পাতা বাহার পর্ব ৫৩ (২)

পাতা বাহার পর্ব ৫৩ (২)
বেলা শেখ 

অন্তঃসারশূন্য গভীর দীর্ঘ রজনী। শীতের দিবাকাল ছোট, রাত্রি দীর্ঘ হয়ে থাকে। তাই তো রাত দশটাকেই বেশ গভীর মনে হয়। বাড়িতে বধুয়ার আগমন ঘটেছে। হৈহৈ কান্ড রৈ রৈ ব্যাপার স্যাপার। সকলের মাঝেই চাপা উত্তেজনা বউ দেখার। পুরো বাড়িতে মানুষজনের অঢেল ভিড়! অরুণ ঘুমন্ত ছেলেকে কোলে নিয়ে ভিড়ের মাঝে পাতাকে খোঁজে। আশ্চর্য মেয়েটা কই? সবাইকেই তো দেখা যাচ্ছে! অরুণ ভিড় ঠেলে নিজেদের জন্য বরাদ্দ প্রিয়’র রুমে ঢুকে। বিছানায় আপাদমস্তক মোড়ানো নারী অবয়ব দেখে স্বস্তির শ্বাস ছাড়লো। মেয়েটা ঘুমোচ্ছে। সে ভোরকে তাঁর পাশে শুইয়ে দিয়ে শু মুজো খুলে দেয়। নিজ ব্লেজার খুলে শার্টের বোতামে হাত চালাতেই কেউ ধরাম করে দরজা খুলে প্রবেশ করে। প্রিয়কে দেখে অরুণের চোখে মুখে বিরক্তের রেশ ফুটে ওঠে। এবাড়িতে আসার পর থেকেই মেয়েটা তাদের মিয়া বিবির মাঝে ফোড়ণ হয়ে ঢুকে পড়ে। পারেনা পাতার সাথে চুইংগামের ন্যায় চিপকে থাকতে।

-” কিছু বলবে?”
তার রসকষহীন গলার স্বর শুনেই প্রিয়’র রাগ হয়। তার কত সুন্দর রসগোল্লার মতো আপুর কি না নিমপাতার মতো তিতকুটে জামাই বাবু জুটেছে! সে বিছানায় ঝুঁকে বলে,
-” বলব তবে আপনাকে না। আমার পাতুপুকে! এই পাতুপু? ওঠো? কাওছার ভাইয়ের বউ এসেছে দেখবে না?”
অরুণ ত্যাক্ত গলায় বলে,
-” পাতুপু কেমন বিদঘুটে শোনায়! আপু বলে ডাকতে কি সমস্যা?”
প্রিয় চোখ বড় বড় করে অরুণের দিকে চায়। কোমড়ে দু হাত রেখে ঝগরুটে ভঙ্গিতে বলে,
-” আমার পাতুপুকে আমি যা খুশি ডাকবো তাতে আপনার কি?”
-” আমারই তো সব। আ’ম হার হাসবেন্ড!”
-” হাসবেন্ড বলে কি মাথা কিনে নিয়েছেন নাকি? শুনুন দুলাভাই আপনাকে আমি পাতুপুর হাসবেন্ড হিসেবে মানি না!”

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

অরুণ মুচকি হাসলো। প্রিয়’র মাঝে যেন কিশোরী পাতার ছায়া পাওয়া যায় ক্ষীণ। সে হামি তুলে বলে,
-” মানো না অথচ দুলাভাই ডাকছো! শোনো পিচ্চি শালিকা তুমি না মানলে এই অরুণ সরকারের বয়েই গেছে! তোমার আপু চোখে হারায় আমাকে!”
অরুণ অতি কৌশলে প্রিয়কে রাগিয়ে দেয়। প্রিয় রাগে লাল হয়ে ফুঁসতে ফুঁসতে বলে,
-” সেটা তো আপুর মতিভ্রম হয়েছে! নইলে আপনার মতো বুড়োকে বিয়ে করে? তাও আবার বাচ্চার বাপ!!”
-” বুড়ো লাগে আমাকে? এখনো রাস্তাঘাটে বেরোলে মেয়েরা হুমড়ি খেয়ে পড়ে! লুকিয়ে ফোন নম্বর,লাভ লেটার দিয়ে যায়। আমি জানি তুমিও একটু আকটু ইমপ্রেসড আমার প্রতি! পাতার পাশে সহ্য হয়না তাই এরকম করো! তাই না?”
দুষ্টুমির সুরে বলল অরুণ! কিশোরী প্রিয় রাগ সামলাতে না পেরে অরুণের বাহুতে কিল ঘুষি মারতে শুরু করে। এ পর্যায়ে অরুণ খানিকটা অপ্রস্তুত হয়ে পড়ে সাথে হাসিও পায়। সে হেসে বলে,

