পাতা বাহার পর্ব ৪৮
বেলা শেখ
থমথমে অবস্থা বিরাজ করছে পুরো রুম জুড়ে;নিস্তব্ধ। পাতাবাহার চুপটি করে সোফায় বসে। ভোর গম্ভীর মুখে পাতার আঁচল ধরে দাঁড়িয়ে আছে। দৃষ্টি তার বাবার মুখাবয়বে। পাতাও অরুণের দিকে তাকিয়ে আছে। লোকটা দরজা বন্ধ করে সেই যে বিছানায় বসেছে। একটা কথাও বলে নি। শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। অরুণের লাল চোখের ভেজা পাপড়ি দেখে পাতার সমস্ত রাগ উবে গেছে। ওভাবে ভোরকে মারায় সে অনেক রেগে ছিলো। কিন্তু তার লাল ক্রন্দনরত মুখটা দেখে পাতার মন খারাপ হয়। অতি আদরের ছেলেকে মেরে নিশ্চয়ই লোকটা মুছড়ে পড়েছে। লোকটার মনের অবস্থাটা খুবই নাজুক। আজ তাঁর মায়ের মৃত্যুবার্ষিকী। তার উপর আজকের এই ঘটনা! পাতা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ভোরের দিকে তাকায়। ভোরও চায় গাল ফুলিয়ে। পাতা ইশারায় কিছু বলে! ভোর ছোট করে মাথা নেড়ে ডাকে,
-” আব্বু?”
-” আব্বু ডাকবে না। আমি কারো আব্বু নই!”
শক্ত গলায় বলে অরুণ সরকার। ভোরও কম না। সেও শক্ত গলায় বলে,
-” একশবার ডাকবো আব্বু! আমার আব্বুকে আমি আব্বু ডাকবে না তো কে ডাকবে!”
অরুণ তেড়ে আসে। ভোর পাতার পেছনে লুকিয়ে পড়ে।
-” লুকাচ্ছো কেন? সাহস থাকে বের হও! অনেক সহ্য করেছি আমি। যাস্ট পাগল হয়ে যাবো আমি! দু চোখ যেদিকে যায় পালিয়ে যাবো!”
পাতার পিছনে ভোরকে ধরার চেষ্টা করে আর শক্ত গলায় বলে অরুণ। ভোর ধরা না দিয়ে গাল ফুলিয়ে বলে,
-” আমি আম্মু তোমার পিছু পিছু যাবো!”
অরুণ তার মন ভোলানো কথায় মোটেই ভুললো না। ভোরের বাহু ধরে সরিয়ে এনে শক্ত গলায় বলে,
-” মেরেছো কেন রূপকে? ভাই হয় না তোমার? বাচ্চা ছেলে একটুও মায়া হয় নি?”
-” না!”
আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন
জিদ্দি গলায় বলে ভোর অরুণ মারতে নিয়ে মারে না। পাতা অরুণের হাত থেকে ভোরকে ছাড়িয়ে নিতে চায় কিন্তু শক্ত বাঁধন থেকে মুক্ত করতে পারে না। অরুণ ভোরের চোয়াল শক্ত করে ধরে বলে,
-” বেয়াদব ছেলে! এতো জেদ, রাগ আসে কোথা থেকে শুনি? মা ডেকেছে তো কি হয়েছে! ডাকতেই পারে। এখুনি রূপ ও রুবির কাছে গিয়ে কান ধরে স্যরি বলবে! নইলে পিঠের চামড়া তুলে নিবো!”
ভোর বাবার দিকে সরাসরি তাকায়। চোখে তার পানি টলটল করছে কিন্তু গড়িয়ে পড়তে পারছে না।
-” বলবো না স্যরি! কেন বলবো? আমি ওকে কতবার বারণ করেছি ও কেন আম্মুকে মা ডাকবে? আমি ওর মাকে মা ডাকি? ওর মায়ের আদর নিই? তাহলে ও কেন নিবে?”
অরুণ ছেড়ে দেয় ভোরকে। বিছানায় রাখা ব্যাগটা থেকে একটা প্যাকেট বের করে। শত মলিনতার মাঝেও ছেলের আবদার করা রিমোট কন্ট্রোল হেলিকপ্টার এনেছিল। সে প্যাকেট থেকে বের করে ফ্লোরে আছড়ে ফেলে। সেটা ভেঙ্গে কয়েক টুকরো হয়ে যায়। পাতাবাহার লাফ দিয়ে এসে ভাঙ্গা খেলনার টুকরো গুলো নড়াচড়া করে মিও মিও করে ডাকে। পাতা ভোরকে আবার নিজের সাথে জড়িয়ে নিল। ক্ষ্যাপা ষাঁড় না আবার হামলে পড়ে বাচ্চাটার উপর! সে নমনীয় গলায় বলে,
-” ভোরের বাবা শান্ত হন! বাচ্চা ছেলে। বুঝিয়ে বললে বুঝতে পারবে!”
-” না বুঝবে না। ও তো ওর বাপের মতোই মেন্টালি সিক! সাইকো!”
পাতা অসহায় চোখে চায়। অরুণ আলমারি খুলে কাপড়চোপড় ছুঁড়ে ফেলে ফ্লোরে। বিড়াল শাবকটি তার পায়ের কাছে গিয়ে মিও মিও করে ডাকে। হয়তো বকছে! অরুণ ওয়াশ রুমে গিয়ে ধরাম করে দরজা লাগায়। সেই শব্দে ভোর পাতা চমকে ওঠে। পাতা ভোরকে বিছানায় বসিয়ে দিয়ে ছোট মুখটা আঁজলায় ভরে। লাল টুকটুকে গালটায় আস্তে চুমু দেয়। ভোর নাক মুখ কুঁচকে নেয় ব্যাথায়। পাতা টি শার্ট খুলে দেয়। ফর্সা গায়ে আঙুলের ছাপ স্পষ্ট। পাতা হাত বুলিয়ে বলে,
-” ভোর তো গুড বয়! এরকম কেউ করে? রূপ এই ছোট বাচ্চা। ও কি বোঝে নাকি! এভাবে মারে কেউ? তুমি না আমার সোনা ছেলে! চাচিমনি ও রূপকে স্যরি বলবে ঠিকাছে?”
-” না!”
পাতা তাঁর মাথায় হাত বুলিয়ে বলে,
-” তাহলে তো ভোর ব্যাড বয়!”
-” তো?”
-” আমি কোনো ব্যাড বয়কে আদর করবো না!”
