শুভ্ররাঙা ভালোবাসা পর্ব ৪০

শুভ্ররাঙা ভালোবাসা পর্ব ৪০
সুমাইয়া সুলতানা

মোম’কে নিয়ে আগুন ঢাকায় ব্যাক করেছে। বাড়িতে এসে মোম যেন হাওয়ায় উড়ছে। একদন্ড স্থির থাকছে না। এসে থেকেই চঞ্চল চড়ুই পাখির মতো শুধু ছোটাছুটি করছে। আগুন ডাকলে রুমে যাচ্ছে না। মেজাজ খারাপ হচ্ছে তার। রাশেদ বাড়িতে, এখন চিৎকার করে ডাকাডাকি কিংবা ধমকে রুমে নিয়ে আসা সম্ভব নয়। নয়তো রামধমক দিয়ে রুমে নিয়ে আসতো! জার্নি করে আসায় ক্লান্ত সে, তাই সোফায় গা এলিয়ে দিল।
মোম বর্তমানে অবস্থান করছে শাশুড়ির রুমে। মিনা, ময়ূরী রয়েছে সাথে। রাশেদ ড্রয়িংরুমে বসে চা পান করছেন আর টিভি দেখছেন। এদিকে ওরা তিনজন গল্পের আসর জমিয়ে দিয়েছে। মুঠো করে মুড়ি চানাচুর তুলে মুখে দিয়ে চিবোতে চিবোতে ময়ূরী বলল,

” তোমাদের গ্রামীণ জনপদ অনেক সুন্দর ভাবী। ছবি তোলার জন্য পারফেক্ট। সময় পাচ্ছি না, নয়তো কিছুদিন গিয়ে তোমাদের বাড়িতে থেকে ঘুরে আসতাম। সেই সাথে ইচ্ছে মতো ছবি তুলতে পারতাম। ”
মোম উৎফুল্ল চিত্তে হাস্যোজ্জ্বল মুখে উত্তর দিল,
” দূরের অনেক পর্যটক আমাদের গ্রামে ঘুরতে আসে। পাকা রাস্তা হওয়াতে খুব সহজেই বড়ো বড়ো গাড়ি ঢুকতে পারে। এতে তাদের জন্য গ্রাম ঘোরাঘুরি আনন্দদায়ক ভ্রমণের উৎস হিসেবে গণ্য হয়। ”
” হুম! একবার গিয়েছিলাম। ভালোই লেগেছিল। ”
মিনা পানি পান করে আঁচল দিয়ে মুখ মুছে মোমের উদ্দেশ্যে বলে উঠলেন,

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

” পরীক্ষা কেমন হয়েছে তোমার? ”
” জ্বি মা, ভালো। ”
” তোমার বাবার কি খবর? ”
” মোটামুটি সুস্থ। এবার গিয়ে দেখেছিলাম ঘনঘন শ্বাস কষ্ট হচ্ছে। চিকিৎসা চলছে। ”
” ডাক্তার দেখায় নি? ”
” দেখিয়েছে। ”
” কি বলেছে ডাক্তার? ”
” ঔষধ দিয়েছে। বলেছেন খুব শীগ্রই অসুস্থতা কেটে যাবে। ”
ময়ূরী উঠে দাঁড়ায়। ফোনে সময় দেখে যেতে যেতে জানালো,
” মা আমার পড়া আছে। আমি গেলাম। ভাবী রাগ করো না প্লিজ। ”
মোম মুচকি হেসে বলল,

” রাগ করার কি আছে? আড্ডার আগে পড়াশোনা। তুমি যাও, গিয়ে পড়তে বসো। ”
কথা বলার ফাঁকে দরজায় নজর পড়তেই মিনা দেখতে পেলেন আগুন’কে। তিনি ছেলেকে কাছে ডাকলেন। আগুন’কে দেখে মোমের হাসি উবে গেল। শুষ্ক ঢোক গিলল সে। সেই কখন রুমে যেতে বলেছে আর ও এতক্ষণ পর্যন্ত শাশুড়ি, ননদের সঙ্গে আড্ডা দিচ্ছিল! মানুষটা হয়তো দরকারে ডেকে ছিল। এতবার যখন ডেকেছে যাওয়া উচিত ছিল। নিশ্চয়ই কোনো কিছু খুঁজে পাচ্ছিল না। এখন লোকটা যদি রেগে যায়? আগুনের ব্যাশভুস পরিপাটি লাগছে। কোথাও যাবে নাকি লোকটা?
মিনা অস্থির গলায় প্রশ্ন করলেন,

