রাজবধূ পর্ব ১৩
রেহানা পুতুল
পুরুষটি কিয়ৎক্ষণ নূরীর মুখপানে চেয়ে রইলো অচেনা দৃষ্টিতে। পরক্ষনেই ফের অগ্নিঝরা চাহনি ফেলে পলকহীনভাবে চাইলো। তার চোখদুটো ইট ভাটার মতো দাউদাউ করে জ্বলছে। কারণ সে এবার নূরীকে চিনতে পেরেছে।
কিন্তু নূরী তাকে চিনতে পারেনি। এবং তার রুদ্রমূর্তি স্পষ্টভাবে দেখতে পেলেও কারণটা বুঝে উঠতে পারেনি সে। তবুও বিনয়ী গলায় সালাম দিলো নূরী তাকে।
“আসসালামু আলাইকুম। ”
“ওয়ালাইকুম আসসালাম। কে তুমি?”
কঠিন গলায় জিজ্ঞেস করলো পুরুষটি।
“আমি এই ঘরের নতুন বেয়াইন মধুপুর গ্রামের। রাজের শাশুড়ী। আপনে কে?”
পুরুষটি ধারালো চাহনি নিক্ষেপ করলো নূরীর মুখপানে। তার চোয়াল ঝুলে পড়লো। সে শতভাগ নিশ্চিত হওয়ার জন্য নিষ্ঠুর গলায় জিজ্ঞেস করলো,
“তুমি মধুপুর গ্রামের মন্ডল বাড়ির মৃত মকবুলের বউ না?”
“জ্বি।”
নমনীয় স্বরে জবাব দিলো নূরী।
“ঘরের সবাইর সঙ্গে তোমার দেখা হইছে?”
“না। আমি মাত্রই আইলাম আমার মেয়েরে নিতে। আপনে কে? ”
“সবার সঙ্গে দেখা কইরা আসো। পরে বলতাছি আমি কে?”
পুরুষটি চলে গেলো। নূরী দাঁড়িয়ে রইলো একইস্থানে। মহাচিন্তায় পড়ে গেলো সে। মনে মনে আওড়ালো,
কে এই ব্যাটা? কথার সাইজ ত সুবিধার না। কাহিনীটা কি? দেখা কইরা জানতে হইবো।
নূরী হেঁটে হেঁটে সবার সঙ্গে দেখা করতে গেলো। যাকে যেখানে দেখলো সে, নমনীয় গলায় মিষ্টি হেসে কথা বলতে চাইলো। কিন্তু কেউই তারসঙ্গে কোন কথা বলল না। নতুন অতিথি। প্রথম এই বাড়িতে আসলো। সেই সুবাদে নূন্যতম আতিথেয়তাও নূরীর কপালে জুটল না। সবাই মুখ ফিরিয়ে নিলো উপেক্ষার সহিত। সে মতির মায়ের সঙ্গে রান্নাঘরে গিয়ে বসে কিছুক্ষণ গল্প করলো। শিখা মতির মায়ের প্রশংসা করেছে নূরীর কাছে। নূরীরও বেশ ভালো লাগলো মতির মাকে। নূরী মতির মাকে বলল,
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
“বাড়িতো অনেক বড়। আমি চারপাশ ঘুইরা দেখলে সমস্যা আছে? ”
মতির মা হেসে ফেলল। বলল,
“কি যে কন না আপা। কিয়ের সমস্যা। এরা কি বাঘ ভাল্লুক নাকি। যে আপনেরে খাই ফালাইবো। শুধু ভাবসাব দেখায়া চলে। তালুকদার ঘরের পুত্রবধূ আপনার মাইয়া। সেই হিসাবে আপনারো এহন এই বাড়ির সকল কিছুতে অধিকার আছে। তবে এখন তো রইদ ভরা। গা তাইতা উঠে। দুপুরে খাওনের পর বেলা পড়লে সব দেইখেন ঘুইরা ফিরা।”
“ঠিক কইছেন। তাইলে পরেই বাইর হমু। বেয়ানরে দেখতেছিনা। কই উনি?”
“উনার শয়ন ঘরেই। সোজা গিয়া কোনার রুমটা ভাবির। যান।”
সুফিয়া বিবি নিজের রুমে বসে আছে। হাতে একজোড়া তসবী। দোয়া দরুদ পড়ছে মৃত ভাইয়ের নামে। আদুরী গিয়ে তাকে বলল,
“আম্মা দেখছো তোমার নতুন বেয়াইন এসেছে। স্বাগতম জানাবানা?”
