প্রথম ভালোবাসার সুর পর্ব ২১

প্রথম ভালোবাসার সুর পর্ব ২১
অনুসা রাত

-“যদি নুন্যতম লজ্জাবোধ আপনার থাকতো তাহলে আপনি বারবার আমাকে এসব বলার সাহস পেতেন না আন্টি।ঠিক কতবার আপনাকে আংকেল কতকিছু বলেছে।এমনকি আপনার ছেলে পর্যন্ত এখন আপনার সমস্ত অন্যায়কে আর সহ্য করতে পারছে না।”
এমন সময় শাহীন খান ও এসে উপস্থিত হলো ড্রয়িংরুমে। শেহনাজ পারভীন তখনো চুপচাপ ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে আছে। নাজমা বেগমও কিছু বলছে না।
-“আমি মানছি আমার একটা সমস্যা রয়েছে। কিন্তু তাই বলে আপনারা বারংবার আমাকে এটা নিয়ে এভাবে খোঁচা দিতে পারেন না।আমি শুরু থেকে যাচ্ছি, আন্টি আমাকে এত এত কথা শোনান।কেন আন্টি?আগে তো আপনি আমাকে ভীষণ আদর করতেন।আমি আপনার হাসবেন্ডের বন্ধুর মেয়ে বলে?নাকি আদৌ আমাকে নিজের মেয়ের মত ভাবতেন বলুন তো।”
শাহীন খান শেহনাজ পারভীনের দিকে একবার তাকিয়ে বললেন,

-“কি হয়েছে আবার?আচ্ছা,ঘরে অশান্তি না করে কি তোমরা থাকতে পারো না?”
-“আজ আমার একটু কথা বলতে দিন আংকেল। প্লিজ।দেখুন আন্টি,চুপ করে থাকার মত মেয়ে আমি না।নিজের ঘরে রাজকন্যার মত বড় হয়েছি।চাইলে প্রথম দিন থেকেই উত্তর দিতে পারতাম।দিইনি দুটো কারণে।এক তো আপনি আমার বড়।আর দ্বিতীয়ত,আমার পারিবারিক শিক্ষা। আমার মা আমাকে ফোন করে বলেছিল যেন আমি আপনাদের সব কথা মুখ বুঝে সহ্য করে নিই।”
আরবাজ প্রশ্ন করে বসলো,

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

-“ফোন কোথায় পেলে মেহের?”
-“আমার একটা বাটন ফোনও আছে।সেটা সবসময় আমি আমার ব্যাগে থাকে।”
শেহনাজ পারভীন শাহীন খান কে উদ্দেশ্য করে বললেন,
-“তোমার সামনে কতকিছু বলছে।আজও ওর হয়েই কথা বলবে?”
শাহীন খান কিছু বলার আগেই মেহের বলতে লাগলো,
-“আপনি ভুল করছেন আন্টি।আমার সাইড নেয়ার কারোরি দরকার নেই।আর নাজমা আন্টি,আপনি আমাকে ঠিক যতটা মিডল ক্লাস মনে করেন,আমি কিন্তু ততটা নই।আপনি আমাকে একটু বেশিই নিচু মনে করেন।আফসোস,আজ আমি আপনার মত উচ্চবিত্ত হতে পারলাম না।পারলে তো নিজের বোনের বাড়িতে মাসের ২০ দিন থাকতাম।তাও আবার ছেলের বউ নিয়ে।”
নাজমা বেগম ফুঁসে ওঠে বললেন,

-“তুমি আমাকে এত বড় কথা বললে!দেখলি আপা?তোর বাসায় থাকতেও আমাকে খোঁটা শুনতে হচ্ছে। আমি কি তোমারটা খাই যে তুমি আমায় কথা শোনাচ্ছ। ”
-“সে হিসেবে তো আমিও বলতে পারি আন্টি।আমিও কিন্তু আপনাদের টা খাই না।আমার বরের টাকায় চলি।আমার শ্বাশুড়ির কথা নাহয় বাদ ই দিলাম।আপনার কিন্তু কোনো অধিকার নেই আমাকে এতকিছু বলার।”
-“তুমি অতিরিক্ত কথা বলছো।আমার বোনকে এতকিছু বলছো।আরবাজ! তুই এখনো চুপ করে থাকবি?”
-“আরবাজকে কিছু বলতে হবে বা আন্টি।আমি আপনাকে জাস্ট কিছু কথা বলব।আজ এমনিতেও সাধের অনুষ্ঠান।আমি সময় নষ্ট করব না।একটু পর মেহমান আসবে।”

