প্রণয়ের বাঁধন পর্ব ২৪

প্রণয়ের বাঁধন পর্ব ২৪
মুসতারিন মুসাররাত

ঠা’স শব্দটা মূহুর্তেই খোলা ছাদ জুড়ে বাতাসে প্রতিধ্বনিত হয়। তৎক্ষণাৎ নিতি বিস্ময়ে স্তব্ধ কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে যায়। অবাকের শীর্ষে পৌঁছায় মেয়েটা। পিটপিট করে পলক তুলে নির্বোধের মতোন গোলগোল চোখ করে দিব্যর রাগান্বিত মুখের দিকে তাকায়। আপনাআপনি একটা হাত নিজের মকমলের মতো তুলতুলে গালে চলে যায়। সেকেন্ডের মধ্যে কী ঘটলো! ভেবে কূলকিনারা খুঁজে পাচ্ছে না মেয়েটা।
নিতিকে রেলিংয়ে দেখে ন্যানো সেকেন্ডের মধ্যে দিব্যর অবচেতন মন ভাবে, নিতি বোধহয় সু-ই-সা-ইড করতে যাচ্ছে। তখন নিতির বলা কথাগুলো সিরিয়াসলি না নিলেও; চোখের সামনে এহেন দৃশ্য দেখে এছাড়া দ্বিতীয় ভাবনা দিব্যর মস্তিষ্কে আসে না। দিব্য জোরেশোরে বলে উঠে,

-” নিতি..”
দিব্যর হঠাৎ এভাবে চেঁচিয়ে ডাকায় তিনি ভড়কায়, হকচকায়। ঘাড় ঘুরিয়ে চাইতেই দেখতে পায়; দিব্য ঝ’ড়ের বেগে ছুটে আসছে। কিছু ঠাহর করার আগেই নিতির চিকন কোমল হাতটা ধরে টান দেয় দিব্য। নিতির মাথাটা গিয়ে সোজা দিব্যর বুকের উপর পরে। মাথা তুলতেই যা ঘটে তার জন্য নিতি মোটেই প্রস্তুত ছিলো না। দিব্য চোখমুখ শক্ত করে ক’ষি’য়ে নিতির গালে থা/প্প/ড় দেয়।
এদিকে দিব্যর চোখ দু’টো যেন আ’গু:নের স্ফু’লিঙ্গ। রাগে হিসহিসিয়ে বলল,
-” এটা কী করতে যাচ্ছিলি? তুই পা/গ/ল হয়েছিস নাকি?”

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

পরপর আঙুলের সাহায্যে কপালে স্লাইড করে রা’গ কমানোর চেষ্টা করে দিব্য। বড়বড় শ্বাস ফেলে ফের বলল,
-” সব কিছুতেই ফা’জ’লামি করে কেউ? ইচ্ছে তো করছিলো ধা’ক্কা দিয়ে ফেলে দিতে। তোর ম/রা/র সাধ ইহজন্মের জন্য ছুটাতে ইচ্ছে করছিলো।”
নিতি হতবাক, বাকরুদ্ধ হয়ে নিস্পন্দ চোখে তাকিয়ে ছিলো। দিব্যর কথা কর্ণগোচর হয়ে নিউরনে পৌঁছাতেই দিনের আলোর মতো সবটা ফকফকা হয়। নিতি ঢের অনুমান করে ফেলে দিব্য কী ভেবেছে! নিতি সত্যিটা বলে না। ওর কেনো জানি রাগ হচ্ছিলো। তাই তো রাগ দেখিয়ে বলল,
-” ইচ্ছেটা পূরণ করতে। কে বলেছিলো এভাবে টেনে নিচে নামাতে? আর..আর এরকম অ’ভ’দ্রের মতো আচরণ করতে।”