“হ জানামু। কই অহন ফইন্নিটা?”
“পাকঘরে মতির মা চাচির সঙ্গে গল্প জুড়ায়া দিছে। যার সঙ্গে যার মানায়।”
“হাচা কইছত। ফকিরে ফকিরে দোস্তফিরি। রুচি হয়না বাইর হইতে। এর লাইগা বইসা আছি।”
“আম্মা একটা কথা।”
“কইয়া ফালা।”
“এই ঘরে কি কোন নিয়ম পরিবর্তন করা যাবে না কোনদিন?”
“তোর কথা আমি বুঝছি। গিলা ফালা। তালুকদার পরিবারে লা*শ পড়বো। তবুও নিয়ম বদলানো যাইবা।”
আদুরী বিষন্ন মনে চলে যায় নিজের রুমে। ভেবে পায়না কি করবে শোয়েবকে নিয়ে।
নূরী রান্নাঘর হতে বেরিয়ে আসে। সুফিয়া বিবির রুমে গিয়ে সালাম দিলো। সুফিয়া বিবি আপন কাজে মগ্ন থেকেই সালামের উত্তর নিলো। নূরীকে বসতে বলার সৌজন্যবোধটুকুও দেখাল না। নূরী নিজ থেকেই সুফিয়ার পালংকের এককোণে বসলো। সুফিয়া বিবির দুচোখ ভর্তি অবজ্ঞা ও তুচ্ছতার ঢেউ। কিন্তু মুখে কিছু বলল না।
নূরী বলল,
” আপা শিখাকে বিকালেই নিয়া যাইতে চাই। ওর স্কুলে যাইতে হইবো। সামনে ম্যাট্রিক পরিক্ষা। কি কন আপনে? ”
প্রতুৎত্তরে সুফিয়া বিবি কাঠ কাঠ গলায় দশ কথা শুনিয়ে ছাড়লো নূরীকে।
“বৈকাল ক্যান? পারলে এখনই নিয়া যান। জজ, ব্যারিস্টার বানান মাইয়ারে। আপনার মাইয়া একটা কুফা! অলক্ষী! আইছে আমগোরে ধ্বংস কইরতে। আপনেও লোভে পইড়া গ্যাছেন। অবশ্য আপনের কি দোষ। ছোড়লোকের নজর থাকেই বড়লোকের সব আত্মসাৎ করা।”
নূরী বেজায় মনঃক্ষুণ্ন হলো। বুকটা ভেঙ্গে গেলো তার। ছেরু মিয়া কি করলো এইটা। এই কোন দোযখখানায় পাঠাইলো তার শিখারে। বড়লোকের ঠাটবাট থাকবে কমবেশি এইটা মাইনা নেওন যায়। কিন্তু এরাতো সবাই বিরাট অহংকারি ও খারাপ মানুষ। নূরী মেঘমুখে বলল,
” লোভে পড়ছি এইটা ভুল কইছেন আপনে। থাউক। তর্কে করনের জন্য কুটুম বাড়ি আসিনাই আমি। অপয়া,অলক্ষী ক্যান কইলেন আমার মেয়েরে?”
