প্রেমসুধা পর্ব ৫২

প্রেমসুধা পর্ব ৫২
সাইয়্যারা খান

জড়সড়ভাব নিয়ে চেয়ারটার এক কোণে বসা পৌষ। ডাক্তার রিপোর্ট দেখছেন। তায়েফা সেদিকেই তাকিয়ে আছে আশানুরূপ কিছু কথা শুনতে।
সকাল দশটা নাগাদ মিথ্যা বলে এখানে এসেছে পৌষ। তৌসিফ আজ নয়টায় বের হয়েছে। পৌষ তখন জানিয়েছে ভার্সিটি যাবে। ড্রাইভারকে বলে রেখে গিয়েছে তৌসিফ। ও যাওয়ার আগ মুহুর্তে পর্যন্ত পৌষ’কে জিজ্ঞেস করেছিলো, কোন সমস্যা কি না? পৌষ মাথা নেড়ে না বলেছে। তৌসিফ কিভাবে জানি বুঝে যায় সবটা। পৌষ স্বাভাবিক থাকার চেষ্টা করেছিলো৷
সেই দশটায় এসে এখন বাজে দুপুর একটা৷ টেস্ট করে ঘন্টার মধ্যেই রিপোর্ট করিয়েছে তায়েফা। তৌসিফ বউ একা ছাড়ে না। এরমধ্যে তিনবার ফোন এসেছে। পৌষ’কে খেতে বলেছে তৌসিফ। দিন দুই ধরে তৌসিফ কিছু একটা করেছে যার ফলে সে ব্যস্ত নাহয় পৌষ’র মিথ্যা ধরতে তার ততটাও কষ্ট হতো না।
তায়েফা পৌষ’কে দেখেই হাত ধরলো। শান্ত স্বরে বললো,

— চিন্তা করিস না।
ফুলা চোখে তাকালো পৌষ। টেস্ট করার সময় থেকেই কাঁদছে ও৷ বুকটা ফেটে কান্না আসছে৷ মনে হচ্ছে রিপোর্ট খারাপ আসবে৷ যদি ও মা হতে না পারে তখন কি হবে? যদি তৌসিফ ছেড়ে দেয়? পৌষ তো এত ভালোবাসা ছাড়তে চায় না৷ তার মনটা দিন দিন লোভী হচ্ছে। ভালোবাসার লোভ তাকে আঁকড়ে ধরেছে।
ডাক্তার তাকালো পৌষ’র দিকে। পৌষ’র বুকটা তখন চিলিক দিয়ে উঠে। ডাক্তার শুধু বললো,
— মিসেস তালুকদার, আই থিংক আপনার ছোট্ট একটা সমস্যা হয়েছে।
মুখে হাত চেপে এবার কেঁদে উঠলো পৌষ। এতক্ষণের চেপে রাখা কান্নাটা এবার বেরিয়ে এলো। তায়েফা পৌষ’কে উঠে জড়িয়ে ধরেই টের পেলো সমান তালে কাঁপছে পৌষ।
তায়েফা ওকে শক্ত করে ধরে। ডাক্তারের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করে,

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

— কি সমস্যা? কি হয়েছে?
ডাক্তার রায়া যেন বিপাকে পরলো৷ ঝটপট গলায় বললো,
— মিসেস তালুকদার প্লিজ শান্ত হন৷ আমার কথাটা শুনুন৷ ভয় পাওয়ার কিছু নেই। শুনতে পাচ্ছেন আপনি।
পৌষ তায়েফা’কে জড়িয়ে ধরেই বলে,
— আপা, আমার ভালো লাগছে না।
— আচ্ছা। বাড়ী যাব। রিপোর্টটা শুনে যাই। একটু বস সোনা।
পৌষ’র চোখ মুছিয়ে বসলো তায়েফা। ডাক্তার রায়া পৌষ’র দিকে তাকিয়ে বললো,
— এত ভীতু তুমি। আমি কিন্তু সাহসী ভেবেছিলাম। তৌসিফ তালুকদারের বউ এত নরম হলে হয়?
পৌষ মনে মনে বললো,