-” নি_তি। চ-ড় যদি আরেকটা খেতে না চাস; তো পা’গ’লা’মি বাদ দে।”
চ-ড় খাওয়ার কথা শুনেই যেন গালের ব্যাথায় টনক নড়লো। গালটা সত্যিই ব্যাথা করছে। রাগের সাথে কান্নাও পাচ্ছে নিতির। হঠাৎ বাচ্চা শিশুর মতো অভিমানী হয়ে ঠোঁট দুটো ফুলাল নিতি। কণ্ঠে নামল তীব্র অভিমান,
-” তুমি জানো আজ অবধি আমার মাম্মা ছাড়া আমার গায়ে কেউ হাত তোলা তো দূর রুড আচরণ করেনি। আর তুমি সবসময় আমার সাথে খেক শিয়ালের মত খ্যাকখ্যাক করা আচরণ তো শো করোই; আর আজকে তুমি তোমার লিমিট ক্রস করে গিয়েছো। আমার গায়ে হাত তুলেছো। আর কে বলেছে আমি সু’ইসা’ইড করতে যাচ্ছি? তোমার মতো একটা বা’জে লোকের জন্য আমার সু-ই-সা-ই-ড করতে বয়েই গিয়েছে।”
থেমে, নাক টেনে চেঁচিয়ে বলল,

-” নিজেকে কী ভাবো তুমি? কী ভাবো টা কী? তোমাকে না পেলে জীবন শেষ করে দিবো! জীবন এতটাই ফে’ল’না? তোমার ভুল চিন্তা ভাবনা তোমার নিজের কাছেই রাখো। আমার জীবন এতটাও সস্তা নয়; যে তোমার মতো অ’ভদ্র…”

বাকি কথা গিলে নেয় নিতি। আঙুলের সাহায্যে চোখের কোণে জমা অশ্রু মুছতে মুছতে দৌড়ে প্রস্থান করে। দিব্য নিম্নাষ্ঠের ডান পাশে দাঁত বসিয়ে নিতির যাওয়ার দিকে তাকিয়ে রয়। পরপর হাত মুষ্টিবদ্ধ করে দেওয়ালে সজোরে ঘু-ষি মা’রে। চোখ বন্ধ করে নিয়ে ভাবে, চ-ড় দেওয়া কোনমতেই ঠিক হয়নি। কিন্তু তখন রাগে মাথা কাজ করছিলো না, তাই। দিব্যর ভেতর তীব্র অনুশোচনা হতে থাকে। এখন আরো ভ-য় জেঁকে বসে দিব্যর মধ্যে। নিতি রাগ-ক্ষোভ নিয়েই এমনটা বলেছে এতে সন্দেহের অবকাশ নেই। গোধূলির অস্তমিত সূর্যের দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলে দিব্য। মনেমনে সিদ্ধান্ত নেয় নিতিকে ঠান্ডা মাথায় বোঝাবে। পাছে না রাগের বশে বড় কোন অঘটন ঘটিয়ে বসে মেয়েটা।

রুমময় অস্থিরতায় পায়চারী করছে দিব্য। একবার রুমে যাচ্ছে তো আরেকবার করিডোর দিয়ে হাঁটছে। উদ্দেশ্য নিতির সাথে কথা বলা। নিতিকে একটু আগে নিচে যেতে দেখেছে। এখন দোতলায় সিঁড়ি থেকে খানিকটা দূরত্বে দুই হাত ট্রাউজারের পকেটে গুঁজে অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে। কিছুক্ষণ পর নিতিকে সিঁড়ি বেয়ে আসতে দেখা যায়। যাক অবশেষে অপেক্ষার অবসান ঘটল। কিন্তু বিধিবাম! নিতি নিজের রুমের দিকে না এসে অন্যদিকে গেল। যা দেখে দিব্যর ধৈর্য্যর বাঁধ হারা হয়। দাঁতে দাঁত পিষে নিজেকে স্বাভাবিক রাখে দিব্য।
তনুজার রুমের সামনে গিয়ে নক করে নিতি। তনুজা এগিয়ে আসতেই নিতি হাতে থাকা কাগজে মোড়ানো প্যাকেট বাড়িয়ে বলল,

