পাতা বাহার পর্ব ৪৫
বেলা শেখ
-” অরুণ মাথা ঠান্ডা কর! এভাবে উত্তেজিত হয়ে পড়লে পড়ে হিতে বিপরীত না হয়ে যায়! আমাদের কাছে কিন্তু এখনো সলিড প্রমাণ নেই!”
শুভর কথায় অরুণ যেন ক্ষেপে যায়। টেবিলের উপর রাখা কলমদানি ছুঁড়ে ফেলে ফ্লোরে। রাগে গজগজ করতে করতে হিসহিসিয়ে বলে,
-” সলিড প্রমাণের নিকুচি করেছে! একবার ওকে হাতের কাছে পাই ওর প্রত্যেকটা অঙ্গ প্রত্যঙ্গ পিস পিস করে কুকুরকে খাওয়াবো! শালা ****। ওর কত বড় কলিজা আমার কলিজার দেহ ক্ষতবিক্ষত করে!! ওর কলিজা ভুনা করে ওকেই খাইয়ে দিবো! ***!
অরুণের মুখশ্রী রাগে লাল হয়ে আছে কপালের প্রত্যেকটা শিরা উপশিরায় যেন ক্ষোভ প্রকাশ করছে। হাত মুঠো করে কাঠের টেবিলে সজোরে আঘাত করে! উপস্থিত বন্ধুরা সবাই অরুণ সরকারের রাগের সাথে পরিচিত! যেখানে অরুণ সরকারের কলিজায় আঘাত করবে আর সে চুপ করে বসে থাকবে সেটা বড্ডই বেমানান। তাদের কাছে অরুণের এমন বিহেভিয়ার ডালভাত! রাসেল গালে হাত দিয়ে বসে অরুণের দিকে তাকিয়ে আছে। একটু আগেই এসেছে তাঁরা। বাড়ির গেটের সিসিটিভি ফুটেজ! গেটের আশপাশের দোকান, বাসাবাড়ির গেইটের সিসিটিভি ফুটেজ কালেক্ট করেছে অরুণ নিজেই। বন্ধুদের নিয়ে গতকাল সহ বেশ কয়েকদিনের ফুটেজ মনোযোগ সহকারে দেখে। মাস খানিক হবে একটা কালো গাড়ি সরকার বাড়ির কিছুটা দূরে প্রায়ই দেখা যায়।
আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন
গাড়ি থেকে কিছু লোককে মাথায় ক্যাপ, চোখে কালো চশমা ও মাস্ক পড়ে বাড়ির আশেপাশে ঘুরঘুর করতে দেখা যায়! মাঝে মাঝে তাদের সাথে দুটো কুকুর দেখা যায়। তাঁদের মধ্যে একটা লোক দাড়োয়ানের সাথে অনেক আলাপ সালাপ করে। চা বিড়ি সিগারেট খায়! অরুণের চোয়াল শক্ত হয়! লোকটাকে চিনতে অরুণ ও রাসেলের বেশি অসুবিধা হয় না। এতো শুকলা মন্ডলের ছেলে! নামটা মনে নেই তাদের! গতকালের ফুটেজে অরুণ সবটা দেখে কিভাবে একটা লোক কুকুর গুলোকে ফোন বের করে ছবি দেখালো; ভিতরে প্রবেশ করালো! সব দেখে অরুণ ভয়ঙ্করভাবে রেগে যায়। ল্যাপটপ ছুঁড়ে ফেলে ফ্লোরে। সেটা ভেঙ্গে দু টুকরো হয়ে গেছে সাথে সাথেই।
রাসেল গাল থাকা হাত সরিয়ে আড়মোড়া ভেঙ্গে সোজা হয়। হামি তুলে অরুণের উদ্দেশ্যে বলে,
-” অরু কুল ম্যান। এতো হাইপার হলে হবে? একটু ঠান্ডা মাথায় ভাব! ওই শুকলা আর ওর ছেলের দ্বারা এতো কিছু ঘটানো সম্ভব? ট্রেইনড কুকুর! এতো এতো প্ল্যান আদৌ ওদের মতো ছোচা কুকুরের মাথা থেকে বেরোবে?”
শুভ , জীবন, ফয়সাল, দীপ্ত ভাবনায় পড়ে। কথা সত্য! তাহলে এসবের মাস্টার মাইন্ড কে? অরুণ লম্বা শ্বাস টেনে নিজের রাগকে নিয়ন্ত্রনে আনে। মাথা ঠান্ডা রেখে স্বাভাবিক রাশভারী গলায় বলে,
-” আরেকটা জানোয়ার পিটিয়েছিলাম না? আলম! ওর ছেলে কি যেন নাম আবাল না আকাশ! ওই এসবের মাস্টার মাইন্ড!”
রাসেল মুচকি হেসে উঠে দাঁড়ালো। অরুণের পাশে টেবিলের উপর বসে অরুণের চুল গুলো মুঠোয় ভরে টানাটানি করে বলে,
-” ঠিক ধরেছিস! আমার এক টিম আছে। সাম কাইন্ড ওফ গোয়েন্দা টাইপ! টোটালি ব্যাকডোর! আমি ওদের সাথে কথা বলে মামলাটা দেখছি! তুই আগে পাকনামি করিস না। ওরাও কম ডেঞ্জারাস না। তোর কথা বাদ দিলাম তোর পরিবারের সেফটির একটা ব্যাপার আছে না? তাই একটু চুপ থাক দুটো দিন! ওদের তোর হাতেই তুলে দিবো!”
অরুণ ভাবে! কথাটা মন্দ নয়! নিজের চুলের মুঠো থেকে রাসেলের হাত ঝটকায় সরিয়ে দিয়ে বলে,
-” ঠিকাছে।যতদিন না ওদের জামাই আদর করতে পারছি ততদিন এই অরুণ সরকার শান্তিতে বসতে পারবে না।রাসেল ওই ***** বাচ্চাদের আমার হাতে তুলে দিতে হবে। এরপর আর তোর টিম নাক গলাতে পারবেন না বলে দিলাম!”
রাসেল আরুণের পিঠ চাপড়ে হেসে বলে,
-‘ তা তো একটু গলাবেই। আইনের লোক কি না! এই খুন টুনের কথা ভাবলে ঝেড়ে ফেল!”
-” মেরে ফেলার মধ্যে কি মজা বন্ধু!
মজা তো কেটে কাটা ঘায়ে মরিচের গুঁড়া ছিটানোর মধ্যে! ব্লেড দিয়ে ভালোবেসে আঁচর দেয়ার মধ্যেই। ছুড়ি দিয়ে হাতের আঙ্গুল…”
থেমে যায় অরুণ! কেউ দরজা খুলে ভিতরে প্রবেশ করে। সুফিয়ার হাতে খাবারের ট্রে! অরুণ ধমক দিয়ে বলে,
-” নক করে ঘরে ঢোকা যায় না? হ্যাঁ?”
আরো কিছু বলবে পেছনে পাতাকে দেখে চুপ করে যায়। পাতার হাতেও ট্রে যাতে চা বিস্কিট!
পাতার আগমন! অরুণের চুপ হয়ে যাওয়া দেখে অরুণের সব বন্ধুরা মিটমাট করে হাসে। পাতা ও সুফিয়া ভিতরে প্রবেশ করে। কিন্তু ট্রে কোথায় রাখবে বুঝতে পারে না। স্টাডি রুমে গোটা কয়েক কাঠের চেয়ার একটা টেবিল।আর সব বুক সেলফ! চেয়ার টেবিল সবাই দখল করে রেখেছে। সুফিয়া একটা ফাঁকা চেয়ারে ট্রে রেখে বেড়িয়ে যায়। ধমক শুনে তার পাঁচ আত্না স্রাধ করতে বেড়িয়েছে। এই বাড়িতে আসার পর সে এই লোকটার ধমক গুনে গুনে সাতবার খেয়েছে। প্রতিবারি তার ছোট রুহ টা ধ্বক করে উঠেছে।
তাই সে পুনরায় ধমক শোনার আগে কেটে পড়ে। পাতা এবার খেয়াল করে রুমের ফ্লোরে কলমদানি পড়ে আছে; রং পেন্সিল কলম হাবিজাবি ফ্লোরে ছিটিয়ে পড়ে আছে। কর্নারের দিকে লোকটার ল্যাপটপ পড়ে আছে দুই টুকরো হয়ে! পাতার কপালে ভাঁজ পড়ে কি হয়েছে এখানে? পাতা অরুণের দিকে তাকায়। লোকটা তার দিকেই তাকিয়ে ছিল তার তাকানোয় নজর লুকিয়ে নেয় সাথে সাথেই! পাতাও নজর সরিয়ে নেবে হঠাৎ খেয়াল করে লোকটার হাতের আঙ্গুল গুলো লাল জখমের ন্যায় হয়ে আছে। পাতা উদ্বিগ্ন হয়। লোকটার কি হয়েছে? সাথে খানিক অস্বস্তিতে পড়ে। ট্রে কোথায় রাখবে? সবাই এরকম সাইলেন্ট মুডে আছে কেন?
