প্রেমসুধা পর্ব ৫৬

প্রেমসুধা পর্ব ৫৬
সাইয়্যারা খান

অস্ট্রেলিয়ার আবহাওয়া শীতল সাথে বইছে হাওয়া। সেই হাওয়া বড়ই ঠান্ডা। গায়ে কাঁটা দেয়ার মতো ঠান্ডা। সূর্য এখানে সচরাচর দেখা দেয় না। সিডনি শহরটা তখন সূর্যের অনুপস্থিতিতে বড়ই ফ্যাকাসে অথচ তার রুপ বড়ই চমৎকার। মানুষ জন সকাল হতেই বাইরে বিচরণ করছে। সূর্য কৃপণতা দেখিয়ে ঠমক ধরেই আড়ালে রইলো।
আলসতা দেখিয়ে উঠে বসে পৌষ। গায়ে ব্যথা নিয়ে আড়মোড়া ভাঙে ও। যদিও তার সয়ে সয়ে গিয়েছে এখন তবুও মাঝেমধ্যেই মাথা চারা দিয়ে উঠে। চোখ ডলতে ডলতে ওর খেয়াল হলো এটা কিছু মাস পূর্ব পৌষ যেই জামাই বাড়ী পেয়েছে সেটা না। এটা অপরিচিত এটা জায়গা। টনক নড়লো ওর। এক ধ্যানে কিছুক্ষণ রুমটার সিলিং দেখে পৌষ। হঠাৎ ই মনটা প্রচন্ড খারাপ হয়। হাঁটু ভাজ করে মাথা ঠেকায় পৌষ। এই সব কিছুই তার নিকট স্বপ্ন। অল্পসল্প পেটে ব্যথা হতেই পৌষ পেট চেপে ধরে। মুখে ব্যাথাকাতুর শব্দ উচ্চারণ করে পুণরায় বালিশে মাথা রাখে। শ্বাস-প্রশ্বাস আচমকাই বেগতিক হয়। পৌষ আশেপাশে তৌসিফ’কে খুঁজে। না নেই সে। একবার অল্প স্বরে ডাকও দিলো,
— আপনি এখানে আছেন? শুনছেন…

উত্তর আসে না মানে তৌসিফ এখানে নেই। পৌষ চোখ বুজে নিলো। কার্ণিশ উপচে কয়েক ফোঁটা মুক্তোর দানা ঝড়লো তখন। তৌসিফ থাকলে নিশ্চিত এখানে কান্ড ঘটিয়ে ফেলতো। বউ নিয়ে বড়ই চিন্তিত থাকে।
সময় গড়ালো মিনিট পাঁচ সাথে কুড়ি সেকেন্ড। সফেদ দেয়ালে সোনালী রঙের ঘড়িটায় তখন টুং করে শব্দ হয়। সচকিত দৃষ্টি ফেলে সেদিকে দৃষ্টিপাত করে পৌষ। পুণরায় উঠে বসে। আস্তেধীরে হেটে যায় বাথরুমের দিকে। এদিকে একটা বিষয় অবশ্য নিন্দনীয় লাগে পৌষ’র কাছে। সাওয়ার নেয়ার জায়গাটাতে স্বচ্ছ কাচ। ভেতর বাহির সবটা দেখা যায়। এমন কুরুচিপূর্ণ ডেকোর ওর ভালো লাগে না। এদিকে তৌসিফ স্পেশাল ভাবে এই হানিমুন সুইট বুক করেছে। এসেছে থেকে একের পর এক চমক। বাথরুমের বাথ টাবে গোলাপের পাপড়ি দিয়ে সবটা সাজানো ছিলো সাথে ছিলো অজস্র ছোট ছোট রং-বেরঙের মোমবাতি। কিছু আলোকসজ্জা আবার রুমে জুড়ে চারপাশে।
পৌষ অনেক চেঁচামেচি করে পর্দা লাগিয়েছে। তৌসিফ অবশ্য এতে নারাজ ছিলো।
কাঁচের দরজায় ঠকঠক শব্দ হতেই পৌষ সাড়া দেয়,

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

— আছি আমি।
— কি করছো?
— ব্রাশ করছি।
— খুলো তাহলে।
— অপেক্ষা করুন।
ব্রাশ হাতে থাইটা খুলে পৌষ। তৌসিফ ঘর্মাক্ত শরীরে বড়ই উদ্বীগ্ন হয়ে চায়। চিন্তার ছাপ কণ্ঠে ফেলে শুধায়,
— ঠিক আছো? আমি বাইরে একটু জিমে গিয়েছিলাম। ভাবলাম তুমি ঘুমাচ্ছো।
পৌষ কুলি করতে করতে বলে,
— এখানেও জিম করা লাগে? আলগা ঢং।
বাঁকা চোখে তাকিয়ে বলতেই তৌসিফ ওর দিকে এগিয়ে আসে। বেসিনের সামনে এসে গরম পানির ট্যাব চালু করে মুখে পানির ঝাপটা দিয়ে বলে,

