রাজনীতির রংমহল সিজন ২ পর্ব ৭৪
সিমরান মিমি
ভোর তখন সাড়ে চারটা।আকাশে তখন আদৌ আলোর কোন রেশ দেখা দিয়েছে কি-না জানা নেই।তখন পুরো ধরণীময় কুয়াশারা রাজত্ব করছে।তাদের এই রাজত্বের স্থায়ীত্ব পুরো দশটা থেকে এগারোটা পর্যন্ত থাকবে।শীতের এই তীব্র ঠান্ডায় ঠকঠক করে কাঁপছে স্পর্শীয়া।প্রতিটা দাঁত যেন অন্যটার সাথে লেগে যাচ্ছে জোড়ালো ভাবে।
গায়ের উপরের সাদা কম্বল টাকে টেনে আরেকটু জড়িয়ে নিলো।মাথার ভেঁজা তোয়ালে টা পলিথিনের ন্যায় পোটলা হয়ে পড়ে আছে বালিশের উপরে।পরশের ঠিক বিপরীত দিকে মুখ করে শুয়ে আছে স্পর্শীয়া।বিষয়টা বড্ড বেমানান।নতুন বউ,কোথায় এই শীতে জামাইয়ের বুকের মাঝখান টাতে এসে জড়সড় হয়ে দলা পাকিয়ে বসে থাকবে তা না;উলটো মুখ ফিরিয়ে অন্যদিকে ঘুরে শুয়ে আছে।পরশ আরেকটু কাছে গেলো।নিজের ঠান্ডা হাত কম্বলের মধ্যে নিয়ে উদরে ছুঁইয়ে দিলো স্পর্শীর।আচমকাই শিউরে উঠে দলা পাঁকিয়ে বসে পড়লো স্পর্শী।কাঁপতে কাঁপতে বললো,_”ভালো হচ্ছে না কিন্তু।সারারাত জ্বালিয়েছেন।এই ঠান্ডার মধ্যে চুবিয়েছেন।এখনো যদি ঘুমাতে না দেন তো কুরুক্ষেত্র বাঁধিয়ে ছাড়বো।”
আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন
মুখ চেপে ধরলো পরশ।একহাত দিয়ে টেনে আবারো কম্বলের মধ্যে আনলো।এরপর দুহাত দিয়ে চেপে ধরে বললো,_”চেঁচাচ্ছো কেন?সবাই শুনলে কি ভাববে?
নুইয়ে পড়লো স্পর্শী।ঘুমে চোখ বুঝে আসছে প্রায়।মুখের শব্দগুলো যেন বের হতে চাইছে না।জড়ানো গলায় বললো,_”ঠান্ডা দিবেন না।না হলে চিল্লাবো।”পরশ মাথা নাড়িয়ে সায় জানালো।এরপর সুতোবিহীন পৃষ্ঠের উপর চুম্বন দিয়ে বলল,_”আচ্ছা জ্বালাবো না।কিন্তু আমার সাথে কথা বলতে হবে।”স্পর্শী কি শুনলো নিজেও জানেনা। তবুও মাথা নাড়িয়ে সায় দিলো।পরশ সান্নিধ্যে আবারো জড়িয়ে নিলো।কাধের এক পাশে ঠোঁট ছুঁইয়ে দিতে দিতে বললো,_”এখন বিশ্বাস হচ্ছে তুমি আমার-ই বউ।”স্পর্শীর কানে গেল কথাটা।মুচকি হেসে জড়ানো আওয়াজে বললো,_”এতোদিন কি অন্যকারো বউ মনে হতো? ”
_”উঁহু!ত্যাড়ামি করো না।যা বলছি সেটার উত্তর দাও।একদম সত্যি কথা বলবে।আমি চাইনা আমাদের প্রথম সকাল টা মিথ্যে দিয়ে শুরু হোক।”
চমকে চোখ দুটো বড় করে ফেললো স্পর্শী।ঘুম তৎক্ষনাৎ -ই ছুটে গিয়েছে।কান সজাগ রেখে সন্দেহী গলায় বললো,_”কি সত্যি কথা?”