— জামাইকে তো আমি নাটাই এর মতো ঘুরাই। শুধু এখন একটু ভয়ে আছি।
ডাক্তার রায়া আবারও বললেন,
— তোমার তো আয়রন ডেফিসিয়েন্সি আছে। আই থিংক এটা জানো।
পৌষ মাথা নাড়ে। নাক টেনে বললো,
— উনি ডাক্তার দেখিয়ে ঔষধ খায়িয়েছেন। এখনও চলছে।
— গুড। এছাড়া আরেকটা সমস্যা হচ্ছে তুই যথেষ্ট দূর্বল পৌষরাত। খাওয়া দাওয়া ঠিক মতো করো। তোমার বডি তৈরী নয় বেবি ক্যারি করার জন্য। কিছু মেডিসিন দিচ্ছি এগুলো স্টার্ট করে দাও। পনেরো দিন পর হাসবেন্ড সহ এসো।
পৌষ মাথা নাড়ে। সস্তির শ্বাস ফেলে জিজ্ঞেস করে,

— বাবু হতে তো সমস্যা নেই তাই না?
— বোকা মেয়ে। কখন বললাম সমস্যা? এসব টুকটাক সমস্যা তো থাকেই। ফ্যাট জাতীয় খাবার একদমই ধরবে না কিন্তু স্বাস্থ্য সম্মত খাবার খাও৷ বডি আগে ঠিক করো। বাচ্চা তো আল্লাহ যখন খুশি হবেন তখন দিবেন।
পৌষ চুপ করে রইলো৷ তায়েফা আলাপ চালালো ডাক্তার রায়া’র সাথে। পৌষ এক ধ্যানে ভাইব্রেট হওয়া ফোনটা দেখছে। ওখানে ভেসে উঠছে তৌসিফের নাম্বার।

বিকেলে ঘুমেয়েছে পৌষ। বাইরে কিচিরমিচির শব্দ শোনা যাচ্ছে। ঘুমের ঘোরে অল্প কাঁপে পৌষ। জানালা খোলা থাকায় ঠান্ডা বাতাস বইছে। গায়ে কম্বলটা নেই। থাকলে হয়তো একটু আরাম লাগতো। অলস পৌষ উঠে না। গায়ে কিছুই নেয় না। ঠান্ডা বাতাসে আরেকটু কুঁকড়ে গিয়ে তৌসিফে’র বালিশে মুখ গুজে দিলো। এই চরম শীতল মুহুর্তে তৌসিফ নামক পুরুষটার কথা ভীষণ মনে পরলো ওর। মনে পরলো তাকে যত্নে আগলে রাখা ঐ উষ্ণ বুকটার কথা। সেই গভীর আলিঙ্গনের কথা। পৌষ মনে মনে বিষাদে পরিপূর্ণ হয়েও হলো না। বালিশ থেকে আসা ঘ্রাণটা যেন তাকে বার বার মনে করাচ্ছে তৌসিফ তার কাছেই আছে। অতি নিকটে।

ঘুমটা তখন আধ কাঁচা। না জাগ্রত না গভীর। ধুপধাপ পা ফেলে কেউ এসেছে তা টের পেলেও চোখ খুলার মতো ততটাও সজাগ নয় পৌষ। স্ব শব্দে যখন দরজাটা বন্ধ হলো তখন ঘুমের মাঝেই কেঁপে উঠে ও। পিলে চমকে উঠে হুরমুরিয়ে উঠে। চোখ তখনও বন্ধ। পৌষ চোখ খুলার আগেই ওর গালটায় চাপ পরে। আস্তে ধীরে চোখ খুলে মুখে “উউ” উচ্চারণ করলেও ছাড়া পেলো না বরং চাপটা একটু বাড়লো। দীর্ঘ দিন অসুস্থ থাকায় শরীরে বল পায় না পৌষ। চোখটা খোলা মাত্রই দৃশ্যমান হলো স্বয়ং তৌসিফ। পৌষ দুই হাত দিয়ে তৌসিফে’র কোমড়টা পেঁচিয়ে ধরে। হঠাৎ উঠায় ওর মাথা ঘুরছে। শরীর ছেড়ে দিয়ে তৌসিফে’র উপর জড়িয়ে যেতেই তৌসিফ গালটা ছেড়ে নিজের হাতটা রাখলো পৌষ’র মাথায়। সন্তপর্ণে ওকে নিয়ে শুয়ে পরলো। পায়ের জুতাটা তখনও পায়েই রয়ে গেছে। খোলার সুযোগ হয় নি তার।

