পাতা বাহার পর্ব ৫৪

পাতা বাহার পর্ব ৫৪
বেলা শেখ 

রাত নয়টার দিকে অরুণ বাড়ি ফিরে। কলিং বেল বাজালে লাবনী আক্তার দরজা খুলে দেয়। অরুণকে দেখে মুচকি হাসলো। অরুণ প্রতিত্তের হালকা হাসে। বুঝতে পারে পাতাবাহারের মিষ্টি হাসির উৎস।
-” সব ঠিকঠাক আম্মা?”
-” একটু বেশিই ঠিকঠাক!”
হেসে জবাব দিল লাবনী আক্তার। অরুণ ভেতরে প্রবেশ করে দরজা লাগিয়ে বলে,
-” কি হয়েছে আবার?”
-” বিকেলে খেলতে যেতে চেয়েছিল ভোর। পাতা যেতে দেয়নি। সেই থেকে শান্ত। সব পড়া শেষ করেছে দুষ্টুমি ছাড়াই।”

-” হঠাৎ নবাবের সু-বুদ্ধি? খেয়েছে কিছু?”
-” হ্যাঁ সন্ধ্যায় পাস্তা খেয়েছে। এখন ভুনা খিচুড়ি রেঁধেছি!”
-” দ্যাটস গ্রেট! টেবিলে খাবার লাগান আমি ঝটপট আসছি আম্মা!”
বলেই অরুণ রুমে যায়! পাতা কিচেন থেকে উঁকি ঝুঁকি দেয়। অরুণের কথা শুনেই পাতাবাহার লেজ নাড়িয়ে তাঁর পিছু পিছু চলছে। পাতা ভ্রু কুঁচকে বিড়বিড় করে ‘শালার ক্যারেক্টারলেস ছ’পোষা’ ! সেও আর ওয়েট করে না। পা বাড়ায় রুমে উদ্দেশ্যে! ভোর তাঁর রুমে পড়া রিভিশন দিচ্ছে। অভিমানী ছেলেটা জেদ চেপে পড়তে বসেছে।
অরুণ ফ্রেশ হয়ে ওয়াশ রুম থেকে বেরোতেই পাতাকে দেখতে পায়। কেমন কাঁচুমাচু মুখে দাঁড়িয়ে আছে। সে তোয়ালে বিছানায় ছুড়ে বলে,

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

-” লাল টমেটোর মতো মুখটা ভেন্ডির মতো বানিয়ে রেখেছো কেন?”
পাতা চোখে শাসায়! লোকটার প্রশংসা শোনা ছাই ছাড়া শিং মাছ ধরার মতো।
-” আমার মুখ আমি ভেন্ডি, টমেটো, আলু যা খুশি বানিয়ে রাখবো আপনার কি? আপনি যে বন ষাঁড়ের মতো মুখ বানিয়ে ঘোরেন আমি কিছু বলি?
অরুণ এগিয়ে আসে! পাতার কপালে গাঢ় ভাঁজ পড়ে। লোকটার হাবভাব সুবিধার নয়। সত্যিই সুবিধার ছিলো না। অরুণ পাতাকে ছেড়ে সরে দাঁড়িয়ে চুক চুক শব্দ করে বলে,
-” ছিঃ পাতাবাহার এক বন ষাঁড়ের চুমু খেলে? ফিলিংস কেমন?”
পাতা থমথমে মুখে জবাব দেয়,

-” খুবই জঘন্য! এলাচ দাঁতের তলায় পিষ্ট হলে যেমন লাগে তেমনি!”
-” তাই না? আসো আরেকবার টেষ্ট করাই ভালো লাগবে!”
বলেই অরুণ এগিয়ে আসে। পাতা নাক মুখ কুঁচকে অরুণকে ধাক্কা দেয়!
-” আপনি একটা যা তা! সরুন তো ভোরের বাবা!”
অরুণ হাসে শব্দহীন! পাতার পেটে হাত রেখে বলে,
-” ভোরের কি হয়েছে?গাল ফুলিয়েছে শুনলাম!”
পাতার মুখটা মলিন হয়ে যায়। মলিন স্বরে বলে,
-” কাল এক্সাম খেলতে দিই নি। তাই কষ্ট পেয়েছে। কেমন শান্ত আচরণ করছে। আপনি একটু কথা বলুন না ওর সাথে?”
-” ওকে। চলো আগে ডিনার করবে। রাত অনেক হলো!”

পাতাকে ডায়নিং-এ বসিয়ে অরুণ ভোরকে কোলে করে নিয়ে আসে। লাবনী আক্তার খাবার পরিবেশন করে নিজেও বসে। অরুণ ভোরকে কোলে বসিয়ে নিজ হাতে খাইয়ে দেয়। অরুণ খুব দ্রুত খাবার শেষ করে ভোরকে নিয়ে চলে যায়। পাতার কেমন যেন সন্দেহ হয়! কি চলছে বাবা ছেলের মনে?
অরুণ ভোরকে বিছানায় বসিয়ে দরজা বন্ধ করে। চেয়ার টেনে ভোরের সম্মুখীন হয়ে বসে। ভোর ছোট করে বলে,
-” কিছু বলবে আব্বু?”
অরুণ নজর অস্বাভাবিক শান্ত। ভোর খানিকটা মিইয়ে যায়। সে তো কোন দুষ্টুমি করে নি তাহলে? অরুণ বরফ শীতল গলায় বলল,

