পাতা বাহার পর্ব ৫৭
বেলা শেখ
শীতের স্নিগ্ধতায় ঘেরা বিকেল বেলা! নীল দিগন্তের পশ্চিম কোণে কমলা রূপ অরুণ মিষ্টি হেসে চেয়ে আছে। তাঁর মিষ্টি হাসির উষ্ণতা ধরনী ছেয়ে আছে। নীল দিগন্তের বুকে শত বিহঙ্গের দল ডানা মেলে উড়ে বেড়ায় এলোমেলো। দেশি পাখির ভিড়ে অতিথি পাখির কলকাকলিতে মুখরিত নিলাম্বর। সরকার বাড়ির আঙিনায় দেশি বিদেশি পাখির মেলা বসেছে যেন। রঙ বেরঙের বিভিন্ন প্রজাতির পাখির বসবাস এই আঙিনায়। সারাটা বেলায় তাদের খুনসুটি দেখা যায় তবে বিকেলে তাদের মেলনায়তন চক্ষু শীতল আবেশে ভরিয়ে দিতে সক্ষম।
অরুণ সরকারের আগমন ঘটেছে সরকার বাড়িতে। একাই এসেছে। শুক্রবার অফিস বন্ধ কাজের চাঁপাকল থেকে মুক্ত। একা তাঁর ছোট্ট কুটিরে ভালো লাগছিলো না। শ্বশুড় বাড়িও যেতে ইচ্ছে করছিলো না। দু’ এক দিন পর পরই যাওয়াটা কেমন দেখায় না? তাঁর উপর ও বাড়িতে পাতাবাহার যেন তাকে চোখেই দেখে না, কথা বলা দূরের কথা। লতা মেয়েটিও বাপের বাড়ি পড়ে আছে। অরুণ গেলেই খোঁচা মেরে কথা বলবে। অরুণ অপমান বোধ করে। তাই ভেবেছে যাবে না।পাতা কল করলে তবেই যাবে। অরুণ বর্তমানে সরকার বাড়ির আঙিনায় পাতা বেতের চেয়ারে বসে গরম ধোঁয়া ওড়ানো চায়ের স্বাদ নিতে ব্যস্ত। সে একা নয় এখানে। আরিয়ান, রুবি, আদুরি, আসমা বেগম, আভারি, মিনু, সুফিয়া সবাই উপস্থিত।
আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন
আনিকা,রূপ, নয়ন খেলছে। সুফিয়া তাদের দেখাশোনা করছে। মিনুও তাঁর সঙ্গে। আভারি অরুণের পেছনে দাঁড়িয়ে। অরুণ বসতে বললেও বসে নি। আদুরি অরুণ পাশে বসে একটার পর একটা প্রশ্ন করেই যাচ্ছে। আরিয়ান তাকে এটা ওটা বলে লেগপুল করছে আদুরি কাঁদো কাঁদো হয়ে তাঁর কাছে নালিশ জানায়। অরুণ আরিয়ানকে মিছে মিছে শাসায়। দুষ্টু মিষ্টি খুনসুটির মাঝে হঠাৎ আদুরি অরুণকে উদ্দেশ্য করে বললো,
-” বড় ভাইয়া? শুনলাম ভাবী নাকি রাগ করে বাপের বাড়ি পারি জমিয়েছে! সত্যিই?”
আরিয়ান সন্দেহ চোখে চায়! আম পাতা জোড়া জোড়া ভাইয়ের উপর রাগ করে বাপের বাড়ি চলে গেছে? সত্যিই? এ যে অতি আশ্চর্যের বিষয়! অরুণ ভ্রু কুটিতে ভাঁজ ফেলে জিজ্ঞেস করে,
-” কার থেকে শুনলি?”
আদুরি পড়ে এবার বিপাকে। কি জবাব দেবে? তবে আরিয়ানের প্রশ্নে আদুরি আটকে রাখা শ্বাস ছাড়লো।
-” ভাই ? সত্যিই আম পাতা জোড়া জোড়া রেগে বাপের বাড়ি গেলো? আমার তো বিশ্বাস হচ্ছে না!”
অরুণ স্বাভাবিক মুখের আদল গম্ভীর হয়। চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে বলে,
-” রেগে না। নাইওর গেছে। ডেলিভারীর সময় সব মেয়েই তো যায়!”
-” তাই তো বলি! তেজপাতার আবার রাগ তাও ভাইয়ের উপর! চোখে হারায় তোকে ভাই! তুই বললে ঠান্ডা চা গরম মনে করে খেয়ে নেবে!”
আরিয়ান হেসে বলে। আদুরিও হেসে ওঠে তাঁর কথায়। অরুণের কাঁধে মাথা রেখে বলে,
-” বড় ভাবী ভাইকে অনেক ভালোবাসে বুঝলে ভাইয়া! তাই ভাইয়ের কথা মেনে চলে।”
আরিয়ান হেসে মাথা নেড়ে সায় জানালো আদুরির কথায়। রুবির দিকে আড়চোখে চেয়ে বলে,
-” আম পাতার মতো জামাই পাগল মেয়েই তো সব ছেলেরা বউ হিসেবে চেয়ে থাকে। কিন্তু কপালে তো তাঁদের রিনা খান নাচে!”
রুবি কটমট করে চায় আরিয়ানের দিকে। আরিয়ান ভুলেও তাকায় না তাঁর দিকে। অরুণ চা শেষ করে কাপ সামনের টেবিলে রেখে আরিয়ানের দিকে তাকিয়ে খানিকটা কড়া সুরে বলে,
-” ভাবী হয় তোর! ভাবী সম্মোধন করবি নইলে দরকার নেই ডাকার। আম পাতা, তেজপাতা কেমন সম্মোধন?”
অরুণের কড়া সুরে বলা বাক্য আরিয়ান সিরিয়াস নেয় না। হেসে বলে,
-” রেগে যাচ্ছো কেন ভাই? আসলে এইটুকুন ই তো আমাদের ভাআবী। দেখতে পিচ্চি লাগে মনে হয় আদুরির চেয়েও ছোট! কলেজ পড়ুয়া মেয়ে!”
অরুণ কিছু বলে না। তবে তার মুখাবয়ব সিরিয়াস! রুবিরআরিয়ানের দিকে তাকিয়ে বললো,
-” তুমি মজা করে বলো কিন্তু তোমার ভাইয়ের ভালো লাগে না হয়তো। কানে ঢোকে নি কথা? ভাবী ডাকলে ডেকো নইলে ডেকো না।”
-” সেটা আমি আর আমার ভাই বুঝে নিবো তোমাকে ভাবতে হবে না।”
ত্যাড়া গলায় বলে আরিয়ান । রুবি’র মুখটা থমথমে। আসমা বেগম আরিয়ানকে চোখে শাসায়। অরুণ চেয়ার ছেড়ে উঠে বলে,
-” আমি আসি তাহলে!”
