্নায় ব্যস্ত তিথি। সোহানাও হাত বাটলেন তাতে। কাজের এক ফাঁকে সোহানা শান্ত গলায় শুধালো,
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
-” আজ একবার যাবো ও বাড়ি। তুমি যাবে আমার সাথে? ”
তিথি জিজ্ঞাসা দৃষ্টিতে তাকালো সোহানা মির্জার দিকে। কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে সোহানা বিরস গলায় বলে উঠলো,
-” নিধির জন্য মনটা কেমন করছে। সেই কবে একবার দেখা হলো। ”
তিথি ইশারায় সম্মতি প্রকাশ করে। সোহানা স্মিথ হেসে উঠেন। তিথির মাথায় হাত বুলিয়ে কাজে মনোনিবেশ করলেন। খাবার টেবিলে নাহিদ মির্জা আর ইশান শুধু কাজের কথায় ব্যস্ত ছিলেন। কি এক অফিসের ঝামেলা। সোহানা মির্জা আর তিথি নিজেদের মতো ছিলেন। কোনোরূপ কথা হয়নি তাদের মধ্যে আর।
আজকে রোদেরা লুকোচুরি করছে যেন। একবার দেখা দিয়ে মূহুর্তেই পালিয়ে যাচ্ছে। তিথি যেন বিরক্ত হলো তাতে। ছাদে শুকোতে দেওয়া কাপড় গুলোর দিকে একবার তাকিয়ে সে দীর্ঘশ্বাস ফেলে। ওয়াশিংমেশিনে দিয়ে আজকে সারাদিন কাপড় ধুইয়ে মেলে দিয়েছে। কিন্তু রোদের দেখা কই। বিকালের দিকে বাড়িতে যেতে হবে। ফিরতে ফিরতে রাত হবে। তিথি শব্দ করে নিঃশ্বাস মাটিতে ফেলে পিছনে ভিড়তেই চমকে উঠলো। আচমকা দৃষ্টি ফেললো পিছনে। ইশান হাসি মুখে তার দিকে তাকিয়ে আছে। তিথির মুখটাও মৃদু মেলে উঠে। ইশান আলতো হাতে তিথিকে জড়িয়ে ধরে।
-” এই দুপুর বেলায় একা একা ছাদে কি করছো? জানো? দাদি বলতো, ভর দুপুর আর রাত করে ছাদে গেলে পেত্নী ভর করতে পারে। বুঝলে? ”
ইশানের কথাটা শেষ হতেই দুজনেই হেসে উঠে। আচমকা মনটাও খারাপ হয়ে গেলো দুজনের। ইশান মুখ মলিন করেই বলে ওঠে,
-” জানো? তোমার আমার বিয়ে নিয়ে যতোটা না খুশি ছিলাম, তার চেয়ে বেশি ভয় ছিলো দাদীর কথা ভেবে। তার সাথে তোমার লেগে যেতে দৈনিক তিনবার। ”
তিথি কিছুই বললো না। চোখ দিয়ে অশ্রু টলটল করছিল। আয়েশা মির্জার কথা মনে হলে এখনো তার হৃদয় থমকে যায়। ইশান টপিক চেঞ্জ করে। মৃদুভাবে ডেকে বলে,
-” আজও কি আমার সাথে কথা বলবে না? কতোদিন তোমার কন্ঠ শোনার জন্য আমার ভেতরটা হাহাকার করছে, তা কি তুমি জানো। ”
তিথি আচমকাই ইশানের বুকে মাথা দিয়ে কেঁদে উঠে। ইশান যেন আবারো ব্যর্থ হলো। ব্যর্থ হৃদয় নিয়ে তিথির চিৎকারের প্রতিটি শব্দ মনোযোগ ভাবে শুনতে লাগলো। তিথি চিৎকার করলেও সে নির্বিকার। যা সম্ভব নয়, তা কেন আবদার করে ইশান? সে কি জানে না? তিথির সেই বিদ্বেষ জাগরিত রাতের মুহূর্ত তাকে খুব কঠিন করে পোড়ায়। সে কি বোঝেনা? ইশান দু’হাতে তিথির মুখ তুলে ললাটে দীর্ঘ চুমু টেনে তার চোখের দিকে গভীর দৃষ্টি নিক্ষেপ করে। তিথি অনেক চেষ্টা করলো স্পষ্ট করে ইশানের নামটি মুখে নিতে। কিন্তু পারলো না। এ যে হবার নয় আর। ইশান মৃদু হেসে নিজের ওষ্ঠ জোড়া ছোঁয়ায় তিথির ওষ্ঠদ্বয়ের সাথে। অতঃপর বিরবির করে বলে ওঠে,