-” আব্বু কিছু লুকাবে না আমার থেকে। আমি যা জিজ্ঞেস করবো সত্যিটা বলবে! পাতা মা হিসেবে কেমন? ভালো লাগে না তোমার? সে ভালোবাসে না তোমাকে? আমার অগোচরে অবহেলা করে? সত্যিটা বলবে কিন্তু?”
ভোর চোখে মুখে অবাকতা! সে বিস্ময়ের সাথে বলে,
-” কি বলছো আব্বু? আম্মু অনেক ভালো। আমাকে সবসময়ই ভালোবাসে। একটুও অবহেলা করে না। বিকেলে আমাকে খেলতে দেয় নি তাই একটু মন খারাপ হয়েছিল শুধু। আম্মু অনেক ভালো আব্বু। ভোরকে অনেক ভালোবাসে!”
ছেলের মুখের ভাষার চেয়ে চোখের স্বচ্ছতা অরুণকে স্পষ্ট জবাব দিয়ে দিলো যেন। অরুণের বুকের উপর থেকে পাথর সমান ভারী বস্তু নেমে গেল বোধহয়। সে ছেলের গালে হাত রেখে আদুরে গলায় বলে,

-” আচ্ছা মানলাম। তাহলে কেন তোমার মা’য়ের কথা মনে পড়ে! লুকিয়ে চুরিয়ে ফোনে কথা বলো তার সাথে! যে তোমাকে ছোটবেলায় ছেড়ে চলে গিয়েছিল! তখন তুমি ছোট ছিলো। তাঁর কোনো স্মৃতি মনে হয় না তোমার স্মরণে আছে! তাহলে কিসের এই টান বাবা?”
ভয়ে ভোরের মুখখানি পানসে হয়ে যায়। বাবা কিভাবে জানলো? সে তো চুপিচুপি কল করে নম্বটা ডিলিটও করে দিয়েছিল! ভোর ভয়ে এই পৌষ মাসের শীতেও ঘামতে শুরু করে।‌নজর লুকিয়ে এদিক ওদিক তাকায়। অরুণ ছেলের গাল থেকে হাত সরিয়ে বলে,

-” নিশ্চয়ই পাতার ভালোবাসা স্নেহে কমতি আছে তাই তোমার তাঁর কথা মনে পড়ে। তাঁর কাছে নালিশ করো তোমাকে ফ্রিডম দেই না! ছয় বছরের বাচ্চার ফ্রিডম?? তোমার সবেতে বাঁধা দেই। তোমার আম্মুর টাম্মির বাবুকে বেশি বেশি ভালোবাসি। তোমাকে ভালোবাসি না! এই ভোর এসব সত্যিই?”
ভোর বাবার চোখে চোখ রাখে। এসব কি বলছে বাবা? সে তো কারো কাছেই নালিশ করে নি! আর নালিশ’ই বা করবে কেন? অরুণ আবার বলে,
-” আমার তো নিজের পায়ে দাঁড়ানোর ক্ষমতা ছিলো না। তাই বাপের রেখে যাওয়া সম্পদে আয়েশ করি! তোমাকেও সেভাবেই রাখতে চাই। ভালো একাডেমীতে ভর্তি করাই না। তোমার স্বপ্নের অন্তরায় দাঁড়িয়ে থাকি?”
ভোর বোঝেনা তার কথা! কিসব হাবিজাবি বলছে বাবা। অরুণ মুচকি হেসে বলল,
-” সে ফোন করেছিল আমাকে। সেই বলেছে এসব। তোমাকে শুধু শাসনের উপরে রাখি! তুমি নাকি ফোন করে বলেছো তাকে?”

ভোর ঝরঝরিয়ে কেঁদে ওঠে। অরুণ বুকে টেনে নেয় না। ভোর কেঁদে কেঁদে বলে,
-” আমি এসব বলিনি আব্বু বিশ্বাস করো! মা জিজ্ঞেস করেছিলো ভোরের মন খারাপ কেন! আমি শুধু বলেছি আম্মু খেলতে দেয় নি তাই। ভোরের পড়তে ভালো লাগে না। ভোর ক্রিকেটার হবে তাহলে এতো পড়ে কি করবে?আর কিছুই বলিনি!”
অরুণ ছেলের মাথায় হাত রেখে কাঁদতে বারণ করে। ভোরের কান্না থামে না। দু হাতে চোখ ডলে ফোপাতে থাকে! অরুণ জিজ্ঞেস করে,
-” আমি জানি তুমি বলো নি। আই ট্রাস্ট ইয়ু! কিন্তু আমার কথা হলো তুমি কেন তাকে কল করবে? কেন তোমার তার সাথে কথা বলতে হবে? এমন না যে তাঁর সাথে বুঝ হওয়ার পর দুই চার বছর থেকেছো তাঁর স্মৃতি টেনে বেড়ায় তোমাকে! দুই বছরের ছিলে যখন আমরা আলাদা হই। তাহলে?”
ভোরের কান্নার গতি কমে আসে। সে নাক টেনে বলে,

