মেহেরজান ২ পর্ব ২
লেখনীতে- সোহামণি
রাউশিকে গাড়িটাতে উঠানো হলো। রাউশিকে একটি সিটে বসিয়ে গাড়ি ছেড়ে দিলো। রাউশি ফ্রন্ট সিটে বসা মানুষটাকে দেখেই চিনে ফেললো আর চেঁচিয়ে বলল,‘ তানজিম ভাই তুমি?’
তানজিম পেছনে ফিরে দাত কেলিয়ে হেসে বলল,
‘ হ্যা আমিই।’
‘ এভাবে কেন গাড়িতে ওঠালে?’
তানজিম মাথা চুলকাতে চুলকাতে বলল,‘ একটু ফিল্মি স্টাইলে নিলাম আর কি। বাবা আর চাচ্চুর থেকে টাকা মেরে দেওয়ার জন্য।।’
রাউশি তীব্র বিরক্তি নিয়ে বলল,‘ আমাকে বাসায় নামিয়ে দিয়ে এসো ভাইয়া। এমনিতেই মাথা গরম। তোমার এসব বেক্কলের মতো বুদ্ধিতে আমায় ইউজ করিও না।’
হো হো করে হেসে ওঠে তানজিম আর বলল,‘ বড় হই তোর। সম্মান দে।’
‘ এসব কি বাচ্চামোপনা ভাইয়া? বাড়িতে নিয়ে চলো।’
‘ দেখ রাউশি, ট্রাই টু আন্ডারস্ট্যান্ড৷ আই নিড সাম মানি। কিন্তু বাবা আমাকে দিচ্ছে না। এখন তুইই আমার এই অপহরণের মতো প্ল্যানটিতে সাহায্য করতে পারবি?’
রাউশি আরও বিরক্ত হলো। এমনিতেই মাথা গরম ছিলো। তার ওপর তানজিম ভাইয়ের এহেন পাগলামোতে যেন আরও বেশি বিরক্ত হলো। নিজেকে শান্ত করে বলল,
‘ আমি কথা দিচ্ছি তোমায়,টাকার ব্যবস্থা আমি করে দেবো। তবে আমার জন্যও তোমাকে একটা কাজ করে দিতে হবে ভাইয়া।’
তানজিম ভ্রু কুঁচকালো,‘ কি কাজ?’
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
‘ আমার বিয়েটা ভেঙ্গে দিতে হবে।আমরা প্ল্যান করে এই বিয়েটা আটকাতে পারি। আমি কিছুতেই ওই খাটাশ লোকটাকে বিয়ে করবো না ভাইয়া। ওই লোককে দেখলেও আমার গা জ্বলে। তার ওপর সেনাবাহিনীতে রয়েছেন। না না না, জীবনেও না।’
‘ খারাপ কোথায়? মেহরান ভাই তো অনেক ভালো। তোর সাথে মানাবে।’ তানজিম কথাটুকু বলতেই রাউশি তাকে থামিয়ে বলল,
‘ অন্তত বন্ধুত্বের বন্ধন দৃঢ় করতে আমি বলির পাঠা হতে পারবো না তানজিম ভাইয়া।’
তানজিম হতাশার শ্বাস ফেলে বলল,
‘ আমি পারবো না কিছু। সর যা। আমি অন্য কাউকে কিডন্যাপ করবো এখন।’
রাউশিও রেগে গাড়ি থেকে নেমে তানজিমকে বলল,‘চাচ্চুকে কল করে বলবো যে তার গুণধর ছেলে কি বাজে কাজ করে বেড়াচ্ছে।’
তানজিম গাড়ির জানালা দিয়ে রাউশিকে ভেংচি কেটে বলল,
‘ যা যা কি বলবি বলে দে। তাতে আমার কিছুই হবে না।’
রাউশি ঠোঁটের কার্ণিশে কুটিল হাসি ফুঁটিয়ে বলল,
‘ দেখা যাবে।’
রুনারা দৌঁড়াতে দৌঁড়াতে এদিকটাই এলো। রাউশিকে দেখে দৌঁড়ের গতি আরও বাড়ালো। কাছে এসে এসে হাঁটুতে ভর দিয়ে সবাই হাপাতে শুরু করলো। হাসিব হাঁপাতে হাঁপাতে জিজ্ঞাসা করলো,
‘ তুই এখানে কি করছিস? আর গাড়িতে কে ছিলো? চেঁচিয়েছিস কেন? সব খুলে বল বেডি।’
‘ গাড়িতে তানজিম ভাই ছিলো।’ রাউশি স্বাভাবিক আওয়াজে বললো।
হাসিব ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞাসা করলো,
‘ কোন তানজিম?’
মিলি হাসিবের মাথায় গাট্টা মেরে বলল,‘ রাউশির কাজিন ভাই তানজিম।’
‘ ওহ হ্যা হ্যা। কিন্তু ভাইয়ের গাড়িতে উঠলি তো চিৎকার করলি কেন? কি সমস্যা তোর? পাগল হয়ে গেলি? নাকি ঢং করছিলি? কিরে কথা বলছিস না কেন?’