পৌষ ছাড়ে না বরং আরেকটু ঘেঁষে মাথাটা পেট থেকে বুকে আনে। ভয়ে রীতিমতো ভেতরে ভূমিকম্প হলেও প্রকাশ করছে না। হাজার ফটর ফটর করুক না কেন পৌষ জানে সত্যি তো এটাই যে তৌসিফ’কে এখনও জমের মতো ভয় পায় সে।
আজ না বলে বাইরে গিয়েছিলো। তৌসিফে’র এত এত কল ধরা হয় নি। বাসায় এসে কল দিলেও তৌসিফ রিসিভ করে নি। বুয়ারা জানিয়েছে তাদের ফোন দিয়েই তৌসিফ জেনেছে যে তায়েফা’র সাথে গিয়েছে পৌষ। কোথায় গিয়েছে সেটা বোধহয় জানতে তার আর বাকি রয় নি তাই শেষ কলটা দিয়েছে। পৌষ তখন কলটা রিসিভ করে কানে ধরা মানেই শোনা গিয়েছে যথেষ্ট ঠান্ডা এক কণ্ঠ,

“বাসায় যাও এখনই।”
পৌষ’র সারা শরীর তখন বরফের মতো ঠান্ডা হলো। দরদরিয়ে ঘাম ছুটে গেলো তখন। তারাতাড়ি তায়েফা’কে নিয়ে ছুটে এসেছে। সেই থেকে বাড়ী ফিরে কতই না কল দিলো রিসিভ হয় না।
বুকের ভেতর নাক, মুখ ঘঁষে পৌষ। চুলের ভাজে তখন তৌসিফে’র হাত। পৌষ হাত তুলে কোমড় থেকে এবার পিঠ জড়িয়ে ধরে। আস্তে করে গলায় মুখ গুজে রাখে। ঘন ঘন শ্বাস ফেলে তৌসিফ নিজেকে শান্ত করে। পৌষ পিঠে হাত বুলায়। আস্তে করে হাত এগিয়ে এনে শার্টের বোতাম গুলো খুলতে থাকে। তৌসিফ কিছুই বলে না। বুক উন্মুক্ত করে মাথা রাখে সেখানে। তৌসিফে’র হাত তখন চুল ছেড়ে এলোমেলো বিলি কাটছে।
রাগটা হয় তো পরে গেলো এখানেই। কথার মারপ্যাঁচ কিছুই তাদের হলো না। যা হলো সবটা অতি শুভ্র, কোমল, নীরব এক উষ্ণ আলিঙ্গন। স্ত্রী খুবই দক্ষ হাতে সামাল দিলো তার রাগী স্বামী’কে। ভালোবাসে ছোট্ট একটু একটু টুকরো করা ভাঙা ভাঙা আদর উড়িয়ে দিলো কতশত রাগ, অভিযোগ।
তৌসিফ আদুরে গলায় ডাকলো,

— হানিই?
— হুম।
— ক্ষুধা লেগেছে।
— উঠুন। রান্না করেছি তো।
— কি কি রাঁধলে?
— শুধু মুড়িঘণ্টাটা আমি করেছি। ঐ দিন না খেতে চাইলেন?
— হুম। মা রান্না করতো। আপারও পছন্দ এটা।
— দেখি, উঠুন। দুপুর গড়ালো সেই কখন৷ আমারও ক্ষুধা লেগেছে?
— খাও তো নি। জানি তো।
— ঘুমিয়ে গেলাম কিভাবে জানি।
— আমি জানি তো কিভাবে ঘুমালে। আসো।
উঠে বসে পৌষ। তৌসিফ দেখলো গালে লাল হয়ে আছে ওর। বুক ফুলিয়ে শ্বাস টানে তৌসিফ। কথা আছে তার পৌষরাতের সাথে। এখন না বললেও তার বলতে হবে। আজই বলতে হবে।
পৌষ হাত বাড়ালো। গা এলিয়ে তখনও তৌসিফ আধ খোলা শর্ট নিয়ে শুয়ে আছে। পৌষ ঝুঁকে তৌসিফে’র জুতা, মুজা খুলতে খুলতে বললো,