-” ভাবিমণি! তুমি বোধহয় বুয়াকে কিছু আনতে দিয়েছিলে। এটা আমার হাতে ধরিয়ে তোমাকে দিতে বলল।”
তনুজা একটু অপ্রস্তুত হয়। হালকা হাসার চেষ্টা করে প্যাকেটটা হাতে নেয় ও। পরপর সৌজন্যমূলক হেসে বলল,
-” ভেতরে এসো নিতি।”
নিতির মনমেজাজ বিক্ষিপ্ত থাকায় এড়িয়ে যায়। ও বলে,
-” ঠিক আছে ভাবিমণি! আমার মাথাটা ধরেছে। তাই এখন লম্বা একটা ঘুম দরকার। আমি আসছি, কেমন?”
তনুজা প্রত্যুত্তরে ঠেলেঠুলে হাসার চেষ্টা করল।

দিব্য উল্টোদিক ঘুরে দাঁড়িয়ে। নিতি দেখেও না দেখার ভান করে লম্বা কদম ফেলে যেতে থাকে। এমন সময় গম্ভীর কণ্ঠস্বর আসলো,
-” নিতি দাঁড়া। তোর সাথে আমার কথা আছে।”
নিতি যেন কথাটা এক কান দিয়ে ঢুকিয়ে অন্য কান দিয়ে বের করে দেয়। প্রত্যুত্তরে টু শব্দটি করলো না। ওর মতো যেতে থাকে। এমন সময় হাতে টান পরায় ঘাড় ঘুরিয়ে তাকায়। কাটকাট গলায় বলল,
-” হাত ছাড়ো। এভাবে হাত ধরেছো কেনো? জলদি হাত ছাড়ো আমার।”
-” মেজাজ খা’রা’প করে দিস না। যা বলছি তাই কর। ছাদে চল। তোর সাথে কথা আছে।”
-” কিছু বলার হলে এখানেই বলো।”
দিব্য আর দ্বিতীয় বাক্য উচ্চারণ করলো না। হাত ধরে টানতে টানতে ছাদের দিকে পা বাড়ায়। নিতি জোরেশোরে কিছু বলতেও পারছে না; কেউ দেখলে আবার কী ভাববে! অগত্যা দিব্যর সাথে পা মেলায়। ছাদে উঠতেই দিব্যর হাতের বাঁধন আলগা হয়ে আসে। আর তক্ষুনি এক ঝটকায় নিজের হাতটা দিব্যর বাঁধন থেকে ছুটিয়ে নেয় নিতি। রাগি স্বরে বলল,

-” কী বলবে তাড়াতাড়ি বলো? আমার কাজ আছে।”
চারিদিকে কুয়াশার চাদরে মুড়ানো। কুয়াশার চাদর গলিয়ে চাঁদের রুপোলি আলোয় বসুন্ধরা আলোকিত। রাস্তার পাশে থাকা ল্যাম্পপোস্টের হলদে টিমটিমে আলো কুয়াশার জন্য আজ বড্ড মলিন ঠেকছে। শীতের সময় হওয়ায়, রাত বেশি না হওয়া স্বত্বেও চারিদিক, পথঘাট কেমন শুনশান নিস্তব্ধতায় ঘেরা। নিস্তব্ধতার মাঝে নিতির কণ্ঠস্বর বাতাসে ঝংকার তুলল। দিব্য চোখ তুলে নিতির রাগান্বিত মুখবিবরে তাকায়। ছটফটে চঞ্চল নিতির রাগি মূর্তি মুখশ্রীটা একটু অন্যরকম ঠেকল। আজ আর দিব্যর মন রাগতে সায় দিলো না। দিব্য অস্ফুটে বলল,