আসমা বেগম কপালে ভাঁজ ফেলে জিজ্ঞেস করে,
-” আসছো মানে? ফ্ল্যাটে তো কেউ নেই। এখানেই থাকো ক’টা দিন!”
-” না ছোট মা! অন্যদিন আজ সম্ভব নয়!”
আসমা বেগম আর জোর করেন না। তবে অরুণকে বসতে বলেন কিছু জরুরী কথা বলবে বলে।অরুণ আবার বসে পড়লো। আদুরি ভাইকে ফিসফিস করে বলে,
-” ভাবীর কাছে যাবে? তাহলে আমাকে সঙ্গে নিবে। ভাবীকে দেখি না কতদিন হলো”
-” না!”
অরুণের স্পষ্ট জবাব। আদুরি চুপসানো বেলুনের মতো মুখ বানিয়ে নেয়। ভাইটা তার একেবারে রসকষহীন! আসমা বেগম চা শেষ করে বলে,
-” আরিয়ানের সাথে কথা বলেছি আমি। তোমাকে ফোন করে আসতে বলতাম। তুমিই এলে ভালোই হয়েছে। আসল কথায় আসি। তোমাদের বোন বড় হচ্ছে। তাকে পাত্রস্থ করতে হবে। ছোট নেই এখন সে। রিসেন্ট একটা প্রস্তাব এসেছে। আসমানী আপার ভাসুরের ছেলে নাম কারিম মুয়ীদ! তোমরা দেখেছো। পেশায় ইঞ্জিনিয়ার। দেখতে শুনতে ভালো, ফ্যামিলি স্টেটাসও মেলে। তাঁরা আদুরিকে তো দেখেছেই। তাদের পছন্দ বেশ! আমি টুকটাক খোঁজ খবর নিয়েছি। আমারো পছন্দ হয়েছে। আরিয়ানের সাথে কথা বলেছি। এখন তোমাকে বলছি দেখো চলে কি না। চললে কথা আগাবো!”
অরুণ মনোযোগ দিয়ে শোনে সবটা! কারিম মুয়ীদ! দেখেছে সে দুই এক বার। লাজুক ভদ্র ছেলেই মনে হয়েছে! দেখতেও সুদর্শন। খোঁজ খবর নেয়া কোন ব্যাপারই না। এখনি একটা ফোন লাগালে আধা ঘন্টার মাঝেই ওদের পুরো চৌদ্দ গুষ্টির রিপোর্ট হাতে চলে আসবে। সে পাশে বসা বোনের দিকে চায়। আদুরীর আদুরে বদন খানি বিষাদের চাদরে মুড়ে আছে। অরুণ আসমা বেগমের দিকে তাকিয়ে বললো,
-” খোঁজ নেয়া যাবে! আসল বিষয় হলো আদুরির মতামত! সে কি চায়! তাঁর কোনো পছন্দ আছে কি না!আফটার ওল লাইফটা ওর! সারা জীবন ও পার করবে। এই প্রস্তাব আগাবে নাকি মানা করে দিবে সবটা তাঁর উপর ডিপেন্ড করে ছোটমা! ছোট ভুল সিদ্ধান্ত যেন গলার কাঁটা না হয়ে যায়।”
আসমা বেগম মেয়ের দিকে চায়! আদুরি মাথা নিচু করে নিয়েছে। আসমা বেগম অরুণকে বলে,
-” তুমিই জিজ্ঞেস করো? আমি করেছি বেশ কয়েকবার! মুখে কুলুপ এঁটে বসে থাকে!”
অরুণ জিজ্ঞেস করে আদুরিকে। আদুরি ভাইয়ের দিকে চায়। বিষাদের ছায়া দেখা যায় তাঁর ছোট কাজল কালো নয়ন জুড়ে। সে ভাইয়ের হাত ধরে বলে,
-” ভাই আমি এখনো প্রস্তুত নই। তাদের মানা করে দাও! আমাকে এই সেমিস্টার অবধি সময় দাও!”
অভিজ্ঞ অরুণ বোনের মনোভাব বোঝার চেষ্টা করে। বুঝতে পারলো কি না কে জানে তবে বোনকে আশ্বস্ত করে বলে,
-” টেক ইয়োর টাইম আদু! তুই যখন প্রস্তুত হবি তখন আমরা ভেবে দেখবো। ভয়ের কিছু নেই। আর পছন্দ বা জানা শোনা থাকলে আমার সাথে কথা বলবি! বুঝাতে পেরেছি?
আদুরির আতঙ্কে আচ্ছাদিত মুখশ্রীতে মিষ্টি রৌদ্রের আনাগোনা শুরু হয়। মুচকি হেসে ভাইয়ের বাহু শক্ত করে চেপে ধরে ধন্যবাদ জানায়। অরুণ মুচকি হেসে তাঁর মাথায় হাত বুলিয়ে উঠতে নিবে আসমা বেগম আবার থামিয়ে দিলো! অরুণ প্রশ্নাত্মক চোখে চাইলে তিনি জানান গুরুত্বপূর্ণ কথা বলবেন। অরুণ শান্ত হয়ে বসে। কি বলবে ছোট মা?
আসমা বেগম অতিশয় সিরিয়াস গলায় বললো,
-” অরুণ তুমি আমার কথায় কিছু মনে কোরো না। বাট আমার মনে হচ্ছে এখনি সময় বলার।হায়াত মউতের গ্যারান্টি নেই। তাই আগেই সব ঠিকঠাক করে নেওয়া ভালো!”
অরুণ আগামাথা কিছুই বুঝতে পারে না। কিসের কথা বলছে? আসমা বেগম সময় নিয়ে ব্যাপারটা ক্লিয়ার করে।
-” তোমার বাবা যখন সম্পদের উইল করেন তখন তুমি প্রাপ্ত বয়স্ক হলেও আরিয়ান আদু নাবালেক নাবালিকা ছিলো! তাই ওদের নামে করলেও সব তোমার আওতাধীন আছে। এখন আদু আরিয়ান দু’জনই যথেষ্ট প্রাপ্ত বয়স্ক তাই সব কিছু বুঝিয়ে নিলে ভালো হয়। তুমি প্লিজ ব্যাপারটা পজেটিভলি নিবে।আদু বড় হয়েছে ওর বিয়ে দিতে হবে। আমি চাই ওর প্রাপ্য অংশ ওকে বুঝিয়ে তবেই বিদায় করতে। আর উইল মোতাবেক তোমার, আরিয়ানের থার্টি থার্টি। আদু’র টুয়েন্টি আর আমার টুয়েন্টি! আমি আজ আছি কাল নেই। আমার টুয়েন্টি পার্সেন্ট আমি ভাগ করে দিতে চাই। টেন তোমার আর টেন পার্সেন্ট আদু ও আরিয়ানের! তুমি কি বলো?”
