প্রেমপিপাসা পর্ব ৫
সুমাইয়া সুলতানা
হ্যাভেন ব্যস্ত পায়ে দরজা খুলে দিল। দরজার সম্মুখে সায়রা অধরে হাসি বজায় রেখে দাঁড়িয়ে আছেন। পরিপাটি শাড়ি পরা, চোখেমুখে লেপ্টে রয়েছে একরাশ মুগ্ধতা। দেখে মনে হয় না, তার এত বড়ো ছেলে আছে, আর সে ভার্সিটিতে পড়ে। বয়সের ছাপ এখনো সুন্দরী নারীর দেহভাগে বসতি স্থাপন করতে সক্ষম হয়নি! এখনো কুড়ি বছরের যুবতী নারী মনে হয়।
এসময় চাচি’কে দেখে কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে গেল হ্যাভেন। তবুও সামান্য হেসে জিজ্ঞেস করলো,
” কিছু বলবে কাকীমা? ”
সায়রা মুচকি হেসে মৃদুস্বরে বললেন,
” তোমার বউয়ের সাথে কথা বলতে আসলাম। সময় সল্পতার জন্য আলাপ করতে পারি নি। ”
হ্যাভেন মাথা নেড়ে সম্মতি জানায়। শান্ত কন্ঠে বলল,
” তোমরা কথা বলো। আমি একটু আসছি। ”
বলে মোবাইলটা হাতে তুলে, অন্য হাত ট্রাউজারের পকেটে গুঁজে দিল। ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে যায়।
রুমে ঢুকে সায়রা দেখলেন অরু বিছানার পাশে চুপচাপ বসে আছে। হাতে একটা বই। বইটা হ্যাভেনের বইয়ের তাক থেকে সময় কাটানোর জন্য নিয়েছে। সায়রা ধীর পায়ে এগিয়ে এসে বিছানায় অরুর পাশে বসে পড়লেন। অরু বইটা পাশে সরিয়ে সায়রার দিকে তাকাল, চোখে কৌতূহল এবং সামান্য অস্বস্তি।
অরুর গালে হাত রেখে সায়রা গভীর দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ অরুর মুখবিবর পর্যবেক্ষণ করলেন। স্মিথ হেসে বলে উঠলেন,
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
” তুমি তো দেখতে ভারী সুন্দর! হ্যাভেনের পছন্দ আছে বলতে হবে। এমনি এমনি আমাদের হ্যাভেন তোমাকে বিয়ে করার জন্য পাগল হয়নি! ”
অরু কিঞ্চিৎ লজ্জা পেলো। জোরপূর্বক হাসার চেষ্টা করল। কিছু বলল না।
” আমাকে চেনো? ”
অরু মাথা নেড়ে না বুঝালো।
” আমি হ্যাভেনের কাকীমা। তার ছোট চাচার বউ। সায়রের মা। তুমিও আমাকে কাকীমা বলে সম্বোধন করতে পারো। ”
অরু এবারেও নিশ্চুপ। কি বলবে সে? বলার মতো কিছু থাকলে তো বলবে! তবে জিজ্ঞাসা করার মতো অনেক কিছুই মস্তিষ্কের ভেতর দাপাদাপি করছে। কিন্তু এখন সেসব কথা জিজ্ঞেস করা উচিত হবে বলে মনে করছে না। মনে দ্বিধা কাজ করছে!
