শুভ্ররাঙা ভালোবাসা পর্ব ৪১

শুভ্ররাঙা ভালোবাসা পর্ব ৪১
সুমাইয়া সুলতানা

মোম’কে নিয়ে আগুন তার নিজস্ব ফ্ল্যাটে ফিরে গিয়েছে। আজকে আগুনের কলেজে ছোটখাটো একটা অনুষ্ঠান রয়েছে। দুপুরে খাওয়া দাওয়া হবে। বিকালে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে। টিচার্স সহ সকল স্টুডেন্টস এবং তাদের কিছু সংখ্যক গার্ডিয়ান থাকবে এই অনুষ্ঠানে। বলা চলে কলেজে টিচার্স ও স্টুডেন্টদের নিয়ে ছোট্ট করে পিকনিকের আয়োজন চলছে। আগুন ভেবেছিল অনুষ্ঠানে থাকবে না, তবে প্রিন্সিপাল স্যার অনুরোধ করায় আর না করতে পারেনি। এমনকি আগুন যখন প্রিন্সিপাল’কে বলেছিল সে কলেজে যাবে না, তখন মোম আগুনের গলা জড়িয়ে আহ্লাদী আবদার করে বলেছে ও যেতে চায়। আগুন তার কোমলমতির কথা ফেলতে পারেনি, সেজন্য রাজি হয়ে গিয়েছিল। অগত্যা ইচ্ছে না থাকা সত্বেও অনুষ্ঠানে উপস্থিত হতে হয়েছে। সাথে করে নিয়ে এসেছে মোম’কে। কলেজে আসার কথা শুনে মোম খুব খুশি হয়েছিল। ঘোরাঘুরি করতে মোমের বেশ ভালোই লাগে।

দুপুরের তেজি গরম সূর্য মাথার উপর তীর্যক ভাবে জেঁকে বসেছে। রোদ্দুরে চোরাবালি চিকচিক করছে। কলেজ ক্যাম্পাসের ছোট ছোট ঘাসফুল গুলো নেতিয়ে পড়েছে। পুকুরের টলমল পানি সূর্যের কিরণে ঝলমলিয়ে উঠছে। কলেজের মাঠের এক সাইডে মধ্য বিস্তর জায়গা নিয়ে তেরপল টাঙানো হয়েছে। দেখতে অনেকটা তাবুর মতো লাগছে। রোদের প্রখরতা থেকে বাঁচতে এবং স্টুডেন্ট, গার্ডিয়ানদের বসার জন্য এটি টাঙানো হয়েছে। লাইন ধরে সরলরৈখিক ভাবে চেয়ার পাতা রয়েছে ভেতরে। প্রিন্সিপাল স্যারের কক্ষের সম্মুখে বামদিকে অনেকটা জায়গা নিয়ে উঁচু করে পাকাপোক্ত ইট, সিমেন্টের তৈরী ফাঁকা জায়গা রয়েছে। সেখানে মঞ্চ বানানো হয়েছে। এখানে সম্মানিত ব্যক্তিবর্গ ও টিচার্স রা বসবেন। মঞ্চটা জাঁকজমকপূর্ণ করে সাজানো গোছানো হয়েছে।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

লাইব্রেরিতে আরও অনেক টিচার্সদের মাঝে বসে আছে আগুন, মোম। বরাবরের মতোন বাকিদের নজর এই দম্পতির উপর। সোনারগাঁও ঘুরতে গিয়ে এখানকার অনেকের সাথে টুকটাক কথা বলার দরুন মোম তাদের সঙ্গে অনেকটা সহজ হয়ে গিয়েছে। তাই আজকে তাদের সাথে কথা বলতে তেমন অস্বস্তি অনুভব হচ্ছে না। মন খুলে উচ্ছ্বাস সমেত হাসিমুখে কথাবার্তা বলছে। যদিও তেমন বেশি কিছু বলছে না, তবে অল্পবিস্তর কথা বলে চলছে তাদের সঙ্গে।
আগুনের এক কলিগ রসিকতা গলায় জিজ্ঞেস করলো,
” তা আগুন সাহেব, বিবাহিত দিনকাল কেমন কাটছে আপনার? ”
আগুন মোমের দিকে একপলক তাকাল। অতঃপর মুচকি হেসে বলল,