“এই বাড়িতে আইসা আমার সুস্থ সবল জোয়ান ভাই মইরা গ্যালো। আপনার মাইয়ার লাইগা রাজ আমার ভাইগনার গায়ে হাত তুলল। এই কয়দিনেই এসব। আর বাকিজনমে যে কি হইবো আল্লাহ মালুম।”
চনচন সুরে বলল সুফিয়া।
“জন্ম,মৃত্যু,বিয়া আল্লার হাতে। এতে কাউরে দোষী ভাবা অন্যায়। আর আপনার ভাইগনা হয়তো কোন বেয়াদবি করছে। তাই তার গায়ে হাত তুলছে। প্রথম দিন আইসাই আজ টের পাইলাম আমার মেয়ের ভালো থাকা কোনদিন হইব না এই ঘরে। আমি আমার মেয়েরে নিয়া বিকালেই চইলা যামু।”
সুফিয়া নিরুত্তর। বিরক্তিকর মনে তসবীহ জপে যাচ্ছে। নূরী উঠে চলে গেলো মেয়ের রুমে। দরজা চাপিয়ে বিছানায় শুয়ে পড়লো। শিখাকে সবার আচার আচরণ সম্পর্কে অবহিত করলো। শিখা লজ্জিত হলো নিজেই নিজের কাছে। এখন পর্যন্ত এরা তার মাকে সামান্য নাস্তা পানি খেতে দিল না। সে চাইলেও মাকে কিছু দিতে পারছে না। কেননা সে জানেনা এদের কোথায় কোন খাবার আছে। তাকে সময়মতো খাবার এনে দেয়। সে নিজেও অতিরিক্ত কিছু খেতে চাইলে পায়না। কি অমানবিক, কঠিন মানুষ এরা। নাকি সবার সঙ্গে ভালো এরা। কেবল শিখার পরিবারের সঙ্গেই শক্ত আচরণ করছে। এতটা অপমান মানা যায়না।
শিখা ঠোঁট বাঁকিয়ে মাকে বলল,
“এইজন্যই কইলাম যাইওনা। কেউই তোমারে পাত্তা দিবনা। আমি ঘরের বউ হইয়া মূল্য পাইনা। অচল পয়সার মতন সবাই ছুঁড়ে মারে যেন।”
নূরী শুরুতে দেখা সেই পুরুষটির কথাও বলল মেয়েকে। শিখা ভাবুকের মতো করে বলল,
“তোমার বর্ণনামতে উনি আমার ছোট চাচাশ্বশুর। খায়রুল তালুকদার। অনেকে ছোট তালুকদারও বলে উনাকে। উনাদের দুই ভাইয়ের ব্যবহারতো ভালই। এই ঘরে বেশী নারীরাই খারাপ। তুমি বেয়াইন লাগো তাই হয়তো মজা করছে সিরিয়াস মুডে। দেখনা এখন নাই। চলো হেগো সাইড়ে যাই৷ এ সময় পুরুষ থাকেনা। ছোট চাচী মানুষ ভালো।
নূরীকে নিয়ে শিখা আমেনার রুমে গেলো। আমেনা ও তার মা হারিছা খাতুন বসে বসে পান চিবোচ্ছে। আমেনা সৌজন্যমূলক আচরণ করলো নূরীর সঙ্গে। কৌতুক করে বলল,
” আসেন আপা। উঁকিঝুঁকি দিতে হইব না। কোন পুরুষ নাই ঘরে। বসেন। আমাদের বেয়াইন ত দেখি মাশাল্লাহ। দুই বেয়াই আমগোরে রাইখা আপনেরে নিয়া কাড়াকাড়ি শুরু করবো।”
“আমি সিংগেল আছি। কাড়াকাড়ি করলে আমি কোলে বইসা যাইমু বেয়াইগো। নাকি কন খালাম্মা?”
মুচকি হেসে হারিছা খাতুনের দিকে চেয়ে বলল নূরী। শিখা মিটমিটিয়ে হাসছে তাদের রসিকতা দেখে। হারিছা খাতুন বলল,
” এউ বেডির বয়সতো কম। পরথম মাইয়ার মা হইলে অল্প বয়সেই শাশুড়ী, বেয়াইন হইয়া যাইতে হয়।”
নূরী আমেনাকে জিজ্ঞেস করলো,
” আপনার কয় ছেলেমেয়ে আপা?”
আমেনার অভিব্যক্তিতে হাহাকারের ঢল। তবুও দীর্ঘশ্বাস গোপন করে বলল,
“আমার এক ছেলে। সদরে বড় ব্যবসা আছে তার। এখন ঘরে নাই। সকালে যায় রাইতে আসে। এজন্যই আমার মায়েরে আমার কাছেই রাখি। আপনার ভাই হেগো তালুকদারি,মামলা,মোকদ্দমা নিয়াই পইড়া থাকে। ”
“আর পোলাপাইন হইলো না ক্যান?”