” কিছু বলবি বাবা? ”
আগুনের শান্ত জাবাব,
” না, মা। ”
ছোট্ট করে জবাব দিয়ে হাঁটা শুরু করল। পেছনে না ঘুরে গমগমে গলায় বলে উঠলো,
” মোম রুমে আসো। লাস্ট বার বলছি, এরপর যেন আর বলতে না হয়! ”

মোম পিলপিল কদমে বেডরুমে এসে হাজির হয়। এতটা ধীর গতিতে এসেছে, যেন ফ্লোরও টের না পায়। মোম রুমে আসা মাত্র আগুন ঠাস করে দরজা বন্ধ করে দিল। মোমের বক্ষস্থল ছ্যাৎ করে উঠল। আটঘাট বেঁধে দেয়ালের সঙ্গে মিশে চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল। আগুন, মোমের থেকে দুরত্ব বজায় রেখে পকেটে হাত গুঁজে সটান হয়ে দাঁড়াল। ভারিক্কি গলায় তীর্যক চাউনী নিক্ষেপ করে জিজ্ঞেস করলো,
” কথা বললে গায়ে লাগে না? মানুষ মনে হয় না আমাকে? কখন থেকে ডাকছিলাম, হুম? নিজের মর্জিকে প্রাধান্য দিলে, একবারও রুমে আসার প্রয়োজনবোধ মনে করলে না! ”

ভয়ে মোমের মুখটা শুকিয়ে গিয়েছে। সমান তালে ওড়নার কোনা হাতের আঙ্গুলে প্যাঁচাচ্ছে! ঠোঁটে ঠোঁট চেপে কাচুমাচু হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। জিভ দ্বারা ঠোঁট ভিজিয়ে হা করে সাফাই দিতে চাইল। তার আগেই আগুন তেড়ে এলো। নরম তুলতুলে গাল আলতো ভাবে চেপে ধরে দাঁত কটমট করে বলল,
” কোনো মিথ্যা এক্সকিউজ শুনতে চাই না। জানি, তুমি ইচ্ছে করে আসো নি! ”
” আসলে কি হতো শুনি? কেন ডেকে ছিলেন? ”
” সেটা কি তুমি এসে শুনতে চেয়েছিলে? আবার মুখে মুখে তর্ক করছো! ”
মোম ভোঁতা মুখে উত্তর দিল,

” আমি ভেবেছিলাম এমনি ডেকেছিলেন। আসলে হয়তো রেস্ট নিতে বলবেন। সেজন্য আসি নি। ”
” তোমাকে এত বেশি বেশি ভাবতে কে বলেছে শুনি? তোমাকে না বলেছি অযথা বেশি ভাববে না। ”
মোম কিছু না বলে মাথা নিচু করে ঠায় দাঁড়িয়ে রইল। ঠোঁট ফুলিয়ে রেখেছে। এক্ষুনি হয়তো ছকিনার মা’র মতোন কেঁদেকেটে গঙ্গাজল বানিয়ে ফেলবে। আগুন দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। মোম’কে কাছে টেনে নিলো। গালে এক হাত দিয়ে শান্ত কন্ঠে বলল,
” নিজে ভুল করবে, আবার নিজেই ঠোঁট ফুলিয়ে রাখবে? সাথে কান্না তো ফ্রী! ”
” কোথায় কাঁদছি? ”
আগুন মুচকি হাসল। রাশভারী কন্ঠে শুধাল,
” আমি কি বলেছি কাঁদছো? না কাঁদলেও কিছুক্ষণের মধ্যেই কেঁদে দিবে। তোমার মুখভঙ্গি তাই বলছে। ”
আগুন থেকে সরে দাঁড়ায় মোম। তিরিক্ষি মেজাজ নিয়ে মৃদুস্বরে আওড়াল,
” মোটেই না! আমি এত সহজে কান্না করি না। ”