-” তুমি বাকি জীবন এইভাবেই আমার নাম মুখে নিও। এই নিশ্চুপ তুমিটা কে আমার একটুও ভালো লাগে না। একটুও না। ”
যাতনায় বিদীর্ণ হওয়া তিথি যেন একটু শান্ত হয়। এই মানুষটা কে ভালোবেসে কোনো ভুল করেনি সে। নিজেকে খুব ভাগ্যবতী মনে হয় তার। ইশান তাকে তার চেয়েও বেশি ভালোবাসে। তা যেন এখনো, কথায় কাজে বুঝিয়ে দেয় প্রতিনিয়ত। সেদিনের দূর্ঘটনায় তিথির জীবনে বড়ো প্রভাব ফেলেছিলো। গাড়িটা জোরে ব্রেক করায় পিছন থেকে সামনে অনেক জোরে এগিয়ে এসেছিলো তিথি। দাঁতে দাঁত প্রচুর জোরে লাগায় তিথির জিহ্বা উপরের কিছুটা কেটে গিয়েছিলো। তাতে তিথির কথা অনেকটাই অস্পষ্ট হয়েছে। নিজের এমন পরবর্তনে কথা বলাই কমিয়ে দিয়েছে তিথি। নিজের মধ্যে মানসিক চাপের খুব বাজে প্রভাব ফেলেছে সে। ইশান সর্বদা চেষ্টা করে তিথিকে হাসি খুশি রাখার। ইশান নিধি কে এবার পাজো কোলে তুলে নিলো। তিথি এবার অস্পষ্ট স্বরে জিজ্ঞেস করে,
-” কোলে কেনো নিলেন? ”
-” আমি খুব টায়ার্ড বউ। একটু বিশ্রাম নিতে হবে। ”
তিথি ভ্রু কুঁচকে তাকালো ইশানের দিকে। যার অর্থ হলো, আপনি বিশ্রাম নিন। আমাকে কেনো টানছেন? ইশান যেন তার কথার মানে বুঝলো। সে সিড়ি দিয়ে নিচে নামতে নামতে মুচকি হেসে বলে উঠে,
-” তোমাকে লাগবে আমার। তোমাকে। কোলবালিশ হিসেবে ও তোমাকে এখন পাশে লাগবে আমার। ”
মানুষের ভিড়, কোলাহল, যানজটের হর্ন সব মিলিয়ে উত্তাল পরিস্থিতি। ইনায়া বাস স্টপে দাঁড়িয়ে আছে। বাস আসার নাম গন্ধ নেই কোনো। চারদিকে প্রচুর ধূলো বালি। শীতের দিনে রাস্তা ঘাটে এই একটা সমস্যা। ইনায়ার মুখে কিছুটা রাগের আদল। প্রচন্ড বিরক্তও বটে। হাতে লাগানো রোল এক্সের ঘড়িটির দিকে তাকিয়ে সময় পরক্ষ করলো সে। বেলা এগারো টা পেরিয়ে গেছে। আজ রায়া আর সে সানিয়ার বাসায় যাবার জন্য বেড়িয়ে ছিলো। পথে জায়ানের কল আসে। শীগ্রই করিম ভিলায় তাকে আসতে বলে। ইনায়া অবাক হলো, রাগও হলো কিছুটা। আচানক বাড়িতে ডাকার মানে কি? রায়া উদাস মনে একটু ঘুরে ফ্লাটে ফিরে গেলো।