রাউশি ‘চ’ শব্দ উচ্চারণ করে বলল,
‘ বাজে বকা বন্ধ কর। একটা জায়গার নাম বল। যেখানে গেলে মুড ভালো হবে। আর দারুণ সব প্ল্যান করতে পারবো বিয়েটা ভেস্তে দেওয়ার।’
সবাই কিছুক্ষণ ভাবলো। শ্রুতি বলে উঠলো,
‘ চল চিড়িয়াখান যায়।’
ঠোঁটে ঠোঁট চেপে রাগ সংবরণ করে একেকজন শ্রুতির দিকে তাকালো। নাঈম দাতে দাত পিষে বলল,
‘ ওখানে গিয়ে কি পশু-পাখিদের সাথে বসে প্ল্যান করবি? আড্ডা দিবি নাকি? গরু কোথাকার।’
‘ এই নাঈম একদম বাজে কথা বলবি না।’
‘ তুই এসব আলতু ফালতু কথা না বললেই হয়।’
‘ আমি একশোবার বলবো।’
‘ তাহলে আমিও একশোবার বলবো।’
শ্রুতি মুখ ফুলিয়ে বলল,
‘ চুপ কর।’
‘ তুই আগে কর।’
‘ আমি চুপ হয়ে গেছি।’
‘ তাহলে কে কথা বলছে? তোর বাপ?’
ইউসুফ এবার ধমকে বলল,
‘ আহ কি বা*লাফালানির ঝগড়া করিস তোরা? একদম মেজাজ খারাপ হয়ে যায়।’
‘ শ্রুতিকে চুপ করতে বল শালা।’
‘ তার আগে তুই চুপ যা।’
এরই মাঝে মিলি বলল,
‘ তার চেয়ে ভালো যে যার বাড়িতে যায়। মেসেঞ্জারে সব প্ল্যান করে ফেলবো। কে বলতে পারে ওই মেজর সাহেব আবার আমাদের পেছনে তার সাঙ্গপাঙ্গ কেউ লাগিয়ে দিয়েছে নাকি?’
রাউশিও বলল,
‘ তাহলে বাড়িতেই চলে যা সবাই। আমিও চলে যাবো।’
সবাই সহমত পোষণ করলো। মেইন রোডে গিয়ে একটি উবারও পেয়ে গেলো।
রাউশি বাড়িতে পা রাখতেই রোকসানা বেগম এগিয়ে এলেন রাউশির দিকে। রাউশির হাত ধরে টেনে নিয়ে গেলেন বসার ঘরে। রাউশি কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পা চালালো রোকসানা বেগমের সাথে। বসার ঘরে এনে রাউশিকে নিজের পাশে বসিয়ে রোকসানা বেগম জিজ্ঞাসা করে উঠলেন,
‘ ফার্স্ট ডেইট কেমন ছিলো রে রাউশি?’
রাউশি থতমত খেয়ে গেলো। রোকসানা বেগম রাউশির ছোট চাচী। বেশ হাস্যরসিক একজন মানুষ। তার ওপর ছেলেমেয়েদের প্রেমের টিপসও দিয়ে থাকেন। রাউশিকে আবারও বলে উঠলেন,
‘ শোন মেহরান শক্তপোক্ত একটা ছেলে। তাকে পটাতে খুব কঠিন হবে জানি। তবে আমার কাছে অনেক টিপস আছে। আজকে আমি তোকে একটি খাতায় লিখে দেবো সেগুলো কাজে লাগালে মেহরান তোর পায়ের কাছে এসে লেজ গুটিয়ে থাকবে।’
রাউশি চোখ বড় করে রোকসানা বেগমকে আপাদমস্তক দেখলো। হাসবে নাকি কাঁদবে বুঝতে পারছে না সে। রোকসানা বেগম রাউশির এমন নিষ্প্রভ চাহনী দেখে বললেন,
‘ এভাবে তাকিয়ে আছিস কেন? মন খারাপ করিস না। বিয়েটা তো হবে তাই না? এখন শুধু মেহরানকে পটানো বাকি। চাপ নিস না আমি আছি তো। ’
বলেই উঠে দাঁড়ালেন। শাড়ির আচল কোমরে গুজে ‘কাজ আছে’ বলে চলে গেলেন। রাউশি উঠে দাঁড়িয়ে মাথার চুল টেনে ধরলো। আর বলল,
‘ আমিও দেখি কি করে হয় এই বিয়ে।’
গটগট পায়ে উপরে ওঠার সময় বাবার সাথে দেখাদেখি হলো রাউশির। রাউশির চলন শান্ত হলো। ভদ্রভাবে সিড়ি বেয়ে উপরে ওঠার সময় মাহমুদ হোসেন হালকা কেশে মেয়েকে ডাকলেন,
‘ রাউশি!’
‘ জ্বি বাবা।’
মাহমুদ হোসেন গম্ভীর স্বরে জিজ্ঞাসা করলেন,
‘ দিন কেমন কাটলো?’
