পাতা বাহার পর্ব ৫১

পাতা বাহার পর্ব ৫১
বেলা শেখ 

টিভিতে ‘টম এন্ড জেরী’ কার্টুন চলছে। জেরী চিজের স্লাইড হাতে নিয়ে দৌড়াচ্ছে আর টম বরাবরের মতো তাকে ধাওয়া করছে! অরুণ সোফায় বসে টি টেবিলে পা তুলে টিভি দেখছে। টি টেবিলে তাঁর পা ঘেঁষে পাতাবাহার বসে; আড়চোখে সেও টিভি দেখছে! আর অরুণের কোলে মাথা রেখে ভোর শুয়ে টম জেরী দেখছে। অধরকোনে তাঁর মিষ্টি হাসি! একটু পর জেরীর দুষ্টুমি দেখে ভোর শরীর দুলিয়ে খিলখিলিয়ে হেসে ওঠে। বাবাকে এটা ওটা বলে! অরুণ ছেলের চুলের ভাঁজে হাত গলিয়ে হু হু করে জবাব দেয় শুধু। ভোর টি টেবিলে শুয়ে থাকা পাতাবাহারকে একনজরে পর্যবেক্ষণ করে বলে,

-” আব্বু আমরা একটা ইঁদুর ছানা নিয়ে আসবো বাড়িতে। নাম রাখবো চুচু! তখন পাতাবাহার চুচুকে দৌড়ানি দিবে! চুচু দুষ্টুমি করবে তাহলে তো টিভিতে টম অ্যান্ড জেরি দেখতেই হবে না। আমাদের বাড়িতেই ‘পাতাবাহার অ্যান্ড চুচু’ দেখবো। আইডিয়াটা দারুণ না?”
অরুণ ভোরের গাল‌ টিপে সায় জানালো। ব্যস ভোরের পরিকল্পনা শুরু! চুচু’র জন্য কোথায় কিভাবে ঘর বানাবে! অরুণ চুপচাপ শুনে যায়। ভোর তাঁর পরিকল্পনা পেশ করে আবার টিভি দেখায় মনোযোগী হয়! অরুণ টিভির ভলিউম কমিয়ে ভোরকে বলে,
-” কলিজা এ বাড়িতে তোমার কেমন লাগে?”
ভোরের হাসিখুশি মুখটায় নিমেষেই মলিনতার ছোঁয়া লেগে যায়। সোজা হয়ে বাবার চোখে চোখ রেখে অভিযোগের সুরে বলে,

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

-” একটুও ভালো লাগে না। আনি, রূপ, দাদি, চাচি, চাচ্চু নেই! মিনু খালা ভারি কাক্কুও নেই! মিনু খালা ভারি কাক্কু নিশ্চয়ই ওদের ছোট্ট বাবুকে অনেক অনেক আদর করছে। ভোরকে তো ভুলেই গেছে। আনি, রূপও ওই বাবুর সাথেই খেলছে! ভোরের একটুও ভালো লাগ না। ভোর ওই বাড়িতে থাকতে চায়। একদম আগের মতো। ভোর কাউকেই মারবে না। একটুও দুষ্টুমি করবে না! আব্বু আমরা ওই বাড়িতে যাই? এখানে খেলার কেউ নেই। ও আব্বু প্লিজ প্লিইজ?”
অরুণ ঝুঁকে ছেলের কপালে চুমু দিয়ে বলে,

-” ধরো তোমার কোন খেলার সাথী এলো তখন ভালো লাগবে?”
ভোরের ছোট কপাল কুঞ্চিত হয়! পিটপিট করে তাকিয়ে বলে,
-” আনি’কে আনবে? আনি এলে ভোরের ভালো লাগবে। রূপকে এনো না। ও পঁচা!”
অরুণ মুচকি হাসলো ভোরের নাক টিপে বলল,
-” না আনি ! না রূপ! অন্য একজন আসবে।”
ভোর ভাবনায় পড়ে কে আসবে? মিনু খালার বাবু আসবে না তো? ভোরের ভাবনাকে পেছনে ফেলে অরুণ ঝুঁকে ভোরের কানে ফিসফিস করে বলল,
-” ভোরের একটা ভাই অথবা বোন আসবে!”

ভোরের চোখের আকার বড় হয়। চোখে মুখে দ্যুতির ঝলকানি দেখা মিলবে মিলবে ভাব! অরুণের আঁখি যুগল ভোরের মায়াঘেরা মুখটাতেই নিবদ্ধ! পড়ে নিতে চায় ছেলের চোখ মুখের ভাষা। ভোরের চোখের আকার শিথিল হয়। দ্যুতি ছড়িয়ে না পড়ে উবে গেল। মলিন মুখটা দেখে অরুণের ঠোঁটের কোনার মুচকি হাসি গায়েব হয়ে যায়। ভোর স্বাভাবিক ভাবেই জিজ্ঞেস করে,
-” মিনু খালার মতো আম্মুর টাম্মি থেকেও বাবু হবে?”
অরুণ ভারী শ্বাস ছাড়লো। মুখে না বলে চোখের পাতা বন্ধ করে সায় জানালো! ভোরের ঠোঁট গোল করে ‘ওহ্’ বলে কাত হয়ে আবার টিভি দেখায় মনোযোগী হওয়ার চেষ্টা করে। কিন্তু মনোযোগ দিতে পারে না। তার ছোট মাথায় বড় বড় চিন্তা নামক উদ্বায়ী বস্তু ঘুরপাক খায়!

অরুণের বুকটা ধ্বক করে ওঠে। ছেলের চোখে মুখে নেই কোনো আনন্দ মিছিল শুধু একরাশ মলিনতা! অরুণ টিভি অফ করে দেয়! ভোরের মাঝে ভাবান্তর হয় না। এক ধ্যানে তাকিয়েই আছে টিভির দিকে। টিভি বন্ধ করেছে এই বোধটুকু বোধহয় ধরতে পারে নি। অরুণ ছেলেকে তাঁর দিকে ফেরায়! সযত্নে তুলে কোলে বসিয়ে ছোট মুখটা আঁজলায় ভরে এক বুক স্নেহ ঢেলে চুমু দেয় দু গালে! আদুরে গলায় বলে,
-” আমার কলিজা খুশি হয়নি তাঁর ভাই অথবা বোন আসবে শুনে?”
-” হয়েছি তো! ভোর অনেক হ্যাপি!”

মিষ্টি হেসে বলে ভোর! তবে অরুণ সেই হাসিতে প্রাণ খুঁজে পেলো না। অরুণ ছেলের গাল ছাড়ে না। ঝুঁকে ছেলের ছোট্ট নাকে নাক বারি দিয়ে বলে,
-” কই আমার কলিজার ঠোঁটে হাসি থাকলেও চোখে তো দেখতে পাচ্ছি না!”
ভোর বাবার নাকে দাঁত বসিয়ে হেসে বলে,
-” আব্বু চোখ আবার হাসে নাকি?”
অরুণ হাসে না। শান্ত গলায় সুধায়,
-” কি হয়েছে আমার আব্বুর? বলো আমাকে?”
ভোর বাবার হাত গাল থেকে ছাড়িয়ে নেয়। বাবার গলা জড়িয়ে কাঁধে মুখ লুকায়; সাথে নোনা জলে টইটুম্বর নেত্রযুগল! মিনমিন করে বলে,
-” কিছুই হয় নি আব্বু! ভোর হ্যাপি তো!”

