খেয়ালি আমি হেয়ালি তুমি পর্ব ৩

খেয়ালি আমি হেয়ালি তুমি পর্ব ৩
আনিকা আয়াত

“ ওই মাইয়াডা দেখ! কি ঢেউ খেলানো চুল। ”
রনিও শুরু করলো তুষিবের সাথে বিজ্ঞানীদের মতো যুবতীদের পর্যবেক্ষণ করা। কোন মেয়ে মারাত্মক সুন্দর! কোন মেয়ের চরিত্র কেমন! তারা মুখ দেখেই আন্দাজে বলে যাচ্ছে। তর্কা-তর্কির চরম পর্যায়ে এদের মাঝে এক যুদ্ধ লেগে গেলো। অর্পণের এই সুন্দর সকালে তাদের কান্ডকারখানা বিরক্ত লাগছে। সে হঠাৎ তুষিবের কোমরে লাত্থি মে/রে বলল,

“ ক্রিকেট খেলার টাকা কই? তোর ভাগের টাকা? যাহ সিঙ্গারা নিয়ে আয়। ”
তুষিবের মেয়ে নিয়ে গবেষণা সেখানেই ইতি ঘটে। রনিকে নিয়ে চলে যায় ক্যান্টিনে! কিছুক্ষণ পরেই হুড়মুড় করে তার দিকে ধেঁয়ে আসে সাত খানা বন্ধুগণ। একেক করে সাত হানা/দার বাহিনী তার সামনে এসে, অর্পণকে ধাক্কা দেয়। টাল সামলাতে না পেরে কয়েক পা পিছিয়ে গেলো। ছেলেটা বিরক্ত হয়ে অশ্রাব্য ভাষায় গা/লি গালাজ করলো। পৃথার মাথায় চাপ্পড় দিয়ে বলল,

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

“ বিয়ের আগেই উপরে পাঠাতে চাইছিস?”
শিহাব মুখ বাঁকালো। প্ল্যান অনুযায়ী সবাই মিলে অর্পণের প্যান্ট আর শার্টের পকেটে দিলো হামলা। অর্পণ বিরক্ত হয়ে তাদের ঠেলে দূরে সরাতে চাইলো! কিন্তু এতোজনের সাথে পারা সম্ভব? ওরা হইহই করে সেকেন্ডের মাঝেই ভার্সিটি মাথায় তুলে। সমুদ্র মানিব্যাগ হাতড়ে ৯৬০ টাকা পেয়ে ভারী অসন্তুষ্ট প্রকাশ করে। হামিম পিঠে কিল মে/রে বলল,
“ মাত্র ৯৬০ টাকা দোস্ত! এই টাকায় সিনেমার টিকেট পাওয়া যাবে? ধুর! ফকিন্নি অর্পণ! ”
অর্পণ চোখ-মুখ শক্ত করলো। দাঁতে দাঁত চেপে বলল,

“ মানিব্যাগ ফেরত দে। তোর বাপরে ক! হাজার খানেক টাকা পাঠাইতে!”
সমুদ্রকে কিছু বলতে না দিয়ে পৃথা অর্পণের কাঁধে ডান হাতের কনুই ভর করলো। পা দুলিয়ে দুলিয়ে অসন্তুষ্ট কণ্ঠে বলল, “ কিপ্টে। এমপির ছেলে হয়ে ফকিন্নির মতো ৯৬০ টাকা রাখিস। ছিহহ! লজ্জায় আমাদের সবার মাথা কা/টা যাচ্ছে। তুই আমাদের বন্ধু। কোথায় হাজার হাজার টাকা নিয়ে ঘুরবি! তুই ভাই ফকিন্নি-ই রইলি।”
তৃধা ভেংচি কাটলো। অর্পণ রাগান্বিত মুখে নিজের কাঁধ ঠেলে পৃথাকে ধাক্কা দিলো। হাত বাড়িয়ে সমুদ্রের কাছ থেকে খপ করে মানিব্যাগ ছিনিয়ে নেয়। হাতের মুঠোয় রেখে বলল,