পরশ চুপ করে নিজেকে সাজিয়ে নিলো।মুহুর্ত খানিক কাটার পর সিরিয়াস কন্ঠে জিজ্ঞেস করলো,_”তুমি কি করে জানতে সেদিনের বিয়ের কথা?তোমাকে তো জানাইনি,তারপরেও কোনো বাঁধা ছাড়া নির্দিধায় কেন বিয়ে করলে?আর পাভেলের সাথেও বা হুট করে এতোটা ঘনিষ্ঠতা কেন?তোমাদের মধ্যে আদৌ চলছে টা কি?ওই-ই কি বিয়ের কথা জানিয়েছিলো তোমায়?আচ্ছা পাভেল কি চেয়েছিলো যাতে তুমি আমায় বিয়ে না করো।”
চমকে গেল স্পর্শী।হতভম্ব হয়ে চেয়ে রইলো পরশের দিকে।এতোক্ষণ উল্টাপাল্টা বুঝিয়ে বুঝ দেওয়ার চিন্তা-ভাবনা করলেও এই মুহুর্তে সেই সিদ্ধান্ত পালটে নিলো।কোনোভাবে পাভেলের ব্যাপারে নেগেটিভ চিন্তা যদি পরশ শিকদারের মনে এসে পড়ে তাহলে সবকিছু ধসে পড়তে কিঞ্চিৎ সময়-ও লাগবে না।এদের দু-ভাইয়ের সম্পর্ক খারাপ হবে এটা কল্পনায়-ও ভাবতে পারে না সে।কন্ঠে তেজ এনে বললো,
_”আপনার কি মাথা খারাপ হয়ে গেছে নাকি?কি সব আবোল তাবোল কথাবার্তা বলছেন।পাভেল ভাইয়ের সম্পর্কে এসব নেগেটিভ ভাবনা চিন্তা আনলেন কিভাবে আপনি?উনি কেন আমাদের মধ্যে বাঁধা হতে চাইবেন।আর আমাদের মধ্যে হুট করে যে ভালো সম্পর্ক টা হয়েছে তাতে তার কোনো সায় নেই।বরঞ্চ আমি নিজেই ওর সাহায্য চেয়েছি যে-চে।আর সেটাও আপনার জন্য।”
থেমে,
দেখুন যেখানে আপনি নিজ ভাইয়ের সম্পর্কে এরকম ভেবেই ফেলেছেন সেখানে আমি আর কিছু লুকাবো না।আপনি যখন সুজন কে প্রশ্রয় দিয়ে লুকিয়ে রেখেছিলেন ঠিক সেই সময়টাতে একদিন রাতেরবেলা আমার কাছে একটা ছবি আসে হোয়াটসঅ্যাপে।সেখানে সুজন সহ আরো একজন ছিলো।”
পরশ শান্ত কন্ঠে বললো,_”আরো একজন ছিলো -এভাবে বলছো কেন? সরাসরি বলো সুজনের সাথে ওটা সোভাম সরদার মানে তোমার বড় ভাই ছিলো।”
চমকে উঠলো স্পর্শী।বললো,_”আপনি কি করে জানলেন?
পরশ হাসলো।এরপর তাড়া দিয়ে বললো,_”এরপর বলো।আগে আমার প্রশ্নের উত্তর দাও।তারপর আমি দিচ্ছি।
স্পর্শী কিছু বলতে গিয়েও থেমে গেল।অপমানিত হয়ে চোখ নামিয়ে পুণরায় বলতে লাগলো,_”হ্যাঁ, ওটা ভাইয়া-ই ছিলো।আমি ওইদিন সুজনের সাথে ওকে দেখে থমকে গেছিলাম।এরপর বেশ কয়েকদিন চোখে চোখে রেখেছিলাম।ওর ফোনে বলা কিছু কনভারসেশন শুনতে পেয়েছি।কবির খাঁ এর সাথে প্রায়শই কথা বলতো।আর সুজন সহ আরো চার পাঁচ জন তো দেখাই করতে আসতো সরাসরি। তবে সেটা গোপনে।কিন্তু ভাইয়া কিছু করেনি।হ্যাঁ ও জেদের বশে ভুল করেছে কিন্তু এটা অন্যায় না।সুজন সহ ওরা দুজন ওইদিন রেপ করার পরে ভাইয়া সুযোগ লুটতে চেয়েছিলো।ও জানতো আপনি কখনোই নিজ দলের কাউকে সাজা পেতে দিবেন না।