ভোর মাথা তুলে তাকায়! কিছু বলে না।
এর মাঝেই অরুণ বেরিয়ে আসে। পড়নে শুধু শর্টস; হাঁটুর উপর! পাতা এমন পরিস্থিতিতেও খানিকটা লজ্জা পায়। অরুণ এগিয়ে আসে। পাতা খেয়াল করে লোকটার ডান হাতের পিঠ লাল হয়ে আছে। খানিক থেঁতলে গেছে। পাতা ঢোক গিলে বলে,
-” আপনি সত্যিই পাগল!”
অরুণ কিছু বলে না। ওষুধের বক্সটা খুলে কিছু ওষুধ মুখে পুরে ঢকঢক করে পানি পান করে। তারপর বিছানায় গা এলিয়ে দেয়! পাতার কপালে ভাঁজ পড়ে। ভোর আড়চোখে বাবাকে দেখে তার কাছে যায়!বাবার পিঠে মাথা রেখে শুয়ে পড়ে। অরুণ সরিয়ে দেয় সাথে সাথেই! পাতাকে উদ্দেশ্য করে রাশভারী গলায় বলে,
-” পাতাবাহার? ওকে বলে দাও আমাকে যেন না ছোঁয়। আমার গা না ঘেঁষে! আমার সাথে কথা না বলে!”
ভোর নাক টেনে ভঙ্গুর গলায় বলে,
-” কেন বলবো না? আম্মু আব্বু আমাকে মারলো আমি কিছু বলেছি? আমি ব্যাথা পেয়েছি অনেক তবুও কিছু বলি নি! মেরেছে আমায়! রাগ আমার করার কথা! আমি রাগ করি নি আব্বু কেন রাগ করবে? আমার সাথে এমন কেন করবে? ভোরকে আদর না করে, বুকে না নিয়ে কেন ঘুমাবে?”
কথা শেষ করে সে আবার বাবাকে জড়িয়ে ধরে। অরুণ ঝটকায় সরিয়ে দিলো। ভোরের চোখের পানি বাঁধনে ছাড়া হয়।
-” ভোরকে ভালোবাসবে না তো? ভোর মরে যাবে তখন কাঁদবে না বলে দিলাম!”
অরুণের মনে হয় কেউ তার গলা চেপে ধরেছে; শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থায় সে। তবুও নিজেকে কঠোর রেখে বলে,
-” যাও মরে! অরুণ সরকার একা থাকতে জানে! আর একা থাকতে না পারলে আর কি হবে?সেও মরে যাবে।”
ভোর শব্দ করে কেঁদে দেয় এবার। পাতার মেজাজ বিগড়ে যায় এবার। ধমকে বলে,
-” কি শুরু করে দিয়েছেন দুজন? কষিয়ে দু’জনকেই দিবো! এতো কিসের মান অভিমান!”
ভোরের কান্নার শব্দ থেমে যায় তবে আঁখি যুগলের মাঝে এখনো অঢেল বর্ষণ! অরুণ বালিশে মুখ গুঁজে শুয়ে থাকে। ভোর বাবার বালিশে মাথা রেখে শুয়ে পড়ে! তবে বাবার গা একটুও স্পর্শ করে না। পাতা থমথমে মুখে কিয়ৎপল তাকিয়ে দু’জনকে পর্যবেক্ষণ করে বলে,
-” অবেলায় ঘুমের প্রস্তুতি নেয়ার মানে কি? উঠুন দুজন! ভোরের বাবা? মনে হয় না সারাটা দিন কিছু মুখে দিয়েছেন! আমি খাবার আনছি!”
-” খাবার নষ্ট করার কোনো মানেই হয় না!”
-” সে দেখা যাবে!”
বলেই পাতা বেরিয়ে যায় ঘর থেকে। নিচে নামতেই নজরে আসে আরিয়ান সরকার। রুবি তার কাছে সব কথা গুছিয়ে বলছে। মিথ্যা বলছে না। যতটুকু ঘটেছে ততটুকুই! আরিয়ানের মুখটা গম্ভীর; ছেলেকে বুকে জড়িয়ে রেখেছে। পাতা চুপটি করে কিচেনে যায়। সুফিয়া সেখানেই বসে আছে। পাতা তাকে খাবার দিতে বলে। এরইমাঝে আরিয়ান কিচেনের দরজায় এসে পাতাকে উদ্দেশ্য করে বলে,
-” একটু কথা ছিল ভাবী!”
প্রথমবারের মতো মনে হয় পাতাকে সম্মানের সাথে ডাকলো আরিয়ান! পাতা মাথা নাড়িয়ে এগিয়ে আসে আরিয়ান বলতে শুরু করে,
-” তুমি উপস্থিত ছিলে সেখানে আশা করি কিছু বলতে হবে না! ব্যাপারটা মোটেই হালকা নয়! ভাই সবসময়ই এমন করে। বাচ্চা বাচ্চা ঝগড়া মারামারি হবে। তার কানে গেলেই কেন সে ভোরকে মারবে? এর মানে কি এটা দাঁড়ায় না যে আমাদের উপর ক্ষোভ বাচ্চাটার উপর দিয়ে চালিয়ে দিচ্ছে?”
পাতা একটু অবাক হয়ে বলে,
-” ভাইয়া আপনারা ভুল ভাবছেন!”
-” ভুল নয় বিভ্রান্তি! ভাই কে আমি চিনি ভাবী! রুবি ভাইকে কথা শুনিয়েছে কাজটা মোটেই ঠিক করে নি। তবে কথাগুলো তিক্ত হলেও কিছুটা সত্য! ভুল বুঝবে না আমায়! তোমরা যেদিন পার্টিতে গেলে সেদিনও ভোর হিংস্র ভাবে মেরেছে আমার মেয়েটাকে। মা ব্যাপারটা কাউকেই বলতে মানা করে কিন্তু মেয়ের গালে থাপ্পড়ের ছাপ দেখে আমার সন্দেহ হয়। আদুরিকে বলতেই ব্যাপারটা ক্লিয়ার হয়! ভোর মেন্টালি সিক না! তবে কিছুটা উগ্র! ওকে ভালোভাবে ভালোবেসে বুঝিয়ে বললেই হবে। কিন্তু ভাইকে এই ব্যাপারে বলতে গেলেই সে ছেলেটার উপর চড়াও হবে ভেবে আমি বলি নি। তোমাকে বললাম বুঝিয়ে বলো! আর রুবির তরফ থেকে আমি স্যরি বলছি!”
পাতার আর কিছু বলার থাকে না। আরিয়ান চলে যায়। পাতা সুফিয়ার দিকে তাকালে সুফিয়া আমতা আমতা করে বলে,
-” রান্না এখনো বসাই নাই বড় ম্যাডাম!গরম দুধ আর পাউরুটি আছে! দিবো?”
-” দাও! চকোসের প্যাকেটটাও দিও সাথে!”