” অসম্ভব ভালো। ”
” সেটা তো আপনাকে দেখেই বোঝা যাচ্ছে। ”
বিনিময়ে আগুন পুনরায় মৃদু হাসি উপহার দিল। কলিগ আবার বলে উঠলো,
” আপনার ভরা কপাল স্যার! এত সুন্দরী ছোট্ট রমণীকে জীবন সঙ্গী হিসেবে পেয়েছেন। ভাবী কত চমৎকার ভাবে নিজেকে আপনার সঙ্গে মানিয়ে নিয়েছে। সাধারণত অল্প বয়সি মেয়েরা সবকিছু বুঝতে পারলেও এতটা ম্যাচিউর হয় না। কিন্তু আপনার ওয়াইফ কত সহনশীল, ম্যাচিউর মানুষ। আপনাদের দুজনের জুটি খুব ভালো মানিয়েছে। ”
কলিগের কথায় মোম কিঞ্চিৎ লজ্জা পেলো। আড়চোখে আগুন’কে একবার দেখে নিলো। তার ভাবভঙ্গি স্বাভাবিক। মোম নজর ফিরিয়ে নেয়। মাথা নিচু করে চুপ করে থাকল। আগুন উত্তরে জানায়,

” ধন্যবাদ। যেখানে উপরওয়ালা নিজে আমাদের এক সঙ্গে থাকা নির্ধারণ করে দিয়েছেন, তখন দুজনকে মানাবে-না তা কি করে হয়? ”
কলিগ শব্দ করে হেসে উঠল। উচ্ছ্বসিত কন্ঠে শুধাল,
” বিয়ে করে আপনার বেশ পরিবর্তন হয়েছে স্যার। আগে তো এত কথা বলতেন না কারো সাথে। কেউ কিছু জিজ্ঞেস করলে ছোট করে হ্যাঁ, হুম এরকম উত্তর দিতেন। আর এখন কথার বাণ ছুটে গিয়েছে। ভাবী বুঝি আপনাকে দিয়ে বেশি কথা বলায়? ”
” তা তো বলায়। নিজে সারাক্ষণ বকবক করে, সাথে এমন এমন কাজ করে, যার দরুন আমাকেও মুখ চালাতে হয়। ”
এ’কথার প্রেক্ষিতে মোমের ভীষণ রাগ হলো। সকলের সামনে ছোটখাটো একটা অপমান করে দিল? মোমের মনটা খারাপ হয়ে গিয়েছে। ভোঁতা মুখে চুপ করে বসে রইল। এই কুমড়ো মার্কা লোকটার সঙ্গে আর কোনো কথাই বলবে না মোম!
আগুন মুখ কালো করে থাকা মোমের দিকে তাকিয়ে, পুনরায় মিহি কন্ঠে চওড়া হাসি ঠোঁটে টেনে উৎফুল্লতা সমেত বলে ওঠে,

” তবে আমি আমার তোতাপাখির বকবক নিয়ে দিব্যি সুখে আছি। বরং সে যদি চুপসানো মুখে থাকে, তখন আমার একটুও ভালো লাগে না। তাকে চঞ্চল প্রানবন্ত স্বভাবেই মানায়। মৌনতা তাকে একদম মানায় না। সে গোমড়া মুখে থাকলে আমার বুকের বাম প্রকোষ্ঠে সুক্ষ্ম একটা ব্যথা নামক সরল সুচ ফুটে, যেটা আমি সহ্য করতে পারি না। ”
শেষের কথাটা গম্ভীর কণ্ঠে আওড়াল আগুন। মোম আহত চোখে আগুনের দিকে দৃষ্টি তাক করল। আগুনের কথাগুলো পজিটিভ ভাবে মেনে নিলেই হতো। গোমড়া মুখে থাকায় মানুষটা হয়তো গিল্টি ফিল করছে! মোম বুঝতে পেরে মনে মনে নিজেকে নিজেই বকা দিল।

