পারমিতা পর্ব ৭
Nabila Ahmed
কলেজের সামনে গাড়ি এসে দাঁড়াতেই মিতা বেড়িয়ে আসে গাড়ি থেকে।
–বাই অরিয়ন ভাইয়া।
আলতো এক হাসি দিয়ে বলে মিতা।
–বাই।
জবাব দেয় অরিয়ন।
–চলেন কাকা।
ড্রাইভারকে বলে অরিয়ন।
গাড়ি মিতার নজরের আড়াল হলেই কলেজে প্রবেশ করে মিতা।
ক্লাসে ঢুকতেই মিতার নজর খুজতে থাকে বেস্ট ফ্রেন্ড ফাহমিদা, সুমাইয়া ও ফয়সালকে।
–সুমা, পারু আসছে।
সুমাইয়াকে ধাক্কা দিয়ে মিতাকে দেখিয়ে বলে ফাহমিদা।
কথা শুনে মিতার দিকে তাকিয়ে মিতাকে দেখেই এই বিশাল হাসি দিয়ে উঠে সুমাইয়া । নিজের সব বন্ধুদের এক সাথে বসে থাকতে দেখে খুশিতে মিতাও দৌড়ে চলে যায় তাদের বেঞ্চের কাছে।
–আমাকে ছাড়া কি আড্ডা দিচ্ছিস হ্যাঁ??
ফাহমিদার কাধের উপর ঢলে পড়ে সবাইকে বলে মিতা।
–লল, দেখ কি করছি।
ফয়সাল সরে যেতেই বেঞ্চের উপর বই আর হাতে কলম নিয়ে বসে থাকা সুমাইয়ার দিকে চোখ যায় মিতার।
–কিচ্ছু পারিনা ভাই, আজ নিশ্চিত আমি ফেল করবো তাই চোরামি করতেছি।
হাসতে হাসতে বলে সুমাইয়া।
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
–তুই পড়িস না কেনো তাহলে, ফাজিল।
সুমাইয়ার পাশে গিয়ে বসে বলে মিতা।
–পড়তে মন চায় না। বই নিয়ে বসলেই আমার শুধু ঘুম আসে।
জবাব দেয় সুমাইয়া।
–অকে শুধু বাদরামি করতে দে, দেখবি সবার আগে থাকবে।
বলে ফয়সাল।
–তুই আমাদের সাথে বসলে ভালো হতো কিন্তু ঐ পাজি স্যার, সব সময় তোকে আলাদা বসায়।
বলে ফাহমিদা।
–আমি ও তো চাই তোদের সাথে বসতে কিন্তু স্যারটা বেশি খারাপ।
বলে মিতা।
ক্লাস শুরুর ঘণ্টা বাজতেই ঘড়ির দিকে তাকায় সবাই।
–ওকে, ফেল করার টাইম চলে এসেছে।
মুখ ভেংচি দিয়ে বলে সুমাইয়া।
সুমাইয়ার রিয়েকশন দেখে সবাই হাসতে থাকে।
সব সময়ের মতো আজও মিতার এক্সাম ভালো হয়েছে। বাসায় আসতে আসতে বিকাল হয়েছে মিতার। একটু রেস্ট নিয়ে ড্রয়িং রুমে বসে বসে আইসক্রিম খাচ্ছে আর টিভি দেখছে মিতা।
কলিং বেলের আওয়াজ শুনতেই ঠিক করে বসে মিতা। একটু পরেই প্রবেশ করে আনিকা চৌধুরী। চোখে সানগ্লাস, হাতে গুচির ব্যাগ। মোবাইল টিপতে টিপতে আনমনে হাটছে আনিকা চৌধুরী।
–আন্টি!
আনিকার পেছন পেছন গিয়ে ডাকতে থাকে মিতা।
–আন্টি!
আবারও ডাক দেয়। কিন্তু আনিকা চৌধুরী থেকে কোনো রিয়েকশন না পেয়েই বুঝতে পারে কানে ব্লুটুথ থাকার কারণে মিতার ডাক শুনতে পাচ্ছে না। তাই নিজের হাত দিয়ে স্পর্শ করে আনিকা চৌধুরীকে।
–আন্টি!
নিজের শরীরে কারো স্পর্শ অনুভব করতেই ফিরে তাকায় আনিকা চৌধুরী। সামনে দাঁড়িয়ে থাকা পারমিতাকে দেখেই বিরক্তি প্রকাশ পায় চেহারায়। কান থেকে ব্লুটুথ খুলে ভ্রু কুচকে বলে-
–কি হয়েছে? ডাকছিস কেনো? আর গায়ে হাত দিতে কতবার না করেছি তোকে?