সুফিয়া সব ট্রেতে দেয়। পাতা সেগুলো নিয়ে রুমে চলে আসে। অরুণ ও ভোরকে ডাকে। অরুণের কোন সাড়া পায় না। তবে ভোর উঠে বসে। পাতা অরুণের পিঠ ঝাঁকি দিয়ে ডাকে অরুণ বিরক্তের সাথে বলে,
-” ডোন্ড ইরিটেটেড মি পাতাবাহার! খাওয়ার মন মানসিকতা মোটেই নেই! দুবার যেন বলতে না হয়! ওকে খাইয়ে দাও!”
পাতা ঢোক গিলে। ভয়ঙ্কর কন্ঠ অরুণের! সে আর ডাকার সাহস করে না। ভোরকে নিয়ে বসায়। ভোর নাকচ করে বলে,
-” খাবো না!”
পাতা তার কথা উপেক্ষা করে বাটিতে চকোস ঢেলে দুধ ঢেলে দেয়। পাউরুটির স্লাইড দুধে হালকা করে ডুবিয়ে ভোরের মুখের সামনে ধরে বলে,
-” কোনো প্রকার না শুনবো না আমি!”
ভোর হাতে গাল মুখ মুছে বলে,
-” আব্বু না খেলে আমিও খাবো না!”
পাতা জোড় করে তার মুখে ব্রেড দিয়ে বলে,
-” সে খেয়ে এসেছে। তুমি খাও নইলে তোমার বাবা রেগে যাবেন আরো!”
ভোর ফোপাতে ফোপাতে বলে,
-” আমি জানি আব্বু খায় নি! তুমি ভালো করে আব্বুকে ডাকো না আম্মু!”
পাতা শান্ত চোখে চায়। ভোর ঘার ফিরিয়ে বারংবার অরুণের দিকে চাইছে। পাতা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ভোরের মুখে আবার ব্রেড দিয়ে বলে,
-” ভোর? আমার দিকে তাকাও?”
ভোর খাবার না চিবিয়েই গলাধঃকরণ করে পাতার দিকে তাকায়। পাতা তার গালে হাত বুলিয়ে বলে,
-” ভোর হয়েছে আর কাঁদে না! তুমি খেয়ে তোমার বাবার বুকে চুপটি করে শুয়ে থেকো! কিছু বলবে না। আমি আছি তো বাবা!”
ভোর মাথা নেড়ে সম্মতি দেয়। পাতা তাকে খাইয়ে দেয়। মুখটা মুছে দিয়ে কোলে বসায়! গালে মুখে চুমু দিয়ে বুকে জড়িয়ে গালে বরফ ঘষে দেয়। আদুরে গলায় বলে,
-” আমার সোনা ছেলে তুমি ভোর! আমি তো তোমার আম্মু! রুপের চাচিমনি। শোন চাচি, মামি ,খালামুনি আন্টিদের মাঝে একটু মা মা ভাইব থাকে। তুমি জানো কি না জানিনা আমরা কিন্তু চাচিদের আম্মা বলে ডাকি। বড় চাচি বড়ম্মা, ছোট চাচি ছোটম্মা! মামিদের মামুনি ডাকি! আমি তো আমার খালাকে মা ডাকি আর খালুকে বাবা! আমার খালাতো ভাই বোন কিন্তু মোটেও রেগে যায় না। একজন ভালোবেসে মা আম্মা ডাকতেই পারে। আমরা কিন্তু তিন ভাইবোন। লতাপু, লুব ভাই আর আমি! আমরা তিনজনই আমার আব্বু আম্মুকে আব্বু আম্মু বলেই ডাকি!আমরা কিন্তু কখনো এটা নিয়ে ঝগড়া করি নি। কারণ আমরা ভাই বোন।ভাই বোনের সম্পর্কগুলো খুব মিষ্টি হয়।
একদম তোমার আইসক্রিমের মতো। রূপ আনিকা তোমার ভাই বোন! তুমি তো ওদের বড় ভাই। বড় ভাই হওয়া অনেক দায়িত্বের কাজ। তোমাকে ওদের দুজনকে আগলে রাখতে হবে। তোমার আব্বু যেমন তোমার আদুরি ফুপ্পি ও আরিয়ান চাচ্চুকে আগলে রাখে। তাদের স্নেহ করে তেমন তোমাকেও আগলে রাখতে হবে। কেউ ওদের ক্ষতি করতে চাইলে তুমি ঢাল হয়ে তাদের রক্ষা করবে। স্পাইডারম্যানের মতো! অথচ তুমি রূপকে কষ্ট দিয়েছো। সে তো ছোট্ট বাবু। এখনো ভালো করে হাঁটতেই পারে না। চারটে দাঁত মাত্র। কথাও বলতে পারে না। আ আ উউ পে পু করে! কিন্তু তুমি তো বড়। আমার কলিজার টুকরো ছেলে।
আমি তোমাকে অন্নেক ভালোবাসি! সবচেয়ে বেশি। কারণ আমার আদুরে ছেলেটা খুব ভালো আর বুঝদার! আমাকে অনেক ভালোবাসে। সেই ভালো ছেলে হঠাৎ এরকম বাজে আচরণ করেছে। আমি কিন্তু খুবই কষ্ট পেয়েছি। আমার ছেলে কেন অন্য একটা বাচ্চাকে মারবে? সে রূপ বা অন্যকেউ। কখনো কাউকে আঘাত করতে নেই। তুমি তো আরবি পড়তে পারো। আমাদের প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) কখনো কাউকে তিল পরিমাণ কষ্ট দেয় নি। তিনি বড়দের সম্মান ও ছোটদের স্নেহ করতেন। রূপ আনি তোমার ছোট, তুমি তাদের স্নেহ করবে! তুমি তোমার ছোট ভাইকে মারলে এটা তো খুবই বাজে কাজ!
দেখো তোমার জন্য তোমার আব্বুও কষ্ট পেলো আম্মুও পেল! চাচিমনি আনি দাদি সবাই! আর রূপ কতটা ব্যাথা পেয়েছে! তুমি কাল সকালে জলদি করে উঠে রূপকে আদর করে দিও। চাচিমনির হাত ধরে স্যরি বলিও! ভোরের আম্মু ভোরকে অনেক ভালোবাসে। সাথে রূপ আনির চাচিমনি রুপ আনিকে ভালোবাসে।এতে তুমি কেন হিংসে করবে? হিংসুটে ছেলেকে কেউ ভালোবাসে না; আল্লাহ তায়ালাও না! বুঝলে?