আগুন ওয়াশরুমের দরজার বাইরে অবস্থান করছে। মোম ভেতরে আছে। যদিও এদিকটায় এখন কেউ আসবে না, কিন্তু আগুন পূর্বে থেকে সচেতন থাকতে চায়। সেজন্য দরজার পাশে দেয়ালে হেলান দিয়ে চিন্তিত ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে রয়েছে। মোম বেরিয়ে আসা মাত্র আগুন উদ্বিগ্ন সমেত জানতে চাইল,
” এখন ঠিক আছো? হঠাৎ এমন হলো কেন? ”
মোম ক্লান্ত মুখে উত্তর দিল,
” জ্বি, ঠিক আছি। আমিও বুঝতে পারছি না কেন এমন হলো! হয়তো গরমের জন্য। তাছাড়া তৈলাক্ত খাবার খাওয়ায় এমনটা হতে পারে। কারণ আমি তৈলাক্ত খাবার একদম খেতে পারি না। গ্যাস্টিকের ট্যাবলেট খেলে ঠিক হয়ে যাবে। ”

দুপুরে খাবার খাওয়ার পর মোম যখন সবার সাথে বসে ছিল, তখন আচমকা পেট গুলিয়ে বমি চলে আসে। মোম তৎক্ষনাৎ মুখ চেপে দৌড়ে বাইরে এসে খোলা মাঠের এক জায়গায় গলগল করে বমি করে দেয়। মোম’কে হন্তদন্ত হয়ে বাইরে যেতে দেখে আগুন তুরন্ত বউয়ের পিছু ছুটল। আকস্মিক বমি করতে দেখে আগুন ঘাবড়ে যায়। তড়িঘড়ি করে মোমের নিকট পৌঁছে ভরা মাঠের মধ্যে পাঁজাকোলে তুলে নিয়ে মেয়ে টিচার্সদের রেস্ট রুমে নিয়ে যায়। মাথাটা বুকে চেপে টিস্যু দিয়ে মুখটা মুছে দেয়। বোতল থেকে অল্প একটু পানি খাইয়ে দেয়। ফ্যানের বাতাসেও মোম ঘেমে একাকার। মুখশ্রীতে ক্লান্তি লেপ্টে রয়েছে। বউয়ের এ অবস্থা দেখে আগুনের বেগতিক অস্বাভাবিক ভাবান্তর! চিন্তায় বক্ষকোষ্ঠক ধড়ফড় করতে লাগলো। ডাক্তার ডাকতে চাইলে মোম বাঁধা প্রদান করে। কিয়ৎকাল পর মোম নিজেকে একটু স্বাভাবিক সুস্থ মনে করলে, আগুন’কে জানায় সে ওয়াশরুম যাবে। তখন আগুন ওকে ধরে ওয়াশরুমে নিয়ে আসে।

মোমের কাঁধ জড়িয়ে ধরে শান্ত কন্ঠে শুধাল,
” হেঁটে যেতে পারবে নাকি কোলে নিতে হবে? ”
মোম পিটপিট করে তাকায়। মিহি স্বরে ঠোঁট উল্টে জবাব দেয়,
” পারবো। আর আপনি সবার সামনে তখন কোলে কেন নিয়েছিলেন? সবাই কেমন ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে ছিল! আমার বুঝি লজ্জা করেনি? ”
আগুন গম্ভীর কণ্ঠে জানায়,
” তোমার লজ্জা তোমার কাছে রাখো। আমার বউ অসুস্থ হয়ে পড়েছে আর তুমি আমাকে লোকলজ্জার ভয়ে হাত গুটিয়ে বসে থাকতে বলছো? যদি সিরিয়াস কিছু হয়ে যেতো? লোকজন পারতো আমাকে আমার বউ সুস্থসবল ফিরিয়ে দিতে? পারতো না! তাহলে আমি কেন তারা কি ভাবছে সেটা নিয়ে মাথা ঘামাবো? ”
মোম হা করে পলকহীনভাবে চেয়ে আছে। সে কি বোঝাতে চাইল, আর আগুন তার উল্টোটা বুঝে বসে আছে! স্বাভাবিক ভাবে যা বোঝাতে চেয়েছে, আগুন সেটা তিল’কে তাল বানিয়ে ফেলেছে! বমি করায় মাথা ঘোরাচ্ছে, তাই মোম পাল্টা কিছু বলল না। নয়তো কয়েকটা কড়া কথা শুনিয়ে দিতো। এই লোক সবসময় বাড়াবাড়ি করবে আর মোম’কে লজ্জায় ফেলবে! এখন কিছু বললে, সেটার প্রেক্ষিতে শত অযুক্তি কথাবার্তা খাঁড়া করে ছাড়বে। তার থেকে মৌনতা বজায় রাখা শ্রেয়তর।

