রাজবধূ পর্ব ৯
রেহানা পুতুল
তার সাতদিন পরের এক নির্জন দুপুরে শিখা কিছু একটার জন্য তার খাটের নিচে যায়। তখন সে যা দেখলো,
তার কোন মানে খুঁজে না পেলেও তার মাঝে বিস্ময় ও কৌতুহলের সীমা রইল না।
সে দেখলো খাটের নিচে এক কোনায় পরিষ্কার একটি খাঁকি রঙের কাগজের প্যাকেট। তার ভিতরে কিছু একটা আছে। তার চঞ্চল চিত্ত আগ্রহান্বিত হয়ে প্যাকেটটি টেনে সামনে নিজের কাছে আনলো। মুখ পাটের রশি দিয়ে গিঁট দেওয়া। শিখা বের হয়ে রুমের দরজা বন্ধ করে দিলো শব্দহীনভাবে। মেঝেতে দুই পা ছড়িয়ে বসলো। প্যাকেটের বাঁধন খুলে নিলো মনোযোগী ও সাবধানী হয়ে। ভিতরের জড়বস্তুটা দেখেই সে ভিরমি খেলো। একটি মাঝারি সাইজের গাছপাড়া আধপাকা পেঁপে। সে নাকের কাছে নিয়ে ধরলো। কোন সুঘ্রাণ নেই। ধরে নিলো কাজ করা কেউ হয়তো এখানে লুকিয়ে রেখেছে পাকার জন্য। কাউকে বলা ঠিক হবে না। যে রেখেছে, সময় হলে তার জিনিস সেই নিয়ে যাবে।
শিখা, মুখটি আগের মতো বেঁধে নিলো। পূর্বের স্থানে প্যাকেটবন্দী পেঁপেটি রেখে দিলো। উঠে আবার দরজা খুলে দিলো। পেঁপে নিয়ে শিখার মাঝে বিশেষ কোন হেলদোল পরিলক্ষিত হলনা। মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলল। বরং মনে বলল,
দূর! এমন ফাউল একটা জিনিস দেখার জন্য কি করলাম আমি। আজাইরা। যাই বাইরের দিকে।
যেহেতু সে নতুন বউ। তাই সামনের উঠানে পা রাখেনা তেমন। পাছে কে কি ভেবে বসে আর দু’চারটা মন্দ কথা বলে ফেলবে। তাই পিছনের উঠানে,আনাচে কানাচে গিয়ে একটু দাঁড়ায় শিখা। যতই সময় গড়িয়ে যাচ্ছে। ততই তালুকদার পরিবারের মানুষজন নিয়ে শিখার ভিতরে কৌতুহলের উদ্রেক হচ্ছে। এই পর্যন্ত তার কিছু জানার,বলার, ভরসাস্থল হিসেবে সে মতির মাকেই পেলো। যে মানুষটি দুইদিনের দেখা এক মেয়েকে নিশিরাতেও চুপিচুপি গিয়ে স্নেহের সহিত সেবা দিয়ে আসে। সে আর যাই হোক, মানুষ হিসেবে খারাপ নয়। শিখা ঘরের পিছনের উঠানে গেলো রাজহংসীর ন্যায় দুলে দুলে। মতির মা তাকে দেখে ডাক দিলো।
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
“রাজের বউ পাকশালায় আসো।”
শিখা হাসি হাসি মুখে রান্নাঘরের ভিতরে গেলো। দেখলো কেউই নেই। মতির মা একা একা বসে চুলোয় লাকড়ি ঠেলছে। সে ঢেঁকির উপর বসলো। মতির মায়ের নাম জানার জন্য তার মন আঁকুপাঁকু করছে।
“খালা আপনের নাম কি?”