ইনায়াও এবার জায়ানের উপর রাগে কিছুটা। মুখ ফুলিয়ে পাশে তাকাতেই বাস স্টপের পিলারের দেয়ালে জায়ানের ছবির পোস্টার দেখে ইনায়া। কোনো মহা সম্মেলনের আয়োজন করা হয়েছে হয় তো। ইনায়া বড়ো নিঃশ্বাস ফেলে। বাস আসাতে তড়িঘড়ি করে বাসে উঠে ইনায়া। গাড়ির দরজার সাথে জানলার পাশের সিটে বসে ইনায়া। কিছুক্ষণ পরেই বাস চলতে শুরু করলো। ইনায়া সীটে হেলান দিয়ে কোলে ব্যাগ রেখে তাতে হাত বসে থাকে। আচমকা চোখ যায় হাতের অনামিকা আঙ্গুলে জ্বলজ্বল করা স্বর্নের ডায়মন্ড খচিত রিং টার দিকে। মুখে হাসির রেখা ফুটে উঠে ইনায়ার। মনে পরে দু বছর আগের সেই দিনটির কথা। যেদিন এই রিং পড়িয়ে জায়ান ওকে বাগদত্তায় স্বীকৃতি দিয়েছিল। মুটামুটি ঘটা করেই তাদের বাগদান অনুষ্ঠান সম্পূর্ণ হয়েছিল। ইনায়ার স্বপ্ন চারণের ফাঁকেই কাঙ্ক্ষিত জায়গায় অগ্রসর হতে থাকে তার যাত্রা বাহক।
করিম ভিলা আজ কিছুটা সাজ সাজ রব। চারদিকে রমরমা ঝলকানো পরিবেশ। খাবারদাবার গুলোতে এলাহী কান্ড। সকাল থেকেই ব্যস্ত হাতে সবকিছু সামাল দিচ্ছে নিধি। সাথে মিনারা বেগমও রয়েছেন। দুই শাশুড়ী বউমার আজ কোনো অবসর নেই। মিনারা বেগম রান্নার এদিক টা নিধির কাছে বুঝিয়ে দিয়ে মিজানুল করিমের কাছে গেলেন। মিজানুল করিম আর ফাহাদ হলরুমে এক সাথে বসে আছেন। মিনারা তাগিদ দিলো তাদের দুজনকেই,
-” আপনি কি এখনো ও বাড়িতে জানাননি কিছু? আর ফাহাদ তোর প্রাক্তন লোকদের কল করে দেখ কোথায় আছে। ”
ফাহাদ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ল্যাপটপ রেখে, ফোন লাগায় জায়ানের কাছে। মিজানুল করিম এতোক্ষণ গভীর ভাবনায় মগ্ন ছিলেন। মিনারার কথায় যেন হুঁশে এলেন মিজানুল করিম। স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে গম্ভীর মুখে বলে উঠলেন,
-” নাহিদ মির্জা জানিয়েছেন যেটা ভালো হয় সেটাই করতে। তিথিরা আসবে একটু পরেই। ”
-” তাহলে তো হলোই। আপনি মুখ ভার করে কেন আছেন? ”
মিজানুল করিম হতাশার সুরে বলে উঠলেন,
-” ফাহাদ এইসব থেকে সরে এসেছে তাতে খুব খুশি হয়েছিলাম। কিন্তু আবারও জায়ানের এইসবে জড়িয়ে যাওয়া খুব চিন্তায় রাখে আমাকে। ফাহাদ কে দেখার জন্য জায়ান ছিলো। কিন্তু ওর জন্য কে আছে? ”
-” তিন বছরে চারবার হামলা হয়েছে। এতেও ছেলের চোখ খুলে না। কি আর করার। ”
ফাহাদ ফোনে কথা শেষ করে বাবা-মায়ের উদ্দেশ্যে বলতে গিয়েও বলে না। তাদের এই তিন বছরে অনেক কথা বলেও বোঝাত পারেনি ফাহাদ। তখনই বাড়িতে প্রবেশ করে ইনায়া। তাকে দেখে সবাই অমায়িক হাসলো। মিনারা বেগম নিধিকে হাঁক ছেড়ে ডাকলেন। হন্তদন্ত হয়ে নিধি ছুটে আসলো। ইনায়া এদের ব্যস্ততা দেখে অবাক হলো কিছুটা। বাড়িতে এমন সাজ সাজ রব দেখে ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করে,
-” আজকে ফাংশন আছে কোনো? ”