অরুণ কিছুই বলে না আর। চুপ থাকে ছেলেকে বুকে জড়িয়ে! ভোর সেভাবেই মুখ লুকিয়ে রাখে। কিছু বলে না; বাবাকেও ছাড়ে বরং আস্তে আস্তে তার ছোট বাঁধন মজবুত হয়! সময় গড়ায়। বাবা ছেলের নিরবতায় গুমট আবহাওয়া! ভোরের টইটুম্বুর নেত্রযুগলে বর্ষণ নামে দুই ফোঁটা! কাঁপা কাঁপা গলায় বলে,
-” আব্বু! বাবু আসলে আম্মু ভোরকে কম কম ভালোবাসবে ? কম আদর করবে?”
-” তোমার কি মনে হয়?”
শান্ত নিরেট গলা অরুণের! তাঁর মুখের আদলটাও অসম্ভব স্বাভাবিক! সে জানে তাঁর ছেলের ছোট্ট মনে কি চলছে।ছেলের প্রতিটি শ্বাস নিঃশ্বাস তাঁর অতি চেনা!
ভোর পূর্বের তুলনায় ধীমে সুরে বলে,

-” যে বাবুটা আসবে সে তো আম্মুর টাম্মি থেকে আসবে। আম্মু তাকে বেশি ভালোবাসবে আদর করবে! আমি তো আম্মুর টাম্মি থেকে আসি নি। তাই…”
বাক্য শেষ করে না ভোর! থেমে যায়। আশায় থাকে বাবা হয়তোবা বলবে আম্মু আগত বাবুকে না ভোরকেই বেশি ভালোবাসবে আদর করবে! কিন্তু অরুণ কিছুই বলে না। চুপচাপ থাকে। ভোর আবার বলে,
-” তুমিও তো দাদির টাম্মি থেকে আসো নি তাই তো দাদি তোমাকে চাচ্চু ফুপ্পির থেকে কম করে ভালোবাসে। ভোরকেও আনি রূপের থেকে কম করে ভালোবাসে! আচ্ছা আব্বু তুমি কার টাম্মি থেকে এসেছো?”
-” তোমার বড় দাদির! স্বপ্না চৌধুরী! ছবি দেখিয়েছিলাম না তোমাকে?”
-” হুম। বড় দাদিও দাদুর মতো আল্লাহর কাছে চলে গেছে তাই না?”
-” হুম!”

ছোট জবাব অরুণের। তাঁরপর আবার পিনপিন নীরবতায় ড্রয়িং রুম। অরুণ সময় নিয়ে নিজেকে সামলায়! ভোরকে জিজ্ঞেস করে,
-” এখন বলো এসব বড় বড় কথা আমার ছোট মানিকের ছোট মাথায় কিভাবে এলো? কে বলেছে এসব কথা হুম?”
-” সবাই বলে! আমি শুনেছি।”

অরুণের দম বন্ধ হয়ে আসে। নিজের তিক্ত অভিজ্ঞতা মস্তিষ্কে কিলবিল করে। ছোটবেলায় সেও অহরহ শুনেছে এসব। পাড়া প্রতিবেশীর করুণ চাহনি! মা হীন সৎ মায়ের ঘরের ছেলে বলে মাথায় হাত বুলিয়ে সহানুভূতি দেখিয়ে ছোট মায়ের কান ভারী করা। তাকেও এটা ওটা বলে খুঁচিয়ে বিদ্ধ করতে ভুলতো না। আদরের ছেলেটির সাথেও এরকম কিছু না হয় তাই তো দূরে আসা। রুবির পাতাকে ভড়কানোর প্রচেষ্টা অরুণকে পুরনো স্মৃতিচারণ করিয়েছে। অরুণ দেড়ি করতে চাই নি কিন্তু দেড়ি তো হয়েছে!
-” এই সবাই কে কে সোনা?”
ভোর জবাব দেয় না বাবার কথায়। উল্টো প্রশ্ন করে,
-“বাবু এলে তুমিও কি ভোরকে ভুলে যাবে আব্বু?
-” তোমার কি ধারনা?”

পাল্টা প্রশ্নে ভোর নাখোশ! বাবা কি বলতে পারলো না যে তার কলিজা সবার আগে। ভোর বাবার কাঁধ থেকে মুখ সরিয়ে মুখোমুখি হয়! গালে কামড় বসিয়ে বলে,
-” আমার আব্বু সবার চেয়ে বেশি ভালোবাসবে আমায়। নইলে ভোর অনেক দূরে চলে যাবে! কক্ষনো আসবেনা।”
অরুণ শান্ত চোখে ছেলের দিকে তাকিয়ে স্মিত হাসে। চোখের কার্নিশ বেয়ে গড়িয়ে পড়ে নোনাজল। ভোর মুছে দেয় হাত দিয়ে। যেখানে শক্ত করে কামড় দিয়েছিল সেখানে চুমু দেয় গোটাকয়েক। অরুণ ছেলের মাথা বুকে চেপে বলে,

-” আমার কলিজা! আমার মানিক সোনা। আমার আব্বু।”
ভোর মুচকি হাসে! অরুণ সরকার আবার ডাকে,
-” আমার জান। যে আসবে সে তোমার ভাই/বোন! তোমাকে ভাইয়া ডাকবে ভোর। তোমাকে অনেক ভালোবাসবে মিলিয়ে নিও! বাবা সবার কথায় কান দিতে নেই। তুমি তোমার আব্বুর কথা শুনিও শুধু। আর তোমার আম্মু! তোমাকে অনেক ভালোবাসে। তোমার ভাই/বোন আসার পর তোমার কখনো যদি মনে হয় তোমার আম্মু তোমাকে কম ভালোবাসে। আদর যত্ন কম করে তুমি তাকে কিছুই বলবে না। তবে হ্যাঁ তুমি আমাকে জানাবে একান্তে! জানাবে না?”

ভোর ভেবে মাথা কাত করে সম্মতি জ্ঞাপন করে। অরুণ তাঁর মাথায় হাত বুলিয়ে বলে,
-” তোমার দাদি আমাকে কম ভালোবাসে না। তোমার চাচ্চুর মতো বেশি না বাসলেও ভালোবাসে। যথেষ্ট। কলিজা? বাইরের মানুষের কথা শুনতে নেই। ওরা চায় ভোর কাদুক! ভোর স্যাড ফেস বানিয়ে ঘুরুক! তাই এসব পঁচা কথা বলে! তুমি তো আমার স্ট্রং বয়! তুমি কাঁদবে না। তুমি ওসব কথা শুনবেই না। শোন ভোর? ছোট বাবুদের অনেক যত্ন নিতে হয়! দেখো নি ছোট রূপকে কিভাবে তোমার চাচিমনি যত্ন করতো? ছোট বাবু খুব নাজুক হয়! হাঁটতে জানে না । কথা বলতে পারে না। ও যদি ব্যাথা পায় কিভাবে বলবে? তাই মায়েরা একটুখানি বেশি করে যত্ন নেয়।

তোমার আম্মু তোমাকে ভালোবাসে।এখন সে যদি বাবুকেও ভালোবাসে তাঁর মানে এটা নয় তোমাকে ভালোবাসবে না। তার পরেও তোমার যদি মনে হয় কম ভালোবাসে তোমায়; তুমি আমাকে বলবে! আমি তোমার আম্মুকে বকে দিবো। যে কলিজার আম্মু তুমি কলিজাকে বেশি বেশি সবচেয়ে বেশি ভালোবাসবে। বুঝতে পেরেছো?”
ভোর মুচকি হেসে মাথা নাড়লো। সে বুঝতে পেরেছে। আম্মু বাবুকেও ভালোবাসবে আবার ভোরকেও! ইকুয়াল ইকুয়াল? নাহ্! ভোর আম্মুর কাছে জেদ করবে আম্মু যেন ভোরকে একটু বেশি ভালোবাসে। সেও বাবুকে একটু বেশি ভালোবাসবে!