আদর করে করে অনেক বোঝায়। ভোর কিছু বলে না। চুপচাপ শুনতে থাকে। বরফ ঘষা শেষ হলে পাতা ভোরকে নাপা সিরাপ খাইয়ে দেয়।সে বিড়ালছানার মতো গুটিসুটি মেরে বাবার বুকে ঘাপটি মেরে শুয়ে থাকে! পাতা হাসে। বরফ কুচি সুতি কাপড়ে মুড়িয়ে অরুণের আঘাতপ্রাপ্ত হাতে ডলে দেয়। অরুণ হাত সরিয়ে নিতে চায় পাতা শক্ত করে ধরে রাখে।
থমথমে পরিস্থিতি আরিয়ানের রুমে বিরাজমান! রুবি চুপচাপ বিছানায় বসে। আনিকা মায়ের পাশে বসে আছে। আসমা বেগম ও আরিয়ান দাঁড়িয়ে আছে। আরিয়ানের কোলে ঘুমন্ত রূপ! আসমা বেগম নিরবতা ভেঙ্গে রুবিকে বলে,
-” ভোর ভুল করেছে! সাথে তুমিও ভুল করেছো রুবি! বাচ্চা ছেলে ভোর। আর বাচ্চারা একটু হিংসুটে হয়। ভোর একটু বেশিই। মায়ের ভালোবাসা পায় নি; হঠাৎ পেয়ে ওর মনে একটু ভয় ঢুকে গেছে।বর্ষার ছেলেকে দেখেছে ভোর! ওর মনে হয়তো এই ধারনা জন্মেছে ওই ছেলে বর্ষাকে ভোরের থেকে দূরে নিয়ে গেছে। রূপ মা ডাকলে হয়তো ওর মনে হয় ওর মা’কে কেড়ে নেবে!”
রুবি থমথমে গলায় বলে,
-” মা এটাও এক ধরনের সিকনেস!”
-” মাইন্ড ইয়ুর ল্যাঙ্গুয়েজ রুবি! অসুস্থ নয় ভোর। এটা বাচ্চাদের একটু বাচ্চামো।আনিকাও করে। রূপের জন্মের পর আনিকাও কিন্তু এমন বিহেভ করতো; ধীরে ধীরে বুঝতে শিখেছে।ভোর বুঝদার ছেলে।সেও বুঝবে। তুমি প্লিজ তোমার বিক্ষুব্ধ মনটাকে ঠিক করো!”
ধমকে কড়া সুরে বলে আরিয়ান। রুবি বেশ অপমান বোধ করে। আসমা বেগম আরিয়ানের কাঁধে হাত রেখে শান্ত হতে বলে। রুবির পাশে বসে নরম গলায় বলে,
-” রুবি আমি বুঝতে পারছি তোমার মনের অবস্থা ঠিক নেই। ছেলের ওমন অবস্থায় ঘাবড়ে গেছো। ভোরের ভুল আছে। পাতা যেমনটি বলল শান্ত ভাবে কথা বলে সব ঠিক করা যেতো! তুমি অরুণের কাছে জানাতে চাইছিলে সেটাও যেতো! কিন্তু সুশীল ভাবে গুছিয়ে। তাহলে ব্যাপারটা এতো দূরে এগোতো না। অরুণ নিশ্চয়ই ছেলেকে শাসন করতে কুণ্ঠাবোধ করতো না! কিন্তু তুমি ব্যাপারটা রাগের মাথায় তুললে। ইটস ওকে। তুমি ভোরকে দুটো কথা শুনিয়েছো। হয়েছে; পাতা বলেছিলো তো সে ভোরকে শক্ত করে বুঝিয়ে বলবে। কিন্তু তুমি অরুণ পাতাকে জড়িয়ে কথা শোনালে। তাদের পার্সোনাল ব্যাপার টেনে আনলে। পাতাকে ম্যানুপুলেট করার চেষ্টা করেছো অনেকটা! এটা বেশি হয়েছে! অরুণ আরিয়ানের বড় ভাই! সম্পর্ক তোমার ভাসুর! তুমি তাঁর সঙ্গে তর্কে জড়িয়ে কটুক্তি করেছো। এটা তোমার ভুল ছিলো!”
রুবি দমে যায় না।
-” মা আপনি শুধু আমার দোষ খুঁজে বেড়াচ্ছেন কিন্তু আমি আমার কোন দোষ দেখছি না। আমি সত্যটা বলেছি! আর অরুণ ভাইয়া কিভাবে কথা বলল? আমি তার উচিত জবাব দিয়েছি। কিন্তু জানেন তো সত্য কথা একটু তিক্ত স্বাদের হয় তাই হজম করতে পারে নি।”
আরিয়ান কঠিন চোখে তাকিয়ে বলে,
-” তুমি আমাদের সাজানো সংসারটাকে ভাঙ্গতে চাইছো রুবি! অরুণ সরকার ভাই হয় আমার। অতিতটা জমকালো না হলেও আমি আমার ভাইকে ভালোবাসি। একসাথে মিলেমিশে থাকতে চাই। তুমি কালই ভাইয়ের কাছে ক্ষমা চাইবে দ্যাটস ইট!”
রুবি ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে বলে,
-” আমি কেন ক্ষমা চাইবো? আমি কোনো দোষ করি নি! ভাইয়ের চামচামি বন্ধ করো আরিয়ান। তোমার ভাই তোমায় গোনায়ও ধরে না।”
আরিয়ান জ্বলন্ত চোখে চায়। ছেলে মেয়ে আর মা উপস্থিত না থাকলে রুবির গালটা হয়তো রঙিন হতো!
-” আমার ভাই ভাস্তে সিক নয়। তুমি মেন্টালি আনস্টেবল রুবি! তোমার মনটা কলুষিত হয়েছে মা ভাবীর কুমন্ত্রনায়!”
-” আমার মা ভাবীকে টানছো কেন? হঠাৎ ভাই ভাবীর প্রতি দরদ উথলে পড়ছে তোমার! তোমার বাবা চলে যাওয়ার আগেও না ভাইয়ের গুনগান গাইতে!”
আসমা বেগম উঠে দাঁড়িয়ে রুবিকে শক্ত গলায় বলে,
-” বেয়াদবি করবে না ছোট বউ!বাচ্চা মেয়েটা উপস্থিতি হয়তো ভুলে গেছো! বড্ড বাড়াবাড়ি করছো..”
থেমে যান আসমা বেগম। দরজায় কেউ কড়া নাড়ছে। আরিয়ান আসমা বেগম একে অপরের দিকে তাকিয়ে থেকে দরজা খুলে দেয়। আগমন ঘটে পাতার। ভিতরে প্রবেশ করে আরিয়ানের কোলে ঘুমন্ত রূপের মাথায় হাত বুলিয়ে বলে,
-” কি অবস্থা বাচ্চাটার?”
-” ভালো! সেই যে ঘুমিয়েছে!”
