পাতা বাহার পর্ব ৪৪

পাতা বাহার পর্ব ৪৪
বেলা শেখ 

সকাল বেলা। সূর্য মামার আগমনের বেশ সময় পেরিয়ে গেছে। ঘড়িতে সময় দশটার এদিক ওদিক হবে। সরকার মহলের পরিবেশ থমথমে ভাব বিরাজ করছে। হবে না কেন? সরকার বাড়িতে বর্ষার আগমন ঘটেছে। কালও এসেছিল বিকেল বেলায়; ভোরের জন্মদিন উপলক্ষ্যে। ভোরের আহত হওয়ার ঘটনা শুনে বেশ উদ্বিগ্ন হয়েছিল। হাসপাতালে যাওয়ার জন্য উতলা হয়ে পড়েছিল কিন্তু কেউ ঠিকানা দেয় নি। বর্ষা বেশ রাগারাগী করেছে। অরুণের সাথে তার ডিভোর্স হলেও বরুণ তার ছেলে।

এই সত্যটা কেউ মুছে দিতে পারবে না। ভোরের উপর তারও অধিকার আছে। আসমা বেগম গম্ভীর মুখে দু একটা জবাব দিয়েছিল! তবে বর্ষা দমে যায় নি। আসমা বেগম আর তর্কে জড়ায় নি তবে তার বোন আসমানী বেগম কোমড় বেঁধে নেমেছিল! বর্ষাকে তীক্ষ্ম কথার বাণে চৈত্রে পাঠিয়ে দিয়েছিল! কিন্তু বর্ষা পরদিন সকালেই হাজির হবে এটা তাদের ভাবনাতিত ছিল। এখন এসে ড্রয়িং রুমের সোফায় বসেছে আর ওঠার নাম নেই‌। গতকাল ‌ছেলেকে সঙ্গে আনলেও আজ সে একাই এসেছে। কারোর কোনো কথার জবাব সে এখনো দেয় নি। চুপচাপ বসে আছে। সে আজ পণ করেছে ছেলেকে দেখবে, কথা বলবে, প্রাণ ভরে আদরও করবে।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

সরকার বাড়ি মেহমানে ভরপুর ছিল কাল। দুপুরের ঘটনার পর অনেকেই চলে গেছে। বার্থডে পার্টিও ক্যান্সেল হয়ে গেছে। এখন বাড়িতে মেহমান বলতে আসমানী বেগম ও তার দুই নাতি নাতনি। রুবির মা আর সাবরিনা সাবিনা চৌধুরী। সাবিনা বর্ষার সামনের সোফায় বসে চা খাচ্ছে আর তীক্ষ্ম দৃষ্টিতে তাঁর দিকে তাকিয়ে আছে।বাড়ির প্রায় সকলেই ড্রয়িং রুমেই উপস্থিত আছে শুধু আনিকা ও আরিয়ান বাদে। বর্ষার ওতে ভাবান্তর নেই।

গেইট পেরিয়ে একটা গাড়ি বাড়ির আঙিনায় প্রবেশ করে। মেইন ফটকের সামনে গাড়ি দাঁড় করালে গম্ভীর অরুণ সরকার নেমে আসে। পাজা কোলে ঘুমন্ত ছেলে। পরপর পাতা নেমে আসে তার হাতে ব্যাগ পত্র! আভারি এগিয়ে এসে পাতার হাত থেকে ব্যাগপত্র নিয়ে নেয়। সাথে বাড়ির থমথমে অবস্থার প্রতিবেদন পেশ করে। অরুণের গম্ভীর মুখটায় চিন্তার ছাপ দেখা মিলে! হঠাৎ বর্ষা? আর পাতার স্বাভাবিক মুখটা নিমিষেই অন্ধকারাচ্ছন্ন নেমে আসে। বুকের ভেতর কেমন অদ্ভুত অনুভূতির আগমন ঘটে। সেথায় হালকা ভয়, ঈর্ষা, বিরক্ত, আশংকা আরো কিছু উপাদানের সংমিশ্রণে তার মনটা বিক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে। অরুণের পাশে দাঁড়িয়ে তার কোমড়ের কাছটার শার্টের কোনা চেপে টান দেয়। অরুণ আভারির কথায় মনোযোগী ছিল এহেন টান পড়ায় ঘার ফিরিয়ে চায়। পাতা মুখে কিছু বলে না; নাকের পাটা ফুলিয়ে ভোরের পা ধরে টান দেয় আস্তে। অরুণ কিছু বুঝতে পারলো না। ভ্রু উঁচিয়ে সুধায়,
-” হোয়াট?”

পাতা বিরক্তের সাথে তাকিয়ে ভোরকে নিজের কাছে টেনে নেয়। ভোর পা দুটো দিয়ে পাতার কোমড় পেঁচিয়ে ঘুমের ঘোরেই পাতার গলা জড়িয়ে ধরলো। পাতা ভোরকে নিয়ে হনহন করে ভিতরে হাঁটা দেয়।
পাতার আগমনে ড্রয়িং রুমের সকলেই তার দিকে তাকায়। বর্ষাও ব্যাতিক্রম নয়। পাতার কোলে ভোরকে দেখতে পেয়ে সে হন্তদন্ত পায়ে এগিয়ে আসে। পাতা থামে না; বর্ষাকে পাশ কাটিয়ে আস্তে ধীরে সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠতে থাকে। পেছনে থেকে বর্ষা ভোরকে ডাকে। ভোর ঘুমে আচ্ছন্ন থাকায় সাঁড়া দিতে পারে না। বর্ষা পাতাকে ডাকবে কিন্তু পাতার নামটা তার স্মরণে নেই! তবুও সে ডাকে,

-” এক্সকিউজ মি! দাঁড়াও? এই মেয়ে?”
পাতা মোটেই দাঁড়ায় না। কারো কোনো কথাকে তোয়াক্কা না করেই চলে যায় নিজ রুমের উদ্দেশ্যে!রাগে অপমানে বর্ষার মুখটা লালিমায় ছেয়ে যায়!
এরইমধ্যে অরুণের আগমন ঘটে। সাবিনা চৌধুরী অরুণের কাছে এসে জিজ্ঞেস করে,
-” কি অবস্থা ছেলেটার? ডাক্তার কি বললো?”
অরুণ বর্ষার দিকে এক পলক তাকায়! আশেপাশে সকলের নজর তার উপর।‌সকলেই তার উত্তর শোনার অপেক্ষায়। অরুণ গম্ভীর গলায় বলে,
-” আলহামদুলিল্লাহ ভালো! ক্ষত শুকাতে শুরু করেছে। দুই এক দিনের ভিতর শুকিয়েও যাবে। আর টিকাও চলছে!”
আসমা বেগম বলেন,