” আমার নাম কাউরে কইনা। তবুও তোমারে কই। জামিলা খাতুন আমার নাম। বিয়ার পর এই নাম নিয়া কম কথা হুনিনাই। আমি নাকি আমার নামের মতই সবখানে জামিলা।”
” কি কন খালা? জামিলা নামের অর্থ সুন্দর! এইটা ত ইসলামিক নাম।”
” এখন আর কি হইবো? সবই শ্যাষ। তোমার পায়ের ব্যথা সারছে? শুনছি ভাই সাহেব ট্যাবলেট আইনা দিছে।”
“তার চাইতেও বড় উপকার হইছে আপনার দেয়া মলমে। আপনি ম্যালা ভালো খালা।”
মতির মা কিছু বলতে গিয়েও ঢোক গিলে ফেলল। মনে পড়লো তাকে শিখিয়ে দেয়া কথাটা। সে কাষ্ঠ হেসে বলল,
“আইচ্ছা। হুইনা ভালা লাগছে মা।”
” আমি আপনেরে জামিলা খালা বইলা ডাকলে সমস্যা আছে?”
মতির মা পান খাওয়া দুপাটি হলদে দাঁত বের করে হাসলো। গালভরা হাসি ছড়িয়ে বলল,
“না। কিসের সমস্যা। ডাইকো। জামিলা যে আমার নাম সেইটাই ভুইলা গ্যাছি আমি। এই নাম ধইরা ডাকনের কেউই নাই এই দুনিয়ায় আমার। বেবাক মইরা সাফা হইয়া গ্যাছে।”
মতির মায়ের বুক চিরে একটা হাহাকারের দীর্ঘস্বাস বেরিয়ে এলো।
“একটা কথা খালা।”
“হ্যাঁ কও।”
“এরা আমারে এমন অসুন্দর একটা রুমে থাকতে দিলো ক্যান? জানেন? পুরা ঘরে ত কতগুলা রুম।”
“এইটার উত্তর সোজাই। আমি যতটুকু বুঝলাম। তুমি নিচু ঘরের মাইয়া বইলাই মনে হয় এই পুরান রুমে তোমারে থাকতে দিছে। ঠিক হইয়া যাইবো মা সময়ের লগে লগে। রাজ সব ঠিক কইরা ফালাইবো। পোলাডা মন্দ না।”
“বুঝলাম খালা। এরাতো সবাই কেমন কথাবার্তা কয় আমার লগে। বাড়ি ঘর কিছুই চিনায় না। ভাইজানেরা কে কি করে জানিওনা। আপনেতো এদের পুরানা লোক। সবই জানেন, চেনেন। তাই কইছিলাম কি আমারে যদি সব চিনায়া,বুঝায়া দিতেন,তাইলে আমার চলতে ফিরতে সুবিধা হইতো।”
“আইচ্ছা মা দিমুনি। তবে এহন না। এহন ঘরের পরিস্থিতি মারাত্মক হইয়া আছে।”
“ক্যান খালা?”
” কি জানি। রাজ শহরে চইলা যাওনের আগে তোমার কথা কি জানি কইলো হের মায়েরে। তারপর থেইকাই অবস্থা মারাত্মক। বেগতিক। আগুনে ঘি ঢাললে যেমন হয়। তেমন।”
মতির মা আর কিছু বলতে পারল না। তার ডাক পড়লো। বরকত কতগুলো নারকেল শাখা ও শুকনো ডালপালা এনে একপাশে জড়ো করলো।
“কই চাচী। এটি দেইখা লও।”
“খাড়া বরকত। আইতাছি। কই রাখছত?”
“রসুই ঘরের চালার নিচে।”
শিখা বলল,
“খালা আপনে কাম করেন। আমি নইলে এখন যাই।”
“আইচ্ছা মা যাও। সাবধানে চলাফিরা কইরো। ”
শিখা উঠান ডিঙিয়ে যাওয়ার সময় বরকত তাকে দেখে সালাম দিলো।
শিখা এই প্রথম দেখলো বরকতকে। কিছুটা বেঁটে। স্থুলকায় গড়ন। গায়ের রঙ কালো। ব্যবহার বেশ নম্র। গৃহকার্যে পটু। পরিশ্রমী ছেলে। বোঝা যায়।
“আপনার নাম বরকত?”