-” মা’র সাথে কথা বলতে ভালো লাগে আমার। তাই কথা বলি!”
অরুণের শান্ত নজর ছেলেতে নিবদ্ধ!
-” কেন ভালো লাগে?”
-” জানি না!”
-” ওহ্ জানো না! কথা বলতে ভালো লাগে! এই তোমার কি তাঁর কাছে ফিরে যাওয়ার কোনো মনোবাসনা আছে? যেতে চাও? ছোট হলেও অতটাও অবুঝ নও তুমি!”
স্বাভাবিকভাবেই ভাবেই বলে অরুণ! ভোর মাথা তুলে বাবার দিকে তাকিয়ে থাকে! অরুণ দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলে,
-” তোমার আবার কারো কারো কথায় মনে হতেই পারে আমার থেকে তাঁর কাছেই ভালো থাকতে! কিন্তু আফসোস সে তোমাকে নেওয়ার বিন্দুমাত্র চেষ্টা করে নি!”
ভোরের মায়ায় ভরপুর বড় বড় আঁখি যুগল বেয়ে বারিধারা বইতে থাকে নিভৃতে! অরুণ চুপচাপ অবলোকন করে বলে,

-” কি হলো? তাঁর কাছে থাকার মনোবাসনা পূরন করবো? তোমার কোন কিছুই আমি অপূর্ণ রাখি না!”
ভোর বাবার চোখে চোখ রাখে আবার। গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়া নোনাজল হাতের পৃষ্ঠে মুছে নিয়ে বলে,
-” তোমার মা তো আসছে! ভোরকে আর কিসের দরকার!”
এযাত্রায় অরুণ বিমূক! কথা বলার ভাষা হারিয়ে ফেলে! তাঁর ছোট্ট কলিজা কথা বলা শিখে গেছে! এবার অরুণের বিষণ্ণ আঁখি যুগলে শিশির কণা জমতে শুরু করে। কন্ঠস্বর রোধ হয়ে আসে। তবুও বিষাদের সুরে বলে,
-” হ্যাঁ তাইতো! দরকার কিসের? ভালো!”

অরুণের পক্ষে আর বসে থাকা সম্ভব হয় না। সে দরজা খুলে চলে যায় ব্যস্ত গতিতে। ভোর আব্বু বলে পিছু ডাকলেও শোনে না। সে দরজার কাছে দাঁড়িয়ে থাকে টইটুম্বর চোখে।পাতা পেট চেপে এগিয়ে আসে দ্রুত পায়ে। লাবনী আক্তার তাকে বকাঝকা করে শোনে না। ভোরের কাছে এসে বলে,
-” কি হয়েছে? কাঁদেছো কেন? তোমার বাবা বকেছে? মেরেছে?”
ভোর ডানে বামে মাথা নেড়ে পাতার কোমড় জড়িয়ে ধরে। নয় মাসের ফুলো পেট হওয়ায় অসুবিধা হয় ভোরের। তবুও শক্ত করে ধরে রাখে। পাতা আদুরে গলায় জিজ্ঞেস করে কি হয়েছে? ভোর চুপচাপ, কিছুই বলে না; না পাতাকে ছাড়ে।

পাতা ভোরকে নিয়ে তাদের ঘরে যায়! অরুণ ঘুমের প্রস্তুতি নিচ্ছে! পাতা শব্দ করে দরজা খুলে ভিলেনের মতো এন্ট্রি নিলো। যেন অরুণকে কাঁচা গিলে নিবে! অরুণ ভ্রু উঁচিয়ে জিজ্ঞেস করল,
-” ভয় পেলাম কিন্তু! কি হয়েছে? মারবে টারবে নাতো? আমি জানি সেটা তোমার দ্বারা সম্ভব নয়!”
আরো কিছু বলতে চেয়েছিলো অরুণ। পাতার পেছনে শাশুড়িকে দেখে চুপ করে। ভোর মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে; আপাদত সে পাতার হাতে বন্দী! পাতা ভনিতা না করে সরাসরি জিজ্ঞেস করে,
-” ভোর কাঁদছে কেন?”
-” আশ্চর্য!তাকেই জিজ্ঞেস করো না!”

-” আমি জানি নাটের গুরু আপনি! নিশ্চয়ই বকেছেন নয়তো মেরেছেন? আপনার হাত পা বেশি চলে কি না!”
কটাক্ষ করে বলে পাতা! ভোর আড়চোখে বাবার দিকে চায়। অরুণও তাকায় তাঁর দিকে। নমনীয় গলায় বলে,
-” বকেছি তোমাকে? মেরেছি?”
ভোর না বোধক মাথা নাড়ল। পাতা কপালে ভাঁজ ফেলে বাবা ছেলেকে দেখে নেয়। তাহলে কাঁদার রহস্য কি? সে আঙ্গুল উঁচিয়ে জিজ্ঞেস করে,
-” তাহলে কি ভোর অতি সুখে কাঁদছে শুনি? আপনার শয়তানী চাল আমি বুঝি না ভেবেছেন? ঘরে দরজা বন্ধ করে বাবা ছেলে লুঙ্গি ডান্স করছিলেন বুঝি?”
অরুণ বিছানায় বসে শান্ত গলায় বলে,

-” সেরকমই কিছু ভেবে নাও। আর হাইপার হচ্ছো কেন? আস্তে কথা বলো। এমনিতেই হাই প্রেশার আছে!”
পাতা শান্ত হওয়ার বদলে আরো উত্তেজিত হয়। তাঁর রাগ লাগছে অসম্ভব! তখন সে লোকটাকে বলেছিলো ভোরের সাথে কথা বলতে! লোকটা নিশ্চয়ই ছেলেকে ধমকেছে! সে ফোঁস ফোঁস করে শ্বাস টেনে বলে,
-” হেঁয়ালি করবেন না! বাচ্চাটা মন খারাপ করে বসেছিল। আমি শুধু কথা বলতে বলেছিলাম! আপনি কাঁদিয়ে দিলেন? আমার রাগ ওর উপর দেখালেন নাকি?”
অরুণ বিস্ময়ে তাকালো পাতার দিকে! কি বলে কি এই মেয়ে? লাবনী আক্তার এবার পাতাকে চাপা স্বরে ধমক দিয়ে বলে,