-” স্যরি!”
নিতি প্রশ্ন ছুঁড়ল,
-” হোয়াট ফর স্যরি?”
রাগের পারদ আজ নিচের দিকে রাখার সর্বোচ্চ চেষ্টা করছে দিব্য। কিন্তু এই মেয়ের জন্য সম্ভব হবে কী না; আল্লাহ মালুম! দিব্য শান্ত স্বরেই বলল,
-” তখন তোর সাথে মিসবিহেভ করার জন্য।”
থামে দিব্য। নিতির থেকে দৃষ্টি সরিয়ে নিয়ে বিশালাকার আকাশপানে একপল চায় দিব্য। অতঃপর অদূরে শুন্যে দৃষ্টি নিবদ্ধ করে শান্ত গলায় বলল,

-” নিতি আমি তোর অনুভূতিকে ছোটো করছি না। আর না তো উপহাস করছি। তবে তুই বুঝদার হ। একটু ভেবে দেখ। হয়তো এটা তোর আবেগ। আর নতুন করে আমার সম্পর্কে নাই বললাম। কারন তুই তো আমার সম্পর্কে সবটা জানিস। নতুন করে কাউকে মেনে নিতে পারব না, ব্যাপারটা এমন নয়। এই পৃথিবীতে ধ্রুব সত্যি কী জানিস?”
নিতির টানাটানা চোখজোড়া দিব্যর শান্ত মুখের দিকে ঠাঁই তাকিয়ে। হঠাৎই খুব মনোযোগী হয়ে পরে ও। এতক্ষণের রাগ-ক্ষোভ সব যেন হাওয়ায় মিলিয়ে যেতে থাকে। দিব্যর কণ্ঠটা আজ অন্যরকম ঠেকছে। বড্ড বিষণ্ণ লাগছে। নিতি ওর সম্পুর্ন মনোযোগ দিব্যর কথায় মনোনিবেশ করে শ্রবণ করতে থাকে। দিব্য বলতে থাকে,

-” জীবন থেমে থাকে না। সময়ের সাথে সাথে প্রবাহমান জীবন। জীবন যেমন থেমে থাকে না ঠিক তেমনি; শুন‌্য স্থানগুলোও আজীবন শুন্য থাকে না। এক সময় না একসময় শুন্য স্থান পূর্ণ হয়। এই পূর্ণতা পাওয়ার জন্য কাউকে না কাউকে প্রয়োজন। সর্বোপরি ভাগ্য বলে কথাটা তো অবধারিত, ধ্রুব সত্য। আমি সবটা মন থেকে মেনে নিয়েছি। তবুও মাঝে মাঝে অস্বস্তি হয়। সেই অস্বস্তিটা কাটানোর জন্য হলেও আমার বাইরে যাওয়া জরুরী। আর নিতি আমি জানি তুই খুব ভালো মেয়ে। তুই কখনোই আমাকে ডিজার্ভ করিস না। তুই আমার থেকেও বেটার ডিজার্ভস করিস। তাই বলছি, যেহেতু তোর জন্য বেটার অপশন আছে তাই মেনে নে। দেখবি সময়ের সাথে সাথে মোহ-টোহ কোথায় উবে যাবে।”

দিব্য ম্লান মুখে আলতো হাসলো। আকাশে পূর্ণ চাঁদ। জোৎস্না স্নিগ্ধ রাত! জোৎস্নার আলোয় দিব্যর হাসিটা বড্ড মলিন আর বিষণ্ণ লাগল। যা নিতির বুকে সুচ ফুটানোর মতো ব্যাথা অনুভব করায়। দৃষ্টি তুলে চাঁদের দিকে তাকিয়ে বক্ষস্থলের গহীন চিঁড়ে দীর্ঘশ্বাস বেরোয় নিতির। পরপর ম্লান স্বরে বলে উঠল,