-” বড় বউয়ের কি অবস্থা?”
-” দুজনেই ঠিক আছে! চিন্তার কোন বিষয় নেই!”
অরুণের কথা শেষ হতেই বর্ষা এগিয়ে এসে অরুণের সম্মুখীন হয়ে দাঁড়ায়। স্বাভাবিকভাবেই বলে,
-” আমি বরুণের সাথে দেখা করবো! তোমার ওই পিচ্চি বউটা হনহন করে নিয়ে গেল আমার ছেলেকে আমি ডাকলাম তোয়াক্কাই করলো না!”
অরুণ তার থেকেও স্বাভাবিক গলায় বলে,
-” সি’জ ওলসো হিজ মাদার! ইয়ু স্যুড টেক পারমিশন ফ্রম হার! নাও সি উইল লেট হার সন মিট ইয়ু ওর নট! দ্যাটস হার থিং!”
বর্ষার মুখশ্রী থমথমে।

-” আই এম হিজ মাদার!বরুণের সাথে দেখা করতে, কথা বলতে আমার ওই মেয়েটার পারমিশন লাগবে? বরুণ যদি একবার শোনে তার মা এসেছে সে ছুটে আসবে!”
অরুণ ঘারে হাত রেখে মাথা এপাশ ওপাশ করে অলস ভঙ্গিতে বলে,
-” তোমার সিলি কথাবার্তা শোনার মুড একটু নেই! ছেলে ঘুমোচ্ছে তার ঘুম অতিব জরুরী!”
বর্ষা কিছু বলবে অরুণ তাকে থামিয়ে দিয়ে আপন গতিতে চলে যায়! এমনিতেই পাতাবাহার তার সাথে কথা বলছে না তার উপর এই আপদের আগমন। তার রানি সাহেবার রাগের মাত্র নিশ্চয়ই আরো বেড়েছে। অরুণ রুমে প্রবেশ করে দেখে দুজন বিছানায় শুয়ে আছে। সেও বিছানায় গা এলিয়ে দেয়। কিন্তু সুবিধা করতে পারে না। উঠে ওয়াশ রুমে যেতে যেতে বলল,

-” গোসল করবো আমি! কাপড় বের করে রেখো!”
আদেশ মুলক বাক্য! পাতা ভেংচি কাটলো।এই নাক উঁচু ম্যানারলেস লোক জীবনেও শুধরানোর নয়! এখনও হুকুম করছে! তার হুকুম পালন করতে যেন পাতা মুখিয়ে আছে!হঠাৎ নক করে কেউ! পাতা ভাবে বাড়ির কেউ হবে তাই আসতে বলে। কিন্তু বর্ষাকে দেখে তাঁর মুডটাই নষ্ট হয়ে যায়! বর্ষা এসে বিছানায় বসে। পাতার চিল্লিয়ে বলতে ইচ্ছে করে এটা আমার বিছানা! আমার রুম! এখানে বসা তো দূর, এই রুমে আপনার প্রবেশ করারও কোনো অধিকার নেই। এক্ষুনি বের হয়ে যান! কিন্তু বলতে পারে না। সে ওতটাও অভদ্র নয়! সে উঠে বসে। ভোরের গা ভালো করে কম্ফোর্টে ঢেকে দিয়ে এসির পাওয়ার কমিয়ে দেয়।
বর্ষা নাক মুখ কুঁচকে বলে,

-” তখন কতবার ডাকলাম শুনলে না কেন?”
-” এমনি!”
বর্ষার বিরক্তের মাত্রা বেড়ে যায়।
-” বরুণকে ডাকো! কথা বলবো আমি!”
-” ঘুমুচ্ছে!”
ছোট করে জবাব দেয় পাতা। তার কথা বলতে ইচ্ছে করছে না মোটেও। ইচ্ছে করছে মহিলার বড় বড় চুলের গোছা ধরে বের করে দিতে। বর্ষা এবার মেজাজ হারিয়ে বসে,
-” আশ্চর্য ডাকতে বললাম ডাকো! তোমার হাসবেন্ডের সাথে লুতুপুতু করতে আসি নি যে এমন মুখ বানিয়ে রাখবে‌। আমি আমার ছেলের কাছে এসেছি!”
পাতা গোল গোল করে চায়। সবাই শুধু তাঁর উপরেই চিল্লাচিল্লি করবে! দুনিয়ায় মানুষের অভাব? পাতা থমথমে মুখে জবাব দেয়,

-” আওয়াজ নামিয়ে ভদ্র ভাষায় কথা বলুন! আর হ্যাঁ আমার হাসবেন্ডের ব্যাপারে একটা কথাও বলবেন না। আমি পাতা সহ্য করবো না। হাসবেন্ড আমার, ছেলেও আমার! ইয়ু মাস্ট বি গেট লস্ট ফ্রম মাই রুম!”
বর্ষা শক্ত চোয়ালে পাতার দিকে তাকিয়ে বলে,
-” অরুণ কোথায়?”

পাতার নাকের পাটা ফুলে ওঠে।এই মহিলা আবার তার জামাইয়ের নাম নিচ্ছে। মহিলার ওই টকটকে লিপস্টিক দেয়া ঠোঁট পাতা হামানদিস্তায় পিষবে।‌সে ওয়াশরুমের দরজার দিকে তাকায়! লোকটার গোসল শেষের পথে বোধহয়। কাপড়চোপড় তো নেয় নি। অর্ধনগ্ন অবস্থাতেই না বেড়িয়ে আসে! সে বর্ষার কথায় তোয়াক্কা না করে আলমারি থেকে ট্রাওজার টি শার্ট নিয়ে ওয়াশ রুমের দরজায় নক করে। সাথে সাথেই দরজা অল্প খুলে যায়। একটা লোমশ হাত বেড়িয়ে আসে পাতা কাপড়চোপড় দিয়ে বর্ষার সামনে দাঁড়ায়। শান্ত গলায় বলে,
-” ছেলেটার শরীর ভালো নয়। এখন ঘুমুচ্ছে ডিস্টার্ব করা ঠিক হবে না। আপনি আসতে পারেন!”