— এই জুতাটা ভালো লাগে না আমার৷ কেমন একটা রং। বাঁশ কালার! আপনি দেখে মুখ ঠিক রাখলাম নাহলে এটাকে বাঁশ কালার বলে সম্মান করতাম না।
তৌসিফ ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করলো,
— তাহলে কি কালার বলে অসম্মান করতে?
— * কালার বলে।
তৌসিফ হা করে তাকালো। পৌষ তখন খ্যাঁচখ্যাঁচ করছে সমান তালে। তৌসিফ বেচারা বউয়ের কথা হজম করতে পারলো না। নাক, মুখ কুঁচকে শুধু বললো,
— তুমি এত পাঁজি কেন?
পৌষ হাত বাড়িয়ে দিলো। ভাবখানা এমন সে টেনে তুলবে তৌসিফ’কে। তৌসিফ মাথার পেছনে হাত দিয়ে বললো,
— তুলতে পারবে আমাকে?
পৌষ ভ্রু কুঁচকে বলে,

— কোন সন্দেহ?
— একদমই না।
— তাহলে আর কি। হাত দিন… এক টানে উল্টে দিব আপনাকে। আমাকে দূর্বল ভাববেন না একদমই। আমি কিন্তু একবার এক বুইড়া ব্যাটা’কে দৌড়ানি দিয়েছিলাম। শা*লার ব্যাটা লুঙ্গি তুলে দৌড় দিতে গিয়ে উল্টে পরলো। সেই থেকে আমার সামনে আসে নি ভয়ে।
তৌসিফ ফাটা চোখে তাকিয়ে বললো,
— মানে কি? বুড়ো লোককে দৌড়ানি দিয়েছো কেন?
কোমড়ে হাত দিয়ে পৌষ কটমট করে বললো,

— বাড়ীর সামনের দোকানে দাঁড়িয়ে পান, চা গিলতো আর মেয়ে দেখলেই পুতুপুতু করতো। ছোট্ট ছোট্ট মেয়েদের দেখে টিটকারি মা’রতো। একদিন দেখি পিহা’কে টিটকারি মা’রছে। আইক্কা ওয়ালা বাঁশ নিয়ে দিলাম দৌড়ানি। বারি একটা দিতে পারলে কলিজা আমার ঠান্ডা হয়ে যেতো। আহা….এখনও আশা নিয়ে আছি বুইড়াকে পেলেই ধোলাই দিব নাহলে আমার নামও পৌষরাত হক পৌষ না।
তৌসিফ মুখটা অসহায় করে তাকালো। বউ বলে কি এটা? আইক্কা ওয়ালা বাঁশ নিয়ে নাকি দৌড়ানি দিয়েছে? সেবার সিনিয়র এক ছেলেকে টুনটুনিতে কিক করেছিলো। সেটা আবার গর্ব করে বলে। পৌষ আবার ঝাঁকি দিয়ে বললো,
— কি হলো? হাত দিন।
মাথার পেছন থেকে হাত বের করে এগিয়ে দিলো তৌসিফ। পৌষ দিলো এক টান। তৌসিফ নড়লো না এক ইঞ্চি। পৌষ দাঁত কিটিমিটি করে। ফোঁস করে শ্বাস ফেলে নিজেই বল দিয়ে উঠে তৌসিফ। পৌষ দাঁত বের করে হাসলো। ভ্রু উঁচু করে ইশারা করলো। তৌসিফ বুঝলো হয়তো বউ বলছে, “এই যে দেখলেন উঠালাম আমি”।

— শুনলাম দেশের বাইরে যাচ্ছিস?
তায়েফা’র প্রশ্নে তৌসিফ টিভি থেকে নজর সরালো। এক পলক দেখলো বারান্দায় থাকা পৌষ’কে। ভিডিও কলে শ্রেয়া’র সাথে কথা বলছে। নেটওয়ার্ক ইস্যু হওয়ার দরুন বারান্দায় যাওয়া তার। তায়েফা’র দিকে তাকিয়ে তৌসিফ বললো,

