প্রেমসুধা পর্ব ৫৭
সাইয়্যারা খান
বরফের মাঝে পৌষ’র চঞ্চলতা বাড়লো বৈ কমলো না। এখনও ল্যাটকা মে’রে বরফে বসে আছে৷ তৌসিফ গা ঝাড়ে। হাত বাড়িয়ে দিয়ে ডাকে,
— হানি, উঠে এসো।
পৌষ হাত ধরে। আচমকা হেচকা টান মা’রতেই হুমড়ি খেয়ে পরে তৌসিফ বরফের উপর। খিলখিল করা হাসি শোনা যায় তখন৷ তৌসিফ রাগে না। একটুও না। তার ভেতরে আচমকা এক অনুভূতি হয়। প্রেমের অনুভূতি। যেন সে সদ্য এডাল্ট হওয়া এক পুরুষ। যার হয়তো প্রথম প্রেম এই নারী। ঐ যে উপন্যাসের নাইকা যেমন হাসে ঠিক ওমন হাসি। তৌসিফে’র বুকটা ঝরঝর করে ভাঙে। সদ্য প্রেমে ডুবন্ত এক প্রেমিক তৌসিফ। তার চোখ দুটো যেন খুবই পিপাসিত। সেই চোখ তার তৃষ্ণা মিটাতে অবিরাম চেয়ে থাকে। তৌসিফে’র ভেতর ছটফট করে তখন। পৌষ একমুঠ বরফ হাতে তুলে তৌসিফে’র গালে লাগিয়ে দিলো। হাসতে হাসতে বললো,
— আপনাকে বরফের দেশের বিদেশিদের মতো দেখাচ্ছে।
— তাই? আর কি দেখায় আমায়?
— উমম। আমার জামাই জামাই লাগে।
— আর?
— আর কি মামাতো ভাই লাগে।
তৌসিফ যেন বিরক্ত হলো এই উত্তরে। কপাল কুঁচকে তাকাতেই ওর লাল হওয়া গালে ঠেসে একটা চুমু দিলো পৌষ। বললো,
আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন
— আপনার গাল দুটো স্ট্রবেরির মতো লাল হয়ে আছে। মন চায় টুকুস করে গিলে নেই।
তৌসিফ হাসলো। পৌষ’কে টেনে ধরে দাঁড় করিয়ে গা ঝেড়ে দিলো। বরফের ভিতর এই মেয়ে বসে আছে কখন থেকে। মন তার ভরছেই না। তৌসিফ সন্দিহান হলো৷ ঠান্ডা না লেগে যায়। হানিমুনে এসে বউয়ের ঠান্ডা কিছুতেই তৌসিফ সহ্য করবে না৷ একদমই না।
পৌষ হাত মুচরাতে মুচরাতে বলে,
— ছাড়ুন৷ এখানে থাকি।
— একদমই না। ঠান্ডা লাগবে?
— লাগবে না৷
— লাগবে। কাম ফাস্ট হানি।
পৌষ’র গাল দুটো ফুলার সুযোগ পায় না৷ পাজা কোলে তুলে তৌসিফ। পৌষ ওর গলা জড়িয়ে ধরে আহ্লাদী হয়ে বলে,
— অ্যাই তুসু ভাই, কই যান?
— একদম হাত ছেড়ে দিব৷ ধ্রিম করে পরবে এখানে। শিক্ষা দরকার তোমার।
— আমি তো শিক্ষিত।
— জালিম বলে এটাকে। জামাই’কে ভাই ডাকে কেউ?
— আগে তো ভাই আপনি৷ পরে জামাই।
— তুমি আগে কোনরূপে পেলে?
— শয়তান, বুইড়া খাটাস মার্কা এক জামাই রুপে।
তৌসিফ ফোঁস করে শ্বাস ফেলে। তার কিছুই বলার নেই। সে অবশ্য স্বীকার করে বিয়ের পরপর পৌষ’কে খুব একটা ভালো ট্রিট করা হয় না। তখন কোন আবেগ বা প্রেম কিছুই ছিলো না। অথচ একরাশ ভালোবাসা ছাড়া তৌসিফে’র বুকে কিছুই নেই। রিক্ত আজ সে এই পৌষরাত ছাড়া।
হাঁটতে হাঁটতে এক কটেজে ঢুকে তৌসিফ। বাইরে মানুষ জন বসা। তৌসিফ যদিও বললো রুমে গিয়ে কফি খাবে কিন্তু পৌষ মানে না৷ ও এখানেই খাবে। এর অবশ্য কারণ আছে। এখানে ঝুলছে ত্রিশ শতাংশ ছাড়ের এক অফার। তৌসিফ মোটেও বিরক্ত হলো না। তার মন আজ-কাল এসবে অভ্যস্ত। তৌসিফ ওকে আস্তে করে সাইডে রাখা নরম গদিতে বসিয়ে বললো,
— কমফোর্ট পাচ্ছো?