অরুণ রাসেলকে ইশারা করে টেবিল থেকে নামতে। রাসেল অরুণের কাঁধ শক্ত করে ধরে তার কোলের উপর বসে পড়লো। পাতা ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে দেখে দুজনকে! মনে হচ্ছে কপোত কপোতী রোমান্টিক মুডে একজন আরেকজনের কোলে বসে আছে।
পাতার হাতের ট্রেতে থাকা চায়ের কেতলিই ঝন ঝন শব্দ করে নড়েচড়ে ওঠে;সাথে চায়ের কাপ। পড়ে বুঝতে পারে তার হাত কাঁপার দরুণ ওগুলো নড়ছে। কিন্তু কথা হলো পাতার হাত কাঁপছে কেন?
জীবন, ফয়সাল ও দীপ্ত হু হা করে হেসে উঠে।শুভর মুখেও চাপা হাসি! অরুণ বিরক্তিকর কন্ঠে বলে,
-” উঠ?”
রাসেল ওঠে না। অরুণের গাল জোড়া টেনে পাতাকে চোখ টিপে দেয়। পাতার হাত থেকে ট্রে পড়তে নিবে শুভ ধরে! ট্রে নিয়ে টেবিলের উপর রাখে। অরুণ আড়চোখে সবটা খেয়াল করে। জীবন গলা খাঁকারি দিয়ে বলে,
-” পিচ্চি ভাবী? এসব তো কিছুই না! আরো কতকিছু চলে দুজনের মাঝে?”
পাতা গোল গোল করে তার দিকে চায়! রাসেল অরুণের কোল থেকে উঠে এসে জীবনের পিঠে লাগায়। জীবন পিঠ ডলে বলে,
-” সত্যি কথা বলেছি আর ওমনেই ছ্যাৎ করে উঠেছে। এদের দুজনের গলায় গলায় ভাব। ভার্সিটি লাইফে কোনো কপোত যুগলও এতো চিপকাইতো না যতোটা এরা দুজন চিপকে থাকতো! ফয়সাল কথা ঠিক না?”
পাতা গোল গোল করে ফয়সালের দিকে চায়। ফয়সাল শয়তানী হেসে মাথা নেড়ে বলে,
-” ঠিক। আমাদের সময়ের আরেকটা ফেমাস জুটি অরু রাসেল!”
অরুণের মুখটা দেখার মতো হয়েছে! তবে সে চুপচাপ বসে থাকে। রাসেল দুটোকে কয়েক ঘা লাগিয়ে তবেই ক্ষান্ত হয়। পাতার দিকে তাকিয়ে বলে,
-” গ্রুপের মধ্যে আমার আর অরুণের বনতো বেশি! এরা সবাই হিংসেয় জ্বলে পুড়ে এসব বলে!”
পাতার বেশ হাসি পায়। হাসি লুকিয়ে রাখাও দায়। সে ফ্লোরে বসে রং পেন্সিল কলমদানিতে তোলে। দীপ্ত হায় হায় করে ওঠে,
-” আরে ভাবী করছেন টা কি? উঠুন! অরুণ সরকারের কুইন আপনি! যাকে বলে মহারানী! আপনাকে এসব মানায় না!”
-” আমি তুললে কি হবে ভাইয়া?”
পাতার কথায় দীপ্ত মুচকি হাসলো। পাতাও ভদ্র সুলভ হেসে ফ্লোর পরিষ্কার করে কলমদানি টেবিলে রাখে। অরুণের পাশের কর্নারে গিয়ে ল্যাপটপ তুলে অরুণের কোলে রাখে। সবাইকে চা নাস্তা নিতে বলে বেরিয়ে আসে।
পাতা বেড়িয়ে যেতেই অরুণ যেন আঁটকে রাখা শ্বাস টেনে নেয়। ফয়সাল ও জীবনের দিকে কটমট করে তাকিয়ে থাকে।হাত বাড়িয়ে বুকশেলফ থেকে বই বের করে জীবনের দিকে ঢিল ছুড়ে। জীবন ক্যাচ করে নেয়,
-” বউ বেড়িয়ে গেল অমনিই আপন রূপে ফিরে এলি! শালা গিরগিটি!”
-” আও ফাও কথা বলে মাথা খারাপ করাস না!”
সিরিয়াস গলায় বলে অরুণ। জীবন থোরাই কেয়ার করে।সে ট্রে থেকে সেমাইয়ের বাটি হাতে নিয়ে মুখে ভরে বলে,
-” তোর আদরের বউকে শান্ত শিষ্ঠই ভাবছিলাম! কিন্তু গতরাত হাসপাতালে সে তো পুরাই টাইম বোম্ব রেরোলো। ঝাঁঝ আছে ভাই!”
অরুণ বিরক্ত হয়। পাতাকে নিয়ে এভাবে কথা বলা তার মোটেও ভালো লাগে না। ফয়সাল কাপে চা ঢেলে বলে,
-” এখানে অরুণের দোষ আছে। বেচারিকে সবার সামনে কাল কিভাবে থাপ্পড় দিলো! দোষী বানালো অথচ সি’জ ইনোসেন্ট! মেয়েটা শান্ত প্রকৃতির তাই ওতটা রিয়েক্ট করে নি।”
অরুণ ঘারে হাত রেখে মাথা এদিক ওদিক করে। রাসেল কপালে ভাঁজ ফেলে বন্ধুর পক্ষ নিয়ে বলে,
-” এখানে অরুণেরও দোষ আমি খুঁজে পাই না। সবাই জানে অরুণ জান হারায় ছেলের উপর! ছেলেকে অমন অবস্থায় দেখে কারই বা মাথা ঠিক থাকে? পাতা মেয়েটা ভালো! ভোরকে অনেক ভালোবাসে স্নেহ করে অরুণ জানে। তাই তো অনুতপ্ত হয়ে স্যরিও বলেছিল! পাতার হাসপাতালে ওভাবে সবার সামনে সিনক্রিয়েট করা মোটেই ঠিক হয় নি।”
অরুণ দীর্ঘশ্বাস ফেলে রাসেলকে কিছু বলবে এর আগে শুভ কঠিন গলায় বলে,
-” তুই জীবনে অরুণের দোষ খুঁজে পাবিও না! শোন একটা মেয়ে নিজের পরিবার ছেড়ে স্বামীর হাত ধরে নতুন জীবনে পদার্পণ করে। সে শতভাগ আশায় থাকে তার ব্যাক্তিগত মানুষটা যেন সবসময় তার পাশে থাকে। তাকে বিশ্বাস করে সাথে একটু সম্মান করে। অরুণ গতকাল কি করলো? মেয়েটার সব আশা ভেঙে চুরমার করে দিল! সবার সামনে সপাটে চড় বসিয়ে দিল! চরটা পাতার গালে না সম্মানে লেগেছে। কাল রাতে পাতা সিনক্রিয়েট করলো ওটা চোখে বাজলো আর অরুণ সবার সামনে ওকে চর মারলো, ধাক্কা দিলো, গলা চড়িয়ে কথা বলল সেটা কি তবে?”
কথাগুলো চরম সত্য হলেও শুভর মুখ থেকে নিঃসৃত হওয়ায় মোটেও ভালো লাগলো না। কেন? শুভ পাতাবাহারের এক কালের ক্রাশ ছিলো তাই? কি সব ছেলেমানুষী চিন্তা ভাবনা। অরুণ আওলা ঝাওলা চিন্তা ঝেড়ে নিয়ে খিটখিটে গলায় শুভর উদ্দেশ্যে বলল,
-” সব আমার দোষ! আমি স্বীকার করছি! গলা জড়িয়ে মাফও চাইবো! হয়েছে? এই টপিক অফ যা তোরা! নাস্তা পানি খেয়ে তারাতাড়ি কেটে পড়। তোদের সহ্য হচ্ছে না একটুও!”