“ আমার বাপ এমপি আমি নই! যখন অর্পণ শেখ এমপির চেয়ারে বসবে এসব দু টাকা রাখবে না। ডলার রাখবে মামা! ডলার!”
পৃথা মুখ ভেঙিয়ে বলল,
“ কাঁচকলা রাখবি। যত্তসব। ক্লাসে চল সবাই। কিপ্টে অর্পণ শুধরাবে না।”
তাদের কথার মাঝেই তুষিব সিঙ্গারা আর ঠান্ডা পানি এনে অস্থির কণ্ঠে বলল,
“ ভাই কালকে একটি মেয়ের কাছ থেকে বিশ টাকা ধার করেছে!”
তৎক্ষনাৎ সকলের মুখ বেলুনের মতো চুপসে যায়। হট্টগোল, গমগমে পরিবেশ মুহূর্তেই হতভাগ্য হয়ে গেলো। সবাই বিস্ফুরণ দৃষ্টিতে অর্পণের দিকে তাকিয়ে। অথচ, সে নির্লিপ্ত! নির্বিকার হয়ে ঠান্ডা পানি গিলছে। কিছুক্ষণ পর চিৎকার করে উঠল সবাই,

“কিহ? অর্পণ তুই? শেষমেশ ভিক্ষা করতে নেমেছিস? আংকেল জানলে হার্ট অ্যাটাক করবে শিউর!”
অর্পণ ডোন্ট কেয়ার ভাব নিয়ে বাইকে রাখা কাঁধ ব্যাগ হাতে তুলে, মাথার কোঁকড়াচুল গুলো পেছনে ঠেলে পা বাড়ালো ক্লাসের দিকে। তার মাঝে নেই কোনো লজ্জার লেশ! সে নির্বিঘ্নে হেঁটে চলছে সামনে। অথচ, একবার পেছন ঘুরলে দেখতে পেতো ৯ জোড়া চোখ তার দিকে হা করে তাকিয়ে। যেনো বিস্ময়ের মাত্রা এখনও কমছে না। অর্পণ শেখ হুটহাট নাটকীয় ঘটনা ঘটালেও, এ ঘটনা তাদের কাছে নতুন।

তাই হয়তো, সকলের চোখ-মুখে অবাকের ছায়া।
চৈতী রেগে মেগে বুম হয়ে ক্লাসে যাওয়ার মাঝেই চোখ আটকে যায়, দূরে হেলেদুলে হেঁটে চলা অর্পণ শেখের কাছে। সিঁড়ি বেয়ে একপ্রকার লাফিয়ে লাফিয়ে চলছে। মাথায় ব্যান্ড থাকলেও ঝাঁকড়া চুলগুলো চারপাশ জুড়ে নেচে নেচে বেড়াচ্ছে। তার হাঁটের তালে তালে চুলগুলোও দুলছে। চৈতী সেখানেই থমকে দাঁড়ায়। নিষ্পলক চোখে তাকিয়েই, হঠাৎ এক কল্পনার জগতে ডুবে যায়। তার কাছে অর্পণকে ভোরে ফুটে উঠা সদ্য শাপলার মতো মনে হলো। সে কল্পনা করলো, বাতাসের সঙ্গে শাপলা যেমন অনবরত উল্টে পাল্টে দুলে উঠে! অর্পণের কোঁকড়া চুল ও দেহটাও লাফানোর সাথে সাথে দুলে যাচ্ছে।

ক্লাস শুরু হয়েছে কিছুক্ষণ আগেই! চৈতী ভার্সিটি প্রবেশ করার পর থেকেই সবাই কেমন কুদৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিলো। নিজেদের মধ্যে বলাবলি করেছে। যেনো, চৈতী কোনো সার্কাস দেখিয়েছে কাল। অবশ্য ওটা কোন অংশে কম?
সেই থেকেই রেগে বোম হয়ে, সবাইকে ছেড়ে আজ একা একা পেছনে বসেছে। জিনিয়া, শ্রাবণ সকাল থেকে চিন্তিত ছিলো। চৈতীর ভেতরের খচখচানি একটু হলেও অনুভব করতে পারছে ওরা। কারণ, এই কয়েকদিনে খুব ভালো বন্ধু হয়েছে চরজন।চৈতী ভীষণ সরল এবং ভদ্র মেয়ে। সকলের সঙ্গে নিমেষেই মিশে যেতে পারে। মুখে কখনও বিরক্ত লেগে নেই! এমন মেয়েকে বন্ধু হিসেবে পেতে কে না চায়?