— হোটেলেই ছিলো তো।
–ফ্রী?
— হ্যাঁ।
পৌষ ফটাফট বলে উঠলো,
— হায় হায়, আগে বলবেন না? রোজ দুই বেলা করে যাবেন৷ মাগনা নাকি? অ্যাই শুনুন আমিও যাব।
তৌসিফ বক্র হাসে। মুখে ক্লিনজার লাগাতে লাগাতে বলে,
— আমাকেই সামাল দিতে ত্যাড়া ব্যাকা হয়ে যাও সেখানে যাবে নাকি জিম?
সরাসরি ঠেস। পৌষ’র রাগ হলো। দাঁত চেপে বললো,
— আপনি একটা বুইড়া খাটাস।
তৌসিফ কপালে মৃদু ভাজ ফেলে ডান হাত দিয়ে পৌষ’র চোয়ালে চাপ দেয়। ফলাফল সরুপ চেপে রাখা দাঁতের পাটি আলগা হয়। তৌসিফ ছেড়ে দেয়ার আগে তাতে আলতো চুমু দিয়ে বলে,

— দাঁত চাপতে নেই।
— কথা বলবেন না?
— আপাতত বলছি না। জলদি গিয়ে গায়ে ভারী কিছু দাও৷
— পারব না।
— হানি, ইটস ঠু কোল্ড।
— হোক।
— কথা শুনবে না?
— আমাকে যে ছোট করে কথা বলে তার কথা আমি শুনব না। খারাপ লোক।
বিরবির করে বলতে বলতে পৌষ চলে গেল। তৌসিফ অবশ্য শুনলো তবে ঘাটলো না। ছোট্ট ব্যাপারটা যে পৌষ’র মাইন্ডে লাগবে তা বুঝতে পারে নি তৌসিফ।
রুমে এসে দেখা গেলো পৌষ বিছানা গোছাচ্ছে। তৌসিফ পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে কাঁধে থুতনি ঠেকাতেই পৌষ’র নাক টানার শব্দ এলো। তৌসিফ পুরোপুরি ভাবে থতমত খেলো। কথাটা কি খুবই বলেছে সে? তেমন কিছু মিন করে তো বলে নি তাহলে পৌষ কেন এতটা কষ্ট পেলো। ব্যস্ত হাতে ওকে নিজের দিকে ঘুরিয়ে তৌসিফ গালে হাত রাখে। অধিকার বোধ নিয়ে বলে,

— তাকাও।
পৌষ’র নজর ফ্লোরে। কাঠের ফিনিশিং দেয়া তাতে। পৌষ ভাবছে কতই না দামী হবে এই কাঠ নাহলে কেন গুনে খাচ্ছে না। হঠাৎ ই আবার মনে হয় ছোট্ট বেলায় একবার দশটা দশ টাকা দামের মুরগীর বাচ্চা কিনেছিলো পৌষ। চাচাকে অনেক বলে কয়ে কিনতে হলো। তো একদিন ওদের খাবার শেষ হয়ে গেলো। চাচা বাড়ীতে নেই। চাচির কাছে চাইতেই চাচি বললো চাল দিতে। পৌষ তাই দিলো। আফসোস অত ছোট বাচ্চা চাল খেতে পারে না। পৌষ তখন ঝাড়ু দিয়ে কয়টা মাছি মে’রে খাওয়ালো। হেমন্ত তখন স্কুল থেকে ফিরেছে। পৌষ দৌড়ে যেয়ে বলতেই হেমন্ত দেখে তার পকেট শূন্য। বন্ধুদের সাথে লুকিয়ে বেনসন সিগারেট খেয়ে উল্টো দোকানে দুই টাকা পরে দিবে বলে একটা সেন্টার ফ্রুট চিবুতে চিবুতে বাড়ী ফিরলো।
পৌষ আবার তার খুবই আদরের। হেমন্তের কাঁধের ব্যাগটা পৌষ’কে দিয়ে বললো,