অরুণ মনোযোগ দিয়ে শোনে সম্পূর্ণটা। সে পজিটিভলি নেয়। সেও কথাটা পারতে চেয়েছিলো কিন্তু ওনারা কিভাবে নেবে তাই বলা হয় নি। অরুণ স্বাভাবিক ভাবেই বলে,
-” ছোট মা আমি সবসময় রেডি। তুমি দিন তারিখ ঠিক করো। আরিয়ান তুই উকিলের সাথে কথা বলে নিস! আর তুমি তোমার অংশ বন্টন করে দিতে চাও ভালো। তোমার ইচ্ছে! আরিয়ান আদু’কে দাও টেন টেন! আমার যতটুকু আছে যথেষ্ট ছোট মা। আমি নিতে পারবো না।”
আসমা বেগম অরুণের চোখে চোখ রেখে বলে,
-“কেন নিবে না? আমি সৎ মা বলে?”
অরুণ মুখটা কেমন তেতো হয়ে যায় নিমিত্তে। ক্ষীণ তিক্ততা ছেয়ে যায় হৃদয় কোণে। সৎ শব্দটা অরুণের বড্ড অপছন্দ। শুনতে খুবই বিশ্রী লাগে। মনে হয় কেউ চোখে চোখ রেখে তাকে ভর্ৎসনা করছে। কিছু হলেই সৎ আপনের প্রশ্ন। যেন আঙুল উঁচিয়ে দেখিয়ে দেওয়া হয় অরুণ সরকার সৎ। অরুণ মন ভেঙ্গে যায় এই ছোট্ট শব্দে! তার কিছুই বলতে ইচ্ছে করে না। তাই সে চুপ থাকে। আরিয়ান মুচকি হেসে বলে,
-” আমি জানতাম তুমি নেবে না! বলেছিলাম না মা? তুমি স্নেহ করলেও সে তোমার স্নেহতলে থাকতে চায় না কেন জোর করো তবে?”
অরুণ আরিয়ানের দিকে একবার তাকিয়ে অল্প হাসে। সে হাসি খুবই নিষ্প্রাণ! আসমা বেগম আরিয়ানের কথায় জবাব না দিয়ে অরুণকে বলে,
-” তুমি পুরনো ব্যাপারটা নিয়ে পড়ে আছো? আমি জানি না তোমার কান কতটুকু ভারী করা হয়েছে…!”
-” আমি কিছু মনে রাখি নি। আর তাছাড়াও আমি সহমত ব্যাপারটা নিয়ে। আব্বু সহানুভূতি দেখিয়ে আমাকে বেশি অংশ দিবে এটা অনুচিত। আমরা সবাই সমান অংশীদার! এখন এই কথা তুলবেন না প্লিজ। আর আমি কচি খোকা নই বা ছিলাম যে আমার কান ভারী করবে!”
তাঁর গাম্ভীর্যে ভরপুর কাটকাট কথায় কারো মুখে রা নেই। আরিয়ানও চুপ করে যায়। তবে সবার নিরাবতার মাঝে রুবি বলে ওঠে,
-” আচ্ছা এই টপিক বাদ রাখি আমরা সবাই! আব্বু সব মিমাংসা করে দিয়েই গেছে আমরা আর কথা না বাড়াই! আচ্ছা অফিসের ভাগ বন্টন কিভাবে কি করা হবে?”
অরুণ রুবির দিকে মাথা তুলে চায়। আরিয়ানের পাশে দাঁড়িয়ে সে। অরুণের অধর কোণে হাসি দেখা যায়। মানুষ কত দ্রুত পরিবর্তন হয়ে যায়। মানব মনে যদি হিংসার এক ছোট্ট ঝলক উদয় হয় সেটা লাভায় পরিণত হতেও সময় নেয় না। এতে সাহায্য করে কতিপয় মানুষ রুপি শয়তানের নাতিপুতি! তবে সে খুশি হয়। অবশেষে তাঁর সামনে একথা উঠলো। সব মিমাংসা করে নেওয়া যাক। সে কিছু বলার উদ্দ্যোগ নেয় এর আগে আরিয়ান খেকিয়ে ওঠে রুবির উপর! দাঁড়িয়ে চড়া গলায় বলে,
-” তোমাকে এর আগেও বলেছি আবার বলছি! অফিস সম্পূর্ণটা ভাইয়ের! আব্বু তাঁর নামে লিখে দিয়েছে। আর অফিসের ভরাডুবির সময়ও ভাই নিজ পুঁজি ও পরিশ্রমে ব্যবসা দাঁড় করিয়েছে। আর তোমাকে আমাদের পারিবারিক বিষয়ে নাক গলানোর কোনো দরকার নেই!”
অপমানে রুবির মুখ থমথমে। সে কিছু না বলে চলে যাওয়ার জন্য পা বাড়ায়! অরুণ উঠে রুবিকে আটকায়। আরিয়ানকে ধমক দিতে ভুলে না। বাচ্চারা খেলা বন্ধ রেখে এগিয়ে আসে। অরুণ তাদের খেলতে যেতে বলে ইশারায় মিনুকে বলে সরিয়ে নিয়ে যেতে! বাচ্চারা চলে গেলে অরুণ রুবিকে বসতে বলে।
-” রুবি তুমি বসো। আর আরিয়ান রুবি আমাদের পরিবারের একজন ! তাই কথা বার্তা সাবধানে বলবি।”
আরিয়ান মাথা নিচু করে বসে থাকে। এই রুবি’টা তো আগে এমন ছিলো না। এতোটা লোভী মনোভাব যে রুবি’র মা’য়ের কু মন্ত্রনার প্রভাব বুঝতে বাকি থাকেনা। সে যাই হোক রুবিও সমান দোষী। লজ্জায় তাঁর মাথা কাটা যায়! আসমা বেগম চুপচাপ। তিনি শান্ত চোখে সবটা পর্যবেক্ষণ করে। রুবি’কে সেই বলেছিলো অফিসে ব্যাপারটা তুলতে। সে রুবি’র দিকে আড়চোখে চায়। রুবিও তাঁর দিকে চেয়ে। ওনার জন্যই তো এভাবে সবার সামনে তাকে অপদস্থ হতে হলো! ওনার জন্যই তাঁর অফিসে পদার্পণ! রুবি দীর্ঘশ্বাস ফেলে মাথা নিচু করে রাখা আরিয়ানের দিকে চায়! আসমা বেগম নিজেকে ধাতস্থ করে অরুণকে বলে,
-” অরুণ? কথা যেহেতু উঠেছে ক্লিয়ার করে নেওয়াটা যুক্তিসঙ্গত নয় কি?”