বর্ষা ওঠে না। কম্ফোর্ট সরিয়ে দিয়ে ভোরকে ডাকে। ভোর চোখ খুলে নিমিত্তে! বর্ষাকে দেখে গোল গোল করে চায়। কয়েকবার পলক ঝাপটিয়ে বোঝার চেষ্টা করে সে স্বপ্ন দেখছে নাকি সত্যিই!যখন বুঝতে পারে এটা স্বপ্ন না, বাস্তব! তার চোখে মুখে যেন ঝিলিক দিয়ে ওঠে। বর্ষার গলা জড়িয়ে মা ডাকে।

পাতা নিষ্পলক চেয়ে থাকে। স্তব্ধ বিমুঢ় হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। তার বুকটা খালি হয়ে যায়। এতক্ষণ বর্ষা নামক মহিলার প্রতি ঈর্ষান্বিত হলেও এবার কেটে যায়। পাতার মনে হয় সে এতো দিন মোহ মায়ার জালে আটকা পড়েছিল! সদ্য ছিটকে বেড়িয়ে এলো। যে দুঃখকে সে নিজে ডেকে এনেছে সেই দুঃখ নিয়ে পাতা কি করে আফসোস করবে। ভোরের গর্ভধারিনী সে নয়! তার সাথে তার রক্তের টান নেই। তাঁর সঙ্গে কেবল মনের টান/ আত্মার টান আছে বোধকরি! বাচ্চাটা যখন তাকে আম্মু ডাকে পাতা নিজেকে মা মা অনুভব করে।

কাল রাতেও যখন বাচ্চাটা তার বুকে মাথা রেখে মা মা করছিল পাতার এক মুহুর্তের জন্যও মনে হয় নি সে তাঁর সৎ মা বা বাচ্চাটা তার নয়! কিন্তু এখন এই মহিলাকে মা ডাকলো তার ছেলেটা; মনে হলো সে কোন তৃতীয় ব্যক্তি। পাতার চোখ ভরে ওঠে। ভোর তাঁর মা’য়ের গলা জড়িয়ে গল্প করছে। কাল কিভাবে কুকুর আক্রমণ করেছিল! বর্ষা মনোযোগ দিয়ে শুনছে কখনো কখনো চুমু দিচ্ছে ভোরের গালে। ভোরও প্রতিত্তরে আদর করতে ভোলে না। তাদের পাশে দাঁড়িয়ে পাতা যে টইটুম্বুর চোখে চেয়ে আছে নিস্পৃহ ভাবে সেটা কি ভোরের চোখে পড়ে না? পড়বে কিভাবে? রক্তের টান যে নেই! পাতা অগোচরে চোখের পানি মুছে নেয়। তার ইচ্ছে করছে ভোরকে ওই কোল থেকে ছিনিয়ে বুকের মাঝখানে লুকিয়ে রাখতে!

এর মাঝেই অরুণ সরকার বেড়িয়ে আসে ওয়াশরুম থেকে। গলায় তোয়ালে ঝুলানো। পাতা সেদিকে তাকায়। নিমিষেই সব রাগ অভিমানের সুর সুরঞ্জিত হয়ে লোকটার উপর বর্তায়। সব দোষ এই নাক উঁচু ম্যানারলেস অসভ্য বেহায়া লোকটার!
অরুণ এগিয়ে এসে গম্ভীর মুখে পাতাকে উদ্দেশ্য করে বলে,
-” এটা বেড রুম আমাদের! কোনো বৈঠক খানা নয় যে যাকে তাকে ঢোকার অনুমতি দেবে!”
ভোর ভীত চোখে বাবার দিকে তাকালো। বর্ষার গলা জড়িয়ে মিনমিন করে বলল,
-” আম্মু চল বাইরে যাই?”

বর্ষা তাকে কোলে নিয়ে উঠে চলে যায়। অরুণের কথা তাঁর বিন্দুমাত্রও গায়ে লাগে নি। কোন পুরুষই তার প্রাক্তন স্ত্রীকে নিশ্চয়ই মধুর গীত শোনাবে না!!
পাতা তাদের যাওয়ার দিকে তাকিয়ে থাকে। ওরা বেরিয়ে গেলে অরুণের দিকে তাকালো। অরুণের নজরও পাতাতেই নিবদ্ধ। সে পাতার নাকটা টিপে দিল। পাতা প্রতিক্রিয়া হীন। অরুণ গলা থেকে তোয়ালে নামিয়ে পাতার গলায় ঝুলিয়ে কাছে টেনে আনে।
-” এমনভাবে তাকিয়ে আছো কেন? মনে হচ্ছে বর্ষাকে আমিই ডেকে এনেছি! আরে বাবা আমি কেন ওকে আনতে যাব!”
পাতা আস্তে করে ছাড়িয়ে নেয় নিজেকে। আলমারি খুলে শাড়িস প্রয়োজনীয় কাপড় নিয়ে ওয়াশ রুমে চলে যায়। অরুণ গলা উঁচিয়ে বলে,

-” একা পারবে? আমি আসবো? হেল্পের জন্য!”
ধরাম করে দরজা বন্ধ হওয়ার শব্দে অরুণের কপালে ভাঁজ পড়ে।
-” এটা কেমন বেয়াদবি পাতাবাহার?”
কথার কোনো ক্রিয়া প্রতিক্রিয়া আসে না। অরুণ ফ্লোরে পা ঝুলিয়ে রেখে বিছানায় গা এলিয়ে দেয়। চোখ বুজে শ্বাস টানে। তখনই মানসপটে ভেসে ওঠে এক আদুরে চেহারা। অরুণ চোখ খুলে উঠে দাঁড়ালো। বেলকনিতে গিয়ে একটা খাঁচা আনে। খাঁচা খুলে বের করে বিড়াল ছানাটিকে। প্রতিবারের মতো মিও মিও করে লাফিয়ে ওঠে না। অরুণের কপালে ভাঁজ পড়ে। পাতাবাহার ছোট ছোট চোখে তাকিয়ে দূর্বল গলায় মিও বলে গুঙ্গিয়ে ওঠে। অরুণ খেয়াল করে বিড়ালটার ঘারের দিকটায় জখম! জখমে ওষুধ জাতীয় কিছু লাগানো। কাল কী তাহলে এই ছোট্ট বাচ্চাটাও আহত হয়েছে? ইশ্! তার ছোট পরিবারের সকলেই আহত! সে বিড়ালটিকে কোলে তুলে নিয়ে আদর করে গা বুলিয়ে বলে,

-” জলদি ঠিক হয়ে যাও পাতাবাহার! আই মিস ইয়ু!”
বিড়াল শাবক অরুণের হাতে গাল ঘষে।অরুণ হেসে বিড়ালটিকে খাঁচায় পুরে দেয়। একেও টিকা দিতে হবে!
অরুণ পূর্বের মতো বিছানায় গা এলিয়ে দেয়। মিনিট বিশেক পড়ে পাতার আগমন ঘটে। অরুণ আড়চোখে চায়। চাওয়া মাত্রই সে উঠে বসে তড়িৎ বেগে। মেয়েটা শাড়ি পড়ে নি। শুধু কোনো মতে গায়ে জড়িয়েছে। অনাবৃত মেয়েলি কায়া উঁকি ঝুঁকি দিচ্ছে অরুণকে।