-” চাঁদকে কখনোই আমার ঝলসানো রুটি মনে হয়নি। বলার অপেক্ষা রাখে না আমি বড্ড আদরে আহ্লাদে বেড়ে উঠেছি। হয়ত আমার জন্য অনেক অপশন আছে। মানলাম তোমার থেকেও বেটার অপশন আছে। যেখানে আমার মনমস্তিষ্ক, আমার কল্পনার রাজ্য; সবটার একছত্র অধিপত্য তুমি। সেখানে বেটার কাউকে প্রয়োজন আছে কী? শত শত বেটার অপশনের ভিড়েও আমার মনমস্তিষ্ক একবার নয় দুইবার নয়, শত সহস্র বার তোমাকেই চাইবে। ইউ আর নট মাই ইনফিচুয়েশন। আমার হৃদসায়রের গভীর ছাড়িয়ে গভীরতম থেকে উত্তাল ঊর্মিমালার মতো আসা ভালোবাসার এক নাম তুমি। তুমি মানেই আমার খেয়ালি অবুঝপনা মনকে হিম করা আদ্রতা। এবার বলো এরপরও তোমাকে শুধুই মোহ আর আবেগের মধ্যে কী করে সীমাবদ্ধ করি!”
নিস্তব্ধতার মাঝে নিতির আবেগঘন কথায় পরিবেশটা কেমন ভারী হয়ে আসে। দিব্য চোখ তুলে পূর্ণ দৃষ্টিতে নিতির দিকে চায়। ওর অবচেতন মন আওড়ায়,

-” বড় অদ্ভুত আমাদের চাওয়া। সবসময় ভুল করে ভুল কাউকেই আমরা চাই। ভুলেতে ডুব দেই। কিন্তু ভাগ্য তো অন্যকিছু লিখে রাখে। ভাগ্যকে খন্ডনের সামর্থ্য তো কারো নেই। ভাগ্যকে না যায় খন্ডন করা আর না যায় উতরানো। তারপরও বে’হা’য়া মন মানতে নারাজ। না চাইতেও কষ্ট সে পাবেই। এই না পাওয়ার বেদনা, যাতনা কতটা ভয়াবহ তা সেই জানে, যে পায়নি, হারিয়েছে ভালোবাসা।”

দিব্য আরো ভাবতে থাকে, জীবনের বারো আনা তো হেলায়-ফেলায় কাটলো। বাকি আছে যে চার আনা, তা দিয়ে কী একবার গ্রো আপ করার চেষ্টা করা যায় না? নিজের জন্য না হোক, তাকে নিয়ে স্বপ্ন বুনার, তাকে নিয়ে ঘর বাঁধার রঙিন স্বপ্ন বুকে যতন করেছে যে মেয়েটি; তার স্বপ্নের পূর্ণতা দেওয়ার জন্য হলেও একবার ট্রাই করে দেখবে কী?
দিব্যর মন দোনামোনা করতে থাকে। সিদ্ধান্তের দোলাচল থেকে বেরিয়ে দিব্য চোখদুটো বুজে নেয়। পরপর নিতির ভাসাভাসা চোখে নিশ্চল চাহনিতে চাইল। গম্ভীর কণ্ঠে বলল,
-” নিতি আমি বলবো আরো একবার ভেবে দেখ। আমার ছন্নছাড়া, অগোছালো এলোমেলো জীবনে নিজেকে জড়িয়ে দিনশেষে তোকে যেনো আফসোস করতে না হয়। তাই বলছি ভালো করে ভাব। ভেবেচিন্তে আমাকে জানা। তারপর…তারপর তুই যেটা চাইবি সেটাই হবে।”