পৌষ মাথা নাড়ে। তৌসিফ ঘড়িতে সময় দেখে। বলে,
— শুধু কফি খেলে তো হবে না। সাথে কি খাবে?
— কফিই খাব।
ছোট চোখ করে তাকায় তৌসিফ। বলে,
— দিনের বেলায় কি তোমার পাকস্থলী সংকুচিত হয়ে যায়?
পৌষ তাগড়া চোখে তাকিয়ে যেন সে খুবই অবাক এহেন কথায়। মুখটা সাক্ষাৎ পেঁচার মতো করে বললো,
— আমাকে বেলুনের মতো বোটকা বললেন আপনি? যে সংকুচিত হই আর বাতাস দিলে রাতে প্রসারিত হই?
তৌসিফ ঝুঁকলো একটু কাছে। পৌষ’র থুতনিটা ধরে বললো,
— তোতাপাখি আমার।
বলামাত্রই ছোটখাটো এক আদরের প্রদান ঘটলো। পৌষ ঝটকা দিয়ে বলে উঠলো হতভম্ব ভাব নিয়ে,
— আশেপাশে মানুষ কত….
— ইটস অস্ট্রেলিয়া হানি।
— তো?
— ইটস ঠু নরমাল।
— মানে কি নরমাল? এরমানে বাংলাদেশে এসব অ্যাবনরমাল?
— উপস সরি। ভুলেই গিয়েছিলাম কার সাথে কথা বলছি।
তৌসিফ কেটে পরলো। পৌষ পিছু ডাকতেই জ্যাকেটের পকেটে হাত গুজে বললো,
— একটু অপেক্ষা করো। এখনই আসছি।
পৌষ ফোনটা হাতে নিলো৷ নরম গদিতে পা তুলে আরাম করে বসেছে সে। বাইরে তুষারপাত হচ্ছে। পৌষ অবাক চোখে দেখে তা। তার পাশেই আগুন জ্বালানো হয়েছে। সেই আগুনের শিখায় অপলক তাকিয়ে আছে এক উন্নত বয়সের নারী। পরণে এখানকার পোশাক। মুখে স্থানীয় ভাষা। সে হাসিমুখে দেখছে পৌষ’কে। তার পাশে ব্রাউন চুলের একটা ছেলে আসতেই সে কিছু কথা বললো তার সাথে। ছেলেটা পরক্ষণেই তাকে বি’য়ার সার্ভ করলো মগ ভর্তি। মহিলা মগে অবলীলায় ঠোঁট রাখে। এমন ঠান্ডা আবহাওয়ায় বিয়ার শরীর গরম রাখতে ভালো কাজ করে। তার মন চাইলো হ্যাংলা পাতলা মেয়েটাকেও সাধতে। তার উচিত বিয়ার খাওয়া। কিভাবে কাঁপছে।
সেটার অবশ্য প্রয়োজন পরলো না। মেয়েটার আশ্রয় হয়েছে এক লম্বা-চওড়া পুরুষের বুকে।
এবারেও নারীটি হাসলো। মিনমিন করে বললো,
— ইউস টু ওই জায়গা, মেয়ে। যদি তুমি জানতে এ-র থেকেও গভীর আদর ভাবে সে আমার মাঝে নিজেকে জড়াতো তাহলে এত খুশি হয়ে তৃপ্ত হয়ে তুমি জড়াতে না তার সাথে।
পেছনে ডাক পরতেই নারীটি হাসলো। ইশারায় দেখালো পাশের অসমবয়সী দম্পতিকে।
— কথার উত্তর কেন দেন না মেহেদী? কখন থেকে কথা বলছি?
মেহেদী খাতা দেখছে। ডিসেম্বর মাস। পরিক্ষা শেষ। সপ্তাহের মাঝে এসব খাতা জমা দিতে হবে। হাত ভর্তি কাজ। এখন কথা বলার সময় হচ্ছে না তবুও বললো,
— রাতে কথা বলছি।
— আর কত রাতে মেহেদী?