পাতা ড্রেসিন টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে শাড়িটা পড়তে শুরু করে প্রাথমিকভাবে। ওয়াশরুম ভিজে থাকার দরুন এখানে আসা। লোকটা রুমেই আছে বুঝতে পারলে আসতো না। সে ভেবেছে ভোরের কাছে গেছে হয়তো। পাতা দক্ষ হাতে কুচি দিয়ে গুঁজে নেয়। বুকের আঁচল ফেলে সম্মুখে আয়নায় কারো প্রতিবিম্ব দেখতে পায়। অসভ্য লোক কেমন করে তাকিয়ে আছে! যেন চোখ দিয়েই গিলে নিচ্ছে। পাতা আঁচল ঠিক ঠাক করে তোয়ালে খুলে মাথার চুল মুছতে থাকে‌। অরুণ সরকার আর বসে থাকতে পারে না। উঠে এসে পাতার পিছন ঘেঁষে দাঁড়ায়। হাত থেকে তোয়ালে নিয়ে যত্ন করে মুছে দেয় চুল!

-” ব্যান্ডেজ খুলে ফেলেছো? ইটস্ ওকে আমি করে দিবো!”
বলে ভেজা তোয়ালে সোফায় ছুড়ে ফেলে। সেটা দেখে পাতার কপালে ভাঁজ পড়ে। তোয়ালে তুলতে যাবে তার আগেই কারো বাহু বন্ধনে বেঁধে রাখা হয় তাকে। পাতা চমকপ্রদ হয়ে ওঠে। অরুণ শূন্যে তুলে নেয় তাকে। নিবিড়ভাবে জড়িয়ে ধরে ভেজা চুলে নাক ডাবিয়ে শ্বাস টানে। কিছু বলে না; কিছু করে না। তবে তার নীরবতা, গভীর আলিঙ্গন যেন অনেক কথাই বলে ফিসফিসিয়ে! পাতার অবুঝ মন অনেক কিছুই বুঝে নেয়। সে ছটফট করে না; আবার আকরেও ধরে না। অরুণ আরেকটু চেপে ধরে নিজের সাথে। চুলের ভাঁজে চুমু দেয়।

বর্ষার হাত ধরে ভোর হাসিখুশি মুখে হাঁটতে হাঁটতে রুমে প্রবেশ করে। বর্ষা ইতস্তত বোধ করে বেশ! ভোর সেসবের তোয়াক্কা না করে হুড়মুড়িয়ে মা’কে টেনে আনে। কারো উপস্থিতি বুঝতে পেরে পাতা উশখুশ শুরু করে। অরুণ ছেড়ে দিয়ে দরজায় তাকায়! ভোর ও বর্ষাকে দেখে খানিকটা ঝাঁঝালো গলায় বর্ষার উদ্দেশ্যে বলে,
-” বিনা পারমিশনে অন্যের রুমে প্রবেশ করতে নেই জানো না? কমন সেন্সের অভাব! গেট আউট?”
রুমে প্রবেশ করেই দু’জনকে ওমন পরিস্থিতিতে দেখে বর্ষাও বেশ অস্বস্তিতে পড়ে। সে কিছু বলবে এর আগে ভোর নাকের পাটা ফুলিয়ে বলে,

-” মা’ কে বকছো কেন? আমিই এনেছি মা’কে। মা’ কে একটুও বকবে না!”
পাতা এপাশ ফিরে শান্ত চোখে ভোরের দিকে চায়। ভোরের নজরে পাতা পড়ে না। অরুণ গম্ভীর গলায় বলে,
-” আচ্ছা বকলাম না। ভোর? এদিকে এসো? অসুস্থ শরীর নিয়ে এভাবে দৌড় ঝাঁপ দেয় কেউ?”
ভোর এগিয়ে যায় বর্ষার হাত ধরেই।
-” ও আব্বু! আমি একটু মা’ র সাথে নানু বাড়ি যাই? প্লিজ আব্বু? প্লিজ?”

অরুণ কপালে গাঢ় ভাঁজ ফেলে বর্ষার দিকে চায়। বর্ষা ভোরের মাথায় হাত বুলিয়ে খানিক অনুনয়ের স্বরে বলে,
-” না কোরো প্লিজ!কাল ভোরে আমাদের ফ্লাইট। আগামী চার পাঁচ বছরেও আশা হবে না। এই মাত্র কয়েক ঘন্টার জন্য নিয়ে যাবো। বাবা মাও দেখতে চেয়েছে!প্লিজ অরুণ?আমি ওর যথেষ্ট খেয়াল রাখবো!”
পাতার মনটা দুরু দুরু করে। সে চায় না ভোর ওনার সাথে যাক! সে অরুণের দিকে চায়। লোকটা যেন মানা করে! অরুণের কপালের ভাঁজ শিথিল হয়।
-” তো এসব ইমোশনাল কথা বলে ছেলেটাকে রাজি করিয়েছো! ছেলে ভুলতে পারে আমি না। ভোর কোথাও যাচ্ছে না। না মানে না!”

পাতার মুখ উজ্জ্বল হয় খানিক। তবে ভোর দৌড়ে এসে অরুণের হাত ঝাঁকিয়ে অনুরোধ করে বলে,
-” আব্বু প্লিজ! আমার না ওই নানু বাড়ির কথা একটুও মনে নেই। আমি যাবো আর এখুনি আসবো! একটু যেতে দাও না? প্লিজ?”
অরুণ কঠোর গলায় বলে,
-” কানে শুনতে পাও না?না বলেছি! অসুস্থ শরীরে মার না খেতে চাইলে চুপচাপ বিছানায় শুয়ে পড়ো! যাও?”
ভোরের চোখ ভরে ওঠে নিমিষেই। নাকের পাঠা ফুলিয়ে ফুঁপিয়ে ওঠে। বাবার হাত ছেড়ে পাতার হাত ধরে বলে,
-” ও আম্মু? আব্বুকে বলো না রাজি হতে! আমি এই এইটুকু যাবো? প্লিজ? আমার না খুব করে যেতে ইচ্ছে করছে! একটু বলো না আব্বুকে? ”

প্রতিবারের মতো এবার আর ভোরের ক্রন্দনরত মুখটা দেখে ইচ্ছে হয় না তার জেদের জন্য আপিল করতে! সে ভোরের মাথায় হাত বুলিয়ে বলে,
-” অসুস্থ না তুমি? অন্য কোন দিন যেও!”
ভোরের চোখ এবার বাঁধন ছাড়া হয়। পাতার হাত ছেড়ে বর্ষার কাছে যায়। পাতার বুকটা কেঁপে উঠলো নিমিষেই! সে ঢোক গিলে।
বর্ষা এবার অরুণকে বলে,
-” অরুণ? আমি বরুণকে নিয়ে হারিয়ে যাবো না। সহি সালামত তোমার কাছেই ফিরিয়ে দিবো। একটু সময় আমার ছেলেটার..”