ফয়সাল ছোট ছোট করে অরুণের দিকে তাকিয়ে দাঁত কপাটি বের করে বলে,
-“ওটা গলা জড়িয়ে না পা জড়িয়ে হবে। আর কাজের বেলায় কাজি কাজ ফুরোলেই পাজি! বাহ্ অরু! যাবো না কি করবি? ডিনার সেরে তবেই ফিরবো!”
অরুণ বিরক্ত হয়ে তার দিকে তাকায়! বাকি সবাই হেসে ওঠে। তাদের হাসির শব্দে অরুণের বিরক্তের রেশ যেন তরতরিয়ে বেড়ে যায়। কেতলি থেকে কাপে চা ঢেলে নেয়। চা খেয়ে মাথা একটু ঠান্ডা করা যাক!
এর মাঝে আরো একজোড়া পায়ের আগমন ঘটে স্টাডি রুমে। পড়নে শুধু হাফ প্যান্ট! হাতে পায়ে অন টাইম ব্যান্ডেজ। শরীরের কিছু কিছু জায়গায় লালচে আচরের দাগ। সেখানে সাদা সাদা ক্রিম জাতীয় ওষুধ লেপ্টে আছে।হালকা গুলুমুলু ভোর সরকার একদিনের ব্যবধানেই যেন শুকিয়ে গেছে অনেকটা। ভোর একটা ছোট বাটিতে কিছু বরফ কুচি নিয়ে এগিয়ে যায় বাবার দিকে। আম্মু তাকে বরফ নিয়ে আসতে বলেছিল তাঁর আব্বুর জন্য। ভোর গাল ফুলিয়ে মানা করে সে পারবে না। আব্বুর সাথে তাঁর আড়ি! পাতা যখন বলে যে তাঁর বাবা হাতে ব্যাথা পেয়েছে! ব্যস ভোরের মুখটায় বাবার জন্য উদ্বেগ ফুটে ওঠে। ভোর আর কিছু না বলে পাতার হাত থেকে বরফের বাটি নিয়ে স্টাডি রুমের দিকে রওনা হয়।
উপস্থিত অরুণের বন্ধুরা ভোরের আগমনে খুব খুশি হয়। তবে ভোরের হাতে বরফ কুচি দেখে এখে অপরকে ইশারায় কিছু বলে মিটিমিটি হাসে। তবে মুখে কিছু বলে না আপাদত। অরুণের মুখের সকল বিরক্তের রেশ নিমিষেই গায়েব হয়ে যায় ছেলের মায়াময় মুখটা দেখে।
ভোর বাটিটা অরুণের কোলে রাখে। অরুণের কপালে ভাঁজ পড়ে। সে চায়ের কাপ রেখে ভোরকে কোলে নেয়ার জন্য উদ্যত হয়। ভোর কোলে ওঠে না। অরুণের বলিষ্ঠ হাত এপিঠ ওপিঠ করে ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করে। বা হাতের উল্টো পিঠে লাল হয়ে গেছে।ভোর হাতের মুঠোয় এক টুকরো বরফ কুচি তুলে বাবার হাতে ঘষে দেয়। অরুণের অধরকোণে হাসি ফুটে উঠলো। ছেলের হাত থেকে ঠান্ডা বরফ কুচি নিয়ে বাটিতে রেখে হাত জোড়ায় ছোট ছোট চুমুতে ভরিয়ে দেয়।
দীপ্ত বাবা ছেলের আবেগপ্রবণ মুহুর্ত দেখে মোটেও আবেগপ্রবণ হলো না। সে টিপ্পনী কেটে বলল,
-” যে বরফ এনেছে তার হাত জোড়ায় চুমুতে ভরিয়ে দিলি! আর যে সবটা খেয়াল করে বাচ্চাটাকে দিয়ে বরফ পাঠালো তাকে কি করবি?”
-” তোর না জানলেও চলবে!”
অরুণের ফটাফট জবাব। উপস্থিত সবাই ‘ওহ হো’ বলে হেসে ওঠে। জীবন লজ্জার ভান করে বলে,
-” কি আর করবে! চুমু দিতে দিতে বেচারি পাতাকে খেয়েই..”
অরুণের চোখ রাঙানোতে থেমে যায় জীবন। তবে মুখে না বললেও ইশারা ইঙ্গিতে চোখে ঠোঁটের দুষ্টু হাসিতে সব বুঝিয়ে দেয়! অরুণ তার দিকে বিরক্তিকর চাহনি নিক্ষেপ করে ছেলেকে কোলে তুলে নেয় যত্ন করে। তবে গায়ের সাথে লেপ্টে নেয় না। ছেলের গায়ে ওষুধ লাগিয়ে দিয়েছে পাতাবাহার! ভোর বাবার কোলে বসে আবার বরফ হাতের মুঠোয় নিয়ে অরুণের জখমে ঘষতে থাকে। অরুণ এবার বাঁধা দেয় না। জীবন দুঃখি দুঃখি মুখ বানিয়ে বলল,
-” ইশ কত ভালোবাসা মিয়া বিবির! আর আমারটা মেরেই কুল পায় না যত্ন নিবে কখন!”
ফয়সাল ও রাসেল হেসে ওঠে শব্দ করে। ছোট ভোর কিছু না বুঝেই হেসে দেয় তাদের সাথে। শুভ এসে ভোরের চুলগুলো এলোমেলো করে দেয়। অরুণের দিকে বিরক্তের সহিত তাকিয়ে বলে,
-” এমন যত্ন শীল সুন্দরী বউ বাচ্চা থাকতেও তোর মুখ রসকষহীন! এই কোনো সমস্যা দেখা গিয়েছে? হরমোনজনিত? বন্ধু হই তোর। শেয়ার করতেই পারিস!”
অরুণ শানিত নজরে শুভর দিকে চায়। শুভসহ সকলের মুখেই চাপা হাসি। জীবন তো চুকচুক শব্দ করে বলে,
-“বেচারি পাতার কপাল পুড়ল! অরুণ হারবাল চিকিৎসা নিতে পারিস। একেবারে ঘোড়ার তেজে..”
বাকি টুকু শেষ করে না। অরুণ চোখ বুজে নেয়। মুখটা তার অসম্ভব লাল হয়ে আছে। সে ছেলেকে নিয়ে উঠে দাঁড়ালো! স্টাডি রুমের বাইরে ছেলেকে রেখে দরজাটা আলগোছে লাগিয়ে দেয়। বন্ধু নামক শত্রুদের দিকে ফিরে দাঁত কপাটি পিষ্ট করে বলে,
-” হয়ে যাক টেস্ট?”
ভোর দরজার দিকে কাঁদো কাঁদো চোখে চেয়ে থাকে। নাক টেনে ফোপাতে থাকে। আব্বু তাকে এভাবে বের করে দিলো? সে আব্বুর উপর রেগে ছিলো। তবুও আব্বু ব্যাথা পেয়েছে শুনে বরফ কুচি এনে লাগিয়ে দিলো! আর আব্বু তাকে এভাবে বের করে দিতে পারলো? সে রাগে পা দ্বারা ফ্লোরে সজোরে আঘাত করে হনহন করে চলে যায়। সিঁড়ি বেয়ে নেমে সোজা মিনুর ঘরে চলে যায়।
মিনু ঘরে একলা বসে মিষ্টি খাচ্ছিলো। আভারি এনে দিয়েছে এক হাঁড়ি মিষ্টি। সাত মাস চলছে তাঁর। ইদানিং কিছুই খেতে পারে না। গন্ধ গন্ধ লাগে তার কাছে। হঠাৎ মিষ্টি খেতে ইচ্ছা করে খুব। আভারিকে বললে এক হাঁড়ি এনে দিয়েছে। মাত্রই মিষ্টির হাঁড়ি নিয়ে বসেছে। দুটোর মতো খেয়েছে। ভোরকে হনহন করে আসতে দেখে মিনু আত্মহারা হয়ে ওঠে। ছেলেটার উপর দিয়ে কাল কি একটা ঝড় বয়ে গেল!! ভোর চুপচাপ বিছানায় উঠে মিনুর সামনে বাবু হয়ে বসে। মিষ্টির হাঁড়ি দেখে গালটা আরেকটু ফুলিয়ে নিয়ে বলে,
-” কেউ ভালোবাসে না ভোরকে! আব্বুও না। কিভাবে বের করে দিলো আমাকে। কথা বলবো না একটুও! তুমিও ভালোবাসো না ভোরকে!”
-” আমি আবার কি করলাম ভোর বাবা?”