অরুণ হাসে। দু হাতের তালু ঘষতে ঘষতে এগিয়ে যায় আসমা বেগমের দিকে। তাঁর পাশের চেয়ারে বসে শান্ত গলায় বলে,
-” অবশ্যই যুক্তিসঙ্গত! আমিও ক্লিয়ার করতে চাই! আমি অরুণ কারো এক আনা হকও মেরে খাবো না ছোট মা। আবার নিজের এক আনা ছেড়েও দেবো না।”
আসমা বেগম অরুণের চোখে চোখ রাখে। অরুণও চোখ সরায় না। চোখে চোখ রেখে বলে,
-” আব্বু সম্পূর্ণ অফিসটা আমার নামে দেয় নি। তিনি উইলে লিখেছেন যে তাঁদের ব্যবসা এগিয়ে নিয়ে যাবে সেই অফিসের মালিকানা পাবে। আমি আরিয়ানের সাথে এ বিষয়ে কথা বলেছি বলি নি আরিয়ান?”
আরিয়ান সম্মতি জানালো। আসমা বেগম ভ্রু কুঁচকে চায় আরিয়ানের দিকে। কই তার সাথে তো কোনো কথা হয় নি এ বিষয়ে? অরুণ রুবির দিকে তাকিয়ে আবার বলে,
-” আমি ছোটমা’কে ,আরিয়ানকে সম্পূর্ণটা অবগত করেই অফিসে পা রাখি। অফিস ভরাডুবি, ঋণে লালবাতি জ্বলে ছিলো। আমি সাহায্য চেয়েছিলাম ছোট মা’র কাছে! সে ভরসা করে নি। এমনকি ধার হিসেবেও চেয়েছিলাম। তবুও ভরসা পাই নি। ইগো ভুলে মামা’র কাছে হাত বাড়িয়ে ছিলাম। মামা রাজি হলেও মামী মুখের উপর মানা করে। সাথে সাথে ফিরে এসেছিলাম। সব আশার আলো নিভে যায়। আমি অফিস নিলামে তোলার জন্য সায় জানাবো তখনই রাসেল ফোন করে জানায় তাঁর কাছে কিছু আছে আরও বন্ধুরা মিলে ম্যানেজ করতে পারবে আমি যেন নিলামের জন্য সম্মতি না দেই। তাঁর পর কি! ওরাই সব ব্যবস্থা করলো। আমি পরিশ্রম করলাম। সফলও হলাম। দু এক বার পা পিছলে পড়লেও সামলে নিয়েছি! স্বস্তি ফিরলে আমি আরিয়ানকে বলেছিলাম অফিস জয়েন হতে। ও মানা করে। আমি এখনো বলি ওকে বিশ্বাস না হলে জিজ্ঞেস করতে পারো রুবি?”
রুবি মাথা নিচু করে নিয়েছে আগেই। আসমা বেগম মুখখানাও মলিন! আরিয়ান ভাইয়ের কথায় মাথা নেড়ে সায় জানালো। অরুণ মুচকি হেসে বলল,
-” আদু’র টেন, আরিয়ানের থার্টি পার্সেন্ট শেয়ার আছে! বাকি সিক্সটি ভোরের নামে! কারো কোনো অভিযোগ? থাকলে নির্দ্বিধায় বলতে পারো!”
পিন পিন নিরবতা। পাখির কল কাকলি ব্যাতিত আর কোনো শব্দ শোনা যায় না।
আরিয়ান নিরবতা ভেঙ্গে বলে,
-” ভাই আমি কোনো শেয়ার নেবো না…!”
অরুণ জানে আরিয়ান কি বলবে! তাঁর আপাদমস্তক চেনা অরুণের। সে তাকে থামিয়ে ধমক দিয়ে বলে,
-” এক থাপ্পড় দিবো! তুই চুপ থাক। তোকে বলি নি। ছোটমা তুমি বলো?”
আসমা বেগম স্বাভাবিক ভাবেই বলে,
-” আমার কি বলার আছে অরুণ? তোমার ভাই বোন! তুমি যা ভালো বোঝো। আমি এসবে নেই!”
বলেই তিনি উঠে চলে যায় বাড়ির ভেতরে। অরুণ তাঁর প্রস্থাণ দেখে। উনি কি নারাজ? থাকলেও তাঁর করার কিছুই নেই। তাঁরও ছেলে মেয়ের ভবিষ্যৎ আছে। স্বার্থপর দুনিয়ায় নিজের কথা না ভাবলেই নয়! আদুরি এতক্ষণ চুপ থাকলেও এবার উঠে অরুণের সামনে দাঁড়িয়ে বলে,
-” ভাই? আমি এসব ভাগ বন্টন বুঝি না। আমার কিছুই চাই না। আব্বু তো নেই তবে তার ছায়া রূপ আমার শুধু দুটো ভাই, ভাবী, আমার ভাতিজা ভাতিজি, মা চাই। তাদের সাথে মিলেমিশে থাকতে চাই। তাদের ভালোবাসা চাই। পাবো না?”
অরুণ মুচকি হাসলো। উঠে বোনকে বাহু বন্ধনে আবদ্ধ করে। আরিয়ানও বসে থাকে না। এসে যোগ দেয়। রুবি চেয়ে দেখে তাদের ভাই বোনের এই মেলাবন্ধন।
-” সন্ধ্যা হয়ে এলো। আমায় ফিরতে হবে আদু!”
-” থেকো যা না ভাই!”