অরুণ ছেলের মুখাবয়ব পর্যবেক্ষণ করে অভিজ্ঞ নজরে। নাহ্ এবার মলিনতার ছোঁয়া নেই! আছে এক বুক আশা! অরুণ দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে। কি হবে ভবিষ্যতে? ভোরের প্রতি কি পাতার টান কমে যাবে নিজ সন্তানের আগমনে? যেতে পারে! বাস্তবতা। অস্বাভাবিক কিছুই নয়। নিজ সম্পর্ক! রক্তের সম্পর্ক, নাড়ির টান বলেও কিছু হয়! অরুণ ভাবতে চায় না। সে শুধু পাতার উপর ভরসা রাখতে চায়। আর উপর ওয়ালার কাছে লাখো কোটি দোয়া প্রার্থনা করে!
-” আব্বু ভাই আসবে নাকি বোন?”
অরুণ ভাবনাকে পেছনে ফেলে মুচকি হেসে বলল,

-” তোমার কি চাই? ভাই না বোন?”
-” ভোরের বোন চাই! অনেক কিউট। অনেক আদুরে! যে শুধু ভোরের সাথেই খেলবে। ভোর বকলেও কাঁদবে না, মারলেও না!ভোর তাকে অনেক ভালোবাসবে।”
উচ্ছ্বাসিত গলায় বলে ভোর! অরুণের কোল থেকে নামতে উদ্দত হয়। অরুণ জিজ্ঞেস করে,
-” বোনকে কেউ বকে? মারে?”
-” না তো শুধু ভোর বাদে। ভোর তাঁর বোনকে বকবে মারবে! কিন্তু বোন রাগ করবে না।”
বলেই কোল থেকে নেমে যায়! রুমের দিকে অগ্রসর হয়ে বলে,
-” আমি আম্মুর কাছে যাই! বাবুকে বলবো জলদি আসতে। মিনু খালার বাবু কত দেড়ি করে এলো! ভোরের জলদি করে বোন চাই। কালকেই যেন এসে পড়ে।”

অরুণ মুচকি হেসে উঠে ভোরের পিছু যায়!
পাতা সরে পরে দরজার আড়াল থেকে আঁচলটায় চোখ নাক মুখ মুছে নিজেকে ধাতস্থ করে বেলকনিতে গিয়ে দাঁড়ায়। বাবা ছেলের কিছু কিছু কথা শুনেছে সে! সে দরজার আড়ালে ছিলো! ভোরের প্রতিক্রিয়া নিজে লক্ষ্য করতে।
ভোর ‘আম্মু আম্মু’ বলে ডাকতে ডাকতে ভেতরে ঢুকে। পাতা আওয়াজ দেয় সে বেলকনিতে। আঁচল দিয়ে চোখে পুনরায় জমে ওঠা নোনাজল মুছে মুচকি হাসার চেষ্টা করে। সফলকাম হয়! ভোর বেলকনিতে এসে পাতার কোমর জড়িয়ে দোলনায় বসিয়ে দিল। হাঁটু গেড়ে বসে পাতার কোলে মাথা রেখে বলে,

-” আম্মু ভাবনা’কে বলবে জলদি করে আসতে। ভোর বেশি অপেক্ষা করতে পারবে না। তাকে ফাস্ট ফাস্ট আসতে বলিও!”
পাতার কপালে ভাঁজ পড়ে,
-” ভাবনা’কে?”
ভোর দাঁত বের করে ক্লোজ আপ হাসি উপহার দেয়! কিউট ভঙ্গিতে মাথা নেড়ে বলে,
-” ভোরের বোন ভাবনা!”
পাতা হেসে দেয়। ভোরকে টেনে কোলে বসিয়ে গায়ের শাল দিয়ে জড়িয়ে বলে,
-” বাব্বাহ নামও ঠিক করেছো এতো জলদি!বোন হবে কে বলেছে?”
ভোর পাতার গালে টপাটপ চুমু দিয়ে মিষ্টি হেসে বলে,

-” আব্বু বলেছে। আর ভোরের বোন চাই! মিষ্টি বোন!”
-” ভাই হয় যদি?”
ভোর গাল ফুলিয়ে বলে,
-” বোন হবে দেখে নিও তুমি! আব্বু তুমি বলো বোন হবে না?”
অরুণ এগিয়ে আসে। পাতা চেপে বসে অরুণ কে বসার জায়গা করে দেয়। অরুণ অল্প জায়গায় নিজেকে মানিয়ে পাতার কাঁধে হাত রেখে ব্যালেন্স রাখে। গরম নিঃশ্বাস ছেড়ে বলে,
-” মহারানী আছে রাজ্যকে সুখের আবেশে ভরিয়ে দিতে। রাজপুত্র আছে রাজ্যের আনাচে কানাচে চাঞ্চল্যতা ছিটিয়ে দিতে। এক রাজকন্যার আগমন হোক রাজাকে মাতৃছায়া দিতে!”

পাতা অরুণের দিকে ফিরে। নোনাজলে চিকচিকে ভেজা চোখ জোড়া মুছে দেয় অরুণ! নাক টিপে ভোরের দিকে তাকায়। ভোর পিটপিট করে তাকিয়ে আছে। বাবার সব কথা তাঁর মাথার উপর দিয়ে গেলো যেন!
-” আব্বু বোন হবে, তাই না? আর ভোর তাঁর নাম রাখবে ভাবনা। ভোরের বোন ভাবনা! সুন্দর না?”
অরুণ ছেলেকে নিজ কোলে নেয়। ছেলের গালে ঠোট ডাবিয়ে বলে,
-” অনেক সুন্দর। অরুণাভ ভোর সরকারের বোন অরুণিতা ভাবনা সরকার!”
পাতা মনে মনে কয়েকবার উচ্চারণ করে পুরো নাম। তবে সেও দুটো নাম ভাবে। ছেলে হলে ‘পল্লব’ মেয়ে হলে ‘অর্পা’। পাতা গায়ের শালটা দিয়ে তিনজনেরই গায়ে মুড়িয়ে দেয়। গোধূলি বেলায় হালকা পবনের দোলাতে ঠান্ডা আবহাওয়ায় গা কাঁটা দিচ্ছে বারংবার। পূর্ব দীগন্ত লালিমায় ছেয়ে সূর্য অস্তমিত হওয়ার পথে।

সময় পেরিয়ে যায় চোখের পলকে। সময়ের সাথে মানব জীবনে নানা ধরনের পরিবর্তন সাধিত হয়। সেই পরিবর্তন ব্যাক্তিগত বা সমাজজীবনে ব্যাপক প্রভাব ফেলে।এই যেমন কয়েক যুগ আগেও মানুষ মোবাইল নেট বিহীন দিব্যি হাসিখুশি ঘুরে বেড়াতো। রেডিওতে প্রচারিত গান নাটক শুনে মনোরঞ্জন করতো। বিকেল হলে দল বেঁধে মাঠে খেলতে নেমে যেতো। সন্ধ্যা হতেই মায়ের লাঠির ধাওয়ায় চৌকির নিচে লুকিয়ে থাকতো। এখন এসব অতীতের স্মৃতিচারণ। যুগের পরিবর্তন সাধিত হয়েছে। বর্তমান যুগে নেট মোবাইল ইত্যাদি ইলেকট্রনিক ডিভাইস ব্যাতিত মানুষ এক মুহুর্তও কল্পনা করতে পারে না।

চোখের পলকে বেশ কয়েকমাস গড়িয়ে গেল। এই কয়েকমাসে পরিবর্তন হয়েছে অরুণ, পাতা ও ভোরের জীবন! ছোট ভোর ধীরে ধীরে নয় বরং হুট করে বড় হয়ে যাচ্ছে যেন! আগের মতো চাঞ্চল্যকর ভোরকে সবসময় পাওয়া যায় না। তাঁর চাঞ্চল্যকর আচরণ মানুষ, পরিস্থিতি বুঝে হয়ে থাকে। আদর পাগল ভোর আর সকলের আদরের জন্য পিছু পিছু ঘোরে না। বরং যে আদর করে, গাল টিপে চুমু দেয় তার থেকে লুকিয়ে চুরিয়ে থাকতে পারলে বাঁচে। নইলে ভোর লজ্জায় লাল হয়ে যাবে। ভোরের আচরণে আরেকটা বিষয় লক্ষণীয়! ছোট ছয় বছর বয়সী ভোরের মাঝে তার বাবার স্বভাব স্পষ্ট লক্ষনীয়। সে গম্ভীর আচরণ করতে জানে। বাবার মতো রাগে ক্ষোভে ফেটে পড়তে জানে। জেদে তো সে বাবার এক কাঠি ওপরে।