-“কি বলবে তুমি?কি বলতে বাকি রেখেছো?”
শেহনাজ পারভীনের এমন কথা শুনে মেহের হালকা হাসলো।দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললো,
-“আন্টি,আপনি সবসময় চেয়েছিলেন ঘরে একটা ভালো বউ আনতে।মূলত ভালো বউ না,এমন বউ যে কিনা আপনাকে নাতি-নাতনি দিতে পারবে।”
-“দেখো মেয়ে,সব মায়েদের ই এমনই ইচ্ছে থাকে।বউমা আসবে, নাতি-নাতনি হবে।”
-“সেটা আমি জানি আন্টি।কিন্তু আমার দিকটা কি কখনো ভেবে দেখেছেন আপনি?কখনো আমার জায়গায় নিজেকে একটু বসিয়ে দেখুন।যদি আপনার সাথে এমন হত আর আপনার বিয়ের পরদিন থেকে আপনার শ্বাশুড়ি এমন জরত তাও বাহিরের একজন মহিলা নিয়ে কেমন লাগত আপনার?”
নাজমা বেগম আবারো ফুঁসে ওঠে বললেন,

-“দেখলি,আবার আমাকে বাজে কথা বলছে।থাকবোই না আমি।”
কথাগুলো শেহনাজ পারভীনের কর্ণপাত হলো কিনা বোঝা গেল না।মেহের আবার বলতে লাগলো,
-“আল্লাহ না করুন,আজ যদি আপনার মেয়ের সাথে এমন হত?একটা বাচ্চাই কি সব আন্টি?আমি কি কম কাঁদি?আপনি যেমন রেগে আছেন,আমি তেমন কষ্ট পাচ্ছি। একজন মেয়ের জন্য সবচেয়ে সম্মানের হলো মা হওয়া।আর আমি সেই ফ..ফিলিং ট..টা ক..ক..কখনো পাব না।আ..আমার কি ক..কষ্ট হচ্ছে না?”
বলতে বলতে মেহের নিচের দিকে তাকিয়ে ফুপিয়ে কেঁদে ফেললো। শেহনাজ পারভীন তখনো চুপ করে রইলেন।মেহের নিজেকে সামলে নিল। তারপর চোখ মুছে বললো,

-“যাক গে সেসব। আপনারা মনে করেন যে মা হতে না পারাটা আমার ব্যার্থতা।কিন্তু আমি তো ইচ্ছে করে নিজের ভাগ্য লিখিনি।উপরওয়ালা আমার ভাগ্যে লিখেছেন।লিখেছেন আরবাজের সাথে বিয়ে হওয়ার কথা।লিখেছেন, আমি ঠিক কিভাবে অপমানিত হব সেসব। কিন্তু নিশ্চয়ই কষ্টের পর সুখ।আমি জানি,আল্লাহ হয়ত আমার জন্য ভালো কিছুই লিখে রেখেছেন।”
মীরারও চোখে পানি চলে এলো মেহেরের এমন কান্না শুনে। মেহেরের পিছনে দাঁড়িয়ে কাঁধে দুই হাত দিয়ে মীরা বলে উঠলো,
-“কেঁদো না ভাবী।”
মেহের নাক টেনে বললো,
-“যেখানে মায়েরা মেয়ের কষ্ট বোঝে না সেখানে মেয়েরা আর কতক্ষণ টিকবে?আমার জার্নিটা এই অবধিই ছিল।আপনারা ভালো থাকবেন আন্টি।আমি চলে যাব নিজের বাসায়।তাও আজই।আপনাদের শুভ কাজের মধ্যে আমি অশুভ হয়ে থাকতে চাই না।আপনারা ভালো থাকুন এটাই চাই।কারণ মেয়ে হয়ে তো মায়ের খারাপ চাইতে পারি না।এসেছিলাম তো বউ হয়েই।মুখে যতই আন্টি বলি,ভাবি তো মা-ই।”
নাজমা বেগম অবাক আর খুশি হয়ে বললেন,