-” বেশি বুঝিস কেন? চল আজ আমার কাছে থাকবি?”
পাতা অনড়! অরুণ উঠে এসে তাদের সামনে দাঁড়িয়ে ভোরকে কোলে তুলে নিয়ে গালে চুমু দিলো। ভোর সুযোগ বুঝে বাবার গলা জড়িয়ে বিড়বিড় করে ‘বাবা স্যরি’ বলে। অরুণ শুনেও তাকে কিছু না‌ বলে পাতার উদ্দেশ্যে বলে,
-” অহেতুক কথা বলবে না পাতাবাহার! ওকে বকি নি। না মেরেছি! আদর করে দুই একটা কথা বলেছি নাকের জল চোখের জলে একাকার। ও ছিঁচকাদুনে সেটা নতুন করে বলতে হবে না নিশ্চয়ই?”
-” এমনি এমনি কেউ কাঁদে না! শাক দিয়ে মাছ ঢাকার চেষ্টা করছেন?”
-” আশ্চর্য অহেতুক বিষয় টেনে সিনক্রিয়েট কেন করছো পাতা?”
শক্ত গলায় বলে অরুণ! ভোর ঘন ঘন শ্বাস টেনে ফুঁপিয়ে কম্পমান গলায় বলে,
-” ও আম্মু?আব্বু বকে নি আমাকে! মারেও নি আম্মু। সত্যি বলছি!”

পাতা শান্ত চোখে ভোরের দিকে চায়। তাঁর বিশ্বাস হয় না। দুই বাবা ছেলের মাঝে কিছু তো হয়েছে! তাঁর থেকে লুকোচ্ছে! কেন এসব লুকোচুরি? সে কি পর কেউ? লাবনী আক্তার অরুণের দিকে করুণ চোখে চেয়ে বলে,
-” কিছু মনে করিও না বাবা! আমি বুঝিয়ে বলবো। ও ভেবেছে তুমি বাচ্চাটাকে বকাঝকা করেছো! আমি নিয়ে যাচ্ছি ওকে। এই পাতু ? মা চল?”
পাতা পা বাড়ায়! যাবার আগে ভোরের মলিন মুখটা আবার দেখে নেয়। কিছুই হয় নি তাহলে প্রাণবন্ত চেহারায় কেন মেঘ জমেছে?

শীতের স্নিগ্ধতায় ভরপুর সকাল! ঘন কুয়াশায় ঢেকে আছে পুরো শহর। ঠান্ডা ঠান্ডা ভাবটা দিনকে দিন বেড়েই চলেছে। পাতা কিচেনে মায়ের পাশে দাঁড়িয়ে আছে! লাবনী আক্তার যে কটা দিন হলো এবাড়িতে এসছে পাতা তার সবটা আদর ভালোবাসা লুফে নিয়েছে। পারে না ছোট বাচ্চার ন্যায় মায়ের কোলে বসে থাকতে। তাঁর ছোট ছোট আশা পাওয়া যেটা মা’কে ঘিরে ছিলো পাতা সবটা উসুল করার চেষ্টায় নেমেছে। নিত্যদিনই শ’ খানেক আবদার করা! মা’কে পেরেশান করা! দুষ্টু মিষ্টি খুনসুটি! সবটা। লাবনী আক্তার কখনো বিরক্ত বোধ করে নি। ছোট বাচ্চার ন্যায় পাতাকে সামলাতে চেষ্টা করেছে‌। পাগলিটাকে তো খুব একটা কাছে ঘেঁষতে দেয় নি কখনো।এখন অনুতাপে পোড়া ঘা’য়ে একটু মলম লাগিয়ে দিলে যদি একটু পাপবোধ কমে যায়!! আতিকুর ইসলামও ফোন করে পাতার খোঁজ খবর নেয়। পাতার ভালো লাগে। ক’দিন আগে লুব এসেছিলো। হাসি দুঃখ মিলে অনেক ভালো কাটছে দিনগুলো। পাতা মায়ের গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে বলে,

-” আম্মু কখন হবে ভাবা পিঠা? আমার তো আর তর সইছে না!”
-” এতোটা অধৈর্য স্বভাব তো তোর ছিল না! দিনকে দিন বাচ্চার মতো হয়ে যাচ্ছিস!”
লাবনী আক্তার মিছে বিরক্তিকর কন্ঠে বলে! পাতা মুচকি হেসে জবাব দেয়,
-” আমি ধৈর্য ধরতে পারি কিন্তু তোমার নাতনি ধৈর্য্য ধরতে পারছে না। সে পেটে লাফালাফি শুরু করে দিয়েছে!”
-” হ্যাঁ রে নাতনিই হবে? আল্ট্রা করিয়ে ছিলি?”
-” হুম! দুই বার! ডাক্তার বললো মেয়ে হবে।”