নিধি উওরে মুচকি হেসে ইনায়ার হাত ধরে উপরে নিয়ে যেতে থাকে। মিনারা বেগম পেছন থেকে বলে উঠে,
-” তারাতাড়ি করো যেন। তারা একটু পরেই চলে আসবে। ”
কে আসবে? কিসের আয়োজন? তা ইনায়ার বোধগম্য হলোনা। নিধি ইনায়া কে কালো রঙের পাথরের কাজের একটা ভারি চুরিদার পরতে বলে।
ইনায়ার অবাকের মাত্রা আরো চওড়া হলো যখন একটু পর ফাহাদ আর মিজানুল করিম তার কাছে একটা প্রস্তাব রেখে বসে। ইনায়া শীতের মধ্যেও ঘেমে ন্যায় একাকার অবস্থা। কি বলবে উওরে বুঝে উঠতে পারছে না। অযাচিত ভাবে ঠোঁট নাড়িয়ে কোনোরকম শব্দ করে তাদের উদ্দেশ্যে বলে উঠলো,
-” আজ? এই মুহূর্তে? একটু বেশিই তাড়াতাড়ি হয়ে গেলো না? ”
মিনারা বেগম আর মিজানুল করিম একে ওপরে দিকে তাকালেন।
-” বিয়েটা দুবছর আগেই হলে ভালো হতো ইনায়া। তোমার অমতের জন্য জায়ান আমাদের নিষেধ করেছিল তখন। ”
মিনারা বেগমের কথায় ইনায়া রা করলো না। মিজানুল করিম বাধ সেধে বলে উঠলো,
-” থাক ইনায়া যেহেতু চাইছে না, তখন জোর করে কি লাভ? তার চেয়ে ভালো হ…………”
ফাহাদ ইশারায় মিজানুল করিম কে চুপ থাকতে বলে। মিজানুল করিমের মুখের কথা মুখেই থেকে যায়। ফাহাদ ইনায়াকে সময় নিয়ে বলে উঠে,
-” তোমার জীবনে সাকসেসফুল হওয়ায়া জায়ানের মূল উদ্দেশ্য ছিলো। এখন আর কি বাকি আছে ইনায়া? জীবনের রঙিন ধাপে যাওয়া ছাড়া? আজ আকদটা হয়ে যাক। সামনে বড়ো করে রিসেপশন করা হবে। জানোই তো, ওর পেছনে শত্রুরা হুমড়ি খেয়ে পরে আছে। সে আগে থেকেই। এখন তো ওর ক্ষমতা অন্যরকম। ”
ইনায়া মাথা ঝাকালো। করিম ভিলার সবাই আজ আটঘাট বেঁধে নেমেছে। আজকেই জায়ান আর ইনায়ার আকদ সম্পূর্ণ করতে চাইছেন। আচমকা আজ হঠাৎ করেই এমন সম্পর্কে বেঁধে যাবে। তাই একটু ঘাবড়ে গেলো ইনায়া। জীবনের প্রথম ঘাত পার করে এই সুখের রাস্তায় হাঁটতে যাবার আগেই ভয়ে মুখ শুকিয়ে যায় তার। ইনায়া নিজেকে ধাতস্থ করে মিনমিন করে বলে ওঠে,
-” আসলে হঠাৎ এমন সিদ্ধান্তে আমি ঘাবড়ে গিয়েছি। মনের প্রস্তুতিরও একটা ব্যাপার ছিলো। সমস্যা নেই, আমি রাজি। ”
সবাই যেন তৃপ্তির নিঃশ্বাস ফেললো। মিজানুল করিম মিনারা বেগমের সাথে কথা বলতে বলতে বেড়িয়ে গেলেন। ফাহাদ এবার চমৎকার হেসে বলে উঠলো,
-” মেয়র সাহেব কিন্তু ভয়ের চোটে আপনার সামনে আসছেন না। মূলত, আমারাই হুট করে এই ডিসিশন নিয়ে জায়ান কে জানিয়েছিলাম। আর কতো? তারও তো বয়স হয়েছে। জীবনের দ্বিতীয় পর্বে যাওয়া খুব জরুরি। ”
ইনায়া মনেমনে হাসলে। পাজি নেতা তাকে ভয় পায়? হু্হ, সব ঢংয়ের কথা। কিন্তু মুখে প্রকাশ করলো না সে। ফাহাদ নিধিকে বলে গেলো ইনায়াকে সাহায্য করতে। এতোক্ষণে কালো চুড়িদার দেখে ভ্রু কুঁচকালো। নিধি উচ্চ স্বরে হেসে বলে ওঠে,