আরিয়ান ভাইকে ছেঁড়ে বলে। আদুরিও সরে দাঁড়ালো। অরুণ মুচকি হাসে। যার অর্থ থাকবে না। আরিয়ান আর জোর করে না। ভাইয়ের না কে হ্যাঁ বানানো তাঁর সাধ্যের বাইরে। আদুরি দুয়েক বার অনুরোধ করেও কাজ হয় না। অরুণ বাচ্চাদের আদর করে বের হয়ে যায়।
মধ্যাহ্ন পেরিয়েছে সবে। পাতা লুবমানের সাথে মাতৃসদনে গিয়েছে চেকাপের জন্য। দুই তিন দিন হলো পাতা কেমন নরম হয়ে গেছে। তাঁর গুলুমুলু চেহারার একাংশও নেই। কেমন হাড্ডিসার হয়ে গেছে শুধু ফুলো পেটটা দেখা যায়। চোখের নিচে কালি জমে গেছে। চোয়াল যেন ঝুলে পড়েছে। চোখ দুটো কোটর থেকে মনে হয় বেরিয়ে আসবে। পিঠ ও কোমড় ব্যাথায় কাঁদে। মাঝে মাঝে সেই ব্যাথা পায়েও ছড়িয়ে পড়ে। অরুণ সরকারও সাত দিন হলো আসে না। ফোন করে অবশ্য লুব ও ভোরের থেকে খোঁজখবর নেয় প্রতিদিন। পাতাকে ফোন করে পাওয়া যায় তবে কথা বলে না পাতা। শুধু কানে ধরে রাখে। পাতার কথা বলতে ইচ্ছে করে না।
লুবমান ও লাবনী আক্তার নিয়ে গেছে পাতাকে। ভোর যাওয়ার জন্য বায়না করেছিলো তাকে বুঝিয়ে রেখে যাওয়া হয়েছে। বাড়িতে শুধু লতা, লাবিব ,রুম্পা ও ভোর। লতা ড্রয়িংরুমে বসে টিভি দেখছে। ভোর ও লাবিব চোর পুলিশ খেলছে। ভোর পুলিশ লাবিব চোর। পুলিশ বন্দুক হাতে চোরকে ধরার প্রচেষ্টায়! কিন্তু ধরতে পারে না। লাবিব হাসতে হাসতে ঘরের এ কোণা ও কোণা ঘুরছে ভোর তাঁর পিছু পিছু। ছুটতে ছুটতে তার ফর্সা গোল গাল মুখ লাল হয়ে গেছে। ছোট রুম্পা হাসতে হাসতে তাদের পিছু পিছু ঘুরছে আর ‘চুল ধলো, চুল ধলো’ বলে লাঠি নিয়ে দৌড়াচ্ছে ভোরের পিছু পিছু। ছুটতে ছুটতে তাঁরা বাড়ির বাইরে বেরিয়ে আসে। গোটা কয়েক ফুলগাছ লাগানো বাগানের আড়ালে লুকিয়ে পড়ে লাবিব। ভোর তাকে খুঁজে এদিকে ওদিকে। রুম্পা তাঁর পিছনে ভোর খেয়াল করে নি। বন্দুক তাক করে পিছনে ঘুরতেই কাঁদায় পড়ে যায় ঠাস করে। সাথে সাথে কেঁদে ওঠে গলা ফাটিয়ে। ভোর চোখ বড় বড় করে চায়। হাত ধরে টেনে তোলার চেষ্টা করে। রুম্পা ওঠে না শরীর ছেড়ে কাঁদতে থাকে! লাবিব বেরিয়ে আসে আড়াল থেকে। ততক্ষণে লতাও ছুটে আসে। মেয়েকে টেনে তুলে বলে,
-” কি হয়েছে? এ অবস্থা কেন ওর?”
লাবিব কাঁধ উঁচিয়ে বলে কি জানি! লতা ভোরের দিকে চায় তীক্ষ্ম দৃষ্টিতে। ভোর কাঁচুমাচু করে চায়। এভাবে তাকিয়ে আছে কেন আন্টি? লতা মেয়েকে সান্ত্বনা দিয়ে জিজ্ঞাসা করে। ছোট রুম্পা কাঁদতে কাঁদতে ভোরের দিকে আঙুল তুলে বলে ‘ফেলি দিছে’! লতা ভোরের দিকে চায়। ভোর মাথা নিচু করে বলে,
-” আন্টি আমি ইচ্ছে করে করি নি। ও পিছনে ছিলো। আমি ঘুরে দাঁড়াতেই ও পড়ে যায়। ব্যাথাও পায় নি। শুধু কাঁদা লেগেছে!”
লতা ছোট ছোট করে চায়।
-” ব্যাথা পায় নি? তাহলে এমনি এমনি কাঁদছে? আর তোমাকে চিনি আমি সেদিন পাতার কোলে ছিলো বলে কিভাবে লুকিয়ে চিমটি কেটে কাঁদালে মেয়েটাকে! সত্যিই করে বলো তো ভোর! ওকে ইচ্ছে করে ফেলো নি?”
ভোর মাথা তুলে চায়। সেদিন চিমটি দিলেও আজ সত্যিই সে ফেলে দেয় নি। সে মুখটা গম্ভীর বানিয়ে বলে,
-” স্যরি আন্টি। তবে আমি ইচ্ছে করে ফেলি নি!”
এমন ভাবে বলল যেন কোন বড় মানুষ বললো। লতার কপালে ভাঁজ ফেলে খানিক শক্ত গলায় বলে,
-” ভোর! লাবিব যাও বাড়ির ভেতরে যাও। কোনো খেলা না। ভদ্র ছেলের মতো বসে থাকবে। যাও?”
লাবিব মুখ কালো বানিয়ে দৌড়ে চলে যায়। ভোর বন্দুক ওখানেই রেখে হনহন করে চলে যায়। লতা নাক মুখ কুঁচকে নেয়। এটুকু ছেলের আবার ভাব! ওর থেকে লাবিব তিন চার বছরের বড়ই হবে এখনো বাচ্চামো স্বভাব যায় নি আর এ এখনি মুরুব্বিদের মতো আচরণ করে।
ভোর চুপচাপ পাতার রুমে যায়। বিছানা চুপটি করে বসে থাকে। লাল মুখটা হাসি বিহীন। লতা আন্টি আগে মিষ্টি ছিলো এখন কেমন যেন! সে কি ইচ্ছে করে ফেলে দিয়েছে ওই রুম্পাকে? ভোর জানালার ধারে বসে থাকে। তাঁর বাবার কথা মনে পড়ছে। আম্মু এলেই বলবে বাবাকে ফোন করতে। তাকে যেন নিয়ে যায়! সে বাবার কাছে থাকবে! ভোর মিসড আব্বু।
বেশ সময় পরে পাতা, লুবমান ও লাবনী আক্তার বাড়ি ফিরে। লতা কন্ডিশন জিজ্ঞেস করে লুবমান বলে সব ঠিকঠাকই আছে। আর ডেলিভারী মনে হয় এ সপ্তাহের মধ্যেই হয়ে যাবে। সাবধানে থাকতে বলেছে। হাঁটাচলা খাওয়া দাওয়া, ঘুমানো সবটা অতি সাবধানতার সাথে করতে হবে। পাতা আস্তে ধীরে হেঁটে ড্রয়িংরুমে বসে। লতা পানি এনে দেয়। পাতা একটু খেয়ে বলে,
-” ভোর কোথায়? ঘুমিয়েছে? দুপুরে খেয়েছে কিছু? নাকি গাল ফুলিয়ে বসে আছে?”