-” আরে বাবা রাগ করছো কেন? আমি তো সম্ভব নয়। দোয়া করে দিলাম আমার থেকেও বুড়ো তবে কিউট হাসবেন্ড হবে তোমার!”
-” কি হচ্ছে এখানে?”
হঠাৎ তৃতীয় ব্যক্তির কথা শুনে দুজনেই ফিরে তাকালো। প্রিয় অভিযোগের সুরে বলে,
-” তোমাকে ডাকতে এসেছিলাম আমি। তোমার অভদ্র বুইড়া জামাই আমার সাথে ঝগড়া লাগাইছে! তারে সাবধান কইরা দাও নইলে তাঁর কিমা বানাবো!”
পাতা উঠে বসে। অরুণ ও প্রিয়’র দিকে একনজর চেয়ে বলে,
-” বলেছি না বুড়ো বলবিনা? সম্মান দিয়ে কথা বলবি!”
প্রিয় গাল ফুলিয়ে অরুণের দিকে চায়। অরুণ ইশারায় বোঝায় বলেছিলাম না চোখে হারায়! প্রিয় দাঁত কপাটি পিষ্ট করে বলে,

-” নিকুচি করেছে সম্মান! তুমি তোমার বুইড়া জামাইকে কোলে নিয়ে বসে থাকো!”
দাঁড়ায় না প্রিয়; গটগট পায়ে চলে যায়। অরুণ তাঁর কান্ডে হেসে দিল। দরজা ভেজিয়ে বিছানায় বসে। পাতার কপালে গলায় হাত রেখে বলল,
-” চোখ মুখ ফুলে আছে কেন? কেঁদেছো?”
পাতা অরুণের চোখে চোখ রেখে শান্ত গলায় বলল,
-” প্রচুর মাথা ব্যাথা করছিলো। বমি করেছি কয়েকবার! সেজন্যই!”
অরুণের কপালে গাঢ় ভাঁজ পড়ে। একটু সন্দেহ হয় তবে চোখে চোখ রেখে বলায় বিশ্বাস করে নেয়। চোখের কোনায় জমা নোনাজল মুছে কপালে অধর ছুঁয়ে বলে,

-” আমাকে ফোন কেন করো নি? আর মাথা ব্যাথা কেন হলো? ব্যাথা করছে এখনো?”
-” এখনো করছে ব্যথা! ভালো লাগছে না আমার! অসহ্য লাগছে সবকিছু। আপনাকেও!”
পাতা নাক টেনে বলে! অরুণের চোখে মুখে চিন্তার ছাপ। বমি হলেই মেয়েটা তীব্র মাথা ব্যাথায় ভোগে। অরুণ গায়েনী ডাক্তারের কাছে কল লাগায়। তার সাথে কথা বলে পাতাকে জিজ্ঞেস করে,
-” খেয়েছো কিছু?”
মাথা নাড়ায় পাতা খায় নি কিছুই। অরুণ উঠে যায়! বাইরে চাপকল চেপে হাত মুখ ধুয়ে প্রিয়কে বলে পাতার জন্য খাবার আনতে বলে। প্রিয় অরুণের উপর হম্বিতম্বি করলেও অতি প্রিয় আপুর জন্য খাবার এনে দেয়। অরুণ নিজ হাতে পাতাকে সবটুকু খাবার খাইয়ে একটা প্যারাসিটামল খাইয়ে বলে,
-” ঘুমিয়ে পড়ো পাতাবাহার ভালো লাগবে!”
-” ওয়াশ রুমে যাবো!”