রাউশি মনে মনে বলল ‘ আমার জীবনের সবচেয়ে বাজে দিন আজকেই ছিলো।’’ মুখে বলল,
‘ মোটামুটি।’
‘ মেহরানের বাবা মাহবুব খান আমার প্রিয় বন্ধু। মাহবুবের সাথে অনেক বছর আগে থেকেই তোদের দুজনের বিয়ের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম। তাই আশা করি এমন কিছু করবি না যে কাজে আমার মান সম্মান হানি হয় এবং এত বছরের বন্ধুত্ব ভেঙ্গে যায়।’
রাউশি মাথা নিচু করে রোবটের মতো শুধু মাথা নাড়লো। মাহমুদ খান চলে গেলেন নিচে। রাউশি যেন একদম সমুদ্রের মাঝখানে পড়ে গেলো এখন। চারপাশে শুধু পানি আর পানি। সাহায্য করার মতো কেউ নেই। একেকজন তার বিয়ের জন্য উঠে পড়ে লেগেছে। হতাশ রাউশি। টলতে টলতে নিজের রুমে ঢুকে ধরাম করে দরজা লাগিয়ে দিলো। বাইরে থেকে কেউ বলে উঠলো ‘ ভেঙ্গে ফেল সব ভেঙ্গে ফেল।’
রাউশি বুঝতে পারলো ওটা তানিয়া ছিলো। রাউশি সোজা বিছানায় গিয়ে শুয়ে পড়লো। তার মাথা ঘুরছে এখন। সেসময় ফোনের টুংটাং আওয়াজে ধ্যান ফিরলো। ফোনটা হাতে নিয়ে দেখলো ‘আজাইরা পুলাপাইন’ নামক মেসেঞ্জার গ্রুপে তুমুল কথাবার্তা আর ঝগড়া চলছে।
নাঈম মেসেজ করলো,
‘ শ্রুতির মতো বেক্কল পৃথিবীতেই নেই। ওর কোন আক্কেলে ধরে রাউশি ওর হিটলার বাপকে বিয়ে করবো না বললেই ওর বাপ মেনে নেবে?’
মিলিও সঙ্গে সঙ্গে মেসেজ করলো,
‘ তুই বেক্কল, তুই কুত্তা, তুই ছাগল। যত খারাপ কিছু আছে সব তুই।’
দুজনের মাঝে চলছে বেশ। সেসময় হাসিব মেসেজ দিলো,
‘ এই এডমিন কে এই গ্রুপের? এই দুইটারে রিমুভ কর বাল।’
ইউসুফ মেসেজ টাইপ করছে। মিলি মেসেজ দিলো,
‘ রাউশি আর রুনা এডমিন। ওদের কে বল হাসিব।’
নাঈম আর শ্রুতি এবার হাসিবকে গালাগাল দিচ্ছে। রুনা তখন মেসেজ করলো,
‘ ভাই থাম তোরা। এখন বিষয়টা সিরিয়াসলি নিয়ে কিছু একটা করতে হবে আমাদের। উপায় বের কর।’
‘ যার জন্য এসব করবো, সেই তো শুধু সিন করে যাচ্ছে মেসেজের দিপ্লাই দিচ্ছে না।’ মেসেজটা মিলি দিলো। তখনই আবার আরেকটা মেসেজ আসলো। রাউশি দেখলো রোকসানা বেগম মেসেজ করেছেন রাউশিকে।
রাউশি মেসেজটা দেখে চোখ কপালে ওঠার জোগাড়। রোকসানা বেগম মেসেজে ১০টা টিপস লিখেছেন কঠোর মনের পুরুষালী পটানোর।হাসফাস করে উঠলো রাউশি।
রাউশি ফোনটা পাশে রেখে দিলো। তার আপাতত এখন একটা ঘুম দরকার। এই ভয়ানক দুনিয়া থেকে স্বপ্নের দুনিয়ায় একবার ঘুরে আসতে চায় সে। একবার মন চাইলে ফ্রেশ হয়ে নিতে। তবে আবার পরক্ষণে ভাবলো আগে আরামের একটা ঘুম দিয়ে বিকেলে উঠে ফ্রেশ হয়ে নেবে। তবে ঘর কাঁপিয়ে তখনই আবার রাউশির ফোনে কল আসলো। রাউশি একরাশ বিরক্তি নিয়ে ফোনটা হাতে নিলো। আননোন নাম্বার দেখে ভাবলো রিসিভ করবে না। কলটাও কেটে গেলো তখন। তবে এরপরই আবার কল আসলো একই নাম্বার থেকে। রাউশি কল রিসিভ করলো। সালাম দিলো আর বলল,
মেহেরজান ২ পর্ব ১
‘ আসসালামু ওয়ালাইকুম। কে আপনি?’
ফোনের অপরপ্রান্ত হতে পরিচিত আওয়াজ এলো,
‘ ওয়ালাইকুম আসসালাম। আমি মেহরান খান বলছি।’