-” যেই আসুক শুধু সুস্থ ভাবে তাঁর আগমন ঘটুক! এই যা ভোরকে ডেকে নিয়ে আয়! আমি জলদি করে বানাচ্ছি!”
পাতা সায় জানিয়ে পা চালায়। লোকটা তো ভোরবেলায় হাঁটতে বের হয়েছে! এখনো ফিরছে না কেন? তখনই দরজা খোলার শব্দ আসে। পাতা মেইন দরজার দিকে তাকাতেই অরুণের সাথে চোখাচোখি হয়! অরুণ দরজা লক করে এগিয়ে আসে। পাতা তাকে পাশ কাটিয়ে রুমে ঢুকে ভোরকে ডাকতে থাকে।
-” আরেকটু আগে তুলে বই নিয়ে বসালে পারতে!”
পাতা তাঁর কথা সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে ভোরকে একপ্রকার টেনে তোলে। ভোর হামি তুলে ঘুম জড়ানো গলায় বলে,
-” আরেকটু ঘুমাই না আম্মু?”
-” এতো বড় রাত ঘুমিয়েছো, এখনো ঘুম পুরো হয় নি ভোর সোনার? জলদি উঠো! নানু ভাপা পিঠা বানাচ্ছো। খেয়ে পড়তে বসবে গুড বয়ের মতো হুম?”

ভোরের ঘুম গায়েব হয়ে যায়। লাফ দিয়ে উঠে ওয়াশ রুমে চলে যায় দৌড়ে। যাওয়ার পথে বাবার দিকে আড়চোখে চাইতে ভুলে নি! বাবা কি এখনো রেগে আছে? ভোর চলে যেতেই অরুণ পাতার কাঁধ জড়িয়ে ধরে বলে,
-” পিঠা একা একা সাবাড় করে ফেলো না যেন! এই অধমের জন্যও দুটো রেখো!”
পাতা ঝটকায় তাঁর হাত সরিয়ে চলে যেতে নেয় অরুণ আটকে রেখে বলে,
-” এই পাতাবাহার?”
কি আদুরে ডাক! তবে এবার আর আবেগী পাতার মন নরম হয় না। সে অরুণকে পাশ কাটিয়ে চলে যায়। অরুণ গলা উঁচিয়ে বলে,

-” রাগ করেছো? আচ্ছা স্যরি! অনেক আদর করবো! গালে বিশটা ওই মোটা অধরে পঁচিশটা বাকি পাঁচটা ওই আপেলের ন্যায় থুতনিতে! অর্ধশতাধিক চুমু দিলে রাগ ভাঙবে বুঝি? নাকি সেঞ্চুরি লাগবে?”
পাতার কান ভারী হয়! অসভ্য বেলাজ লোক কোথাকার! বাড়িতে আম্মু আছে ভুলে গেছে নাকি? আম্মু নিশ্চয়ই শুনতে পেয়েছে! কি লজ্জা!! অরুণ বলা শেষ হয় নি আবার বলতে শুরু করলে পাতা গলা উঁচিয়ে ‘আম্মু’ ডাকে। ব্যস অরুণ চুপ হয়ে যায়। বাড়িতে শাশুড়ি মায়ের অবস্থানের কথা ভুলে বসেছিল সে! এরই মাঝে ভোর ওয়াশরুম থেকে বের হয়ে আসে হাতে ব্রাশ ও ক্লোজআপ! সে মিনমিনে গলায় বলল,
-” ও আব্বু? পেস্ট ব্রাশে লাগিয়ে দাও না?”

অরুণ তাঁর হাত থেকে ব্রাশ ও ক্লোজ আপ নিয়ে ওয়াশ রুমে ঢুকে যায়। ভোর তাঁর পিছু পিছু। অরুণ চুপচাপ ভোরকে ফ্রেশ করিয়ে নিজেও ফ্রেশ হয়ে বের হয়ে যায়। পাতা ও লাবনী আক্তারকে কিচেনে দেখে তাঁরাও সেখানেই যায়! লাবনী আক্তার একটা ভাপা পিঠা নামিয়ে বলে,
-” এই পাতা এটা জামাইকে দে? আর ভোর তোমার জন্যও বানাচ্ছি! খেতে পারো ভাপা পিঠা?”
-” পারি তো! গুড় বেশি করে দিও নানু!”
ভোর মিষ্টি হেসে বলে। পাতা পিঠার ঝুলি রেখে কেবিনেটের উপর রাখে। অরুণ ছোট ছোট চোখে চায়! বুঝতে পারে সেটা তাঁর জন্যই। তবে সে এমন ভাব ধরে যেন সে দেখেই নি। লাবনী আক্তার আবার একই কথা বললে পাতা ত্যাছড়া গলায় বলে,

-” দিয়েছি পিঠা! তাঁর চোখ নেই দেখতে পারে না? নাকি মুখে তুলে খাওয়াতে হবে?”
লাবনী আক্তার চোখ রাঙায়! অরুণের মুখাবয়ব গম্ভীর হয়। খানিকটা অপমান বোধ করে! রেগে আছে মানছে তাই বলে এভাবে মায়ের সামনে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করে কথা বলবে? লাবনী আক্তার পাতার দিকে কটমট করে চেয়ে পিঠার ঝুলি অরুণের দিকে বাড়িয়ে বলে,
-” নাও গরম গরম পিঠা ভালো লাগে!”
-” আমি এসব খাই না আম্মা! আপনারা খান!”
অরুণ গটগট করে চলে যায়। লাবনী আক্তার মেয়েকে বকাঝকা করে পিঠার ঝুলি সমেত দিয়ে পাঠায়! পাতা দোনামোনা মনে এগিয়ে আসে। ওভাবে বলা উচিত হয়নি। লোকটার খারাপ লেগেছে বোধহয়!