–ড্রাইভার আংকেল অনেকক্ষণ ধরে ডাকছে তোমাকে।
নিজের হাত দিয়ে দরজায় দাঁড়িয়ে থাকা ড্রাইভারকে দেখিয়ে বলে মিতা।
–আচ্ছা আচ্ছা।
কথাটা বলেই দরজার কাছে চলে যায় আনিকা চৌধুরী।
নিজের জায়গায় গিয়ে আবারও বসে পড়ে মিতা। আগে স্কুল কলেজ থেকে ফিরলেই বাকি সময় আফরিন বা মায়া চৌধুরীর সাথে কেটে যেত। কিন্তু এই বাড়িতে আসার পর থেকে বেশিরভাগ সময় একা একাই কাটাতে হচ্ছে মিতার। আনিকা চৌধুরী মিতাকে দেখলে যেন এক প্রকার এড়িয়েই চলে। হাবিব চৌধুরীর সাথে সকালে ছাড়া দেখাই হওয়ার সুযোগ হয় না মিতার। আর আফরিনের ঘটনার পর থেকে অরিয়ন কাজে নিজেকে এতোটা ব্যস্ত করে নিয়েছে যে নিজের মতো একাই রুমে সময় পার করে দেয়। একমাত্র আবরারের সাথেই সময় কাটাতে পারে মিতা।
টিভি দেখতে থাকা মিতার আনিকা চৌধুরীর চেহারাটা সামনে ভাসতেই চোখে পানি চলে। “এমন নয় তুমি সবার সাথে এরকম, তাহলে আমার সাথেই এরকম কেন? কেনো অন্যদের পছন্দ করো আর আমাকে দেখলে এতো ঘৃণা প্রকাশ পায়?” নিজে নিজে ভাবে মিতা।
নিজের রুমের টেবিলে বসে পড়ছে মিতা। মোবাইলে মেসেজের নোটিফিকেশন শুনলেও পরে দেখবে ভেবে পড়া পড়তে থাকে মিতা। আগামীকাল উচ্চতর গনিত পরীক্ষা মিতার। এই ম্যাথটাই মিতার জীবন কঠিন করে তুলেছে তাই বার বার চেষ্টা করে আর টিউশন টিচার থেকে সব বুঝে নিয়েছে মিতা।
–উফফ..সব শেষ কালকের পড়া।
হাত পা টান করতে করতে খুশি হয়ে বলে মিতা।
ঘড়িতে ১০:৩০ টা বাজে। যদিও শায়লা খাবার খাওয়ার জন্য ডেকেছিলো কিন্তু পড়ার মাঝখানে যেতে চায়নি মিতা। এখন ডিনার শেষ করেই শুয়ে পড়বে।
খুশিতে মোবাইল হাতে নিয়ে বিছানায় টান হয়ে শুয়ে পড়ে মিতা। মোবাইলের লক খুলে ওয়াইফাই অন করতেই একের পর এক মেসেজ আসতেই থাকে গ্রুপে।
“এতো কথা কীভাবে বলিস তোরা?”মনে মনে ভাবে মিতা।
বেস্টু গ্যাং ২৪০+ মেসেজ।
কি এতো কথা হচ্ছে জানার জন্য ইনবক্সে প্রবেশ মিতা।
সাল্লু ( ফায়সাল) : ঐ কবিরের উপর গজব পড়বে।
সুম্মু ( সুমাইয়া) : আমি নিশ্চিত স্যারের তার বউয়ের সাথে ঝড়গা হইছে।
মিদা ( ফাহমিদা) : আমি দোয়া করি কাল স্যারের পেট খাবার হোক। আল্লাহ বিচার করুক উনার।
স্যারকে এতো গালি দিচ্ছে দেখে হেসে ফেলে মিতা।
পারু উইথয়াউট দেবদাস (মিতা) : কি হয়েছে তোদের? স্যারকে এতো গালি দিচ্ছিস কেনো?
সাল্লু : বেটা গালি খাওয়ার কাজ করছে তাই।
সুম্মু : কেনো জানিস না কি করছে?
পারু উইথয়াউট দেবদাস : নাহ, কি হয়েছে?