— সারাদিন বাসায়ই থাকে। ভাবলাম ঘুরিয়ে আনি।
— কোথায় যাওয়া হচ্ছে?
— অস্ট্রেলিয়া।
— হজ্জটা সেরে ফেলতি।
— ইনশা আল্লাহ আপা। ইচ্ছে আছে বাচ্চাকাচ্চা নিয়েই যাব।
— ইনশা আল্লাহ। তুসু একটা কথা ছিলো।
তায়েফা ইতস্তত করে কথাটা বললো। তৌসিফ এবার টিভির সাউন্ডটা মিউট করে দিয়ে ঘুরে বসে জিজ্ঞেস করলো,
— কি হয়েছে আপা? সব ঠিক?
— তোকে না বলে পৌষ’কে নিয়ে গেলাম। রেগে আছিস আপা’র উপর? আমি আসলে চাইছিলাম যাতে কোন সমস্যা না হয় তাই..
তায়েফা’র কথা থামিয়ে দিয়ে তৌসিফ বলে উঠলো,

— আমার বউ আমি বুঝে নিতাম আপা। তোমার কষ্ট করার দরকার ছিলো না। আমি জানি তুমি ভালোর জন্য করেছো কিন্তু জানো এখানে সমস্যাটা হবে কোথায়?
তৌসিফে’র কণ্ঠস্বর দৃঢ় এবং রুষ্ট। তায়েফা বুঝে গেলো চট করে। ভাই রেগে গিয়েছে। বউ নিয়ে সে অনেক সিরিয়াস। যাকে মন থেকে একবার গ্রহণ করে তাকে সে ছাড়তে পারে না। এই ক্ষেত্রে পৌষ’কে তৌসিফ একটু বেশিই আপন করেছে তা দেখা যায়। বুঝা যায়। লোকমুখে শোনা যায়।
তৌসিফ তায়েফা’কে উদ্দেশ্য করে বললো,

— আপা, ওর স্বভাব আমার জানা। ওর মাথা থেকে পা সবটা আমার মুখস্থ, ঠোঁটস্থ। এই যে এখন ডাক্তার দেখালে না তুমি, এখন ও এটা নিয়েই পরে থাকবে। সারাক্ষণ ওর মাথায় এটাই ঘুরবে। পা’গল হয়ে যাবে এটার জন্যই। ও আমাকে খুশি করার জন্য এই বাচ্চাই দিতে চাইবে এখন। ওর মাথায় ঢুকে গিয়েছে আমার বাচ্চা চাই। সেই সাথে আমি না বলাতেও নিজে নিজেই ভেবে নিয়েছে হয়তো বাচ্চা না হলে আমি ওকে অবহেলা করব৷ এখানে ওর দোষ নেই আপা। ছোট থেকে আমার তোতাপাখি এভাবেই বড় হয়েছে। ওই বাড়ীতে ওকে বসিয়ে খাওয়ানো হতো না। ওর চাচিরা হাসতে হাসতে হাতে কাজ তুলে দিতো। ওর রান্নার হাত দেখেছো? পাক্কা গৃহিণী। এই হাত শখ করে শেখা রান্নার হাত না। এই হাত চাপে পরে করা রান্নার। আমি চিনি। মায়ের হাতের স্বাদ পাই। ওর লবন দিতে চামচ লাগে না আপা। মায়ের মতো আন্দাজে দিয়ে দেয়। ওর চামড়ায় ছিটাফোঁটা দেখো। বহু বছর পুরাতন তেলের ছিটার দাগ। এগুলো তাহলে কবে থেকে করে আসছে ও বলো? নিশ্চিত স্কুলে থাকাকালীন সময় থেকে। ওর ভাই-বোনরা থাকায় আর চাচারা হয়তো কিছুটা সদয় ছিলো।