অরুণ তাকে ধরে ওয়াশ রুমে নিয়ে যায়। সেখান থেকে এসেই পাতা ভোরের ওপাশে গিয়ে শুয়ে পড়ল। অরুণ বাইরে কাওছারের কাছে একবার ঘুরে আসে। সম্পর্কে বোনের জামাই সে; কিছু দায়িত্ব আছে না? দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করে অরুণ নিজ দরজায় খিল দিবে প্রিয় তাতে বামহাত ঢুকিয়ে বলে,
-” মনে হচ্ছে কাওছার ভাই না আপনিই বাসর ঘরে যাচ্ছেন! এতো তাড়া কিসের হুম?”
অরুণ কি বলবে এই কিশোরী ইঁচড়ে পাকা মেয়েকে? বয়সের তারতম্য অনেক বেশি। তাই সে জবাব দিতে পারে নি। নইলে সেও মুখ্য জবাব দিতে জানে। অরুণ শার্ট খুলে লাগেজ থেকে মুভ ক্রিম বের করে। ভোরের পাশে গা এলিয়ে লেপের মাঝে নিজেকে আবৃত করে। ভোর পাতাকে কোল বালিশের ন্যায় আষ্টপৃষ্টে জড়িয়ে রেখেছে। অরুণ তাকে ছাড়িয়ে নিজের সাথে জড়িয়ে নিল। ভোর ঘুমের ঘোরেই বাবার মুখ হাতরিয়ে ‘বাবা’ বলে বিড়বিড় করে বলে ‘ভোর দই খাবে না’! অরুণ ছেলের ঠোঁটে সশব্দে চুমু দিয়ে ফিসফিসিয়ে বলে,

-” তো আদর খাও বাবা!”
ভোর ধীমে স্বরে বিড়বিড় করে এটা ওটা বলে! অরুণ দরূদ পাঠ করে ছেলের মুখে ফুঁ দিলো। নিশ্চয়ই হাবিজাবি স্বপ্ন দেখছে। অরুণ ভোরকে বুকে নিয়েই পাতার দিকে এগিয়ে আসে। তর্জনী আঙ্গুলের ডগায় মুভ ক্রিম নিয়ে পাতার কপালে ম্যাসাজ করতে থাকে। পাতা ফুঁপিয়ে ওঠে তবে চোখ খোলে না। লোকটার এই ছোট ছোট যত্ন পাতার খুব প্রিয়। ভালো লাগে; মনটা নেচে ওঠে। কিন্তু আজ বুকে কাঁপন ধরায়। লোকটা বর্ষা নামক মহিলাকে নিশ্চয়ই একরকম যত্ন করতো!

পরদিন সকাল না হতেই অরুণ বাড়ি ফেরার সিদ্ধান্ত জানায়। যাওয়ার কথা আজ বিকেলেই ছিল। তবে দূরপাল্লার পথ, বিকেলে বেরোলে ফিরতে রাত হবে! রাতের জার্নি সেফ হবে না। রোডে ডাকাতি বা ছিনতাইয়ের ঘটনা অহরহ। অরুণ কোনো রিস্ক নিতে চায় না। পাতা বাধ্য পত্নীর ন্যায় মেনে নেয় তার কথা। লাগেজ গুছিয়ে সে উঠোনে বসেছে। পারুল তাঁর মাথায় তেল দিচ্ছে আর এটা ওটা উপদেশ দিচ্ছে। পাতা চুপচাপ শুনতে থাকে। অরুণ বাজারে গিয়েছে কিছু দরকারি জিনিসপত্র কিনতে। ভোর তাঁর সমবয়সী বাচ্চাদের সাথে লুকোচুরি খেলছে। বাড়ি ভরপুর মেহমান উঠোনে নতুন বউকে বসিয়ে হাসি ঠাট্টায় আসর জমিয়ে রেখেছে। কাওছার একটু পর পর ঘর থেকে উঁকি ঝুঁকি দিচ্ছে। বেচারা বিয়ের পরেও বউয়ের সাথে প্রাণ খুলে কথা বলতে পারছে না। পাতা তা লক্ষ্য করে মুচকি হাসলো। পারুল তাঁর হাসি দেখে বলে,

-” এই পাতু হাসছিস কেন? আমি কি হাসির কিছু বলেছি?”
-” না মা! এমনিতেই হাসি পেলো!”
পারুল বুঝতে পারে পাতা তার কোনো কথাই গ্রাহ্য করছে না। সে হতাশ ভঙ্গিতে বলে,
-” আমি তো এখন পর হয়ে গেছি তাই আমার কথা আর ভালো লাগেনা তাই না?”
-” পর’ই তো তুমি আমার। আপন হলে তো তোমার কাছেই রেখে দিতে মা!”
স্বাভাবিক সুরে বলে পাতা। পারুল বেগমের মুখখানি চুপসে যায়। বিষন্ন গলায় বলে,
-” মেয়েরা তো চিরকাল স্বামীর দ্বারস্থ! আমার কিছু করার ছিলো না রে পাতু। অথচ তোর সব অভিযোগ আমাকে ঘিরে!”