তালুকদার পরিবারের সবাই বরকত ছেলেটাকে তুই তোকারি, ঝাড়িঝুড়ি দিয়ে কথা বলে। অথচ এত সুন্দর নতুন বউ তাকে আপনি বলে সম্বোধন করছে। ভেবেই বরকতের চোখের কোণ চিকচিক করে উঠলো। আপ্লুত হলো বেশ। নিজেকে এখন আর তার আরশোলার ন্যায় ক্ষুদ্র পোকা মনে হচ্ছে না। সত্যিই মানুষ মনে হচ্ছে।
বরকত আন্দোলিত মনে বিনয়ের সুরে উত্তর দিলো,
“জ্বে ভাবিসাব। আমি বরকত।”
“সুন্দর নাম। কে রাখলো?”
” মায় কইছে আমার নানী রাখছে আমার এই নাম। আমারে দিয়া সব কামে নাকি বরকত হইবো। এর লাইগা এই টাইপের সব কাম আমারেই দিয়াই করাই সবাই। আমারো করতে ভালোই লাগে। ”
“আপনার কোন গ্রাম বরকত ভাই?”
“চরে ভাবিসাব।”
আচ্ছা, বলে শিখা চলে গেলো। সে ভাবলো, তার নিজের একটা ভাই থাকলে হয়তো আজ বরকতের বয়েসীই হতো।
বরকত শিখাকে বেশি কিছু বলতে চেয়েও পারল না। পরে যদি অন্যদের মতো তাকে ভুল বুঝে শিখা। নয়তো শিখার খুব প্রশংসা করতে ইচ্ছে করছে তার। যেন তার কত আপন এই নতুন বউটি।
সেদিন বিকেলে মতির মা সবাইকে একসঙ্গে জড়ো করলো আগেরকার মতো। বাঁশঝাড়ের নিচে গিয়ে দাঁড়ালো। এই নিরিবিলি স্থানটা তার বেশ পছন্দ। বাঁশঝাড় নিয়ে কথিত ভয়ের কেচ্ছাকাহীনি আছে বলে সহজে কেউ আসে না এখানে। পুরোনো বউ, ঝিয়েরা,ছোট,বড় ছেলেমেয়েরাও ভয়ে তটস্থ থাকে। তাকে ঘিরে দাঁড়িয়ে আছে তার মেয়ে জোছনা। পাশে আছে বাদশা,বরকত,ফুলবানু।
সে তাদের বলল,
“হুন,এগো ঘরে ত একজন আরেকজনের পিছে আঠার মতন লাইগা থাকে। ওইটার লগে তোরাও মিঠাই দিতে ভুল করস না। রাজের বউর দিল পরিষ্কার। অল্পবয়সী মাইয়া। বরকতরে আইজ ভাই বইলা কথা কইলো কি সুন্দর কইরা। সুন্দরী, আবার তালুকদার ঘরের বউ বইলা কোন দেমাক নাই তার মাঝে। তোরা কেউ হের বিপক্ষে যাইস না। হে তোগো লগে ভালা চলে। তোরাও হ্যারে ইজ্জত দিয়া চলবি। এই হইলো আমার কথা। এরা কেউ হ্যার কোন ক্ষতি করতে চাইলে তোরা জানলে আমারে জানাইবি। এই হইলো বিষয়। আমার চুলে এমনে এমনে পাক ধরেনাই। মানুষ চিনি। এই মাইয়ারে দিয়া সামনের দিগে আমগো সবার লাভ ছাড়া লোসকান হইব না। মনে রাহিস।”
মতির মায়ের অনুরোধ ওরা প্রত্যেকে কায়মনোবাক্যে মেনে নিলো প্রফুল্লচিত্তে।
“কইগো বুবু,সবাই কই?”