ক্লাস শেষে শ্রাবণ ব্যাগ নিয়েই দৌঁড়ে গেলো চৈতীর পাশের চেয়ারে। জিনিয়াকে ইশারা দিতেই সেও মেয়েটার সাথে বসলো। ইনিয়েবিনিয়ে কি বলে কথা শুরু করবে ওরা ভাবছে। অথচ চৈতী মুখ ডুবিয়ে রেখেছে ফিজিক্স বইয়ে। আশেপাশে সবটাই তার ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় জানান দিচ্ছে। কিন্তু ও ইচ্ছে করেই চুপচাপ রইলো। সে জানে, কয়েক সেকেন্ড পরেই তার কানের কাছে ঘ্যানঘ্যান করবে এই ফা/জিল দুটো। সকাল থেকে সুযোগে ছিলো কখন চৈতী আসবে। প্রতিদিন সবার আগে উপস্থিত থাকলেও, আজ স্যারের সাথে সাথে ক্লাসে ঢুকেছে চৈতী।
“ চৈত্রের গরমে এসি থাকা স্বত্তেও ক্লাসে টেকা যাচ্ছে না! ইশশ! কি গরম। চৈত্র মাসে কেনো তেজ বেশী থাকে? সারাক্ষণ কি রেগে ভয়ংকর রূপ ধারণ করে? একটু ঠান্ডা হওয়া যায় না?”
শ্রাবণের কথা শুনে জিনিয়া চৈতীর দিকে তাকিয়ে হালকা ঢোক গিললো। মতিগতি বুঝা যাচ্ছে না! ভয়াবহ ঝড়ের আভাস! হয়তো, আসলেই রেগে ফুলে আছে। শ্রাবণ চোখের ইশারায় জিনিয়াকে উদ্দেশ্য করে চৈতীকে শুনিয়ে শুনিয়ে বলল,

“ চৈত্র থেকে শ্রাবণ মাস হাজার গুণ ভালো! সবাইকে ভাসিয়ে রাখে জলে। হুটহাট বৃষ্টি নেমে সব তেজ ঠান্ডা করে দেয়। আগু/নে পানি ঢালা যাকে বলে! সব রাগ, ঝাঁঝ নিমেষেই শেষ। কি বলিস জিনিয়া ঠিক বলিনি? চৈত্রের জন্য শ্রাবণই একদম পারফেক্ট! বৃষ্টির পর যেমন রোদ প্রয়োজন। তেমনি তীব্র খরার পর এক পশলা বৃষ্টি! একে অপরের পরিপূরক! চৈত্র আর শ্রাবণ। দারুণ! দারুণ! ”
” হ্যাঁ ঠিক!ঠিক! এতো গভীরে তো ভেবে দেখিনি। ”
চৈতী বইয়ের দিকে মুখ রেখে ভেতরে ভেতরে রাগে ফুঁসছে। কি থেকে কি বানালো ওই অসভ্য? ছিহ! শ্রাবণ খচ্চর! সে নাকি আমাকে ঠান্ডা করবে? আয় তবে। কালকের কথা সব মনে আছে। কিভাবে সব কটা বিপদে ফেলে পালালি। এদের মতো মানুষকে কেউ বেস্ট ফ্রেন্ড বলে? শ্রাবণ উত্তর না পেয়ে গলা খাঁকড়ি দিলো। চৈতীর বই ছিনিয়ে নিয়ে বলল,