-“সত্যি তুমি চলে যাবে?”
-“জ্বী আন্টি।চলে যাব আমি।”
মীরা অবাক হয়ে বললো,
-“এসব তুমি কি বলছো ভাবী?চলে যাবে কেন?”
-“এবার কিন্তু বেশি হচ্ছে মেহের।”
শাহীন খানের কথা শুনে মেহের ওনার দিকে এগিয়ে গেলো।তারপর বললো,
-“আপনি সবসময় আমাকে নিজের মেয়ের মত ভেবেছেন।আপনার প্রতি আমার অনেক ঋণ।আপনি
চেয়েছিলেন আমি যেন হাজার অপমানের পরেও এখানে টিকে থাকতে পারি।কেননা এটা আমার সংসার।কিন্তু বাবা,যেখানে আমি অপয়া,অশুভ।আর সেটা মায়েরা নিজেরাই বলেন।মা হয়ে কষ্ট বোঝেন না।সেখানে আমি কি করে থাকব?”

-“তাই বলে তুই চলে যাবি মা?তোকে আমি কত আশা দিয়ে এনেছি।তোর বাবা-মায়ের কত আশা যে আমি তোকে আমার বাড়ির রাণী করে রাখব।”
-“রাণী তো হবই।হয়ত নিজের ঘরে।এটা তো আমার ঘর না।এতদিন ভাবতাম আমি আমার ঘর।কিন্তু আমার না।”
-“আমি কি বলব বুঝতে পারছি না।শুধু চাই,তুই যাস না।”
-“থেকে কি করব বাবা?”
-“সংসার করবি।আরবাজ আছে।”
-“সংসার টা আর আমার হবে না আংকেল।যেখানে আমার সম্মান নেই সেখানে আমি থাকব না।আমি এখনই লাগেজ আনছি।গোছানোই ছিল।”
বলতে বলতে মেহের চলে গেল ঘরের দিকে। শেহনাজ পারভীন চুপ করে বসে পড়লেন সোফায়।নাজমা বেগম বলতে লাগলেন,
-“আপা,এবার তো আরো ভালোই হলো।পথের কাটা নিজেই সরে গেল।”
শেহনাজ পারভীন হাতের ইশারায় ওনাকে থামিয়ে বললেন,

-“একটু চুপ কর।”
শাহীন খান বলতে লাগলেন,
-“এতকিছুর পরেও যদি তুমি ঘরের লক্ষ্মী আর অলক্ষ্মীর মধ্যে পার্থক্য না করতে পারো শেহনাজ।আ
তাহলে বুঝে নেব এতদিন আমি একটা পাথরের সাথে সংসার করেছি।”
বলেই চলে গেলেন মেহেরের ঘরে।শেহনাজ পারভীন ওনার যাওয়ার দিকে তাকিয়ে রইলেন।
আরবাজ তখনো চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে।মীরা আরবাজের পাশে দাঁড়িয়ে বলতে লাগলো,
-“চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছিস যে?”
-“…..”
-“তোরও তো আনন্দ হওয়ার কথা।”
-“মানে?”(ভ্রু কুঁচকে)
-“তুই হয়ত মানবতার খাতিরে ভাবীর জন্য প্রতিবাদ করেছিস।কিন্তু কখনো কি স্ত্রীর মর্যাদা দিয়েছিস?”
-“ছোট, ছোটর মত থাক মীরা।”
-“এতটাও ছোট না আমি ভাইয়া।ভাবীকে রোজ কাঁদতে দেখেছি আমি।মেয়েটা তো তোর সাথে সংসার করতেই চেয়েছিলো।দেখ,বিয়েটা তো হয়েই গেছে। এমনিতেও কোনোদিন তো বিয়ে করতিই।তখন কি মানিয়ে নিতিস না?তাহলে এই মেয়েটা কি দোষ করেছে?ওর দোষ কি ওই একটাই?মা হতে পারবে না।তুইও তো তাহলে আমার মায়ের মতই হলি।”