তার পরেরদিন সকালে গলা খাঁকারি দিয়ে তালুকদার ঘরে প্রবেশ করলো এক অল্পবয়সী পুরুষ লোক।
“কে হাসু মামা? কতদিন পরে এলেন বোনের বাড়ি।”
গলা বাড়িয়ে বলল আদুরী।
বাইরে থেকে সুমনা বলল,
“কে রে আইছে ঘরে?”
বাদশা দেখে এসে জানালো,
“হেগো ফাটা হাসু মামু আইছে।”
জোছনা ফিক করে হেসে উঠলো। বলল,
“ফাটা হাসু আবার কেমন নাম?”.
তার মা বলল,
” এই ব্যাডার নাম হাসেম। ভাবির সৎ ছোড় ভাই। আমি চিনি। সবাই আদর কইরা হাসু বইলা ডাকে তারে। একদিন হ্যার চান্দির উপরে গাছ থেইকা ঝুনা নাইয়ল পড়ছে। চান্দি ফাইটা গ্যাছে। বারোটা সেলাই দেওন লাগছে। এরপর তার নাম ফাটা হাসু হইয়া গ্যাছে। মইরা যাওনের কথা। ক্যামনে যে বাঁচলো। আমার মাথায় ধরে না। এরে কয় খোদার কুদরতি। ”
সুফিয়া বিবি ভাইয়ের গলা শুনে আহ্লাদে গদগদ হয়ে গেলো। ভাইকে গলা জড়িয়ে ধরলো। বলল,
“বাপের বাড়ির নিশানা তুই। আহছ খবর নিতে? বয়। বরকতরে দিয়া স্বাসওয়ালা ডাব পাড়াইতাছি।”
“বুবু স্বাস খামুনা। কচি ডাবের পানি খামু। ”
“আইচ্ছা। আমার ভাইর যেমন সাধ তেমনই দিতাছি।”
” শুনলাম রাজ বিয়া করলো। বাকি সব শুনলাম বাড়িত আইসা। এখন বউ দেখতে আইলাম। এই যে দেখো বউর জন্য এই সোনালি চেইনের ঘড়িটি উপহার আনলাম। সিকো ফাইভ ঘড়ি বুজান। এখন বাজারে এটার কাটতি রমরমা।”
সুফিয়া বিবি ছোঁ মেরে হাসুর হাত হতে ঘড়িটি ছিনিয়ে নিলো। তেজী স্বরে বলল,
“সব হুনলে এইটা আনলি ক্যান ওই দুই পয়সার মাইয়ার লাইগা?”
সুফিয়ার হাত থেকে ঘড়িটি ফের হাসু নিজের হাতে নিয়ে নিলো।
“আহ বুবু। ছ্যাতো কেন? যতই হোক এখন সে আমগো রাজের বউ। আমারে সালাম দিলে সালামি দিমু না? রাজ শুনলেও খুশী হইবো। কই বউরে ডাকো। দেখি।”
“জিরান দে। আস্তে ধীরে দেহিস নবাবজাদিরে।”
হাসু নামধারী হাসেম ডাব,পিঠা আরো এটা সেটা খেলো। জমিদার বোন বলে কথা।
“ভাবি আপনারে খালাম্মার রুমে ডাকতাছে৷ তার ভাই আসছে। ”
বলল স্বল্পভাষী ফুলবানু। শিখা বিলম্ব না করে শাড়ির আঁচল মাথায় টেনে ছন্দপায়ে হেঁটে গেলো শাশুড়ির শয়ন কক্ষে। দেখলো সুফিয়া, আদুরী ও অপরিচিত একজন পুরুষ বসে খোশমেজাজে গল্প করছে।
“আসসালামু আলাইকুম। ”
শিখা মুখে সালাম দিলো।
সুফিয়া বিবি তিরিক্ষি গলায় বলল,
“তোমার দুলাভাই লাগেনি হে। মুখে সালাম দিলা যে? পা ধইরা কদমবুসি করো। তোমার মামাশ্বশুর। হাসেম। আমার ছোডোভাই। বিয়ার সময় কামের ঝামেলায় আইতে পারেনাই শহর থেইকা।”
শিখা তাড়াহুড়ো করে হাসেমের পা ছুঁয়ে সালাম দিলো। হাসেম শিখার দু’হাত ধরে দাঁড় করিয়ে নিলো। নিজের পাশে বসালো। অদ্ভুত চোখে শিখার আপাতমস্তকে নজর বুলিয়ে নিলো বার দুয়েক। শিখা নিচু মাথায় নম্রভাবে বসে আছে। সে আদুরী ও সুফিয়ার দিকে চেয়ে বলল,
“মাশাল্লাহ! চয়েজ আছে মিয়াভাইয়ের। এত কচি একখান মেয়ে রাজের বউ। আলহামদুলিল্লাহ। ”
সে ঘড়ির প্যাকেটটি শিখার হাতে গুঁজে দিয়ে বলল,
“নাও। তোমার সালামি উপহার। ”
শিখা নিতে চাচ্ছেনা। আদুরী বলল,
“বড়রা কিছু দিলে নিতে হয়। নাও।”
শিখা ঘড়িটি এবার রাখলো।
“নাম কি তোমার?”