-” থাকবে না বলছো? রাখার মন মানসিকতা থাকলে রেখে দেওয়া যায়। ভালোই হয়েছে রেখে দাও নি। আপন’দের ভিড়ে বেশ ছিলাম।”
হেসে বলে পাতা। পারুল বেগম চোখে মুখে বিষণ্নতা ছড়িয়ে পড়ে। সাথে সকলের সামনে পাতার এরকম কাটকাট জবাবে লজ্জায় মাথা নুইয়ে পড়ে। পারুলের ছোট জা ফোড়ন কেটে বলে,
-” তুই তো বেশ অকৃতজ্ঞ পাতা! ভাবী না আনলে তুই হয়তোবা দুনিয়ার আলোও চোখে দেখতিস না! আর তুই শুধু নিজেরটা ভাবছিস! তখন আমরা কিরকম পরিস্থিতিতে ছিলাম তুই নিজ চোখে দেখেছিস তারপরও কথা বলিস?”
পরিবেশ থমথমে। সকলের মাঝেই চাপা গুঞ্জন। পাতা জবাব দেয় না। কথা বললে কথা বাড়বে। সিনক্রিয়েট করার কোনো মানেই হয় না। প্রতিবেশী এক বৃদ্ধা মহিলা লাঠি ভর দিয়ে এগিয়ে আসে‌। পাতার মাথায় হাত রেখে আঞ্চলিক টোনে বলল,

-” এই বুড়িডার কথা মনোযোগ দিয়া শোন! কাজে লাগবে। কাউকেই কখনো নিজের চেয়ে বেশি ভালোবাসবি না। আগে নিজে; পড়ে জগত সংসার। আর হ্যাঁ যদি কোন মানুষকে ভালোবাসবি তবে সীমার মাঝে। কোনো কিছুই মাত্রাতিরিক্ত ভালো না। যেখানে ভালোবাসা বেশি সেখানে দুঃখ কষ্টও বেশি। কম ভালোবাসলে কম করে দুঃখ পাবি! মানুষ যাকে সবচেয়ে বেশি ভালোবাসে সেই তাঁর দুঃখের মুখ্য কারণ হয়ে দাঁড়ায়। বুঝলি পাগলি?”
পাতা বৃদ্ধার প্রতিটি কথা মনোযোগ দিয়ে শোনে। কথাগুলোতে কিছু ছিলো বোধ করি। বৃদ্ধা আরো বলে,
-” সৎ ছেলে মেয়ে মানুষ করা সবচেয়ে কঠিন কাজ। তুই যতই আদর ভালোবাসা দিস না কেন সবশেষে তুই সৎ মা’ই থেকে যাবি। আপন সন্তানদের দুই তিনটা থাপ্পড় মারবি ওরা দিনশেষে তোর আঁচলের তলে আসবে। কিন্তু সৎ ছেলে মেয়ে আসবে না। তোর প্রতি তাঁদের বিদ্বেষী মনোভাব সৃষ্টি হবে। আশেপাশের আছে না কতগুলো সিসি ক্যামেরা? তাঁরা বলে বেরাবে সৎ দেখে অমানবিক অত্যাচার করছে। শোন নিজ অভিজ্ঞতা থেকে বলছি তোর সৎ ছেলে আছে; ভালোবাসবি, আদর যত্ন করবি! তবে অতিরঞ্জিত নয়। যতটুকু প্রয়োজন ততটুকুই। বেশি ভালোবাসলে পরে পচে যেতে পারিস! দিনশেষে আপন আপনকে খোঁজে পর ঠ্যাং দেখিয়ে চলে যায়। তাই বলছি কম কম ভালোবাসবি দুঃখ কম পাবি!”

কথা গুলো চরম বাস্তবতা হলেও পাতা মানতে নারাজ। সে ভালোবাসতে জানে। এখন ভালোবাসার বিনিময়ে কেউ যদি এক বুক দুঃখ ঢেলে দেয় সে হাসিমুখে মেনে নেবে। কেউ দুঃখ দিবে দিক; সে ভালোবেসেই যাবে। বৃদ্ধা তাঁর কথা শেষ করে চলে যায়।
ভোর উঠোনের গাছের আড়ালে লুকিয়ে ছিলো লুকোচুরি খেলার উদ্দেশ্যে। বৃদ্ধার সব কথা সে শুনতে পায়। সে সব কথার মানে বুঝতে না পারলেও এটুকু বুঝতে পারলো এখানে তাকে সৎ বলা হয়েছে। মহিলাটি আম্মুকে বলেছে তাকে কম কম ভালোবাসতে। ভোরের মুখের আদল গম্ভীর হয়। সে কিছু সময় সেখানেই দাঁড়িয়ে থাকে। তারপর গুটি গুটি পায়ে পাতার সম্মুখীন হয়ে বলে,
-” ভোর পানি খাবে। পানি দাও আম্মু?”
পাতা উঠতে নিবে প্রিয় তাকে থামিয়ে নিজেই গ্লাস ভরে পানি আনে। ভোর হাতে নেয় না। পাতার হাত ধরে টেনে বলে,
-” তুমি দাও!”
পাতা ছোট ছোট চোখে চেয়ে ভোরকে ভর দিয়েই উঠে দাঁড়ালো। কলপাড়ে গিয়ে টিওবয়েল চেপে পানি দেয়। ভোর ঢকঢক করে সবটা পান করে বলে,
-” বাড়ি যাবো কখন আমরা? এখানে আর ভালোলাগছে না।”