লহমায় আকাশের চন্দ্র হাতে পাওয়ার থেকেও বেশি আনন্দ অনুভব হয় নিতির। চোখমুখ জুড়ে খুশির ঝিলিক দেখা যায়। আনন্দে আত্মহারা হয়ে নিতি দিব্যকে ঝাপটে ধরে। দিব্য টাল সামলাতে না পেরে পিছিয়ে যেতে যেতে নিজেকে সামলে নেয়। নিতির কণ্ঠে এক সমুদ্দুর আনন্দ উচ্ছ্বাস তরঙ্গের ন্যায় ঢেউ তুলল,
-” যতক্ষণ শ্বাস-প্রশ্বাস থাকবে ততক্ষণ অবধি আমার মন তোমাকেই চাইবে। সাহারার মরুর মতো খরখরে তৃষ্ণার্ত মন আমার বারংবার তোমাকেই চায়। বেশি কিছু চাওয়ার নেই আমার, শুধু পাশে থেকো আপন করে নিও; ব্যস!”
সুন্দর আবেগময় কথার মাঝে দিব্য এক নিমিষেই ছন্দপতন ঘটিয়ে দিলো। ঝটিকায় আগের রুপে ফিরে আসলো। নিতিকে নিজের থেকে ছাড়িয়ে কর্কশ স্বরে আদেশ বাণী আওড়ালো,

-” রুমে যা। কুয়াশা পড়ছে। এখানে প্রচন্ড ঠান্ডা।”
নিতি চোখ সরু করে তাকায়। মনে মনে ভাবে,
-” ব্যা’টা পুরাই নিরামিষ তো আছেই, তার উপর একদম আনসোশ্যাল দেখছি। কোথায় আলিঙ্গন শক্ত করবে, প্রত্যুত্তরে দু’টো মিষ্টি করে কথা বলবে। তা না…. আশ্চর্য! নিতি যেচে নিজের লাইফে দিব্য নামক প্যারাময় বাঁ-শ স্বইচ্ছায় টেনে নিলি। এবার জিন্দেগি ভর সামলাও একে।”
নিতির ভাবনার সুতোর চরকায় টান পড়লো। দিব্য ধ’ম’কের সুরে বলল,

-” কী হলো এখনো সংয়ের মত দাঁড়িয়েই আছিস; কথা কানে ঢুকেনি?”
নিতি মুখ বাঁকিয়ে বলল,
-” যাচ্ছি যাচ্ছি।”
নিতি ক’কদম যেয়ে পিছু ফিরে চায়। কিছু ভেবে শুধালো,
-” তুমি? দাড়িয়ে আছো যে; ভেতরে যাবা না?”
-” তুই যা। আমাকে নিয়ে ভাবতে হবে না। রাজ্যের ভাবনা আমার ঘাড়ে চেপে দিয়ে তুই তো এখন নিশ্চিন্তে আরামসে ঘুমাবি। এখন কীভাবে সবটা ঠিকঠাক করবো, এই চিন্তায় আমি দিশেহারা হচ্ছি।”
-” প্যারা নিও না। ইচ্ছে থাকলে উপায় বেরোয়।”
দিব্য চোখ গরম করে তাকাতেই নিতি নাকমুখ কুঁচকে ভেংচি কে’টে যেতে থাকে।

ইভান সোফায় বসে ল্যাপটপে কিছু একটা করছে। দুইহাতের আঙুল ল্যাপটপের কিবোর্ডে থাকলেও চোখদুটো বারবার তনুজার দিকে যাচ্ছে। তনুজা ব্যাগ গোছাচ্ছে। তনুজা কোণা চোখে ইভানের দিকে তাকাচ্ছে। ওর মনটা খুব করে চাইছে, ইভান বাঁধা দিক। একবার না করুক। ইভান মন থেকে বললেই ও যাবে না। ইভানকে নির্লিপ্ত নির্বিকার দেখে তনুজার বেশি কষ্ট হতে থাকে। ইভান মনে মনে ভাবে,