মিদা : মিতা কাল সত্যি সত্যি পারু হয়ে যাবে ।
সাল্লু : হাসির ইমুজি।
পারু উইথয়াউট দেবদাস : কি হয়েছে বলবি তো।
সুম্মু : স্যার কাল এক চ্যাপ্টার বাড়াই দিছে এক্সামের জন্য।
পারু উইথয়াউট দেবদাস : কিইইইইইইই?কখন আমি জানিনা কেনো?
সাল্লু : সন্ধ্যায়, কাল আমাদের সাথে ফেলের লাইনে পারু ও থাকবে। শুনেই খুশি লাগছে।
পারু উইথয়াউট দেবদাস : আল্লাহ বিচার করবে এই স্যারের। সব সময় এমন প্যাঁচ লাগায় উনি। আগে কেনো বলেন না। সবগুলা পড়তে যা এখন।
মিতা আর কোনো কথা না বলেই স্যারের সাথে এড থাকা গ্রুপে গিয়ে ম্যাথের অধ্যায় দেখেই মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়ে। এই অধ্যায়টা এখনো ধরেনি মিতা। যখন স্যার করিয়েছিলো তখন বিয়ে নিয়ে ব্যস্ত থাকায় কলেজ যেতে পারেনি। এতো রাতে স্যারকেই বা কিভাবে কল দিবে। “কবির স্যার, আপনি একটা খবিস ” রাগ হয়ে দাঁতে দাঁত চেপে বলে মিতা।
তাড়াতাড়ি করে বই, খাতা আর কলম নিয়ে দৌড়ে চলে যায় আবরারের রুমের সামনে।
–আরিয়ান ভাইয়া?
দরজায় নক করে বলে মিতা।
–আরিয়ান ভাইয়া?
–আরিয়ান ভাইয়া?
কোনো জবাব আসতে না দেখে হ্যান্ডেল ধরে পুশ করতেই দরজা খুলে যায়। রুমের মধ্যে ঘোর অন্ধকার। আবরার রুমে। ড্রয়িং রুমে আছে ভেবে নিচে নেমে আসে মিতা। আবরারকে কোথাও দেখতে না পেয়ে শায়লার কাছে চলে যায় মিতা।
–শায়লা আপু।
–কি হয়েছে মিতা? খাবার দিবো এখন?
জিজ্ঞেস করে শায়লা।
শায়লা এই বাড়ির হেল্পিংহ্যান্ড হিসেবে কাজ করছে ২ বছর ধরে। বয়স ২৯/৩০ হবে।
–আরিয়ান ভাইয়া কি বাসায় আসেনি এখনো?
–না, কেনো?
–না এমনিতেই। একটু হেল্প লাগতো তাই।
মন খারাপ করে বলে মিতা। পরক্ষণেই কিছু ভাবতে খুশি হয়ে যায়।
–শায়লা আপু আমাকে একটু হেল্প করবে?
শায়লার কাছাকাছি গিয়ে বলে মিতা।
–কি হেল্প? যা বলবে তাই করবো।
আলতো এক হাসি দিয়ে বলে শায়লা।
–আমাকে ম্যাথ করে দিতে পারবে? এইযে এই অধ্যায়।
–মিতা…মিতা.. তুমি তো জানোই আমি আর্টস নিয়ে পড়েছি। ম্যাথে একদম কাঁচা আমি।
মন খারাপ করে বলে শায়লা।
–পারবে না.?