-” ভোর আমার ছেলে! শুধু আমার! ও কোথাও যাবে না। তুমি যেতে পারো এখন?”
হুঙ্কার দিয়ে বলে অরুণ। বর্ষা দমে যায় না। সেও চিল্লিয়ে বলে,
-” তুমি বোধহয় ভুলে যাও ভোরের জন্মদাত্রী মা আমি! ওর উপর আমারও অধিকার আছে! ছেলেটা আমার সাথে যেতে চায়; আমি নিয়ে যাবোই!”
-” জন্ম দিলেই মা হয়?হবে হয়তো! তবে মমতাময়ী না! এটা তো ভোরের দূর্ভাগ্য যে তুমি তার জন্মদাত্রী!দুধের বাচ্চাকে রেখে যাওয়ার সময় মাতৃত্ব কোথায় গিয়েছিল?এখন হঠাৎ এতো দরদ ভালোবাসা উতলে উতলে পড়ছে! থাক পুরনো কথা! দেখি তোমার কত বড় স্পর্ধা!নিয়ে গিয়ে দেখাও?”
এবার শান্ত সুর অরুণের!ভোর সেই কখন বর্ষার কোমড় জড়িয়ে মুখ লুকিয়ে নিয়েছে। সে মা’য়ের সাথে যেতে চায়।মা অনেক দূরে যাবে বিমানে চড়ে।অনেক বছর আসবে না। তাই সে একটু মায়ের সাথে সময় কাটাতে চায়!বর্ষা ভোরকে কোলে তুলে নেয়,

-” দেখি কিভাবে আটকাও!”
-” ভোর? একেবারে ছোট বাচ্চা তুমি নও! আম্মু চাই! আম্মু চাই! এনে দিই নি? তোমার আম্মু কম ভালোবাসে তোমায়?তারপরও এর কাছে কেন যেতে হবে তোমার?”
-” অরুণ সৎ আর আপন বলে একটা কথা আছে! আশা করি এ বিষয়ে তোমার থেকে ভালো কেউ জানে না!”
তাচ্ছিল্যভাবে বলে বর্ষা! অরুণ পাতা দুজনেই যেন নিস্প্রভ প্রদীপের আলোর মতো নিভে গেলো! অরুণ এগিয়ে যায়। বর্ষার সম্মুখীন হয়ে ভোরকে বলে,
-” ভোর? তুমি যেতে চাও?”
ভোর কনুই ভাঁজ করে চোখ ডলে বলে,

-” আব্বু? একটু গেলে কি হবে?”
-” কিছু না! আসো আমি রেডি করিয়ে দিচ্ছি!”
বর্ষা ,ভোর, পাতা তিনজনেই অবাক হয় ঢের! ভোর উজ্জ্বল লেচনে জিজ্ঞেস করে
-“সত্যিই আব্বু?”
অরুণ মাথা নাড়ল। ভোর খুশি হয়ে হাত বাড়িয়ে দিলে অরুণ কোলে তুলে নেয়। ছেলেকে নিয়ে ওয়াশ রুমে যেতে যেতে বলে,

-” পাতাবাহার? ঘর থেকে জঞ্জাল বের করো! ফাস্ট!”
পাতার অধরকোনে হাসির রেখা দেখা যায়। এই নাক উঁচু ম্যানারলেস কপোট লোকটার চাল বুঝতে বাকি নেই! বর্ষা আহাম্মক হয়ে দাঁড়িয়ে! পাতা গলা খাঁকারি দিয়ে বলে,
-” ঝাড়ু আনবো? ওই ওই জঞ্জাল পরিষ্কার করতে!”
বর্ষা কটমট করে পাতাকে চোখ রাঙিয়ে হনহন করে বের হয়ে যায়। তার বোঝা উচিত ছিলো অরুণ সরকার কখনোই বরুণকে নিয়ে যেতে দেবে না!
বর্ষা বেরিয়ে যেতেই পাতা দরজা বন্ধ করে দীর্ঘশ্বাস ফেলে। তার জীবন নাটক সিনেমার থেকেও কোনো অংশে কম নয়। তবে ছোট ভোরের উপর তার বেশ অভিমান হয়। সে যখন কোন বাচ্চাকে কখনো আদর করে নবাব গাল ফুলিয়ে বসে থাকবে ‌আর এখন মা’ কে পেয়ে আম্মুকেই ভুলে গেলো?

বিছানায় গাল ফুলিয়ে বসে আছে আনিকা! পাশে রূপ আনিকার পুতুল হাতে বসে আছি। শুধু বসেই ক্ষান্ত হয়নি; পুতুলের নাক মুখে পুরে কামড়ে দিচ্ছে আর খিলখিলিয়ে হাসছে। তাঁর হাসিতে আনিকা বিরক্ত হয়ে ধুম করে কিল বসিয়ে দেয়‌‌। ব্যস রূপের রেডিও বেজে উঠলো। আরিয়ান ছেলের কান্না শুনে ওয়াশরুম থেকে বেড়িয়ে এসে কোলে তুলে নিয়ে বলে,

-” কি হয়েছে আমাল বাবাটাল? হুম! ওলে লে কাঁদে না! আনি মা কি হয়েছে? কাঁদছে কেন?”
রূপ আও আও করে অভিযোগ জানায়। আরিয়ান কিছু বোঝে না তবে হেসে ছেলের গালে মুখে চুমু দিয়ে বলে,
-” হুম বকে দেবো! বাবা হাসো তো?”
রূপ হাসে না। ঠোঁট উল্টিয়ে আনিকার দিকে তাকায়। আরিয়ানও তাকায়। মেয়েকে চুপচাপ গালে হাত দিয়ে বসে থাকতে দেখে বলে,