“ স্যরি চৈত্র! বেঁচে থাকতে ওইসব ডেয়ার খেলবো না। পুতুল পুতুল খেলবো। ওসব বড়দের খেলা। ডেকে এনে বিপদে পড়া যাকে বলে! আমরা ছোট মানুষ। আজ থেকে পুতুল খেলবো। ওকে ডিয়ার?”
চৈতী রক্তলাল চোখে শ্রাবণের দিকে তাকালো। দাঁতে দাঁত চেপে বলল, “ হাঁদারাম কোথাকার! তুই খেল পুতুল। ছানাপোনা বিয়ে দিয়ে উদ্ধার কর।”
“ ওকে! তবুও শান্ত হ। এভাবে ক্লাস করতে বিরক্ত লাগছে। আজ তোর অভিমানে সব কিছু লবন ছাড়া তরকারির মতো বিদঘুটে ঠেকছে। ক্লাস করার ম্যুড নেই ভাই! চল ক্যাম্পাসে যাই। আড্ডা দেই।”
“ তোরা আমার বন্ধু নয়। সত্যি কারের বন্ধু কখনও বিপদে ফেলে পালায় না। তোরা কালকে প্রমাণ দিয়েছিস। আমি তোদের কেউ না। এখনও গালে ব্যাথা আছে।”
শ্রাবণ এবার তাড়াহুড়ো করে চৈতীর গালে তাকাল। অসহায় কণ্ঠে বলল,
“ আমরা কি জানতাম ডাইরেক্ট চড় লাগাবে? ভেবেছিলাম তোর মতো সুন্দরী দেখে লজ্জা পাবে! খুশিতে গদগদ হবে। ”

“ ঘন্টা পাবে। যতসব। সামনে থেকে যা তো!”
জিনিয়া আর শ্রাবণ কথা শুনলো না। চৈতীকে স্যরি বলে ইমপ্রেস করার ট্রাই করলো। অনেক টানাটানির পর চৈতীর উঠে বিরক্ত কণ্ঠে বলল,
“ হাত ছাড়। ব্যাথা পাচ্ছি। আরেকটু হলেই ছিটকে পড়বে আমার চিকন হাত। ”
শ্রাবণ হেঁসে ওদের সাথে বেড়িয়ে গেলো। হিমুকে কল করে বলল, ক্যাম্পাসে যেতে। কিছুসময় পর হিমু আর শ্রাবণ ওদের জন্য খাবার আনলো। চৈতীকে হাঁসানোর জন্য কত আয়োজন। চৈতী দীর্ঘশ্বাস ফেলে আকাশের দিকে তাকায়। তার পাশেই গালে হাত রেখে শ্রাবণ এক দৃষ্টিতে চৈতীর কাজল কালো আঁখির দিকে তাকিয়ে রয়। যেনো, কতদিনের তৃষ্ণা মিটছে তার।

স্নিগ্ধা ক্লাস শেষে সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামার সময় একটা ছেলের সাথে ধাক্কা খেলো। কোনো মতে টান সামলে পেছন ঘুরে বলল,
“ স্যরি!”
সমুদ্র ঠিকঠাক হয়ে দাঁড়িয়ে সামনের মেয়েটিকে আগাগোড়া পরখ করলো। মিষ্টি হাঁসি হেঁসে বলল,
“ ইট’স ওকে। বাই দ্য ওয়ে! তুমি কোন ইয়ার? ”
স্নিগ্ধা কপাল কুঁচকে বলল,
“ ফাস্ট ইয়ার।”

তৎক্ষনাৎ সেখানে উপস্থিত হলো অর্পণ আর শিহাব। কাঁধে তাদের ব্যাগ ঝুলছে। অর্পণের বাম হাত পকেটে গুঁজে রাখা। সে টানটান হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল। সামনে স্নিগ্ধাকে এখানে দেখে কপাল কুঁচকে ফেললো। ওদিকে মেয়েটার মুখও দেখার মতো হয়েছে। চোখ দুটি বড় বড় করে বলল,
“ আপনি এখানে?”
সমুদ্র এবং শিহাব নিজেদের মধ্যে চোখাচোখি করে অবাকের সুরে বলল,
“এই মেয়েটাই কালকে তোকে প্রপোজ করেছে?”
“ মানে?” স্নিগ্ধার কৌতুহল কণ্ঠ।
অর্পণ চোখ-মুখে গম্ভীরতা টেনে স্নিগ্ধার নিকট গেলো। হালকা ঝুঁকে ঠাট্টার সুরে বলল,
“ ম্যাডাম দেখি বিশ টাকার জন্য আমার ভার্সিটি পর্যন্ত চলে এসেছে! এতোই দরকার? ”