আগুন এবার শব্দ করে হেসে উঠল। মোম এক দৃষ্টিতে চেয়ে সেই হাসি দেখে। লোকটার হাসি মোমের এত ভালো লাগে কেন? অদ্ভুত এক সৌন্দর্য রয়েছে এই চাপ দাঁড়ি যুক্ত স্নিগ্ধ হাসিতে। আপনাআপনি মোমের ঠোঁট জোড়া প্রসারিত হয়ে কিঞ্চিৎ হাসির ঝলকানির দেখা মিলল। তবে হাসিটা দীর্ঘস্থায়ী হলো না! আগুনের অস্বাভাবিক কাজে বিস্ময়ে দপ করে নিভে গেল। আগুন এক টানে মোমের গলা হতে ওড়না কেড়ে নিলো। যার দরুন মোমের বুক এখন আগুনের সামনে উন্মুক্ত! মেয়েলি শরীরি ভাঁজ স্পষ্ট দৃশ্যমান। মোম দু’হাতে বুক ঢেকে নিলো। অবিশ্বাসের স্বরে হতবিহ্বল অক্ষিপটে চেয়ে রুষ্ট গলায় বলে ওঠে,

” এসব কি করছেন, মাস্টার মশাই? দেখুন, এখন একদম কোনরকম দুষ্টুমি করবেন না বলে দিলাম! ”
আগুন ঠোঁট বাঁকিয়ে ভ্রু কুঁচকে ফেলল। চওড়া গলায় ধমকে বলে উঠলো,
” সবসময় মাথায় শুধু উল্টাপাল্টা জিনিস ঘুরে, তাই না? বিছানায় একটা প্যাকেট রাখা আছে। সেটাতে যা আছে পড়ে দ্রুত রেডি হও। এক্ষুনি তোমাকে নিয়ে এক জায়গায় যাবো। ”
” কোথায় যাবেন? ”
” গেলেই দেখতে পাবে। অলরেডি অনেক লেট হয়ে গিয়েছে তোমার জন্য। সময় ব্যয় করলে, এখন তো ওড়না নিয়েছি। এরপর নিজের হাতে সব খুলে চেঞ্জ করিয়ে দিবো। ”

মোম চক্ষুদ্বয় বড়ো বড়ো করে চেয়ে রইল। বিস্মিয়ে কিংকর্তব্যবিমুঢ় সে। আগুনের কথা শুনে মাথা ঘুরছে! তৈরী হবে কি? সে তো একই জায়গায় মূর্তির মতো ঠায় দাঁড়িয়ে। আগুন পুনরায় গমগমে গলায় বলে,
” সময় নষ্ট করছো কেন? ও বুঝতে পেরেছি। আমার হাতে রেডি হতে চাইছো, তাই তো? নো প্রবলেম কোমলমতি। তোমাকে হেল্প করতে আমি সর্বদা প্রস্তুত। ”
হতভম্ব মোমের টনক নড়ল। মৃদু আওয়াজে চিৎকার করে বলল,
” না’য়ায়ায়া! আমি নিজেই তৈরী হতে পারবো। ”
” জলদি রেডি হতে শুরু করো। সময় দশ মিনিট। ”