অরুকে চুপ থাকতে দেখে, সায়রা নিজেই বললেন,
” তুমি কি সবসময় চুপচাপ থাকো? কারো সাথে কথা বলো না? আমি আসায় অস্বস্তি অনুভব করছো কি? ”
অরু তুরন্ত চঞ্চল কন্ঠে জবাব দিল,
” না তেমন কিছু না। আসলে আপনাদের কাউকে সেভাবে চিনি না। তাই…”
” বুঝতে পেরেছি। চিন্তা করো না। আস্তে আস্তে সব জড়তা-সংকোচ ভেঙে যাবে। ”
অরুর মধ্যে কোনো ভাবান্তর হলো না, চুপ করে আছে। সায়রা একটা হাত অরুর হাতের উপর রাখলেন। অরু চমকে ওঠে। চক্ষুদ্বয় প্রশ্নবিদ্ধ দৃষ্টিতে চেয়ে রয়েছে সায়রার দিকে। অরুর চাউনী দেখে স্বল্প হাসলেন সায়রা। কোমল স্বরে বলে উঠলেন,
” সংসার মানে শুধু ভালোবাসা না, অনেক দায়িত্ব। আবার ভালোবাসা না থাকলে সেই সকল দায়িত্ব কর্তব্য যথাযথ সম্মানের সহিত পালন করা যায় না। তুমি বুঝতে শিখেছো, অরু। জীবনে চলতে গেলে অনেক কিছু মানিয়ে নিতে হয়। হ্যাঁ, ইচ্ছার বিরুদ্ধে কোনো কিছু মানিয়ে নেওয়া ততোটা সহজ নয়, অনেক কঠিন। ”
এতটুকু বলে সায়রা তপ্ত শ্বাস টানলেন। অরু চুপ করে শুনছিল, তবে মুখে কোনো স্পষ্ট প্রতিক্রিয়া নেই। চোখের পলকহীন চাহনি বুঝিয়ে দেয় সে মনোযোগ দিচ্ছে। মাঝে মাঝে মাথা নেড়ে সায়রার কথার সাথে সায় দিচ্ছে। যদিও ভেতরে বিরক্তি ধীরে ধীরে জমা হচ্ছিল।
সায়রা অধরে হাসি ফুটিয়ে, মুখবিবর সিরিয়াস করে নরম গলায় পুনরায় বললেন,
” হঠাৎ বিয়ে হয়ে যাওয়ায় তুমি হয়তো হ্যাভেন’কে মেনে নিতে পারছো না। এটা স্বাভাবিক। প্রাপ্তবয়স্ক মেয়ে তুমি। তোমার পছন্দ অপছন্দ থাকতে পারে। জানি না, তোমার কোনো পূর্বে পছন্দ রয়েছে কি-না! তবে এতটুকু বলতে পারি, হ্যাভেন’কে বিয়ে করে তুমি ঠকে যাও নি। ”
এ পর্যায়ে অরুর মুখভঙ্গি বদলে গেল। চোখ দুটো ছোট ছোট করে ভ্রু কুঁচকে ফেলল। চওড়া গলায় জানতে চাইল,
” আপনি একজন মেয়ে হয়ে কিভাবে বলছেন আমাকে ঠকানো হয়নি? রূপে গুণে কোন দিক দিয়ে কমতি রয়েছে আমার? বয়সও বেশি না। তাহলে পূর্বে বিবাহিত পুত্র সমেত এক বাচ্চার বাবার সঙ্গে বিয়ে দেওয়া কি আমার প্রতি অন্যায় নয়? আমার জায়গায় আপনি থাকলে কি করতেন? মেনে নিতে পারতেন এসব? ”
সায়রা থমথমে খেয়ে যান। এদিক ওদিক নজর ঘুরান। কথা ঘুরিয়ে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে চেয়ে পাল্টা প্রশ্ন ছুড়লেন,
” তুমি কেন বিয়ে করেছো? তোমাকে বিয়ের জন্য বলা হয়েছে, জবরদস্তি তো করা হয়নি! তুমি স্বেচ্ছায় বিয়েতে মত দিয়েছো। চাইলেই তুমি বিয়ের জন্য মানা করে দিতে পারতে। পরিবার বেশি জোরাজোরি করলে পালিয়ে যেতে পারতে। যেহেতু প্রাপ্তবয়স্ক আইনের আশ্রয় নিতে পারতে। নিজের সিদ্ধান্ত নিজে নেওয়ার অধিকার রয়েছে তোমার। ”