বলেই হাঁপাতে থাকে। আজকাল অল্পতেই হাঁপিয়ে ওঠে। দমবন্ধ হয়ে যায়। লতা ত্যাড়া গলায় বলে,
-” নবাব ঘরে আছেন। ঘুমিয়ে আছে কি না বলতে পারবো না। আর খায় নি। ডাকলাম এতো করে এলোই না। বলে পড়ে খাবে!”
পাতা চিন্তিত বদনে উঠে দাঁড়ালো। বাচ্চাটা নিশ্চয়ই মন খারাপ করে আছে সাথে না নেওয়ার জন্য। পাতা সাবধানে হেঁটে নিজের ঘরে যায়। লতা বোনের যাওয়ার দিকে তাকিয়ে থাকে।
পাতা ঘরে গিয়ে দেখে ভোর জানালার দিকে উদাসীন হয়ে তাকিয়ে আছে। সে যে ভেতরে এসেছে খেয়ালই নেই। পাতা শাল খুলে রাখে। বড় হিজাব খুলে ভোরকে ডেকে বলে,
-” আব্বাজানের মন খারাপ কেন? রেগে আছো আম্মুর উপর?”
ভোরের উদাস মুখে চঞ্চলতা ফিরে আসে পাতাকে দেখে। সে একপ্রকার লাফিয়ে এসে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করে বলে,
-” আম্মু? ডাক্তার কি বললো? বাবু কবে আসবে?”
পাতাও উচ্ছ্বসিত হয়ে ফিসফিসিয়ে বললো,
-” খুব শিঘ্রই আসছে! এক্সাইটেড হুম?”
ভোর মিষ্টি হেসে উপর নিচ মাথা নাড়লো। পাতা তার গাল টেনে কপালে চুমু দিয়ে আদুরে গলায় সুধায়,
-” খাওনি কেন সোনা? কত বেলা হয়েছে! আরেকটু পরে তো রাত হবে।”
-” তোমার হাতে খাবো তাই খাই নি!”
কিউট ভঙ্গিতে বলে ভোর। পাতা ছোট ছোট চোখে চায়। ভোর হেসে তার কপালে চুমু দিয়ে খিলখিল করে হেসে ওঠে। পাতাও হেসে দেয়।ফ্রেশ হয়ে খাবার নিয়ে আসে বড় প্লেটে। ভোর ভদ্র বাচ্চার ন্যায় বাবু হয়ে বিছানায় বসে। পাতাও উঠে বসে। গরম ভাতের সাথে ডাল, আলু ভাজি , ভর্তা, ছোট মাছের চচ্চরি, আর ডিম পোস! পাতা ভাত মেখে বড় করে লোকমা বানিয়ে ভোরের মুখে দিতে থাকে। ভোর গপাগপ মুখে পুরে। পেটের খিদে যে আকাশ চুম্বি পাতার বুঝতে অসুবিধে হয় না। লতা এসে পানি দিয়ে যায়। পাতা ভোরকে পানি খাওয়ায়। ভোর বলে,
-” ও আম্মু তুমিও খাও না? অনেক ইয়াম্মি হয়েছে!”
-” তাই? আচ্ছা খাচ্ছি তুমিও খাও!”
পাতা বলে নিজেও ভোরের সাথে দুই তিন লোকমা খায়। হঠাৎ পাতার স্বাভাবিক মুখটা রক্তশূন্য হয়ে যায়। ব্যথায় মুখটা নীল হয়ে গেলো যেনো! প্লেট বিছানায় রেখে পাতা পেট চেপে ধরে। ভোর ভয় পায়! পাতার বাড়ন্ত পেটে হাত বুলিয়ে ভগ্ন কন্ঠে জিজ্ঞেস করে,
-” আম্মু ব্যাথা করছে? পঁচা বোন আবার কিক করছে, তাই না?”
পাতা চোখ মুখ খিঁচে মাথা নাড়ে। ভোরের হাতটা পেটের এক সাইডে রেখে বলে,
-” দেখো তোমার বোন নড়ছে! এতো দুষ্টু সে! আম্মুর যে কষ্ট হয় সে বুঝতেই পারে না।”
ভোর দুঃখি চোখে চায়। আম্মুর কষ্ট হচ্ছে অনেক? হচ্ছেই তো! ওই যে কাঁদছে! ভোর বিছানা থেকে নেমে টেবিলের উপর থেকে পাতা’র নতুন ফোনটা নিয়ে বাবার নম্বরে কল করে। রিসিভ হওয়ার সাথে সাথেই ভোর নাক টেনে বলে,
-” আব্বু তোমার বাবু খুব দুষ্টু! আম্মুকে কষ্ট দেয়! ভোর কিন্তু দুষ্টু বোনকে ভালোবাসবে না। কোলেও নেবে না!”
ঠেকে ঠেকে কাঁপা গলায় বলে ভোর! পাতার ব্যাথার মাঝেও হাসে। বোনের নামে অভিযোগ দেওয়া দেওয়া হচ্ছে! পাতা ভোরকে ইশারায় ডাকে। ভোর এগিয়ে আসে ফোন কানে রেখেই। ওপাশ থেকে অরুণ অল্প হেঁসে বললো,
-” কি দুষ্টুমি করলো আমার বাবু?”
-” আম্মু টাম্মিতে কিক করে! আম্মুর ব্যাথা লাগে না বুঝি? কাঁদছে তো!”
পাতা ভোরকে পানি খাইয়ে ওড়নায় মুখ মুছে দেয়। ফোন লাউডে থাকায় অরুণের গমগমে আওয়াজ ভেসে আসে,
-” তোমার আম্মু দুষ্টুমি করে তাই বাবু তাকে পানিশড করে!”
ভোর তীব্র বিরোধিতা করে বলে,
-” আম্মু একটুও দুষ্টুমি করে না। সে গুড গার্ল!”
-” তোমার আম্মু আমার একটা কথাও শোনে না!”
পাতার ব্যাথা ধীরে ধীরে কমে গেছে। এমনিই হয়। হুট করে ব্যাথা শুরু হবে মিনিট দশেক থেকে ব্যাথা আপনে আপ চলে যাবে। অরুণের কথা শুনে পাতার ইচ্ছে করে ফোনের ভেতর দিয়ে হাত ঢুকিয়ে লোকটার গলা টিপে দিতে! নাক উঁচু ম্যানারলেস লোক!
-” ও আব্বু তুমি আসো না? তুমি এসে তোমার বাবুকে বকে দাও”
-” আমি গিয়ে কি করবো? তোমার আম্মু তো চেনেই না আমাকে! কথা বলা তো দূর ফিরেই তাকায় না!”