-” ভাইয়া নিজে গিয়ে কিনেছে তোমার জন্য। তার নাকি খুব শখ তোমাকে তার রাজ্যের ব্লাক কুইন বানাবে। ”
ইনায়া কপাল চাপড়ায়। এই লোক শুধরাবে বলে হয় না। দীর্ঘ দু’ঘন্টা সময় নিয়ে ইনায়াকে রেডি করে নিধি। সবশেষে নিজেই মুগ্ধ হয়ে বলে উঠে,
-” মাশাআল্লাহ, খুব সুন্দর লাগছে তোমাকে। ছেলে হলে নির্ঘাত তোমাকে নিয়ে পালাতাম। ”
দুজনেই হেঁসে উঠলো। নিধি তড়িঘড়ি করে নিচে নেমে যায়। বিয়েতে পার্টির কিছু বিশ্বস্ত লোককে ডেকেছে ফাহাদ। তারা এসে গেছে সেই কখন। খাবারদাবারের পার্ট চুকিয়ে বিয়ে পরানোর কাজ সম্পূর্ণ করতে চাইছেন মিজানুল করিম। স্টাফদের সবাইকে খাবার রেডি করার কথা বলে, তিনি গেলেন জায়ানের খোঁজ করতে। নেতা সাহেবের আসার সময় হয়েছে। মিনারা বেগম জায়ানের সব কাপড় গুছিয়ে রাখছেন। তিনি জায়ানের মতের বিরুদ্ধে যাননি। ছেলের পছন্দ কেই মেনে নিয়েছেন। তিথি ইশান এসেছে। সোহানা মির্জা শেষ দিকে আর আসেননি। ইনায়া চুপচাপ বসে আছে। মিনারা বেগম তাকে ডায়মন্ডের একটা নেকলেস পড়িয়ে দিয়েছেন। কালো পাথরের ভাড়ি লং চুড়িদার আর চকচকে ডায়মন্ডে ইনায়াকে অপ্সরার ন্যায় লাগছে। চুল গুলো বাঁধন ছাড়ার মতোই কোমর পর্যন্ত বিছিয়ে আছে। দোপাট্টা মাথায় ভালো করে টেনে দিয়ে ইনায়া দরজার দিকে লক্ষ্য করে। নিধি আর তিথি এগিয়ে এসে ঝটপট বলতে শুরু করে,
-” এক্ষুনি বিয়ে হবে। কাজি আর রেজিস্ট্রার আসছে। তৈরি হয়ে নাও। ”
ইনায়া চমকালো। ঘেমে ন্যায় একাকার অবস্থা হয়ে যাচ্ছে। শীতের মধ্যে ইনায়ার এমন অবস্থা দেখে নিধি আর তিথি দৃষ্টি মেলালো একবার। জীবনের এমন পরিক্ষা ইনায়া পার করে এসেছে একবার। তখন যেটা খুশির ছিলো, এখন সেটা ভালো লাগা ভয় দুটোই কাজ করছে। কিছুক্ষণ পরেই ফাহাদ ইশান মিজানুল করিম সহ কয়েকজন লোক আসলো। ইনায়া ঠোঁট কামড়ে নিজের অস্থিরতা কমায়।
প্রথমেই সাইন করে রেজিস্ট্রার কমপ্লিট করে। নিচে বসে সম্পূর্ণ কাগজ তারা ঠিকঠাক করেই নিয়ে এসেছিলো। কাজি বিয়ে পড়ানো শুরু করে। ইনায়া কে কবুল বলতে বললে সে কিছুটা সময় নিয়ে কাঁপা কাঁপা গলায় কবুল বলে দেয়। সম্পূর্ণ অস্থিরতা ইনায়াকে আচানক ঘিরে ধরে আছে যেন। জীবনের হঠাৎ হঠাৎ এমন মোড় বদল তাকে বিভ্রান্ত করে তুলেছিল প্রথম থেকেই। লোকজন চলে যাওয়ার পর। নিধি ইনায়ার কাধে ধরে হালকা স্বরে জিজ্ঞেস করে,
-” তু্মি খুব ভিষণ ভাবে কাপছো। ”
ইনায়া মুখ মলিন করলো। বিরবির করে বলে উঠলো,
-” ভিষণ অস্থিরতা অনুভব করছি। না জানি কি হয় পরে? ”