যা বলবে তাই; নইলে ঘূর্ণিঝড় বইবে নিশ্চিন্তে থাকো! আর পাতা?অরুণ যেভাবে বলবে মেয়েটা সেভাবেই চলা মেয়েটি এখন যেটা বলবে তাঁর বিপরীত কাজ করবে। আগের মতো চঞ্চলতা বাচ্চামো স্বভাব দেখা যায় না মোটেও। এখন সে নীরব থাকতে ভালোবাসে। ভালোবাসবে না? পুরো ফ্ল্যাটে সে একাই! পাঁচ মাস চলছে তার। পেটটা দেখা যায়।‌ স্কুলের পাঠ চুকিয়েছে বেশ আগে। যখন পেটটা অল্প অল্প দেখা যেতো! কলিগের কানাঘুষো টিপ্পনী পাতার কানে বাজতো। জবাব দিতো প্রথম প্রথম। তবুও তাঁরা থামে নি। এরপর পাতা জবাব দেয়া বন্ধ করে ইগনোর করেছে ব্যাপারটাতে। এতে সবাই যেন আরো মজা পায়। তাদের কানাঘুষো খোঁচা মেরে কথা বলা বেড়ে যায়। পাতা মাঝে মাঝে দুই একটার উত্তর দিতো।

প্রিন্সিপাল ম্যামের কানে গেলে ম্যাম সবাইকে ডেকে ওয়ার্ন করে। কিন্তু দূর্ভাগ্যবশত ব্যাপারটা অরুণ সরকারের কানে অবধি যায়। ব্যস! বিরাট সমস্যার সৃষ্টি হয়। অরুণ পাতাকে না জানিয়েই স্কুলে মিটিং ডাকে। পাতার সব কলিগদের কড়া গলায় শাসাতে ভোলে না। সবটাই পাতার অগোচরে হয়। স্কুলের ছোট বড় সকলের মুখে মুখে পাতার কানাঘুষো।পাতা সব শোনে। অরুণের হস্তক্ষেপ তাঁর ভালো লাগে না। নিশ্চয়ই পাতার সব কলিগ ভাববে জামাইয়ের দাপটে চলে। তাই সে সিদ্ধান্ত জানায় সে আর এই স্কুলে জব করবে না।অরুণ অবাক হয়েছিল। ভাবে পাতা তার হস্তক্ষেপের কারণে রেগে আছে। অরুণ কথা বলে পাতার সাথে। পাতার সোজাসাপ্টা জবাব অরুণ কেন তাকে না জানিয়ে গন্ডগোল বাধালো?অরুণের গা ছাড়া জবাব দেয়। অরুণ সরকারের ওয়াইফ কে নিয়ে কটুক্তি করে এতো বড় সাহস পায় কিভাবে?

পাতার রাগ হয়! কথা কাটাকাটি হয় দুজনের।এর কারণেই কিছু দিন থেকেই দুজনের সম্পর্ক টানাপোড়নে। অরুণ স্বাভাবিক চললেও পাতা নীরব শান্ত নদীর মতো বয়ে চলছে। অরুণের সাথে অতি দরকারি ছাড়া কথা বলে না। আর এই অতি দরকারি কথা হলো ভোরের কাছ থেকে তাদের মনোমালিন্য লুকিয়ে রাখা! পাতা সোফায় গা এলিয়ে বসে আছে। হাতে আচারের বৈয়াম! পাতা একটু একটু করে মুখে নিয়ে মুখ কুঁচকে আরামে চটকে চটকে খায়। তবে তার আরামে খাওয়ার মাঝেই কলিং বেল বাজায়। পাতার চোখে মুখে বিরক্ত ফুটে ওঠে। কে এলো আবার? পাতা বৈয়াম আটকে আস্তে করে উঠে যায়। দরজা খুলে সামনে দন্ডিত ভোরকে দেখে বিরক্তিকর ভাব উবে যায়! অধরকোনে খেলা করে মিষ্টি হাসি। হাত বাড়িয়ে ভোরের এলোমেলো চুল ঠিক করে ওড়না দিয়ে কপালের ঘাম মুছে দিয়ে বলে,

-” এতো দেড়ি হলো কেন? খুব ক্লান্ত লাগছে তোমাকে! স্কুল শেষে খেলতে শুরু করে দাও! রোজ দেড়ি করে ফেরো! তোমার আব্বুকে জানাবো?”
-” জি ম্যাডাম জানাবেন! স্কুল শেষ হতেই ব্যাট বল হাতে ক্লাস থ্রির ছেলেদের সাথে ম্যাচ খেলেছে। এতো বারণ করলাম শুনলোই না। আপনাকেও তো ফোন করে জানালাম!”
পেছন থেকে ড্রাইভার রঞ্জু বলে ওঠে। পাতা ভোরের দিকে ছোট ছোট চোখে চায়! ভোর দুই হাতে কান ধরে মিষ্টি করে হেসে বলে,
-” স্যরি! প্লিজ আব্বু কে বলবে না! বাড়িতে একা একা ভোর বোর হয়! তাই তো খেলছিলাম! জানো আম্মু আমি দুটো ভাইয়াকে আউট করেছি!”
-” অনেক বড় কাজ করেছেন আব্বাজান! এবার ভিতরে এসে চেঞ্জ করে নিন! আমি শরবত বানিয়ে আনছি! ভাইয়া আপনিও আসুন?”

রঞ্জু বিনয়ের সাথে মাথা নেড়ে বলে তাঁর কাজ আছে। ভেতরে যেতে পারবে না। ভোর ভিতরে প্রবেশ করে। পাতা দরজা বন্ধ করে তাকে চেঞ্জ করে ফ্রেশ হতে বলে। ভোর বায়না করে সে পাস্তা খাবে। আর পাস্তা যেন বেশি করে বানায় তাঁর বাবাও খাবে! পাতা ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করে,
-” তোমার বাবা তো অফিসে!”
ভোর স্কুল ব্যাগ রুমে ছুঁড়ে মেরে বলে,
-” ড্রাইভার আঙ্কেলের ফোন দিয়ে বাবাকে কল করে বলেছি ‘আব্বু জলদি এসো। ভোরের একটুও ভালো লাগছে না।’ ব্যস আব্বু আসছে!”

পাতা এগিয়ে আসে। ভোরের কপালে গলায় হাত রাখে। ভোর মুচকি হেসে বলে,
-” ওহ হো আম্মু। ভোর ঠিক আছে! আব্বুকে এমনি বলেছি! বিকেলে আমরা ঘুরতে যাবো তাই!”
পাতা মুচকি হেসে তার টাই খুলে শার্টটাও খুলে বলল,
-” আপনার কপালে আজ দেখছি এতো এতো বকা নাচছে। যান ফ্রেশ হয়ে আসেন!”

ভোর খিলখিলিয়ে হেসে নাচতে নাচতে ওয়াশ রুমে চলে যায়। পাতা ভোরের ব্যাগ তুলে টেবিলের উপর রাখে। ভোরের পুরো রুমে চোখ বুলিয়ে নেয়। ভোর এখন আলাদা রুমে থাকে। মাঝে মাঝে তাদের সাথেও থাকে। আবার তাঁরাও মাঝে মাঝে ভোরের রুমে রাত্রিযাপন করে। পাতা রুম থেকে বেরিয়ে কিচেনে যায়। পাস্তা বানিয়ে নেয় জলদি হাতে। টুকটাক রান্না বান্না সে করতে পারে এখন। ইমনের মায়ের কাছে শিখেছে।সে অরুণ সরকারের নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করেই রান্না বান্না করে টুকটাক। অরুণ প্রথম প্রথম কড়া গলায় বলতো। পাতার রান্না করা খাবার ছুঁয়েও দেখতো না। কিন্তু পাতাও কম না। বাবা ছেলের থেকেই জেদের হাতেখড়ি হয়েছে। নইলে বিয়ের আগের পাতা জেদ কাকে বলে জানতোই না। আগাছা’র আবার জেদ! হুহ্!
পাতা পাস্তার বাটি এনে ভোরের সম্মুখে রাখে। ভোর মুচকি হেসে হাত প্রসারিত করে বলে,
-” আই লাভ ইয়ু আম্মু! আই লাভ ইয়ু ভাবনা!”