অরু বার কয়েক পলক ঝাপটায়। হতবাক হয়ে ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে থাকল। সায়রার কথাটা ফেলে দেওয়ার মতো না, যুক্তিসঙ্গত। কিছুক্ষণ চুপ থেকে কিয়ৎকাল পর তাচ্ছিল্য হেসে অরু জানালো,
” কি জানেন তো কাকীমা! আমাদের জীবন অনেক সময় এমন কিছু পরিস্থিতির মুখোমুখি দাঁড়িয়ে থাকে, হয় সেই পরিস্থিতির সাথে লড়াই করতে হয়, নয়তো সেই পরিস্থিতি মেনে নিতে হয়। আমি সেকেন্ড অপশন টা চয়েস করেছি। ইচ্ছে করে না, বাধ্য হয়েছি। ”
সায়রা গভীর দৃষ্টিতে তাকায় অরুর কোমল স্নিগ্ধ মুখশ্রীর দিকে। সেথায় হাসি নেই, আছে শুধু হতাশা। অরুর হাতটা মুঠোয় শক্ত করে ধরলেন। অত্যন্ত শীতল গলায় বললেন,
” তুমি কেন বিয়ে করতে বাধ্য হয়েছো জানতে চাইবো না। শুধু এতটুকু বলবো, হ্যাভেন ভালো ছেলে। ভালো না, খুবই ভালো ছেলে। যেকোনো মেয়ের স্বামী হওয়ার জন্য পার্ফেক্ট। সে ভীষণ একরোখা জেদি ছেলে। নিজের ছাড়া কারো কথায় তেমন পাত্তা দেয় না। তবে আপনজনের কথায় গুরুত্ব অবশ্যই দেয়। আমরা ছাড়া তার আপন বলতে কেউ নেই। হ্যাভেনের জীবনে একটা ঘনকালো অন্ধকার আচ্ছাদন ভয়ংকর অতীত ছিল। ছেলেটা চোখের সামনে পুরোপুরি ছন্নছাড়া হয়ে গিয়েছিল। যার রেশ অন্ধকার কেটে যাওয়ার পরও জীবনে ক্ষুদ্র গাছের অঙ্কুরিত ডালপালার ন্যায় রয়ে গিয়েছিল। আমরা তাকে সামলাতে পারছিলাম না। সেই মুহূর্তে টুটুলই ছিল তার বেঁচে থাকার একমাত্র অবলম্বন। টুটুল’কে আঁকড়ে ধরে ছেলেটা স্বাভাবিক জীবনে পদার্পণ করতে সক্ষম হয়েছে। বাইরে তাকে দেখতে কঠিন মনে হলেও ভেতরে কোমল কোষের মতো নরম। হ্যাভেন নামক গুরুগম্ভীর ছেলেটা ভালোবাসার কাঙাল। সহজে মুখ ফুটে কিছু বলে না। সকলের সামনে রাগী লুক নিয়ে থাকে। তুমি তাকে ভালোবেসে একটু যত্ন নিও, দেখবে সে তোমাকে হৃদয়ের রাণী করে রাখবে। জানতো ভালোবাসা এমন এক শক্তি, যার মাধ্যমে সবচেয়ে নিকৃষ্টতর মানুষকে বশিভূত করা সম্ভব। সেখানে হ্যাভেন তো খাঁটি সোনা! ”
অরু মনোযোগ সহকারে সকল কথা শ্রবণ করল। তবে কথাগুলোর কতটা আমলে নিয়েছে কিংবা আজও কথাগুলো মন দিয়ে বুঝার চেষ্টা করেছে কি-না ওর মুখবিবর দেখে বোঝা যাচ্ছে না। অরুর মুখশ্রীতে এখন গুমোট ভাব। সায়রার জ্ঞানগর্ভ কথাগুলো ক্রমশ একঘেয়ে লাগতে শুরু করল অরুর কাছে। ঠোঁটের কোণে সামান্য কুঞ্চন, যা সে চেপে রাখার চেষ্টা করছে। একবার মনে হলো মেজাজ সহিত মুখের উপর জবাব দিয়ে দিবে,
” কাকীমা, এবার থামুন। আর শুনতে পারছি না এসব ইমোশনাল কথাবার্তা! যেখানে আমার অনুভূতির কেউ মূল্য দেয়নি, সেখানে অন্য কারো দুঃখের গল্প শোনার ইচ্ছা, রুচি কোনটাই আমার নেই। ”