“জ্বি শিখা।”
“পুরো নাম কি?”
“আয়েশা আখতার শিখা।”
সুফিয়া বলে উঠলো,
“তোর এত কথার দরকার আছে? ওর নাম দিয়া তোর কি কাম?”
“বুবু তোমার কাম থাকলে যাও। আমি নতুন বউরের সাথে একটু আলাপ সালাপ করি। তার বাপের বাড়ির গল্প শুনি।”
“বউ তুমি চইলা যাও। হাসু দুইদিন থাকবো। দেখা সাক্ষাৎ হইবো। বছর বাদে আইলো বইনের বাড়ি। দুইদিন না বেড়াইলে পোষায় না আমার ভাইয়ের।”
শিখাকে আদেশ করে বলল সুফিয়া। শিখা তড়িতেই উঠে চলে যায়। আদুরী বলল,
“মামা তার কাছে কি শুনবেন। সেতো বানিয়ে বানিয়ে গাল্পগল্প করবে বাবার বাড়ির। আমাদের কাছেই শুনেন তাদের পারিবারিক,সামাজিক,অর্থনৈতিক অবস্থার কথা।”
হাসেম অন্যমনস্ক হয়ে আছে। সুফিয়ার কথায় সম্বিত ফিরে পায়। সুফিয়া নাক সিঁটকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করে শিখার বাবার বাড়ির কথা জানালো ভাইকে।
হাসেম গোপনে লালসার চিত্তে ভাবলো,
“অল্পবয়েসী আলাভোলা ভীতু মেয়ে। এই ঘরে রাজ আর মিয়াভাই ছাড়া তারে কেউই পছন্দ করে না। বাপের বাড়িতে বাপ নাই,ভাই নাই। পায়ের তলার মাটি খুব দুর্বল। তার পক্ষ নিয়া প্রতিবাদ করার মতো কেউইতো নাই। রাজ থাকে শহরে। এত বড় ঘরে রাতে সবাই আধমরা হইতা ঘুমায়। এমন সুযোগ জীবনে আর কবে আসবো কে জানে। বাকির নামে ফাঁকি। ভবিষ্যতে কি হইবো তা ভাইবা বর্তমানের সুখ হইতে নিজেরে বঞ্চিত করা হবে বড়ই বোকামি। এই বোকামি আইজ কিছুতেই করা যাইব না।”
সেদিন রাতে শিখা কিছুক্ষন পড়াশোনা করলো। পৌরনীতির কিছু প্রশ্ন নোট করলো নোট খাতায়। তার রুমে কেউই দরকার না হলে আসেনা। তাই তার পড়ার বিষয় এখনো সবার অজানা। এখনো তাকে সবার সঙ্গে ডাইনিং টেবিলে খেতে ডাকা হয়না। কাজের লোক দিয়ে রিফুজি বা আশ্রিত পথিকের মতো করে থালা ভরে ভাত দিয়ে আসে। শিখা তাতেই সন্তুষ্ট রয় মনে কিছু ব্যথা পেলেও।