ভোর ফোঁস ফোঁস করে হাত বাড়িয়ে মিনুর বাড়ন্ত পেটে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে বলে,
-” তোমার বাবু আসছে! তুমি শুধু তাকেই ভালোবাসো! তাকে পেয়ে আমাকে ভুলেই গেছো! মিষ্টি এনে লুকিয়ে লুকিয়ে খাচ্ছো!”
মিনু মুচকি হেসে ভোরের মুখে মিষ্টি তুলে দেয়। ভোর পুরোটি মুখে পুরে নেয়। তার ফুলো গাল ফুলে একাকার। মিনু তাঁর কপালে চুমু দিয়ে বলে,
-” ভোর বাবারে আমি অনেক ভালোবাসি! তাকে কি কইরে ভুইলে যাবো? এই বাবুরে নিয়ে হাঁটবার পারি না। বসবার পারি না। সারাক্ষণ ঘর বন্দি থাকি! তুমিও তো একটু দেখবার আসো না এই খালারে!”
ভোর কুটুর কুটুর করে চায়। সময় নিয়ে মুখের মিষ্টি চিবিয়ে চিবিয়ে গলাধঃকরণ করে। পাশে রাখা গ্লাস থেকে ঢকঢক করে পানি খায়। মিনু তার আঁচল দিয়ে সযত্নে মুখ মুছে দেয়। ভোর পুলকিত হেসে বলে,
-” আব্বু বলেছিল তুমি অসুস্থ থাকো। তাই যেন তোমাকে বেশি করে ডিস্টার্ব না করি!”
-” তুমি আইলে আমার ভালো লাগে ভোর বাবা!
মিনুর কথায় ভোর মিষ্টি করে বলে,
-” তাহলে কিন্তু আমি বেশি বেশি আসবো! তোমার বাবুকে বলে দিও আমাকে দেখে হিংসে না করে?’
মিনু ভোরের গাল টিপে বলে সায় জানালো ! ভোর মিনুর কোলে মাথা রেখে শুয়ে পড়লো। মিনু মুচকি হেসে তার চুলের ভাঁজে হাত বুলিয়ে দিতে থাকে। ভোর এটা ওটা বলে মুহুর্তেই মহল জমিয়ে নেয়। তার গল্পের মাঝে নিরানব্বই টি অভিযোগ দায়ের করেছে বাবার নামে। ‘বাবা কেন অল্প সময়ের জন্য মায়ের সাথে নানু বাড়ি যেতে দিলো না? তাকে বোকা বানিয়ে লুকিয়ে রাখলো? আবার একেবারে মায়ের কাছে রেখে আসার কথা কেন বলবে? ভোরের কষ্ট হয় এক কথা শুনলে! সে কি মায়ের সাথে একেবারে যেতে চেয়েছে নাকি। মা অনেক দূরে চলে যাবে তাই একটু যেতে চেয়েছিল। তারপর বলে কিনা কালই বিয়ে করিয়ে বউ আনবে! ভোরের কি লজ্জা করে না? আব্বুকেই বিয়ে করতে বলিও! হুম!’ আরো কতশত অভিযোগ তাঁর। মিনু তার কথা শুনে হাসে। ভোর গাল ফুলিয়ে বলে,
-” তুমি হাসছো খালা? তুমিও ভোরকে ভালোবাসো না!”
মিনু হাসি থামিয়ে স্বাভাবিক মুখে বলে,
-” ভোর বাবা? তোমার মা’য়ের কথা আমি বলবো না। তোমার আম্মুর কথা বলি! আচ্ছা?”
ভোর পিটপিট করে চায়। মিনু বলতে শুরু করে,
-” তোমার আম্মু কিন্তু ভালো একজন মা! তোমারে কত্তো ভালোবাসে! আদর যত্ন করে। কখনো তার মুখে সামান্য বিরক্ত প্রকাশ হয় নাই। সবসময় তোমার সাথে হাসিখুশি কথা বলবে। খাইয়ে দিবে, তোমার সাথে খেলবে! তোমার পড়া পইড়ে দিবে। তোমার ছোট খাট সব ব্যাপারে তার বিশাল আগ্রহ কাজ করে। করে না?”
ভোর মাথা নাড়ল। মিনু্ তার গাল টিপে বলে,
-” তো তোমাকে সে ভালোবাসে, তোমার পাশে থাকে, তোমার যত্ন কইরবে! তোমারে বুকে আগলাইয়া রাইখবে! তোমার মায়ের অল্প একটু সময়ের আদরের জইন্যে তোমার আম্মুরে ভুইলে যাইবে? কাইল তোমারে ওই পঁচা কুকুরের হাত থাইকে বাচাইলো! সেও কত ব্যাথা পাইলো। আর তুমি কি করলা? রূপ বাবা তোমার আম্মুরে মা ডাকলে তোমার খারাপ লাগে রাইগে যাও তো তোমার আম্মুর কি তখন খারাপ লাগে নাই? হয়তো তোমারে বুঝতে দেয় নাই কিন্তু খারাপ তো তারও লাগছে ভোর বাবা।”
ভোর মুখে আঁধার নামে। অরুণ সরকারের মতো গম্ভীর গম্ভীর ভাব বিরাজ করে মুখশ্রী জুড়ে। সে কতক্ষণ চুপ করে ওভাবেই শুয়ে থাকে। তারপর আস্তে করে উঠে ঘর থেকে বেরিয়ে যায়। মিনু ডাকে,
-” ভোর বাবা রাগ কইরছো আমার কথায়? এই বাবা শোনো?”
ভোর শোনে না। থমথমে মুখে হাঁটতে থাকে এলোমেলো। ড্রয়িংরুমের দিকে গেলে আনিকা ডাকে,
-” এই ভোর আয় লুডু খেলি! আয় না?”
ভোর তাঁর কাছেও যায় না। ফ্লোরে খেলনা নিয়ে বসে থাকা রুপের কাছে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকে। রূপ উ উ শব্দ করে ভোরকে তার খেলনা দেখায় একটা একটা করে। ভোর হঠাৎ করে তাঁর পিঠে একটা চড় লাগিয়ে চলে যায়। রূপ তাঁর যাওয়ার দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থেকে ঠোঁট উল্টায়। কেঁদে দিবে তখনি আসমানী বেগম এসে কোলে নেয়। রূপের আর কাঁদা হয় না।
ভোর বাড়ির ভিতর এলোমেলো হাঁটতে হাঁটতে দেখতে পায় পাতাকে। ডায়নিং টেবিলে খাবার সাজিয়ে রাখছে। তার সঙ্গী সুফিয়া। ভোর দ্রুত পা চালিয়ে সেখানে যায়। পাতার আঁচল টেনে ধরে। পাতা নিচের দিকে তাকিয়ে ভোরকে দেখে মিষ্টি করে হাসি দিয়ে বলে,
-” কি হয়েছে ভোর সোনার?”
ভোর মাথা নাড়ে কিছু হয়নি। পাতা আবার জিজ্ঞেস করে,
-” তোমার আব্বুর হাতে বরফ ঘষে দিয়েছিলে?”
ভোর আবার মাথা নাড়ল। মুখে কিছু বলে না। পাতা তার গাল টেনে সব খাবার সাজিয়ে রাখে। ভোর পাতার আঁচল মুঠোয় পুরে পাশ ঘেঁষে দাঁড়িয়ে থাকে।
অরুণ ও তার বন্ধুরা নিচে নেমে আসে। জীবন ফয়সাল বিড়বিড় করে অরুণের গুষ্টির তুষ্টি বের করে। শালা! এক নম্বরের বজ্জাত! তার লাইফে মায়ের হাতেও এতো মার খায় নি যতোটা অরুণের হাতে খেয়েছে। শুভর মুখটার দেখার মতো! বেচারা ভদ্রলোকটাও বাদ যায় নি। সবার মধ্যে শুধু রাসেলের মুখে চাপা হাসি। তাঁরা সবাই এসে ডাইনিং টেবিল দখল করে। আরিয়ানও মেয়েকে নিয়ে বসে পড়লো। অরুণ, আসমা বেগম ও আসমানী বেগমকে ডাকে বসার জন্য। তাঁরা মানা করে বলে ‘তোমরা খেয়ে নাও আমরা পড়ে বসবো!’ আদুরি এসে ভাইয়ের পাশে বসে। ভোর এখনো পাতার আঁচলের আড়ালে লুকিয়ে আছে। আদুরি ডাকে সাঁড়া দেয় না! পাতা জিজ্ঞেস করে,
-” খাবে না? যাও তোমার বাবার সাথে বসো?”