পাতা তাঁর গাল টিপে পাশে বসবে এর আগে কলিং বেল বেজে উঠল। পাতার চোখে মুখে আকাশসম বিরক্ত ভেসে ওঠে। পাঁচ মাসের বেশি চলছে প্রেগন্যান্সি। সে এখনি বেশ গুলুমুলু হয়ে গেছে। হাত পা শরীরে মেদ জমতে শুরু করেছে। তাই অল্পতেই হাঁপিয়ে ওঠে। কলিং বেলের গুষ্টি তুষ্টি করে এগিয়ে যায়! শালার কলিং বেল! তবে দরজা খুলে তাঁর শালার জামাইকে দেখতে পায়! অরুণ মুচকি হাসলো পাতাকে দেখে। পাতা হাসে না। নাক মুখ কুঁচকে বিরক্তিকর ভঙ্গিতে তাকালো। অরুণ দরজা চাপিয়ে ভিতরে উঁকি দিল। ভিতরের গতিবিধি লক্ষ্য করে নিজ কাজ হাসিল করে। পাতা পরনের ঢিলেঢালা ফ্রক দু হাতে শক্ত করে চেপে ধরে বিড়বিড় করে! ‘শালার জামাই’।
অরুণ তার মাথায় আলতো চাপড় মেরে ড্রয়িং রুমে ছেলের সামনে দাঁড়ায় বুকে হাত গুটিয়ে। ভোর পাস্তার বাটি কোলে রেখে চামচের সাহায্যে মুখে চালনা করতে ব্যস্ত। সামনে দন্ডায়মান কারো অস্তিত্ব অনুভব করে মাথা তুলে তাকায়! বাবাকে দেখে মিষ্টি করে হেসে বলে,

-” ভোর মিসড ইয়ু আব্বু!”
অরুণ দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে। এদের মা ছেলের চক্করে কখন না সে পরপারে পাড়ি জমায়। তখন ফোন দিয়ে কেমন দূর্বল কাঁপা কাঁপা গলায় বলল ‘আব্বু ভোরের ভালো লাগছে না কান্না পাচ্ছে! তুমি জলদি আসো’ অরুণ সমস্ত কাজ ফেলে তৎক্ষণাৎ ছুটে এসেছে। অথচ ছেলে দিব্যি আছে। তাঁর বুঝতে অসুবিধা হয়না যে তাকে বোকা বানানো হয়েছে! সে হতাশ গলায় বলল,
-” কাল কি হবে মনে আছে?”
ভোরের হাস্যোজ্জ্বল মুখ খানি চুপসে যায়! ত্যাক্ত গলায় বলে,
-” খুউব মনে আছে। তবে আব্বু তুমিও মনে রেখো! ভোর বেশি ব্যাথা পেলে কারো সাথেই কথা বলবে না!”
অরুণের গম্ভীর মুখে হাসি ফুটলো। কাঁধের ব্যাগ নিচে রেখে ভোরের কোল থেকে পাস্তার বাটি কেড়ে নিয়ে ঘরের দিকে যেতে যেতে বলে,

-” পাস্তা পাবে না তুমি! মিথ্যে বলেছো আমায় এটা তাঁর পানিশমেন্ট!”
ভোর চিল্লিয়ে ওঠে। বাবার পেছনে ছুট লাগিয়ে বলে,
-” ভোর রেগে যাচ্ছে কিন্তু। আমার আম্মু বানিয়েছে আমি খাবো! দাও বলছি?”
পাতা বিরক্ত হয়ে দু’জনের পেছনে যায়! রুমে ঢুকে অরুণের হাত থেকে বাটি কেড়ে নিয়ে ভোরের হাতে দেয়। ভোর বাবাকে ভেংচি কেটে সোফায় পা তুলে বসে বলে,
-” আব্বু একটু পরে কিন্তু আমরা পার্কে ঘুরতে যাবো!”
অরুণ শার্টের বোতাম খুলতে খুলতে বলে,
-” কে ডিসাইড করলো শুনি? কোথাও যাওয়া হচ্ছে না!”
-” কেন কেন? যাওয়া হচ্ছে মানে হচ্ছে। তুমি তো সারাদিন অফিসেই ব্যস্ত থাকো। আমি আম্মু সারাদিন বাড়িতে বসে বোর হই না বুঝি? তাই যাবো। তোমার না শুনবো না মানে না। তোমাকে রেখে ইমন আঙ্কেলকে নিয়ে যাবো! তখন তুমি কাদিও!”

কপালে ভাঁজ ফেলে গমগমে গলায় বলে ভোর। অরুণ আলমারি খুলে প্রয়োজনীয় কাপড় বের করে বলে,
-” পা ভেঙ্গে ঘরে বসিয়ে রাখবো!”
ভোরের আঁখি যুগল ভরে যায়। নাকের পাটা ফুলিয়ে রাগে ক্ষোভে পাস্তার বাটি ঠাস করে ফেলে দেয় ফ্লোরে। পাস্তা ফ্লোরে গরাগরি খায়। কড়ির বাটি ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে যায়। পাতা কেঁপে ওঠে। অরুণ মুখের আদল ভয়ঙ্কর। হাতের কাপড় ফেলে তেড়ে আসে ভোরের দিকে। পাতা তড়িঘড়ি ভোরকে আগলে নেয়! বোঝানোর সুরে বলে,
-” বাচ্চা ছেলে ভুল করেছে ‌ আমি বুঝিয়ে বলবো!”
অরুণ কড়া গলায় পাতার উদ্দেশ্যে বলে,

-” আজ ওর খাওয়া বন্ধ। যখন যা চায় পায়। তাই নষ্ট করতে হাত পা কাঁপে না। ওর বয়সী কত বাচ্চা অনাহারে অর্ধাহারে দিনাতিপাত করে ওর ধারনা আছে! ওর বয়সী বাচ্চারা রাস্তায় পাঁচটা টাকার জন্য লোকের কাছে হাত পাতে।ফুল পেন্সিল বিক্রি করে! অথচ রাজার পুত্তুরের একশখানি ফরমায়েশ!”
অরুণ কাপড় চোপড় তুলে ওয়াশ রুমে চলে যায়! ধরাম করে দরজা বন্ধ করে। সেই শব্দে কেঁপে ওঠে পাতা! ভোরের মাথায় হাত বুলিয়ে শান্ত করার চেষ্টায়! ভোর কাঁদে না। টলমল আঁখিতে নাকের পাটা ফুলিয়ে ফোঁস ফোঁস করে। পাতা ফ্লোরে বসে পড়লো। আস্তে করে নোংরা ফ্লোর পরিষ্কার করতে থাকে। অরুণ একটু পরে বেরিয়ে আসে। পাতাকে থামিয়ে নিজেই ফ্লোর পরিষ্কার করে ধুয়ে নিলো।

-” ঘুরতে যাবে! কয়েক দিন পরপরই বায়না! শীতের ছুটিতে সিলেট ঘুরিয়ে আনি নি? দু মাস আগে সাতদিন কক্সবাজার ভ্রমণে নিয়ে যাই নি? পদ্ম বিলে ঘুরিয়ে এনেছি। প্রতি ফ্রাইডে পার্কে ঘুরতে বের হতে হয়। তাঁর পরও ওনার তৃপ্তি হয় না।”
ভোর নাক টেনে শব্দ করে পা ফেলে চলে যায় ঘর থেকে। পাতা খেকিয়ে ওঠে অরুণের উপর,
-” ছোট বাচ্চা। অবুঝ! ভুল তো করবেই। আপনার উচিত ঠান্ডা মাথায় তার ভুল ধরিয়ে সুধরে নেয়া। অথচ আপনার হাত গলা বেশি‌ চলে! মনে রাখবেন লেবু বেশি নিংড়ালে তেতো হয়!”
অরুণ পাতার দিকে তাকিয়ে শক্ত গলায় বলে,