সূর্যের রক্তিম আভা ডুবে গিয়ে গোধূলি বেলা যখন দিন শেষ হতে শুরু করে এবং সন্ধ্যার আলো আস্তে আস্তে ছড়িয়ে পড়ে, তখন প্রকৃতি যেন নতুন এক জাদুতে রূপান্তরিত হয়। এই সময়টাতে চারপাশে এক অপূর্ব নীরবতা বিরাজ করে, যা মনকে শান্তি এবং প্রশান্তিতে ভরিয়ে তোলে। যদিও ঋতুভেদে আবহাওয়া সমান থাকে না। ভিন্নতা দেখা যায়।

মোমের শরীর খারাপ হওয়ার দরুন আগুন বেশিক্ষণ কলেজে থাকেনি। বিকেলের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান দেখার মনমানসিকতা হয়ে ওঠেনি। মোম থাকতে চেয়েছিল কিন্তু আগুন চোখ রাঙাতেই আর কিছু মুখ ফুটে বলতে পারেনি। অগত্যা আগুনের কথায় সম্মতি প্রকাশ করে কলেজ থেকে বেরিয়ে এসেছে। কলেজ থেকে বেরিয়ে আগুন কাছাকাছি হসপিটালে গিয়ে একজন মহিলা ডক্টরের কাছে মোম’কে নিয়ে গিয়েছিল। মোম ডক্টর দেখাতে নিষেধ করেছিল, তবে আগুন তার কথা শোনেনি। মোম’কে ভালো ভাবে চেক করে, বর্তমান কন্ডিশন দেখে ডক্টর বলেছেন প্রেশার লৌ, সেজন্য এমনটা হয়েছে। কিছুদিন রেস্ট নিলে আর স্বাস্থ্যকর খাবার খেলে ঠিক হয়ে যাবে।
গাড়ির ভেতর সিটে মাথা এলিয়ে মোম গাল ফুলিয়ে চুপ করে বসে আছে। আগুন হাত বাড়িয়ে মোমের কপাল চেক করল। তাপমাত্রা ঠিকঠাক। আগুন মনে মনে কিছুটা স্বস্তি পেলো। মোমের হাতের উল্টো পিঠে চুমু দিয়ে অত্যান্ত শীতল গলায় ডাকল,

” মোম? ”
মোম নিশ্চুপ। কোনো হেলদোল নেই। আগুন ঝুঁকে আসে খানিকটা। শক্তপোক্ত এক হাত মোমের কোমল গালে ঠেকিয়ে শীতল গলায় প্রশ্ন করলো,
” বেশি খারাপ লাগছে? ”
মোম ক্ষীণ স্বরে আওড়াল,
” চিন্তা করবেন না। বমি করায় মাথাটা একটু ঘুরছে। এছাড়া কোনো খারাপ লাগছে না। ”
আগুন শান্ত হতে পারলো না। চিন্তা থেকেই যাচ্ছে তার। মোমের কপালে চুমু খেয়ে গাড়ি স্টার্ট দিল। ফ্ল্যাটে ফেরার রাস্তায় নাঈমার হসপিটাল পড়ে। মূলত হসপিটাল পেরিয়ে আগুন’কে কলেজে যেতে হয়। হসপিটালের কাছাকাছি আসতেই সেই বৃদ্ধর দেখা মিলল, যাকে আগুন বৃদ্ধাশ্রমে থাকার ব্যবস্থা করে দিয়েছিল। আগুন গাড়ি পার্ক করে বৃদ্ধর কাছে আসলো। বৃদ্ধ হসপিটালের গেইটের পাশে হাঁটু ভেঙে ধুলাবালির মধ্যে বসে আছে। মোম ভ্রু কুঁচকে তাকায়। পরমুহূর্তে সেও গাড়ি থেকে নেমে আগুনের পাশে এসে দাঁড়ায়। আগুন কোমর বাঁকিয়ে ঝুঁকে বৃদ্ধ’কে শুধায়,