অরুণ আসে বেশকিছু সময় পর। সাথে ড্রাইভার। তাঁরা দেড়ি না করে সকলের থেকে বিদায় নিয়ে রওনা হয়। পাতা নিজেকে সামলে নিজ অবতারে ফিরে আসে। তবে খোলসে আবৃত পাতার বিষন্ন চোখ জোড়া অরুণের অভিজ্ঞ নজর ফাকি দিতে অক্ষম। তবে অরুণ বুঝতে পারে না বিষন্নতার কারণ। যে নয়ন যুগল প্রণয়ের জোয়ারে ভাসে সেথা কেন শান্ত সাগর?

পরবর্তী দিনগুলো খুব স্বাভাবিকভাবেই কেটে যায় তাদের। জুবাইদার কথা গুলো ক্ষণিকের জন্য তাঁর হৃদয়ে হুল ফুটালেও তা সয়ে যায় পাতা। সে তো সব জেনেই পা বাড়িয়েছে এ রাজ্যে। এখন এসব ভেবে দুঃখের সাগরে হাবুডুবু খাওয়ার মানেই হয় না। সে আবেগী মনটাকে সামলে নেয় তবে মাঝে মাঝে খারাপ লাগে এই যা। পাতার নয় মাস চলছে! ডেলিভারী ডেইট যত এগিয়ে আসছে পাতার চিন্তার মাত্রা ততই বেড়ে চলেছে। স্বাস্থ্যবান পাতার শরীর ভাঙতে শুরু করেছে। চেহারার লাবণ্যতা হারাতে বসেছে। চোখের নিচে ডার্ক সার্কেল দেখা যায়। ফ্রেশ মুখে ব্রণের দাগ। চিন্তায় পাতার ঘুম হয় না। সে খুবই দূর্বল চিত্তের মানুষ। সাথে ভীতু প্রকৃতির। পৃথিবীতে নতুন প্রাণের সঞ্চার করা যুদ্ধের চেয়ে কম কিসে?সে কিভাবে এই কঠিন পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হবে! চিন্তায় তাঁর ঘুম হয় না। অরুণ সাহস জোগায় পাতা ভরসা পায়। আবার ভয়ও করে।

ভিতরে বেড়ে ওঠা আরেকটা প্রাণ যখন নড়াচড়া করে পাতার সুখানুভূতি হয়। নিজেকে কেমন বড় বড় ফিল হয়। কখনো কখনো ভেতরের প্রাণটা এতো দুষ্টুমি করে পাতার প্রাণ পাখি উড়ে যাবার উপক্রম হয়। ব্যাথায় হাউমাউ করে কাঁদে। অবুঝ পাতা ভাবে নিশ্চয়ই ওর কোন সমস্যা হচ্ছে তাই এতো নড়াচড়া করে! অরুণ যখন বোঝায় এটা স্বাভাবিক পাতা তখন স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়লেও আবার একই কান্ড করে । বর্তমানে অরুণ অফিসে অনিয়মিত। ভোরের এক্সাম চলছে! পাতার প্রেগন্যান্সির লাস্ট স্টেজ। এই দুটোকে সামলাতে অরুণের হিমসিম খাওয়ার মতো অবস্থায়। তাকে উদ্ধার করতে পাতার মা লাবনী আক্তারের আগমন ঘটে। তার আগমন কিছু দিন হলো।