বারোটার দিকে এক্সাম শুরু হবে ভোর! অরুণ ছেলেকে সঙ্গে নিয়ে এসেছে স্কুলে। একটু পরেই এক্সাম শুরু হবে। ভোর আর অরুণ স্কুল মাঠে দাঁড়িয়ে আছে। দু’জনেই চুপচাপ! ব্যাপারটা অস্বাভাবিক কিছুই। ভোর বাবার হাত ধরে আছে শক্ত করে। তাঁর মুখাবয়ব ঠাহর করা মুশকিল। বাবা তাঁর সাথে কথা বলছে না। তাঁর খুব কষ্ট হচ্ছে! বাবা কেন তাঁর সঙ্গে কথা বলবে না? সে অরুণের বাহু ঝাঁকিয়ে বললো,
-” ও আব্বু এক্সাম শুরু হবে আমি যাই?”

-” যাও!”
ক্লিপ বোর্ড, পেন্সিল বক্স ও স্কেল ভোরের হাতে ধরিয়ে দেয় অরুণ! ভোরের মুখখানি এইটুকুন হয়ে যায়! সবসময় তো আব্বু এক্সাম হলে রেখে আসে! সে ঠোঁট উল্টিয়ে সব নিয়ে হেঁটে যায়! অরুণ পিছু ডাকে ভোরকে! ভোরের টকটকে অধর জোড়ায় হাসির ঝিলিক দেখা দেয়। সে পেছন ফিরে এগিয়ে আসে উদ্বেগের সাথে। অরুণ ছোট করে বলে,
-” তুমি কি তাঁর সাথে থাকতে চাও?”
ভোরের বুঝতে অসুবিধা হয়না তাঁর বলতে কাকে বোঝানো হয়েছে! ভোরের হাসি মুখখানি থমথমে ভাব বিরাজ করে। সে থমথমে গলায় বলে,
-” তুমি ভোরকে ছাড়া থাকতে পারলে ভোরও বাবাকে ছাড়া থাকা শিখে যাবে আব্বু!”
বলেই দৌড়ে যায়! অরুণ সেখানে দাঁড়িয়ে ভাবনার সাগরে ডুব দেয়। তাঁর পিচ্চি কলিজা এতো ভারী ভারী কথা শিখলো কিভাবে?

রুমের এক কোনায় লাস্ট সিটে ভোর বসে আছে থমথমে মুখে। চোখে চিকচিক করছে জলকনা।গাল ও নাকটা লাল হয়ে আছে। নাকের পাটা ফুলে উঠছে বারংবার। অষ্ঠাধর কাঁপছে মৃদু। হাতে পেন্সিল শক্ত করে ধরে আছে। এক্সাম শুরু হতে আরো বিশ মিনিট বাকি আছে। কিছুক্ষণের মাঝেই টিচারের আগমন ঘটবে। ভোরের বয়সী এক ছেলে এসে ভোরের পাশে বসে। পোকায় খাওয়া দাঁতে ফোকলা হেসে বলে,
-” এই হুতুম পেঁচার মতো মুখ বানিয়ে রেখেছিস কেন? বাড়ি থেকে বের করে দিয়েছে নাকি?”
ভোর কথা বলে না। টুটুল তাঁর কাঁধে হাত রেখে বলে,

-” এই তোর বোনের বার্থ হয়ে গেছে নাকি?”
ভোর মাথা নেড়ে অসম্মতি জানায়। টুটুল হেসে বলল,
-” তাহলে চিন্তা কিসের? তোর বাবা মা এখনো তো তোরই! বোন হলে তবেই না তোর রাজত্ব শেষ!”
-” ফালতু কথা বলবি না! সর এখান থেকে!”
দাঁত কপাটি পিষে পিষে বলে ভোর। টুটুল হেসে বলে,

-” এখন বিশ্বাস না করলি! মিলিয়ে নিস! আগে আমিও আমাদের বাড়ির আদরের টুটুল ছিলাম। যেই ওই টাপুর এলো আমাকে ভুলেই গেলো! আমি আর ভাইয়া তো ওই টাপুরের বডিগার্ড যেন! টাপুর নিজে দুষ্টুমি করে ব্যাথা পেলেও বাবা আমাদের দুই ভাইকে বকে। মা অবশ্য আমাদের বেশি ভালোবাসে। কিন্তু বাবা দেখতেই পারে না। সারাক্ষণ ম্যা ম্যা করে মেয়েকে নিয়েই পড়ে থাকে। ওর জন্য এতো এতো পুতুল আনবে শপিং করাবে আমরা চাইলেই ধমক দিবে! ভোর ভাই তো বলে মেয়েরা হলো দুষ্টু পরি। সবাইকে নিজেদের দিকে টেনে নেয়। তোর বোন হলে তোরও এই হালই হবে ভোর!”

ভোর কিছু বলে না। টুটুল নিজের মতোই বকবক করতে থাকে।ভোর জানে তাঁর সব কথা। রোজ বলবে এসব! ভোরের এসব শুনতে ভালো লাগে না! টিচার চলে আসায় টুটুল চলে যায়। ভোর গোমড়া মুখে বসে থাকে। বোন এলে বাবাও কি টুটুলের বাবার মতো ভোরকে শুধু বকবে? নাহ্ ভোরের বাবা তো ভোরকে সববচেয়ে বেশি ভালোবাসে। তবে আগে বাবা শুধু ভোরকে ভালোবাসতো এখন বোনকেও ভালোবাসবে! টিচার খাতা ও প্রশ্ন পত্র দিয়ে যায়। ভোরের প্রশ্ন দেখতে ইচ্ছে করছে না। তাঁর শুধু কান্না পাচ্ছে! বাবা কিভাবে তাকে দূরে যাওয়ার কথা বলতে পারলো? বাবার কি কষ্ট হয় নি? ভোরের তো অনেক কষ্ট হচ্ছে!