ভোর মাথা নাড়িয়ে মানা করে। পাতা ভ্রু কুটিতে ভাঁজ ফেলে বলে,
-” আমার সাথে খাবে?”
ভোর মাথা নাড়ল খাবে। শুভ উঠে এসে ভোরকে কোলে নিতে চায়। ভোর হাত পা ছুড়তে থাকে যাবে না। অগত্যা শুভ ছেড়ে দিয়ে বলে,
-” আজ সাইলেন্ট মুডে আমাদের ভোর! শরীর খারাপ লাগছে নাকি?”
ভোর আবার পাতার আঁচল ধরে লুকায়। কারো প্রশ্নের জবাব দেয় না। অরুণ ছেলের হাত ধরলে ভোর ঝটকায় সরিয়ে দিলো। অরুণ কিছু বলবে এর আগে পাতা বলে,
-” আপনারা শুরু করুন। ভোরকে আমি খাইয়ে দিবো। ও আমার হাতে খাবে!”
সবাই খাওয়া শুরু করে। সুফিয়া অরুণকে দেখে আগেই কেটে পড়েছে এই বলে,
-” ম্যাডাম আপনার ওনারে আপনেই সামলান। বেডায় খালি ধমকায়। আমি আগে পিছে নাই!”
পাতা অরুণ পাশে দাঁড়িয়ে সব কিছুর তদারকি করে। অরুণ রুটি ছিঁড়ে ভোরের দিকে বাড়িয়ে দেয়। ভোর হা করে তবে মুখে খাবার না নিয়ে অরুণের হাতে কামড় বসিয়ে আবার লুকায়! অরুণের কপালে ভাঁজ পড়ে। ছেলের রাগ তাহলে এখনো পড়ে নি। অরুণ খাওয়ায় মনোনিবেশ করে। ফয়সাল খায় কম পাতা ও অরুণের দিকে আড়চোখে চায়। প্রতিশোধ তো সে নিয়েই ছাড়বে! তাঁর পাশে বসা জীবনকে কনুই দিয়ে কিছু ইশারা করে। জীবন হালকা গলা খাঁকারি দিয়ে বলে,
-” পিচ্চি ভাবী? ডালের বাটিটা পাস করুণ তো?”
পাতা এগিয়ে দিবে এর আগে অরুণ এগিয়ে দেয় বাটি। জীবন হাসে। চোখের ইশারায় অরুণকে কিছু বোঝায়। বন্ধুদের ইশারা বুঝতে তার সেকেন্ড সময়ও লাগে না। সে চোখে চোখে শাসায়। ফয়সাল দাঁত কপাটি বের অরে হেসে বলে,
-” আচ্ছা ভাবী আমাদের অরুণের পারফরমেন্স কেমন? ঠিক ঠাক ভাবে..”
আর বলতে পারে না। অরুণ বিষম খায় সাথে সাথেই। এরকম কয়েকপিস বন্ধু থাকলে জীবনে আর কি লাগে? পাতা গ্লাসে পানি দেয়। অরুণ ঢক ঢক করে খেয়ে নেয় সবটুকু। জীবন মিছে উদ্বেগ প্রকাশ করে বলে,
-” ভাবী পিঠ ডলে দিন ঠিক হয়ে যাবে। ইশ্ বেচারা কি হাল হয়েছে চোখ মুখের!”
অরুণ এমন ভাবে তাকালো যেন জীবন হরিণ শাবক আর সে বন্দি খাঁচার বাঘ। পাতা সত্যি সত্যিই অরুণের পিঠে হাত বুলিয়ে দেয়। অরুণের বন্ধুরা মিটমিট করে হাসে। অরুণ হতাশ হয়। তাঁর পাতাবাহারটা খুবই সরল সোজা। একদম জামাই পাগল!
ফয়সাল আবার পাতাকে জিজ্ঞেস করে
-” বললেন না ভাবী অরুণের পারফরম্যান্স কেমন? খেলতে পারে?”
পাতা বুঝতে পারে কথার মানে! লজ্জায় তার কান ভারী হয়ে আসে। পানির জগ হাতে নিয়ে সরে যায় ডায়নিং থেকে। অরুণ ভয়ঙ্কর রেগে যায়। এসব কেমন কথাবার্তা? তাও সবার সামনে? আদুরি, বাচ্চারা উপস্থিত আছে। সে শান্ত দৃষ্টি নিক্ষেপ করে ফয়সালের দিকে। ফয়সাল যেন বুঝতে পারে বন্ধুর দৃষ্টির ভাষা। সে বুঝতে পারে ব্যাপারটা বাড়াবাড়ি হয়ে গেছে। সে ইশারায় স্যরি বোঝায়।
আরিয়ান এতক্ষণ চুপচাপ সবার গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করছিল আর মেয়েকে খাইয়ে দিচ্ছিলো। তবে আর চুপ থাকে না। অরুণের দিকে তাকিয়ে বলে,
-” ভাই তোমার বন্ধুদের একটু চুপ থাকতে বলো! তাদের কি একটুও সোদবোধ নেই? বাচ্চারা আছে এখানে তোমার বুড়ো বন্ধুদের কি নজরে পড়ে না?”
ফয়সালও যেন খানিকটা লজ্জায় পড়ে। কনুই দিয়ে জীবনের পেটে গুঁতো মারল। যার অর্থ এই পরিস্থিতি সামলা? জীবন হাত বাড়িয়ে রুটি নেয় দু’টো! আরিয়ানকে উদ্দেশ্য করে বলে,
-” শালার ঘরের সম্বন্ধি তুই চুপ থাক! নেই সোদবোধ তোর আছে তুই ফুট! আর বুড়ো বলে কি প্রমান করতে চাস টা কি? হুম?”
আরিয়ান মুচকি হাসে। ভাইয়ের বন্ধুদের সাথে তাঁর সম্পর্ক একটু ভিন্ন টাইপের।
-” এটাই প্রমাণ করতে চাই যে তোমরা বুড়ো হয়ে যাচ্ছো জীবন ভাই! এখন তো একটু শুধরে যাও? আর ক’দিনই বা বাঁচবে!”
জীবন ক্ষেপে যায়,
-” তুই বুড়ো তোর শশুর বুড়ো! এখনো হাজার মেয়ে হোয়াটসঅ্যাপে মেসেজে প্রেম নিবেদন করে। রাস্তায় বেরোলে মেয়েরা চোখ দিয়েই গিলে খায়! আর তুই বলছিস বুড়ো হয়ে যাচ্ছি?”
আরিয়ান মজা পায় বেশ। সে চেয়ারে গা এলিয়ে বলে,
-” প্রেম নিবেদনের কথা ভাবীকে জানাবো?”
জীবন থেমে যায়। আমতা আমতা করে বলে,
-” তোর ভাবীকে আমি ভয় পাই নাকি? সে আমার কথায় উঠবস করে।”
-” তাই না?”
জীবন অসহায় বনে যায়। বউ জানলে তো তার বনবাস কনফার্ম! ফয়সাল এবার মুখ খোলে,
-” আরু? তোর সাহস তো কম না? আমাদের বন্ধুকে ভয় দেখাস?”
আদুরি তার ভাই ও ভাইয়ের বন্ধুদের খুনসুটি এনজয় করছে। তার ভালো লাগে যখন সবাই মিলে এরকম টক ঝাল মিষ্টি টাইপ ঝগড়া করে। এবার সে হেসে সবার উদ্দেশ্যে ভাব নিয়ে বলল,
-” আল্লাহর গজব পড়বে তোমাদের উপর; যা শুরু করে দিয়েছো তোমরা!”
হঠাৎ আদুরির কথায় সকলের নজরে আদুরি আসে। পিটপিট করে তাকিয়ে সবাই সমস্বরে হেসে ওঠে। আদুরিও যোগ দেয় তাদের সাথে। সকলের খুনসুটির ঝগড়ায় ডায়নিং টেবিল যেন ডিবেটিং ক্লাব বনে যায়। তবে সবার মাঝে অরুণ চুপচাপ খেয়ে চলেছে। যেখানে সবার মুখেই হাসি লেপ্টে সেখানে তার গোমড়া মুখ। অরুণ খাওয়া শেষ করে বেসিনে যায় হাত ধুয়ে সোফায় বসে। রুবির কোল থেকে রূপকে নিয়ে আদর করে। রুবির সাথে অফিসের বিষয়ে টুকটাক কথা বলে। তার বন্ধুদের খাওয়া শেষ হলে বন্ধুদের এগিয়ে দিতে যায়। গেট অবধি গিয়ে ফয়সালকে উদ্দেশ্য করে বলে,
-” সব কিছুরই একটা লিমিট থাকে। তুই আমাকে নিয়ে আনলিমিটেড মজা উড়াবি ইটস ওকে বাট আমার পাতাবাহার! ইটস নট ওকে! সাবধান।”
ফয়সাল হেসে অরুণের পিঠ চাপড়ে বলে,
-” হয়েছে আর ফুটেজ খেতে হবে না। আমি বুঝতে পেরেছি সবার সামনে ওরকম বলা মোটেও উচিত হয় নি। স্লিপ ওফ টাঙ ইয়ার!”