অরুণ একটু হাঁফ ছেড়ে বাঁচে; একা কিভাবে সামাল দিতো সে? ভাগ্যিস শাশুড়ির আগমন ঘটেছে! সে’ই দিনভর ভোর , পাতাকে সামলায়।আর রাতে তার ডিউটি। পাতা তো কখনো কখনো ভয়ে মূর্ছা যায়! সে কিভাবে এতো যন্ত্রণা সহ্য করবে? যদি অঘটন ঘটে? অরুণ রেগে যায়! পাতার চোয়াল চেপে শক্তভাবে কথা বললে অভিমানের পাল্লা ভারী হয়। কথা বলে না! অরুণ নত হয়ে বুঝিয়ে একটু আদর করলেই অভিমান গলে যায়। এভাবেই চলছে তাদের সংসার।
পাতা মায়ের কোলে মাথা রেখে বিছানায় শুয়ে আছে। লাবনী আক্তার সস্নেহে তাঁর মাথায় হাত বুলিয়ে অভয় বানী শোনায়। পাতা অস্থির গলায় বলে,

-” আমি পারবো না মা! আমার ভয় করে মা। ইমনের মা সেদিন বলল না? পাশের বিল্ডিংয়ের এক মহিলার মৃত জমজ সন্তান হয়েছে। মা আমার বেলা…”
-” এক থাপ্পড় দিবো পাতা! এসব কি অলুক্ষণে কথা বলিস! সব ঠিকঠাক হবে দেখেনিস। ডাক্তার বলল তো বাচ্চা, তুই দুজনে সুস্থ আছিস। বাকিটা আল্লাহ ভরসা।এসব অপয়া কথা না বলে আল্লাহকে ডাক পাগলী।”
-” মা আমার বাচ্চাটা সুস্থ সমেত দুনিয়ায় আসুক শুধু।”
-” আসবে পাগলী। ঘুমা তুই!”
-” কত বাজে ? ভোর আসার সময় হলো?”

বলতে বলতেই কলিং বেলের আওয়াজ শোনা যায়। লাবনী আক্তার উঠে যায়। পাতাও আস্তে আস্তে উঠে বেরিয়ে আসে।‌ ড্রয়িংরুমের সোফায় বসতেই ভোর দৌড়ে এসে বলে,
-” আম্মু এতো ভালো এক্সাম দিয়েছি কি বলবো! মনে হচ্ছে এবার আমিই ফাস্ট হবো!”
পাতা সন্দেহ ভাজন চোখে চায়। ভোর বলছে একথা? অবিশ্বাস্য! সে প্রশ্ন পত্র হাতে নেয়।
-” সব অ্যানসার করেছো?”
ভোর হাসিমুখে উত্তর দেয় । সব দিয়েছে! পাতা একে একে জিজ্ঞেস করে। ভোর সঠিকভাবেই উত্তর দেয়। পাতা প্রশ্ন করে,

-” অরুণ শব্দের অর্থ?”
-” এটা তো সবচেয়ে ইজি! অরুণ শব্দের অর্থ বাবা!”
লাবনী আক্তার হেসে ভোরের চুল এলোমেলো করে দেয়। পাতা ভ্রু কুঁচকে বলে,
-” কতবার করে পড়ালাম অরুণ অর্থ সূর্য!”
-” আম্মু আমি সূর্য লিখবো না বলেছিলাম তো। অরুণ সরকার ভোরের বাবা তাই অরুণ শব্দের অর্থ বাবা! অনেক খিদে পেয়েছে আমার। নানু খেতে দাও না?”
-” তুমি ফ্রেশ হয়ে আসো আমি দিচ্ছি!”
ভোর রুমে চলে যায়। পাতা তাঁর যাওয়ার দিকে তাকিয়ে থাকে। বাবা পাগল ছেলে! ভোর একটু পরেই বেরিয়ে আসে। পাতার পাশে বসে তাঁর ওড়নায় হাত মুখ মুছে মিষ্টি করে হাসলো।ফুলো পেটে হাত রেখে বলে,
-” ভোরের বোন ভাবনা কবে আসবে আম্মু?”
পাতা ঠোঁট উল্টে উত্তর দেয় ‘কি জানি’ । লাবনী আক্তার খাবার এনে টি টেবিলে রেখে বলে,
-” তুমি খাবে নাকি আমি খাইয়ে দিবো?”
ভোর পাতার দিকে তাকিয়ে বলে,