” দাদু আপনি এখানে কি করছেন? ”
বৃদ্ধ চশমার ফাঁকে ঘোলাটে নয়নমণি দ্বারা আগুনের দিকে তাকিয়ে হেসে ফেলল। হাত নাড়িয়ে তাকে কাছে ডাকলেন। আগুন আরেকটু বৃদ্ধর কাছে গেল। বৃদ্ধ মৃদুস্বরে জানালেন,
” ছেলের বউ একটা দূর্ঘটনায় পঙ্গু হয়ে গিয়েছে। এই হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে। বউয়ের মামা বড়োলোক, তাই ভাগ্নীকে ভালো হাসপাতালে ভর্তি করিয়ে চিকিৎসা করাচ্ছে। আমি এসেছি নাতি-নাতনীদের একপলক দেখতে। সাথে বউ’মাকে একবার দেখে যাবো। বউ’মা আমার মুখ দর্শন করতে চায় না। আমাকে হাসপাতালের ভেতর ঢুকতে দিচ্ছে না, সেজন্য দুপুর হতে গেইটের বাইরে বসে আছি। ”
আগুন হতভম্ব হয়ে জানতে চাইল,

” তাই বলে এতক্ষণ ধরে বসে থাকবেন? কষ্ট হচ্ছে না? যাদের কাছে আপনার কোনো মূল্য নেই কেন তাদের বিপদে বারবার ফিরে আসেন? ”
বৃদ্ধর অক্ষিকোটরে জমে থাকা নোনাজল গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়ল। আগুন আলতো করে তা মুছে দিল। মাথা নাড়িয়ে কাঁদতে নিষেধ করল।
” তাদের কাছে আমার মূল্য না থাকলেও আমার কাছে তাদের মূল্য অনেক। তারা যতই অস্বীকার করুক আমি তো তাদের অস্বীকার করতে পারি না, দাদু ভাই। আমি তো ওদের বাবা, বলো? ”
আগুন ফোঁস করে তপ্ত শ্বাস টেনে গমগমে গলায় বলল,
” এখানে আর কতক্ষণ বসে থাকবেন? চলুন, আপনাকে পৌঁছে দিয়ে আসি। ”
বৃদ্ধ যেতে রাজি হলো না। তার এক কথা তিনি তাদেরকে একবার দেখে তবেই ফিরে যাবেন। আগুন আর জোর করল না। মোম’কে দেখে বৃদ্ধ ঠোঁট প্রসারিত করে হেসে বললেন,
” ওটা কে রে, দাদু ভাই? নাতবৌ নাকি? ”

আগুন ফিচেল হেসে উত্তর দেয়,
” জ্বি, দাদু। ”
বৃদ্ধ ডাকতেই মোম তার নিকট গেল। মোমের মাথায় হাত বুলিয়ে হাস্যোজ্জ্বল মুখে বৃদ্ধ বলে উঠলেন,
” ভারী মিষ্টি মেয়ে। দোয়া করি আমার দাদু ভাইয়ের শতকোটি সন্তানের জননী হও। ”
মোম বিষম খেল। অধরের হাসি উবে গেল। চক্ষুদ্বয় বড়ো বড়ো করে হতভম্বের ন্যায় ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে থাকল। আগুন ঠোঁট কামড়ে মিটিমিটি হাসল। মোম প্রতিত্তোরে কিছু বলল না। শুষ্ক ঢোক গিলল। ভদ্রতাসূচক মেকি হাসি উপহার দিয়ে গাড়ির কাছে চলে যায়। আগুন বৃদ্ধর সঙ্গে আরও কিছুক্ষণ কথা বলে চলে আসে।
গাড়িতে উঠতে যাবে তক্ষুণি পেছন হতে কেউ ডেকে ওঠে। আগুন ভ্রু কুঁচকে তাকায়। নাঈমা’কে দেখে পুরুষালী দৃঢ় চোয়াল আরো শক্ত হয়ে উঠে। রাগে শরীর গিজগিজ করছে। হাত দুটো মুষ্টি বদ্ধ করে ফেলল। নাঈমার অযাচিত আগমনে মোম ভয় পেয়ে যায়। আগুনের পেছনে দাঁড়িয়ে বাহু আঁকড়ে পৃষ্ঠের শার্ট খামচে ধরে। আগুন দাম্ভিক সহিত বুকে হাত গুঁজে শিনা টানটান করে দাঁড়ায়। নাঈমা ওদের কাছাকাছি এসে দাঁড়াল। মোম’কে একবার দেখে বলে উঠলো,