অরুণ কিছু বলে না চুপচাপ থাকে। ওর বন্ধুরা গাড়িতে উঠে বসে। রাসেল গাড়ি এনেছে আজ সেই সকলের সারথি! তাঁরা গাড়িতে উঠে বসে; গাড়ি স্টার্ট করে এমন সময় ফয়সাল গ্লাস খুলে সিরিয়াস মুখে বলে,
-” ভাই আমার মনে হচ্ছে ভাবী তোর পারফরমেন্সে খুশি না!”
জীবন তার পাশ থেকে মাথা বের করে গলা উঁচিয়ে বলে,
-” আই ওলসো এগরি উইথ হিম! দেখলি না তোর পাতাবাহার কেমন দুঃখি দুঃখি ফেস বানিয়ে চলে গেলো!”
অরুণ পায়ের স্লিপার খুলে ঢিল ছুড়ে গাড়িতে। সঠিক সময়ে গ্লাস লাগানোর দরুণ কারো লাগে না। তবে উচ্চ স্বরে হাসির আওয়াজ শোনা যায়। শুভ ফ্রন্ট সিট থেকে অল্প একটু গ্লাস নামিয়ে নিয়ে বলে,
-” অরুণ? চিন্তা করিস না। আমি কালই তোর জন্য কলিকাতা হারবাল অর্ডার করবো। আর নয় হতাশা আর নয় দুরাশা..”
আর শোনা যায় না। গাড়ি চলতে শুরু করেছে। অরুণ ক্ষেপে যায়। পায়ে থাকা আরেকটা স্লিপার তুলে গাড়ির উদ্দেশ্যে ঢিল ছুড়ে। শালাদের একবার হাতের কাছে পাক! পুরো ওয়ানডে ম্যাচ দেখিয়ে দেবে!
জোৎস্নার আলোয় আলোকিত ধরনী। হেমন্ত কালের স্বচ্ছতায় ঘেরা আকাশে শশীধর পূর্ন যৌবনে পা দিয়েছে। তার জোৎস্নার মধুর ম্লান আলো বেশ উপভোগ্য। হেমন্তের ঠান্ডা ঠান্ডা ভাব! এরকম রোমাঞ্চকর মুহূর্তে জোৎস্না বিলাস কপোত কপোতীর রোম খাড়া করে দেয়ার জন্য মুখিয়ে। রাত বারোটা পেরিয়ে গেছে। এখনো ঘুম নেই ভোরের চোখে। ঠান্ডা ঠান্ডা পরিবেশে কম্ফোর্টের ভেতর ঢুকে গল্পে মেতেছে। সঙ্গী পাতা ও পাতাবাহার। পাতাবাহার সোফায় বসে আছে চুপটি করে। আর পাতা ভোর বিছানায় শুয়ে আছে। ভোর গল্প করছে পাতা পিটপিট করে তাকিয়ে শুনছে। কখনো ভোরকে উৎসাহ দেয়ার জন্য হু হা বলছে।
অরুণ সরকারের এখনো রুমে আগমন ঘটে নি। পাতা কয়েকবার উঁকি দিয়ে দেখে এসেছে। লোকটা স্টাডি রুমে হাবিজাবি কিসব করছে। মুখটা নিত্য সময়ের মতো গোমড়া মুখো! পাতা মনে মনে ভেংচি কেটে বিড়বিড় করে ‘নাক উঁচু ম্যানারলেস অসভ্য ঘারত্যাড়া লোক’! সে রেগে আছে লোকটার উপর অথচ লোকটার কোনো ভাবান্তর নেই? কোথায় তাড়াতাড়ি ঘরে এসে ছেলেকে ঘুম পাড়িয়ে বউয়ের রাগ ভাঙাবি! একটু আহ্লাদ করে সোনা মোনা জানটুস ডাকবি! কান ধরে উঠবস করে স্যরি বলবি। তা’না লোকটা চশমা পরে স্টাডি রুমে স্টাডি করতে ব্যস্ত। শালার জামাই! পাতার কপালটাই ফুটা! পাতা ঠোঁট উল্টায়। কালই সে স্কুল থেকে ওবাড়ি চলে যাবে। সাথে ভোরকেও নিয়ে যাবে।
তখন বুঝবে মজা! পাতা উদাসীন হয়ে ভোরের কথা শুনতে থাকে। কিছু সময় আগেও ভোর সাইলেন্ট মুডে ছিল! একদম বাবার মতো! যা বলবে শুধু মাথা নাড়বে। পাতা জিজ্ঞেস করে কি হয়েছে? সে না বোধক মাথা নেড়ে বোঝায় কিছু না। শেষে পাতা ভাবে মায়ের সাথে যেতে পারে নি তাই মন খারাপ! ভাবতেই তার মনটাও খারাপ হয়ে যায়। তবুও হাসি মুখে ভোরকে মজার মজার গল্প শোনায়! ফানি গল্প! ব্যস ভোর হেসে কুটিকুটি। সাথে চড়ুইয়ের বুলিও ফুটেছে। হঠাৎ দরজা খোলার শব্দে ভোর পাতা দরজার দিকে তাকালো। বাবাকে দেখে ভোর কম্ফোর্ট মাথা অবধি ঢেকে নিলো। সাথে পাতাকেও ঢেকে দিলো!
অরুণ দরজা বন্ধ করে বুকে হাত গুটিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে কতক্ষণ। দৃষ্টি বিছানায় ঢাকা দুই চড়ুইয়ের ঢাকা দেহখানে নিবদ্ধ।
-” পচে গেছি তো আমি! আমার সাথে কথা বললে ঘোর পাপ হবে তাই না? না বললে কথা ! আমার কি? অরুণ সরকার একাই থাকতে শিখেছে!”