— আর একটু।
সোহা ক্ষুদ্র শ্বাস ফেলে চলে গেলো৷ ওর প্রস্থান এক পলক দেখে মেহেদী। বিশেষ পাত্তা দেয় না।
রান্না ঘরে খাবার গরম করছে সোহা। শশুর তখন চায়ের আবদার করলেন। আদা চা। সোহা দেখলো ঘরে আদা নেই। শশুড়কে তো আর বলা যাচ্ছে না আদা আনতে। বাজার সামনেই৷ মুদির দোকানেই আদা পাওয়া যায়। সোহা বিব্রত বোধ করে শিশুর’কে বলতে তাই পুণরায় রুমে ঢুকে দরজায় দাঁড়িয়ে বলে,
— মেহেদী আদা লাগতো। বাবা চা খাবেন।
— হুঁ। এক মিনিট।
ড্রয়ার থেকে ভাঙতি টাকা নিয়ে মেহেদী বের হলো। একদম সোহা’র সামনে দিয়ে। সোহা’র কণ্ঠনালী কাঁপলো। ভীষণ ভাবে কাঁপলো। একটা কথার উত্তর দেয়ার সময় হচ্ছে না অথচ বাড়ীর বাইরে নিজ বাবা’র জন্য ঠিকই যাচ্ছে আদা আনতে। সোহা নিজের অবস্থান বুঝে। এটাও বুঝে ঠিক কতটা খারাপ লাগে অবহেলায়।
মাঝেমধ্যে মনে হয় নিজ থেকে কপালে দুঃখ এনেছে সোহা। দরজাটা ধরেই দাঁড়িয়ে থাকে ও। হঠাৎ যখন হাতের মুঠোয় একটা পলিথিন এলো তখন টের পেলো মিনিট পাঁচ এখানেই পার হলো। মেহেদী ফিরে এসেছে। সোহা রান্না ঘরে ঢুকে চা বানায়। তিন কাপ চা করে শশুর সহ শাশুড়ী’কে দিয়ে আরেক কাপ নিয়ে ঢুকে রুমে। মেহেদী’কে চা দিতেই চমৎকার হাসে মেহেদী যেন সে খুবই কৃতজ্ঞ। সোহা চোখে হাসে। মানুষ স্বার্থপর। কিছু পেলে তারা কিছু দিতে রাজি। এই যেমন সোহা নিজেও এখন স্বার্থপর। ভালোবাসা পেতে, ভালো থাকতে ও মেহেদী’কে এতটা ভালোবাসাছে। সেই প্রথম রাত থেকে।
যতক্ষণ মেহেদী খাতা দেখলো সোহা ঠাই বসে রইলো। এক গভীর ভাবনার মাঝেই ওরা রাতের খাওয়াও শেষ করলো। সোহা রুমে ঢুকেই এবার সরাসরি বললো,
— এখন উত্তর দিন মেহেদী…
হেলামি দেখায় মেহেদী। বিছানায় উঠতে নিলেই এবার সোহা একটু জোরেই বলে উঠলো,
— কি সমস্যা কি মেহেদী? সেই কবে থেকে বলছি একই কথা। হ্যাঁ বা না বলুন….
মেহেদী নিজেও রেগে বলে উঠলো,
— আমার মুখের হ্যাঁ-না কেন লাগবে? তুমি বোঝো না? দেখো না? সংসার চালিয়ে কত খরচ তার উপর তুমি চাইছো মিনু’কে এখানে আনতে? জীবন্ত একটা মানুষ সে সোহা। পালতে টাকা লাগবে। রাখব কোথায়? রুম ই তো দুটো। খাওয়াব কি? অতিরিক্ত খাবার অপচয় বৈ কিছুই না আমার কাছে। ওর পোশাক-আশাক সব কিছুর দায়িত্ব নিতে হবে। সবচাইতে বড় কথা, ও তোমার নিজের আপন বোনও না। ওখানে খাচ্ছে দাচ্ছে ভালোই আছে। এখানে এনে কি করব আমরা? অতিরিক্ত খরচ না একটা? দরকার আছে কোন?
— না।
খুবই শান্ত গলায় উত্তর করে সোহা। মেহেদী ফোঁস করে শ্বাস ফেলে এগিয়ে আসে। সোহা’র হাত ধরে বসায় খাঁটে। এক হাত গালে রেখে বলে,
— বুঝার চেষ্টা করো সোহা।
— বুঝেছি তো।
— সত্যি তো?
— হুঁ।
— এসো৷ ঘুমাবে।
প্রেমসুধা পর্ব ৫৬
সোহা চুপচাপ শুয়ে পরলো। মেহেদী তাকে বুকে টেনে নিলো। বুঝ দিলো অনেক কিছু। সোহা চুপচাপ বুঝ নিলো।
সকাল হতেই মেহেদী টেবিলে দেখলো এক জোড়া কানের দুল, দুই মুঠো চুড়ি সাথে একটা থ্রি পিস রাখা। মেহেদী’র বুকে মোচড় দিলো হঠাৎ। কাল কি খুব বেশি খারাপ আচরণ করা হলো সোহা’র সাথে? এসব তো এই কয় মাসে বিয়ের পর মিনু’কে দেয়া হচ্ছিলো। সোহা সব ফিরত আনিয়েছে। সে কি তবে খুব কষ্ট পেলো? মেহেদী কাল রাতে এত কাজের পর হয়তো বেশিই রুক্ষ ভাবে কথাগুলো বলে ফেলেছে। সোহা’কে নরম ভাবে বলা উচিত ছিলো।
মেহেদী’র ফোনে আচমকা এক ম্যাসেজ আসে যা দেখা মাত্র ওর কপাল বেয়ে ঘাম ছুটতে থাকে। এই শীতের সকালে ওর শরীর নিয়ে এক দফা ঘাম ছুটে গেলো। হাত-পা অবস হয়ে এলো। চিৎকার করে ও ডাকতে লাগলো,
“সোহা? এই সোহা? এখানে এসো! সোহা?”