আগুন হসপিটাল এসেছে মোম’কে নিয়ে। মোম বেশ অবাক হলো। হঠাৎ হসপিটাল কেন এসেছে? কোনো কিছু বোধগম্য হচ্ছে না। চুপচাপ আগুনের সঙ্গে পা চালাচ্ছে। আগুন রুম নাম্বার সম্পর্কে পূর্বে অবগত ছিল, তাই খুব সহজে খুজে পেলো কাঙ্ক্ষিত রুমটা। মোম’কে নিয়ে ভেতরে প্রবেশ করল। মোম ভেতরে ঢুকতেই ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল। ঘন পাপড়ি যুক্ত নয়ন জোড়া বড়ো বড়ো করে তাকিয়ে থাকল। বারকয়েক পলক ঝাপটালো। ছোট্ট মস্তিষ্কের গাত্রে গাত্রে তীব্র বেগে হানা দিয়েছে উৎসুক্যের আবির্ভাব। ড্যাবড্যাব করে চেয়ে প্রশ্নবিদ্ধ চোখে আগুনের দিকে দৃষ্টি তাক করল। মোমের উদগ্রীব বুঝতে পেরে আগুন কিঞ্চিৎ মুচকি হাসল। উচ্ছ্বসিত কন্ঠে জানালো,
” স্বপ্ন নয়! যা দেখছো সবটা সত্যি। আফিফার বাবু হয়েছে। ছেলে বাবু। কয়েক ঘন্টা আগেই হয়েছে। তোমাকে আগে বলিনি, সারপ্রাইজ দিবো বলে। ”

মোম খুশিতে গদগদ হয়ে বাচ্চাদের মতো ঝড়ের গতিতে আফিফার কাছে গেল। পাশে একটা টুলে আশানুর বসে আছে তার নবজাতক ছেলেকে নিয়ে। মোম’কে দেখে আফিফা শুষ্ক ঠোঁটে ক্লান্তি মাখা হাসি উপহার দিল। আফিফার বেডের সাইডে বসে, মোম বাবু’কে তার কোলে দিতে বলল। আশানুর আস্তে করে বাবু’কে মোমের কোলে তুলে দেয়। মোম বাবুর কপালে চুমু খায়। আগুন কাছে এসে দাঁড়ায়। হাত দিয়ে বাবু’কে আলতো করে ছুঁয়ে দিল। হাত সরাতে নিবে তক্ষুণি ঘুমন্ত বাবুটা আনমনে আগুনের হাতের একটা আঙুল শক্ত করে মুঠো করে ধরে। আগুন চমকে ওঠে। পরপরই ঠোঁট এলিয়ে একপেশে হাসল। মোম চনমনে চিত্তে বলে উঠলো,

” কি সুন্দর না? ”
আগুন মাথা নাড়াল। আশানুর জিভ দ্বারা ঠোঁট ভিজিয়ে আগুনের উদ্দেশ্যে হাস্যকর গলায় বলল,
” আমাদের বন্ধু মহলে তুই পিছিয়ে গিয়েছিস! এবার তুইও ছক্কাপাঞ্জা মেরে দে। তাহলে কেল্লাফতে! ”
আগুন ভ্রু উঁচিয়ে জিজ্ঞেস করলো,
” আবার শুরু করে দিয়েছিস? হসপিটালে অন্তত রেহাই দে, ইডিয়ট! ”
” বাচ্চার বাবা হয়ে গিয়েছে। সেজন্য আমার মুখ এখন অলরাউন্ডার! ”
” বাজে বকিস না! ”
আশানুর ঠোঁট উল্টে জবাব দিল,
” সত্যি কথা তোর কোনকালেই হজম হয় না! এটা আবার নতুন কি? ”
আগুন আর প্রতিত্তোর করল না। কিছু বললে এই ছাগল এখন পেয়ে বসবে! তার থেকে মৌনতা বজায় রাখা শ্রেয়তর।
মোম এক দৃষ্টিতে বাবুর দিকে তাকিয়ে আছে। কেমন যেন অদ্ভুত এক শান্তি লাগছে। বাবু’কে দেখে আগুন কত খুশি। যদি তাদের বাবু হয়, তখন নিশ্চয়ই আগুন আরও অনেক বেশি খুশি হবে? হবেই তো। সে তো আগুনের র’ক্তের বাবু হবে। মোমের বাবু হলে মোম তাকে অনেক আদর করবে। সর্বক্ষণ বুকে জড়িয়ে রাখবে। বাবুর সঙ্গে সময় কাটিয়ে দিন পার করবে। ভেবেই মোমের মনে সুখের দোলা দিয়ে উঠল।