বলে হনহন করে ওয়াশ রুমে চলে যায়। ভোর উঁকি দিয়ে বাবাকে না দেখতে পেয়ে বিজয়ী হাসে। পাতার কপাল কুঞ্চিত! লোকটার শেষের কথাটা কেমন শোনালো যেন! একটু পরে অরুণ বেরিয়ে আসে। শার্টের বোতাম একে একে খুলে ছুড়ে ফেলে। কোথায় পড়ে সেদিকে খেয়াল নেই। পাতাবাহার অবশ্য খেয়াল করে। সুস্থ থাকলে সে দৌড়ে যেতো নখ দিয়ে শার্ট টেনে আনতে। অরুণ বিছানায় ওঠে। পাতার পাশ থেকে কম্ফোর্ট টেনে ভিতরে ঢুকে গেলো। পাতার পাশ ঘেঁষে কাত হয়ে শোয়। কনুই বালিশে ঠেকিয়ে হাতের উপর মাথা রেখে উঁচু হয়। পাতা খানিক সময় পিটপিট করে তাকালো তার দিকে। অরুণের চোখে চোখ পড়তেই সে ভোরের দিকে কাত হয়ে শুয়ে পড়বে অরুণ কাঁধ ধরে চিৎ করে শুইয়ে দেয়। এক পা তুলে দিয়ে আটকে নেয় পাতাকে। পাতা গোল গোল করে চায়। সাথে ভোরও। অরুণ তাদের দৃষ্টি উপেক্ষা করে রাশভারী গলায় ধীমে সুরে বলে,
-” আমার বিপক্ষে দল ঘোষণা করা হয়েছে! ওকে আমি কালকেই পুত্রবধূকে নিয়ে আসবো। ভোর? বি প্রিপেয়ারড! বিয়ে কালকেই পড়িয়ে দেবো! ”
ভোর উঠে বসে। ফোঁস ফোঁস করে তাকায় বাবার দিকে। তার ফুলো গাল দুটো কাঁপছে নাকের পাটা ফুলে উঠেছে বারংবার। অরুণ কিছু বলার উদ্যোগ নেয় কিন্তু বলতে পারে না। ভোর কম্বল সরিয়ে অরুণের উন্মুক্ত বুকে উঁকি দেয়া কালো লোম টেনে ধরে। পাতা চোখ বড় বড় করে তাকায়। ভোরের হাত ধরে ছাড়ানোর চেষ্টা করে। ভোর ছাড়ে না। পাতা চেষ্টা অব্যাহত রেখে অরুণের দিকে তাকায়। আশ্চর্য! লোকটা কি ব্যাথা পাচ্ছে না? চোখে মুখে ব্যাথা পাওয়ার কোনো ছাপ ঠাহর করতে পারলো না।
তবে পাতার ব্যাথা হয়। তার চুলে অল্প টান পড়লেই ব্যাথায় চিল্লিয়ে ওঠে অথচ লোকটা ব্যাথা পাচ্ছে নিশ্চিন্ত; কিন্তু প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করছে না। এ কেমন রোবট মানব? পাতা শান্ত গলায় ‘ভোর’ বলে ডাকে! ভোর ছেড়ে দিয়ে শুয়ে পড়ল কম্বল মুড়িয়ে। পাতা আড়চোখে নির্লিপ্ত অরুণের দিকে তাকিয়ে নিজেও এপাশ ফিরে ভোরকে এক হাতে জড়িয়ে শুয়ে পড়ে। অনুভব করে একটা বলিষ্ঠ হাত আলগোছে তাঁর কোমড় ছুঁয়ে দিচ্ছে। পাতা ঝট করে এদিকে ফিরে। সাথে সাথেই আক্রমণের স্বীকার হয়। অরুণ আবারো ঠোঁট দাবিয়ে চুমু দেয় রক্তিম গালে। পাতা নিজেকে ধাতস্থ করে ঝুঁকে আসা অরুণকে সরাতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে।
অরুণ হাত বাড়িয়ে ভোরের গলায় কাতুকুতু দেয়। ভোর ছটফটিয়ে উঠে এপাশ ফিরে। অরুণ নিরাপদ দূরত্বে সরে গিয়ে ভোরকে কাতুকুতু দেয় একনাগাড়ে। ভোর ছটফট করে আর খিলখিলিয়ে হেসে ওঠে। অরুণের হাত সরিয়ে দিতে চায় কিন্তু পারে না। পাতা ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে দেখছে বাবা ছেলের কান্ড। অরুণ ছেলের কাতুকুতুর ডোজ বাড়িয়ে দিয়ে তাঁর অলক্ষ্যে পাতার গালে আবার চুমু দেয়। থুতনিতে গাল ঘষে। পাতা কেঁপে কেঁপে ওঠে সাথে বিরক্তও হয়। অরুণ থামে না তার কার্যক্রম চালিয়ে যায়। ভোর হাসতে হাসতে হাঁপিয়ে ওঠে। পাতা বিরক্ত হয়ে অরুণের বলিষ্ঠ হাত ঠেলে বলে,
-” কি হচ্ছে টা কি ভোরের বাবা?”
অরুণ থামিয়ে দেয় কাতুকুতু দেয়া। ভোর আস্তে আস্তে স্বাভাবিক হয়ে আসে। তবে তার হাসি থামে নি। অরুণ ছেলের পিঠে হাত বুলিয়ে দেয়। মাথার এলোমেলো চুল ঠিক করে দেয়। পাতার দিকে তাকিয়ে বিজয়ী হাসে। অবশেষে মহারানীর কথা ফুটলো।
-“কি হয়েছে ভোর? তোমার আম্মু এতো রেগে যাচ্ছে কেন?”
পাতা কটমট করে চায়। অরুণ ছেলের চোখে মুখে হাত রেখে পাতার অধরে অধর ছুঁয়ে দেয় আলতো ভাবে। পাতা অরুণের কাঁধ ঠেলে সরিয়ে দেয়। দাঁতে দাঁত পিষে বলে,
-” ভোর? মাঝখানে এসো! রাত অনেক হয়েছে ঘুমোও!”
অরুণ ভোরের চোখ মুখ থেকে হাত সরিয়ে দেয়। ভোর নাক মুখ কুঁচকে অরুণের দিকে তাকিয়ে বলে,
-” ভোর আব্বুর পাশে ঘুমাবে না। আব্বুর সাথে কথাও বলবে না!”
অরুণ তৎক্ষণাৎ পাতাকে ডিঙিয়ে ভোরের গালে মুখে চুমু দেয় বেশ কয়েকটি। পাতার মনে হয় দম বন্ধ হয়ে যাবে যাবে ভাব! এই ক্ষ্যাপা ষাঁড় তাকে পিষ্ট করে চ্যাপ্টা বানিয়ে দিবে। অরুণ ছেলের কপালে ছোট ছোট দুটো চুমু দিয়ে সরে আসে।
-” ভোরের বাবাও ভোরের পাশে ঘুমাবে না।”
ভোর মিটমিট করে হাসে। অরুণ তাকাতেই চোখ বুজে ওপাশে ফিরে শুয়ে পড়ে।পাতা পড়ে বিপাকে। অসভ্য লোকটা পা দিয়ে তার পায়ে সুরসুরি দিচ্ছে। পাতার থামিয়ে রাখা হাসি ঠিকরে বেড়িয়ে আসতে চায়। অনেক কষ্টে হাসি লুকিয়ে অরুণের দিকে রাগি চোখে চায়। অরুণ পাতার টপসের ভিতরে হাত গলিয়ে দেয়। পাতা রেগে বলে,
-” নাক উঁচু ম্যানারলেস অসভ্য বর্বর লোক!”
অরুণের অধরকোণে হাসি ফুটে উঠলো। ঝুঁকে পাতার কানে অধর নিয়ে ফিসফিসিয়ে কিছু বলে। পাতার কপোল জোড়ে লালিমায় ছেয়ে যায়। অধরকোণে হাসি প্রস্ফুটিত হয়।অরুণকে ঠেলে সরিয়ে দেয়। অরুণ হাসতে হাসতেই সরে যায়।পাতা ভোরের দিকে মুখ করে শুয়ে পড়ে। সময় যায় টিক টিক টিক। ঘরের আলো নিভে ড্রিম লাইট জ্বলে ওঠে।পাতার চোখে ঘুম নামে না। এদিকে ভোর ঘুমে কাত! পাতার মনটা আনচান করে। লোকটাও কি ঘুমিয়েছে?সে ভোরের গায়ে হাত বুলিয়ে এপাশ ফিরে। ফিরেই যেন ভুল করে। লোকটা ঘুমায় নি। কাত হয়ে এদিকে ফিরেই চেয়ে আছে জ্বল জ্বল চোখে। ড্রিম লাইটের আলোয় নয়নে নয়নে মিলন হয়! পাতা সোজা হয়ে শুয়ে থাকে।
মনের পড়ে গতকাল দুপুরে সবার সম্মুখে চড় খাওয়ার দৃশ্য! সাথে তাকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেয়ার দৃশ্যটিও! পাতার চোখ ভিজে যায়। সেই মুহূর্তে পাতার মনের অবস্থাটা কেমন হয়েছিল পাতা নিজেও বলতে পারবে না। কেমন দম বদ্ধকর মুহূর্ত। মনে হচ্ছিল সে মরে যাবে। একটা সুখের সংসারের স্বপ্ন দেখছিল সেটা বোধহয় সম্ভব নয়। ভয় হয়েছিল লোকটা বোধহয় তাকে দূরে ঠেলে দিবে। পাতার কার্নিশ বেয়ে জল গড়িয়ে পড়ে। নাক ভরে যায় নিমিষে।পাতা নাক টানে। সে কেন লোকটার উপর রেগে থাকতে পারে না? তার কি সত্যিই আত্মসম্মানবোধ নেই? নেই বোধহয়! সে লোকটাকে ভালোবাসে। ভয়ঙ্কর ভাবে।
পাতা খুব কম লোকের কাছ থেকেই ভালোবাসা, আদর, যত্ন পেয়েছে। তাদের মধ্যে নিঃসন্দেহে অরুণ সরকার উপরে অবস্থান করছে। লোকটার মত কেউ কখনোই তার যত্ন করেনি। পাতার মনে পড়ে না বুঝ হওয়ার পর কেউ কখনো তাকে খাইয়ে দিয়েছিল কি না! কেউ যত্ন করে ভেজা চুল মুছে দেয় নি। কেউ এতটা ভালোবেসে কেউ কখনো মাথায় হাত বুলিয়ে ঘুম পাড়ায় নি। অথচ লোকটা দিনে একবার হলেও নিজের হাতে তুলে যত্ন সহকারে খাইয়ে দিবে। ছোট খাট সব বিষয়ে যত্ন নেবে ;তার সর্বোচ্চ খেয়াল করবে। ক্ষুধা পেটে ঘুম হয় না তাঁর। উশখুশ করে। লোকটা রাত বিরেতে রান্না করে খাওয়াবে।কিভাবে যেন বুঝতে পারে তার সব অসুবিধা! অথচ কাল সকলের সম্মুখে চর দিলো! পাতা খুব কষ্ট পেয়েছিল! কাল রাতেও ভেবেছিল কথা বলবে না লোকটার সাথে। অথচ রাত গড়িয়ে দিন হতেই পাতা গলে যায় আইসক্রিমের মতো। এখন লোকটার প্রতি রাগ আসে না সে কি করবে?