-” আনি মা? কি হয়েছে? এভাবে গাল ফুলিয়ে রেখেছো কেন? ভোর এসেছে দেখা করো নি? ভোর যাবো ভোর যাবো বলে তো কাল থেকে পুরো বাড়ি মাথায় তুলছিলে। এখন ভোর তো এসে গেছে!”
আনিকা গাল ফুলিয়ে রেখে বলে,
-“গিয়েছিলাম আমি ওই পঁচা ভোরের কাছে! ও পঁচা চাচিমনির সাথে কথা বলছিলো! আমার কথা শুনলোই না! ওর সাথে আর কথা নেই!”
আরিয়ান ছেলেকে শূন্যে ছুঁড়ে আবার ধরে। রূপ খিলখিল করে হাসে, কান্না ভুলে। আরিয়ান মেয়ের উদ্দেশ্যে বলে,
-” ওই মহিলা চলে গেছে সেই কখন! এখন দুপুর হতে চলল!”
-” সত্যিই চলে গেছে?”
কৌতূহল মনে প্রশ্ন আনিকার। আরিয়ান মাথা নাড়তেই আনিকা দৌড়ে বেড়িয়ে যায় ঘর থেকে। উদ্দেশ্য ভোরের সাথে কথা বলা!
সে দৌড়ে ভোরদের রুমে যায়! ধরাম করে দরজা খুলে হাঁটুতে ভর দিয়ে হাঁপাতে হাঁপাতে বলে,

-” ভোর? বড় চাচিমনি? তোমরা ঠিক আছো?”
পাতা ঘার ফিরিয়ে আনিকার দিকে চায়! হাঁফ প্যান্ট ও ফ্রক পড়ে মাথায় রঙ বেরঙের ক্লিপ লাগানো এক আদুরে মিষ্টি মেয়ে! পাতা মুচকি হেসে বলে,
-” একদম! আসো?”
আনিকা এগিয়ে আসে। পাতা তাকে বিছানায় বসিয়ে দেয়। ভোর কম্বল থেকে মুখ বের করে একবার দেখে নিয়ে আবার লুকিয়ে পড়ে‌। সে সবার সাথে রাগ করে আছে। আব্বু তখন তাকে বোকা বানিয়েছে। তাকে রেডি করানোর কথা বলে নিয়ে যায়। রেডি হয়ে ভোর এসে মা’ কে পায় নি! আম্মু বলেছে সে নাকি চলে গেছে। কিন্তু ভোর যানে মা যায় নি! আব্বু পাঠিয়ে দিয়েছে।
পাতা ও আনিকা ভোরকে ডাকে। ভোর সাঁড়া দেয় না। পাতা দীর্ঘশ্বাস ফেলে। রেডা হয়ে মা’ কেনা পেয়ে ভোরের সে কি কান্না? থামানোই যাচ্ছিল না! অরুণ জোড়ে এক ধমক দিয়ে বলেছিল,

-” এই চুপ? আরেকবার আওয়াজ হলে রেখে আসবো ওই মহিলার কাছে! একেবারের জন্য! আর আনবো না। তখন থেকো মা’ য়ের কাছে!”
তখন ভোরের কান্নার আওয়াজ থেমে যায়। সে মায়ের সাথে থাকতে চায় নি তো! সে মা’কে ভালোবাসলেও মা’ তো তাকে ভালোবাসে না! তবে সে শুধু একটু সময় কাটাতে চেয়েছিল! সে আব্বু আম্মুর সাথেই থাকতে চায়! আব্বু তাকে ওখানে রেখে আসার কথা বলতে পারলো?
-” আব্বু তুমি মিথ্যুক! বলেছিলে যেতে দিবে!
-” কখন বলেছি? আমি শুধু বলেছি আসো রেডি করিয়ে দিচ্ছি!

ভোর তখন বিছানায় উঠে আপাদমস্তক কম্বলে মুড়িয়ে নেয় নিজেকে। কারোর সাথেই কথা বলছে না। আসমা বেগম, আদুরি ,সাবিনা চৌধুরী, আভারি এসে ডেকে গেছে কথা বলে নি!এমনকি পাতার সাথেও না। পাতা তখন থেকেই ভোরকে ডাকছে। এটা ওটা বলে বোঝাতে চেষ্টা করছে। ভোর শুনছে তবে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করছে না। অরুণ সরকার কিন্তু একবারও ডাকে নি। পাতা জানে লোকটা এসে একটু আদর করে ডাকলেই ভোর উঠবে। কিন্তু লোকটাও আরেক জেদের খাম্বা। সেই যে বেড়িয়েছে আসার নাম ডাক নেই! আনিকা ভোরের কম্ফোর্ট টেনে ধরে; ভোর শক্ত করে ধরে রাখে ছাড়ে না। আনিকা বিরক্ত হয়ে বলে,

-” উফ চাচিমনি ছাড়ো তো পঁচা ভোরকে! তুমি যখন আমাকে, রূপকে আদর করো তখন ভোর কেমন করে? তাহলে আজ ভোর ওর ওই পঁচা মায়ের সাথে কথা বলেছে আদর করেছে! তুমিও ওর সাথে রাগ করে থাকো! কথা বলো না। তখন বুঝবে মজা!”
পাতা আনিকার গাল জোড়া টিপে দিয়ে কপালে চুমু দেয় সশব্দে। ভোর গাল ফুলিয়ে কান খাঁড়া করে রাখে। তার আম্মুকে পচা বুদ্ধি দিচ্ছে শয়তান আনিকা! ভোর কম্ফোর্ট পেঁচিয়েই গড়াগড়ি খায় বিছানায়। পাতার অবস্থান বুঝতে পেরে পিঁপড়ের মতো গুটি গুটি করে পাতার কোলে মাথা রাখে। হাত বাড়িয়ে আনিকার হাতে জোড়ে চিমটি কাটলো। আনিকা চেঁচিয়ে উঠলো সাথে সাথেই।

-” দুষ্টু ভোর! চাচিমনি তুমি ওকে সরিয়ে দাও তো! ওর সাথে একটুও কথা বলবে না!”
পাতা সত্যিই সরিয়ে দেয় ভোরের মাথা তাঁর কোল থেকে। এ পর্যায়ে ভোর কষ্ট পায়! কম্ফোর্ট সরিয়ে দিয়ে গম্ভীর মুখে বলে,
-” বলতে হবে না কথা! ভোর আরেকটু বড় হলেই চলে যাবে এখান থেকে! ভোরের কারোর দরকার নেই!”
-” তাই নাকি?”
ভোর বাবার গলা শুনে গোল গোল চায়! ঝাপিয়ে পড়ে পাতার উপর! গলা জড়িয়ে কাঁধে মুখ লুকিয়ে বিড়বিড় করে বলে,