-” আস্তে কথা বলো!আমি জানি আমার কি করতে হবে তোমাকে জ্ঞান দিতে হবে না।”
অপমানে পাতার মুখটা লাল হয়ে যায়! বাড়ন্ত পেট ধরে আস্তে আস্তে সেও বেরিয়ে যায়! অরুণ দীর্ঘশ্বাস ফেলে মাথার চুল টেনে ধরে বিছানায় বসে থাকে কিছুক্ষণ।
পাতা বেরিয়ে ভোরের রুমে যায়! ভোর শান্ত ছেলের মতো ফ্লোরে বসে খেলনা গাড়ি নাড়াচাড়া করছে। পাতা এসে তাঁর পাশে বসে পা ছড়িয়ে। ভোর একবার তাঁর দিকে তাকিয়ে খেলনা ছুঁড়ে কোলে মাথা রেখে শুয়ে পড়ে। পাতা তাঁর মাথায় হাত বুলিয়ে বলে,

-” খাবার নষ্ট করা খুবই বাজে কাজ! তুমি একটা খাবারের দানা নষ্ট করলে সেই খাবারের দানা আল্লাহর কাছে অভিযোগ করে। তখন আল্লাহ তোমার উপর নারাজ হবে। কেননা হতদরিদ্র মানুষ এক মুঠো খাবারের জন্য আল্লাহর কাছে হাত তুলে ভিক্ষা চায়। আর সেই খাবার তুমি নষ্ট করছো রাগ করে। তোমার খাবার পড়ার অভাব নেই। কিন্তু অনেক বাচ্চাই আছে যাঁরা খাবারের খোঁজে লোকের হাত পাতে লাজ লজ্জা ভুলে। হোটেলে, ইটের ভাটায়, দোকানে দিনমজুর খাটে। পড়ালেখা তাদের কাছে বিলাসীতা! তাই কখনো কোনো কিছু নষ্ট করার আগে আশেপাশে তাকাবে। আশেপাশের করুণ অবস্থা অবলোকন করলে ভোরের কোমল হৃদয়খানি কেঁপে উঠবে।”
দরজায় দন্ডায়মান অরুণ সরকার সবটা শোনে! নিজের কর্মে নিজেকে ভর্ৎসনা করে। ভোর মাথা তুলে সোজা হয়ে বসে। তাঁর শান্ত মলিন চোখে অনুতাপের ছাপ স্পষ্ট। সে মিনমিনে গলায় বলে,

-” স্যরি আম্মু আর খাবার নষ্ট করবো না। আল্লাহ কি আমার উপর অনেক রেগে আছে?”
-” ভোর তাঁর ভুল বুঝতে পেরেছে তাই আল্লাহ আর রেগে নেই।”
পাতা মুচকি হেসে বলে। ভোর মুচকি হেসে দরজার দিকে তাকায়। বাবাকে দেখে তাঁর হাসি উবে যায়। গাল ফুলিয়ে অন্যদিকে তাকিয়ে থাকে। পাতা আড়চোখে অরুণকে দেখে তবে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে না।
অরুণ এগিয়ে এসে বলে,

-” দুজন রেডি হও! নরাইট শাপলা বিলে ঘুরতে যাবো। যদিও বিকেল বেলা।”
পাতার রাগ হয়। সেই যাবিই যখন তাহলে তালবাহানা করে বাচ্চাটাকে রাগিয়ে দেওয়ার কোনো মানে আছে? সে ভোরের দিকে তাকায়। ভোর গাল ফুলিয়ে বলে,
-” আম্মু! ভোর কোথাও যাবে না।”
-” রেডি হতে বলেছি জিজ্ঞেস করি নি। পাঁচ মিনিটের ভিতর যেন রেডি দেখি দু’টোকেই!”
বলেই অরুণ চলে যায়! পাতা উঠে দাঁড়ায় আস্তে আস্তে। ওয়্যাড্রপ খুলে ভোরের হাফ প্যান্ট টি শার্ট বের করে বলে,

-” কাল থেকে তো প্যান্ট পড়তে পারবে না। লুঙ্গি পরে ঘুরতে হবে কিন্তু!”
ভোর গাল ফুলিয়ে বসে থাকে। পাতা তাকে জোর করিয়ে রেডি করিয়ে দেয়। ভোর বলে,
-” তুমি রেডি হবে না?”
-” না বাবা! তোমরা বাবা ছেলে ঘুরে এসো! আমি তোমার এই পুচু বোনকে নিয়ে যেতে পারবো না। গাড়ি উঠলেই বমি হবে। আর হাঁটতে তো পারবোই না।”
-” আম্মু ও পুচু না ও ভাবনা! আর তুমি না গেলে আমিও যাবো না!”
-” কে যাবে না শুনি?”

দু’জনের কথোপকথনের মাঝে অরুণের গলা শুনে দুজনেই দরজার দিকে তাকালো।অরুণ টি শার্ট জিন্স পরিধান করে কালো ফ্রেমের চশমা চোখে একদম রেডি। অরুণ এগিয়ে আসে। পাতা শান্ত গলায় বলে,
-” ভোর যাবে। আমি যাবো না। গাড়িতে উঠে বমি হবে আর হাঁটতে পারি না বেশি। হাঁপিয়ে উঠি। আপনারা যান!”
-” আমি যাচ্ছি সাথে কোনো প্রবলেম হবে না! রেডি হয়ে আসো পাতাবাহার!”
অরুণের কথায় পাতা পুরোপুরি অবজ্ঞা করে ভোরের চোখে সানগ্লাস পরিয়ে বলে,
-” বললাম তো যাবো না। আমি বাড়িতেই ঠিক আছি!”
অরুণ আরো কয়েকবার নরম গলায় বলে। পাতা মানা করে। অরুণ গম্ভীর মুখে ভোরকে কোলে নিয়ে গটগট করে বেরিয়ে যায় কিছু না বলেই! পাতা কপাল কুঁচকে দরজা বন্ধ করে আরাম করে সোফায় বসে। একা বসে বিরক্ত হয় তাই টিভি অন করে।

অরুণ রেগে বের হয়। গাড়িও নেয় না। রিকশা নিয়ে এলোমেলো ঘোরে ছেলের সাথে। রাস্তায় কুলফি খায় বাবা ছেলে। রাস্তায় ঘোরাঘুরি করা ছোট ছোট বাচ্চাদের সাথে ভাব জমায়। তাদের নিয়ে স্ট্রিট ফুডের দোকানে যায়। সবার ইচ্ছে অনুযায়ী খাবার অর্ডার করে। ছোট ছোট বাচ্চারা খুশি হয় বেশ! রোগা পটকা জীর্ণশীর্ণ শরীরে মায়াময় মুখের প্রাণোচ্ছ্বল হাসি বেশ সুন্দর লাগে। ভোর তাদের সাথে মিশে একাকার। হাসি ঠাট্টা নানান গল্পে জমে ওঠে তাদের আড্ডা খানা।অরুণ ফটাফট ক্যাপচার করে স্মৃতির পাতায়।

এরপর সকলকে নিয়ে শপিং মলে যায়। বাচ্চারা যেতে চায় না। ভয় পায়, যদি ছেলে ধরা হয়? ভোর তাদের সন্দেহে হেসে কুটিকুটি। তাদের আশ্বস্ত করে হাত ধরে নিয়ে যায় ভেতরে। অরুণ কিডজোনে প্রত্যেক বাচ্চাকে তাদের পছন্দের একসেট জামা কিনে দেয়। আর সাথে তাদের পছন্দমাফিক খেলনা। ভোরের জন্যও কেনে। সেখান থেকে শাড়ি বিতানে যায়! প্রয়োজনীয় শপিং করে তাঁরা রেস্টুরেন্টে যায়। সব বাচ্চাদের জন্য মোরগ পোলাও প্যাকেট করে দিতে বলে। বাচ্চাদের আইসক্রিম হাতে ধরিয়ে সবার থেকে বিদায় নিয়ে বাবা ছেলে রিকশায় চড়ে বাড়ি ফেরার পথ ধরে। ভোরের চোখে মুখে উপচে পড়া আনন্দ। তাঁর সমবয়সী বাচ্চাদের সঙ্গ সে বেশ এনজয় করেছে। সবার কথাই বলে বেড়াচ্ছে। সবার নাম উল্লেখ করে বাবার সাথে গল্প করতে করতে তাঁরা বাড়ি ফেরে। কলিং বেল না চেপে চাবি ঘুরিয়ে দরজা খোলে। ভোর দৌড়ে ‘আম্মু আম্মু’ ডেকে ভিতরে প্রবেশ করে।
পাতা সোফায় অলস বসে আশিকি টু মুভি দেখছিলো টিভিতে। ভোরের আগমনে হেসে বলল,