-” ও আম্মু কতদিন হলো তোমার হাতে খাই না! আজকে খাইয়ে দাও না?”
পাতার খাবারের প্লেটের দিকে তাকালো।রুই মাছের পেটি ভাজা। পাতার গা গুলিয়ে আসে। চার মাসের পর থেকে কেন যেন পাতার মাছ দেখলেই গা গুলিয়ে আসে। সে ভোরের মাথায় হাত রেখে বলে,
-” এখন নানুর হাতে খেয়ে নাও রাত্রে আমি খাইয়ে দিবো! মাছ তোমার বোনের সহ্যই হয় না!”
-” ইটস্ ওকে।”
ভোরের মনটা খারাপ হয়ে যায়। তবে সে হাসিমুখেই প্লেট টেনে নিজের হাতেই খাওয়া শুরু করলো। কয়েক লোকমা খেতেই আগমন ঘটে ইমনের। তাকে দেখেই ভোর উৎফুল্ল হয়ে বলে,
-” মামু আজ খেলবে না ক্রিকেট? আজ কিন্তু আমি ব্যাট করবো! তুমি শুধু বল কুড়িয়ে আনতে বলো ব্যাট করতে দাও না?”

-” ভাগ্নে আজ তুমি প্রথমে ব্যাট করবে জলদি খাও! একটু পরেই মাঠে যাবো!”
ইমন হেসে বলে। পাতা সাফ সাফ মানা করে,
-” কোথাও যাওয়া হচ্ছে না। ইমন তুমি যাও! ভোরের কাল এক্সাম আছে। অনেক পড়া বাকি! সে খেলতে পারবে না!”
ভোর প্লেট টি টেবিলে রেখে সাথে সাথে প্রতিবাদ জানিয়ে দেয়,
-” আমি খেলবো। রাতে পড়ে নিবো। মামু তুমি দাঁড়াও আমি হাত ধুয়ে আসছি।”
আধ খাওয়া খাবার রেখেই দৌড়ে যেতে নেয় ভোর। পাতা হাত ধরে আটকায়। ইমনকে ইশারায় চলে যেতে বলে। ইমন ভোরের দিকে করুণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করে প্রস্থাণ করে। ভোর চিল্লিয়ে ডাকে সে শোনে না। ভোর পাতাকে অনুরোধ করে,

-” আম্মু সব পড়া কমপ্লিট করবো! একটু খেলি প্লিজ? ও আম্মু?”
-” কাল খেলো! মানা করবো না। আজ না। অনেক পড়া বাকি। তোমার বাবা যদি শোনে পড়া রেখে খেলতে গেছো তাহলে বকা কে খাবে শুনি?”
-” আব্বু জানতেই পারবে না! প্লিজ আম্মু? যাই না?”
-” না। খাবার শেষ করে একটু রেস্ট নাও। তারপর পড়তে হবে। অহেতুক জেদ করবে না।”
ভোরের এবার রাগ হয়।
-” একটু খেললে কি‌ হবে?”
পাতা মুচকি হেসে জবাব দেয়,

-” একটু না খেললে কি হবে? এক্সাম শেষ হলে তো ছুটি আর ছুটি তখন খেলবে। পড়ালেখা বাদ রেখে খেলতে গেলে তোমার বাবা পিটুনি দিবে!”
-” পড়বো না আমি! পড়ে কি হবে? শুধু টাকা, সময় নষ্ট! আমি তো বড় হয়ে ডাক্তার হবো না। আমি ক্রিকেটার হবো। তাই বেশি বেশি খেলতে হবে। পড়ে আমি কি করবো?”
একপ্রকার চিল্লিয়ে বলে ভোর। পাতা হেসে ওঠে শব্দ করে। হাসতে হাসতেই বলে,
-” ওরে আমার ভবিষ্যৎ টাইগার্স! ক্রিকেটার হলে পড়তে হবে না? ক্রিকেটের জন্য তোমায় ফিজিক্স, ম্যাথ জানতে হবে। ইন্টারভিউ, ফরেনে কমিউনিকেশনের জন্য ইংলিশ জানতে হবে! ছেলে বলে পড়বে না।”
ভোর গাল ফুলিয়ে নেয়। রাগে ভাতের থালা উল্টে দিতে ইচ্ছে করছে; খাবার নষ্ট করলে আল্লাহ রাগ করবে তাই কিছু করে না। ধুপ ধাপ পা ফেলে নিজ ঘরে চলে যায়। কথা বলবে না কারো সাথে।
লাবনী আক্তার পাতার দিকে তাকিয়ে বলে,