— ভেতরে রেখে আয়।
এক দৌড়ে পৌষ তাই করে। হেমন্ত তখন পঁচা একটা কাঠের টুকরো বের করে। গ্যাসের ভয়ংকর সমস্যা। বড় চাচি প্রায়ই লাকড়ি সংগ্রহ রাখেন। হেমন্ত কাঠটা টুকরো করা মাত্রই ছোট ছোট কাঠের রঙের পোকা বেরিয়ে আসে। মুরগীর বাচ্চাগুলো ঠুকরে ঠুকরে খায়। পৌষ উচ্ছাসিত হয়ে আগামী দুই দিন তার মুরগীর বাচ্চাদের ঐ পোঁকা খাওয়ালো সাথে যতটুকু পারা যায় মাছি।
তৌসিফ বেখেয়াল পৌষ’কে দেখে নিজেই মুখটা তুলে। বলে,
— কি ভাবছো?
— মুরগীর বাচ্চা।
— মুরগীর বাচ্চা? চিকেন খাবে আমার তোতাপাখি?
— ধুরু মিয়া। আপনার আলগা পিরিত রাখুন। আচ্ছা, বলুন কখনো মুরগী পেলেছেন? দশ টাকা দামের? ঐ যে বাসায় এসে বিক্রি করতো।
তৌসিফ জানপ্রাণ অবাক হয়। ও কি না মুরগীর বাচ্চা পালবে? তাও আবার দশ টাকা! আশ্চর্য! যদিও এত মাসে তৌসিফ বউয়ের পা’গলামিতে অভ্যস্ত। মুখটায় পানির ঝাপ্টা দিয়ে মুছতে মুছতে বললো,

— কুকুর পেলেছিলাম।
— কুত্তা পালা ভালো না জানেন না?
— উপফ পৌষরাত। কুকুর বলা যায় না?
— না ফিলিং পাই না। কুত্তা বললে মনে শান্তি লাগে। এখন ধরুন কাউকে আমি গালি দিব তখন যদি বলি, “এই শোনো তুমি একটা কুকুর” তখন কি মনের ভাব প্রকাশ হতো? একটুও হতো না। কিন্তু যদি বলি “শা’লা তুই একটা কুত্তা” তাহলে মনের খায়েশ মিটে যাবে।
তৌসিফে’র মাথা ঘুরতে চায় কিন্তু তৌসিফ সামলে নেয় নিজেকে। পৌষ’কে পাজা তুলে হঠাৎ। পৌষ গলা জড়িয়ে ধরে আহ্লাদ করে। কাঁধে মাথা রেখে বলে,

— এভাবে বাইরে যাবেন?
— আমার তো সমস্যা নেই।
— তাহলে চলুন।
— এই ড্রেসেই যাবে?
পৌষ একটু ফেঁসে গেলো৷ মুখটা গোমড়া হয়ে গেলো সহসা। বললো,
— না নেয়ার ধান্দা। নামান আমাকে।
— একটা ট্যুর তো দেয়াই যায়।
দরজা খুলে বিশাল বড় করিডোরে চলে এলো তৌসিফ। পৌষ অবাক হয়ে চোখ দুটো বড় বড় করে নিলো। চাপা স্বরে বললো,

— কই যান?
— জানি না তো।
— আজব কি করছেন? আমি তো ফাইজলামি করছিলাম…..
“গুড মনিং স্যার”
আচমকা শক্ত হাতে তৌসিফে’র পিঠ আঁকড়ে ধরে কাঁধে মুখ গুজে পৌষ। সাদা ধবধবে বিড়ালের মতো লোকটা’কে তার ম্যানেজার মনে হলো। লজ্জায় মরি মরি পৌষ। তৌসিফ মুচকি হাসলো। পৌষ আকুতি করে উঠলো,
— প্লিজ ফিরে চলুন। আর দুষ্টামি করব না।
— দুষ্টামি না করলে যাব না।
— আচ্ছা, দুষ্টামি করব।
— এখন করো।
— ভাই, দয়া করে ফিরে চলুন। আমার সত্যিই লজ্জা লাগছে।
তৌসিফে’র কাঁধেই মুখটা গুজে রইলো। আচমকা কাঁধে দাঁত বসতেই তৌসিফ হেসে ফেললো। ফিচেল স্বরে বললো,
— এই দুষ্টামি আমিই করতে পারি।

হিজাবের উপর দিয়ে পৌষ’কে টুপি পরালো তৌসিফ। পৌষ খুলতে চাইলো৷ বললো,
— কান ঢাকা তো।
— বাইরে অনেক ঠান্ডা হানি।
পৌষ’কে লং জ্যাকেট পরিয়ে পরিপাটি হয়ে নিজেকে গুছালো তৌসিফ। গালে হাত দিয়ে তা দেখে পৌষ। পা ঝুলাতে ঝুলাতে গুনগুনিয়ে গান গায়। তৌসিফ আড় চোখে বউকে দেখে। শরীর কিছুটা দূর্বল হলেও এই মেয়ে তা বুঝতে দেয় না। তৌসিফ টুপি পরে পৌষ’র দিকে হাত বাড়ালো। দু’জন হাতের ভাজে হাত নিয়ে বেরিয়ে এলো বিশাল বড় হোটেল থেকে।
গাড়িতে উঠতে নিতেই পৌষ বাগড়া দিলো,