-” আই’ম স্যরি ভাইয়া! ভোরের পক্ষ থেকেও স্যরি বলছি! আমি ভাবতে পারি নি ভোর এমনটা করবে! আমারি দোষ! আগে থেকেই ব্যাপারটা নিয়ে ভোরের সাথে কথা বলা উচিত ছিল। কিন্তু এখন এসব বলে লাভ নেই।বাচ্চা ছেলে ভুল করেছে আপনারা কিছু মনে করবেন না। ওর বাবা বকেছে। আমি বুঝিয়ে বলেছি আশাকরি আর এমনটা হবে না। রুবি আপু আমি সত্যিই ক্ষমা চাইছি। তুমি প্লিজ বাচ্চাটার উপর রেগে থেকো না!”
রুবি কিছু বলবে আরিয়ানের গরম চাহনিতে কিছু বলতে পারে না। আরিয়ান নরম গলায় বলে,
-” ক্ষমা চাইতে হবে না। ভোর বাচ্চা ছেলে। ভুল হতেই পারে। তুমি একটু আদর করে বুঝিয়ে বললেই হবে!”
পাতা সায় জানালো। রুবি হঠাৎ করে বরফ শীতল গলায় বলল,
-” বড় ভাবী? তুমি প্লিজ আমার ছেলে মেয়ের থেকে দূরে থেকো! ভোর কখন কি করে বসে। আমার ছেলে মেয়ের সেফটি ফাস্ট প্রায়োরিটি!”
পাতা চমকায় না। সে একটু আগেল সব কথাই শুনেছে। সে নিচে এসেছিল অরুণের জন্য খাবার আনতে। সাথে রূপকে দেখতে। রুমের বাইরে থেকেই উঁচু গলায় কিছু কথোপকথন কানে বাজে তাঁর। আড়ি না পাতলেও স্তম্ভিত হয়ে দাঁড়িয়ে সবটা শুনতে পায় সে। পাতা রুবির দিকে তাকিয়ে বলে,
-” রুবি আপু তোমার এই কথাটার মানে কি দাঁড়ালো? আপু ভোর একবার ভুল করেছে।এর মানে এই না সবসময় করবে। তুমি তখনও বারবার বলেছো ভোর মেন্টালি সিক! ভেবে দেখেছো এই কথাটা ভোরের উপর প্রভাব ফেলতে পারে! মানছি ছেলের অমন অবস্থায় তুমি ঘাবড়ে গিয়েছিলে তাই বলে এভাবে বলবে? তোমাদের চোখের সামনেই তো বড় হয়েছে আমার চেয়ে ভালো তোমরা চেনো তাকে। তবুও এই কথাটা বলতে একবারো বুক কাঁপে নি!”
রুবি হেসে ওঠে শব্দ করে।হাসতে হাসতেই বলে,
-” তুমি আবেগী নাকি ঢংগী! যাই হোক। এখন আমার ছেলে আমার ছেলে জপছো আর কটা দিন যাক নিজের পেটের দুই একটা আসুক তখন দেখবো ছেলের প্রতি কতখানি ভালোবাসা অবশিষ্ট থাকে। বাস্তবতা বড়ই কঠিন বড় ভাবী। আপন পর হয়ে যায় সেখানে সৎ তো গলার কাটা বেড়োলো বলে!”
কথাটা পাতার গায়ে লাগে। সে শক্ত গলায় বলে,
-” বাস্তবতা সত্যিই কঠিন। যেখানে আপন মা সন্তানের মাঝেই তিক্ততা আসে; বৃদ্ধাশ্রমের সংখ্যা বৃদ্ধি পায়; ডাস্টবিনে নবজাতককে খুঁজে পাওয়া যায় সেখানে সৎ নামক জটিল সম্পর্কটার কথা নাই হলো! তবে এতো সব তিক্ততার মাঝেও কিন্তু ভালোবাসা নামক ভরসার স্থান এখনো টিকে আছে। ভোর আমার গর্ভজাত সন্তান না হলেও আমি তার মা! মা’ নামক অনুভূতি থেকে অপরিচিত হলেও ভোর যখন আম্মু বলে ডাকে আমার অন্তঃস্থল যেন পরিপূর্ণতায় ছেয়ে যায়। আমি সৎ আপন বুঝতে চাই না। আমি শুধু এটুকু বুঝতে চাই আমি ভোরের আম্মু। ভোর আমার ছেলে। তবে হ্যাঁ মানুষ পরিবর্তনশীল। সময়ের সঙ্গে আপনে আপ তার মাঝে পরিবর্তন সাধিত হয়। যদি এই পাতার মাতৃহৃদ কুঠিরে ভোরের জন্য তিল পরিমাণও ভালোবাসার ঘাটতি দেখা যায় তখন যেন এই পাতা অভিশাপের অনলে দগ্ধ হয়ে ছাই হয়ে ফুরিয়ে যায়।”
কথা শেষ করে দাঁড়ায় না পাতা। বেড়িয়ে যায় ঘর থেকে। আজ পাতা নতুন করে ভেঙ্গে গড়ে উঠলো যেন। এক নতুন চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হলো সে। এই চ্যালেঞ্জ রুবির সাথে নয়। নিজের সাথে নিজের চ্যালেঞ্জ! উজানের ঢেউয়ে ভাসমান পাতার ঘুরে দাঁড়ানোর দৃঢ় প্রত্যয়। পাতার আঁখি যুগল এবার ভরে ওঠে না। সে কিচেনে গিয়ে রুটি অমলেট ও একগ্লাস গরম দুধ ট্রেতে করে নিয়ে রুমে যায়! ভেজানো দরজা খুলে ভিতরে ঢুকতেই তার চোখজোড়া যেন শীতল আবেশ শান্ত হয়ে যায়!
অরুণ সরকার ছেলেকে বুকে জড়িয়ে আলতোভাবে চুমু দিচ্ছে যেন ব্যাথা না পায়। ছোট আদুরে মুখটায়, বুকে, পিঠে, বাহুতে। বিড়বিড় করে বলছে,
-” আমার আব্বু! আমার মানিক সোনা! কলিজা। আমার জান!”
কিন্তু ছোট ভোর চুপচাপ। সে ঘুমের সাগরে ভেসে বেড়াচ্ছে। জেগে থাকলে দেখতে পেতো তার বাবার চুড়ান্ত পর্যায়ের পাগলামো।অরুণ ছেলের রক্তিম হয়ে যাওয়া গালে আলতো চুমুতে ভরিয়ে দিল আবার!