-” কেমন ঘুরলে হুম?”
ভোর উচ্ছ্বাসের সাথে জবাব দেয়। কিভাবে কোথায় কাদের সাথে ঘুরেছে সবটা বলে তবেই ক্ষান্ত হয়। পাতা আগ্রহী চোখে তাকিয়ে সব শোনে। অরুণ এগিয়ে এসে পাতার পাশে বসে। শপিং ব্যাগ থেকে একটা পার্সেল বের করে পাতার সামনে রাখে কিছু বলে না। পাতার কপালে ভাঁজ পরে। আড়চোখে পার্সেল টা পর্যবেক্ষণ করে। কি আছে ওতে? তারজন্য এনেছে? ভোর বাবার হাতের বাকি শপিং নিয়ে সব বের করে দেখালো। নিজের খেলনা! বোনের জন্য পুতুল জামা কাপড়! অরুণ গলা খাঁকারি দিয়ে খাবারের প্যাকেট রেখে বলে,

-” মোরগ পোলাও এনেছি। গরম গরম আছে খেয়ে নাও!”
পাতার ক্ষুধার্ত মনটা নেচে ওঠে। ইদানিং তার খাওয়ার পরিমাণ বেড়েছে তরতরিয়ে। সুস্বাদু খাবারের কথা স্মরণে আসলেই ক্ষিধেয় পাতার পেটে চু চু শব্দ হয়! তবে পাতা নিজ লোভি মনটাকে আটকে রেখে বলে,
-” সন্ধ্যা হয়ে এলো বলে! গরম করে দেব রাতে খাবেন!”

রাতের খাবার শেষে অরুণ ভোরকে নিয়ে রুমে যায়। বিছানায় শুইয়ে আগামী কালের জন্য প্রস্তুতি নিতে বলে। ভালোভাবে সব বুঝিয়ে বলে। ভোর লজ্জা পায় একটু আকটু সাথে ভয়ও পায়! বাবাকে সুধায়,
-” আব্বু ব্যাথা করবে অনেক? হুজুর বলে অল্প অল্প ব্যাথা করবে! পিঁপড়ে কামড় দিলে যেমন ব্যাথা হয়!”
অরুণ হেসে ছেলের মাথায় হাত বুলিয়ে বলে,
-” হুম! তুমি ঘুমাও তো কলিজা!”

ভোর চোখ মুখ খিচে বাবাকে শক্ত করে জড়িয়ে রাখে। ধীরে ধীরে ঘুমিয়ে যায়। তার ঘুম গভীর হলেই অরুণ উঠে আসে। ড্রিম লাইট জ্বালিয়ে দরজা হালকা ভেজিয়ে বের হয়!
পাতা ড্রয়িংরুমের সোফায় বসে। কোলে অরুণ সরকারের আনা সেই পার্সেলটা। পাতা এদিক ওদিক তাকিয়ে পার্সেল খোলে! খুলে একটু অবাক হয়! একটা কালো জামদানি শাড়ি! কালো চুড়ি! আরো টুকটাক অর্নামেন্টস! গোটাকয়েক লাল গোলাপ! একটা চিরকুট! পাতার অধর জুড়ে মিষ্টি হাসি। পাতা চিরকুট হাতে তুলে নিল। বিড়বিড় করে চিরকুট পড়তে শুরু করে,

মহারানী,
মান অভিমান অনেক হলো! এখন অভিমানকে বিদায় দেওয়ার সময় এসেছে। আপনি কথা বলেন না আমার সাথে। শ্বাস আটকে আসে আমার। আমি আমার দোষ স্বীকার করেছি অনেক আগেই! আবার করেছি! আপনি অনুগ্রহ করিয়া একটু কৃপা করুণ এই অধমের উপর। কথা দিচ্ছি নিরাশ হবেন না। আর শুনুন? আমার আগের পাতাবাহার ফেরত চাই! এরকম গোমড়া মুখো শান্ত পাতাবাহারকে দেখলে আমার অন্তঃস্থলে বহ্নি শিখা জ্বলিত হয়! আমি চাই সে আগের মতোই হাসুক বাচ্চামো করুক। আর হ্যাঁ আপনি এভাবে গোমড়া মুখে থাকলে আপনার অস্তিত্বে বিরাজমান আমার রাজকন্যাটাও গোমড়া মুখে থাকবে। তাই আপনি হাসুন আমার রাজকন্যাকে হাসার সুযোগ করে দিন!

ইতি
আপনার রাজ্যের অসহায় এক রাজা
বি.দ্র: ভালোবাসি!
পাতা বেশ কয়েকবার পরে চিরকুট টা লোকটার হাতের লেখা খুবই বাজে। তবে তার ভালোলাগে। মনটা ফুরফুরে হয়ে যায়। সব মন খারাবি উবে যায়! পাতা চিরকুটটা সুন্দর করে আগের জায়গায় রেখে দেয়! প্যাকেটটাও সেভাবেই টি টেবিলের উপর রেখে পূর্বের ন্যায় গোমড়া মুখে বসে টিভি দেখায় মনোযোগী হয়! অথচ ভিতরে সে লুঙ্গি ড্যান্স দিচ্ছে।

একটু পর অরুণে আগমনেও পাতার মাঝে ভাবান্তর হয় না। অরুণ চুপচাপ পাতার সম্মুখীন হয়ে দাঁড়ায়। পাতা মুখটা আরেকটু গম্ভীর বানিয়ে নেয়। অরুণ লক্ষ্য করে সবটা।‌পকেটে হাত গুজে শান্ত গলায় বলে,
-” পার্সেল খোলো নি পাতাবাহার?”
পাতা চুপ থাকে জবাব দেয় না। অরুণের পকেটে গুঁজে রাখা হাতের মুঠ শক্ত হয়। দাঁত কপাটি পিষ্ট করে রাশভারী গলায় বলে,

-” কিছু জিজ্ঞেস করছি আমি!”
পাতা মনে মনে ভেঙ্গায়! ‘কিতু দিগ্যেস কলছি আমি ‘ শালার ষাঁড় মুখো জামাই! মুখে এক ফোঁটা রসকস নেই। পুরো নিমপাতার ন্যায় তেতো। শাশুড়ি আম্মা হওয়ার পর নিশ্চয়ই মধু খাওয়ায় নি! পাতা টিভিতে নজর স্থির রেখে স্বাভাবিক ভাবেই জবাব দেয়,
-” কার না কার পার্সেল আমি কেন খুলবো?”

অরুণের কপালে ভাঁজ পড়ে। পার্সেলটা হাতে তুলে আনপ্যাক করে। পাতার নজর টিভিতে হলেও আড়চোখে সে অরুণের কর্মকাণ্ডে ঠিকই খেয়াল করে। অরুণ চিরকুট পকেটে রেখে একে একে শাড়ি, চুড়ি, অর্নামেন্টস, গোলাপ গুলো টি টেবিলে রেখে আরো কিছু খোঁজে। পাতা ত্যাছড়া নজরে তাকায়। সবই তো বের করলো! আর তো কিছুই নেই। তাহলে কি খুঁজছে? পাতার জিজ্ঞেস করতে হয় না! অরুণ নিজেই বলে,
-” এতে দশহাজার টাকাও ছিলো! পাচ্ছি না এখন!”