— হাটি? কত সুন্দর রাস্তা।
— হাটব। আপাতত এক জায়গায় যাচ্ছি।
পৌষ মাথা নাড়ে। বাইরে ফুরফুরে বাতাস। স্নোরী মাউন্টেনে ওদের পৌঁছাতে ভালোই সময় লাগলো। তৌসিফ জানালা আটকে রাখলো। পৌষ খুলতে চাইলেই বললো,
— অনেক ঠান্ডা। অসুস্থ হয়ে যাবে।
— গাড়িতেই যদি থাকি তাহলে কেন এলাম?
— দেখাচ্ছি কেন এলে।
পর্বতে পৌছাতেই পৌষ অবাক হয়ে গেলো৷ তৌসিফ ওর হাত মুজা পরিয়ে দিতে দিতে বললো,
— কেমন?
অবাক পৌষ তখন স্নো দেখছে। পুরোটা চূড়া বরফে আচ্ছাদিত। কিছু মানুষ আছে যারা বিভিন্ন খেলাধুলায় মত্ত যার পুরোটা বরফ ভিত্তিক। পৌষ অবাক হয়ে বললো,

— আমি এমন কিছু কখনো স্বপ্নেও দেখি নি।
— বাস্তবে দেখো তাহলে।
— শুনছেন?
— হুঁ।
— আমি কিন্তু অনেক অবাক।
— আমি অনেক খুশি।
হঠাৎ একটা বরফের খন্ড উঁড়ে আসে। পৌষ চমকায়। তৌসিফ কপাল কুঁচকে তাকাতেই ছোট্ট একটা বাচ্চা দৌড়ে এসে বললো,

— স্যরি ম্যাম। আই ডিডেন্ট শিই।
পৌষ চমৎকার হেসে ছেলেটার বাদামি চুল নেড়ে বললো,
— ক্যান আই প্লে উইথ ইউ?
বাচ্চাটা খুশি হয়ে হাতে থাকা গোল বরফ ছুঁড়ে মা’রে। পৌষ নিজেও তুলে মা’রে। সাথে আরো কিছু বাচ্চা যোগ দিলো। তৌসিফ বুকে হাত গুজে তাকিয়ে আছে। তার এক জীবনের প্রেম নিহিত এখানে। এই পৌষ’র মাঝে। হঠাৎ ওর শরীরেও একটা এলো। পৌষ খিলখিল করে হাসছে। আরেকটা মে-রে বললো,
— আসুন না।
তৌসিফ ঠোঁট কামড়ে নিজেও সামিল হলো৷ তৌসিফ ইচ্ছে মতো যতটা পারলো বরফ একত্রিত করে ছুঁড়তে লাগলো। এত বড় মানুষটা বাচ্চা হয়ে গেলো যেন। পৌষ বরফের মাঝেই মুখ থুবড়ে একবার পরলো। তৌসিফ টেনে তুলতেই দেখলো নাক, মুখ লাল হয়ে আছে ওর ঠান্ডায়। পৌষ হাসিমুখে বললো,

— স্কি করব।
— কাম।
দু’জন একসাথে হাত ধরে করতে গিয়ে পরে গেলো। পৌষ দাঁড়াতে পারে না। তৌসিফ এবার ওকেও নিজের কাছে নিলো। পৌষ’র টকটকে ঠোঁট জোড়া ওকে আকর্ষণ করলো। মুখ দিয়ে তখন দু’জনে আভ বের হচ্ছে।
আচমকা ঠোঁটে ঠোঁট মিলায় তৌসিফ। পৌষ ওকে দুই হাতে আঁকড়ে ধরে। স্কি’র বোর্ডে পা রাখে তৌসিফ। একটু পথ যেতেই পরে গেলো ওরা। ছুটলো না অবশ্য কেউ। তাদের শীতলতা তখন ওষ্ঠের উষ্ণ মাদকতায় ভরপুর। বরফের মাঝে যেন বিলীন হয় তারা। পান হয় প্রেমসুধা।

প্রেমসুধা পর্ব ৫৫

দূরের ক্যাফেতে তখন পরিপূর্ণ নারীটির চোখে বাঝে তা। সে গরম কফির কাপে চুমুক বসায়। জীবন সুন্দর। শুকনো গাছের পাতাটার মতোই সুন্দর যার প্রয়োজন ফুরালেও সে দূর থেকে সুন্দর। চোখ জুড়ানো সুন্দর।

প্রেমসুধা পর্ব ৫৭