পাতা দাঁড়িয়ে দেখে এক পাগলাটে বাবার অসীম ভালোবাসার সমারোহ। বাবারা এমন হয়? কই তাঁর বাবা তো তাকে কখনো এভাবে আদর করে নি। এতোটা স্নেহের সাথে আদর করে নি। পাতা টি টেবিলে খাবার রেখে দরজা বন্ধ করে আসে। বিছানার পাশে দাড়িয়ে বলে,
-” যতোটুকু ব্যাথা দিয়েছেন তার চেয়ে হাজার গুণ বেশি ব্যাথার ছাপ আপনার চোখে মুখে ফুটে উঠেছে ভোরের বাবা!”
অরুণ ছেলের মাথাটা বুকে চেপে কম্ফোর্ট দিয়ে ঢেকে পাতার দিকে তাকায়! কিছু বলে না। পাতা একটা প্লেটে রুটি অমলেট এনে বিছানায় উঠে বসলো।
-” চুপচাপ ভদ্র বাচ্চার মতো খেয়ে নিবেন। আপনার উপর কিন্তু আমি রেগে আছি!”
-” খাবো না পাতাবাহার। তুমি খেয়ে এসে শুয়ে পড়ো!”
পাতা রুটি ছিঁড়ে শাসনের সুরে বলে,
-” কোন কথা না! কি ভাবেন নিজেকে হুম? ফিল্মের হিরো! সব নিজের ভিতর চেপে রেখে দুঃখের সাগরে ভেসে বেড়াবেন? শুনুন আমি পাতা আপনার টুঁটি চেপে টেনে আনবো! আসছে হিরো আলম! চুপচাপ খাবার গলাধঃকরণ করুণ!”
অরুণ শুয়ে থেকেই খাবার চিবোতে থাকে নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে। পাতা বলে,
-” বাচ্চারা ভুল করবে স্বাভাবিক কারণ তাঁরা বাচ্চা। তাদের কাজই ভুল করা। আর বড়দের কাজ হলো তাদের ভুলটা বুঝিয়ে তাকে সাবধান করা! শাসনের নামে নির্যাতন করা নয়। ওভাবে কেউ বাচ্চাকে মারে?”
অরুণ ছেলের মাথায় চুমু দিয়ে বলে,
-” কন্ট্রোল করতে পারি নি। আমার হাত বেশি চলে পাতাবাহার। রুবির কথায় মাথা ভোঁ ভোঁ করছিলো!”
পাতা অরুণের মুখে রুটি অমলেট দিয়ে বলে,
-” তাই মেরে দিলেন! ছেলেটা ব্যাথা পেয়েও ট্যু শব্দটি করে নি। ভোরের বাবা নিজের রাগ টাকে আয়ত্তে আনতে শিখুন। রাগ মানুষকে ধ্বংসের পথে নিয়ে যায়।”
অরুণ কিছু বলে না। তাঁর ছোট চোখ জোড়ায় ঘুম নামে। পাতা জোড় করে দুটো রুটি খাইয়ে দেয়। দুধের গ্লাস মুখে ধরলে অরুণ মানা করে। পাতা চোখ রাঙায়। অরুণ একটুখানি মুখে নিয়ে বারণ করে খাবে না। পাতা আর জোড় করে না। খেয়েছে এই অনেক। সে তো ভেবেছিলো ধমকে তাকে মুড়িঘণ্ট বানিয়ে দিবে।
পাতা ভোরের পাশে বসে লাইট অফ করে ড্রিম লাইট জ্বালিয়ে দেয়। বালিশে কনুই ভর দিয়ে তাকিয়ে থাকে বাবা ছেলের দিকে। ভোরের মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়। কপালে গায়ে হাত রেখে তাপমাত্রা পরখ করে। গা একটু গরম! তবে হাত পা গুটিয়ে বাবাকে জড়িয়ে শুয়ে আছে। শীত করছে হয়তো। পাতা একটু এগিয়ে এসে জড়িয়ে নেয়। অরুণের চুলের মাঝে হাত গলিয়ে কপালে চুমু দেয়। অরুণ সরকার চোখ খুলে তাকালো। পাতা খানিক অস্বস্তিতে পড়ে। লোকটা মহা ধরিবাজ! সে স্বাভাবিক গলায় বলে,
-” ঘুমান নি?”
-” ঘুমের ওষুধ খেয়েও চোখে ঘুম নামছে না। ছেলেটার গা গরম!”
অরুণের ভগ্ন কন্ঠস্বর। পাতার কেমন যেন লাগলো! তাঁর চুলের ভাঁজে থাকা হাতটা কপোলে এসে থামে আশ্বস্ত করে বলে,
-” নাপা সিরাপ খাইয়ে দিয়েছি। চিন্তা করবেন না। আপনি ঘুমের ওষুধ খেয়েছেন কেন?”
অরুণ উত্তর দেয় না। সে মাঝে মাঝে খায় ঘুমের ওষুধ। ডাক্তারের অনুমতিতেই। পাতা মলিন চোখে চায়। লোকটা তাঁর সাথে কোন কথাই শেয়ার করে না। সে জিজ্ঞেস করলেও চুপ থাকে। পাতা আবার ঝুঁকে এসে অরুণের গালে চুমু দিয়ে বলে,
-“চিন্তা বাদ দিন। ঘুমিয়ে পড়ুন!”
অরুণ চোখ বুজে নেয়। পাতা তার বন্ধ চোখের পাতায় চুমু দিয়ে বালিশে মাথা রাখে! ভোর ঘুমের ঘোরে নড়ে চড়ে এপাশে ফেরে। পাতার দিকে সেটে জড়িয়ে ধরে বুকে মাথা রাখে। ছোট হাতে পাতার মুখাবয়ব হাতরে আম্মু আম্মু বলে বিড়বিড় করে। পাতা তার কপালে চুমু দিয়ে ফিসফিসিয়ে বলে,
-” আম্মু আছে তো!”