” অল্পকিছু সময় হবে? আমি দুটো কথা বলে চলে যাবো। ”
আগুন দাঁতে দাঁত পিষে গম্ভীর কণ্ঠে জানালো,
” সেদিন তোর শিক্ষা হয়নি, তাই না? আবার এসেছিস তোর ইস্টুপিড মার্কা ড্রামা করতে? কোনো মেয়ে যে এতটা নির্লজ্জ ছ্যাঁচড়া হতে পারে সেটা তোকে না দেখলে বুঝতে পারতাম না। ”
নাঈমা মলিন হাসল। ব্যথাতুর দৃষ্টিতে চেয়ে বলে,
” কথাটা বলেই চলে যাবো। ”
আগুন ভাবলেশহীন ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে রইল। নাঈমা এগিয়ে গেল মোমের নিকট। মোম নিজেকে আগুনের সঙ্গে আরেকটু গুটিয়ে নিলো। নাঈমা অপরাধীর ন্যায় মাথা নিচু করে হাত জোর করে বলে ওঠে,
” আমাকে তুমি ক্ষমা করে দিও মোম। জানি, আমি ক্ষমা পাওয়ার যোগ্য না, তবুও পারলে ক্ষমা করে দিও। একতরফা ভালোবাসায় অন্ধ হয়ে তোমার সাথে যেটা করেছি তার জন্য আমি অনুতপ্ত। ”
আগুন ভ্রু উঁচিয়ে জিজ্ঞেস করে,

” মন থেকে ক্ষমা চাইছিস নাকি আবার কোনো কূটনৈতিক কাজ করার কথা ভাবছিস? ”
নাঈমা তাচ্ছিল্য হাসল। চোখ দুটো ছলছল করে উঠল। এটাই তার পাওনা। সে কাজই এমন করেছে, যার জন্য তাকে বিশ্বাস করার প্রশ্নই আসে না।
” মন থেকেই চেয়েছি। মোম শুধু একবার বলো তুমি আমাকে ক্ষমা করে দিয়েছো! তুমি ক্ষমা না করলে আমি যে মরেও শান্তি পাবো না। ”
মোম কারো কষ্ট দেখতে পারে না। নরম মনের মানুষ ও। সাইড থেকে অল্প মাথা বের করে ছোট করে উত্তর দিল,
” আপনি অনুতপ্ত, নিজের ভুল বুঝতে পেরেছেন এটাই অনেক। ”
বলে চুপ হয়ে গেল। আর কথা বাড়াল না। আগুনের পিঠে মুখ গুঁজে দাঁড়িয়ে রইল। আগুন ভারিক্কি নিঃশ্বাস ছেড়ে চওড়া গলায় বলল,
” মোম তোকে ক্ষমা করে দিলেও আমি তোকে এ’জীবনে কক্ষনো ক্ষমা করবো না। ”
নাঈমা ব্যাকুলতা সমেত আহত চোখে চায়। নেত্রদ্বয় জলে টইটম্বুর হয়ে গিয়েছে। অনিমেষ চেয়ে থাকল ছুটন্ত গাড়ির দিকে। আগুনের চার চাকা ওয়ালা গাড়িটা সাই-সাই করে ছুটে চোখের আড়াল হয়ে গেল।