সে তো শ্বাস নিতে পারছে না। সে মা’য়ের সাথে কথা বলেছে তো কি হয়েছে?মা’র সাথে তার কথা বলতে ভালো লাগে একটু একটু। কেন লাগে তা সে জানে না! সে কি মায়ের সাথে থাকতে চেয়েছে নাকি! তাঁর তো আম্মু আছেই। সে আম্মুকে ভালোবাসে । আম্মুর বুকে মুখ লুকিয়ে ঘুমোতে তাঁর ভালো লাগে। আম্মু খাইয়ে দিলে ভোর বেশি বেশি খেতে পারে। আম্মু তাকে আদর করলে ভোরের মনে হয় সে আকাশে পাখির মতো উড়ছে। আম্মু ভালোবেসে ডাকলে ভোরের নাচতে ইচ্ছে করে। আম্মু হাসলে ভোরের আকাশে রামধনু ওঠে বুঝি? আর আম্মু স্যাড স্যাড থাকলে আকাশে কালো মেঘ জমে। সে আম্মুর কাছেই থাকবে। আব্বু আরেকবার বলুক রেখে আসার কথা ভোর সব ভেঙ্গে চুরমার করে দেবে। সে জানে আব্বু মিছে মিছে বলছে ভোরকে পানিশমেন্ট দেয়ার জন্য। তবুও তাঁর কষ্ট হয়।

-” এই ভোর? লিখছো না কেন?”
টিচারের কর্কশ গলায় ভোরের ধ্যান ভঙ্গ হয়। ভোর ভাবনার জগত থেকে বেরিয়ে এসে লেখা শুরু করে। চোখের পলকে সময় গড়িয়ে যায়। দু ঘন্টা পেরোতেই ঘন্টা বেজে ওঠে। টিচার খাতা নিয়ে গেলে ভোর সব গুছিয়ে বের হয়ে আসে। টুটুল এসে ভোরের কাঁধে কাঁধ রেখে হাসিমুখে বলে,
-” কি রে কেমন হলো এক্সাম?”
-” ভালো!”
-” ভালো হয়েছে? সত্যিই?”
অবাক স্বরে বলে টুটুল। ভোরের ছোট্ট কপালে ভাঁজ পড়ে।
-” কেন ভালো হবে না কেন?”
-” না মানে আমার ভালো হয় নি । তাহলে তোর কেন ভালো হবে?”
ভোর এবার মুচকি হাসলো। বুক ফুলিয়ে বলে,
-” আম্মু সব সুন্দর করে পড়িয়েছে তাই ভালো হয়েছে বুঝলি টাট্টু ঘোড়া!”
-” এই টাট্টু ঘোড়া বলবি না ভোলা!”
ভোর মুখ মুচড়ে বলে,
-” একশবার বলবো। টাট্টু ঘোড়া টাট্টু ঘোড়া!”

টুটুল ভোরের পিঠে ধুম করে একটা কিল বসিয়ে দিল সাথে সাথেই। ভোর চোখ বড় বড় করে চায়! ক্লিপ বোর্ড, পেন্সিল বক্স ফেলে টুটুলকে ধুমধাম মারতে থাকে। আশেপাশের বাচ্চারা ভিড় জমায়। সবাই মজা নেয়! টিচারের আগমন ঘটতেই ভোর টুটুলকে ছেড়ে ভদ্র বাচ্চার ন্যায় মাথা নিচু করে নেয়। টুটুলও ভোরের অনুকরণ করে। মিনমিনে গলায় বলে,

-” স্যরি টিচার! আমরা এমনি মজা করছিলাম। আমরা তো বন্ধু তাই না ভোর? বলনা?”
ভোরকে কনুই দিয়ে গুতো দিয়ে বলে। ভোর দাঁত বের করে হেসে মাথা নেড়ে সম্মতি জানালো। টিচার দুজনকেই বকতে বকতে চলে যায়। ভোরও তার জিনিসপত্র তুলে নিয়ে টুটুলের সাথে হাঁটা দেয়। একটু যেতেই প্রিয় মুখ দেখে ভোরের চোখের আকার বড় হয়। দিগ্বিদিক ভুলে দৌড় দেয় সে। এক দৌড়ে বাবার কোলে উঠে গলা জড়িয়ে গালে মুখে চুমুর বন্যা বইয়ে দেয়। আব্বু অফিসে যায় নি! তার জন্য ওয়েট করছিলো! আশেপাশের অনেকের নজরই এদিকে। অরুণ ছেলের কপালে চুমু দিয়ে বলে,

-” তোমাকে ছাড়া শ্বাস পর্যন্ত নিতে পারি না দূরে কি করে রাখবো কলিজা?”
ভোরের চোখে নোনাজল জমতে শুরু করে। নাক ভরে ওঠে। সে নাক টেনে বলে,
-” তাহলে পঁচা কথা বলো কেন? ভোরের কষ্ট হয় না বুঝি?”
অরুণ ছেলেকে নিয়ে পা বাড়ায়। সে তো শুধু ছেলেকে একটু বাজিয়ে দেখতে চেয়েছিলো। মা’য়ের সাথে কথা বলে তাঁর কোমলসম ছেলের মনটা প্রভাবিত হয় নি তো? ছেলের মনে কোনো আক্ষেপ নেই তো! অরুণ ছেলেকে নিয়ে গাড়িতে উঠে বলে,
-” বাবার থেকে দূরে যাওয়ার কথা মাথায় এলে শেকল দিয়ে বেঁধে রাখবো।”
ভোর হু হু করে কেঁদে ওঠে। অরুণ কিছু বলে না। কাঁদুক একটু! ভোরের কান্না থামে একটু পরেই। অরুণ টিস্যু নিয়ে তাঁর নাক মুখ পরিষ্কার করে দিয়ে বলে,