-” পাতাবাহার?”
অরুণের ডাকে ঘার ঘুরিয়ে চায় পাতা। চোখের পানি মুছে নিয়ে নাক টানে। অরুণ হাতরিয়ে টিস্যু বক্স খোঁজে। তার বিছানায় এটা আবশ্যকীয় একটা বস্তু। ছিঁচকাদুনে মানুষের বসবাস কি না? অরুণ টিস্যু পেপার দিয়ে পাতার গাল মুখ মুছে নাকটাও মুছে দেয়। অন্ধকারে টিস্যু ছুঁড়ে ফেলে বিড়বিড় করে ছিঁচকাদুনে বলে। পাতা আড়চোখে চাইলে অরুণ মুচকি হেসে বলল,
-” তোমার বুকটায় একটু মাথা রাখি?”
পাতা যেন একটু ঝটকা খেলো। বাহ্ এ তো সাধু পুরুষ। একটু আগে জোড় জবরদস্তি চুমু খেলো এখন অনুমতি চেয়ে কি প্রমাণ করতে চাইছে? পাতা গাল ফুলিয়ে অন্যদিকে তাকিয়ে থাকে। অরুণ নীরবতাকে সম্মতির লক্ষণ ভেবে এগিয়ে যায়। পাতার ছোট বুকে মাথা রেখে পিঠ গলিয়ে হাত রেখে নিবিড়ভাবে জড়িয়ে নেয়। পাতা কেঁপে উঠলো। অরুণ বুক ভরে শ্বাস টানে। কোনো কথা হয় না। দুজনেই চুপ থেকে একে অপরকে বোঝার খেলায় মেতে ওঠে। সময় গড়ায়। অরুণ আবার আবদার করে,
-” মাথায় একটু হাত বুলিয়ে দেবে পাতাবাহার? আব্বু বাদে কে কবে ভালোবেসে মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়েছিল মনে নেই!”
আবেগি পাতার বুকটা ধ্বক করে ওঠে অরুণের কথা শুনে। সময় ব্যয় না করে হাত গলিয়ে দেয় চুলের ভাঁজে। যত্ন, ভালোবাসা ঢেলে বুলিয়ে দেয়! আস্তে ধীরে টেনে দেয়। অরুণ আরাম পেল বোধকরি। পাতার বুকে মুখ গুঁজে অস্পষ্ট গোঙায়! ফিসফিসিয়ে বলে,
-” পাতাবাহার তুমি অনেক ভালো একটা মেয়ে।”
পাতার হাত থেমে যায়। অরুণ তার বুকে নাক মুখ ঘষে। যার অর্থ হয়তোবা এই যে, হাত বুলিয়ে দাও! পাতা হাত চালিয়ে থমথমে গলায় বলে,
-” ভালো? হয়তো! তাই সবাই নিজ স্বার্থে ব্যবহার করে; পড়ে ছুঁড়ে ফেলে। প্রয়োজনে পাতা; প্রয়োজন ফুরোলেই আগাছা!”
অরুণ মাথা তুলে পাতার মুখোমুখি হয়। গালে অধর ছুঁয়ে রেখে বলে,
-” সবার কথা বলতে পারবো না। আমার কথা বলি? আমি আগেই বলেছিলাম আমি লোকটা খুব খারাপ। লোকের সাথে মিশতে পারি না।সৌজন্য মূলক কথা বলতে পারি না। সামাজিকতা জানি না। শেখাই নি কেউ! থাক সেসব কথা! কাল হুঁশ ছিল না আমার। ভোরের ওমন অবস্থা দেখে পাগল হয়ে গিয়েছিলাম। বুকের ভিতর কেউ ছুড়ি দিয়ে খোঁচাচ্ছিলো! আমি কাজটা মোটেও ঠিক করি নি। স্যরি বললে মোটেও সেই ঘায়ে মলেরম প্রলেপ পড়বে না। তবুও আই’ম স্যরি পাতাবাহার! আই প্রমিজড ইয়ু আর কখনো হবে না। আর ব্যবহার করেছি তোমায়? নিজ স্বার্থে? ভালোবাসি নি?”
পাতা নিরুত্তর। কি বলবে সে? অরুণ পর পর চুমু দেয়। এই গালেই তো মেরেছিল বোধহয়! নাহ্ ওই গালে! অরুণ অপর গালেও ছোট ছোট চুমু দেয়।
-” কষ্ট দিয়েছি তাই না? শতগুন আদর ভালোবাসা দিয়ে পুষিয়ে দিবো!”
পাতার অধরকোণে এবার হাসি ফুটে ওঠে।অরুণ অঢেল ভালোবাসা ঢেলে পাতার হৃষ্টপুষ্ট অধরে অধর বসিয়ে চুমু খায়। পাতার চোখ বন্ধ হয়ে যায়। অরুণ বেশি সময় নেয় না। সরে এসে পাতার বুকে মাথা রেখে বলে,
-” মানিয়ে নিতে হবে না তোমার। আমিই মানিয়ে নিবো। কখনো আমার উপর খুব রেগে গেলে অভিমান করো! চুপ থেকো! চিল্লিও! শুধু কখনো ছেড়ে যেও না। আর ভোরের সকালের আচরণে কষ্ট পেও না। ও অবুঝ! বুঝলে..”
-” ওটা আমার আর আমার ছেলের ব্যাপার! আমরা বুঝে নিবো। আপনার বোচা নাক ঢুকাতে হবে না!”
অরুণকে বলতে না দিয়ে পাতা বলে ওঠে। অরুণ হাসে না এবার। আবার মাথা তুলে মুখোমুখি হয়। পাতার নাকে দাঁত বসিয়ে গম্ভীর মুখে বলে,
-” আমি বোচা?”
পাতা কথা বলে না। এই না ঠিক ছিলো? হঠাৎ মুড সুয়িং? গিরগিটি কোথাকার! অরুণ পাতার কপালে চুমু দিয়ে বলে,
-” এখনো রাগ আছে? অভিমান? হুম? পাতাবাহার? আমি জানি তুমি জামাই পাগলী! আর তোমার আদরের জামাইকে খুব ভালোবাসো!”
পাতা গাল ফুলিয়ে অন্যদিকে তাকিয়ে অভিযোগের গলায় বলে,
-” জামাই তো আর ভালোবাসে না!”
অরুণ তার গালে দাঁত বসিয়ে দিল। পাতা নাকের পাটা ফুলে ওঠে। অরুণ পাতার কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে খুবই ক্ষীণ আওয়াজে গম্ভীর গলায় বলে,
-” ভোরের আম্মু? ভোরের বাবা আপনাকে একটু আকটু ভালোবাসে!”
বলেই পাতার উপর থেকে সরে আসে। পাতা সন্দেহ নজরে তাকায়। কুঞ্চিত কপালে বলে,
-” সত্যিই? নাকি মিছে মিছে!”
অরুণ বালিশে মাথা রেখে বলে,
-” মিছে মিছে!”
পাতা হেসে অরুণের গলা জড়িয়ে ধরে!
-” একটু আকটু কতটুকু?”
-” এক বুক!”
পাতা বাহার পর্ব ৪৪
যথেষ্ট পাতার জন্য। সে অরুণের বুকে মুখ গুঁজে শ্বাস টেনে নেয়। তার পরিচিত প্রিয় নেশালো ঘ্রাণ! অরুণ বাহুতে বেঁধে নেয় তার পাতাবাহারকে! পাতা অরুণের পিঠে হাত গলিয়ে গায়ে পা তুলে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে। বুকে নাক মুখ ঘষে ছোট্ট করে চুমু দেয় যেন বুঝতে না পারে। অরুণ বুঝতে পারে। পাতাকে বুকের সাথে আরেকটু শক্ত করে চেপে ধরে। চুলের রেবন খুলে দিয়ে চুলের ভাঁজে হাত গলিয়ে দেয়।