এতে আপনার দূর্নাম হবে।আর সবচেয়ে বড় কথা,সুজন আপনার খাস লোক।এইজন্য-ই কবির খাঁ এর সাথে হাত মিলিয়েছিলো যাতে আপনাকে পদে পদে বিপদে ফেলতে পারে।হুট করে আমার জন্য সুজনের সাথে আপনার বিরোধিতার কারনে ও নিজেও ভাইয়ার কথা মতো কাজ করেছে,কারন ও নিজেও জানতো ভাইয়া এ বিয়েতে রাজী না। ভাইয়া রাজনীতির সাথে তেমন ভাবে জড়িত না বলেই কবির খাঁ এর সাহায্য নিয়েছে।রাজনৈতিক ভাবে,প্রশাসনিকভাবে উপরমহল থেকে আপনার উপর ঠিক যত প্রকার চাপ সৃষ্টি করা যায় সেটা কবির খাঁ করতো।
অন্যদিকে সুজন বারবার আপনার থেকে অনুগ্রহ চেয়ে রক্ষা পাওয়ার চেষ্টা করতো যাতে জনগণ আপনার উপর ক্ষেপে যায়।সুজন চাইলে নিজেই কোথাও লুকাতে পারতো।কিন্তু ও যায় নি , বরং আপনার কাছে থেকে সব দোষ আপনার উপর চাপানোর জন্য।এদিকে এসব দেখে যেন আমি বিয়েটা ভেঙে দেই,আর অন্যদিকে প্রতিনিয়ত সুজনকে দিয়ে আপনার নামে বাজে কথা বলিয়েছে আব্বুর কাছে। যাতে সেও রাজী না হয়।মানে সব দিক থেকে আষ্টেপৃষ্ঠে ধরেছিলো।একদিকে রাজনৈতিক চাপ,প্রশাসনিক চাপ,জনগণের চাপ,হুট করে দলের মধ্যেই নতুন শত্রুর আবির্ভাব,আমাকে আর আব্বুকে দিয়ে বিয়ে ভাঙানো থেকে শুরু করে শত্রুর সাথে হাত মেলানো পর্যন্ত করেছে।আর মাঝখানে বসে সম্পুর্ন ভাবে গুটি গুলো চেলেছে সোভাম ভাই।আমি জানি না আপনার প্রতি ওনার এতো আক্রোশ কেন?আপনিও বা ওনার প্রতি এতোটা হিংস্র কেন?ভাইয়া রাজনীতি পছন্দ করে না।ব্যবসা করে।তাও আপনাকে ধ্বংস করার জন্য উঠেপড়ে লেগেছে।কেন?
আমি সবটা যখন বুঝতে পারি তখন আপনাকে বারবার চাপ দেই যাতে সুজনকে ধরিয়ে দেন।কিন্তু আপনি আমার কথা কানে ও নেন নি।এরপর পাভেল ভাই কে জানাই।উনি সবটা শোনার পর আমাকে সাহায্য করেন।বারবার আপনাকে ভয় দিতে থাকেন যে আমি আপনাকে ছেড়ে চলে যাবো।এরপর যেই দিন আপনি আমাকে নিয়ে তালতলি গিয়েছেন ওটা আমার-ই প্লান ছিলো।আর সুজন সহ বাকিদের নামে যেসব কথা আপনাকে জানিয়েছে সেটাও আমার কথামতো।যাতে আপনি সব টা বুঝতে পেরে ওকে ধরিয়ে দেন।তবে ওভাবে বিয়ে করার কোনো ইচ্ছে না হলেও বাধ্য হয়ে করেছি।কারন আমি চাইনি সোভাম ভাইয়া আবারো কোনো পরিকল্পনা করুক।ওনার রাগের মূলেই ছিলাম আমি।উনি কিছুতেই চাইতেন না আমার বিয়ে আপনার সাথে হোক।সেজন্যই বিয়েটা করা।আর কিচ্ছু না।এতে পাভেল এর কোনো দোষ নেই।আমি যেভাবে বলেছি ও সেভাবেই করেছে।”
পরশ ঠোঁট কামড়ে হাসলো।বললো,_”ওহ,আচ্ছা।থ্যাংক ইউ!”