ভোরের বিড়বিড় থেমে যায়। পাতা ঝুঁকে ভোরের গালে চুমু দিয়ে চোখ বন্ধ করে। সাথে অনুভব করে একটা বলিষ্ঠ বাঁধনে তাকে বাঁধা হয়েছে।একজোড়া উষ্ণতায় ভরপুর ওষ্ঠাধর তার ললাট ছুঁয়ে যায়। পাতা চোখ খোলে না; পরম আবেশে ঘুমে তলিয়ে যায়।
আবছা কুয়াশায় ঢাকা বাড়ির আঙিনায় ভোরের পাখি ডাকছে অহরহ। যেন ঝগড়ায় জড়িয়ে পড়েছে এঁকে অন্যের সাথে। বেলকনির গ্রিলে আজকেও ছোট ছোট চড়ুইয়ের আগমন ঘটেছে। তাঁরা ভিতরে প্রবেশ করতে চায় কিন্তু পারে না। বেলকনির টবের সাথে ঘেঁষে বসে আছে পাতাবাহার। লেজটা তাঁর নড়ছে সাপের মতো। ভাব এমন যেন ভিতরে এলেই গিলে খাবে। কঠিন তদারকি তাঁর। তবে তাঁর চোখ ফাঁকি দিয়েই একটা চড়ুই পাখি উড়ে আসে ভিতরে। বিড়ালটি বুঝতে পেরেই মিও মিও করে লাফাতে থাকে পাখিটিকে ধরার উদ্দেশ্যে। পাখিটি নিজেকে বাঁচাতে উড়ে ঘরে প্রবেশ করে। পাতাবাহার তাঁর পিছু পিছু দৌড়ায়। পাখির চিও চিও ও পাতাবাহারের মিও মিও শব্দে ভোরের ঘুম ভেঙ্গে যায়। চোখ ডলে পিটপিট করে চায়। ঘরে পাখি উড়তে দেখে মুখে হাসি ফুটে ওঠে। কিন্তু পাতাবাহারকে পাখিটার পিছনে লাগতে দেখে চিল্লিয়ে বলে,
-” এই পাতাবাহার?”
পাতা ধর ফরিয়ে ওঠে।গোল গোল করে তাকায়। ভোর জিভে কামড় দিয়ে বলে,
-” আম্মু তোমাকে বলি নি। ওই বিড়ালকে বলেছি!”
পাতার মস্তিষ্ক কার্যকর হয়। ভোরের গাল টিপে ভাঙ্গা ভাঙ্গা গলায় হামি তুলে বলে,
-” শুভ সকাল!”
ভোর পাতার গলা জড়িয়ে ধরে বলে,
-” আম্মু দেখো পাতাবাহার পাখিটাকে ধাওয়া করছে!”
পাতা তাকিয়ে দেখে, সত্যিই। সে কড়া গলায় বিড়ালটিকে ডাকে,
-” এই অরুণ সরকারের ছা’পোষা?”
ভোর হেসে ওঠে সম্মোধন শুনে। পাতাবাহারও যেন বুঝতে পারলো তাকে তলব করেছে। সে পাখির পিছু না নিয়ে লাফ দিয়ে বিছানায় পাতার কোলে ওঠে। পাখিটি উড়ে বেরিয়ে গেল।
পাতা বিড়ালটিকে সরিয়ে দিয়ে নাক সিঁটকায়। পাতাবাহার আড়চোখে তাকিয়ে গুটি গুটি পায়ে লেজ নাড়িয়ে সোফায় গিয়ে বসে। ভোর হাসে। পাতা তার গালে ঠোঁট ডাবিয়ে চুমু খায়। হাসলে ভোর সরকার পুরোই রসে টইটম্বুর রসগোল্লা! ভোরের হঠাৎ বাবার কথা মনে পড়ে। সে বিছানায় তাকায়। বাবা নেই; তার ছোট মনে ভয় নামক আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। বাবা কাল বলেছিলো চলে যাবে। সত্যিই চলে গেছে? ভোর কে ফাঁকি দিয়ে! ভাবতেই তার চোখ ভরে ওঠে। কাঁদো কাঁদো গলায় বলে,
-” ও আম্মু? ভোরের আব্বু কোথায়?”
পাতা খানিক চিন্তায় পড়ে।
-” হাঁটতে গেছে। আসলো বলে! কি হয়েছে?”
-” কিছু না। ওই ওয়াশ রুমে যাবো!”
পাতা হেসে তাকে ওয়াশ রুমে নিয়ে যায়। ফ্রেশ করিয়ে বিছানায় বসিয়ে টি শার্ট গায়ে গলিয়ে দেয়! নিজেও ফ্রেশ হতে যায়। ভোর বিছানায় বসে থাকে গালে হাত দিয়ে। কিছু সময় পরে বিছানা থেকে নামে! থ্রি কোয়ার্টার প্যান্টের পকেটে হাত ঢুকিয়ে গুটি গুটি পায়ে নিচে নামে। ড্রয়িং রুমে আনি, রূপ ও চাচ্চুকে দেখে এগিয়ে যায়। কিন্তু কাছে যাওয়ার সাহস পায় না। চাচ্চু যদি আব্বুর মতো মারে, বকা দেয়?
আরিয়ান ছেলেকে কোলে নিয়ে বসে আছে। ছেলেটার জ্বর এসেছে রাত্রেই। এখন কিছুটা কমেছে। আনিকা বাবার পাশে বসে চায়ে বিস্কুট ডুবিয়ে খাচ্ছে। ভোরকে দেখে ভেংচি কেটে বিড়বিড় করে ‘পঁচা ছেলে’ বলে। ভোর বুঝতে পেরে চোখ রাঙায়! আনিকা জিভ বের করে ভেঙায়। বাবাকে ইশারায় ভোরকে দেখায়! আরিয়ান ঘার ফিরে ভোরকে দেখে। মুচকি হেসে বলে,
-” কাম ভোর?”
রূপ ভোরকে দেখে হেসে দেয়! ভু ভু বলে কাছে ডাকে। ভোর মাথা নিচু করে এগিয়ে যায়। রূপের জন্য তার একটু একটু কষ্ট হচ্ছে।রূপ ভোরের গলায় হাত রেখে মুখ এগিয়ে গালে মুখ লাগিয়ে লালা মেখে আ’মা আ’মা ডাকে। ভোরের একটু একটু রাগ হয়। তবে ভালোও লাগে। সে রূপকে কোলে নিয়ে গালে চুমু দেয়। বিড়বিড় করে বলে ‘ভোর অনেক গুলো স্যরি’। আরিয়ান শুনতে পায়। হেসে ভোরের চুল এলোমেলো করে দেয়। ভোর চাচ্চুর দিকে তাকিয়ে বলে,
-” ভোর ভেরি ভেরি স্যরি চাচ্চু! আর হবে না। রূপ তো আমার ভাই হয়। ভোর তার ভাইকে কখনও মারবে না। শুধু স্নেহ করবে! প্রমিজ!”
আরিয়ান মুচকি হেসে বলে,
-” এই তো গুড বয়! আমাদের ভোর কতটা বুঝদার! শুধু মাঝে মাঝে একটু ভায়োলেন্ট বনে যায়। রূপ তোমার ছোট ভাই আর আনিকা ছোট বোন! তুমি তো সবার বড় ভাই! তুমি ওদের দেখে রাখবে। এটা তোমার দায়িত্ব।”
ভোর বাধ্য ছেলের মতো মাথা নাড়ল। তখনি কেউ ভোরের কোল থেকে রূপকে কেড়ে নেয়। ভোর চাচিমনিকে দেখে ঘাবড়ে যায়। রুবি ভোরকে কিছু না বলে আরিয়ানকে বলে,
-” সব ভুলে গেছো? হাত কাঁপে নি ওর কাছে বাচ্চা দিতে?”