আয়মান শরীর অল্প দুলিয়ে নাচার ভঙ্গিতে বাড়িতে ঢুকছে। তার এত আনন্দ, উচ্ছাসের কারণ, আনিকা। আসার সময় সানাউল্লাহ’কে বলে আনিকা’কে সাথে করে নিয়ে এসেছে। শ্বশুরকে জানিয়ে এসেছে, আনিকা আজকে তাদের বাড়িতে থাকবে। আয়মানের খুশি দেখে কে? আনিকা বাড়িতে থাকবে মানে, তার সঙ্গে তার রুমে একই বিছানায় থাকবে! উফফ! কি যে শান্তি লাগছে আয়মানের বলে বোঝানো যাবে না।
আনিকা ড্রয়িংরুমে সোফায় বসে আছে। আয়মান গিয়ে তার কাছ ঘেঁষে বসে পড়ল। আনিকা বিরক্ত হলো। বর্তমানে ড্রয়িংরুমে বাড়ির সকলে অবস্থান করছে। রাশেদ, আগুন সবাই রয়েছে। আর এই নির্লজ্জ ছেলের কিনা ওর কাছ ঘেঁষে বসতে হলো? আনিকা সবার দিকে নজর বুলিয়ে, মুখবিবরে একরাশ অস্বস্তি নিয়ে কিছুটা দূরে সরে গেল। আয়মানের ভালো লাগলো না। নিরদ্বিধায় আনিকার কোমর টেনে পুনরায় নিজের কাছে নিয়ে আসলো। আনিকা আলগোছা ভাবে হাত সরিয়ে দিল। দাঁত পিষে কটমট করে তাকায় আয়মানের পানে। কন্ঠ খাদে এনে চিবিয়ে চিবিয়ে বলে,

” এমন বেহায়ার মতো আচরণ করছেন কেন? দেখছেন না, এখানে সবাই আছে। ”
আয়মান দুষ্টু হেসে ফিসফিস করে মিহি কন্ঠে বলল,
” সবাই আছে তো কি হয়েছে? ময়ূরী ছাড়া সবাই দম্পতি। আমাদের নতুন নতুন বিয়ে হয়েছে। আশাকরি সকলে বুঝবে। ”
” এতটা নির্লজ্জ মার্কা কথাবার্তা কিভাবে বলতে পারেন, বাবা ভাইয়ের সম্মুখে? ”
” তারা আমাদের কথা শুনতে পাচ্ছে না। আর শুনলেই বা কি? তাদের বোঝা উচিত, আমাদের এখন প্রাইভেসি দরকার। বাবা হিসেবে এবং বড়ো ভাই হিসেবে তাদের কর্তব্য আমাদের দু’জনকে এখন রুমে পাঠানো। ”
” দয়াকরে আপনার মুখটা বন্ধ করুন। ”
” আচ্ছা করলাম, তবে রাতে কিন্তু তুমি আমার রুমে থাকবে। কোনো চালাকি করে ময়ূরীর রুমে থাকার প্ল্যান করলে, তোমার খবর আছে। মনে রেখো! ”
আনিকা পাত্তা দিল না। নিজের মতো করে ভাবলেশহীন ভাবে চুপচাপ বসে রইল। রাশেদ গম্ভীর কণ্ঠে আনিকা’কে জিজ্ঞেস করলেন,