-“না জেনে না বুঝে কিছু বলবি না।”(দাঁতে দাঁত চেপে)
-“আমি সবটাই জানি।তুই তোর অহংকারের জন্য নিজের ফিলিং টা প্রকাশ করছিস না।তুই কি ভালোবাসিস না ভাবীকে? আমি ছবি দেখেছি তোর ফোনে।”
আরবাজ আশ্চর্য হয়ে গেল মীরার কথা শুনে।মীরা হালকা হেসে বললো,
-“ভালো যদি বেসেই থাকিস,তাহলে বলে দেখ না।দেখ মেয়েটাও তোকে কতটা আপন করে নেয়।যদি তুই একবার ভালোবাসিস ওকে,তাহলে শত লাঞ্ছনার পরেও ও এখানে পড়ে থাকবে! ”
-“…..”
-“ভাবীর মত মেয়ে হয় না। ও চলে যাবে।তুই আটকাবি না?”
-“চলে যেতে চাইলে আমি আটকে কি করব?”
-“ওহ হ্যা তাই তো।তুই তো আর ভালোবাসিস না।কিন্তু আমি চাই মেহের আপুর জীবনে ভালোবাসার মানুষ আসুক।”
আরবাজের ভ্রু কুঁচকে গেল।তারপর বললো,
-“তুই ওকে আপু ডাকছিস কেন আবার?”
-“ও চলে যাওয়ার পর নিশ্চয়ই কোনো একদিন না একদিন ওর জীবনে ভালো একজন মানুষ আসবে। তাই এখন থেকেই আপু ডাকার প্রেকটিস করছি।ভাবী তো ডাকতে পারব না।”

-“ভালো মানুষ আসবে মানে? “(অবাক হয়ে)
-“ন্যাকা সাজিস না ভাইয়া।ও কি তোর জন্য সারাজীবন বসে থাকবে নাকি?”
-“মানেটা কি?”
-“ও সংসার করবে না?”
-“…..”
-“আই ওইশ ওর জীবনে এমন কেউ আসুক যে ওকে মর্যাদা দিবে।সম্মান দিবে আর অনেক ভালোবাসবে!”
মীরার কথা শুনে আরবাজ চুপ হয়ে গেল।মেহের ওর সামনে দিয়ে ব্যাগ নিয়ে চলে গেল।আরবাজ সেভাবেই দাঁড়িয়ে রইলো।কিছুই বললো না।তবে মীরার কথাগুলো ওর মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে।মেহের যাওয়ার আগে দরজায় দাঁড়িয়ে পিছনে ফিরে বললো,
-“আরবাজ?”
আরবাজ মাথা তুলে তাকালো মেহেরের দিকে।আরবাজ ভাবলো মেহের হয়ত তাকে ভালোবাসে।কিন্তু মেহের বলে উঠলো,

-“ভালো থাকবেন।আর কোনোদিন হয়ত দেখা হবে না।আর ডিভোর্স লেটার টা পাঠিয়ে দিয়েন।আজ থেকে আপনাকে মুক্ত করে দিলাম।আর কোনোদিন আপনার আমার জন্য কিছু করতে হবে না।সেদিন আমার হয়ে কথা বলার জন্য থ্যাংকস।জানি,আপনি আমার সম্মান বাঁচাতে সেদিন এতকিছু করেছিলেন।আর আন্টি?”
শেহনাজ পারভীন মুখ তুলে তাকালো মেহেরের দিকে।মেহের চোখ মুছতে মুছতে বললো,
-“হয়ত অনেক বাজে কথা বলেছি,অপমানও করে ফেলেছি।মাফ করে দিয়েন।আপনার ছেলে আপনারই থাকলো।আসি আংকেল।বায় মীরা।”
বলে মেহের কাঁদতে কাঁদতে চলে গেলো।মীরা আর চোখের পানি ধরে রাখতে পারলো না।সবার সামনে দাঁড়িয়ে তার মা আর আরবাজকে উদ্দেশ্য করে বললো,

প্রথম ভালোবাসার সুর পর্ব ২০

-“হয়েছে শান্তি?এবারে থাকো শান্তিতে।বাবা,আমি হোস্টেল যাচ্ছি,তুমি ব্যবস্থা করো।”
বলে মীরাও কাঁদতে কাঁদতে চলে গেল।আরবাজ ঠাঁই দাঁড়িয়ে রইলো।আজ তার নিজেকে ভীষণ একা লাগছে।এতটা একা তার কোনোদিন লাগে নি।কেমন হচ্ছে এমনটা?বুকের ভিতরটা যেন কষ্টে ফেটে যাচ্ছে। মনে হচ্ছে কেউ ভারী পাথর রেখে দিছে।

প্রথম ভালোবাসার সুর পর্ব ২২