ধরিয়া রাখিও সোহাগে আদরে পর্ব ১৩

ধরিয়া রাখিও সোহাগে আদরে পর্ব ১৩
জেনিফা চৌধুরী

“বাবা হয়ে নিজের মেয়েকে কিডন্যাপ করেছেন, মিস্টার আহিল? এত জঘন্য আপনি? আপনার জন্য আজ পুরো জাতি ‘বাবা’ নামক মানুষটাকে নিয়ে ভয়ে থাকবে।”
মেহরিশের ঘৃণিক বাক্যের কথাগুলো শুনে আহিল থমকে গেল। মাথা ভনভন করে ঘুরতে শুরু করল। কানে বাজতে লাগল,
‘বাবা হয়ে নিজের মেয়েকে কিডন্যাপ করেছেন?’

তার মানে আনায়াকে কেউ কিডন্যাপ করেছেন? এইটুকু বাচ্চাকে কেউ কিডন্যাপ করেছেন? ভেবেই আহিল কেঁপে উঠল। বুকের ভেতরটা ধক করে উঠল। শরীর কেমন কাঁপতে শুরু করল। যতোই হোক আহিলের অস্তিত্ব আনায়া। আনায়ার কোনো ক্ষতি করার কথা আহিল স্বপ্নেও ভাবতে পারে না। সেখানে আহিল নাকি আনায়াকে কিডন্যাপ করেছে? ভাবতেই পারছে না। মেহরিশ এত জঘন্য একটা অপবাদ কিভাবে দিচ্ছে? আহিলের গলা দিয়ে স্বর বের হচ্ছে না। তবুও থেমে থেমে বলে উঠল,
“আমার মেয়েকে আমি কিডন্যাপ করেছি____এমন কথা তুমি ভাবতে পারলে, মেহরিশ?”
মেহরিশ আগের ন্যায় বলল,

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

“শুধু ভাবতে পারিনি, আমি জানি এই কাজটা তুমিই করেছো। তুমি ছাড়া আমার কোনো শত্রু নেই।”
আহিল কেশে উঠল। গলা পরিষ্কার করে নিয়ে বলল,
“মেহরিশ! আনায়া আমার মেয়ে।”
“তুমি মানো?”
মেহরিশের পাল্টা প্রশ্নে আহিল খুব দৃঢ় বাক্যে বলে উঠল,
“অবশ্যই মানি। আনায়া আমার রক্ত। আমার অস্তিত্ব। হ্যাঁ, আমার তোমার সাথে শত্রুতা। ক্ষতি করার হলে এতদিনে আমি তোমার ক্ষতি করতাম। কিন্তু আনায়া আমার মেয়ে। পুরো পৃথিবী মিথ্যা হলেও আনায়া আমার একমাত্র সত্য।”
মেহরিশের কণ্ঠ স্বর এবার নরম হলো। সত্যিই তো! আনায়ার ক্ষতি করার হলেও আহিল এতদিনেই করতে পারতো। মেহরিশ এবার আরো একবার কেঁপে উঠল। তাহলে কে এই অদৃশ্য শত্রু? চেনা কেউ নাকি অচেনা কেউ? মেহরিশ ফোন রেখে দেওয়ার জন্য তৈরি হতেই ওপাশ থেকে আহিল ব্যস্ত স্বরে প্রশ্ন করল,

“আনায়ার কি হয়েছে, মেহরিশ?”
মেহরিশ থমকাল। কি উত্তর দিবে ভেবে পাচ্ছে না। আহিল এবার ধমকে উঠে পুনরায় জিজ্ঞেস করল,
“আমার মেয়ে কোথায়?”
কথাটা একটু উচ্চস্বরেই বলল আহিল। মেহরিশের নিঃশ্বাস আটকে আসছে৷ পৃথিবীটা ঘুরছে। মস্তিষ্ক প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার জন্য কোনোরকম কাজ করছে না। তবুও কোনোরকমে থমকে থমকে উত্তর দিল,
“আনায়া আজ প্রায় ৪দিন হলো মিসিং।”
আহিল থমকে উঠে বলে উঠল,
“কি? মিসিং? আল্লাহ! কবে থেকে? কিভাবে হলো? আর তুমি আমাকে একবার জানানোর প্রয়োজন মনে করলে না? আনায়া আমারও সন্তান। তোমার আর আমার সাথে সম্পর্ক নষ্ট হয়েছে। কিন্তু আনায়ার উপর আমার সম্পূর্ণ অধিকার আছে__এটা ভুলে যেও না। ”
মেহরিশ উত্তর দিতে পারলো না। সত্যিই তো জানানোর দরকার ছিল। কিন্তু মেহরিশ তো জানানোর পরিস্থিতিতে ছিল না। মেহরিশ এবার আস্তে ধীরে সবটা খুলে বলল। সবটা শুনতে শুনতে আহিলের চোখের কোন বেয়ে কখন যে জল গড়িয়ে পড়েছে আহিল তা খেয়াল করেনি। মন, মস্তিষ্ক জুড়ে চিন্তা ভর করল। আনায়া ঠিক আছে তো?