” আজকে এখানে থাকবে তোমার বাবা জানে? ”
আনিকা মাথা নিচু করে মৃদুস্বরে বলে,
” জ্বি, আমি তো আসতে চাইনি। আপনার ছেলে বাবা’কে বলে রাজি করিয়েছে। ”
মিনা স্নিগ্ধকর হাসি মুখে বললেন,
” এসেছো, ভালো করেছো। এটাতো তেমারও বাড়ি। অনুষ্ঠানের পর তো এখানেই থাকতে হবে। যাওয়া আসা করে নিজের মধ্যে থাকা জড়তা কাটিয়ে নেওয়া ভালো। ”
আনিকা মাথা নেড়ে মুচকি হাসল। আয়মানের মা কত্ত ভালো মনের একজন মানুষ। ভাগ্য করে এমন একজন শাশুড়ি পেয়েছে। এ বাড়ির প্রত্যেকে খুব আন্তরিক মানুষ। সবাইকে আনিকার বেশ পছন্দ, তবে আয়মানের খুঁতখুঁতো অসভ্যতা মার্কা স্বভাবের জন্য কিছুটা বিরক্ত হয়ে যায় মাঝে মাঝে।

ঘোলাটে নীলিমার বুক চিঁড়ে সন্ধ্যা নামছে ধরিত্রীতে। কি সুন্দর মনোমুগ্ধকর এই ধরণি, সুন্দরতম প্রকৃতি। চমৎকার সৃষ্টির সেরা জীবগুলো। ছাঁদের ছোট লাইটিংয়ের আলোতে রেলিং ঘেঁষে একপাশে দাঁড়িয়ে আছে আগুন, মোম এবং অন্য পাশে আয়মান, আনিকা। তারা চারজন এক সাথে চেয়ারে বসে ছিল। মূলত আয়মান, আনিকা’কে জবরদস্তি টেনে অন্য সাইডে নিয়ে গিয়েছে। আগুন সামনে ছিল, সেজন্য আনিকা কোনো সিনক্রিয়েট করেনি। নয়তো তেতে উঠতো আয়মানের উপর! এভাবে টেনে নিয়ে আসায় লজ্জা পেয়েছে সে। আগুন অবশ্য কিছু মনে করেনি। তার মুখভঙ্গি স্বাভাবিক। ওরা চলে যাওয়ায় আগুন মনে মনে খুশি হয়েছে। কোমলমতি’কে নিয়ে একা সন্ধ্যার এই সচ্ছল, স্নিগ্ধকর মুহূর্তটা উপভোগ করতে পারবে।
সাইডে আসা মাত্র আনিকা ঝাড়া মেরে হাত ছাড়িয়ে নিলো। ওপাশে নজর বুলিয়ে দাঁতে দাঁত চেপে বলল,

” আপনি কি পা’গল? ”
আয়মান ভুবনমোহিনী গোলাপের পাপড়ির মতো কোমল ওষ্ঠে ছড়িয়ে হেসে বলল,
” হ্যাঁ, তোমার জন্য। ”
” আপনার বড়ো ভাই-ভাবী ছিল। ”
” তাতে কি? ”
” লজ্জা করেনি আমাকে ওভাবে টেনে নিয়ে আসতে? ”
” লজ্জা করলে কি নিয়ে আসতে পারতাম নাকি?”
” সেটাও ঠিক! ”

আচমকা আনিকার কোমর প্যাঁচিয়ে নিজের সঙ্গে মিশিয়ে নিলো আয়মান। আনিকা হকচকিয়ে যায়। ঘাড় ঘুরিয়ে এদিক ওদিক নজর বোলালো। কেউ যদি দেখে নেয়? না, এদিকে কেউ নেই। আর আগুনের এদিকটায় কোনো খেয়াল নেই। সে ওদের দিকে পিঠ করে অন্য দিকে মুখ করে দাঁড়িয়ে রয়েছে। আনিকা রাগান্বিত চোখে চায়। আয়মান টপাটপ আনিকার গালে চুমু খায়। আনিকা হতভম্ব হয়ে গেল। তেজি স্বরে ঠোঁট নেড়ে কিছু বলতে উদ্যত হলো, পারলো না। আয়মান তার ঠোঁটে আলতো করে নিজের ঠোঁট দ্বারা ছুঁয়ে দিল। আনিকা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে ভোঁতা মুখে দাঁড়িয়ে রইল। আয়মান ঝুঁকে আসে। কোমরে রাখা হাতের বন্ধন দৃঢ় করল। মিটিমিটি হেসে আনিকার কানের পিঠে মুখ গুঁজে টিটকারি মেরে হিসহিসিয়ে বলে ওঠে,

