ধরিয়া রাখিও সোহাগে আদরে পর্ব ১২
জেনিফা চৌধুরী
বছর খানেক একটা বাচ্চা মেয়ের লা°শ ভেসে উঠেছে নর্দমার পানিতে। দেখতে ভীড় জমেছে হাজার মানুষের। ফুলের মতো বাচ্চাটাকে কারা এভাবে মা°রলো? হাত কাঁপলো না? একটুও মায়া হলো না? হায়, আল্লাহ! ভীড়ের মাঝ থেকে এসব কথা ভেসে আসছে মেহরিশ আর সায়রের কানে। মেহরিশ তো ঠাঁয় দাঁড়ানো। কান্না করার শক্তি অব্দি পাচ্ছে না। ভয়ে দম বন্ধ হয়ে আসছে। বুক কাঁপছে। শরীর কাঁপছে। নিঃশ্বাস নিতে পারছে না। এটা যদি আনায়া হয়! নাহ! আল্লাহ! মেহরিশ ভাবতে পারছে না। মুখ দিয়েও কোনো শব্দ বের হচ্ছে না। সায়রেরও একই অবস্থা। তবুও সায়র কোনোমতে নিজেকে শান্ত রেখেছে। মেহরিশকে অভয় দিয়ে বলল,
“আমরা একবার দেখি? চলেন। ভয় পাবেন না। আল্লাহ ভরসা।”
মেহরিশ তবুও সাহস পাচ্ছে না। অর্ধেক এসে দাঁড়িয়ে আছে৷ সায়র মেহরিশ একহাতে নিজের সাথে শক্ত করে চেপে ধরে আছে। পুনরায় আগের ন্যায় বলে উঠল,
“মেহরিশ, আল্লাহ তার বান্দাদের নিরাশ করেন না। আমরা যদি বাচ্চাটার মুখ না দেখি তাহলে শিওর হবো কি করে? আপনি মা। নিজের মনকে শক্ত করুন। মায়েরা যা দোয়া করে আল্লাহ তাই কবুল করেন। তাই মনে মনে আনায়ার সুস্থ থাকা প্রার্থনা করুন। চলুন আমার সাথে।”
মেহরিশ এবার একটু সাহস পেলো। মনে মনে বলে উঠল,
“এটা আমার আনায়া না। আনায়া হতে পারে না। আমার ফুল। আমার বুকে যত্নে থাকবে। এই নর্দমায় তাকে মানায় না।”
আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন
বলতে বলতে সায়রকে আগলে এগিয়ে যাচ্ছে। ভীড় ঠেলে সামনে যেতেই দেখলো বাচ্চাটাকে পলিথিনে মুড়িয়ে রাখা হয়েছে। চারদিকে পুলিশ ঘের দিয়ে রেখেছে। মেহরিশ আর সায়র এগিয়ে যেতেই পুলিশ বাঁধা দিলেন। বললেন
“সামনে যাওয়া যাবে না।”
সায়র শান্ত বাক্যে বলে উঠল,
“অফিসার, আমাদের বাচ্চা মিসিং আজ ৩দিন। আমরা একটু বাচ্চাটার মুখ দেখতে চাই, প্লিজ।”
পুলিশ কর্মকর্তা বাঁধা ছেড়ে দিয়ে অপর একজনকে আদেশ করলেন,
“বাচ্চাটার মুখ দেখাও।”
কথাটা মেহরিশের কানে যেতেই মেহরিশ সায়রের হাত খামচে ধরল। চোখ দুটো বন্ধ করে ফেলল। এই দৃশ্যটা দেখা সম্ভব না। এটা যদি আনায়া নাও হয় তবুও দেখা সম্ভব না। এটা আনায়া না হোক, কিন্তু আনায়ার মতো একটা ফুল তো। কারোর বেঁচে থাকার সম্বল তো। কোনো এক মায়ের নাড়ি কাটা ফুল তো। এইটুকু একটা বাচ্চার মৃ°ত দেখা পৃথিবীর কারোর পক্ষে সম্ভব না। পুলিশ কর্মকর্তা বাচ্চাটার মুখ খুলতেই মেহরিশ আর সায়র দুজনেই চোখ বন্ধ করে ফেলল। পুলিশ কর্মকর্তা বললেন,