কিন্তু অরুর শিক্ষিত ভদ্রতা এবং সায়রার প্রতি সম্মানবোধ তাকে সেটা বলতে দিল না। সায়রা যখন কথা শেষ করলেন, অরু তখন একটি দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলল।
অরু মুখে ভদ্রতার হাসি ফুটিয়ে বলে,
” ঠিক বলেছেন কাকীমা। আমি চেষ্টা করবো, সবকিছু মেনে নিয়ে আমাদের সম্পর্ক স্বাভাবিক করার। ”
সায়রা চক্ষু হাসলেন। অরুর মাথায় স্নেহময় হাত বুলিয়ে দিলেন। কিন্তু অরুর চোখে এক ধরনের ক্লান্তি এবং মনের মধ্যে এক গভীর বিরক্তির ছায়া স্পষ্ট ফুটে উঠল।
ড্রয়িংরুমের সোফায় বসে হ্যাভেন কিছু ছবি দেখছে ফোনের গ্যালারিতে। একটার পর একটা ছবি দেখেই চলেছে, তবে হিসাব মিলছে না। মনে হচ্ছে মাঝখানের কোনো এক মুহূর্তের ছবি স্কিপ করে গিয়েছে। ঠোঁটে ঠোঁট চেপে নিগূঢ় চাউনীতে পর্যবেক্ষণ করে চলেছে। ভাবুক চিত্তে কিছুক্ষণ মৌন স্থিরতায় কাটাল। কোনো ভাবে কোনো সুরাহা পেলো না। দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে রিমোট দিয়ে টিভি অন করল। ছবির মতো একের পর এক চ্যানেল পাল্টালো, টিভি দেখায় মন বসছে না। বিরক্ত ভঙ্গিতে নাকমুখ বিকৃত করে উঠে দাঁড়াল।
হাঁটতে হাঁটতে হ্যাভেন ছাদে চলে এসেছে। পায়ের ধীর লয়ের শব্দ ছাদের নির্জনতায় এক অদ্ভুত প্রতিধ্বনি তুলছে। হ্যাভেন ছাদে এসে রেলিং ঘেঁষে দাঁড়িয়েছে। তার চোখের চাহনি যেন নিগূঢ় রহস্যে ভরা। গভীর কোনো চিন্তা বা যন্ত্রণার আঁধার! কপালটা খানিকটা কুঁচকে আছে, ঠোঁটের কোণায় একফোঁটা কোলাজল ঝুলে আছে, যা তার দুঃসহ অবস্থাকে আরো বেশি প্রকট করছে। রাত কিংবা দিনের কোনো মিশ্র অনুভূতি হ্যাভেনের চারপাশে ছড়িয়ে রয়েছে। একটা সময়হীন পরিবেশ মনে হচ্ছে! আকাশের অদ্ভুত ধূসরাভা আভা তার মুখের ছায়া-আলোতে যেন এক রহস্যময় চিত্র তৈরি করছে।
হ্যাভেন ছাদের এক কোণে থাকা স্টোর রুমের দিকে অগ্রসর হয়। চোখ আটকে থাকে বড়ো রকমের তালার ওপরে। যেটা দরজার সম্মুখে সুন্দর করে ঝুলে রয়েছে। পকেট হাতড়ে চাবি খুঁজে, পরমুহূর্তে মনে পড়ল চাবি তো পকেটে নেই। ঘরে ফিরে চাবি আনার ইচ্ছা হলো না। দরজাটার দিকে এক দৃষ্টিতে চেয়ে থাকল কিয়ৎপরিমাণ। অন্ধকারে অদৃশ্য হয়ে থাকা ঘরটার চৌকাঠ যেন তাকে ডাকছে, অথচ সে দ্বিধাগ্রস্ত। তার দৃষ্টি তীক্ষ্ণ, সন্দেহ মিশ্রিত, আবার বিষণ্নতায় ভারাক্রান্ত। মনে হচ্ছে, ঘরটার ভেতরে এখনো অজানা কিছু আছে। তবে তা জানার ইচ্ছা আর ধৈর্যে কুলচ্ছে না! পুরো ঘরটা তন্নতন্ন করে খুঁজেছিল, কাঙ্ক্ষিত কিছুর দেখা পায়নি! আর খুঁজতে ইচ্ছা করে না। অজানা ভয়, রাগ, যন্ত্রণা একসঙ্গে মনকে বিষিয়ে তুলছে!