-” বাচ্চাটা কাল সারাদিন পড়েছে। এখন একটু খেলতে দিতি! মনটা ফ্রেশ হতো?”
-” মা কাল এক্সাম ওর। আর এখন খেলতে গেলে সন্ধ্যা অবধি ওনার দেখা মিলবে না। খেলাধুলা করে টায়ার্ড শরীরে পড়তে পারবে? ঘুমে কাত হয়ে পড়ে থাকবে।”
-” আচ্ছা বুঝলাম। তুই যা ছেলেটা রেগে আছে। খিদে লেগেছিল অথচ খেলোনা!”
পাতা ভাতের থালা নিয়ে ভোরের রুমে যায়। ভোর ক্রিকেট বল নিয়ে খেলছে আপনমনে। মুখাবয়বে বাবার ছায়া। পাতা আস্তে করে হেঁটে বিছানায় বসে। গন্ধে পেটের নাড়িভুঁড়ি উল্টে এলেও সে মাছ ভাত লোকমায় নিয়ে ভোরের মুখের সামনে ধরে বলে,
-” ভোর তো গুড বয়। বড়দের কথা মেনে চলে। তাহলে এখন কেন জেদ করছে?”
ভোর কিছু বলে না।মুখে খাবারও নেয় না। উঠে দূরে ফ্লোরে বসে খেলতে থাকে।
পাতা নিজ পেটে হাত রেখে বলে,

-” ভোর দেখো বাবু কিক করছে?”
অন্যসময় হলে ভোর ছুটে আসে। কিন্তু এবার আসে না; না ফিরে চায়। পাতা বুঝতে পারে সহজে মানবে না। সে বলে,
-” এরকম করলে কিন্তু বাবুকে বেশি বেশি আদর করবো। বাবুকে অনেক গল্প শোনাবো।”
ভোর শুধু মাথা তুলে তাকালো একবার। কিছু বলে না। পাতা উঠে এসে ভোরের পাশে দাঁড়ায়। বসতে পারে না! সে আদুরে গলায় ডাকে,

-” আব্বু রাগ করে না তো! সবসময় খেলো মানা করি না‌। কাল এক্সাম তাই মানা করেছি। তুমি শুনবে না? জলদি পড়া শেষ করে আমি তুমি তোমার নানু লুডু খেলবো। মজা হবে না?”
ভোর মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানালো। মুখে কিছু বলে না। পাতা এতেই খুশি হয়।
-” আব্বু খেয়ে নাও? আসো আমি খাইয়ে দিচ্ছি?”
ভোর খেয়ে নেয়। আর জেদ করে না। খাওয়া শেষ করে চুপচাপ পড়তেও বসে। রোজকার মতো পড়ার সময় দুষ্টুমি করে না। শান্ত বাচ্চার ন্যায় মনোযোগ দিয়ে পড়তে থাকে। তাই জলদি পড়া শেষ করতে পারে। পাতা খুশি হয়ে তাকে আদর করে। ভোর আবদার করে ,
-” এখন তো পড়া শেষ! তোমার ফোনটা একটু দিবে? গেম খেলবো!”

পাতা সশব্দে তার ফুলো গালে চুমু দিয়ে ফোন দেয়। ভোর মিষ্টি হাসি উপহার দিয়ে ফোনটা নিয়ে নিজ ঘরে চলে গেল। আস্তে করে দরজা আটকে তাঁর মিনি আলমারি খুলে একটা খাম বের করে। ফ্লোরে বসে খামের ভেতর থেকে অনেক গুলো ছবি বের করে। তাঁর ছোট বেলার ছবি। ছবিতে মায়ের কোলে সে। পাশে বাবা দাঁড়িয়ে আছে।অনেক আগে ছবিগুলো সে লুকোচুরি খেলার সময় স্টোর রুমে পেয়েছিল। সে লুকিয়ে নিজের কাছে রেখে দিয়েছে। ভোর একটা ছবির পেছনে থাকা বিদেশি নম্বর ফোনের ডায়াল প্যাডে তোলে।

পাতা বাহার পর্ব ৫৩

সরকার বাড়ি থাকতে আদু ফুপ্পির সহায়তায় মা’ র সাথে কথা বলেছিলো। তখন মা এই নম্বরটা ভোরকে দিয়েছিলো। ভোরের যখন তাঁর কথা মনে পড়ে সে লুকিয়ে লুকিয়ে আম্মুর ফোন দিয়ে কথা বলে। মা তাঁর সাথে না থাকলেও সে তো ভোরের মা। মা ভালো না বাসলেও সে তো মা’কে ভালোবাসে! ভোর কল লাগায়! রিসিভ হলেও ভোর মোহাচ্ছন্ন গলায় ডাকে,
-“মা?

পাতা বাহার পর্ব ৫৪