সায়র এক গ্লাস পানি মেহনূরের দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল,
“মেহনূর শান্ত হও। পানিটা খেয়ে নাও। আমরা একটু ঠান্ডা মাথায় ডিসকাশন করি।”
মেহনূর পানিটা নিল। চেয়ারে বসে পানিটা সম্পূর্ণ ঢকঢক করে গিলে ফেলল। বড় করে নিঃশ্বাস ছাড়ল। মুন্না শান্ত বাক্যে জিজ্ঞেস করল,
“ব্যাটার ফিল করছেন, মেহনূর?”
মেহনূর উত্তর দিলো না৷ কটমট দৃষ্টিতে তাকাল মুন্নার দিকে। সায়র এবার মেহনূরকে প্রশ্ন করল,
“মেহনূর, আমি তোমাকে কিছু প্রশ্ন জিজ্ঞেস করব। ভেবেচিন্তে ঠিকঠাক উত্তর দিবে। ওকে?”
মেহনূর মাথা নাড়ল। অর্থাৎ ‘হ্যাঁ ’। সায়র গলা পরিষ্কার করে নিয়ে প্রথম প্রশ্ন করল,
“আংকেল বা আন্টি তোমাদের আসল বাবা মা, শিওর?”
মেহনূর প্রচন্ড বিরক্ত হলো। বিরক্তিতে কপাল কুঁচকে এলো। বিরক্তস্বরে বলল,
“অদ্ভুত! বাবা-মা আবার আসল নকল হয় বুঝি, সায়র ভাইয়া?”
সায়র হালকা হাসার চেষ্টা করে। পুনরায় বলে উঠল,
“আমাকে বিশ্বাস করো?”

মেহনূর এবার নরম বাক্যে জবাব দিল,
“আপনাকে আমি নিজের ভাইয়ের মতো ভাবি, সায়র ভাই। তাই আপনাকে বিশ্বাস না করার প্রশ্নই উঠে না।”
“তাহলে প্লিজ আমি যা জিজ্ঞেস করব একটু ভেবেচিন্তে উত্তর দাও।”
মেহনূর মাথা নাড়ল শুধু। সায়র পুনরায় জিজ্ঞেস করল,
“দেখো আমাদের চারপাশে অজানা এমন অনেক কিছু আছে। আমাদের দেখার বাইরেও কিছু সত্য থাকে। অনেক সময় সেসব সত্য সামনে আসলে আমাদের মেনে নিতে কষ্ট হয়।”
মেহনূর এবার অসহায় বাক্যে বলল,
“তাই বলে আমার বাবাকে সন্দেহ করবেন, সায়র ভাই?”
সায়র শান্ত বাক্যে জবাব দিল,

“আমি সন্দেহ করছি না, বোন। সব প্রমাণ আংকেলের সপক্ষে।”
মেহনূর আর উত্তর দিল না। মুন্না এবার বলে উঠল,
“আপনি কি আপনার বোনের মেয়েকে সুস্থ ভাবে ফেরত চান?”
মেহনূর কাঠকাঠ গলায় বলল,
“আপনি আমার জায়গায় থাকলে কি সুস্থ ভাবে ফেরত চাইতেন না?”
মুন্না থেমে গেল৷ মিনমিন করে বলল,
“ধানি লংকা একটা।”
সায়র এবার বলল,

“মেহনূর তোমার কাজ হলো আংকেল ও আন্টির চুল এনে আমাদের দেওয়া। আমাদের কনফিউশান দূর করার জন্য ডি.এন.এ টেস্ট একমাত্র উপায়। এখনেই মেহরিশকে কিছু বলার দরকার নেই। আরো অনেক প্রমাণ দরকার। নিজেকে যেকোনো ধাক্কা সামলানোর জন্য প্রস্তুত রাখো, মেহনূর।”
বলেই উঠে দাঁড়াল। পরক্ষণেই একটু থেমে বলল,
“একটা খুশির সংবাদ দেই, আনায়া যেখানে আছে সুস্থ আছে। খুব শিঘ্রই আমরা আনায়াকে ফিরে পাবো।”
মেহনূর খুশিতে দাঁড়িয়ে পড়ল। ঠোঁটের কোনে হাসির ঝলক দেখা দিল। প্রফুল্লচিত্তে প্রশ্ন করল,
“সত্যি?”
মুন্না বলে উঠল,
“আমরা ফেক নিউজ দেই না।”
মেহনূর বিরক্তিতে মুখ বাঁকাল। সায়র মেহনূরকে নিয়ে বেরিয়ে আসল।