বেলকনিতে দাঁড়িয়ে কতশত চিন্তায় বিভোর অরু। মস্তিষ্কের ভেতর সৃষ্টি হওয়া প্রশ্নগুলো ভেবেছিল সায়রা’কে জিজ্ঞেস করবে, প্রশ্নগুলো ঠোঁটের ডগায় রয়ে গিয়েছে, জিজ্ঞেস করাও হলো না, আর উত্তর পাওয়াও হলো না।
অরু ভাবুকতা সমেত দূর নীলিমাতে চোখ দুটো স্থির করে রেখেছে। ডাগর ডাগর গভীর চক্ষুদ্বয় ওই নীলিমাতে আটকে তার উত্তর খুঁজছে, যেন সেগুলো ভেতরে লুকিয়ে থাকা নিগূঢ় চিন্তা আর বিষণ্নতার প্রতিফলন। নিঃশব্দে একটা ব্যথা বহন করছে চোখের পাতা। ললাটে প্রগাঢ় ভাঁজ ফেলে মূর্তির ন্যায় দাঁড়িয়ে রয়েছে। মনে হচ্ছে, কিছু সময় একা থাকা জরুরি। হয়তো তার ভেতরে যে শত প্রশ্ন জমা হয়ে আছে, সেগুলোর সঠিক কোনো উত্তর পাবে না। তবে গভীর ভাবে চিন্তা করলে ক্ষতি কি? পীবর ঠোঁটে সামান্য আঁটসাঁট, যেন কোনো কথা না বলে চুপচাপ নিজের এলোমেলো ধ্যানে ডুবে আছে।
হ্যাভেন ব্যস্ত কদমে রুমে প্রবেশ করে চারপাশে চোখ বুলিয়ে নিলো। জানালার পর্দা অল্প নড়ে উঠছে, বাতাসের হালকা ছোঁয়ায়। পুরো রুম জুড়ে একটা ভারী নিরবতা বিরাজমান। হ্যাভেনের মনটা অজানা উদ্বেগে টান টান হয়ে উঠল। ভেতরে কোথাও একটা অস্থিরতা কাজ করছে, তবে তা বাইরে প্রকাশ করতে চাইল না। নিজেকে সংযত করে দ্রুত বেলকনির দিকে এগিয়ে গেল।
বেলকনিতে গিয়ে হ্যাভেনের দৃষ্টি পড়ল অরুর দিকে। বিষন্ন ভগ্নহৃদয়ে অরু’কে নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে হ্যাভেন ভ্রু কুঁচকে ফেলল। এগিয়ে এসে পাশাপাশি দাঁড়াল। পলকহীন এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকল অপ্রত্যাশিত কিছু সুপ্ত অনুভূতি মেশানো সম্মুখের নারীর দিকে। অরু তখন আপন ছন্দে ঠায় দাঁড়িয়ে। হ্যাভেন’কে খেয়াল করেনি। অরুর মনোযোগ আকর্ষণের লক্ষ্যে হ্যাভেন গলা খাঁকারি দিল। অরু তৎক্ষনাৎ চমকে ওঠে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকায়। এতক্ষণ সে নিজের একান্ত জগতে বন্দি ছিল। হঠাৎ ফিরে তাকিয়ে তার চোখে ধরা পড়ল হ্যাভেনের থমথমে মুখমন্ডল। দেখেই একধরনের বিরক্তি মুখে ফুটে উঠল।
হ্যাভেন থম মেরে চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল। গভীর দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকল নববধূর দিকে। অরুকে এইভাবে দেখে হ্যাভেনের মনের ভেতর কিছু একটা যেন ভেঙে পড়ল। তবে সেই সুক্ষ্ণ অনুভূতিকে চেপে রাখল। অরুর কাজল দেওয়া চোখের অদ্ভুত এক মায়া আর অসহায়ত্ব তার ভেতর থেকে ঝাঁকি দিচ্ছিল। কিন্তু মনের সেই টান অনুভব করেও অরুকে ছুঁতে দ্বিধাবোধ করছে।
কিছু সময় দাঁড়িয়ে থেকে হঠাৎ হ্যাভেন ভ্রু কুঁচকে গম্ভীর কণ্ঠে বলে ওঠে,
” শীতল বাতাসে ঠান্ডা লেগে যাবে। এভাবে এতক্ষণ ধরে এখানে দাঁড়িয়ে আছো কেন? কি হয়েছে? ”
অরু চোখমুখ শক্ত করে পাল্টা প্রশ্ন ছুড়ল,
” কি হয়নি সেটা বলুন? ”
হ্যাভেন অরুর রাগের কারণ বুঝতে পারলো। বুঝেও আশা পূর্ণ প্রতিক্রিয়া দেখাল না। নিজের অস্থিরতা চাপা দিয়ে, হ্যাভেন ধীরে ধীরে অরুর নিকট আরেকটু এগিয়ে এসে দাঁড়ায়। অরু নজর ফিরিয়ে নেয়। দৃষ্টি রাখল বেলকনির গ্রিলে।