রাফি কলেজ থেকে কিছু একটা কাজে নাঈমার হসপিটালে এসেছিল। গেইটের বাইরে পথিমধ্যে আগুন আর নাঈমা’কে কথা বলতে দেখে সহসা দাঁড়িয়ে গেল। ওদের সকল কথাবার্তা শুনেছে রাফি। নাঈমা তখনও একই জায়গায় ঠায় দাঁড়িয়ে রয়েছে। রাফি এগিয়ে যায়। নাঈমার নিষ্পলক চাহনি পর্যবেক্ষণ করে কিছুটা চিৎকার করে বলে উঠলো,
” ডাক্তার ম্যাডাম, কি খবর? ”
নাঈমার ধ্যান কাটল। নিজেকে সামলে চোরাচোখে রাফির দিকে দৃষ্টি তাক করল। রাফি হাসি মুখে তার পানে চেয়ে আছে। নাঈমা মলিন চোখে চেয়ে শান্ত কন্ঠে জবাব দিল,
” আছি মোটামুটি। ”
” এখানে দাঁড়িয়ে আছেন যে? ”
” এমনি। ”
দুজনের মধ্যে কিছুক্ষণ পিনপিনে নিরবতা বিরাজমান চলল। ভারিক্কি গলায় নাঈমা বলল,

” থ্যাংকস মিস্টার রাফি। ”
” কারণ? ”
” সেদিন আমাকে প্রোটেক্ট করার জন্য। ”
রাফি ফিচেল হেসে বলে,
” মানুষ হিসেবে নিজের কর্তব্য পালন করেছিলাম মাত্র। ”
আবারও দুজন মৌনতা পালন করল। হঠাৎ রাফি মোহনীয়তা ঢেলে আবেগিয় গলায় বলে উঠলো,
” অতীতের কথা ভেবে বর্তমান’কে নষ্ট করার কোনো মানে হয় না। যা হয়ে গিয়েছে ভুলে নতুন করে নতুন ভাবে জীবন শুরু করলে মন্দ হয় না। নিজের ভুলের জন্য অনুতপ্ত হয়ে স্বাভাবিক জীবনযাপন করা তো যেতেই পারে। আর সেই জীবনের….. ”
” তারপর? ”
রাফি জিভ দ্বারা ঠোঁট ভিজিয়ে চোখ খিঁচে বন্ধ করে মৃদুস্বরে বলে,
” সেই জীবনের সঙ্গি হিসেবে আমাকে রাখলে কি খুব অন্যায় হবে? ”
নাঈমা শব্দ করে হেসে উঠল। মনে হচ্ছে রাফি কোনো জোকস বলেছে! হাসতে হাসতে তার চোখ হতো দু ফোঁটা অশ্রু বিসর্জন হলো।
” হাসার মতো কি কিছু হয়েছে? ”

নাঈমা হাসা বন্ধ করল না। বরং চওড়া হলো। সময় নিয়ে নিজেকে ধাতস্থ করে হতাশ কন্ঠে জানালো,
” সেটা সম্ভব নয়। আপনি ভীষণ ভালো মনের একজন ভালো মানুষ। আপনি আমার মতো কাউকে নয়, বরং একজন ভালো মেয়ে ডিজার্ভ করেন। ডাক্তারি কাজে কিছুদিনের মধ্যেই আমি ইন্ডিয়া চলে যাচ্ছি। হসপিটাল থেকে পাঠাচ্ছে। আর আমি অন্য দেশে চলে যাবার চেষ্টায় আছি। পাসপোর্ট রেডি, এখন ভিসা আসলেই চলে যাবো। সেখানে সারাজীবন থাকতে পারবো নাকি জানিন না, তবে একবার গেলে বাংলাদেশে ফেরার আর কোনো ইচ্ছা নেই। যদি কোনো কারণে বাংলাদেশে ফিরে আসিও সেটা খানিক সময়ের জন্য। চেনাপরিচয় মুখবিবর মানুষদের সঙ্গে দেখা হবে নাকি, তাও জানি না। তবে আমি খুব করে চাইবো যেন দেখা না হয়। ”
রাফি অসহায় মুখভঙ্গিতে চেয়ে কাতর গলায় আকুতিভরা মনে বলে,

” আপনি যেমন, সব জেনেশুনে আমি আপনাকে তেমন ভাবেই মেনে নিবো ডাক্তার ম্যাডাম। জীবনকে একটা সুযোগ কি দেওয়া যায় না? ”
নাঈমার অকপটে জবাব,
” না। ”