ভোর আড়চোখে আম্মুর দিকে চায়। ছোট ভোরও খেয়াল করেছে আম্মু আব্বুর সাথে কথা বলে না। আব্বু এলে দূরে থাকে। আম্মু কি আব্বুর উপর রেগে আছে? সে পাতার দিকে দৃষ্টি স্থির রেখে বলে,
-” তুমি আসো আব্বু! তুমি এলে আম্মু’র কষ্ট হবেনা! আম্মু কাঁদবে না। কাল অনেক কেঁদেছিলো। আজ লুব মামা, নানু হাসপাতালেও নিয়ে গিয়েছিলো!”
পাতা চোখ বড় বড় করে ঘনঘন না বোধক মাথা নেড়ে মানা করে বাবাকে না বলতে ! ভোর তবুও গড়গড় করে বলে দেয় সব! ওপাশে পিনপতন নিরবতা বিরাজ করে। কিছু সময় পর টুট টুট করে ফোনের সংযোগ লাইন কেটে যায়। পাতা ছোট ছোট চোখে ভোরের দিকে চায়! ভোর ফোন রেখে দৌড়ে চলে যায়! যাওয়ার সময় চিল্লিয়ে ‘স্যরি আম্মু’ বলতে ভুলে না।
ভোর ঘর থেকে বেরিয়ে ড্রয়িং রুমে সোফায় বসলো। রিমোট খুঁজে টিভি অন করে কার্টুন দেখে। একটু পর গুটি গুটি পায়ে একটি মেয়ে দু হাতের আড়ালে মুখ লুকিয়ে এগিয়ে আসে। পিচ্চি হাতের আঙ্গুলের আড়ালে মাঝে মাঝে উঁকি দিয়ে ‘তুকি তুকি’ বলে ভোরের সামনে ঘুরঘুর করে। ভোর সেদিকে ভুলেও ফিরে তাকায় না। রুম্পা অনেকসময় ধরে তু’কি তুকি’ বলে, ভোর শোনে না বিধায় চলে যায়। মেইন দরজার একপাশে রাখা জুতোর র্যাক থেকে একটা স্যান্ডেল এনে ভোরকে মারতে থাকে! ভোর রেগে চায়। জুতোটা রুম্পার হাত থেকে ছিনিয়ে তাঁর দিকে তাক করে চোখ রাঙিয়ে বলে,
-” দুষ্টু মেয়ে! একটা মারবো!”
রুম্পা ঠোঁট উল্টিয়ে কেঁদে দেয়। যেন সত্যিই ভোর মেরেছে! ভোর খানিক ঘাবড়ে আশেপাশে চায়! কেউ নেই তবে সামনে চাইতেই লতাকে দেখে ভোর উঠে দাঁড়ালো! রুম্পাও পেছনে চায়। মা’কে দেখে দৌড়ে গিয়ে নালিশ জানায় ‘ভোল মাববো’! ভোর চোখ বড় করে রুম্পার দিকে চায়। কি বিচ্ছু! তাকেই মারলো আবার নালিশ করে যে, ভোল মাববো! পঁচা মেয়ে! লতা মেয়েকে কোলে নিয়ে ভোরের দিকে তীক্ষ্ম দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলে,
-” মারছো কেন ওকে?”
ভোর ভ্রু কুঁচকে বলে,
-” আমি মারি নি ওকে। ওই মারছিলো আমাকে এই জুতা দিয়ে!”
-” কিন্তু জুতো তো তোমার হাতে?”
ভোর বা হাতে থাকা জুতোর দিকে চায়! সাথে সাথেই ফেলে দেয়। ইয়ু! কি নোংরা! সে নাক মুখ কুঁচকে বলে,
-” আমি ওর থেকে কেড়ে নিয়েছি!”
লতা ভোরের আপাদমস্তক দেখে নিয়ে আঙুল উঁচিয়ে বলে,
-“তোমার হাবভাব ভালো না! সেদিনের পাতার কথা মাথায় গেঁথে নিয়েছো নাকি? আমি কিন্তু তোমার মতো বিচ্ছু ছেলেকে মেয়ের জামাই কক্ষনো বানাবো না। এই তুমি আমার মেয়ের থেকে দূরে থাকবে বলে দিলাম!”
শেষের কথাটা একটু জোড়েই বলে। ভোর লজ্জা পায় সাথে রাগও হয়! ওই পঁচা দুষ্টু মেয়েকে বিয়ে করতে ভোরের বয়েই গেছে। ভোর রুম্পার দিকে চায়। নাক দিয়ে সর্দি পড়ছে সেই সর্দি মুখে যাচ্ছে! ইয়ু! নোংরা মেয়ে। সে মুখ ফিরিয়ে দরজার দিকেই চাইতেই চোখ মুখ উজ্জ্বল হয়! আব্বু? এতো জলদি? ভোর বিস্ময়ে দৌড়ে যেতেও ভূলে যায়! অরুণ থমথমে মুখে ভেতরে প্রবেশ করে। লতা ও ভোরের কিছু কিছু কথা কানে এসেছে তাঁর! কি করেছে ভোর? এভাবে বকছে কেন? তাঁর ছেলেকে কেউ বকুক তাঁর পছন্দ নয়। সেটা যেই হোক! সে এগিয়ে এসে ভোরকে কোলে তুলে নিয়ে চুমু দেয় কপালে। ভোর হেসে বাবার গলা জড়িয়ে ধরে। রুম্পা লতার কোল থেকে হাত বাড়িয়ে ‘আনকেল আনকেল’ ডাকে। লতা মেয়ের নাক মুখ মুছে নামিয়ে দেয়।
-” আসসালামুয়ালাইকুম! কেমন আছেন আপু?”
লতা ড্যাবড্যাব করে চায় অরুণের দিকে। সে কি ঠিক শুনলো? অরুণ ভোরকে নিয়ে চলে যেতে যেতে বলে,
-” সালাম দিলে, ভালোমন্দ জিজ্ঞেস করলে তাঁর উত্তর দিতে হয়। এটুকু ম্যানার্স শেখায় নি আপনার ছোট বোন পাতা?”
ছোট রুম্পা দৌড়ে অরুণের হাত ধরে হাসতে হাসতে চলে যায়। লতা আহাম্মকের ন্যায় দাঁড়িয়ে! ভূতের মুখে রাম নাম?