রাত্রি দ্বিপ্রহরের সূচনা হলো। রাজকে গভীরভাবে মনে পড়ছে শিখার। রোজ নিশিতেই এমন হয়। তার কিশোরী মন বড় উম্মনা উয়ে উঠে। রাজের ঠোঁটের একটু নিবিড় ছোঁয়াতেই সে ভেঙ্গেচুরে গুঁড়িয়ে গিয়েছে। আনমনা থাকে দিবানিশি। রাজ তার কাছে অচিনপুরের রাজকুমারের মতো। টগবগিয়ে এলো। রাজকন্যাকে দেখলো অল্পক্ষণ। ভালোবাসা, মায়া দিলো এক দরিয়া। আবার চলে গেলো দেশান্তরী হয়ে। কবে ফিরবে। কবে দর্শন হবে তাদের। তা অচিন্তনীয়।
শিখা ঘুম জড়ানো চোখে নেড়েছেড়ে রাজের দেয়া প্রীতি উপহারের হিরের আংটিটা দেখছে। চাঁদের ন্যায় কি অপরূপ দ্যুতি ছড়াচ্ছে আংটিটা। শিখার মনে হচ্ছে আংটিটার সঙ্গে তার সরু লম্বা পাঁচটি আঙ্গুলও জ্বলজ্বল করে জ্বলছে। সে নিঃশব্দে আপন মনে মিটিমিটিয়ে হাসলো।
হঠাৎ দরজায় টোকা পড়লো। শিখা শুনতে পেল না। ফের টোকা পড়লো আরেকটু শব্দ করে। শিখা ধড়মড়িয়ে উঠে গেলো।
“কে?”
শিখা দরজা খুলছে না। দাঁড়িয়ে আছে৷ আবার টোকা পড়লো।
“কে? কথা কন?”
“শিখা আমি তোমার মামা। একটু দরকার ছিলো।”
মামাশ্বশুর পিতার সমতূল্য। না খুললে বেয়াদবি হয়। তাই নবোঢ়া বধূটি দরজা খুলে দিলো। হাসেম ভিতরে ঢুকে পড়লো। চোরের মতো ফিসফিসিয়ে বলল,
“ঘুম আসতেছেনা। তাই ভাবলাম শিখা ঘুমিয়ে গেলো কিনা দেখি। আর ঘড়ি পছন্দ হইছে কিনা জেনে আসি।”
“হ্যাঁ মামা। খুব সুন্দর। পছন্দ হইছে।”
শিখা জড়োসড়ো হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
হাসেম বলল,
“ঘড়ি হাতে দাও এখন। দেখি কেমন লাগে?”
রাজবধূ পর্ব ৮
বলেই শিখার হাত টেনে ধরলো। শিখা তার দিকে চাইলো। দেখলো তার দু’চোখ রক্তজবার মতো লাল হয়ে আছে। কথাগুলোও কেমন জড়িয়ে যাচ্ছে। বুঝলো এই ব্যাটা মনে হয় তাড়ি খাইছে। এসব খাইলে হুঁশ জ্ঞান থাকে না। শিখা এক ঝটকায় হাত ছাড়িয়ে নিলো।
“মামা আপনি এখন যান। দিনে ঘড়ি দেখবেন।”
কিন্তু হাসেম বের হলো না। দরজা বন্ধ করে দিলো ভিতর থেকে। শিখা ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে করুণ গলায় ‘আম্মাগো’ বলে চিৎকার দিলো।
মাঝরাতে চারদেয়াল ভেদ করে শিখার আর্তচিৎকার কারো কানেই পোঁছাল না। কেবল অশরীরী আত্মার মতো শিখার সেই নৈরাশ্যবাদী চিৎকার দেয়ালেই ঘুরলো প্রতিধ্বনি হয়ে।