ডাক্তার আনায়াকে দেখে চিন্তিত স্বরে বলে উঠল,
“ওর মা কে?”
পাশে থাকা লোকটা বলল,
“ডাক্তার, আমাকে বলেন কি হয়েছে? এনিথিং রং?”
ডাক্তার চিন্তিত বাক্যে বলে উঠল,
“বাচ্চাটাকে আজকের মধ্যে হসপিটালে এডমিট করা দরকার। বাচ্চাটার গায়ে জ্বর ১০২°। এভাবে রেখে দিলে যেকোনো খারাপ কিছু ঘটতে পারে।”
লোকটা ভয় পেলো খানিকটা। ডাক্তার কিছু ঔষধ সাথে কিছু বিধিনিষেধ লিখে দিয়ে বার বার বলে গেলেন হসপিটালে নিয়ে যাওয়া জন্য। ডাক্তারকে বিদায় দেওয়ার সাথে সাথে রুমে প্রবেশ করল মুক্তা। আনায়া কাঁদছে। আনায়ার কান্নাতে চারপাশটা ভারী হয়ে আছে। কিছুতেই থামানো যাচ্ছে না। মুক্তা আনায়াকে শান্ত করার বৃথা চেষ্টা করতে করতে অসহায় স্বরে বলে উঠল,
“স্যার, ওকে ওর মায়ের কাছে দিয়ে আসুন না প্লিজ। তার বদলে আপনি আমার জীবন নিয়ে নিন। তবুও বাচ্চাটার কোনো ক্ষতি করবেন না, প্লিজ।”

কথাটা বলতে না বলতেই মুক্তার কপালে সজোরে কোনো ভারী বস্তু আঘাত হানল। হঠাৎ আঘাতে মুক্তার টাল সামলাতে একটু সময় লাগল। খেয়াল করল মাটিতে একটা মোবাইল পড়ে আছে। তার মানে লোকটা মুক্তাকে মোবাইল ছু°ড়ে মে°রেছে। কপাল কী কেটে গেছে? মাথাটা কেমন ঝিমঝিম করছে। হয়তো কাটেনি। কিন্তু টের পেল কপালের মাঝ বরাবর গোলাকার মাংশ পিন্ড শক্ত হয়ে ফুলে উঠছে। ব্যাথায় চোখ বেয়ে পানি পড়ছে। আনায়া একাধারে কেদেই চলেছে। লোকটা এবার বিরক্তিতে চেঁচিয়ে বলল,
“ওকে এক্ষুনি আমার চোখের সামনের থেকে নিয়া যা। ওর কান্না সহ্য হচ্ছে না আমার। নিয়া যা। নয়তো ব°ন্ধুকের সবগুলো গু°লি ওর গায়ে বসবে।”

মুক্তা ভয়ে কেঁপে উঠল। আনায়াকে বুকে আগলে কাঁদতে কাঁদতে রুম থেকে বেরিয়ে গেল। লোকটা রাগ সামলাতে না পেরে দেয়ালে ঘু°ষি মে°রে চিৎকার করে বলে উঠল,
“আমার কেন মায়া হচ্ছে? কেন? আমি কেন এখনো বাচ্চাটাকে মা°রতে পারছিনা? কেন বাঁচিয়ে রেখেছি? কি হয়েছে আমার? আমি তো চাই বাচ্চাটা যেন ম°রে যায়। তাহলে কেন মে°রে ফেলতে পারছি না।”

মাঝরাতে বাচ্চার কান্নার শব্দে ঘুম ভেঙে গেল মেহরিশের। ঘুমের ইঞ্জেকশন দিয়ে মেহরিশকে ঘুম পাড়িয়ে রাখা হয়েছিল। তবুও ভেঙে গেল। মেহরিশ লাফিয়ে উঠে বেডে বসতেই দেখল কেউ একজন নিচে বসে বেডে মাথা রেখে শুয়ে আছে। মেহরিশকে উঠে বসতে দেখে মানুষটা ধড়ফড়িয়ে উঠল। এবার মেহরিশ মানুষটাকে খেয়াল রাখল। সায়র মেহরিশকে উঠে বসতে দেখে চিন্তিত বাক্যে জিজ্ঞেস করল,
“মেহরিশ, কি হলো? ঠিক আছেন আপনি?”
মেহরিশ হাঁপাতে হাঁপাতে বলে উঠল,
“সায়র, আনায়া! আনায়া!”

ধরিয়া রাখিও সোহাগে আদরে পর্ব ১২

বলতে বলতে মেহরিশ বিছানায়া থেকে নেমে পড়ল। ছুটে বেরিয়ে গেল ঘর থেকে। সায়র ধরতে চেয়েও পারল না। মেহরিশের পেছন পেছন নিজেও ছুটে আসল। মেহরিশ দৌড়ে এসে সোজা মেইন ডোর খুলল। মেইন ডোর খুলতেই অবাক হয়ে গেল। দরজার সামনে আনায়া। আনায়া কাঁদছে। কাঁদতে কাঁদতে গলা বসে গেছে বাচ্চাটার। সায়রও মেহরিশের পেছন পেছন ছুটে এসে আনায়াকে দেখে থমকে গেল। এটা কী সত্যিই আনায়া? নাকি চোখের ভ্রম?

ধরিয়া রাখিও সোহাগে আদরে পর্ব ১৪