অরুণ রুম্পাকে সহ পাতার রুমে প্রবেশ করে। সে পথেই ছিলো। সরকার বাড়ি থেকে সরাসরি এই বাড়ির উদ্দেশ্যেই রওনা দেয়। তাঁর মনটা বিক্ষিপ্ত ছিলো। প্রশান্তির হাওয়া দরকার! আর তাছাড়াও প্রাণভোমরা গুলো থেকে দূরে থাকতে তাঁরও ভালো লাগে না। এই সবটার জন্য পাতাবাহার দায়ী। মেয়েটা তাকে নাকে দড়ি দিয়ে ঘুরাচ্ছে! ভাবা যায় অরুণ সরকারকে নাকানিচুবানি খাইয়ে আধমরা বানিয়েছে! অরুণ সরকার প্রতিটা মুহুর্ত তরপায় যেমনটা কাঁচা ঘায়ে লঙ্কা গুঁড়ো ছিটালে মানুষ তরপায়! তফাৎটা এই, তাঁরা গলা ফাটিয়ে কাঁদতে পারে আর অরুণ সরকার পারে না। তবে সেও ছটফট করে। শীতকালীন এই দীর্ঘ রজনী একা একা কাটাতে হয়। কখনো ঘুমে তো কখনো নির্ঘুমে! স্বপ্ন রাজ্যে চড়ুইয়ের খুনসুটিতে মেতে থেকে সুবাহে সাদিকে পুরো বাড়ি খুঁজেও পাওয়া যায় না চড়ুই; তখন অরুণ সরকার ভেতর থেকে মূর্ছা যায়। রাতের অন্ধকারে যখন একাকিত্ব কুড়ে কুড়ে খায় তখন ভাবে হোক সকাল! চক্ষু লজ্জা গুল্লি মেরে শশুর বাড়ি চলে যাবে। কিন্তু দিনের আলোয় পারে না অরুণ সরকার। কবে যে সব স্বাভাবিক হবে। তাঁর মেয়েটা আসুক! মেয়েই সব ঠিক করে দেবে। তাতেও ঠিক না হলে! কষিয়ে এক থাপ্পড় দিয়ে কাঁধে তুলে নিয়ে যাবে। অরুণ রুমে প্রবেশ করে একটু অবাক হয়। গোধূলি লগ্ন, দূর হতে মাগরিবের আজানের ধ্বনি ভেসে আসে। আর এই অবেলায় মেয়েটা কাঁথা মুড়ি দিয়ে শুয়ে আছে! শরীর ঠিক আছে তো? কাঁদছে কি? অরুণ রুম্পার হাত ছেড়ে ভোরকে নামিয়ে দিলো! বিছানায় বসে পাতার গা থেকে কম্বল সরিয়ে ডাকে,
-” এই পাতাবাহার? কি হয়েছে? অবেলায় শুয়ে আছো কেন? শরীর খারাপ লাগছে? দেখি এদিকে ফেরো?”
অরুণের উদ্বেগতা ভরাট কন্ঠস্বর কর্নগোচর হতেই পাতা চমকপ্রদ হয়ে এদিকে ফেরে। ক্লান্ত লাগছিলো কেমন যেন। চোখে ঘুম ঠেলে দিচ্ছিলো যেন। তাই গা এলিয়ে দিয়েছিলো! আচ্ছা সে কতক্ষন ঘুমিয়ে ছিলো? লোকটা এসেও গেলো! পাতা হা করে চেয়ে থাকে! অরুণ পাতাকে তুলে বসিয়ে দিলো। পাতার আপাদমস্তক দেখতে হয় না। শুকনো ফ্যাকাশে মুখটা দেখে অরুণ শান্ত হয়ে যায়! কি হাল করেছে নিজের! উসকোখুসকো চুল। চকচক করা চোখ জোড়ায় মলিনতা! ত্বকটা কেমন খসখসে!গলার নিচের ক্ল্যাভিকল দেখা যায়! অরুণ তাঁর থুতনি ধরে বলে,
-” মহারানীর সারা অঙ্গে এতো অযত্নের ছাপ! এতো মানুষের ভিড়ে? আয়নায় দেখেছো নিজেকে? এতো আমার পাতাবাহার নয়!”
পাতা মুখে বিরক্তের রেশ ফুটে তোলে। থুতনিতে রাখা অরুণের হাতটা ঝটকায় সরিয়ে দেয়। সাত দিন হয়ে গেলো নাক উঁচু লোকের খবর নেই এখন এসেছে সারা অঙ্গে অযত্নের ছাপ খুঁজতে! অরুণের রাগ হয়। সে বিছানা থেকে উঠে গমগমে গলায় আদেশ বানি শোনায়,
-” উই আর রিটার্নিং হোম আর্লি টুমোরো মর্নিং। আই উইল নট লিসেন টু অ্যানিওন । ইফ নেসেসারি আই উইল ইউস ফোর্স!”
পাতা ঠোঁট উল্টিয়ে ভেংগে বলে,
-‘ আই উইল ইউস ফোলস! ভোর তাকে বলে দাও কোথাও যাচ্ছি না! আমাকে জোর করলে আমি আমি… কি করবো নিজেও জানি না!”
-” সে দেখা যাবে। গুলুমুলু বউ যত্নের অভাবে হাড্ডিসার হয়ে গেছে! হাসপাতালের চক্কর পর্যন্ত লাগিয়েছে আমাকে জানানোর প্রয়োজন বোধ করে নি! আর আমি অরুণ সরকার চুপ করে বসে থাকবো?”
ভোরকে সুধায় অরুণ! ভোর পিটপিট করে চায়। আব্বু আম্মু তাকে জিজ্ঞেস করছে কেন? সে কার পক্ষে কথা বলবে এবার? রুম্পা আগেই কেটে পড়েছে অরুণের গম্ভীর গলার আওয়াজ শুনে! তাদের কথোপকথনের মাঝেই লতা আসে ধুপধাপ পা ফেলে। পাতার সব রিপোর্ট বিছানায় রেখে বলে,
-” আপনার অতি আদরের গুলুমুলু বউটা যত্নের অভাবে হাড্ডিসার হয়ে যায় নি। তাঁর ডেলিভারীর সময় ঘনিয়ে এসেছে। যেকোনো সময় তার আগমন হতে পারে। তাই উইক হয়ে পড়ছে; ইটস্ নরমাল। বাচ্চা, বাচ্চার মা দুজনেই সুস্থ আছে আল্লাহর রহমতে। তবে সাবধানে থাকতে হবে।”
পাতা বাহার পর্ব ৫৬
অরুণ বিশ্বাস করে না তাঁর কথা। সে রিপোর্ট হাতে নিয়ে বোঝার চেষ্টা করে। পুরোটা না বুঝলেও টুকটাক পড়ে কিছুটা শান্ত হয়। তবে সে আর রাখবে না। যতই পাতা জেদ করুক। কালকেই চলে যাবে। লতা পাতাকে উঠতে বলে নামাজের জন্য। অরুণ তাকে ধরে নিয়ে ওয়াশ রুমে যায়। পাতাকে অযু করিয়ে দিয়ে নিজেও অযু করে নেয়।