” এত ভাব নিচ্ছো কেন ডার্লিং? এনগেজমেন্টের দিন যখন বলেছিলাম, আমি তোমার সাথে এনগেজমেন্ট করবো না। তখন তোমার মুখটা দেখার মতো হয়েছিল! তুমি তো কান্না করে ফেলেছিল। আমাকে পছন্দ যদি না-ই করবে, তাহলে সেদিন তোমার চোখে আমার জন্য বেদনার একরাশ অবিশ্বাস আর অভিমানের জল দেখতে পেতাম না। তুমি ভয় পেয়ে গিয়েছিলে, আমি যদি এনগেজমেন্ট না করি! তোমাদের মানসম্মান যাবে সাথে তোমার মনে আমার জন্য যে বিন্দু বিন্দু ভালোবাসা, ভালোলাগার পাহাড় গড়ে উঠছিল, সেটা মুহূর্তে ধূলিসাৎ হয়ে যাবে। যাকে ভালোবেসেছি তার চোখের ভাষা যদি বুঝতে না-ই পারি, তাহলে কিসের ভালোবাসলাম? ”
আনিকা এবার সরাসরি আয়মানের চোখে চোখ রাখল। মুগ্ধ দৃষ্টিতে চেয়ে রইল কিয়ৎকাল। লম্বা শ্বাস টেনে ভারিক্কি গলায় জানালো,

” আমি ভয় পাই আয়মান। ভালোবাসতে নয়, ধোঁকা খেতে। আমার মা নেই। বাবাই আমার সব। আমি জানি না, বাবা আপনাকে কখন কিভাবে পছন্দ করেছে। বাবা যে আপনার সঙ্গে আমার বিয়ে দিতে রাজি হবে, সেটা কোন কালেই ভাবিনি। এনগেজমেন্টের দিন ওনার চোখে কিছু প্রাপ্তির খুশি দেখেছিলাম। এদিকে আপনিও অজান্তে আমার মনে জায়গায় করে নিয়েছিলেন। সেজন্য সেদিন আপনার বলা কথায় বড়ো রকমের হোঁচট খেয়ে ছিলাম। ভাবলাম, হয়তো আপনি কপাল ফাটানোর জন্য প্রতিশোধের স্পৃহায় আমার সঙ্গে এতদিন নাটক করছিলেন! তাই কিছুটা ঘাবড়ে গিয়েছিলাম। ”
আয়মান তর্জনী স্পর্শ করল আনিকার ঠোঁটে। যত্ন নিয়ে কপালে দূঢ় ভাবে আদুরে চুমু এঁটে দিল। মাথাটা বক্ষে চেপে ধরে শান্ত গলায় বলল,

” আমি স্বীকার করছি, অনেক মেয়েদের সাথে ফ্ল্যাটিং করেছি। বাট তোমার সঙ্গে নয়! আর নাটক? আমি তোমাকে কিছু করতে চাইলে সরাসরি করতে পারতাম। নাটক করার প্রয়োজন পড়তো না। তোমাকে আমি হৃদয়ের গহীন থেকে অনুভব করেছি। আমার মন তোমাকে ভালোবাসতে চেয়েছে, তাই তোমাকে ভালোবেসেছি। হাতছাড়া হওয়ার আগে ডিরেক্টলি বিয়েও করে নিয়েছি। ”
আনিকা মাথা তুলে চায়। ছলছল চোখে চেয়ে বলে,
” আপনাকে ভালোবাসি শব্দটা কখনো বলতে পারবো নাকি জানি না! তবে আমি আপনাকে চাই। আমার জীবনের প্রতিটা মুহূর্তে আপনাকে পাশে চাই। থাকবেন তো? ”