স্নিগ্ধার মনে পড়লো কালকের কথা। তৎক্ষনাৎ রাগের পারদ তরতর করে বাড়ে। এই বেয়াদব তাকে অপমান করছে? সে কখন টাকার কথা বলেছে? তার মানে অর্পণ শেখ এই ভার্সিটি তেই পড়ে! শিট! শিট! শেষে তাকেও এখানেই পড়তে হলো? স্নিগ্ধা তার চোখে চোখ রেখে বলল,
“ অবশ্যই দরকার। বড় কথা আপনি বলেছিলেন কাল বিকেলের মধ্যেই টাকা ফেরত দিবেন। অথচ, কথা খেলাপ করলেন। ”
অর্পণ বাঁকা হাঁসলো। সমুদ্র উত্তেজিত কণ্ঠে বলল,
“এ্যাই মেয়ের থেকে কাল টাকা নিয়েছিস! হায় খোদা!”
স্নিগ্ধা তাচ্ছিল্য হাঁসলো। দাঁতে দাঁত শক্ত করে বলল,

” অবশ্য আপনার থেকে কি-ই বা আশা করা যায়। ভরা রাস্তায় গুন্ডামী করে বেড়ান। নিষ্ঠুরের মতো পিটিয়ে ভারী মজা লাগে তাই না?”
শিহাব এবং সমুদ্র হতভম্ব! এ মেয়ে দেখি সবই জানে। কে এই মেয়ে? অর্পণের পানে ওরা বিস্ময় নিয়ে তাকাল। অর্পণ ভ্রু কুঁচকে তাকে সম্পূর্ণ এড়িয়ে, সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠতে উঠতে বলল,
“ সুন্দরী দেখছি সবই নজর রাখে! ইন্টারেস্টিং!”
সমুদ্র আর শিহাবকে উচ্চস্বরে ডেকে ফের স্নিগ্ধার উদ্দেশ্যে বলল,
“ তোমাকেও পেটাতে খুব ইচ্ছে করছে জুনিয়র! আমার কিন্তু সময় লাগবে না। সুন্দরী ময়েেদের মুখের ভাষা এমন অভদ্র হতে নেই। তারা লজ্জায় নরম কণ্ঠে কথা বলবে। চোখ-মুখে ভর করবে, এক আকাশ মুগ্ধতা! ”
“ আপনি বুঝি খুব ভদ্র? ”

অর্পণ তীক্ষ্ণ চোখে এক নজর তাকিয়ে চোখ দিয়েই তাকে শাসিয়ে গেলো। স্নিগ্ধা তার চোখের ভাষা বুঝতে পেরে হকচকিয়ে উঠে। এই ছেলের মাঝে কোনো গিল্টি ফিল নেই। নির্বিঘ্নে বলে যাচ্ছে। আবার হুমকি ধমকিও দিচ্ছে?
ক্লাসে বসে শিহাব কৌতুহল দমিয়ে রাখতে না পেরে অর্পণকে বলল,
“ তুই মেয়েটার সাথে এমন করলি কেনো?”
“ কাল থেকেই খেয়াল করছি। মেয়েটা আমার উপর বিরক্ত! রাগান্বিত! ”
সমুদ্র খুশিতে গদগদ হয়ে বলল,
” ওই মেয়ের সাথে ধাক্কা খেয়ে তার প্রেমে পিছলে গেছি মামা! আমি ভালোবেসে ফেলেছি মেয়েটাকে। আজ থেকে তোরা ভাবী ডাকবি ওকে ?”
শিহাব আর অর্পণ তৎক্ষনাৎ উচ্চস্বরে হেঁসে উঠলো। সমুদ্রের মেয়েলী রোগ বলে কথা! এটা তো হওয়ারই ছিলো!