রাফি বলার মতো কথা খুঁজে পেলো না। ভারাক্রান্ত গলায় টলমলে চোখে মুচকি হেসে নাঈমা পুনরায় বলল,
” আমি আপনার যোগ্য না, মিস্টার রাফি। আমার সঙ্গে নিজের জীবন জড়িয়ে দিন শেষে আপনাকে খালি হাতে ফিরতে হবে। কেননা আমি এখনো আগুন’কে ভালোবাসি। ও আমাকে ভালো না বাসলেও মৃত্যুর আগ পর্যন্ত আমি তাকেই ভালোবেসে যাবো। যদি সুযোগ পাই, তাহলে মরণের পরও আমি ওকে ভালোবাসবো, ওকেই চাইবো। আপনি বলেছিলেন না, জীবন কারোর জন্য থেমে থাকে না? তাহলে সেটা আপনার জীবনে কেন প্রয়োগ করছেন না? প্রয়োগ করুন, মিস্টার রাফি। আগুনের সাথে আমি যতটা সময় চলাফেরা করেছি, আড্ডা দিয়েছি, ঘোরাঘুরি করেছি, কথা বলেছি তার দশ ভাগের এক ভাগও আমার আপনার সঙ্গে কাটানো হয়নি, কথা হয়নি! এক সাথে এতটা সময় পার করেছি তাই আগুনের প্রতি আমার টান ছিল অনেক।

সেই টান এখনো আছে আর আজীবন থাকবে। কিন্তু আমার প্রতি আপনার যেটা আছে সেটা খানিকক্ষণের মোহ্! হয়তো আপনার ভালোবাসা সত্যি, তবে যেহেতু আমার আপনার যোগাযোগ সাময়িক সময়ের জন্য ছিল, তাই আপনি নিজেকে খুব সহজেই সামলে নিতে পারবেন। নতুন কাউকে জীবনে ঠাই দিয়ে নতুন ভাবে জীবন শুরু করতে পারবেন। আমাকে ভুলে যাওয়া সহজ হবে। তাছাড়া, আমার মতোন আপনার ভালোবাসাটাও এক তরফা ছিল। আমার আসায় বসে থাকবেন না প্লিজ। ভালো মেয়ে দেখে বিয়ে করে জীবন গুছিয়ে নিয়েন। আমার পক্ষে আগুন’কে ভুলে যাওয়া সম্ভব না। আগুনের জায়গায় আমি অন্য কাউকে কল্পনাতেও ভাবতে পারি না। সেখানে কারো সাথে জীবনের সুতা কিভাবে বাঁধবো? মন না চাইলে, মনের মিল না থাকলে ঘর বাঁধা যায় না। আমার কথায় কষ্ট পেলে সরি। আমাদের আবার দেখা হতেও পারে আবার না-ও হতে পারে। ভালো থাকবেন, আসছি। ”

কথার ইতি টেনে পেছন ফিরে নাঈমা পা বাড়াল তার নিজ গন্তব্যে। সে এখন নিজের মতো করে আগুনের না পাওয়া ভালোবাসার স্মৃতি আঁকড়ে ধরে বাঁচার চেষ্টা করবে। অমায়িক ধোঁয়াশায় জড়ানো নিকষকালো এই ধরুণিতে তার অস্তিত্ব খুঁজে বেড়াবে। হাতের করুন ভাগ্যরেখা তার শূন্যের কোঠায়, তবুও সে থামবে না। ভিনদেশে পাড়ি জমিয়ে, শান্তিপূর্ণ নিঃশ্বাস ত্যাগ করার জন্য এই সংগ্রাম চালিয়ে যাবে। কিন্তু আজও কি স্বস্তির প্রশান্তি-দায়ক নিঃশ্বাস ছাড়ার সুযোগ হবে তার?

শুভ্ররাঙা ভালোবাসা পর্ব ৪০

রাফি ভাঙা হৃদয়ে, নিশ্চুপ হয়ে নিষ্পলক চেয়ে রইল নাঈমার প্রস্থানের দিকে। বক্ষস্থলে চিনচিন সুক্ষ্ম ব্যথা অনুভব করল। প্রকট দৃষ্টিতে উন্মুক্ত নীলিমাতে চোখ বুলিয়ে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল।

শুভ্ররাঙা ভালোবাসা পর্ব ৪২