“দেখুন, মিস্টার। চিহ্নিত করে আমাদের কাজে সাহায্য করুন।”
সায়র মনে মনে একবার প্রার্থনা করল,
“আল্লাহ, আমাদের উপর রহম করো। আমরা যা ভাবছি তা যেন না হয়।”
সায়র চোখ খুলল। একবার আকাশের দিকে অসহায় চোখে তাকাল। অতঃপর বাচ্চাটার দিকে তাকাতেই বুকের ভেতর জমে থাকা নিঃশ্বাস বেড়িয়ে আসল। ঠোঁটের কোনে চিলতে হাসির রেখা দেখা দিল। শরীরের এবার খুশিতে কাঁপতে শুরু করল। মেহরিশ তো এখনো চোখ বন্ধ করে আছে। চোখ খোলার সাহস নেই ওর। সায়র এবার খুশিতে আত্মহারা হয়ে বলে উঠল,
“মেহরিশ, চোখ খুলুন। চোখ খুলুন মেহরিশ। আমাদের কথা আল্লাহ শুনেছে, মেহরিশ।”
মেহরিশের কানে কথাটা যেতেই মেহরিশ ফট করে চোখ খুলল। পাশ ফিরে দেখল সত্যিই বাচ্চাটা আনায়া না। আল্লাহ! মেহরিশ এবার খুশিতে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল। সায়রকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে ববলে উঠল,
“সায়র! আমার আনায়া কোথায়?”
সায়র মেহরিশকে ভীড় থেকে বুকে চেপে ধরেই বের করে নিয়ে আসল। মেহরিশকে এনে গাড়িতে বসিয়ে দিয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে বলল,
“আমার মন বলছে, মেহরিশ। আনায়া যেখানে আছে একদম ঠিক আছে। ওর কোনো ক্ষতি হবে না দেখে নিয়েন।”
বলেই পানির বোতল বের করে মেহরিশের দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল,
“পানিটা খেয়ে নিন। আপনাকে এখন শান্ত থাকতে হবে। সুস্থ থাকতে হবে। আমি আপনার পাশে আছি, মেহরিশ।”
মেহরিশ পানিটা খেয়ে নিল। সায়র যথারীতি আবার ড্রাইভিং সীটে গিয়ে বসল। গাড়ি চলতে শুরু করল। হুট করে সায়রের ফোনে ২/৩টা ম্যাসেজের শব্দ বেজে উঠল। সায়র এক হাত দিয়ে ফোন বের করে ম্যাসেজগুলো সীন করতেই সারা মুখে অন্ধকার নেমে আসল। ম্যাসেজের রিপ্লাই না করে চুপচাপ ফোনটা পকেটে রেখে দিল। অতঃপর কিছু সময় পর হুট করে মেহরিশকে প্রশ্ন করল,
“মেহরিশ, আংকেল কোথায়?”
মেহরিশের ধ্যান ফিরলে জবাব দিল,
“আমি তো জানিনা, সায়র। বাবা, আনায়াকে খুঁজতে ব্যস্ত আছে। দিন রাত এক করে খুঁজে যাচ্ছে। কেন বলুন তো?”
সায়র ছোট করে উত্তর দিল,
”এমনি।”
খানিক থেমে পুনরায় জিজ্ঞেস করল,
“আংকেলতো হসপিটালের কোথাও দেখলাম না এই দুইদিন।”
মেহরিশের পুনরায় ধ্যান ভাঙল। ভেবে দেখল সত্যিই তো! যে মেহরিশের কিছু হলে পাগল হয়ে উঠে সে কিনা এই ৩/৪দিনে মেহরিশকে দেখতে একবারো হসপিটালের যায় নি! ব্যাপারটা আশ্চর্যজনক! মেহরিশ কথা ঘুরিয়ে বলল,
“একা মানুষ কতদিকে যাবে বলুন?”