রাত হয়েছে অনেকটা। আজকেও হালকা তুষার পড়া অব্যাহত রয়েছে। ফায়ারপ্লেসের আগুনে খানিক সময় শরীরটা উষ্ণতা অনুভব করলেও, আচমকা নাভানের শরীর যেন কাঁপুনি দিয়ে যায়। গ্লাস থেকে কিছুটা ওয়াইন নিয়ে সেটা গলাধঃকরণ করার আগেই সেখানে আগমন ঘটে লিও আর সাফরানের। দুজনের শরীরে মোটা উলের লং কোর্ট।
দুজনেই নাভানের দুপাশে ধপ করে বসে পড়লো। নাভান ভ্রুক্ষেপহীন ভাবে বসে ওয়াইনের গ্লাসে ঠোঁট লাগালো। সাফরান নাভানের পাশে বসে নিজের টুপি আর কোটটা খুলে রাখে। লিও মুখ গোমড়া করে বলে ওঠে,
-” আমাদের দেখে খুশি হওনি নাভান? ”
-” বাড়ি বয়ে চলে এসে জিজ্ঞেস করছো খুশি হয়েছি নাকি? হ্যাঁ, সাফরান কে দেখে ভালো লাগলেও তোমাকে দেখে হতে পারছিনা। তোমার এখন জিসার পাশে থাকা খুব জরুরি। ”
লিও ঠোঁট উলটে দিলো। জিসা আজকে নিজের বাবার গ্রহে গিয়েছে। সিজারের আরো পনেরো দিন বাকি। একা একা ভালো লাগছিল না দেখে নাভানের এখানে আসা। সাফরান নাভানের কথার বিপক্ষে দুর্দান্ত শটের মতো বলে উঠে,
-” স্যার, আজকে কি খুব বেশি ডিস্টার্ব লাগছে? এমনই মনে হচ্ছে আপনাকে। মনটা মনে হয় বাংলাদেশ পরে আছে। ”
সাফরানের কথায় নাভান দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল ওয়াইনের গ্লাস রেখে হতাশ দৃষ্টিতে তাকালো দুজনের পানে। অতঃপর বিরবির করে বলে ওঠে,
-” কেমন এক অস্থিরতা ধেয়ে আসছে যেন। ”
লিও নাভান কে মৃদু ধাক্কা দিয়ে জিজ্ঞেস করে,
-” তাহলে, বাংলাদেশে যাও। বাবা মা পরিবারের সাথে সময় কাটালে ভালো লাগবে তোমার। নাকি না যাবার প্ল্যান করে বসে আছো? ”
নাভান হাসলো, কেন যেন মন স্থির করতে পারছে না৷ দুজনের দিকে ওয়াইনের গ্লাস এগিয়ে দিয়ে, ফায়ারপ্লেসের খানিক জ্বলতে থাকা আগুনে দৃষ্টি স্থির করে ম্লান কন্ঠে বলে ওঠে,
-” জীবনটাই যেন কেমন। যা চেয়েছি তা পেলাম কই? যা পেয়েছি তা চাইলাম কই? আবার যটাতে মন স্থির করেছি, সেটাই মারাত্মক ভাবে ক্ষতির স্বরূপ আমার কাছে ধরা দিয়েছে। তা কি ভাগ্য? না সব আমার ভুলে কারণ? ”
গুমোট পরিবেশ যেন আরো গম্ভীরতায় ছেয়ে গেলো। লিও আর সাফরান কিছু বলার মতো খুঁজে পায় না। কিছু কিছু মানুষের জীবন টা এমনই। কিছু ভুলের মাশুল দিতে হয় অনেক। শোধরাবার চেষ্টা করলেও তা ঠিক করা যায় না। লিও মুচকি হেসে জিজ্ঞেস করে,
-” তাকে নিজের করে রাখার প্রয়াস করোনি? ”
নাভান এবারো চমৎকার হাসলো। তার হাসির মাঝে কষ্ট লুকিয়ে রয়েছে। লিওর দিকে তাকিয়ে হাসিমুখে বলে,