-” দিদুন তো দুদিনের কথা বলেছিলো। কিন্তু তনুজার ব্যাগ গোছানো দেখে তো মনে হচ্ছে না দু’দিনের জন্য যাচ্ছে।”
একবার জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে হলো পরক্ষনেই কোথা থেকে জড়তা এসে হাজির হয়। আর জিজ্ঞেস করা হয়ে উঠলো না। ইভানের কেনো জানি রাগ হতে থাকে, সে বউয়ের সাথে ঠিকমতো কথা বলছে না, তাদের মধ্যে মনোমালিন্য হয়েছে। তাই বলে টিপিক্যাল বউদের মতো বাপের বাড়ি যেতে হবে। ইভান এটা হজম করতে পারছে না। রাগ করে ল্যাপটপের শাটার বন্ধ করে ল্যাপটপটা শব্দ তুলে সোফায় নামায়। উঠে দুই হাতে টিশার্ট টেনেটুনে ঠিক করে রুম থেকে বেরিয়ে যেতে থাকে। তনুজা আড়চোখে সবটা অবলোকন করে। পরপর বসা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে পিছু ডাকল,

-” ইভান শুনুন।”
ইভান দরজার সামনে দাঁড়িয়ে। দরজাটা হাট করে খোলা ছিলো। তনুজার দিকে না তাকিয়ে গম্ভীর মুখে বলল,
-” বলো।”
তনুজা এগোয়। ইভানের সামনাসামনি দাঁড়ায়। মুখটা ওর মলিন। ভেতরে ভেতরে গুমরে ম/রছে মেয়েটা। অথচ বাইরে সবার সামনে নিজেকে স্বাভাবিক খোলসে আবৃত রাখার আপ্রাণ চেষ্টা করছে। ঘুটঘুটে অন্ধকারে ছেয়ে থাকা আকাশে হঠাৎ বিজলির মতো এক টুকরো আলো উঁকি দিয়েছে তনুজার জীবনে। এত যাতনা অবহেলার মাঝেও ওর মনটা চাইছে ইভানকে কিছু বলতে, জানাতে। হয়তো এই খুশির খবরটা শোনার পর ইভানের রাগ-ক্ষোভ কর্পূরের মতো উবে যাবে। তনুজা জিভ দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে নেয়। মাথাটা নুইয়ে নিচু স্বরে বলে,

-” ইভান আপনি বা…”
ইভানের কথায় তনুজার কথাটা অসম্পূর্ণ রয়। কথার মাঝেই ইভান বলল,
-” হ্যা বাইরে যাচ্ছি। কী বলবে ফাস্ট বলো? আর একটা কথা শুনে রাখো, এইযে রাত করে ফিরি এর মানে ড্রিংক করে আসি না। একবার কাউকে কথা দিলে সেই কথা ইভান রাখতে জানে। ইভান অন্যদের মতো প্র’তা’রণা করতে জানে না। কোনো কিছু গোপন করে না।”

তনুজার হৃদয় ক্ষতবিক্ষত হয়। যে মন নিয়ে কথাটা বলতে আসছিলো, সে মনটা নিমিষেই বেদনায় নীল হয়ে আসে। ইদানিং রাত করে ফেরে দেখে সেদিন তনুজা আচমকা বলেছিলো, -” আপনি বোধহয় আবার ড্রিংক শুরু করেছেন। তাই রাত করে বাসায় ফেরেন।” সেদিন উত্তর না দিলেও, আজ পুরো কথা না শুনে উল্টো বুঝে এমন ধারালো অ”স্ত্রে”র ন্যায় উত্তর দেয়। যে উত্তরে তনুজার সত্তা র’ক্তা’ক্ত হয়। ইশশ্! এই ব্যাথা যে দেখানো যায় না। তনুজা টলমলে চোখে চেয়ে বলল,
-” ইভান! আপনি একবারো কেনো সিচুয়েশনটা বোঝার চেষ্টা করছেন না। আপনি অযথাই আমাকে মিসজাজ করছেন।”
ইভান তপ্ত নিঃশ্বাস ফেলল। কণ্ঠটা খাদে নামিয়ে বলল,