মন খারাপ করে বলে মিতা।
মাথা নাড়িয়ে না বোঝায় শায়লা।
–ওকে, আরিয়ান ভাইয়া আসলে আমাকে ডাক দিও।
–ওকে।
কথা বলেই নিজের রুমের দিকে আগাতে থাকে মিতা। সিড়ি বেয়ে উপরে উঠে নিজের রুমের দিকে আগাতেই চোখ যায় এক কর্ণারের শেষের রুমের আলো জ্বলতে দেখে। রুমটা অরিয়নের। “একবার কি গিয়ে দেখবো?” মনে মনে ভাবে মিতা। আগে অনেক বারই মিতাকে পড়ালেখায় হেল্প করেছে অরিয়ন।
ধীরে ধীরে হাটতে হাটতে রুমের দরজার সামনে এসে দাঁড়ায় মিতা। নক করতে গিয়েও যেন সাহস পাচ্ছে না মিতা। ” থাক লাগবে না” কথাটা ভেবে চলে যেতেই হাতে থাকা উচ্চতর গণিত বইয়ের দিকে চোখ যেতেই আবারও দাঁড়িয়ে পড়ে মিতা।
“আই হেট ইউ কবির স্যার” রাগ হয়ে মিনমিন করে বলে মিতা।
ভয় ভুলে দরজায় নক করে মিতা। কোনো উত্তর আসে না। আবারও নক করে মিতা। এবার ও কোনো উত্তর আসে না। তৃতীয়বার নক করেও কোনো উত্তর না পেয়ে চলে যেতে নেয় মিতা।
–কাম ইন।
ভেতর থেকে উত্তর আসে।
অরিয়নের কথা শুনে আস্তে আস্তে দরজা খুলে ভিতরে ঢুকে মিতা। সামনেই দাঁড়িয়ে আছে অরিয়ন। পরণে শুধু ট্রাউজার। দেখে মনে হচ্ছে মাত্র গোসল করে এসেছে। তোয়ালে দিয়ে নিজের চুল মুছতে ব্যস্ত অরিয়ন মিতাকে এখনো খেয়াল করেনি। নিজের জায়গায় চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকলো মিতা। অপেক্ষা করছে অরিয়নের ঘুরে তাকানোর।
অরিয়ন ঘুরে তাকাতেই মিতাকে দেখে কিছুটা অবাক হয়। এতো রাতে কি করতে এসেছে বুঝতে পারছে না অরিয়ন। সামনে দাঁড়িয়ে থাকা মিতার চুল খোপা করা, খোপার এক পাশে কলম গুজা। পরণে পাজামা স্যুট।
–কি হয়েছে? এতো রাতে এখানে কেনো এসেছিস?
আলমারি থেকে নিজের টি শার্ট বের করে পরতে পরতে বলে অরিয়ন।
–কাল উচ্চতর গণিত পরীক্ষা।
ধীরে ধীরে বলে মিতা।
–তো?স্যার কিছু করিয়ে দেয় নি?
বিছানার উপর বসে জিজ্ঞেস করে অরিয়ন।
–করিয়েছিল কিন্তু কলেজের স্যার নতুন অধ্যায় দিয়েছে আমি পারিনা সেটা।
মাথা নিচু করে বলে মিতা।
–আরিয়ানের কাছে যা।
কথাটা বলে নিজের ল্যাপটপ নিয়ে বসে অরিয়ন।
–আরিয়ান ভাইয়া বাসায় আসেনি এখনো।
জবাব দেয় মিতা।
–তাহলে আসলে করিস, এখন যা। আমি হেল্প করতে পারবো না ।
মিতার দিকে তাকিয়ে বলে অরিয়ন।
অরিয়নের কথা শুনে মন খারাপ হয়ে যায় মিতার। “এতো আদর করতে কি শুধু আফরিন আপুর জন্যই? আপু নেই তাই কি আমার প্রতি আদর ও নেই?” মনে মনে ভাবে মিতা। অরিয়নের এরকম ব্যবহার কেনো যেন খুব কষ্ট দেয় মিতাকে। মন খারাপ করে বেড়িয়ে যেতে নেয় মিতা।
–পরী?
পেছন থেকে অরিয়নের কথা শুনেই মুখে হাসি ফুটে উঠে মিতার।
পরী, পরী বলে মিতাকে আর কেউ ডাকে না। অরিয়ন কেনো পরী ডাকে তাও মিতা জানেনা। শুধু জানে অরিয়নের মুখ থেকে প্রতিবার পরী ডাকটা শুনলেই মন ভালো হয়ে যায় মিতার।
–জি অনিয়ন ভাইয়া।
খুশি হয়ে বলে মিতা।
–যাবার সময় দরজা লক করে যাস।
ল্যাপটপের দিকে তাকিয়ে থেকেই বলে অরিয়ন।
অরিয়নের কথা শুনতেই যেন মুখ থেকে হাসিটা নাই হয়ে গেলো মিতার। হয়তো অরিয়ন আবার আগের মতো হয়ে গেছে ভেবেছিলো মিতা।
পারমিতা পর্ব ৬
“আচ্ছা প্রথম ভালোবাসা কি এমনই? প্রথম ভালোবাসা কি মানুষকে সত্যিই পরিবর্তন করে দেয়?প্রথম ভালোবাসা কি সত্যিই ভুলা যায় না? অরিয়ন ভাইয়া কি আর আগের মতো হবে না?” কথাগুলো ভাবতেই চোখের কোণে পানি চলে আসে মিতার। দরজা লক করে রুম থেকে বেড়িয়ে আসে মিতা।
অরিয়ন হারিয়েছে আফরিনকে।
আর মিতা?
মিতা হারিয়েছে তার আইডল আফরিনকে,
তার বেস্টফ্রেন্ড অনিয়ন ভাইয়াকে।