আয়মান, আনিকার ভেজা চোখের পাতায় চুমু খেল। গাল টিপে হেসে আওড়াল,
” আ রে, থাকবো মানে? তুমি থাকতে না চাইলেও তোমাকে জোর করে রেখে দেবো। এই জনমে এই আয়মান শিকদার এর থেকে তোমার মুক্তি নেই, ডার্লিং! ”
আয়মানের ঠোঁট বাঁকিয়ে জবাব দেওয়ার ধরন দেখে আনিকা হেসে উঠল। আলতো চাপড় মারলো আয়মানের বাহুতে। আয়মান ঠোঁট কামড়ে হাসে।

প্রকৃতি হতে মৃদুমন্দ হাওয়ায় বইছে। মোম’কে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে আগুন ঠায় দাঁড়িয়ে আছে। আগুনের বেহায়া হাত মোমের পেটে বিচরণ করছে। মোমের খোঁপা বাঁধা চুলগুলো আগুন খুলে দেয় অবলীলায়। পেটে আরেকটু চাপ দিয়ে ঘনকালো চুলে মুখ ডুবিয়ে দিল। আগুনের শীতল হাতের সংস্পর্শে মোমের শরীর কেঁপে ওঠে। আগুন লম্বা শ্বাস টেনে চুলের ঘ্রাণ নাসারন্ধ্রে টেনে নিয়ে কন্ঠে মাদকতা মিশিয়ে ডাকল,
” কোমলমতি? ”
আগুনের হাতের উপর হাত রেখে আস্তে করে মোম উত্তর দেয়,
” হুম! ”
” তোমার মাঝে কি এমন আছে, যার জন্য বেশি সময় ধরে আমি তোমার থেকে দূরে থাকতে পারি না? ”
মোম লজ্জা মিশ্রিত নিঃশব্দে মৃদু হাসল। আগুন মাথা নামিয়ে মোমের ঘাড়ে অধর চেপে চুমু খেয়ে শান্ত কন্ঠে শুধাল,

” তুমি কি তন্ত্রমন্ত্র জানো নাকি, হ্যাঁ? বাচ্চা একটা মেয়ে! কি জাদু করেছো আমায়, হুম? ”
মোমের হৃৎপিণ্ডের কোষ গুলো ধড়ফড় করতে লাগলো। রন্ধ্রে রন্ধ্রে ছুটে বেড়াচ্ছে সুখকর অনুভূতি। ঘনঘন নিঃশ্বাস নিচ্ছে। আগুন গ্রীবা বাঁকিয়ে মোমের গলায় মুখ গুঁজে দিল। গলদেশে ঠোঁট দিয়ে স্লাইড করতে করতে হাস্কিস্বরে বিড়বিড়িয়ে আওড়াল,
” আমাকে বশীভূত করার জন্য তোমাকে কি শাস্তি দেওয়া যায়, বলোতো? ”

শুভ্ররাঙা ভালোবাসা পর্ব ৩৯

মোম কথা বলতে পারছে না। কন্ঠ ফুঁড়ে শব্দ বের হচ্ছে না! আগুনের ঠোঁটের বিচরণে মোমের সর্বাঙ্গে শিউরে উঠছে। দাঁড়িয়ে থাকা মুশকিল হয়ে যাচ্ছে। যথাসাধ্য উৎকৃষ্টতার বলে নিজের শক্তি প্রয়োগ করে পেট হতে আগুনের হাত ছাড়িয়ে, পেছন ফিরে আগুন’কে দুহাতে শক্ত করে জড়িয়ে ধরল। বুকের ভেতর ধ্রীম ধ্রীম শব্দ হচ্ছে তার। এই বুঝি হৃৎপিণ্ডটা ছিটকে বেরিয়ে আসবে। আগুন নিজেও তার কোমলমতি কে আগলে নিলো। অগোছালো চুলের ভাঁজে পরপর কয়েকবার চুমু খেল। মোম’কে বুকের ভেতর শক্ত করে জড়িয়ে ধরে, সন্ধ্যার হিম শীতল কোমলপ্রাণ স্নিগ্ধতায় ভরপুর আবহাওয়া উপভোগ করতে লাগলো।

শুভ্ররাঙা ভালোবাসা পর্ব ৪১