-” না কাঁপে নি। একাই গেছে ছেলে তার ভাইয়ের কাছে; তাও হাসিমুখে।”
আরিয়ানের স্পষ্ট জবাবে রুবি জ্বলে ওঠে। ভোর মিনমিনে গলায় বলে,
-” ভোর ভেরি ভেরি স্যরি! আর কখনো মারবো না রূপকে। অনেক ভালোবাসবো! স্নেহ করবো!”
রুবি ভোরের আদুরে গলায় গলে না,
-” তোমার ভালোবাসা স্নেহের দরকার নেই আমার ছেলে মেয়ের! ওদের থেকে দূরে থাকবে।”
আরিয়ান শক্ত গলায় বলে,
-” রুবি বড্ড বাড়াবাড়ি করছো তুমি!”
-” ভোর সত্যিই অনেক স্যরি!”
রুবি ছেলেকে নিয়ে হনহন করে চলে যায়। ভোর ভরা চোখে সেদিকে তাকিয়ে দেখে। কেউ তার কাঁধে হাত রাখলে ভোর মাথা উঁচিয়ে তাকায়। আম্মুকে দেখে ভোর বলে,
-” আমি আব্বুর কাছে যাবো!”
পাতা তার মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়।
আরিয়ান এগিয়ে এসে ভোরকে কোলে তুলে নিয়ে গালে চুমু দিয়ে বলে,
-” চাচিমনির কথায় রাগ করে না ভোর! এখন একটু রেগে আছে। পড়ে আদর করে পুষিয়ে দেবে!”
ভোর মাথা নাড়ে। আবার বায়না করে বাবার কাছে যাবে। আনিকা চায়ে চুমুক দিয়ে বলে,
-” বড় চাচ্চু তো সেই সকাল সকাল রেডি হয়ে অফিসে চলে গেল!”
পাতার ভ্রু কুটি কুঁচকে যায়।
-” অফিসে গেছে? এতো সকালে?”
-” হুম! আমি ডাকলাম কতবার করে! ভাই ফিরেই তাকালো না। হনহনিয়ে চলে গেলো।”
আরিয়ানের কথায় ভোর এবার কেঁদে ওঠে। বাবা তাকে রেখে চলে গেছে! আব্বু তাঁর উপর রাগ করে চলে গেছে!
হঠাৎ ভোরের কান্না দেখে পাতা, আরিয়ান ঘাবড়ে যায়। আনিকা নাক মুখ কুঁচকে বলে,
-” বড় চাচ্চু ঠিকই বলে। ভোর ছিঁচকাদুনে ছেলে। কিছু হলেই ভ্যাঁ ভ্যাঁ করে কাঁদবে!”
-” বস? হঠাৎ ফ্ল্যাটে উঠার সিদ্ধান্ত নিলেন যে?”
-” তোমাকে যেটা বলেছি সেটা করো সুজন! বাড়তি কথা আমি শুনতে পছন্দ করি না। বিকেলের মধ্যেই ফ্ল্যাটের সব কিছু গুছিয়ে রাখবে। কাল সকালেই ফ্ল্যাটে উঠবো।”
সুজন সায় জানিয়ে চলে যায়। কিন্তু সে ভেবে পায় না হঠাৎ বস কেন ফ্ল্যাটে উঠবে? এতো বড় বাড়ি রেখে ফ্ল্যাট! স্যারের দুটো ফ্ল্যাট আছে। একটা অফিসের কাছেই; বিদেশি ক্লায়েন্ট, বায়ারদের আগমন ঘটলে সেটায় থাকার ব্যবস্থা করা হয়। আরেকটা মেইন রোডে।
সুজন বেরিয়ে যাওয়ার পর অরুণ ল্যাপটপে মনোযোগ দেয়ার চেষ্টা করে। কিন্তু মনোযোগী হতে পারে না।হবেই বা কি করে প্রাণভোমরার সাথে কথা হয় নি সকালে। মন ভরে আদর করে নি। চুপচাপ চলে এসেছে। পণ করেছে কথা বলবে না যতক্ষণ পর্যন্ত ছেলে ভুল বুঝতে পারে। শত চেষ্টা করার পরেও কাজে মন না দিতে পাড়ায় অরুণ উঠে দাঁড়ালো। কেবিন থেকে বেরিয়ে আসে। পিয়নকে ডেকে কড়া লিকারের চা দিতে বলে। মিসেস রুনার ডেস্কটপে গিয়ে কিছু অফিসিয়াল কথা বলে। হঠাৎ অতিপরিচিত প্রিয় ডাক ভেসে আসে কর্ণগহ্বরে! অরুণ এগিয়ে আসে।
ভোর আব্বু বলে ঝড়ের বেগে ছুটে আসে। অরুণের পা জড়িয়ে কেঁদে ওঠে ঝরঝরিয়ে। অরুণ ভোরকে তুলে আদরে ভাসিয়ে দেয় না।
শান্ত ভঙ্গিতে বোঝার চেষ্টা করে, কি হলো? সামনে তাকাতেই পাতাকে দেখে; আসছে হনহনিয়ে। লং টি শার্টের সাথে সালোয়ার! গায়ে বড় শাল জড়ানো! অরুণ অবাক হয়! এরা এখানে?
পাতা এগিয়ে আসে। হাঁপিয়ে গেছে সে।
-” ঘুম থেকে উঠেই আপনার খোঁজে। আব্বু যাবো আব্বু যাবো বলে কাঁদছে। কিছুতেই বোঝানো যাচ্ছে না। মনে হয় ভোর দুধের শিশু আর আপনি তার মা! নিন একটু শান্ত করুন!”
বলেই পাতা মিটমিট করে হাসে। অরুণ ছেলেকে কোলে তুলে নিয়ে চুমু খায়। তবে কথা বলে না। ভোর বাবার গলা জড়িয়ে বলে,
পাতা বাহার পর্ব ৪৭
-” আমি রূপ, চাচ্চু, চাচিমনি সবাইকে স্যরি বলেছি! সত্যিই বলছি! আম্মুকে জিজ্ঞেস করো! ভোর আর রূপকে মারবে না। শুধু ভালোবাসবে আর স্নেহ করবে। আনি’কেও!”
অরুণ পাতার দিকে চায় সন্দেহ চোখে। পাতা পলক ঝাপটিয়ে আশ্বস্ত করে। অরুণের অধরকোণে হাসি ফুটে ওঠে। ছেলেকে পাঁজা কোলে নিয়ে কপালে চুমু দিয়ে ডাকে,
-” আমার কলিজা! আমার আব্বু!”