একবার ভাবো আমার মতো বিবাহিত, সংসার করা, এলাকায় যার নামে নারী ঘটিত ব্যাপার যারা মুখে মুখে তার কাছে কেউ মেয়ে দেয়? দেয় না কিন্তু ভাতিজী দিয়ে দিলো তারা। হ্যাঁ, আমি স্বীকার করি আমি অপরাধী। চাপ দিয়েছি কিন্তু কতটা আপা? ওটা চাপ না বরং লোভ ছিলো। তারা এখন বুক ফুলিয়ে হাঁটে আর বলে, “চাচা হওয়ার দায়িত্ব পালন করেছি। ভাতিজী বড় ঘরে দিয়েছে। সুখে আছে। ভরপুর সংসার”। কোথায় একটাবার নাহয় আমার অনুপস্থিতিতে সেই চাচারা জোর করেই নিয়ে যেতো। যেভাবে জোর করে বিয়ে দিলো।

ওকে আমি বিয়ের আগে ভালোবাসি নি আপা। ভালোবেসেছি বিয়ের পর। ওর প্রতি আমার ভালোবাসা পবিত্র। ওর সাথে জড়িয়ে আছে এমন সবটার দায়িত্ব আমার। বাচ্চা আমার চাই কিন্তু পৌষরাতের স্বাস্থ্যের বিপরীতে গিয়ে না। আমি চেয়েছি বাচ্চা যাতে ও প্রস্তুত থাকে কিন্তু এখন ও উঠেপড়ে লাগবে বাচ্চার জন্য। ওকে ফিরিয়ে দেয়ার সাধ্য আমি তৌসিফ হারিয়েছে বহু আগে। পাঁজি, দুষ্ট আর দূরন্ত এই তোতাপাখি আমি পুষে রাখি যত্নে আপা। ওর অযত্ন হবে এই দায় আমি নিতে পারব না। সৃষ্টিকর্তা সেই ক্ষমতা আমায় দেয় নি।
তায়েফা থম ধরে গেলো। আসলে ও বুঝতেই পারে নি তৌসিফ যে এভাবে ভেবেছে। মূলত স্বামী স্ত্রীর মাঝে ঢুকাটাই উচিত হয় নি। তায়েফা চেয়েছিলো একটু গুছিয়ে দিতে কিন্তু ঝামেলা পাকিয়ে যাবে এটা ওর ধারণার বাইরে ছিলো। তৌসিফ বুঝে তাই তায়েফা’র হাত ধরে বললো,

— আমি জানি তুমি ইচ্ছে করে করো নি।
— কি ঝামেলা পাকিয়ে দিলাম বল তো সোনা।
— কোন ঝামেলা না। বললাম না পুষে রেখেছি এই পাখি। আমি বুঝিয়ে বলব ওকে কিন্তু কথা হলো বিনিময়ে তোমার তুসু’র ডুগডুগি বাজাবে সে।
তায়েফা মৃদু হাসলো। তৌসিফ যে এতটা ভালোবাসে পৌষ’কে তা ধারণার বাইরে ছিলো ওর।
বারান্দায় দাঁড়িয়ে পৌষ নাক টেনে বললো,
— ভাবী হেমু ভাইকে বলবে আমার এখানে আসতে তোমাদের নিয়ে।
— বলব তো। বাবুর চল্লিশ দিন হোক আগে।
— আচ্ছা ভাবী, বাবু জ্বালায় কেমন?
— এই যে সারারাত ঘুমায় নি৷ এখন ঘুমাচ্ছে। আবার রাতে উঠে যাবে। তোর ভাই হাঁটে কোলে নিয়ে। ইনি, মিনি এসেছে দেখ।

প্রেমসুধা পর্ব ৫১

পৌষ দেখলো জমজ দুটো একসাথে ভাতিজার গালে চুমু দিচ্ছে। বুকটা জুড়িয়ে যায় এই দৃশ্য দেখে। পৌষ মনে মনে হাসে। তার বাচ্চা হলে সে কলিজায় পুরে রাখবে। তৌসিফ তখন আরো ভালোবাসবে। পৌষ আবার ভাবে, যদি বাচ্চা হতে গিয়ে সে ম’রে যায় তখন কিভাবে হবে ভালোবাসা? কতই তো খবর দেখায়। ইদানীং আবার এসবই মাথায় ঘুরে।
পৌষ ভয় পায় পরক্ষণেই ভাবে, “লাগলে ম’রণ হোক তবুও সে আমার হোক”।

প্রেমসুধা পর্ব ৫৩