-” শুধু আম্মু হলেই হবে;আব্বু দুষ্টু! আম্মু তুমি আর আমি চলে যাবো এখান থেকে আচ্ছা?”
পাতা ‘আচ্ছা’ বলে ভোরের পিঠে আস্তে করে চাপড় দিলো! অধরকোনে হাসির রেখা ফুটে উঠলেও আঁখি যুগল ভরে গেছে। বর্ষা নামক মহিলার কাছে যাওয়ার পরে এই প্রথম তার বুকে এলো! পাতা বোধকরি জানে প্রাণ ফিরে পেলো! সাথে এটাও ঠাহর করতে পারলো বাচ্চাটা তার হৃদ কুঠিরে কতটা জুড়ে আছে!
অরুণ টি টেবিলে ট্রে রাখে। ট্রে’তে খাবার সরঞ্জাম! গরম ভাত সাথে শিং মাছের ঝোল! বড় রুই মাছের ডিম ভুনা! রুই মাছের বড় মাথা! সে প্লেটে ভাতসহ মাছ নিয়ে বিছানায় বসে। মাছের কাটা বেছে নিয়ে বলে,

-” কে কোথায় যাবে দেখা যাবে! আমি মেয়ে পছন্দ করে রেখেছি। কালই গিয়ে বিয়ে পড়িয়ে ছেলের বউকে নিয়ে আসবো‌। লাল টুকটুকে বউ রেখে সে কোথাও যেতেই পারবে না!”
আনিকা হু হা হা করে হেসে ওঠে।
-” ভোরের বউ?চাচ্চু সত্যিই কাল ভোরের বিয়ে?”
ভোর গাল ফুলিয়ে পাতার গলা ছেড়ে আনিকার চুল টেনে ধরে।জোড়ে না, আবার আস্তেও নয়! আনিকা চেঁচিয়ে উঠলো। ভোরের কপালে আবার ধমক জোটে। ভোর পাতার কোলে মাথা রেখে কাঁদত কাঁদতে বলে,

-” আম্মু? কেউ ভালোবাসে না আমায়! আমি বিয়ে করবো না? আব্বুকেই বলো বিয়ে করতে!”
অরুণ মুচকি হাসলো। পাতা কটমট করে চায়। বিয়ের কথা শুনে কি লোকটার মনে লাড্ডু ফুটলো? সে ভোরকে সান্ত্বনা দিয়ে বলে,
-” তোমার বাবা মজা করছে তো! এত ছোট বাচ্চা বিয়ে করে? বিয়ে করতে একুশ বছর হতে হবে! তুমি তো সবে ছয় বছর একদিন!”

-” একুশ বাইশ চব্বিশ আমি কখনোই বিয়ে করবো না! না মানে না!”
চিল্লিয়ে বলে ভোর! আনিকা তার চিল্লাচিল্লিতে হেসে কুটিকুটি! ভোর তার হাসি দেখে আরো রেগে যায়! পাতা তার মাথায় হাত বুলিয়ে শান্ত করে!
-” কেন বিয়ে করবে না?”
ভোর পাতার দিকে পিটপিট করে চায়। নাক টেনে বলে,
-” বিয়ে করলে সবাই লজ্জা দিবে!”
পাতা ফিক করে হেসে দেয়। আনিকা তো কংস মামার মতো করে হাসছেই! অরুণও হাসে শব্দহীন! ভোর আরো লজ্জিত হয়। দু হাতে নাক মুখ ঢেকে নিয়ে বলে,
-” তোমরা একটুও ভালো না! শুধু শুধু ভোরকে লজ্জা দিচ্ছো!’
পাতা হাসি থামিয়ে বলল,
-” আচ্ছা আর দিবো না লজ্জা! এখন ওঠো তো ভোর?”

ভোর উঠে পাতার কোলে বসে। অরুণ ভাতের লোকমা মুখে দেয়! ভোর অন্যদিকে তাকিয়ে খাবার চিবোতে থাকে। কথা বলবে না বাবার সাথে! অরুণ আনিকার মুখে দেয় খাবার! আনিকা হাসিমুখ নেয়। পাতার বারি এলে পাতা হা করে না! ঠোঁটে ঠোঁট চেপে বসে থাকে! অরুণ শান্ত চোখে চেয়ে থাকে।
-” পাতাবাহার? খাওয়ার সাথে কিসের গোস্বা? হা করো?”
পাতা বাচ্চাদের দিকে চায় আড়চোখে। দু’জনেই তার দিকে তাকিয়ে আছে। পাতা হা করে অরুণ তার মুখ ভর্তি ভাত দিয়ে বলে,
-” আমি খুবই বাজে একজন মানুষ! খুবই বাজে।এখন কি আর করার তোমাদের কপাল খারাপ তাই আমার ঘরে অবস্থান করছো! এর থেকে তো নিস্তার পাওয়ার কোনো অবকাশ ই নেই! এই বাজে লোকটাকেই সহ্য করতে হবে সারাটা জীবন !”

আনিকা এগিয়ে এসে অরুণের গাল জোড়া টেনে দিয়ে বলে,
-” বড় চাচ্চু তুমি খুব খুব খুব ভালো! ইস্ট ওর ওয়েস্ট চাচ্চু ইজ দা বেস্ট!”
-” থ্যাংক ইয়ু আনিবুড়ি!”
আনিকা অরুণের গালে চুমু বসিয়ে দিয়ে নিজ স্থানে বসে পড়লো। ভোর আর পাতা আড়চোখে তাকিয়ে তাদের দিকে। অরুণ ভোরের মুখে খাবার দিয়ে বলে,
-” কলিজা? সবসময় জেদ করো তুমি! পড়ে বকলে আমার দোষ?”
ভোর খাবার গিলে ঘার মুড়িয়ে আম্মুর দিকে তাকিয়ে বলে,

-” আমি জেদ করি? একটু গেলে কি হতো?”
-” যে ভালোইবাসে না তাঁর সাথে কেন যাবে?”
ভোর মুখটা মলিন দেখায়। বাবার দিকে তাকিয়ে বলে,
-” আমি তো ভালোবাসি!”
অরুণ আর একটা শব্দও উচ্চারণ করে না। বাসুক ভালো! সে তো আর থামাতে পারবে না। অরুণ পাতার দিকে তাকায়! মেয়েটার মুখটা মলিন হয়ে গেছে নিমিষেই। মলিনতার কারন বুঝতে সময় লাগে না। ভোর বাবার নজর দেখে নিজে ঘার মুড়িয়ে আম্মুর দিকে চায়! পাতা অধর বাঁকিয়ে হাসে। কিন্তু সেই হাসিতে যেন দ্যুতি ছড়িয়ে পড়ছে না। ভোর পাতাকে জড়িয়ে ধরে বলে,