অরুর নির্লিপ্ততা হ্যাভেনকে আরও কৌতূহলী করে তুলল। বাইরে নজর রেখে গভীর ভারী স্বরে বলে উঠলো,
” মানুষের জীবন অতি ক্ষুদ্র অরু। সময় আমাদের হাতে যতটুকু আছে, তাতে প্রতিটি মুহূর্তকে কাজে লাগানো উচিত। জীবনের প্রতিটি মুহূর্ত খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সময় থাকতে চলার পথে বুঝে শুনে প্রতিটি কদম ফেলা আর সিদ্ধান্ত নেওয়া অত্যন্ত জরুরি। সময় পেরিয়ে গেলে, তখন আফসোস করা ছাড়া আর কোনো উপায় থাকে না। আমি বুঝতে পারছি তোমার ইচ্ছার বিরুদ্ধে ঘটে যাওয়া সম্পর্ক হয়তো এখনো তোমার হৃদয়ে ভার হয়ে আছে। তবে এটার রেশ কতদিন থাকবে জানি না। আমি তোমাকে সময় দিবো। ভেবোনা আমার সঙ্গে থাকবে কি না সেটার জন্য! সময় দিচ্ছি আমাকে মেনে নেওয়ার জন্য। না মানলেও সমস্যা নেই। আমার থেকে মুক্তি তুমি পাবে না। বাকি জীবন আমার মতো, তোমার ভাষ্যমতে অসহ্যকর, বজ্জাত লোকের সাথে কাটাতে হবে। ”
হ্যাভেনের বিদ্রুপ স্বরে কাটকাট জবাবে অরু পিটপিট করে চেয়ে, তাচ্ছিল্য হাসে। তার কণ্ঠে কোনো উষ্ণতা ছিল না, ছিল কাঠিন্য ভাব। অরু একদম স্পষ্ট সোজাসুজি ভাবে বলল,
” মুক্তি পাওয়ার আশাতো করি না! সময় আর ভাগ্য আমাকে যেদিকে নিয়ে যাবে, সেদিকেই যাবো। তা আপনাকে মেনে না নিলে কি আমার উপর মেন্টালি চাপ সৃষ্টি করবেন? ”
শেষের কথাটা অরু ব্যঙ্গাত্মক করে বলে উঠল।
হ্যাভেন কিঞ্চিৎ মুচকি হাসল। কিন্তু সেই হাসির মধ্যে একটা রহস্য লুকানো ছিল। যেন সে অরুকে চ্যালেঞ্জ করছে কোনো ভয়ংকর খেলায়!
পূর্ণ দৃষ্টিতে অরুর পানে চেয়ে হ্যাভেন শান্ত গলায় জবাব দিল,
” হৃদয় জয় করার জন্য চাপ নয়, বরং বোঝাপড়া আর ধৈর্যের প্রয়োজন।
কথাটায় কি ছিল জানা নেই, তবে অরুর ভাঙা হৃদয়ে স্বল্প ভালো লাগার সুখকর অনুভূতি দোলা দিয়ে যায়। ঠোঁটে ঠোঁট চেপে অরু নিশ্চুপ রইল। লম্বা শ্বাস টেনে, বার কয়েক পলক ঝাপটায়। হঠাৎ মুখভঙ্গি বদলে গেল। তিরিক্ষি মেজাজ সহিত বলে ওঠে,
” আপনি এখানে কি করছেন? ”
হ্যাভেন চক্ষুদ্বয় ছোট ছোট করে তাকায়। ভ্রু উঁচিয়ে জিজ্ঞেস করলো,
” তুমি কি ভেবেছো, রাস্তায় থাকব? আমাকে বিয়ে করার সুবাদে আমার সবকিছুতে সমান অর্ধেক ভাগ পাও বলে, এই ঘরটা কি শুধু তোমার একার? আমি যেখানে খুশি যেতে পারি, থাকতে পারি! ”
অরুর মুখ বাঁকায়। মনে মনে ভেংচি কাটল। কোনো প্রতিত্তোর করতে পারলো না। হ্যাভেনের এই স্বাভাবিক কিন্তু কটাক্ষ মিশ্রিত কথাগুলো তাকে অস্বস্তিতে ফেলল।
হ্যাভেন কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকল অরুর দিকে। তারপর গলা পরিষ্কার করে একটু নরম স্বরে বলে,
” একা একা এভাবে চুপচাপ আর কতক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকবে? পা ব্যথা করবে তো। ”
অরু এবার ভ্রু কুঁচকে তাকাল। মুখমন্ডল জুড়ে বিরক্তিকর আভাস ফুটে রয়েছে। অবাক হওয়ার ভান করে কটাক্ষ করে বলল,
” আপনি এত ভাবেন আমার জন্য? এত চিন্তা করেন? তাহলে বিয়ে করার সময় আপনাকে আমার পছন্দ নাকি জিজ্ঞেস কেন করেন নি? আপনি বিয়েটা না করলে আমার আপনাকে বিয়ে করতে হতো না। এত ঝামেলা পোহাতে হতো না!”