চৈতীর ডিপার্টমেন্টের ক্লাস শেষ আজ। ওরা চারজন ক্যান্টিনে বসে ইচ্ছে মতো আড্ডা দিচ্ছে। তাদের গল্প ইতি টেনে হুড়মুড় করে প্রবেশ করল, অর্পণের দল। তৃধা আর পৃথা দৌঁড়ে বসে পড়লো খালি জায়গায়। চারপাশে বাকি বন্ধুরা। অর্পণ টেবিলে কাঁধের ব্যাগ ছুঁড়ে মে/রে উচ্চস্বরে বলল,
“ শিহাব গিটার বের কর। গান ধর শা/লা। হুদা মুদা মজা লাগেনা বা/ল। ”
অর্পণের পরিচিত কণ্ঠে চৈতী, জিনিয়া ওরা নিরব হয়ে গেলো। চুপচাপ কফির কাপে চুমুক দিয়ে নিজেদের পড়া বুঝে নিচ্ছিল। তৃধা এর মাঝে অর্পণের বাহুতে থাপ্পড় মে/রে বলল,
“ ওই মেয়েটাকে দেখা বা-ল!”

অর্পণ ফোন টিপছিল। তৃধার কথায় মনে পড়ল! তৎক্ষনাৎ সে অজান্তেই হেঁসে উঠে। সেই হাঁসির ঝংকারে চৈতীর চোখ আটকে যায়। না চাইতেও তড়িৎ গতিতে তাকালো পেছনে বসে থাকা যুবকটির দিকে। অর্পণের হাঁসিতে তৃধাও হতবাক হয়। সে কি এমন বলল, যে পা-গলের মতো হাঁসতে হবে?
অর্পণ হেঁসে মাথা তুলে সামনে নজর দিতেই চোখাচোখি হলো চৈতীর সাথে। ঘোলাটে বাদামি মনির আঁখির মালিককে দেখে মেয়েটা লজ্জায় ঘাড় ঘুরিয়ে নেয়। শ্রাবণ, জিনিয়া আড়চোখে ভয়ে ঢোক গিলতে ব্যস্ত। কালকে তো পালালো! কিন্তু আজ?

“ মেয়েটা তোদের সামনেই বসা!”
শিহাব কপাল কুঁচকে সমস্ত ক্যান্টিনে পর্যবেক্ষণ করে বলল,
“ চারপাশ কত মেয়ে! বুঝবো কিভাবে? তাকে সামনে আসতে বল! ”
অর্পণ উঠে গভীর চোখে চৈতীর দিকে এগিয়ে যায়। ভয়ে মেয়েটার বুকের ভেতরের ছোট্ট মাংসপিণ্ড লাফিয়ে উঠে। সে মুখ ঢেকে নিলো বই দিয়ে। অর্পণ তার নিকট গিয়ে একদম ঝুঁকে গেলো। ফিসফিস করে বলল,
“ নাম কি মেয়ে? আজ কাকে প্রপোজ করেছ?”
চৈতী চোখ খিঁচে নেয়। লজ্জায় তার হৃদপিণ্ড দ্রুত বেগে ঢিপঢিপ করছে। গলা দিয়ে কোনো কথা বেরচ্ছে না। লোকটা আজও তাকে হেনস্তা করতে এসেছে? তাও এতগুলো মানুষের সামনে! কালকে চড় মে/রেও শান্তি হয়নি বুঝি? অর্পণ ফের বলল,

“চৈতী নাকি চুমকি? ফিজিক্স নাকি কেমিস্ট্রি? ফাস্ট ইয়ার নাকি ফাইনাল ইয়ার? ”
চৈতী চকিত মুখ থেকে বই নামিয়ে হকচকিয়ে উঠলো। হতভম্বের ন্যায় ড্যাব ড্যাব করে তাকায়।। দরদর করে ঘামলো সে। এই ছেলে তার সব ইনফরমেশন কালেক্ট করে ফেলেছে? এবার রক্ষা? সে যা কান্ড করেছে, তাতে এসব জানা স্বাভাবিক। অর্পণের কথায় লজ্জার পারদ দ্বিগুণ হলো তার। সে কাল ভেবেছিল ভুলেও আর দেখা হবে না। অথচ, হয়েই গেলো। শ্রাবণ তো তাদের রেখেই ভয়ে পেছন ঘুরেই পালিয়েছে। অর্পণ বন্ধুদের দিকে তাকিয়ে বাঁকা হেঁসে বলল,