আমেনা আবারো ব্যথিত কন্ঠে বলল,
“ওপরওয়ালা দেয়নাই। হয়তো কোন কারণে বেজার হইছে আমাগো উপরে। তাই।”
দুপুরে সবাই খেতে বসলো ডাইনিং টেবিলে। নিত্যদিনের মতো শিখাকে তার রুমে খাবার দিয়ে আসলো। সঙ্গে তার মা নূরীকেও। তারা মা মেয়ে খেয়ে উঠলো। শিখা মতির মায়ের থেকে এক খিলি পান চেয়ে এনে দিলো তার মাকে। তার মা কিছুক্ষন জিরিয়ে নিলো। তারপর বলল,
“তুই সব গোছগাছ কইরা নে। শাড়ি নিয়া নিস। তাইলে কোন বিয়াসাদিতে পরতে পারবি। বই খাতা যেন না থাইকা যায়। আমি এগো বাড়ির আনাচ কানাচ ঘুইরা দেইখা আসি। আর কবে আসা হয় না হয়, তার কোন ঠিক ঠিকানা আছে। যা দেখলাম,বুঝলাম। ”
“হ আম্মা। ঠিকই কইছো। আমি ব্রিফকেস গোছায়া নিতাছি। তুমি ঘুইরা আসো।”
নূরী আস্তেধীরে তালুকদার বাড়ির চারপাশ দেখতে লাগলো। হাঁটতে হাঁটতে চলে গেলো পুকুর পাড়ের শেষ মাথায়। যেখানে ভর করে আছে একরাশ নির্জনতা। নূরী ফলের গাছগুলো দেখতে লাগলো মাথা উঁচিয়ে। আচম্বিতে সে ভড়কে যায় কোন পুরুষালী কন্ঠে গলা হাঁকানো কাশির শব্দে। নূরী চোখ নামিয়ে দেখলো সকালে দেখা সেই মাঝবয়েসী পাঞ্জাবি পরা পুরুষটি।
” আপনে এইখানে ? তখন খুঁজলাম আপনেরে। পাইলাম না।”
সহজ গলায় বলল নূরী।
“আমি ধরা দেইনি তাই পাওনি। আমি এই সময়ের অপেক্ষায় ছিলাম। তোমার দিগে খেয়াল রাইখতে গিয়া আমার বহুত কামের লোকসান হইলো আইজ।”
ক্ষুব্ধ কন্ঠে বলল লোকটি।
“ওমা! কি আজগুবি কথা। কে কইছে আপনারে আমারে পাহারা দিতে? কে আপনে?পরিচয় দেন কইলাম।”
কঠিন গলায় বলল নূরী।
পুরুষটি দুই পা এগিয়ে নূরীর শরীর ঘেঁষে দাঁড়ালো। খপ করে নূরীর হাত ধরে ফেলে। নূরীর চিবুক চিবিয়ে ধরে ককর্শ কন্ঠে বলে উঠলো,
“একটা ধর্ষিতার মাইয়া তালুকদার পরিবারের বউ হইবার যোগ্যতা রাখে না। তোর মেয়েরে তালাক দিয়া দিতে কইবি রাজকে। নইলে… ”
নিমিষেই নূরী দপ করে জ্বলে উঠলো পজ্বলিত শিখার ন্যায়। থরথর করে কাঁপতে লাগলো। পুরুষটির পাঞ্জাবীর কলার চেপে ধরে দাঁত মুখ খিঁচিয়ে বলল,
“কিইইহ! এতবড় অপবাদ! এতবড় কলংক! আমার গায়ে দিলেন? এই জীবনে কেউ আমার চরিত্রে কালি লেপন কইরা কথা কইতে পারেনাই। আর আপনে কইতাছেন এতবড় বেইজ্জতির কথা। কে আপনে ?কন কইলাম?”
“আমি তোগো মা মাইয়ার যম! মিছা কিছুই কইনাই আমি। মনে করে দেখ নূরী!”
রাজবধূ পর্ব ১২
পুরুষটি লম্বা লম্বা পা ফেলে চলে যায় বাগানের ভিতর দিয়ে। নূরী মাথায় হাত দিয়ে মাটিতে ঘাসের উপর বসে পড়লো। ফিরে গেলো তার দুঃসহ অতীতে। তবুও একটা হিসেব কিছুতেই নূরী মেলাতে পারছে না। নূরী চট করে উঠে দাঁড়ালো। প্রায় দৌড়ে গিয়ে সেই পুরুষটির পাঞ্জাবী টেনে ধরলো। পুরুষটিও নূরীর গলা টিপে ধরলো।
এতক্ষন পুরো ঘটনাটি বাগানের শেষ মাথায় দাঁড়িয়ে অবলোকন করে যাচ্ছে আরেকজন মানুষ। সে প্রকাণ্ড এক বৃক্ষের আড়ালে লুকিয়ে আছে এখনো। তার চোখ দুটি ভীতসন্ত্রস্ত! তবুও নূরীকে বাঁচানোর জন্য সে ছুট দিলো বাগানের দিকে।