অরুর গলা কেঁপে উঠল। কথা বলতে বলতে তার চোখে জল জমতে শুরু করল। তবে সে নিজের দুর্বলতা কারো সম্মুখে প্রকাশ করতে নারাজ। হ্যাভেন দেখার আগে চোখের জল কোনোভাবে আড়াল করার চেষ্টা চালাল। বিশেষ লাভ হলো না, হ্যাভেন ঠিকই দেখে নিয়েছে অরুর কান্না মিশ্রিত আঁখি যুগল। হ্যাভেন নিগূঢ় চাউনী নিক্ষেপ করল অরুর মুখবিবরে। সবকিছু বুঝেও কিছু স্বীকার করতে চাইছে না।
হ্যাভেন হঠাৎ একটু এগিয়ে এসে একদম অরুর শরীর ঘেঁষে দাঁড়াল। অরু হতবিহ্বল হকচকানো দৃষ্টি তুলতেই, হ্যাভেন শীতল গলায় বলল,
” তুমি আমার থেকে দূরে থাকতে চাও, তাই না? কিন্তু তুমি কি জানো, তোমার এই দূরত্বটা আমাকে কষ্ট দেয়? ”
অরুর মাথা ভনভন করছে। বলার মতো কথা খুঁজে পেলো না। এই অসহ্যকর লোকটার আবার কি হলো? এতক্ষণ তো ঠিক ছিল! অরু পেলব হাতে হ্যাভেনের বুকে ধাক্কা দিয়ে দূরে সরিয়ে দিতে চাইল, সক্ষম হলো না। পিনপিনে নীরবতা বিরাজমান পরিবেশটা যেন আরও বেশি গুমোট রূপ ধারণ করছে! হ্যাভেন আরেকটু ঘনিষ্ঠ হয়ে অরু’কে গ্রিলের সঙ্গে চেপে ধরল। হ্যাভেন যেন কোনো ঘোরে চলে গিয়েছে। অরু নেত্রদ্বয় বড়ো বড়ো করে চেয়ে থাকল।
হ্যাভেন মুখটা অরুর বিস্ময়কর মুখশ্রীর আরও কাছাকাছি নিয়ে আবেগ সমেত আকুলতা ঢেলে হিসহিসিয়ে জানালো,
” আমি জানি তুমি আমাকে এখনো মেনে নেওনি। তুমিই বা কেমন করে মেনে নিবে? এই সম্পর্কটা তো তোমার ইচ্ছের বিরুদ্ধে তৈরি হয়েছে। কিন্তু আমি চেষ্টা করছি সবকিছু স্বাভাবিক করার। আর আমি জানি, তুমি একদিন আমাকে ঠিক বুঝবে। ভয় তো অন্য জায়গায়! যতদিনে তুমি আমাকে বুঝতে পারবে, ততদিনে আমি যদি না থাকি? আমি বড্ড একা অরু পাখি! আমার হাতটা শক্ত করে ধরার মতো কাউকে চাই। আমার মন খারাপের দিনে একটা ভরসা যোগ্য বুক চাই। আমার কষ্টের কথা বলার জন্য বিশ্বস্ত একজন ব্যক্তিগত সঙ্গী চাই। আমার যন্ত্রণা লাঘব করার জন্য শান্তিপূর্ণ একটা নরম কোল চাই। সেই একজন যদি তুমি হও, তাহলে কি খুব বড়ো অন্যায় হবে? ”
অরু ভাবুকতা চিত্তে ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে রইল। এক সত্তা সম্মুখের পুরুষের কথাগুলো বিশ্বাস করতে চাইছে, তো আরেক সত্তা সেটার ঘোর বিরোধিতা করছে। এই মুহূর্তে বজ্জাত লোকের ইমোশনাল হৃদয় নাড়া দিয়ে উঠল কেন? অরুর প্রতি এত সুগভীর আবেগ হঠাৎ করে কোথা থেকে উদয় হলো? অরুর গলায় কথাগুলো আটকে গেল। সে বুঝতে পারছে না কী বলবে?