-” এক্সাম কেমন হলো?”
-” ভালো! তুমি অফিসে যাবে না?”
-” থাক আজ আর যাবো না! আজ সবাই মিলে অনেক মজা করবো!”
ভোর বাবার গলা জড়িয়ে বসে আছে। হঠাৎ সে মিনমিনে গলায় বলে,
-” আব্বু তুমি আম্মুকে বলবে না প্লিজ!”
-” কেন বলবো না? তুমি লুকিয়ে লুকিয়ে এতো কান্ড করো পাতার জানতে হবে না? বেচারি কতটা ভালোবাসে তোমাকে।এ কথা জানলে কি ভাববে?”
ভোর কথা বলে না! বাবার কাঁধে মুখ লুকিয়ে রাখে।

বাড়ি ফিরতে ফিরতে ভোর বাবার কোলে ঘুমিয়ে যায়। অরুণ ঘুমন্ত ছেলেকে নিয়েই কলিং বেল বাজালো। দরজা খুলতেই নতুন মুখ দেখতে পায়! অরুণ মনে মনে ভাবে এমনিতেই আদুরে বউটা রেগে তাঁর উপর বউয়ের জল্লাদ বোন লতার আগমন! মনে হয় এবারের অভিমান ভাঙাতে অরুণের অনেক কাঠখড় পোড়াতে হবে।
দু’জনেই চুপচাপ থাকে। একে অপরের সাথে ভদ্রতাসুলভ কুশল বিনিময়ও হয় না। লতা দরজা থেকে সরে দাঁড়ালে অরুণ ভেতরে প্রবেশ করে। লাবনী আক্তার ড্রয়িং রুমেই রুম্পার সাথে খেলছিলেন। অরুণকে দেখে বলে,
-” অফিস যাবে না?”
-” যেতে ইচ্ছে করছে না। তাই ফিরে এলাম! পাতাবাহার কই?”
লাবনী আক্তার ভাবে বিড়ালের কথা বলছে তাই আঙুলের ইশারায় সোফার উপর দেখায়। যেখানে বিড়ালটি গভীর ঘুমে। অরুণ কি বলবে ভেবে পায় না। লতা মায়ের পাশে বসে বলে,

-” পাতা ঘরেই কুরআন তেলাওয়াত করছে!”
‘ওহ্’ বলে অরুণ ঘরে চলে যায়। লতা মায়ের দিকে তাকিয়ে রাগি চোখে বলে,
-” দেখেছো? ভালোমন্দ জিজ্ঞেস করা দূরের কথা ট্যু শব্দটি বলল না। এর মতো অসামাজিক মানুষ হয়? বড়লোক তাই রগে রগে অহংকার। এই জন্য আমি আসতে চাইছিলাম না। আমি এক্ষুনি চলে যাবো!”
-” তুই ও তো কিছু বলিস নি। দোষ তোরও আছে। তুই জিজ্ঞেস করতে পারতি! নাহ্ তোরও তো ইগো প্রবলেম!”
লতার মুখটা থমথমে হয়ে যায়। পাতার মতো সেও অরুণকে গালি দেয়। ম্যানারলেস লোক!

রুমে প্রবেশ করতেই অরুণের কানে দোল খায় সুমধুর কন্ঠের তিলওয়াত। সূরা আর রাহমান পাঠ করছে পাতা! অরুণ চুপচাপ ভোরকে বিছানায় শুইয়ে দিয়ে হুডি ও টাওজার নিয়ে ওয়াশ রুমে যায়। পাতা তিলাওয়াতের মাঝেও আড়চোখে চায়। এই ম্যানারলেস এখানে কেন? অফিসে যাবে না নাকি! পাতা সুরা রাহমান পাঠ করে ছোট করে কুরআন শরীফ বন্ধ করে‌ তাতে চুমু দিয়ে দুই চোখে ছুঁয়ে দেয়। টেবিলে কুরআন শরীফ রেখে ঘুরে দাড়াতেই বলিষ্ঠ শরীরের সাথে ধাক্কা লাগে। পাতার বুঝতে বাকি থাকেনা এই শক্ত খাম্বাটা অরুণ সরকার। অরুণ আলগোছে পাতাকে জড়িয়ে নেয় নিজের সাথে। ফিসফিসিয়ে ডাকে

পাতা বাহার পর্ব ৫৩ (২)

-” এই পাতাবাহার?”
পাতা জানে এভাবে আর দুই একবার ডাকলে একটু আদুরে কথা বললেই তার মনটা বেঈমানি করে বসবে। সে ছাড়া পাওয়ার চেষ্টা করে। অরুণ ছাড়ে না। নমনীয় গলায় বলল,
-” রাগ করেছো?”
-” না! ছাড়ুন।”
যথেষ্ট শক্ত গলায় বলে পাতা। অরুণ তাঁর গালে চুমু দিয়ে বলে,
-” হাফ সেঞ্চুরিতে রাগ কমবে না সেঞ্চুরিতে?”

পাতা বাহার পর্ব ৫৫