ভ্রুঁ যুগল কুঁচকে পরশের দিকে তাকালো স্পর্শী।সন্দেহী কন্ঠে বললো,_”আপনি কি কিছুই জানতেন না?আচ্ছা ছবির ওই লোকটা যে আমার ভাইয়া-ই ছিলো সেটা কিভাবে জানলেন?আর আমি যে এতোসব মিথ্যে বলি নি সেটাও বা নিশ্চিত হলেন কিভাবে?এইইই!সত্যিটা বলুন।নইলে কিন্তু খুব খারাপ হয়ে যাবে।”
নিজেকে ছাড়াতে ছাড়াতে পরশ হেসে বললো,_”আরে আশ্চর্য মহিলা তো তুমি?বিশ্বাস করলেও দোষ, না করলেও দোষ।”
স্পর্শী একদৃষ্টে অবিশ্বাসের চোখে তাকিয়ে রইলো।পরশ চোরাচোখে আশেপাশে তাকালো।এরপর আচমকাই জড়িয়ে নিয়ে বললো, _”আরে বাবা এতো রাগ করার কি আছে?আচ্ছা,তুমি তো কিছুই জানতে না।এটা বলো যে ওইদিন ওই সোভাম আর সুজনের ছবি কে দিলো তোমায়?”
_”সেটা এখনো জানতে পারি নি।ওই নাম্বার বন্ধ বলছে।”
থেমে, পরশের দিকে তাকাতেই মুখভঙ্গি পালটে গেলো স্পর্শীয়ার।হতভম্বের ন্যায় তাকিয়ে থেকে আর্তনাদ করে উঠলো।নিজেকে আপ্রান ছাড়ানোর চেষ্টা করতে করতে আহত গলায় বললো,_”ওটা আপনি ছিলেন?তার মানে মাঝখান থেকে আমাকে গুটি হিসেবে আপনি ব্যবহার করেছেন।তাও নিজের ভাইকে লেলিয়ে দিয়ে?ছাড়ুন, ছোবেন না আমায়।আল্লাহ!আমি বুঝতেই পারলাম না।”
পরশ ছাড়লো না।বরং বাঁধন আরো শক্ত করলো।আদুরে গলায় অনবরত বলতে লাগলো,_”আরে রাগ করছো কেন?আমি কি ভুল কিছু করেছি?আচ্ছা জান শোনো না।আমি তো তোমায় এসবে জড়াতে চাইনি।বরং তুমি নিজেই পাকনামি করতে করতে ঢুকে গেছো।কিচ্ছু করার ছিলো না আমার।তোমার ভাইকে শায়েস্তা করার জন্য আমি নিজেই যথেষ্ট ছিলাম।তবে এখানে ঘটনা সম্পুর্ন আলাদা।যদি ধর্ষণ সম্পর্কিত কোনো ঘটনায় সোভাম জড়িত থাকতো তাহলে কথাই ছিলো না।কিন্তু সমস্যা হচ্ছে ও মাঝখানে বসে সব নাড়াচাড়া দিচ্ছে গুটি দিয়ে।
ওর বিরুদ্ধে নিশ্চিতভাবে কোনো অপরাধের প্রমাণ নেই।যদিও মাঝখানে বসে ষড়যন্ত্র করার জন্য ওকে দোষী করিও, কিন্তু সেই তীরের ফলা শেষ মেষ আমার দিকেই ঘুরবে।কারন সুজন আমার দলের লোক।যে নিজেই ধর্ষক।আর তোমার মাধ্যমে এসব করেছি কারন আমি চাইছিলাম তুমি নিজেই যাতে আমাকে বিয়ে করো।তুমি একটাবার ভাবো,সোভাম তোমাকে দিয়ে বিয়ে ভাঙতে চেয়েছিলো,আর আমি তোমার মাধ্যমেই বিয়ে করে নিলাম।ব্যাপারটা জোশ না।কে জিতেছে বলো?আমি না কি তোমার ভাই?আচ্ছা সেসব বাদ দাও।জিতেছো তো তুমি।কারন আমার মতো একটা জামাই পেয়েছো যে।আচ্ছা ডার্লিং,বলো না।জিতেছো না তুমি?”
রাজনীতির রংমহল সিজন ২ পর্ব ৭৩
স্পর্শী দাঁতে দাঁত চেপে চুপ করে রইলো।পরশ আবারো সেই রাগে ঘি ঢেলে দিলো।সুতোবিহীন ঘাড়টাতে ঠান্ডা নাক ঘষে বললো,_”দেবরের কথা ভাবছো নাকি?আরেহ!পাভেল তো আমাকে জিজ্ঞেস না করে ওয়াশরুমে পর্যন্ত যায় না।সেখানে আমার কোনো সায় না নিয়ে তোমার কথামতো কাজ করবে?ধুর!তুমি আর তোমার ভাই কতকিছুই না ভেবে বসে থাকো।হাস্যকর!”