“ মেয়ে দেখতে চাইলি না? এ্যাই দেখ। ঘন কালো মেঘের মতো লম্বা যার কেশ। গভীর চোখে তীক্ষ্ণ দৃষ্টির ঘায়েল করা এক যুবতী। নারী জাতি সত্যি রহস্যময়ী!”
সবার চোখ কপালে উঠে গেলো। অর্পণ ফিরে এসে টেবিল থেকে একটা কফির কাপ হাতে নিয়ে বলল,
“ বাসায় যাচ্ছি ছাগলের দল। কাল দেখা হবে।”

সময়টা বিকেল! ছাঁদের রেলিঙের ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে স্নিগ্ধা আর মিষ্টি। দুজনের গায়ে একই পোশাক। কুর্তির সাথে প্যান্ট! চুলগুলো বিনুনি করে পেছনে পড়ে আছে। মিষ্টি দুহাত দুপাশে মেলে বুক ভরে শ্বাস নিলো। নতুন শহরে তার বেশ লাগছে। কিন্তু কাল রাতে তার মা জানিয়েছে তিন মাস পর, অন্য বাসায় উঠবে। এই এলাকা নাকি বাজে! কই মিষ্টির চোখে তো কিছু পড়লো না। সেই থেকে মেয়েটার মন খারাপ ছিলো। কিন্তু ছাঁদে এসে মুহুর্তেই হৃদয় ভরে উঠলো খুশিতে। কি সুন্দর পরিপাটি ছাঁদ।
স্নিগ্ধা ছাঁদের বাগানে রঙবেরঙের গাছ দেখে খুশি হলো। সে হাত বাড়িয়ে প্রতিটি গাছ ছুঁয়ে দেখতে থাকে। ছাঁদে তারা ছাড়াও আরোও দু-তিনজন মানুষ আছে। হয়তো ভাড়াটিয়া। স্নিগ্ধার মিষ্টিকে বলল,
“ আমাকে কয়টা ছবি তুলে দে। এই প্রকৃতির মাঝে, ঠান্ডা বাতাসে চমৎকার ছবি উঠবে।”

মিষ্টিও বোনকে বলে দিলো, ওর ছবি তুলা শেষে তাকেও তুলে দিতে হবে। স্নিগ্ধা একটি নয়নতারা ফুল কানে গুঁজে ছবি তুলার জন্য রেডি হলো। বেশ কয়েকটা তুলার পর ছাঁদের দরজা ধাক্কা দিয়ে প্রবেশ করলো এক শক্তপোক্ত যুবক। যার গায়ে থ্রি-কোয়াটার প্যান্ট আর কালো টি-শার্ট। চোখে মোটা ফ্রেমের চশমা। চুলগুলো একদম ছোট করে কাটা। যেনো চিমটি কে/টে ধরতে হবে। মুখের বদনখানি কঠিন! মুখে কোনো হাঁসির রেশ মাত্র নেই। স্নিগ্ধা কারো উপস্থিতি টের পেয়ে চট করে সামনে তাকালো। মুহুর্তেই সে হতভম্ব হয়ে যায়। চোখ দুটি অস্বাভাবিক বড় হয়ে থমকে গেলো মেয়েটা। চোয়াল ঝুলে পড়ার জোগাড় হয়ে মুখ থেকে অজান্তেই বের হলো,

খেয়ালি আমি হেয়ালি তুমি পর্ব ২

“ অর্পণ শেখ! এ কি রূপ আপনার? ঝাকড়া চুল এই সময়ের ব্যবধানে গেলো কই?”
লোকটি ভুরু কুঁচকে মেয়েটির পানে পূর্ণ দৃষ্টি মেললো। তৎক্ষনাৎ থমকে গেলো সেও। কানে ফুল গুঁজে রাখায় অপ্সরা লাগছে রমনীকে। সে মনে মনে তাকে, রাতে ঝড়ে পড়া শিউলির সাথে তুলনা করলো। গোলগাল মুখটা ভীষণ মায়াবী। কেমন অবাক নয়নে তাকিয়ে আছে! ছেলেটা অসভ্যের মতো এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রমনীকে আগাগোড়া পরখ করে এগিয়ে গেলো। স্নিগ্ধার নিকট দাঁড়িয়ে হঠাৎ বলে উঠে,
“ এ বাসায় নতুন উঠেছেন নাকি? আগে কখনও দেখিনি!”

খেয়ালি আমি হেয়ালি তুমি পর্ব ৪