শীর্ণকায় হ্যাভেনের কথাগুলো নাজুক মেয়েটির ভগ্ন হৃদয় নাড়া দিল। কিছু সময় হ্যাভেনের সুগভীর ভাসা ভাসা চক্ষু জোড়ায় নিজেকে হারিয়ে ফেলল অরু। শুষ্ক ঢোক গিলল। পীবর ঠোঁট নেড়ে মিহি স্বরে বলে,
” সবে তো আমাদের পথ চলা শুরু হয়েছে। এখনো আমার আপনাকে চেনা বাকি, জানা বাকি। আগে ভালো করে আপনাকে বুঝতে সক্ষম হই, তারপর আপনার ভরসা যোগ্য কাছের একজন মানুষ হলেও হতে পারি। ”
হ্যাভেন আরও কিছুটা অরুর দিকে ঝুঁকে আসে। অরুর কপালে সরু নাক ঘষলো। অরু খানিকটা কেঁপে ওঠে। হ্যাভেন বাঁকা হাসল। ঠোঁট কামড়ে বিদ্রুপ সরূপ মুখবিবর গম্ভীর করে তুলল। কন্ঠ খাদে এনে গা জ্বালানো বুলি আওড়াল,
” মেয়েদের হিপনোটাইজ করা বাম হাতের খেলা! দু-চারটা মিষ্টি মিষ্টি আর আবেগ-প্রবণ কথা বললেই রসমালাইয়ের মতো গলে যায়। তোমার কি মনে হয়, কিছুক্ষণ আগে আমি যে কথাগুলো বলেছিলাম সেগুলো সত্যি ছিল? না, তা কোনো ভাবেই নয়! দিস ইজ অ্যা টোটালি ফাকিং স্টুপিড ওপিনিয়ন! আমার কাউকে প্রয়োজন নেই। আমি খুব সুখী। যে থাকার, সে এমনিতেই থাকবে। আলাদা করে অনুরোধ করার প্রয়োজন নেই। আমার কথা সিরিয়াস নিয়ে বোকার মতো আচরণ করো না। হ্যাভেন তালুকদার চাইলে যেকোনো জিনিস জোর করে নিজের কাছে ধরে রাখতে জানে। এসব লেইম ধরনের আবেগ-প্রবণ কথাবার্তা বলার প্রয়োজন নেই। গেট দ্ব্যাট? ”
হ্যাভেন দুরত্ব বজায় রেখে অরুর থেকে সরে দাঁড়ায়। অরুর বিস্ময়কর দৃষ্টি, কিংকর্তব্যবিমূঢ় মুখশ্রী দেখার ইচ্ছা হলো না। আর পাল্টা উত্তর শোনার প্রয়োজনবোধও করল না। পেছন ঘুরে ব্যস্ত কদমে চলে গেল। কিন্তু তার শেষ কথাগুলো অরুর মনে গভীর এক দাগ কেটে গেল। নিজের পুরোনো ফর্মে ফিরে রাগে ফোঁস ফোঁস করতে লাগলো। মৃদুভাবে কেঁপে উঠছে ক্রোধান্বিত শরীর!
প্রেমপিপাসা পর্ব ৪
অরু রেগে পা দিয়ে ফ্লোরে আঘাত করল। নিজের উপর বিরক্ত হলো। দাঁতে দাঁত চেপে বিড়বিড়িয়ে বলল,
” সাধে কি আর বলি বজ্জাত লোক! কিভাবে পাল্টি খেলো? আমারই বোঝার ভুল! উফফ! এই লোকটার মধ্যে এমন কিছু আছে, যার দরুন লোকটা আমার কাছে আসলে কেমন অজানা এক ফিলিংস হয়। শয়তান লোকটার চোখে অদ্ভুত একা মায়া রয়েছে। জানি না, এই ফিলিংস এর মানে কি? কি নাম দিবো এটার! না না, আমার এই অসহ্যকর লোকটার থেকে সাবধানে থাকতে হবে। আমার সঙ্গে কোনো রকম চালাকি করার সুযোগ দেওয়া যাবে না। ব্যাটা খচ্চর! ”