-” তোমার অতীত আছে সেখানে আমার বিন্দুমাত্র অভিযোগ নেই। তোমার অতীতের সাথে দিব্য জড়িয়ে আছে। বিষয়টা চাইলেও আমি মেনে নিতে পারছি না। আমি তোমার সাথে স্বাভাবিক থাকতে চাইছি বাট পারছি না। বারবার অ’নু’শোচনায় দ/গ্ধ হচ্ছি। ভেতরে ভেতরে অপরাধ বোধে ভুগছি। মনে হচ্ছে আমার জন্য দিব্য তোমাকে পেলো না। দিব্য কষ্ট পেলো। আর তুমি তো জোর করে মেনে নেওয়ার নিছক অভিনয় করে যাচ্ছো।”
তনুজা প্রতিবাদ স্বরূপ বলল,

-” ইভান আমি প্রথমে বিয়েটা মানতে না পারলেও, ধীরে ধীরে মেনে নিয়েছি। আর চেষ্টা করেছি আপনাকে আপন করার। বিশ্বাস করুন আমায়। আমি আবারো বলছি, আমার মনে আপনি ছাড়া বর্তমানে কেউ নেই। ট্রাস্ট মি!”
-” আমি সবসময় অন্য মানুষের কাছ থেকে নয়, নিজের আপন মানুষদের থেকে কষ্ট পেয়েছি। জীবনে নিজের মানুষদের কাছ থেকে প্রতারণা পেয়ে, আমি বড্ড শান্ত হয়ে গিয়েছি। অনুভূতি শুণ্য হয়ে পড়েছি। সেদিন তৃষার মাধ্যমে কথাগুলো শুনে আমি খুব বেশিই আপসেট হয়ে পরি। এর থেকে বেটার হতো যদি তুমি নিজেই সাহস করে সত্যিটা বলতে। যাইহোক এখন এটা বলে লাভ নেই। তবে জেনে রাখো, আমি ইচ্ছে করে তোমায় কষ্ট দিচ্ছি না। সবকিছু আগের মতো করতে আমার একটু সময় দরকার। আশাকরি তুমি আমার অবস্থা বুঝবে। আপাতত আমাকে আমার মতো থাকতে দাও।”

ইভান ত্রস্ত পায়ে প্রস্থান করতে থাকে। ওদিকে ছাদ থেকে নেমে রুমের উদ্দেশ্য যাচ্ছিলো দিব্য। ইভান-তনুজার শেষের কথাগুলো ও স্পষ্ট শুনতে পায়। দাঁত কিড়মিড়িয়ে ঘৃ/ণা ভরে গালিসহ একটা নাম উচ্চারণ করলো,
-” তৃষা___”
তনুজা ব্যালকনিতে আসে। গায়ের শালের আস্তিন মৃদু হাওয়ায় দুলছে। ওর চক্ষুতারা পানিতে টলমল করছে। ঘনপল্লব নোনতা জলে ভিজিয়ে অদূরে অন্ধকারে তাকায়। একটা হাত আপনাআপনি শাড়ির আঁচল গলিয়ে তুলতুলে পেটের উপর রাখে। ঠোঁট দুটো নেড়ে বলে,
-” দুঃখ আমার নিত্যদিনের সঙ্গী! সুখ সে তো আমার জন্য কারাগারে বন্দী। সুখের আশা করাও ভুল আমারই!”

প্রণয়ের বাঁধন পর্ব ২৩

রাতে ডায়নিংয়ে ডিনার করতে বসেছে মির্জা বাড়ির সদস্যরা। এরমধ্যে দিব্যর কথায় যেন খাওয়ার টেবিলে বো-মা বি’স্ফো’রণ ঘটে, এমন মুখাবয়ব করে সকলে এ ওর দিকে মুখ চাওয়া-চাওয়ি করে।

প্রণয়ের বাঁধন পর্ব ২৫