-” আম্মু তুমি মন খারাপ করেছো? ভোর তোমাকেও অনেক ভালোবাসে! আমি মা’কে একটু একটু ভালোবাসি তোমাকে অনেক অনেক ভালোবাসি! সত্যিই বিশ্বাস করো?”
-” মন খারাপ করি নি তো! আমি জানি ভোর আমাকে অনেক ভালোবাসে! তবে মা’কে পেলে আম্মুকে ভুলে যায়! থাক সেটা কোনো ব্যাপারই না!”
ভোর পাতাকে ছেড়ে দিয়ে কাঁদো কাঁদো গলায় বলে,
-” ভোর একটুও ভুলে যায় নি তার আম্মুকে। সত্যিই বলছি! আম্মুকে কখনো ভোলা যায় না কি? হুম?”
পাতা মুচকি হেসে মাথা নেড়ে বলল,

-” যায় না?”
-” কখনো না! ইস্ট ওর ওয়েস্ট ভোরের আম্মু ইজ দা বেস্ট! আই লাভ ইয়ু আম্মু”
পাতা তার মাথার চুল এলোমেলো করে দিয়ে হাসে। ভোর উঠে দাঁড়িয়ে পাতার গালে কপালে চুমু খায়। পাতার মন খারাবির রেশ! হালকার উপর ঝাপসা অভিমান! সব উবে যায় কর্পূরের মতো।বর্ষা ভোরের মা! ভোর ভালোবাসতেই পারে। এতে কোন দোষ নেই। মোদ্দা কথাটা হলো বর্ষা তাদের জীবন থেকে অনেক দূরে! ফিরে আসার চান্স শূন্যের কোঠায়!
অরুণ আস্তে ধীরে সবটুকু খাবার খাইয়ে দেয় তিনজনকে! খাওয়া শেষে ওষুধ পত্র খাইয়ে দিয়ে সব গুছিয়ে নিয়ে নিচে যায়। আনিকা অরুণের সাথেই বেড়িয়ে আসে। ডাইনিং টেবিলে আরিয়ানকে দেখে সে বাবা কাছে যায়! অরুণ সব কিচেনে রেখে নিজেও ডাইনিং টেবিলে বসে। সুফিয়া তার প্লেটে খাবার দেয়! অরুণ আরিয়ানকে উদ্দেশ্য করে বলে,

-” রুবি অফিসে?”
-” হুম! সে তো অফিস জয়েন করে স্বামী বাচ্চা ভুলতে বসেছে!”
হাসতে হাসতে বলে আরিয়ান। প্রতিত্তরে অরুণ মুচকি হেসে খাবার মুখে নেয়।
-” ও কাজে খুবই আগ্রহী! সে যাক বিড়ালটিকে ওষুধ লাগিয়েছে কে?”
আদুরি এবার হাসিমুখে বলে,
-” আমি পশু হাসপাতালে নিয়ে গিয়েছিলাম! তাঁরাই ওষুধ লাগিয়ে দিল! টিকাও দিয়েছে!”
-” থ্যাংকস আদু!”
আদুরি মুচকি হেসে বলে,
-” মেনশন নট বিগ ব্রো!”

আরো টুকটাক কথার মাঝেই অরুণ খাওয়া দাওয়া শেষ করে বেসিনে হাত ধুয়ে নেয়।‌সবার থেকে বিদায় নিয়ে রুমে রওনা হয়। রুমে প্রবেশ করে অরুণের কপালে ভাঁজ পড়ে। কেউ নেই তো! সে ওয়াশ রুমে বেলকনিতে খোঁজে পায় না। বেলকনির সেই ছোট দরজা খুলে উঁকি দিতেই নজরে আসে দুজন! নিশ্চিন্ত মনে ঘুমুচ্ছেন তার চড়ূই জোড়া! অরুণের অধরকোনে মিষ্টি হাসির ডালপালা ছড়িয়ে পড়ে। সে কতক্ষণ তাকিয়ে দেখে। ভোর পাতার দিকে পিঠ করে পাতার একটা হাতের উপর মাথা রেখে হা শুয়ে আছে। আর পাতা হাত পা গুটিয়ে শুয়ে আছে তার শাড়ির অবস্থা যাচ্ছে তাই! অরুণ রুমে ফিরে আসে।দরজা বন্ধ করে বিছানা থেকে কম্ফোর্ট নিয়ে ও ঘরে যায়! দু’জনের গায়ে জড়িয়ে আধ খোলা পর্দা বন্ধ করে দেয়!

বাইরের আলো আর গ্লাস ভেদ করে ভিতরে প্রবেশ করতে পারে না। অরুণ ফ্লোরে পাতানো বিছানায় বসে। ঝুঁকে ছেলের কপালে চুমু দেয়। এরপর গায়ের টি শার্ট খুলে পাতার ওপাশে গিয়ে তারই বালিশে মাথা রেখে কম্ফোর্টের ভিতর গা এলিয়ে দেয়। ভোরের মাথার নিচ থেকে সন্তঃপর্নে পাতার হাতটা বের করে পাতাকে সোজা করে শুইয়ে দেয়। কপালে পরপর ছোট ছোট চুমু দিয়ে গায়ে জড়িয়ে থাকা এলোমেলো আঁচল সরিয়ে দেয়। সেথায় মুখ গুঁজে উন্মুক্ত উদরে বলিষ্ঠ হাত রাখল। পাতার হালকা ঘুম ছুটে যায় নিমিষেই! তাঁর নড়াচড়ায় অরুণ বিরক্ত হয়ে বলে,
-” পাতাবাহার ডোন্ট ডিস্টার্ব মি! ঘুমোবো আমি!”

পাতা বাহার পর্ব ৪৩(২)

পাতা নড়াচড়া থামিয়ে দেয়। কিছু পল চুপচাপ থেকে ঝটকায় অরুণকে সরিয়ে দিয়ে এপাশ ফিরে শুয়ে পড়ল।
অরুণ বালিশ বিহীন বেশ সময় শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে! তাঁর পর উঠে টি শার্ট গায়ে গলিয়ে বেড়িয়ে যায় রুম থেকে। পাতা তাকিয়ে থাকে তার প্রস্থানের দিকে। লোকটা রেগে গেলো? তার ওভাবে সরিয়ে দেয়া মোটেই ঠিক হয় নি! লোকটা কষ্ট পেয়েছে বোধহয়! পাতার ঘুম হাওয়া হয়ে যায়। মাথায় একরাশ চিন্তা ঘুরপাক খায় লোকটাকে ঘিরে।

পাতা বাহার পর্ব ৪৫