পাতার চোখের আকার বড় হয়। কই সে তো একটা কানাকড়িও দেখে নি! পাতা অবাক সুরে বলে,
-” কোন টাকা ছিলো না তো! শুধু এইগুলো আর ওই চিরকুট যেটা আপনি পকেটে রাখলেন!”
অরুণ ভ্রু উঁচিয়ে চায়!
-” আচ্ছা? তুমি কিভাবে জানলে? তুমি তো খোলোই নি!”
পাতা আহাম্মক বনে যায়! শালার চালাক জামাই রে! পাতা হালকা কেশে বলে,
-” আমি খুলি নিই তো! আপনি খুললেন দেখলাম! কোনো টাকা ছিলো না!”
অরুণ হেসে উঠলো শব্দ করে। পাতার পাশে বসে পাতার গায়ে ঢলে পড়ে। পাতার গা জ্বলে ওঠে! অসভ্য নাক উঁচু ম্যানারলেস লোক! তাকে বোকা বানানো! সে গাল ফুলিয়ে উঠে যাবে অরুণ কাঁধ জড়িয়ে আঁকড়ে ধরে। টি টেবিলের উপর থেকে একটা লাল গোলাপ তুলে বলে,

-” শোন পাতাবাহার? প্লিজ অ্যাকসেপ্ট মায় অ্যাপোলোগাইজ! তুমি আমার উপর অভিমান করে জব ছেড়ে দিলে। পণ করলে আর জব করবে না। এখানে আমার দোষ কি বলো? অরুণ সরকারের একটা মাত্র আদরের বউকে নিয়ে সবাই হাসি তামাশা করবে আজেবাজে কথা বলবে আর অরুণ সরকার চুপ থাকবে? আর তুমিই বা চুপ থাকবে কেন? জবাব দিয়ে তাদের মুখ বন্ধ করে দিতে পারো না? নিজেকে দূর্বল ভাবো কেন? একা নও তুমি। তোমার পাশে তোমার হাসবেন্ড আছে।”

-” আমি জব করবো না । জব করার প্রয়োজনীয়তা আমার নেই। স্কুল থেকে প্রাপ্ত বেতন বিয়ের পূর্বে আব্বু নিলেও বিয়ের পর এক টাকাও নেয় নি। শত জোর করেও দিতে পারি নি! তাহলে জব করে আমি কি করবো?আমার সব নীডস আপনিই পূরণ করেন এবং করবেন ইনশাআল্লাহ। আপনাকে আমি পুরোপুরি বিশ্বাস করি। বাংলাদেশে অনেক বেকার আছে যাদের সত্যিকার অর্থেই জব অতিব জরুরি! আমি জবটা ছেড়ে দিলে কেউ চাকরিটা পেয়ে যাবে যার প্রকৃত অর্থেই জবটা প্রয়োজন। জব আমার পরিচয় নয়! আমার পরিচয় আমি পাতা ইসলাম। আমি নিজ সংসার সামলাতে চাই। কোনো জব করতে চাই না। তবে হ্যাঁ যখন মনে হবে জব করা জরুরী! তখন কেউ আটকাতে পারবে না। রুবি আপুর মতো আপনার অফিসে জয়েন হবো। আপনার অফিসটা দখলে নিবো”
অরুণের কুঞ্চিত হয় পাতার কথায়।

-” অ্যানি টাইম।তোমাদের অফিস; যা খুশি করবে। ইটস অল অ্যাবাউট ইয়ু! তোমার ডিসিশন তুমিই নিবে। আমি শুধু গার্ডিয়ান হিসেবে তোমাকে পথ দেখাবো!”
থেমে আবার বলে,
-” আচ্ছা তাহলে এখানে প্রবলেম টা কোথায় বলবে?”
পাতা অরুণের দিকে তাকিয়ে বলে,

-” প্রবলেমটা হলো আপনি আমাকে না জানিয়ে ওখানে গন্ডগোল বাধালেন। যেখানে প্রিন্সিপাল ম্যাম সবাইকে ডেকে সব সমাধান করিয়েছিলো! তারপরও আপনি আপনার উঁচু নাক ঢুকিয়ে দিলেন। তাদের কথা প্রমাণ করে দিলেন যে পাতা তার হাসবেন্ডের দাপটে চলাফেরা করে। শুনুন ওরা কটুক্তি করে। আমি মোটেই চুপ থাকি না। তাদের জবাব দিই। তাই বলে তাদের সাথে পায়ে পা লাগিয়ে ঝগড়া করবো? সিনক্রিয়েট করবো? আমি ব্যাপারটি কানেই নিই না! পাছে লোকে কিছু বলে! বলুক! তাদের কাজই নিন্দা করা। প্রিন্সিপাল ম্যাম তাদের ওয়ার্ন করার পরেও আপনার উঁচু নাক গলানোটা বাড়াবাড়ি লেগেছে আমার কাছে। স্কুলের সবার মুখে মুখে পাতার চর্চা হচ্ছে। কানাঘুষা! আগে কলিগরা করতো পরে সবাই!আমার ব‌্যাপার আমি সামলে নিতাম। সামলাতে না পারলে আপনাকে জানাতাম!”

অরুণ লম্বা শ্বাস নিয়ে বলে,
-” পাতাবাহার ভুল স্বীকার করি নি আমি? তারপরও কেন জব করবে না বলে জেদ করছো? এতে তো এটাই প্রমাণ হয় আমার জন্যই জব ছাড়ছো!
অরুণকে থামিয়ে পাতা বলে,
-” আপনার জন্য না! প্রথমে রেগে এই সিদ্ধান্ত নিলেও পরে আমি ভেবেছি অনেক। আমি ছোট থেকেই চাইতাম আমার নিজস্ব সংসার হোক। যেখানে আমার বিস্তার থাকবে সর্বত্র‌। আমি স্বপ্ন দেখতাম গৃহিণী হওয়ার। কিন্তু ঘরের কাজে আমি অষ্টরম্ভা। কিন্তু আমি শিখতে চাই! ‌আমি আমার সবটা সময় ভোর ও আগত বাচ্চাকে দিতে চাই!”
-” আমি কি দোষ করলাম?”

পাতাকে থামিয়ে ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করে অরুণ! পাতা চোখ রাঙায়! অরুণ হেসে বলে,
-” আচ্ছা দিতে হবেনা আমাকে সময়। অরুণ সরকার তার প্রাপ্যটা বুঝে নিতে জানে!”
-” চিরকুট টা বের করুন তো ভোরের বাবা?”
-” কেন?”
-” আরে বের করুণ তারপর বলছি!”
অরুণ বের করে। পাতা মুচকি হেসে বলে,
-” এবার সুন্দর করে সবটা পড়ুন ! কোনো বাহানা নয়। পড়ুন! আর হ্যাঁ পড়ে চিরকুট আমার হাতে দিবেন আমি এটা ফ্রেম করিয়ে লুকিয়ে রাখবো! বুড়ো হয়ে গেলে নাতি নাতনিদের দেখাবো!”
অরুণ ছোট ছোট করে চায়! অনেক দিন পর সেই পূর্বের পাতাবাহারের দেখা মিলল যেন! তাঁর হুল্লোড় মাতানো আরেক চড়ুই! অরুণ সবটা পড়ে। পাতা শুনে খিলখিলিয়ে হাসে। অরুণ মিছে বিরক্ত হওয়ার ভান করে। পাতাকে পাজা কোলে নিয়ে রুমের দিকে হাঁটা দেয়! পাতা চিল্লিয়ে ওঠে,

পাতা বাহার পর্ব ৫০

-” আরে ভোরের বাবা পড়ে যাবো! অনেক ওয়েট আমার!”
-” তো? অরুণ সরকারের স্ট্রেন্থ সম্পর্কে কোনো ধারনা নেই!”
পাতা মুচকি হেসে তাঁর গলা জড়িয়ে ধরলো। অরুণ বিছানায় বসিয়ে দেয় পাতাকে। তাঁর বাড়ন্ত পেটে চুমু দিয়ে কান পেতে ডাকে,
-” মা?”

পাতা বাহার পর্ব ৫২