-” ঠিক তা নয়। তাকে নিজের করে রাখায় তাকে মানানোর মুখ আমার ছিলোনা। তার কাছে ক্ষমা চাইনি। তাকে অনুরোধ করিনি আমার কাছে থাকার জন্য। যতোবার সামনে গিয়েছি, নিজেকে তার সামনে খুবই নিকৃষ্ট মনে হয়েছে। পরিশেষে চেয়েছি, তার সুখের সন্ধান করা ভুল নয়। সে সুখে থাক। তার সেটা অধিকার রয়েছে। ”
নাভান কিছুক্ষণ থেমে আবার বলে উঠলো,
-” ডিভোর্স পেপারে সাইন করার সময় গুলোতে, ইনায়ার দীর্ঘশ্বাস ব্যাতিত কিছুই লক্ষ্য করিনি আমি। দাদি মা-রা যাবার পরপরই চলে আসতে চেয়েছিলাম। কিন্তু ডিভোর্সের শেষ কার্যকর পর্যন্ত অপেক্ষা করা জরুরি ছিলো। শেষ দিন ইনায়া আমাকে কি বলেছিলো জানো? ”
সাফরান আর লিও দুজনেই তাকালো। নাভান দীর্ঘশ্বাস ফেলে ফিরে গেলো সেদিনের অতীতে। তিথির বিয়ের দুইমাস পরে। একটা লেকের পাড়ে দু’জনেই দাঁড়িয়ে। সময়টা গোধূলি বিকেলের দিকে। দুজনেই হাত ভাজ করে সামনে তাকিয়ে। আচমকা নাভান জিজ্ঞেস করে,
-” আজ থেকে সম্পর্কের বোঝা নেই তোমার উপর। যা তুমি একা যাতনার সহিত বয়ে এসেছিলে? ”
ইনায়া হাসলো। কিঞ্চিত পরিমাণের বাকিয়েই হেসে উঠে। নাভানের দিকে পূর্ণ দৃষ্টি স্থাপন করে কাটকাট গলায় বলে ওঠে,
-” নয় মাস খুব কম সময় ছিলোনা। যেখানে, আপনার পর নারীর সাথে অন্তরঙ্গ মূহুর্ত প্রতিনিয়ত দেখে, নিজের আত্মসম্মান বিসর্জন দিয়ে অবলা নারীর মতো আপনার আশায় পরে ছিলাম। যেদিন বাড়ী ছেড়েছি, সেদিন কাবুলের জোরে মায়া ভালোবাসা সব শেষ করে এসেছি। এই জেনারেশনের আমার মতো এমন মেয়ে কই? যে স্বামীর আশায় এভাবে বসেছিল। হয়তো আমার স্বার্থে, আর নয়তো আমার অসহায়ত্ব নাহলে আপনার আশায়। যেগুলো আমার আত্মসম্মানে ঘাত করেছিল। যার এক কারণ মামনী। চোখ খুলতেই সেসব ছেড়ে এসেছি। ”
ইনায়া কথা গুলো বলে। পিছুফিরে একবার দেখে বলেছিলো,
-” ভালো থাকবেন নাভান। ভুল থেকে বেড়িয়ে আপনি ভালো কিছু জীবনে পাবেন। ”
নাভান ঠোঁট দুটি নাড়িয়ে অস্ফুটস্বরে বলেছিল,
-” হয়তোবা, তোমার কথাই জয় হোক। ”
পিছুটানের স্মৃতি থেকে বেড়িয়ে আসে নাভান। বসা থেকে উঠে গিয়ে দাড়ালো নিভু নিভু ফায়ারপ্লেসের আগুনের কাছে। অতঃপর গম্ভীর গলায় বলে ওঠে,
-” সেদিন আমি বলতে পারিনি। সেই নয় মাস অদিতির সাথে আমার সম্পর্ক দীর্ঘস্থায়ী ছিলো না। কারন হলো, বিয়ের পরেও তার সাথে আমি কয়কবার ফিজিক্যাল রিলেশনশিপে গিয়েছিলাম। তার আমার অতীত নিয়ে মাথা ব্যাথা ছিলো না। কিন্তু তাকে কবুল বলেও যেই পাপ অব্যাহত রেখেছি, তাই তার হৃদয়ে দাগ টেনেছে প্রচুর। যেটাকে আমি সম্মান করি। ”
লিও আর সাফরান আর কোনো কথা খুজে পেলোনা। তারা ইনায়া কে দোষও দিতে পারলো না। নাভান জ্বলন্ত আগুনে আবারও চোখ রেখে বিরবির করে বলে ওঠে,