সায়রও চুপ করে গেল। আর কথা বাড়াল না। নিরবতায় ছেয়ে গেল পরের মুহূর্তগুলো।
“স্যার, বাচ্চাটা আজ খুব কাঁদছে। জ্বরও এসেছে প্রচন্ড। কিছুতেই সামলানো যাচ্ছে না। একবার ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাওয়া খুব দরকার।”
মেয়েলী কন্ঠে কথাগুলো ভেসে আসতেই সামনে থাকা ব্যক্তিটি মেয়েটার দিকে চোখ রাঙিয়ে তাকালেন। পরক্ষণেই আবার চোখ নামিয়ে ফেললেন। ধীর বাক্যে বললেন,
“ডাক্তার সময় মতো এসে যাবে। যাও, এখন। বাচ্চাটাকে সামলানোর দায়িত্ব তোমার। এখন তুমি কিভাবে সামলাবে এটা তোমার ব্যাপার। আমার দেখার বিষয় না।”
মেয়েটা চলে যেতেই ব্যক্তিটি নিজের পরিচিত ডাক্তারকে ফোন করে আসতে বললেন। ফোন রেখে দেয়ালে টাঙানো মেহরিশের ছবির দিকে তাকিয়ে বললেন,
“মেয়ে তুমি অলুক্ষণে, অপয়া নাকি ভাগ্যবতী জানিনা। জন্মের পর নিজের বাবা-মাকে হারিয়ে, চাকরানী থেকে রাজরানী হয়ে থাকলে এটা অবশ্যই ভাগ্য। কিন্তু তুমি রাজরানী হয়েছো বলেই আমার মেয়ে হয়েছিল চাকরানী। আমার মেয়েটা তোমার জন্য আত্মহ°ত্যা করতে বাধ্য হয়েছে। তোমার জন্য আমি আমার মেয়েটাকে চিরতরে হারিয়ে ফেলেছি। শুধু তোমার জন্য না তোমার আর তোমার বোনের জন্য। তোমরা দুইবোন আমার থেকে আমার সব কেড়ে নিয়েছো। তোমাদের পরিনতি হবে ভয়ংকর।”
বলতে না বলতে তার চোখ বেয়ে দুফোটা পানি গড়িয়ে পড়ল। অস্পষ্ট স্বরে আওড়াল,
“প্রত্যেকটা মানুষের ভিলেন হওয়ার পেছনে একেকটা মর্মান্তিক কাহিনী থাকে৷ যে এই মর্মান্তিক পরিস্থিতির ভেতর দিয়ে গেছে একমাত্র সে বাদে সমাজ ও সমাজের মানুষ কখনো তার ভিলেন হওয়ার পেছনের কাহিনীটা জানতে চায় না। বুঝতে চায় না। সবাই শুধু খারাপ মানুষটাকেই দেখে। খারাপ হওয়ার কারন দেখে না।”
সায়র মেহরিশকে বাড়ি পৌঁছে দিয়ে নিজে মুন্নার সাথে দেখা করতে থানায় গেলো। মেহরিশের শরীর খারাপ হয়েছে তাই সায়র মেহরিশকে বুঝিয়ে শুনিয়ে বাড়ি পৌঁছে দিল। মুন্নার কাছে গিয়ে সায়র দেখল সেখানে আগের থেকেই মেহনূর উপস্থিত। মেহনূর সায়রকে দেখেই অশান্ত স্বরে প্রশ্ন করে বসল,
“সায়র ভাইয়া, আপনারা যা ভাবছেন সম্পূর্ণ ভুল। আমাদের পরিবারে এখন শোকের ছায়া পড়েছে। আমাদের শোক আরো বাড়িয়ে দিবেন না, প্লিজ।”
সায়র কিছু বলার আগেই মুন্না আগ বাড়িয়ে বলে উঠল,
ধরিয়া রাখিও সোহাগে আদরে পর্ব ১১
“আপনাদের শোক কেউ বাড়িয়ে দিচ্ছে না, মেহনূর। দেখুন তদন্তের খাতিরে আমরা সবাইকেই সন্দেহ করতে পারি। আপনিও সেই লিস্টের বাইরে নন।”
মেহনূর বিরক্ত হলো। চেঁচিয়ে বলল,
“তাই বলে আপনারা আমার বাবাকে কিডন্যাপার বানিয়ে দিতে পারেন না, অফিসার। আমার বাবা কেন তার নাতনিকে কিডন্যাপ করবে?”