-” “তুমি আমার জীবনের একমাত্র ধোঁয়াশা, যা হাত বাড়িয়ে ছুঁতে গেলেই হারিয়ে যাও। ”
বিয়ে কাজ সম্পূর্ণ হয়েছে। শেষ বারে মোনাজাত শেষ করে তারা মিষ্টি মুখ করায় ব্যস্ত। ইনায়া খোঁজ করে জায়ানের এখানে আসার পরে একবারও তার দেখা পায়নি। এবং কি বিয়ের আগে পরেও ইচ্ছাকৃত ভাবে কোনো দেখা দেয়নি। নিধি তিথি এই নিয়ে হাসাহাসি করেছে প্রচুর। তাদের ভাষ্যমতে, জায়ান লজ্জায় ইনায়াকে দেখা দিচ্ছে না। কিন্তু ইনায়ার মোটেই সেটা বিশ্বাস হলো না। সময় গড়িয়ে রাত হলো। ইনায়া রায়াকে ফোন করে সব জানায়। ফোনের ওপরপাশের রায়ার রিয়াকশন ছিলো মাথায় আকাশ ভাঙে পড়ার মতোন। রায়ার সাথে কথা বলতে থাকার সময় নিধি তিথি এসে ইনায়াকে নিয়ে যেতে লাগলো।
-” কোথায় নিয়ে যাচ্ছো? ”
-” গেলেই দেখতে পারবে। ”
ইনায়ার কথার উত্তরে নিধি জবাব দিলো। তারা দুজন ইনায়াকে টেনে হিঁচড়ে ছাঁদে নিয়ে আসতেই, চোখছানাবড়া হয়ে উঠলো ইনায়ার। সম্পূর্ণ ছাদ লাইটিং করা। একপাশের স্টেজটা সম্পূর্ণ কালো গোলাপে আবৃত করা। উপরের কাজে অর্কিড ফুলের সমাহার। ছোট বড়ো অসংখ্য ক্যান্ডেল লাইট বসানো সারা ছাঁদ জুড়ে। ইনায়ার মনটা পুলকিত হলো। পাশে তাকাতেই নিধি আর তিথি কে পেলো না। আচমকা চোখ যায় সামনে দাড়ানো জায়ানের পানে। কালো রঙের শেরওয়ানি কোটে তাকে প্রিন্সের থেকে কম লাগছে না। হাত বাড়িয়ে দাড়িয়ে আছে ইনায়ার দিকে। ইনায়া হাসিমুখে তার দিকে হাত স্পর্শ করে। অতিব উৎসুক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়েছে ইনায়া জায়ানের দিকে। অসম্ভব সুন্দর সুদর্শন পুরুষটি তার স্বামী। আচ্ছা ছেলেদের এতো সুন্দর হতে হয়? ইনায়ার ভাবনার মাঝে জায়ান তাকে নিজের বাহুতে জড়িয়ে ধরে পরম শান্তিতে। অতঃপর ইনায়ার কানে কানে ফিসফিস করে বলে,
-” আমার ভীতু হরিণী, আজ তো চোখে কোনো ভয় দেখতে পারছি না? ”
ইনায়া জায়ানের বুকে থেকেই স্নিগ্ধ মধুময় হাসলো। বুক থেকে মাথা উঠিয়ে কপাল ঠেকালো জায়ানের কপালের সাথে। স্মিথ হেসে বলে ওঠে,
-” তা কি আমি পারবো জনাব? আমি সারাজীবন আপনার কাছে বোকা হরিণী হয়েই থাকতে চাই। ”
জায়ান ইনায়াকে পাজো কোলে তুলে নেয়। ললাটে দীর্ঘ চুমু একে বলতে শুরু করে,
যাতনা আমার পর্ব ৩৯
-” আমার স্বপ্ন গুলো, আচমকাই আজ আমার হয়ে ধরা দিয়েছে। আমি এই মুহূর্ত টাকে অনুভব করতে চাই। বিষণ ভাবে উপভোগ করতে চাই। ছুয়ে দেখতে চাই, তুমি আদেও আমার হয়েছো? না কি স্বপ্নেই রয়েছো। ”
ইনায়া চোখবুঁজে বিরবির করে বলে উঠলো,
-” আমি আজ আপনারই। স্বপ্ন নয় সত্যিই। ”